বিশ দিন পর শুভ্রর ঘরে মনজুর ডাক পড়ল। সকাল আটটা মাত্ৰ বাজে। মনজু নাশতা শেষ করে চা খেতে বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে বসেছে। কড়া করে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিনের প্রথম সিগারেট ধরিয়েছে। এমন সময় রহমতউল্লাহ ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ছোট সাহেব ডাকেন।
মনজু হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠিক আছে।
রহমতউল্লাহ বললেন, ঠিক আছে মানে? তাড়াতাড়ি যাও।
মনজু বলল, চা-টা খেয়ে যাই।
রহমতউল্লাহ বিস্মিত গলায় বললেন, তোমার ডাক পড়েছে, তুমি এক্ষণ ছুটে যাবে। আয়েশ করে চা খাওয়া আবার কী?
মনজুরহমতউল্লাহরতউল্লাহর ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে মোটামুটি আয়েশ করেই চায়ে চুমুক দিল।
রহমতউল্লাহ বললেন, ব্যাপারটা কী তোমার? তুমি কি এইখানে চাকরি করতে চাও না? মাঝখানে এক রাত কোথায় কাটায়ে এসেছ। তোমার ভাগ্য ভালো, আমি রিপোর্ট করি নাই। এখন আবার নবাবী চালে চা খাচ্ছ।
মনজু বলল, আমি ঠিক করেছি। ছাতার চাকরি করব না।
চাকরি করবে না?
না। চাকরের চাকরি আমার পোষাবে না।
ছোটসাহেবের সঙ্গে দেখা করবে না?
দেখা করলেও করতে পারি। চাচাজি, আপনি চা খাবেন? এরা চা ভালো বানায়। খান এক কাপ। পয়সা আমি দেব।
রহমতউল্লাহ রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলেন। মনজু প্ৰথম কাপ চা শেষ করে দ্বিতীয় কাপ নিল। আরেকটা সিগারেট ধরাল। দিনের প্রথম চায়ের সঙ্গে পর পর দুটা সিগারেট খেতে হয়। মামা-ভাগ্নে সিগারেট।
রহমতউল্লাহ বললেন, মনজু, তুমি চাকরি কর বা না কর ছোটসাহেব ডেকেছেন দেখা করে আস।
মনজু বলল, যাচ্ছি। সিগারেট শেষ করেই যাচ্ছি। আপনি এত অস্থির হবেন না। অস্থির হবার কিছু নাই।
রহমতউল্লাহ বললেন, তোমার সমস্যাটা কী?
মনজু বলল, আমার কোনোই সমস্যা নাই। সমস্যা আপনার। খাবেন এক কাপ চা? দিতে বলব?
শুভ্র কালো রঙের প্যান্টের সঙ্গে ধবধবে সাদা সার্ট পরেছে। তাকে দেখাচ্ছে শ্বেতপাথরের মূর্তির মতো। শ্বেতপাথরের মূর্তির চুল বাতাসে উড়ে না। সে ফ্যানের নিচে বসে আছে বলে তার মাথার চুল উড়ছে। শুভ্র মনজুকে দেখেই হাসি মুখে বলল, Hello young man and the tree.
মনজু কিছু বলল না। সে অদ্ভুত রূপবান যুবকের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। হুট করে তার মাথায় অদ্ভুত একটা চিন্তা চলে এলো। ইস, সে যদি রুনুকে শুভ্ৰ ভাইজানের সামনে দাঁড়া করাতে পারত! রুনু কী বলত তাকে দেখে?
শুভ্র বলল, বুড়োমানুষ দেখলেই আমার মাথায় সমুদ্রের ইমেজ চলে আসে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে Old man and the sea উপন্যাসটি লিখে এই কাণ্ডটা করেছেন। তার উপন্যাসটা পড়ার পর পরই আমার ইচ্ছা করল। আমি একটা উপন্যাস লিখি যার নাম Young man and the tree, শেষপর্যন্ত অবশ্যি লেখা হয় নি। তুমি হেমিংওয়ের বই পড়েছ?
জি-না।
উনার নাম শুনেছে?
জি-না। ভাইজান, আমি ইংরেজি তেমন জানি না।
তাতে অসুবিধা নেই, হেমিংওয়ের বইয়ের বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়।
ভাইজান, আমার বই পড়তে ভালো লাগে না।
ভালো বই কখনো পড় নি বলে ভালো লাগে না। ভালো বই পড়ে দেখতে হবে। মানুষ খুবই উন্নত প্রাণী। ভালো জিনিস যাতে তার ভালো লাগে প্রকৃতি সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে।
সব মানুষ একরকম না। কেউ আপনার মতো, আবার কেউ আমার মতো।
শুভ্র বলল, আচ্ছা থাক, পরে এই নিয়ে কথা বলব। তুমি কেমন আছ?
