বিবাহ নির্বিঘ্নে শেষ হইয়া গেল।
পূর্বের কথামত সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিরাগমন শেষ করিয়া বধূকে কাছে রাখা হইয়াছে। নান্তির কষ্টের কোনো কারণ নাই। শ্বশুরবাড়ির জানালা খুলিয়া বাপের বাড়ির জানালার মানুষ চেনা যায়, কথা কওয়াও চলে। সকালে একবার, বিকালে একবার সেখানে যাওয়ার ছুটি তো দেওয়াই আছে। তাহার ওপর সুযোগ পাইলেই নান্তি পলাইয়া গিয়া দিদিমাকে দেখিয়া আসে। তাহার ওপর কাজের ভারও পড়িয়াছে—পান সাজা, পূজার ফুল বাছা এবং শিবনাথের জামাকাপড় গুছাইয়া রাখার ভার পিসিমা তাহাকে দিয়াছিলেন। কিন্তু মা শিবনাথের জামাকাপড় রাখিবার ভারটি লইতে দেন নাই, তাহার পরিবর্তে সন্ধ্যায় পিসিমার পায়ে তেল দিবার কাজ দিয়াছেন। রাত্রে বউ শোয় মায়ের কাছে।
ফারুন মাস। গোমস্তারা সকলে পৌষ-কিস্তির আদায়ের হিসাব দিতে আসিয়াছে। মৌজা বেলেড়ার গোমস্তার ইরসাল অর্থাৎ সদরে পাঠানো ঢাকার পরিমাণ খুব কম হওয়ায় পিসিমা আদেশ করিলেন, আদায় না হয়ে থাকে, তুমি নিজে দিয়ে পূরণ করে দাও; তারপর আদায় করে নেবে। জোড়হাত করিয়া গোমস্তা শ্ৰীপতি দে বলিল, পাঁচ টাকা মাইনের কর্মচারী আমি, মহলের টাকা কি আমার ঘরে আছে মা?
পিসিমা প্রশ্ন করিলেন, সরকারের ঘরে কম দিয়ে কি শিবনাথ মাপ পাবে? তার জমিদারি থাকবে কী করে?
নায়েবও দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনি বললেন, রাজার রাজস্বটা তো দিতে হবে বাপু, জমিদারের মুনাফা না হয় বলতে পার, দিতে পারলাম না।
গোমস্তা বলিল, বড় গাছে বড় ঝড়ই লাগে মা। আপনাদের সহ্য না করে উপায় কী? প্রজার। এবার বড় দুরবস্থা।
পিসিমা বলিলেন, সে শুনলে নাবালকের এস্টেট চলবে না শ্ৰীপতি, চৈত্র-কিস্তিতে টাকা আমার আদায় চাই-ই। আদায় না হলে তোমাকে হ্যান্ডনোট লিখে দিতে হবে।-বলিয়া পিসিমা। স্নানে বাহির হইয়া গেলেন। কথাগুলি অন্দরের মধ্যেই হইতেছিল। নায়েব ও শ্ৰীপতি চলিয়া যাইতেছিল, শিবনাথের মা বারান্দায় বাহির হইয়া আসিয়া ডাকিলেন, শ্ৰীপতি।
শ্ৰীপতি ফিরিয়া সসম্ভ্ৰমে বলিল, মা!
মা নিচে আসিয়া দরদালানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, শোন তো বাবা, এদিকে একবার। সিংমশায়, আপনিও শুনুন।
নায়েব ও শ্ৰীপতি উভয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেই মা মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিলেন, সত্যিই কি প্রজাদের দুর্দশা এবার খুব বেশি?
শ্ৰীপতি জোড়হাত করিয়া বলিল, আমি মিথ্যে কথা বলি নি মা। আপনি তদন্ত করে দেখুন।
মা বলিলন, আর একটা কথা আমি জিজ্ঞেস করব বাবা, সত্যি উত্তর দিও। আচ্ছা, শিবুর বিয়েতে প্রজাদের কাছ থেকে কৌশল করে টাকা আদায় করার কি দুর্নাম হয়েছে বাবা?
শ্ৰীপতি নীরব হইয়া রহিল। মা আবার প্রশ্ন করিলেন, নায়েববাবু!
নায়েব বলিলেন, ও কথা বাদ দিন মা, সংসারে দশ রকমের মানুষ আছে, দশ রকম বিশ রকম বলে, ও-কথায় কান দিতে গেলে কি চলে?
