০৬. বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার আগে

বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার আগে ওরা ওকে বিদায় জানায়। এ সীমানার পরে ওরা আর যেতেও পারবে না। বলে, আবার দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে।

অবনীশ হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ, কোথাও না কোথাও তো হবেই। পৃথিবীটা খুবই ছোট।

তোমারও কি তাই মনে হয় দময়ন্তী?

হয়ই তো। অবনীশ বলেছে বলে নয়, আমিও এটা বিশ্বাস করি। নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।

তাই যেন হয়। আসি।

দময়ন্তী ওকে জড়িয়ে ধরে–অবনীশ হাত মেলায়। মৃদুস্বরে বলে, ভালো থাকবে।

তন্ময় ট্রলি ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়। পেছনে তাকায় না—এটা ওর অভ্যেস নয়–ওর মনে হয় ওরা দাঁড়িয়ে আছে–আবার দেখা হবে এই বিশ্বাস ওর নিজেরও আছে–ও অভ্যেস ভেঙে পেছন ফিরে তাকায়–দেখে ওরা দাঁড়িয়ে আছে–ওকে হাত নেড়ে বিদায় দেয়।

প্লেনে বসে তন্ময়ের মনে হয় ই-মেইলে বন্ধু হওয়া দময়ন্তী কিংবা লন্ডনে দেখে আসা নীলিমা, মাধবী, জুলিয়ানার সঙ্গে অনিমার কোনো মিল নেই। অনিমা এদের মতো করে এখন পর্যন্ত জীবনকে দেখেছে বলে ওর মনে হয় না। তাহলে অনিমা কি বিয়ের পরে জীবনকে নতুন করে দেখতে শিখবে? নাকি ও নিজের সঙ্গে কোনো যুদ্ধ না করে পরিস্থিতি মেনে নিয়ে জীবন কাটাবে? কোনটা হবে অনিমার ঠিকানা? শান্ত, নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়া অনিমার আসলে জীবনকে দেখাই হয়নি। এইসব নারীর ভাবনা অনিমার জীবনে শক্ত অবস্থান তৈরি। করেনি। তন্ময় সিটের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ভাবে, অনিমার কী আছে এখনও ওর জন্য অপেক্ষা করে? মুহূর্তে ধড়মড় করে আবার সোজা হয়ে বসে। বিচলিত বোধ করে। আতঙ্কিত হয়। পাশের সিটের ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলে, কিছু হয়েছে?

নো। থ্যাঙ্কস।

তন্ময় নিজের উৎকণ্ঠায় বিব্রত বোধ করে। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এয়ারহোস্টেসকে বলে, আমাকে একটু পানি দেবেন? ওর মনে হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ও যেন নতুন অনিমাকে দেখতে পাচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও অবে, অনিমা যদি বদলে যায় তাহলে ও। অনিমাকে বোঝার মতো অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে। এটাকে কি ও জ্ঞান বলবে? হ্যাঁ, জ্ঞানও বলা যায়। অবশ্যই ও জ্ঞান লাভ করেছে, শিখেছে। এটা ভাবতেই ওর মাথা হালকা হয়ে যায়। ও নড়েচড়ে বসে। উইনডো সিটটা পেয়েছে বলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে নীলিমা দেখে। আবার মন খারাপ হয়ে যায়। অনিমা কি ওর ওপর আস্থা রাখতে পেরেছে? ওর লেখা একটা চিঠিও কি অনিমা পেয়েছে? নীলিমাজুড়ে অনিমার মুখ ভেসে ওঠে। মনে হয়, ও একটি অন্যরকম মেয়ে, মাধবী বা নীলিমার মতো জীবনের শিক্ষা না থাকলেও ও নিশ্চয় পরাভূত হবার নয়। তন্ময় আবার আশ্বস্ত হবার চেষ্টায় সিটের গায়ে হেলান দেয়। পাশের যাত্রীটি আবার বলে, কিছু হয়েছে?