ভাইজান, আমি ভালো আছি।
কফি খাবে? এক্সপ্রেসো কফি— প্রচুর ফেনা। অতিরিক্ত মিষ্টি।
বিস্মিত মনজু বলল, জ্বি ভাইজান খাব।
শুভ্র বলল, তুমি চেয়ারটায় বসো। তাকিয়ে দেখ আমি কীভাবে কফি বানাই।
মনজু বলল, ভাইজান এর মধ্যেও কি কোনো ম্যাজিক আছে?
শুভ্র বলল, পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যেই ম্যাজিক আছে। এই যে তুমি চেয়ারটায় বসেছ এর মধ্যেও আছে। ম্যাজিক অব গ্রাভিটেশন। মধ্যাকর্ষণের ম্যাজিক। মধ্যাকর্ষণ কে বের করেছিলেন জানো?
জি-না।
স্যার আইজ্যাক নিউটন। পদার্থবিদ্যার সুপার জায়েন্ট। কী পরিমাণ মেধা যে এই মানুষটা নিয়ে এসেছিল…
শুভ্ৰ কথা বলতে বলতে এক্সপ্রেসো মেশিনে কফি বানাচ্ছে। তার দুটি চোখ বন্ধ। মনজু অবাক হয়ে ভাবছে- এইটাই কি ম্যাজিক? চোখ বন্ধ করে কফি বানানো? চোখ বন্ধ করে কফি বানাতে এই মানুষটার কোনোরকম অসুবিধা হচ্ছে না। দু। মগ ভর্তি কফি নিয়ে চোখ বন্ধ করেই সে ফিরে আসছে। মনজুর দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে শুভ্ৰ চোখ খুলল।
হালকা গলায় বলল, কফি বানানোর ম্যাজিক কেমন দেখলে? অন্ধ হয়ে যাবার পর আমার যেন কোনো অসুবিধা না হয়- তার ব্যবস্থা।
মনজু অবাক হয়ে বলল, অন্ধ হবেন কেন ভাইজান?
শুভ্ৰ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমার অপটিক নাৰ্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। যে-কোনো একদিন দরবারের সব আলো নিভে যাবে।
মনজু অবাক হয়ে বলল, ভাইজান, এইসব কী বলেন?
শুভ্র সহজ ভঙ্গিতে বলল, এখন যে আমি দেখতে পারছি, this is important. চল যাই। আজ সারাদিন ঘুরব।
মনজু বলল, কোথায় যাবেন ভাইজান?
শুভ্র বলল, আমি ঠিক করেছি এখন প্রতিদিন তোমাকে নিয়ে বের হব। সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখব। মেমোরি সেলে জমা করে রাখব। অন্ধ হয়ে যাবার পর যেন স্মৃতি থেকে দেখতে পারি। স্মৃতির জাবর। তুমিই বলে কোথায় যাওয়া যায়?
ভাইজান, বুড়িগঙ্গায় যাবেন?
যাওয়া যায়। বুড়িগঙ্গার মাঝখানে নৌকা ড়ুবিয়ে ঘসেটি বেগমকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঠিক কোনখানে নৌকাড়ুবি হয়েছিল সেই জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারলে ভালো হতো।
ঘসেটি বেগম কে?
নবাব সিরাজদ্দৌলার খালা। সিরাজদ্দৌলাকে চেন তো?
জি চিনি। উনার ছবিও দেখেছি। আনোয়ার হোসেন সাহেব অভিনয় করেছিলেন। ভাইজান, ছবিটা আপনি দেখেছিলেন? খুবই মারাত্মক।
না, আমি ছবিটা দেখি নি। অনেক কিছু তুমি জানো যা আমি জানি না, আবার অনেক কিছু আমি জানি যা তুমি জানো না। তাহলে কী ঠিক করা হলো? আমরা বুড়িগঙ্গায় যাচ্ছি।
আপনে যেখানে বলবেন সেখানে যাব।
বুড়িগঙ্গাই ভালো। মনজু, নদীটার নাম বুড়িগঙ্গা কেন হলো? যুবতীগঙ্গা কেন হলো না?
জানি না ভাইজান। আমার বুদ্ধি খুবই কম।
কে বলেছে তোমার বুদ্ধি কম?