মা বলিলেন, আমি টাকাটা ফিরিয়ে দিতে চাই।
শ্ৰীপতি বলিল, না মা, তা হয় না, সকলেই তো তা বলে না, আর তাতে কি তাদের অপমান করা হবে না? অবশ্য আপনাদের কাছে তাদের আর মান-অপমান কী?
মৃদু হাসিয়া মা বুলিলেন, না না, ও কথা বোলো না বাবা, আঙুলের ছোট বড় বাছা চলে না, মানুষেরও তাই, অবস্থার ছোট-বড়তে ছোট-বড় হয় না। যাগে, আসুন আপনারা।
নায়েব যাইতে যাইতে বলিলেন, আমারই হয়েছে মরণ শ্ৰীপতি, এক মালিক যান উত্তরে তো আর একজন যাবেন দক্ষিণে। ছেলেটা বড় হলে যে বাঁচি।
সে-সময়ে দোলের ছুটি, শিবনাথ তাহার ঘরের মধ্যে বসিয়া একটা পিতলের পিচকারিতে ন্যাকড়া জড়াইতেছিল। দোল আসিতেছে, রং খেলিতে হইবে। নয় বৎসরের নান্তি পাশে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল। সিঁড়ির উপর হইতেই মা প্রশ্ন করিলেন, শিবু আছিস?
ঘরের মধ্যে ঠিক পাশেই বধূর অস্তিত্ব স্মরণ করিয়া শিবুর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, সে। শুস্বরে বলিয়া উঠিল, অ্যাঁ!
নান্তি কিন্তু অপ্রতিভ বা বিব্রত হইল না, সে চুপ করিয়া পুঁড়ি মারিয়া খাটের এক কোণে আত্মগোপন করিয়া বসিল। মা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দরজাটা বন্ধ করিয়া দিলেন। শিবু ভয়ে শুকাইয়া গেল।
মা বলিলেন, তোকে একটা কথা বলব শিবু।
শিবু মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মা বলিলেন, গোমস্তারা বলছিল, এবার নাকি বড় দুর্বৎসর, ফসল ভাল হয় নি। প্রজারা খাজনা দিতে পারছে না।
শিবু মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, এবার তা হলে খাজনা নিও না মা।
মা বলিলেন, সে ছেড়ে দেবার মত অবস্থা তো আমাদের নয়। তা ছাড়া জজ সাহেবকে প্রতি বৎসর নাবালক এস্টেটের হিসেব দিতে হয়, তিনি হয়ত তা মঞ্জুর করবেন না। সে কথা আমি বলি নি বাবা। আমি বলছিলাম যে এই দুর্বৎসরে প্রজাদের কাছে বিয়ের সময় টাকা আদায় করায় লোকে খুব দুর্নাম করছে।
মায়ের কথা শুনিতে শুনিতে শিবুর মুখ কখন চিন্তায় গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছিল। সে ধীরে ধীরে বলিল, সেটা খুব খারাপ হয়েছে মা।
মা ছেলের মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, সেইটে তাদের ফিরে দিতে হবে শিবু। তোর পিসিমাকে বলে তাকে এইটেতে রাজি করাতে হবে।
শিবু বলিল, পিসিমাকে আমি রাজি করার মা। একবেলা না খেলেই পিসিমা ঠিক মত দেবে।
শোন, বিয়ের টাকা ফিরে দিতে গেলে প্রজাদের অপমান করা হবে। তার চেয়ে সবার খাজনা থেকে এবার এক টাকা করে মাপ দেওয়ার হুকুমটা তোকে পিসিমার কাছে করিয়ে নিতে হবে। অধিকাংশ লোকই এক টাকা করে দিয়েছে। বলবি, আমার বিয়ের বছর এক টাকা করে। মাপ দিলে প্রজারা চিরদিন নাম করবে আর আশীর্বাদ করবে।
বেশিও তো কজন দিয়েছে মা। পাঁচ টাকা দিয়েছে যোগী মোড়ল, খুদী মোল্যান, আরও কে কে, সব লেখা আছে সিংমশায়ের কাছে।
তারা অভাবী নয় শিবু, তারা ও কৌশল না করলেও দিত। তুই ওই এক টাকা মাপের হুকুমটাই করিয়ে নে।
মা আর দাঁড়াইলেন না, যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, আজই বলিস নি যেন পিসিমাকে। গোমস্তারা আজ সন্ধের সময় চলে যাবে, কাল বলবি। নইলে তারা বকুনি খেয়ে মরবে, পিসিমা ভাববে, ওরাই তোকে ধরে পড়েছে। মা চলিয়া গেলেন। বউও সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একরাশ ঝুল মাখিয়া গুটিগুটি বাহির হইয়া হাসিতে হাসিতে শিবুর পিঠে গুম করিয়া একটা কিল মারিয়া বাহির হইয়া পলাইল।
পরদিন বেলা তখন নয়টা হইবে। বউ উপরে পুতুল খেলিতে খেলিতে অঝেরঝরে কাঁদিতে কাঁদিতে নামিয়া আসিল। শিবনাথ তাহার বড় চীনামাটির পুতুলটা ভাঙিয়া দিয়াছে।
পিসিমা ডাকিলেন, শিবনাথ!