না তো! আমি ঠিক আছি।

এতক্ষণে পাশের যাত্রীটির ওপর ও বিরক্ত হয়। তবে রাগতে পারে। পরক্ষণে নিজেকে শাসায়। ও তো অস্থিরতা দমাতে পারছে না এবং তা কোনো না কোনোভাবে ওর আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। পাশের যাত্রীটি নিঃসন্দেহে একজন তীক্ষ্মধী ব্যক্তি–সরাসরি ওর মুখের দিকে না। তাকিয়ে ঠিকই ওর অস্থিরতা অনুভব করতে পারছে। তিনি কি একজন মনস্তাত্ত্বিক, নাকি লেখক? ও ওর ভাবনায় নিচুপ হয়ে যায়।

প্লেন ল্যান্ড করার আগে পাশের যাত্রী ওকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি দিল্লিতে থাকেন?

না, ঢাকায়। একটা ওয়ার্কশপ অ্যাটেন্ড করব।

কত দিনের?

দিন পনেরো।

দ্রলোক তার কার্ড দিয়ে বলে, সময় পেলে আসবেন।

তন্ময় তাকিয়ে দেখে, তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। চেম্বারের ঠিকানা আছে। ও মৃদু হেসে বলে, থ্যাঙ্কু। প্লেন ততক্ষণ মাটি ছুঁয়েছে। রানওয়েতে দৌড়ে যাচ্ছে। সিট বেল্ট খোলার শব্দ উঠেছে, প্লেন থেমে গেলে সবাই মাথার ওপরের লকার থেকে ছোটখাটো ব্যাগগুলো নামায়। ভদ্রলোক পায়ের কাছে রাখা নিজের ব্যাগটি তুলে নিয়ে বলে, আসি।

তন্ময় ঘাড় নাড়ায়। ও জানে তার দেয়া কার্ড ওর কোনো কাজে আসবে না। ওর মানসিক অবস্থা এখনো সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ও ধীরেসুস্থে নামার জন্য অপেক্ষা করে এবং শেষ পর্যন্ত এয়ারক্র্যাফটের শেষ যাত্রী হয়ে সিড়িতে পা রাখে।

দিল্লিতে কয়েকটা দিন ওর হাওয়ার বেগে উড়ে যায়। ওয়ার্কশপের পাশাপাশি নতুন দিল্লি, পুরনো দিল্লি মিলিয়ে পাঁচশ ছবি তোলে। সবচেয়ে অবাক হয় সড়ক দ্বীপে চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা নতুন দিল্লিতে বাসকারী গৃহহীন মানুষদের ছবি তুলে। ভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থানকারী দেশের রাজধানীর প্রথম আলোর সকাল এমনই! মানুষকে ভাত ও গৃহ দেয়ার বদলে প্রতিযোগিতা করে অস্ত্র ও বোমার পাল্লায়। কে ঠেকাবে কাকে!

ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকানোর সময় রাতের উপার্জনকারী একটি কিশোরী কাছে এসে বলে, আমার একটা ছবি তুলবেন?

তুলতে পারি, কিন্তু ছবি তো তোমাকে দিতে পারব না।

আমি তো ছবি চাই না।

তাহলে কী চাও?

টাকা। বিশ টাকা দিলেই হবে।

তোমার ছবি দিয়ে আমি কী করব?

উপার্জন করবেন।

উপার্জন?

হ্যাঁ, দিল্লির একটি মেয়ে যে শরীর বিক্রি করে তার ছবি পত্রিকায় দিতে পারবেন, এক্সিবিশন করতে পারবেন, এমনই। আপনিও টাকা পাবেন।

টাকা আমি পাব কি-না জানি না। তবে তোমার একটি ছবি আমি তুলব।

গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিকটা কি লাগাব?

দরকার নেই।

সন্ধ্যায় যখন সাজি তখন ওই লিপস্টিকটা লাগাই। সারা রাতের কাস্টমাররা শুষে নিয়েছে।

তুমি এখানে দাঁড়াও।

ক্লান্ত, বিষণ্ণ মেয়েটির চোখজোড়ায় যেন পরাজিত মানুষের ছায়া। তন্ময় শিহরিত হয়। এমন চোখ ও আগে দেখেনি। ছবি তোলা হলে টাকা দিতে দিতে বলে, তোমার নাম কী?