আমার দূরসম্পর্কের একজন বোন আছে, রুনু নাম। এইবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিবে। সে বলেছে।
তার কি খুব বুদ্ধি?
জি।
কীভাবে বুঝলে তার খুব বুদ্ধি?
মনজু আগ্রহ নিয়ে বলল, কেউ মিথ্যা কথা বললে সে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে। আমি যতবার তার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি, ততবারই ধরে ফেলেছে।
মেয়েটার নাম রুনু, তাই না?
জি ভাইজান।
মেয়েটাকে একবার আমার কাছে নিয়ে এসো। বুদ্ধি পরীক্ষা করার কিছু টেস্ট আছে। আমি পরীক্ষা করে বলে দেব তার আইকিউ কত।
জি ভাইজান, আমি নিয়ে আসব।
গাড়িতে উঠেই শুভ্র বলল, ড্রাইভার সাহেব, আপনার সঙ্গে যে মোবাইল টেলিফোন আছে সেটা বন্ধ করে দিন। মা একটু পর পর খোঁজ করবে। আমি কোথায় আছি কী করছি- আমি সেটা চাচ্ছি না।
ড্রাইভার বলল, মোবাইল অফ করলে ম্যাডাম খুব রাগ করবেন। শু
ভ্র বলল, রাগ সামলানোর ব্যবস্থা করা যাবে। মোবাইল বন্ধ থাকুক।
ড্রাইভার অপ্ৰসন্ন মুখে মোবাইল অফ করল। শুভ্র ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, ড্রাইভার সাহেব, মুখ ভোঁতা করে রাখবেন না। মুখ ভোঁতা করার মতো কিছু হয় নি।
ড্রাইভার শুকনা গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা।
শুভ্র মনজুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বোনকে আমাদের সঙ্গে উঠিয়ে নিলে কেমন হয়? সুন্দর সুন্দর দৃশ্য একা বা দোকা দেখা যায় না। তিনজন লাগে। Three is company.
মনজু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভাইজান এইসব কী বলছে?
শুভ্র বলল, রুনু কি আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হবে? তোমার কথায় রাজি না হলে আমি অনুরোধ করে দেখতে পারি। রুনু থাকে কোথায়?
মনজু বিড়বিড় করে বলল, যাত্রাবাড়িতে।
শুভ্র ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, আগে যাত্রাবাড়িতে চলুন। সেখান থেকে আমরা যাব বুড়িগঙ্গায়।
মোতাহার হোসেনের নির্দেশ আছে- অতি জরুরি কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হলে বাড়ি থেকে কখনো তাকে টেলিফোন করা যাবে না। অফিস এবং বাড়ি হলো তেল ও জল। যখন তিনি তেলে থাকবেন তখন তেলেই থাকতে চান। ঝাকুনি দিয়ে তেল-জল মেশানোর পক্ষে তিনি কখনো না।
জাহানারা যখন টেলিফোনে আতঙ্কিত গলায় জানালেন, শুভ্ৰ সকাল দশটা এগারো মিনিটে মজনু না-কি ফজনু নামের ছেলেটাকে নিয়ে বের হয়েছে তখন মোতাহার হোসেন গম্ভীর গলায় বললেন, এটা কি অতি জরুরি কোনো খবর?
জাহানারা বললেন, অবশ্যই জরুরি। এরপর থেকে ওরা কোথায় আমি ট্রেস করতে পারছি না। ড্রাইভার হারামজাদা মোবাইল অফ করে রেখেছে। ওকে আমি বলে রেখেছি শুভ্রকে নিয়ে যখনই বের হবে মোবাইল খোলা রাখবে।
মোতাহার হোসেন বললেন, আমার ধারণা শুভ্ৰই বন্ধ রাখতে বলেছে।
শুভ্ৰ কেন বন্ধ রাখতে বলবে?
তোমার অশরীরী উপস্থিতি হয়তো তার পছন্দ না। তুমি টেনশান করো না।
আমি টেনশান করব না? ঢাকা শহরে রোজ কয়টা রোড এক্সিডেন্ট হয় তুমি জানো?
না জানি না।
ইররেসপনসিবল একটা ড্রাইভার! ও নিৰ্ঘাৎ কোনো ট্রাকের সঙ্গে গাড়ি লাগিয়ে দেবে। অটোমেটিক গাড়ি, কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হলে দরজা-জানালা লক হয়ে যাবে। দরজা না কেটে শুভ্ৰকে বের করা যাবে না।
কী বলছি। এসব?