তখন শিবনাথ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়াই দুমদাম করিয়া নামিয়া আসিতেছিল, সে সিঁড়ি হইতেই আরম্ভ করিল, বিলিতি পুতুল কেন খেলবে ও?
রোষক্ষুব্ধ বধূ জ্বলন্ত তুবড়ির মত বলিয়া উঠিল, বেশ করব, খুব করব। আমি বিলিতি খেলব, তাতে ওর কী?
শিবনাথ গম্ভীরস্বরে আদেশ করিল, নিত্য, ওপর থেকে আমার সরু বেতগাছাটা আন্ তো!
বধৃটি অকস্মাৎ পাগলের মত জিব বাহির করিয়া বিকৃতভাবে শিবনাথকে ভেঙাইয়া উঠিল, অ্যাঁই, অ্যাঁই, অ্যাঁই।
পিসিমা দাঁড়াইয়া মৃদু হাসিতেছিলেন। মাও হাসিতেছিলেন, কিন্তু এবার তিনি শাসনের স্বরে বলিয়া উঠিলেন, বউমা! যাও, ঘরের মধ্যে যাও।
নান্তি মৃদুস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরের মধ্যে চলিয়া গেল।
পিসিমা বলিলেন, নিত্য, নায়েববাবুকে বলে আয় অনন্ত বৈরাগীর কাছে লোক পাঠিয়ে দিতে, সে যেন তার দোকানে যা পুতুল আছে নিয়ে আসে, বউমার যেটা পছন্দ হবে বেছে নেবে।
শিবনাথ বলিল, বিলিতি হলে অনন্তকে আমি বাড়ি ঢুকতে দোব না।
ঘরের মধ্য হইতে বউ বলিয়া উঠিল, না দেবে না, একা ওর বাড়ি কিনা!
মা সেলাই করিতে করিতে বলিলেন, বউমা, তোমায় চুপ করে থাকতে হয়।
উত্তর দিতে না পারিয়া বউ শিবনাথের দিকে চাহিয়া নিঃশব্দে ছোট একটি ভেংচি কাটিয়া দিল। শিবনাথ বলিল, ওই দেখ, আবার আমায় ভেংচি কাটছে, আমি বেত দিয়ে ওর পিঠের চামড়া তুলে দোব।
মা বলিলেন, শিবু, মেয়েমানুষের গায়ে হাত তো তুলতেই নেই, মুখে মারব বলাও দোষের কথা। ও কথা আর বোলো না।
সতীশ চাকর আসিয়া দাঁড়াইল। সতীশের একটা অদ্ভুত স্বভাব, বাড়িতে কলরব বা কোনো উত্তেজনার আভাস পাইলে সে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। তাহা স্তিমিত হইয়া শান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা সে বলে না, তা সে যত গুরুতর প্রয়োজনীয় বিষয়ই হউক না কেন। সে বলে, মিছিমিছি পেঁচিয়ে কী করব? গোলমালে কি কথা শোনা যায়? তাঁহার এই বাক্যসংযমের ফলও একটা হইয়াছে, সে আসিয়া সঁড়াইলে সকলের দৃষ্টি তাহার প্রতি আকৃষ্ট হয়, বাড়ির লোকেই প্রশ্নজ্ঞাপক সুরে তাহাকে সম্বোধন করে, সতীশ!