আমার তো অনেক নাম। কাস্টমাররাই নাম দেয়। মায়ের রাখা নাম আমার মনে নেই। আপনিও আমাকে একটা নাম দিতে পারেন। আপনিও তো আমার কাস্টমার।

কাস্টমার? তন্ময়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

মেয়েটি খিলখিল হাসিতে দিনের প্রথম আলো ভরিয়ে দেয়। বলে, কাস্টমার না হলে টাকা দিলেন কেন? আমরা তো পোলাও খাই, আবার মুড়িও খাই। সব খাওয়া কি একরকম!

আশ্চর্য! তন্ময় হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, কত বয়স হয়েছে ওর? মেয়েটি খিলখিল হাসি হেসে বলে, আপনি এখানে এলে আমাকে পাবেন। আমি এই এলাকার চারপাশেই থাকি। আসবেন কিন্তু, এই সময়ে। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব।

অপেক্ষায়! তন্ময়ের মাথা বনবন করে। দেখতে পায় মেয়েটি উল্টো দিকের ফুটপাথে উঠে চলে যাচ্ছে। ওর ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে বলে আসতে, আমার অপেক্ষায় তুমি থেকো না। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনো দিন দেখা হবে না। কিন্তু কী লাভ? এটাই বোধহয় ওর উপার্জনের ভাষা। ও সবাইকে এভাবেই বলে হয়তো। নিজেকে যুক্তি দেখিয়ে খানিকটুকু সান্ত্বনা খোঁজে তন্ময়।

 

দুদিন পর ঢাকায় ফিরে মাকে ঘটনাটা বলে ও। সাবিহা বানু এক। মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, সখিনাকে তুই আমার কাছে নিয়ে না এলে ও হয়তো এভাবে নিজের জায়গা খুঁজে নিত সোনা।

তন্ময় চেঁচিয়ে বলে, তুমি আমার কথা বললে না কেন? আমিও তো…

চুপ কর, চুপ কর বলছি। তুই শুধু আমার ছেলে, শুধু আমার।

সাবিহা বানু হিংস্র কণ্ঠে কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তন্ময় মাকে জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ গুঁজলে ওর মনে হয় একটি বিশাল সত্য প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে দুজনের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে–দুজনকেই এই সত্য কুরে খায়। কখনো সেটা সামনে আসে, কখনো অদৃশ্য থাকে–তারপরও সম্পর্কের সুষম টানের ফাঁক গলিয়ে সেই সত্য নাক গলায়। উপায়হীন জীবনের নির্মম কষ্ট।

 

অনিমার সামনে এখন অসীম শূন্যতা। চারদিক থেকে ওকে ঘিরে ধরা হয়েছে–বড় বাধা বাবা, সেই সঙ্গে বাবার ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, ভবিষ্যৎ চিন্তা এবং মেয়ের নিরাপদ জীবন দেখার তীব্র বাসনা ওকে দমিয়ে রাখে। এই বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে আসার ওর কোনো উপায় নেই। ও সব কিছু বাদ দিয়ে তো ‘আমি’ হতে শেখেনি। ও বাবাকে অস্বীকার করবে কীভাবে? অনিমার দিনগুলোতে অন্ধকার ভরে থাকে। এরপরও স্টেশনে ট্রেন এলে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। না, তন্ময় নামে না। দুদিনের মাথায় দেখতে পায় সাদেক আলী ও তার ছেলে তারেক ট্রেন থেকে নামছে। অনিমা বুঝে যায় বাবা আর অপেক্ষা করবে না। সবই গুছিয়ে ফেলেছে। তার চাচাতো ভাই আর ভাইয়ের। ছেলেকে আনিয়েছে। ও ছুটে ভেতরে আসে। পাখি বানিয়ে রাখা চিঠির ব্যাগটা টান দিয়ে নামিয়ে ঘরময় উড়িয়ে দেয়–কত দিকে গড়িয়ে যায় পাখিগুলো। ও চৌকিতে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে থাকে। ওর শরীর হিম হতে থাকে, এক সময় ওর মনে হয় ওর ঘুম পাচ্ছে–ও একগাদা কাগজের পাখি বুকে জড়িয়ে চৌকির সঙ্গে মাথা হেলায়।

অতিথি নিয়ে বাড়ি এসে তৌফিক অনিমাকে এই অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠে। ওর কাছে উবু হয়ে বসে আস্তে করে ডাকে, মা। অনিমা ঘোলা চোখে বাবাকে দেখে।

কী হয়েছে মা?