জাহানারা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি কাল রাতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি। এই জন্যেই এত টেনশন করছি।
ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন তো তুমি প্রতিরাতেই দেখ।
কাল রাতের মতো ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কম দেখি। কাল রাতে কী স্বপ্ন দেখেছি শোন। স্বপ্ন বলা ঠিক না, তারপরেও বলছি।
মোতাহার হোসেন বললেন, বাসায় এসে শুনব। টেলিফোনে স্বপ্ন শুনে মজা পাওয়া যায় না।
জাহানারা কঠিন গলায় বললেন, আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নের আবার মজা কী! কাল রাতে স্বপ্নে আমি প্ৰকাণ্ড একটা কালো রঙের হাতি দেখেছি।
হাতি কি তোমাকে কিছু করেছে?
না, কিছু করে নি। হাতির গলায় ঘণ্টা বাধা। ঘণ্টা বাজিয়ে হাতি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।
এটা তো তেমন দুঃস্বপ্ন বলে আমার মনে হচ্ছে না।
তুমি এই বিষয়ে কিছু জানো না বলে এরকম বলতে পারলে। সাদা হাতি দেখা ভালো। সাদা হাতি দেখলে ধন লাভ হয়। কালো হাতি দেখার মানে অতি প্রিয়জনের মৃত্যু।
মোতাহার হোসেন হতাশ গলায় বললেন, মৃত্যু ঠেকানোর উপায় কী?
জাহানারা বললেন, আজ সন্ধ্যায় আমি তালতলার পীর সাহেবের কাছে যাব। উনার দোয়া নেব।
বেশ তো যাও।
তুমি উনার কাছে খবর পাঠাও যে আজ আমি যাব। উনি সপ্তাহে দুদিন হুজরাখানায় বসেন। তখন কেউ তাকে ডিসটর্ব করতে পারে না। আজ হলো সেই দুদিনের একদিন। আগে খবর না দেয়া থাকলে উনি হুজরাখানায় বসে পড়বেন।
খবর পাঠাচ্ছি।
দ্বীপ কি কেনা হয়েছে?
দ্বীপ কেনা হয়েছে মানে কী?
জাহানারা হতাশ গলায় বললেন, তোমাকে বললাম না ছোট্ট একটা দ্বীপ কিনে দিতে? আমার কোনো একটা কথাও কি তুমি মন দিয়ে শোন না?
মোতাহার হোসেন বিরক্ত গলায় বললেন, কাঁদছ কেন?
জাহানারা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, কাঁদব না তো কী করব? আনন্দে নাচব? খুব ভালো কথা— নাচব। অফিস ছুটি দিয়ে বাড়িতে চলে এসো, স্ত্রীর নাচ দেখে যাও। চাও দেখতে?
মোতাহার হোসেন টেলিফোন রেখে সুলেমানকে ডেকে পাঠালেন। পৃথিবীর সমস্ত ধনবান ব্যক্তিদের একজন ম্যাজিক পারসন থাকে। যে-কোনো জটিল কাজ এরা করতে পারে। কীভাবে তারা করে সেই বিষয়টি কখনো ব্যাখ্যা করে না।
মোতাহার হোসেনের টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে সুলেমান দাঁড়িয়ে আছে। রোগী লম্বা একজন মানুষ। চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। মাথার চুল এবং গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি সবই পাকা, অথচ বয়স এখনো পঞ্চাশ হয় নি। চেহারা বিশেষত্বহীন। এই চেহারা একবার দেখলে দ্বিতীয়বার আর মনে থাকে না।
কেমন আছ সুলেমান?
স্যার ভালো আছি। আপনার দোয়া।
মোতাহার হোসেন বললেন, দোয়া তো আমি কারো জন্যে করি না।
সুলেমান বলল, এই যে আপনি জিজ্ঞেস করেছেন— কেমন আছ সুলেমান। এতেই দোয়া হয়েছে।
মোতাহার হোসেন বললেন, তালতলার পীর সাহেবের কাছে একটা খবর পাঠাতে হবে। আজ সন্ধ্যায় শুভ্রর মা উনার কাছে যাবেন। উনার দোয়া নেবেন?
জি আচ্ছা।
সুলেমান চলে যাচ্ছে না, দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে জটিল কোনো কাজ তার জন্যে অপেক্ষা করছে। বড় সাহেব জটিল কোনো কাজের আগে একটা অতি সহজ কাজ দেন। একেকজন মানুষের কর্মপদ্ধতি একেক রকম। বড় সাহেব চট করে জটিল কাজে যান না। সুলেমান বলল, স্যার, আর কোনো কাজ আছে?
মোতাহার হোসেন বললেন, আমি বঙ্গোপসাগরে ছোট্ট একটা দ্বীপ কিনতে চাই। এটা কি সম্ভব?
সুলেমান বলল, কেনা সম্ভব না। সরকারি খাস জমি বিক্রি হয় না। তবে নিরানব্বই বছরের জন্যে লীজ নিতে পারেন। লীজ নেওয়া কেনার মতোই।
মোতাহার হোসেন বললেন, নিরানব্বই বছরের জন্যে কেন? একশ বছর না কেন?
সুলেমান বলল, খাস জমি একশ বছরের জন্যে লীজ হয় না। ওদের কী একটা হিসাব আছে আমি জানি না। আপনি যদি জানতে চান আমি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে খোঁজ নিয়ে জানাতে পারি।
জানতে চাচ্ছি না।
সুলেমান বলল, স্যার, আমি কি চলে যাব?
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না। টেবিলে রাখা ফাইলের দিকে চোখ ফেরালেন। এর অর্থ হলো— তোমার সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে, তুমি চলে যেতে পার।
জাহানারা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন। তার মাথা দপদপ করছে। সকিনা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। জলপট্টি বদলে দেয়া ছাড়াও তাকে আরেকটি কাজ করতে হচ্ছে— প্রতি দশ মিনিট পর পর মোবাইল টেলিফোনে শুভ্রর ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। চেষ্টায় কোনো ফল হচ্ছে না। টেলিফোন বন্ধ।
জাহানারার মাথার দপদপানি মাইগ্রেনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। এখন চোখ জুলুনি শুরু হয়েছে। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরুর এটা হলো পূর্বলক্ষণ। যদি সত্যি সত্যি ব্যথা উঠে যায় তাহলে তালতলার হুজুরের কাছে যাওয়া যাবে না। খবর দিয়ে না যাওয়া বিরাট বেয়াদবি হবে। জাহানারা অস্থির বোধ করছেন।
সকিনা বলল, মা, আপনি কি মাথার যন্ত্রণার অন্য একটা চিকিৎসা করবেন?
জাহানারা বললেন, অন্য কী চিকিৎসা?
সকিনা বলল, আমাদের গ্রামে অচিনবৃক্ষ বলে একটা বৃক্ষ আছে। বর্ষাকালে সেই বৃক্ষে ফুল ফুটে। তখন যদি কেউ সেই গাছে হাত রেখে কিছু চায় তাহলে সে সেটা পায়।
জাহানারা বিরক্ত গলায় বললেন, এইসব আজগুবি কথা আমাকে শুনাবে না। গাছের কাছে চাইলেই গাছ দিয়ে দেবে। গাছ কি পীর সাহেব না-কি?
সকিনা বলল, বহুকাল আগে এক সাধু কুমিরের পিঠে চড়ে আমাদের অঞ্চলে এসেছিলেন। উনি নিজের হাতে এই গাছ লাগিয়েছিলেন।
জাহানারা বললেন, তোমাকে না বললাম আজগুবি গল্প বন্ধ করতে। কুমিরের পিঠে চড়ে তাকে আসতে হলো কেন? তখন কি দেশে নৌকা ছিল না?
সকিনা বলল, শুভ্ৰ ভাইজান তো গাছ দেখতে যাবেন– তখন আপনি যদি যান।
জাহানারা বিছানা থেকে উঠে বসতে বসতে বললেন, শুভ্র গাছ দেখতে যাবে মানে কী?
সকিনা বলল, উনি বলেছেন যাবেন। এই বর্ষার মধ্যেই যাবেন।
শুভ্রকে গাছের হাবিজাবি কথা তুমি বলেছ? কখন বলেছ? খাতিরের এত আলাপ করার সময়টা বলো।
সকিনা চুপ করে গেল। জাহানারা বললেন, তুমি তলে তলে অনেকদূর চলে গেছ। সুড়ঙ্গ কেটে যাওয়া। এখন বলো, শুভ্ৰ কি কখনো তোমার ঘরে গিয়েছে?
সকিনা বলল, উনি আমার ঘরে কেন যাবেন?
জাহানারা বললেন, প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়ে দিবে না। ও তোমার ঘরে গিয়েছে, না-কি যায় নি?
জাহানারার চোখ চকচক করছে। ঠোট কালো হয়ে আসছে। সকিনা ভীত গলায় বলল, মা, আপনি খুব ভালো করে জানেন ভাইজান এরকম মানুষ না।
জাহানারা চাপা গলায় বললেন, শোন সকিনা, মাকাল ফলের ভেতর পোকা হয় না। পোকা হয় সবচে ভালো যে ফল তার মধ্যে— আমের মধ্যে। বুঝেছ? শুভ্ৰ মাকাল ফল না।
সকিনা বলল, মা আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার শরীর কাঁপছে।
জাহানারা বললেন, অচিনবৃক্ষের কথা শুভ্রর সঙ্গে কখন হয়েছে সেটা বলে। কখন হয়েছে? কোথায় হয়েছে?
উনার ঘরে। সন্ধ্যাবেলায়।
জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, কথা বলার সময় তুমি কি ইচ্ছা করে শাড়ির আঁচল ফেলে দিয়েছ বুক দেখানোর জন্যে? চুপ করে থাকবে না— বলো। আমার ছেলেকে ভুলানোর জন্যে কী কী কৌশল করেছ সেটা বলো। বুক দেখানো ছাড়া আর কী করেছ?
মা, কেন এরকম করছেন?
চুপ থাক মাগি! মা ডাকবি না। তুই এক্ষুণি এই মুহুর্তে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি।
সকিনা বলল, ঠিক আছে মা— চলে যাব।
চলে যাব বলেও বসে আছিস কেন?
সকিনা উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বের হলো। জাহানারা কাঁদতে শুরু করলেন।
রুনু অবাক হয়ে শুভ্রকে দেখছে। একটি যুবক ছেলের দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকা যায় না। অস্বস্তি লাগে। রুনুর অস্বস্তি লাগছে না। বরং তার মনে হচ্ছে এইভাবে তাকিয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। রুনু বের করার চেষ্টা করছে কেন তার অস্বস্তি লাগছে না। তার ধারণা তার অস্বস্তি লাগছে না। কারণ যার দিকে সে তাকিয়ে আছে তার অস্বস্তি লাগছে না। একজন পাগলের দিকে একদৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা যায়, কারণ পাগল তাতে কিছু মনে করে না। বাচ্চা একটা ছেলের দিকেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায়।
রুনু বসে আছে ইঞ্জিন বসানো ছোট্ট একটা নৌকার পাটাতনে। পাটাতনে শীতলপার্টি বিছানো। শুভ্ৰ পা ছড়িয়ে হাতে ভর দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আধশোয়া হয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির না। সে সব কিছুর উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে হাসিমুখে তাকাচ্ছে রুনুর দিকে। মনজু বসেছে মাঝির কাছে। নৌকায় অল্প অল্প পানি উঠছে। মনজু অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে সেই পানি তুলে নদীতে ফেলছে।
শুভ্র রুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যে পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছ তার জন্যে ধন্যবাদ। এখন বলো— তোমার কি ভালো লাগছে?
রুনু বলল, ভালো লাগছে।
শুভ্ৰ আধশোয়া অবস্থা থেকে বসতে বসতে বলল, কোন জিনিসটা ভালো লাগছে বলো তো। স্পেসিফিক্যালি বলো।
রুনু কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই অদ্ভুত সুন্দর ছেলেমানুষ ধরনের যুবক তার কাছে কী শুনতে চাচ্ছে? সে যা শুনতে চায়। রুনু তাকে তাই বলবে।
শুভ্র বলল, চুপ করে আছ কেন বলো? এখানে ভালো লাগার অনেকগুলি এলিমেন্ট আছে। একটা হচ্ছে নদী, একটা হচ্ছে আকাশ, একটা হচ্ছে নদীর নানান কর্মকাণ্ড…।
রুনু বলল, সবকিছু মিলিয়েই আমার ভালো লাগছে।
শুভ্র বলল, তোমার কি এরকম মনে হচ্ছে যে সবচে ভালো হয় যদি আর বাড়িতে ফিরে না যাওয়া যেত? নৌকা চলছে তো চলছেই। আমরা নৌকার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি।
রুনু সামান্য চমকালো। নৌকায় উঠার পর থেকেই তার এরকম মনে হচ্ছে। শুভ্র বলল, বাড়ি থেকে বের হলে আমার আর বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছা করে না। দশ-এগারো বছর বয়সে আমি একবার বাড়ি থেকে গোপনে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
রুনু ক্ষীণ গলায় বলল, কেন?
শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, মনের দুঃখে। আমার একটা পোষা কাক ছিল। কাকটা রোজ আসত আমার কাছে। হঠাৎ একদিন আসা বন্ধ করল। খুব কষ্ট লাগল। আমি বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম কাকটাকে খুঁজে বের করতে।
পোষা কাক মানে?
কাকটা পোষ মেনেছিল। আমি তার নাম দিয়েছিলাম কিংকর।
কাকটাকে পেয়েছিলেন?
না। আমি সকালবেলা বের হয়েছিলাম, সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজলাম।
কীভাবে খুঁজলেন?
যেখানে কাক দেখতাম দাঁড়িয়ে পড়তাম। আমার ধারণা ছিল আমি কাকটাকে চিনতে না পারলেও সে আমাকে চিনবে। আমাকে দেখলেই উড়ে আসবে আমার কাছে।
আপনি কী করলেন? সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে এলেন?
না। তোমাকে বলেছি না একবার বাড়ি থেকে বের হলে আমার আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না। আমি ফিরলাম তিনদিন পরে। ফিরলাম বলা ঠিক হবে না। পুলিশ তিনদিন পর আমাকে মুন্সিগঞ্জ থেকে উদ্ধার করল। আমাকে উদ্ধারের জন্যে বাবা এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। আমার মা এই তিনদিন পানি ছাড়া কিছু খান নি। ঐ ঘটনার পর আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। প্রাইভেট মাস্টাররা বাড়িতে এসে আমাকে পড়াত।
রুনু বলল, আপনাকে উদ্ধারের জন্য এক লক্ষ টাকা পুরস্কার কে পেয়েছিল?
শুভ্র বলল, আমি জানি না কে পেয়েছিল। আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
আপনাকে জানতে হবে না।
অবশ্যই জানতে হবে। একটা বিষয়ে তোমার কৌতূহল হয়েছে, তুমি সেটা জানবে না?
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। এক পাশে সূর্য এখনো দেখা যাচ্ছে কিন্তু সূর্যে তাপ নেই। মনজু চিন্তিত মুখে আকাশ দেখছে। সে বলল, ভাইজান, এখন ফিরি? বৃষ্টি নামবে।
শুভ্র বলল, নামুক। বৃষ্টি নামলে বৃষ্টিতে ভিজব। রুনু, তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে আপত্তি আছে?
রুনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।
শুভ্র লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। তার দৃষ্টি এখন আকাশে। মেঘের উপর মেঘ জমার দৃশ্যটা যে এত সুন্দর তা সে আগে লক্ষ করে নি। আজ রাতে আত্রলিতাকে এই দৃশ্যের কথা জানাতে হবে। কীভাবে লিখবে এটা গুছিয়ে ফেললে কেমন হয়?
আত্রলিতা! আজ কিছুক্ষণের জন্যে নৌকাভ্রমণ করেছি। আমি নৌকার পাটাতনে শুয়েছিলাম। নৌকা দুলছিল। নৌকার দুলুনির সঙ্গে আশেপাশের সব দৃশ্য দুলছে। শুধু দুলছে না মাথার উপরের ঘন কালো মেঘ। প্রকৃতির একটি অংশ দুলছে, আরেকটি অংশ স্থির। খুবই অদ্ভুত।
রুনুর কেমন জানি লাগছে। এক ধরনের অস্বস্তি, এক ধরনের কষ্ট। মানুষটা এতক্ষণ তার সঙ্গে কত কথা বলছিল, এখন কেমন ঘোরলাগা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে চোখের সামনে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
মানুষটা শুয়ে আছে নৌকার পাটাতনে। শোয়ার ভঙ্গিটাও কী সুন্দর। এত মন দিয়ে দেখার মতো কী আছে আকাশে? রুনুর এখন খুব একটা বাজে ইচ্ছা হচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে মানুষটার পাশে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। সে নিশ্চয়ই খুব খারাপ একটা মেয়ে। এরকম চিন্তা খারাপ মেয়ে ছাড়া কারোর মাথায় আসবে না। সে অবশ্যই খারাপ মেয়ে। ভয়ঙ্কর খারাপ মেয়ে।
রুনুর কান্না পাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে কান্না আটকে রাখতে। কতক্ষণ পারবে কে জানে! মনজু ভাই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে যদি কাঁদতে শুরু করে তাহলে মনজু ভাই কী ভাববেন কে জানে!
শুভ্ৰ হঠাৎ রুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, রুনু, একটা কাজ কর। আমি যেভাবে শুয়ে আছি ঠিক এইভাবে শুয়ে আকাশের দিকে তাকাও। অদ্ভুত একটা ফিলিং হবে। মনে হবে মেঘের সঙ্গে সঙ্গে তুমিও ভাসছ।
রুনু সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। সে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। কিন্তু সে মেঘ দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তার চোখ ভর্তি জল। আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে তার কাঁদতে ভালো লাগছে।
তালতলার পীর সাহেবের নাম কামাল উদ্দিন কাশেমপুরী। পীর সাহেব ছোটখাটো মানুষ। গলার স্বর মধুর। তিনি সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলেন। তাঁর ছোট ভাই জামাল উদ্দিন কাশেমপুরীও পীর ছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল কৰ্কশ। মুরিদানদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারও ছিল খারাপ। এমনও শোনা যায় তিনি কোনো মুরিদানের উপর রাগ করে লাথি মেরেছেন। দুই ভাই দুই তরিকার পীর। একজন গরম পীর, একজন নরম পীর। বছর ছয়েক আগে ছোট ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। তার মুরিদানরা বড় ভাইয়ের কাছে ছুটে এসেছে। বড় ভাই হাসিমুখে বলেছেন, বাবারা, তোমরা আমার কাছে এসো না। আমার ভাইয়ের পথ আর আমার পথ এক না। এক পুকুরেই আমরা অজু করি। কিন্তু আমাদের ঘাট ভিন্ন।
জাহানারা পীর সাহেবের সামনে ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। পীর সাহেব বললেন, মাগো, বাম হাতটা একটু বাড়ান।
জাহানারা হাত বাড়ালেন। পীর সাহেব জাহানারার হাতে আন্তর মাখিয়ে দিলেন। জাহানারা বললেন, বাবা আমার জন্যে দোয়া করবেন, আমি খুবই কষ্টে আছি।
পীর সাহেব বললেন, কেউ যখন আমাকে বলে আমি কষ্টে আছি তখন বড় আনন্দ হয় গো মা। কারণ আল্লাহপাক তার পিয়ারাবান্দাদের কষ্টে রাখেন। তিনি যাদের উপর নাখোশ তারাই ইহকালে সুখে থাকে। আপনার মাথাব্যথা রোগের কি কিছু আরাম হয়েছে?
জি-না।
চোখে সুরমা দিবেন। সুরমা দিয়ে জায়নামাজে বসে বলবেন– হে আল্লাহপাক, তুমি আমাকে রোগ দিয়েছ। এই রোগ নিয়াও আমি সবুর করলাম। এই রোগই আমার বান্ধব। খাস দিলে এটা বলতে পারলে আল্লাহপাক রোগ তুলে নিবেন।
জাহানারা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি খাস দিলে কিছুই বলতে পারি না বাবা। আমার মন সবসময় অস্থির থাকে। ছেলে সকালবেলা বের হয়েছে, এখনো ফিরে নাই। কোথায় গিয়েছে কিছুই জানি না। ড্রাইভার বদমাশটা মোবাইল টেলিফোন বন্ধ করে রেখেছে।
পীর সাহেব কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখলেন। তারপর চোখ মেলে বললেন, ছেলে বাড়িতে ফিরেছে গো মা। টেলিফোন করে দেখেন। আর যদি নাও ফিরে–কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরবে। ধ্যানে পেয়েছি।
জাহানার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করলেন। টেলিফোন ধরল। সকিনা। সে জানাল, শুভ্ৰ ভাইজান কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। তার সারা শরীর ভেজা। চোখ লাল। মনে হয় জ্বর এসেছে।
জাহানারা বললেন, ডাক্তার খবর দিয়েছ?
সকিনা বলল, দিয়েছি মা।
জাহানারা বললেন, ওর জ্বর কত থার্মোমিটার দিয়ে এক্ষুণি আমাকে জানাও। আমার ফিরতে দেরি হবে, আমি পীর সাহেবের কাছে আছি।
জি আচ্ছা।
তোমাকে তো আমি চলে যেতে বলেছিলাম, তুমি চলে যাও নি কেন?
কাল সকালে যাব। মা।
অবশ্যই সকালে বিদায় হবে। আমি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে যেন তোমাকে দেখতে না পাই।… আমি টেলিফোন ধরে আছি। তুমি শুভ্রর জ্বর কত সেটা থার্মোমিটারে দেখে আমাকে জানাও।
জি আচ্ছা।
আর ড্রাইভার হারামজাদাটাকে জেগে থাকতে বলবে, তার সঙ্গে আমার কথা আছে।
জি আচ্ছা।
সকিনা জ্বর দেখে ভীত গলায় বলল, ভাইজানের জ্বর অনেক বেশি মা। একশ তিন।