ওইটুকুতেই যথেষ্ট, বাকিটুকু উহ্যই থাকিয়া যায়; সতীশও আপনার প্রয়োজন ব্যক্ত করে। পাচিকা রতন-ঠাকরুন তাহার নাম দিয়াছে, ভগ্নদূত।
সতীশ দাঁড়াইতেই মা হাসিয়া প্রশ্ন করিলেন, কী চাই বাবা সতীশ?
আজ্ঞে তেল। মাস্টারমশায় এসেছেন।
বধূ রোষভরে বলিল, আমি মাস্টারমশায়কে বলে দোব।
মা তিরস্কারপূর্ণ স্বরে বলিলেন, ছি!
মাস্টারমশায়ের ছুটি ফুরুল নাকি? আবার তো এই সামনে দোলের ছুটি। আবার ছুটি হলেই তো মাস্টার ছুটবে বাড়ি। বুঝলে মাসিমা, দেখেছি আমি মাস্টারের বাড়ি যাওয়া। ঠিক যেন একটি কেউ চাষাভুষো চলেছে খালি পায়ে দুমদুম করে। রতন সে দৃশ্য স্মরণ করিয়া হাসিয়া ফেলিল, বক্তব্যটি আর শেষ করিতে পারিল না।
শিবু তাড়াতাড়ি আসিয়া দেখিল, মাস্টার দাড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখে পদচারণা করিতেছেন। শিবুকে দেখিয়াই তিনি আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন, ওয়েল শিবু!
স্যার!
ওয়েল, মাই বয়, ক্যান ইউ টেল মি,-হোয়াট শ্যাল আই সে? হ্যাঁ, বলতে পারিস শিবু, মানুষের মান বড় অথবা অর্থ বড়?
এত সহজ প্ৰশ্ন মাস্টার মহাশয় করিবেন এ শিবু ভাবে নাই, সে হাসিয়া মুহূর্তে উত্তর দিল, মানই সকলের চেয়ে বড়, প্রাণের চেয়েও বড় স্যার।
মাস্টার উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ইয়েস। এই উত্তরই আমি শুনতে চেয়েছিলাম। গড ব্লেস ইউ, মাই বয়।
এবার শিবুর হাত ধরিয়া তিনি বলিলেন, দেন আই বিড ইউ গুডবাই, মাই বয়, আই হ্যাভ রিজাইন্ড। স্কুলের কাজে আমি রিজাইন দিয়েছি।
এমন একটা সংবাদের আকস্মিক রূঢ়তায় শিবু স্তম্ভিত নির্বাক হইয়া গেল। মাস্টার গম্ভীরভাবে পদচারণা করিতে করিতে বলিলেন, আমায় অপমানিত হতে হচ্ছে শিবু। আমি রিজাইন দিয়েছি। সে আর আমি উইথড্র করতে পারি না। এই জন্যেই আমি ছুটি নিয়েছিলাম। বাড়ির সঙ্কলে আপত্তি করছে, বন্ধুবান্ধব সকলে বারণ করছে, কিন্তু তারা ঠিক বলছে না। ইউ, ওলি ইউ, মাই বয়, ঠিক উত্তর দিয়েছ। আই অ্যাম গ্ল্যাড।
শিবুর চোখে জল আসিয়াছিল; এই শিক্ষকটির সঙ্গে এম একটি নিবিড় মমতার বন্ধনে সে আবদ্ধ হইয়া গিয়াছে যে সে বন্ধনে অস্ত্রোপচারের ছুরিকা–স্পর্শমাত্রেই তাহার অন্তর অসহ্য বেদনায় আতুর হইয়া উঠিল। একটা চেয়ারের মাথায় মুখ রাগিয়া সে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার মাথায় হাত দিয়া মাস্টার তাহাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়া দিতে পারিলেন না, তাহারও চোখ হইতে ঝরঝর করিয়া জল শিবুর মাথায় আশীর্বাদের মতই ঝরিয়া পড়িল। অনেকক্ষণ পর তিনি বলিলেন, কাঁদস নি শিবু। এর উপায় নেই। এ হল দুর্বলতা। ম্যান ইজ বর্ন টু ডাই। মরেই যায় মানুষ, তাতেও বিচলিত হতে নেই। জানি, চাকরির অভাবে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে। কিন্তু এ আমাকে সহ্য করতে হবে।