কিছু তো হয়নি বাবা।

তুই ভালো আছিস তো মা?

ভালো তো আছি।

ইয়ে মানে–ওরা এসেছে–তুই—

আমাকে নিয়ে তুমি কিছু ভেব না বাবা। তুমি আমাকে কত ভালোবাসো–তোমার ঋণ কি আমি শোধ করতে পারি! বাবা আমাকে দিয়ে তোমার কোনো অবমানো হবে না।

সত্যি বলছিস মা?

হ্যাঁ বাবা।

তৌফিক খুশি মনে উঠে যায়। অনিমা শুনতে পায় ওর বাবা সাদেক আর তারেকের সঙ্গে উঁচু স্বরে কথা বলছে। ও বুকের সঙ্গে খুঁতনি ঠেকিয়ে বলে, ভালোবাসাহীন জীবনের একটি বিয়ে, পুরো জীবনের আর কতটুকু খাবে? দেখতে হবে আর একটি ভালোবাসার অপেক্ষায় জিততে পারে কি-না। এ অপেক্ষা তারেককে নিয়ে। এভাবে বেশ ভালোই একটি সময় গেল। সামনে কী আছে অনিমা জানে না–ও জানার জন্য ভাবতে চায় না, ওর মাথা ভার হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে বুকের ভেতরের সব জায়গাটুকু জুড়ে নুড়ি বিছানো। কখনো সেসব নুড়ি আশ্চর্য ধ্বনিতে টুংটুং করে–ওর কিছু করার নেই, শুধুই কান পেতে থাকে। অনিমা নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে।

 

দুদিন পরে বিয়ে।

রঙিন কাগজে দিয়ে স্টেশন মাস্টারের বাড়ি সাজানো হয়েছে। অনিমার ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে মাসুম। মনের সুখে ওরা রঙিন কাগজ কেটে ফুল বানাচ্ছে, নৌকা, পাখি, হাতি, ঘোড়া নানা কিছু বানাতে চাইছে। কখনো ঠিকমতো হয়, কখনো হয় না–তাতে কি, পুরো বাড়ির দেয়াল ভরে যাচ্ছে সেসব নকশায়। মাসুম মাঝে মাঝে অনিমার সামনে এসে দাঁড়ায়–কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না। আসলে ওর বলারও কিছু নেই। মানুষটি যে এখান থেকে গেল আর কোনো খবর নেই। ঠোঁট উল্টে বলে, এমন ভবঘুরে মানুষের সঙ্গে আপার বিয়ে না হওয়াটাই ভালো। কোন দিন আবার আপাকে রেখে কোথায় উড়ে যাবে, কে জানে! ভালোই হয়েছে। ও ছেলেমেয়েদের তাগাদা দিয়ে জিঞ্জির বানানো শেষ করে। গেটের উপর ওটা ঝোলাতে গিয়ে আকস্মিকভাবে ওর খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ওর দুচোখ ভেসে যায় জলে।

কান্দেন ক্যান মাসুম ভাই?