ব্যাপারটা সামান্যই। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভ্য নির্বাচনে মাস্টার উপযুক্ততা বিচার করিয়া স্কুলের মালিক ও সেক্রেটারিদের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট না দিয়া অপর ব্যক্তিকে ভোট দিয়াছেন। লোকটি উপযুক্ত কেন, উপযুক্ততম প্রার্থী। কিন্তু স্কুলের মালিক পক্ষ তাঁহাকে চান না। তিনি তাঁহাদের পিছনে পিছনে যাইবেন না, তাহাদের সম্মুখে আসিয়া পথরোধ করিয়া দাঁড়াইবেন বলিয়াই তাহাদের ধারণা। এই কারণেই মালিকপক্ষ মাস্টারের ওপর রুষ্ট হইয়া ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করিয়াছেন, অন্যথায় অক্ষমতার অপবাদে তাহাকে পদচ্যুত করিবার স্থিরসংকল্প লইয়া বসিয়া আছেন। মাস্টার কয়েকদিন ছুটি লইয়া অনেক চিন্তা করিয়াছেন, তাহার পরিবারবর্গের সকলে, বন্ধুবান্ধব, হিতাকাঙ্ক্ষী সকলেই তাহাকে ক্ষমাপ্রার্থনা করিবার উপদেশ দিয়াছেন, কিন্তু সে তাহার মনোমত হয় নাই, তিনি নিজেই ইস্তফাপত্ৰ দাখিল করিয়া বসিয়াছেন।
সংবাদটা শুনিয়া এ সংসারটা সত্য সত্যই প্ৰিয়বিয়োগাতুর সংসারের মত দুঃখবেদনায় আচ্ছন্ন ম্লান হইয়া গেল। পিসিমা তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, বাবা রতন, তুমি যাবে কেন? আমার শিবুকে নিয়ে তুমি থাক। যতখানি পারি তোমায় পুষিয়ে দোব।
আজ আর মাস্টার পূর্বের সে তেজোচ্ছ্বসিত মাস্টার নন, শান্ত ধীর অচঞ্চল। আহার বন্ধ করিয়া মাস্টার মুখ তুলিয়া পিসিমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, না, শিবুর এস্টেটের তাতে ক্ষতি হবে। শিবু তো আমার শুধু ছাত্রই নয় পিসিমা, ওর সঙ্গে আমার হিন্দু আমলের গুরু-শিষ্য সম্বন্ধ। আমি আর চাকরিও করব না। বাড়িতে গিয়ে চাষ করব। জানেন, আমাদের এক কবি বলেছেন—চাই না স্বর্গের সুখ নন্দনকানন, মুহুর্তেক পাই যদি স্বাধীনতা ধন? স্বাধীন জীবনের জন্যে যদি কিছু কষ্ট-স্বীকারই করতে হয়, সে করতে হবে।
পিসিমা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তা হলে শিবু কার কাছে পড়বে, তুমিই একটা ঠিক করে দিয়ে যাও বাবা।
দরকার নেই পিসিমা, শিবুকে অন্য মাস্টার ঠিক পথে নিয়ে যেতে পারবে না। তারা লেখাপড়া শেখাতে পারবে, কিন্তু মানুষ করতে পারবে না। শিবু নিজেই পড়ে যাবে, মাই শিবু ইজ এ গুড বয়।
শিবু ম্লান মুখে দেওয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিল, আমার আর প্রাইভেট মাস্টার চাই না, আমি নিজেই পড়ব।
পিসিমা কোনো প্রতিবাদ করিলেন না। কিন্তু তাহার মনটা বেশ সন্তুষ্ট হইল না। পরদিনই মাস্টার বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিলেন, বড় হয়ে আমায় ভুলবি না তো শিবু?
শিবুর চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। মাস্টার হাসিয়া বলিলেন, তুই ভুলবি না, সে আমি জানি। আচ্ছা, মাঝে মাঝে আমি আসব। তুই কিন্তু একবার যাস। গেলে আমি ভারি খুশি হব। আচ্ছা, আসি।
শিবু আজ জাতিভেদ মানিল না, মাস্টারের পায়ে হাত দিয়া প্ৰণাম করিল। মাস্টারও সে প্রণাম লইতে দ্বিধা করিলেন না, আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া তিনি বলিলেন, গড ব্লেস ইউ, মাই বয়। ডোন্ট ফগেট, লাইফ ইজ নট অ্যান এম্পটি ড্রিম!