আপা যে থাকবে না সেজন্য মন পোড়ে।

ঠিক। আমারও দুঃখ লাগে।

অন্যরা হৈচৈ করছে। মাসুম দুহাতে চোখ মুছে ওদের সঙ্গে মিলে যায়।

পরদিন বিয়ে। কনে সেজে বসে থাকে অনিমা। চমৎকার বেনারসি শাড়ি এনেছে, সঙ্গে হালকা গয়না, কসমেটিকস। অনিমা তাকিয়ে দেখেই বোঝে যে ওদের সাধ্য অনুযায়ীই ওরা এনেছে। একটু পরেই বরের বেশে তারেক ঢুকবে বাড়িতে। সবটাই খুব সাজানো, খুবই সংক্ষিপ্ত মনে হয় অনিমার। জীবনের বিশাল একটি পর্ব কেমন ধূলিমলিন বাস্তবতায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। এই পর্ব আর টেনে তোলা যাবে না। ওটাকে ধুলোবালির নিচে আড়াল করে টেনে তোলা যাবে না। এর বেশি কিছু ও আর ভাবতে পারে না। ভাবাটা সঙ্গত নয়। শুধু তন্ময়ের স্মৃতি বুকের ফ্রেমে উজ্জ্বল। যে ছবি তন্ময় উঠিয়েছিল তার কোনো কপি অনিমার কাছে নেই। কথা ছিল তন্ময় ঢাকায় গিয়ে প্রিন্ট করে আনবে। অনিমা নিজেকে শক্ত করে বলে, ওই ছবিগুলো আমি চাই না। তুমি তো কত জায়গাতেই যাও, কোনো এক জায়গায় ফেলে দিও। তন্ময় এখন ওর স্মৃতির মানুষ। বিয়ে পড়ানোর সময় তৌফিক নিজের মেয়েকে চিনতে পারে না। তৌফিকের বুক মুচড়ে ওঠে, ও এতটাই অচেনা হয়ে গেল কেন? এই অন্য অনিমা কি আমার মেয়ে? তৌফিকের কান্নায় উপস্থিত সকলে চমকে ওর দিকে তাকায়।

 

গভীর রাতে তারেক অনিমাকে বলে, চলো বাইরে যাই।

বাইরে।

হ্যাঁ, দেখো কী সুন্দর পূর্ণিমা। তুমি চাইলে আমরা রেললাইন ধরে অনেক দূর চলে যেতে পারি। যাবে?

স্টেশনের প্লাটফর্ম পর্যন্ত যেতে পারি। এর বেশি নয়।

তারেক ওকে বুকে নিয়ে বলে, এত ছোট স্বপ্ন! তোমাকে ছাড়া আমি। কখনো কারো কথা ভাবিনি। তোমাকে না পেলে আমি বিয়ে করতাম না। সারা জীবন একা থাকতাম। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, একটুও মিথ্যে না।

দুজনে হাত ধরে বাইরে আসে। সুনসান রাত। পাখির ডাকও নেই। শুধু ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় চরাচর প্লাবিত হয়ে আছে। প্লাটফর্মের কাঠের বেঞ্চে দুজনে বসলে অনিমার মনে হয় পূর্ণিমা আছে বলে দুঃখ। খোলা যায়। তারেকের মতো ছেলেদের হৃদয়জুড়ে পূর্ণিমা।

 

একদিন পরেই বিকেলে ট্রেন আসার শব্দে মুচড়ে ওঠে অনিমার বুক। ও নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে না। স্মৃতি এখনো ভীষণ তাজা। সামাজিকভাবে ওর আর কারো জন্য অপেক্ষা করার অনুমোদন নেই। কিন্তু বুকের গভীরে নিজেকে আড়াল করবে কোথায়? ও জায়গাটুকু ওর একার। ওখানে ও যে কাউকে রাখতে পারে, যে কারো কথা ভাবতে পারে যতদিন খুশি ততদিন। ও দু-কান ভরে ট্রেনের শব্দ শোনে–শুনতে ওর ভালো লাগে। সেই আনন্দ নিয়ে তারেককে বলে, তুমি চা খাবে?

না, এখন চায়ের দরকার নেই। চলো দুজনে ঘুরে আসি। রাস্তার ধারে মকবুল মিয়ার দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাব। যাবে?

হ্যাঁ যাব। ওই চা খেতে ভীষণ মজা পাই।

মজা কেন?

ওরা যেভাবে চায়ের পাতা সেদ্ধ করে চা বানায় সেটাই আমার মজা। আমরা তো ওভাবে চা বানাতে পারি না।

হাসতে হাসতে তারেক বলে, তাহলে চলো যাই।

একটু অপেক্ষা করো। হাতের কাজটুকু সারি।

বেশি দেরি করা চলবে না কিন্তু।

একদমই না। আসছি।

তার একটুক্ষণ আগে তন্ময় নেমেছে ট্রেন থেকে।

ওর কেমন অচেনা লাগে ফুলসি স্টেশনকে, কোথায় যেন কী ঘটেছে–দারুণ আকাল চারদিকে এই দুর্ভিক্ষপূর্ণ এলাকাটি ওকে মর্মাহত করে। নাকি বিদেশ থেকে ঘুরে আসার কারণে এই অখ্যাত স্টেশনটি ওকে টানতে পারছে না! নাকি এখানে কোনো বিপর্যয় ঘটেছে? তন্ময় নিজেকে প্রশ্ন করে কিন্তু বুকের ভেতরে উত্তর পায় না। ট্রেন থেকে এখানে নামার পরেই বুকের ওই জায়গাটা অসার হয়ে আছে।

আর দূর থেকে তন্ময়কে দেখে মাসুমের হাত থেকে সবুজ পতাকাটা পড়ে যায়। ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পতাকাটা ওঠাতেও মনে থাকে না। ট্রেন চলে গেছে। যাত্রীরাও কেউ নেই। তন্ময় ওকে দেখে এগিয়ে আসে। ও পতাকাটা উঠিয়ে মাসুমের হাতে দিয়ে বলে, কেমন আছ মাসুম?

আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন তন্ময় ভাই?

আমার কি থাকার জায়গার অভাব? যেখানেই যাই সেখানেই ঠাঁই।

মাসুমের হাঁ করে তাকিয়ে থাকা দেখে বলে, কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? মনে হচ্ছে তোমার খুব কষ্ট।

মাসুম আস্তে করে বলে, তাহেরা চাচি মারা গেছে।

কবে?

দুদিন আগে। আমি নিজের হাতে কবরে নামিয়েছি।

ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে ও বাড়িতে যাব। ফজর আলি আর হনুফাঁকে ছবি দিয়ে আসব। অনিমা কেমন আছে মাসুম?

জানি না।

জানো না? সেজন্য তুমি অনিমার কথাই বলছ না। বেশ মজার ছেলে তুমি! মাস্টার সাহেব অফিসে আছেন?

না বাড়িতে।

তাহলে চলো আমরাও বাড়িতে যাই। তোমার সঙ্গে কথা বলে কতটা সময় পার করে দিলাম।

আপনি যান, আমার কাজ আছে। আর দশ মিনিটের মধ্যে উল্টো দিক থেকে আর একটা ট্রেন আসবে।

মাসুমের কথাগুলো খুব কাটা কাটা মনে হয়। তন্ময়ের কানে খট করে বাজে। তারপরও ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, বুঝতে পারছি কোনো কারণে তোমার মুড অফ। যাকগে আমি যাই।

প্লাটফর্ম পার হতেই কাগজের ফুল-পাতায় সাজানো বাড়িটা ওর চোখে পড়ে। তন্ময় থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় কাগজগুলো ম্যাথুর টেবিলে রাখা রঙিন পাথর। বর্ণিল দ্যুতিতে ফুলৰ্মসি স্টেশনে অদ্ভুত আলো ছড়িয়েছে। তাহলে কিছুক্ষণ আগেও কেন জায়গাটিকে দুর্ভিক্ষপূর্ণ মনে হয়েছিল ওর? তন্ময় ফিরে আসে মাসুমের কাছে।

অনিমাদের বাড়িটা অমন সাজানো কেন মাসুম?

দুদিন আগে আপার বিয়ে হয়েছে।

ওহ! তন্ময় মাসুমের ঘাড়ে হাত রাখে। বলে, যে ট্রেনটি আসবে বললে আমি ওই ট্রেনে উঠব।

ওটা তো ঢাকায় যাবে না।

যেদিকে খুশি সেদিকে যাবে। যাওয়া হলেই হয়।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাসুম সবুজ পতাকা ওড়ায়। তন্ময় দেখতে পায় দ্রুতগতিতে আসা ট্রেনটা গতি কমিয়ে আস্তে আস্তে স্টেশনে ঢুকছে। ও মাসুমের দিকে একটি ছোট ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে, এটা অনিমাকে দিও। এর ভেতরে আমার তোলা ওর কয়েকশ’ ছবি আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *