০৬. বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে

বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে।

লম্বা একজন কেউ এমনভাবে দাঁড়িয়ে যেন সে নিজেকে লুকাতে চাইছে। আগে বারান্দায় সারারাত পচিশ ওয়াটের একটা বাতি জ্বলতো—এখন জ্বলে না। সুইচে কি যেন গণ্ডগোল হয়েছে।

রাত প্রায় আটটা। দুটা টিউশানি শেষ করে ফিরতে-ফিরতে রাত সাড়ে নটার মতো বাজে, ভাগ্যিস আজ একটা বাড়িতে যেতে হয় নি। ছেলেটার গলাব্যথা, গলাব্যথা নিয়ে পড়বে না।

বারান্দায় পা দেয়ার আগেই জহির বলল, কে?

দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেন আরো একটু সরে গেল।

কে?

জহির ভাই, আমি তরু।

আরে রু। তুমি এখানে? কতক্ষণ ধরে আছ?

অনেকক্ষণ।

বল কি! দশটার আগে আসলে তো আমাকে পাওয়ার কথা না। ভাগ্যিস পেয়ে গেলে। আজ একটা ছেলে পড়ল না। ওর গলাব্যথা। তুমি…

কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না জহির ভাই। দরজা খুলুন।

জহির তালা খুলতে-খুলতে বলল, অপেক্ষা করার কোন দরকার ছিল না তরু। যখন দেখলে আমি নেই তখন একটা স্লিপ লিখে চলে গেলেই হত। তুমি স্লিপ লিখে চলে গেলেই আমি বাসায় চলে যেতাম।

আপনি এত বকবক করছেন কেন জহির ভাই। দরজাটা খুলুন না।

তোমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। চাবিটা কোথায় থাকে দেখ। আমার একটা চাবি সঙ্গে থাকে, আরেকটা চাবি জানালা খুলে একটু হাত বাড়ালেই পাবে। যদি কখনো এসে দেখ আমি নেই তখন হাত বাড়িয়ে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ফেলবে। তখন আর কষ্ট করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।

উফ আপনি এত কথা বলা শিখেছেন।

জহির লজ্জিত মুখে বলল, তোমাকে দেখে হঠাৎ এত ভালো লাগছে যে শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

তরু চোখ বড়-বড় করে তাকাল। জহির বলল, কেউ তো আমার কাছে আসে। না। হঠাৎ যখন কেউ এসে পড়ে এমন ভালো লাগে।

তরু বিছানায় বসতে-বসতে বলল, আমি তো জানি অরু আপা মাঝেমাঝে আপনার এখানে আসে। তাই না?

তা আসে, কাজে আসে। এসেই বলে, চললাম। বড় অদ্ভুত মেয়ে।

অদ্ভুত এবং সুন্দর—তাই না জহির ভাই?

হ্যাঁ। সুন্দর তো বটেই। মনটাও ভালো। সুন্দর মেয়েগুলির মন সাধারণত একটু ছোট থাকে, ওর সে রকম না।

আমি এত রাতে আপনার জন্য কেন বসে আছি তা কি জানেন?

না।

তাহলে জিজ্ঞেস করছেন না কেন?

জহির দেখল তরুর চোখ ভেজা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এতক্ষণ হয়ত কাঁদছিল। জহির অভিভূত হয়ে গেল। কাউকে কাঁদতে দেখলে তার বড় খারাপ লাগে। জহির কোমল গলায় বলল, কি হয়েছে তরু?

তরু ঘরের চারদিকে তাকাতে-তাকাতে বলল, ইস ঘর-দের কী করে রেখেছেন। আমি এসে সুন্দর করে সাজিয়ে দেব। ঘরভর্তি এত ক্যালেন্ডার কেন? এই জিনিসটাই খারাপ লাগে। এ কি, গত বছরের ক্যালেন্ডারও দেখি আছে।

জহির লজ্জিত গলায় বলল, ফেলা হয় নি। সুন্দর ক্যালেন্ডার, ফেলতে মায়া লাগল।

এত মায়া করলে চলবে না জহির ভাই। খুব প্রিয় জিনিসকেও ছুঁড়ে ফেলার সাহস থাকতে হবে।

তুমি কী জন্যে এসেছ বল। মামা-মামীর শরীর ভালো?

হুঁ।

তাহলে?

অরু আপা আপনার কাছে কবে এসেছিল?

কেন বল তো?

আপনি আমার কথার জবাব আগে দিন। কবে এসেছিল?

দিন তিনেক আগে।

কেন?

তা দিয়ে তোমার দরকার কি?

আহা বলেন না।

কিছু টাকার জন্যে।

কত টাকা?

তা দিয়ে তোমার দরকার কি?

দরকার আছে জহির ভাই। খুব দরকার। আপা পালিয়ে গেছে।

জহির হতভম্ব হয়ে বলল, তোমার কথা বুঝলাম না। পালিয়ে গেছে মানে?

আজ বিকেলে আজহার সাহেব এসেছিলেন, তাকে দুলাভাই বলব কিনা বুঝতে পারছি না। উনি বললেন, একটা চিঠি লিখে অরু পালিয়ে গেছে।

কি লেখা চিঠিতে?

আমি কী করে জানব চিঠিতে কী লেখা, চিঠি তো আর সঙ্গে করে নিয়ে আসেন নি। আমরা জানতে চাই নি চিঠিতে কী লেখা।

তোমরা ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনো কথা বললে না?

না। শুধু মা বলল, আপনি আমাদের কাছে এসেছেন কেন? আমরা ওর খবর আগেও রাখতাম না, এখনো রাখি না। তারপর ঐ লোকটা আপনার ঠিকানা চাইল। সেই ঠিকানাও আমরা দিলাম না।

দিলে না কেন?

আমি দিতে চাচ্ছিলাম কিন্তু বলার আগেই বাবা বললেন, জহিরের বাসা চিনি, ঠিকানা জানি না। লোকটা তখন আর কিছু না বলে চলে গেল। এরপর থেকেই বাসায় কান্নাকাটি চলছে। খুব খারাপ অবস্থা। এদিকে আবার মীরু…।

মীরু আবার কী করল?

আপনি আমার সঙ্গে একটু বাসায় চলুন তো।

চল যাই।

 

কে বলে বাসায় কোনো সমস্যা আছে।

সব স্বাভাবিক।

বরকত সাহেব উঠানে বসে পত্রিকা পড়ছেন। জহির এবং তরুকে মুখ তুলে একবার তাকিয়ে দেখলেন। মনে হচ্ছে খুবই জরুরি একটা খবর পড়ছেন। ওদের দিকে তাকিয়ে নষ্ট করার মতো সময়ও তার নেই।

জহির বলল, মামা ভালো আছেন?

বরকত সাহেব আবার তাকালেন। এবারো জবাব দিলেন না।

এসব কী শুনলাম তরুর কাছ থেকে?

নতুন কিছু শোন নি। নতুন কি শুনলে? অরু পালিয়ে গেছে এইতো শুনেছ? অরু কি আজ নতুন পালিয়েছে? আগেও তো পালিয়েছে। Itsnothingnew. একবার মানুষ যা করে, সেই জিনিসটাই সে বার বার করে। যাও ভেতরে যাও। Concerned হওয়ার কোনো দরকার নেই। সব ঠিকই আছে।

বরকত সাহেব স্বাভাবিক ভাব দেখাবার চেষ্টা করছেন।

ভেঙ্গে পড়েছেন শাহানা। সেই ভেঙ্গে পড়াটা অরুর কারণে না মীরুর কারণে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অরুর ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু মীরু কী করেছে?

মীরুর ঘরের দরজা বন্ধ। সেই ঘর অন্ধকার। কিছুক্ষণ পরপর ফুপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে।

জহির বলল, মামী মীরুর কী হয়েছে?

শাহানা খড়খড়ে গলায় বললেন, মীরুর তো কিছু হয় নি। মীরুর কথা কে তোমাকে বলেছে?

তরু বলছিল….

তরু কি পৃথিবীর সব জেনে বসে আছে? ওর জিহ্বাটা এত লম্বা কেন? কে তাকে বলেছে রাতদুপুরে তোমাকে ধরে নিয়ে আসতে? তুমি কে? তুমি করবেটা কি?

এত রাগ করছেন কেন মামী?

তোমার বোকামি দেখে রাগ করছি। তোমার মতে বোকা পুরুষ মানুষ দেখি নি। আমার কাছ থেকে তুমি যাও তো। তোমাকে দেখলেই রাগ লাগছে।

মামীর কথায় জহির রাগ করল না। একটা বড় রকমের সমস্যা যে হয়েছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সমস্যার সময় কারোর মাথা ঠিক থাকে না। মেয়েরা নার্ভাস হয়ে অকারণ রাগারাগি করে।

জহির রাত দশটা পর্যন্ত থেকেও বিশেষ কিছু জানতে পারল না। বরকত সাহেব পত্রিকার পাতা চোখের সামনে মেলে আগের মতোই বসে রইলেন। জহির যখন বলল, মামা আমি কি থাকব না চলে যাব?বরকত সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তোমার এখানে থাকার দরকারটা কি? তরু যে তোমাকে ধরে নিয়ে এসেছে তাতেই আমি রাগ করেছি। আমার সব কটা মেয়ে গাধা—শুধু গাধা না, গাধার গাধা।

তরু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বরকত সাহেব তাকেও প্রচণ্ড একটা ধমক দিলেন। এই ধমকের বিষয়বস্তু হল-গাধার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে জানালা বন্ধ করে রাখলে মশা ঘরে কম ঢোকে।

জহির চলে গেল।

 

জহির দুবার কলিং বেল টিপল।

মনে হয় আজহার সাহেব জহিরের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। দরজা খোলার আগেই বললেন, আসুন জহির সাহেব, আসুন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম আপনি আসবেন। ধারণা ছিল আরো পরে আসবেন। রাত বারটা-একটার দিকে। আগেই এসে পড়েছেন। কেমন আছেন জহির সাহেব?

জ্বি ভালো।

বসুন। এই বিছানায় আরাম করে পা তুলে বসুন। আপনাকে অনেকক্ষণ থাকতে হবে। কথা আছে।

বলুন কি কথা।

বলব। সবই বলব, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন ভাই? চা খান। দোকান থেকে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নিয়ে এসেছি। চা খাব আর গল্প করব।

আগে ব্যাপারটি কি বলুন।

ব্যাপার কিছুই নেই। ব্যাপার খুব সিম্পল—অরু চলে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় লিপিস্টিক দিয়ে লিখেছে–

যে ভাবে এসেছিলাম।
সে ভাবে চলে গেলাম।
চারদিকে লিলুয়া বাতাস।

কাব্য করার একটা প্রচেষ্টা। ফাজলামি আর কি। লিলুয়া বাতাস কি জানেন?

না।

ডিকশনারিতে পাবেন না। লিলুয়া বাতাস মানে হচ্ছে যে বাতাস মানুষ নিয়ে খেলা করে, মানুষকে উদাস করে, বিষণ্ণ করে। মৈমনসিংহ গীতিকায় আছে। আমিই শিখিয়েছিলাম।

ও চলে গেল কেন?

জানি না ভাই। সত্যি জানি না। উদ্ভট-উদ্ভট কথা সে আমার সম্পর্কে অনেককে বলে—যেমন আমি এখানে তাসের আড্ডা বসাই, মদের আড়াবসাই, আজেবাজে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করি। একটা কথাও ঠিক না। কেন সে এসব বলে তাও বুঝি না। আমি একজন শিক্ষক মানুষ। আজেবাজে সব কাণ্ডকারখানা ইচ্ছা থাকলেও আমি করতে পারব না।

আমি জানি সে আমার জন্য অনেক কিছু ছেড়েছে। আমিও কি তার জন্যে অনেক কিছু ছাড়ি নি? আমি কি তার জন্যে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সব ছাড়ি নি? আপনি কি জানেন যে আমার চাকরি চলে গেছে? বেসরকারি কলেজের চাকরি। আমার স্ত্রী কলেজ গভর্নিং বডিকে ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা বলেছে। শুধু তাই না, তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, এক মেয়েকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাজি করিয়েছেঐ মেয়ে লিখিত একটা অভিযোগ করেছে আমার সম্পর্কে। সেই অভিযোগ কি শুনতে চান? অভিযোগ হচ্ছে—একদিন বিকেলে এই মেয়ে আমার কাছে পড়া বুঝতে এসেছিল তখন নাকি আমি তার শাড়ি খুলে ফেলার চেষ্টা করেছি।

শিক্ষকতা আমার পছন্দ। আমি পড়াতে পছন্দ করি। কিন্তু আজ আমার সব গেছে। ঘরে বসে থাকি। কেরুর জীন কিনে নিয়ে আসি আর চুকচুক করে খাই।

জহির বলল, আপনি তো একটু আগে বললেন খান না; এইসব রটনা।

না পুরোপুরি রটনা না। টুথ কিছু আছে। সব সত্যির সঙ্গে যেমন মিথ্যা মেশানো থাকে তেমনি সব মিথ্যার সঙ্গেও সত্যি মেশানো থাকে। আপনি বসুন। আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাব।

কি দেখাবেন?

বললাম তো একটা মজার জিনিস। ইন্টারেস্টিং।

 

জহির বসে আছে। তার বসে থাকতে ভালো লাগছে না, আবার উঠে চলে যেতেও ইচ্ছে। করছে না। আজহার নামেরই এই মানুষটির সবাইকে মুগ্ধ করে রাখার একটা ক্ষমতা আছে।

জহির সাহেব?

জ্বি।

দেখুন তাকিয়ে, এর নাম কি বলুন?

জহির তাকিয়ে দেখল, জিনিসটির বিশেষ কোনো নাম মনে পড়ল না। বাঁকানো ধরনের একটা ছোরা। ছোরার হাতলে নানান ধরনের কারুকার্য। নীল, হলুদ কিছু পাথর বসানো।

আজহার সাহেব শান্ত গলায় বললেন, রাজপুত রমণীদের কাছে এই জিনিস থাকে। ওরা কোমরে গুজে রাখে। অরুও এটি জোগাড় করল এবং ঘোষণা করল, এটা সে কিনেছে একটা খুন করবার জন্যে। আমাকে সে খুন করবে। এখন বলুন, আপনাকে আপনার স্ত্রী এই কথা বললে আপনার শুনতে কেমন লাগত?

জহির বলল, অরু খুব রসিকতা করে।

আপনার সঙ্গে সে কি কখনো রসিকতা করেছে?

না।

তাহলে আমার সঙ্গে তার কিসের রসিকতা? আমি কি তাকে পা ধরে সেধেছিলাম, এস তুমি আমাকে বিয়ে করে উদ্ধার কর? না কখনো না। সে সায়েন্সের মেয়ে, আমি পড়াই ইতিহাস। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে কী মনে করে সে আমার একটা ক্লাস করতে এল-গল্পটা কি আপনি শুনতে চান?

বলুন।

আমি পড়াচ্ছিলাম সম্রাট অশোক এবং সম্রাট প্রিয়দর্শিনী। দুজন কি আসলে এক, না ভিন্ন? কে সম্রাট অশোেক, কে প্রিয়দর্শিনী? আমি ক্লাসে নানান ধরনের ড্রামা করতে পছন্দ করি। কিছু প্রাচীন ভারতীয় ভাষা জানি-গম্ভীর গলায় সেসব বলে একটা পুরানো আবহাওয়া তৈরি করি এইসব দেখে এই মেয়ে অন্য রকম হয়ে গেল। অল্পবয়েসী মেয়েদের মনে যখন প্ৰেম আসে তখন তা আসে টাইডাল ওয়েরে মতো। অরু নিজে তো ভেসে গেলই, আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এই আমি একজন বুড়োমানুষ। ওল্ড ম্যান। 13thNov 1940-তে আমার জন্ম। আমার বয়স হিসেব করে দেখুন। এই মেয়ে তার নিজের যতটুকু না সর্বনাশ করল, আমার করল তার চেয়ে বেশি। এখন সে বলে বেড়াচ্ছে অবিশ্বাস্য সব কথা।

আমার এক বন্ধু না-কি রান্নাঘরে গিয়ে তার নাভিতে হাত দিয়েছে। আমার ঐ বন্ধুটি চারিত্রিক দিক থেকে মহাপুরুষ ধরনের। সে মাঝে-সাঝে আমার এখানে এসে তাস খেলত। তার পক্ষে…..

আজহার সাহেব আপনি বলেছিলেন এখানে তাস খেলা হয় না।

বলেছিলাম? হা শুরুতে বলেছিলেন।

মাঝে-মাঝে তাস খেলা হয়। Once inafull-moon. এই বাড়ি তো আর মসজিদ বা মন্দির না যে এখানে তাস খেলা যাবে না। আপনি তাহলে পুরোপুরি সত্যি কথা বলছেন না।

আরে ভাই কী মুশকিল পুরোপুরি সত্য কথা কেউ বলে না। কেন বলবে? মানুষতো আর কম্পিউটার না যে পুরোপুরি সত্যি কথা বলবে। একমাত্র কম্পিউটার পুরোপুরি সত্যি কথা বলে। এই জন্যেই কম্পিউটারের প্রেমে পড়া যায় না। মানুষের প্রেমে পড়া যায়।

ভাই আমি উঠি।

উঠতে চান?

হ্যাঁ।

যেসব কথা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম তার একটি কথাও আপনাকে এখনো বলা হয় নি।

বলুন।

নাম্বার ওয়ান, আমার ধারণা অরু জীবিত নেই। চমকে উঠবেন না। চমকে ওঠার মতো কিছু না। আমার আরো একজন স্ত্রী আছে যে অরুকে হত্যা করার জন্যে তোক লাগিয়েছে—এই গুজব বাজারে আছে। নাম্বার টু মেয়েটা অসুস্থ। সে নিজেও আত্মহত্যা করতে পারে। নাম্বার থ্রি, সে অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে, গুণ্ডা-পাণ্ডাদের হাতে পড়লেও একই জিনিস হবে। গ্যাং রেপ বলে একটি কথা আছে। আপনি শুনেছেন কিনা জানি না। আপনাকে যে রকম সুফি মানুষ বলে মনে হয়, আপনার না শোনারই কথা। গ্যাং রেপ বিষয়টি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরুন পাঁচজন যুবক এবং একজন তরুণী আছে। যুবকরা সবাই লাইন ধরে অপেক্ষা করছে……

জহির বলল, দয়া করে চুপ করুন, আপনি ক্রমাগত আজেবাজে কথা বলছেন। কেন বলছেন?

বলছি কারণ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মেয়েটা মারা গেলে আমি বিরাট বিপদে পড়ে যাব। পুলিশ কোনো না কোনো সূত্র বের করে আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। বিজ্ঞ জজ সাহেব দড়িতে ঝুলিয়ে দেবেন। জজ সাহেবরা নিজেরা যেহেতু কখনো দড়িতে ঝোলেন না, তারা জানেন না ব্যাপারটা কি। কাজেই I am going to die.

আজহার সাহেব।

জ্বি।

আপনি কি মদ্যপান করেছেন?

বেশি করতে পারি নি, অল্প করেছি। এত পয়সা আমার কোথায় ভাই? আপনাকে আমি এখন একটা রিকোয়েস্ট করব। যদি চান আপনার পায়ে ধরেই রিকোয়েস্ট করব। সেটা হচ্ছে আমি জানি অরু যদি বেঁচে থাকে তাহলে সে আপনার সঙ্গে দেখা করবেই। আপনি তখন দয়া করে আমাকে সেটা জানাবেন।

আমার সঙ্গে দেখা করবে কেন?

কারণ আপনাকে সে ভালবাসে। আপনি একটা মহা গাধা বলে এই সহজ জিনিসটা ধরতে পারেন নি। শুধু যে সেই আপনাকে ভালবাসে তাই না, অরুর ছোট বোন তরু…..ঐ মেয়েটিও আপনার জন্যে পাগল। এই তথ্যটাও আপনার জানা নেই। আপনি তো ভাই বিশ্বপ্রেমিক।

জহির চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। আজহার সাহেব বললেন, বোকামি ছাড়া আপনার মধ্যে এমন কিছু নেই যা চোখে পড়ে। এই বোকামির জন্যেও যে মেয়েরা প্রেমে পড়তে পারে তা আমার জানা ছিল না। আপনি এখন যদি চলে চান, চলে যেতে পারেন। বোকা মানুষদের আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না।

A rich man you can tolerate many times
A wise man can only twice be tolerated
But a fool..

বাকিটা শেষ করলাম না। শেষ করলে মনে কষ্ট পাবেন। আসুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

এগিয়ে দিতে হবে না।

হবে রে ভাই হবে। এগিয়ে দিতে হবে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা নিয়ে এইজন্যেই যাচ্ছি। সেতুলে দিয়ে আসব। এতটুকু গুণ আমার আছে। তা ছাড়া জানেন না বোধ হয় যে মাতালদের ভদ্রতাবোধ হয় অসাধারণ।

আপনি মাতাল হন নি।

হয়েছি। মাতাল হয়েছি। ভালোমতোই হয়েছি। মদ না খেয়েও মানুষ মাতাল হতে পারে। একটা ভালো কবিতা পড়ে মাতাল হতে পারে, একটা সুন্দর সুর শুনে মাতাল হতে পারে, প্রেমে পড়েও মাতাল হতে পারে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে আজহার সাহেব বললেন, মাতালদের ফেভারে কিছু চমৎকার কথা আছে আপনাকে বলছি শুনুন। অরুকে বলায় অরু খুব মজা পেয়েছিল আপনিও পাবেন। আপনি তো অরুর বন্ধু-বলব?

বলুন।

একজন মাতাল অতি সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে।
একজন ঘুমন্ত মানুষ কোনো পাপ করতে পারে না।
যে পাপ করতে পারে না সে স্বর্গে যায়।
কাজেই মাতালরা সব সময় স্বর্গে যায়।

মজার কবিতা না?

জহির জবাব দিল না। রাস্তায় প্রচণ্ড বৃষ্টি। আজহার সাহেব নিজে ভিজতে-ভিজতে অনেক ঝামেলা করে জহিরকে একটা রিকশা করে দিলেন। রিকশায় উঠবার ঠিক আগমুহূর্তে বললেন, আপনাকে অনেক মন্দ কথা বলেছি, দয়া করে মনে কিছু করবেন না। আপনার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছি—অরুর ব্যক্তিগত একটা খাতা–ডায়েরিও বলতে পারেন। আমার সম্পর্কে এই খাতায় সে অনেক কিছু লিখেছে। পাশাপাশি আপনার কথাও লিখেছে। পড়লে আপনার ভালো লাগবে।

তাই নাকি?

জ্বি। অরু ফিরে না এলে আমি পাগল হয়ে যাব জহির সাহেব।

আজহার সাহেব রিকশাওয়ালা এবং আশেপাশের দুএকজন মানুষকে সচকিত করে হঠাৎ হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন। মাতালের কান্না নয়, জগৎ সংসার ছারখার হয়ে যাওয়া একজন মানুষের কান্না। রিকশাওয়ালা পর্যন্ত অভিভূত হয়ে বলল, ভাইজান কাইন্দেন না-আল্লারে ডাকেন। আল্লা ছাড়া আমরার আর কে আছে।

 

সুন্দর ডায়েরিতে মেয়েরা খুব যত্ন করে অনেক কিছু লেখে। এই লেখা মোটেই এরকম নয়। মোটা লাইন টানা একটা খাতা। শুরুতে বায়োলজির নোট নেবার জন্যে হয়ত কেনা হয়েছিল। বায়োলজির নানান প্রসঙ্গে খাতা ভর্তি। তার ফাঁকে-ফাঁকে অন্য সব কথা। হয়ত ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে দীর্ঘ একটা লেখার ফাঁকে চার লাইনের সম্পূর্ণ অন্য একটা লেখা।

জহির সারারাত জেগে লেখাগুলি পড়ল—

 

** জহির ভাইকে নিয়ে আজ মার সঙ্গে ঝগড়া হল। ঝগড়া হবার মতো কোনো ঘটনা ছিল না তবু হল। আসলে অন্য একটা ব্যাপারে আমি মার ওপর রেগে ছিলাম। সুযোগ পেয়ে রাগ ঝাড়লাম। মা খুব অবাক হলেন আমি জহির ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে এত কথা বলছি কেন? মাঝখান থেকে বেচারা জহির ভাই খুব সজ্জা পেলেন। আমার মনে হচ্ছে বেচারা আর অনেকদিন আমাদের বাসায় আসবেন না। এরকম ছোটখাট একটা ঘটনা ঘটে আর জহির ভাই সপ্তাহখানেক এ বাসায় আসা ছেড়ে দেন। আজকের সমস্যার সূত্রপাত হল এইভাবে-জহির ভাইকে বাজারে পাঠানো হয়েছিল, তিনি বাইম মাছ নিয়ে এসেছেন। সেই বাইম মাছ দেখে মা তাঁর স্বভাব মতো অগ্ন্যুৎপাত শুরু করলেন সাপের মতো দেখতে একটা মাছ তুমি কি মনে করে আনলে? কে খাবে এই মাছ?

আমি তখন বললাম, ওমাবাইম মাছ! আমার খুব ফেভারিট মাছ।

জহির ভাই আনন্দিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টি দেখে আমার বড় ভালো লাগল। আহা বেচারা! মা হতভম্ব। তিনি বললেন, বাইম মাছ তোর পছন্দ? তুই কবে খেয়েছিস?

আমি কখনো খাই নি তবু বুঝতে পারছি এ মাছ খেতে অসাধারণ হবে।

জহির ভাই বিব্রত গলায় বললেন, আমি বদলে নিয়ে আসছি।

আমি বললাম—অসম্ভব। আমি আজ বাইম মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ খাবই না।

 

** তরু জহির ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন কথা বলছিল। ওরা বারান্দায় বসে কথা বলছিল। অবাক হয়ে দেখি তরুর গাল পাল, মাথা নিচু হয়ে আছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়েই তরু থেমে গেল এবং চোখমুখ কেমন করে যেন তাকাল। তাকানোর এই দৃষ্টি আমি চিনি। আমি কেন, সবাই চেনে। শুধু গাধার গাধা জহির ভাই চেনেন না। কোনোদিন চিনবেনও না। আমি তরুকে ডেকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। বললাম, জহির ভাইয়ের সঙ্গে কী কথা বলছিলি?

কোনো কথা বলছিলাম না তো।

কোনো কথা বলছিলি না?

ক্লাসের একটা মেয়ের কথা বলছিলাম।

কি কথা?

মেয়েটার নাম তৃষ্ণাও একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে—ছেলেটা ওদের আত্মীয়—ঐ গল্পটা বলছিলাম।

কেন?

কথায় কথায় চলে আসল–ওর কথা তোমাকেও তো বলেছি।

আমি হঠাৎ রুর গালে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলাম। এই কাজটা আমি কেন করলাম তরু কি তা বুঝতে পারল?

অবশ্যই পারল। আমি যেমন মেয়ে তরুও তো তেমনি মেয়ে। ও কেন পারবে না? ওকে চড়টা দিয়েই আমি দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলাম। তরু আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করতে লাগল। আহা রে, এত ভালো কেন আমার বোনটা।

 

** জহির ভাইকে আমার এত ভালো লাগে কেন তা বুঝতে চেষ্টা করছি। কারণ নেই। কোনো কারণ নেই। এই মানুষটা একটা অকাট গাধা, একটা ছাগল। একবারের কথা, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ঢাকায় ফিরছি। আমি বললাম, জহির ভাই আসুন আমরা ডেকের বেঞ্চিতে বসে চাঁদের আলো দেখতে-দেখতে যাই। গাধাটা বলল, ঠাণ্ডা লাগবে না। আমি বললাম, লাওক। আমি একা-একা বসে আছি, গাধাটা কোত্থেকে একটা কম্বল না কী-যেন এনে আমার গায়ে জড়িয়ে দিল। যখন কম্বলটা জড়িয়ে দিচ্ছে তখন হঠাৎ কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল। এর নামই কি ভালবাসা? এই ভালবাসা কোথায় লুকিয়ে থাকে? কোন অচেনা জগতে? কোন অচেনা ভূবনে? কি করে সে আসে? কেন সে আসে? কেন সে আমাদের অভিভূত করে?

জহির ভাই আমার পাশে বসলেন। জড়সড় হয়ে বসলেন। একটু সরে বসলেন, যেন গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়। আমি বললাম, এমন দূরে সরে বসেছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমার গার সঙ্গে গা লাগলে আপনার পাপ হবে?

জহির ভাই বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।

আমি বললাম, আসুন তত আপনি আমার আরো কাছে সরে আসুন।

তিনি কাছে এলেন, আমি মনে-মনে বললাম, জনম জনম তব তরে কাঁদিব।

কি আশ্চর্য! কেন কাঁদব? কী আছে এই মানুষটির? হে ঈশর, ভালবাসা কী আমাকে বুঝিয়ে দাও।

 

** রাত কত হবে?

দুটা? তিনটা? না তার চেয়েও বেশি। আমি দরজা খুলে বের হলাম। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে। কী জোছনা। জোছনায় মন এমন করে কেন? অনেকক্ষণ বসে রইলাম বারান্দায় আমার মাথাটা হঠাৎ গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমি বসার ঘরে ঢুকলাম। ওখানে একটা খাটে জহির ভাই কদিন ধরে আছেন। আমি ঘরে ঢুকলাম খুব সাবধানে। আমি একটা ঘরের মধ্যে আছি। কি করছি বুঝতে পারছি না। জহির ভাইয়ের টের পাশে বসলাম। আমার ধারণা ছিল তিনি ঘুমাচ্ছেন। আসলে তিনি ঘুমুচ্ছিলেন না। আমি পাশে বসা মাত্র জহির ভাই বললেন, অরু—তুমি ঘুমাতে যাও। আমি একটা কথা না বলে উঠে চলে এলাম। এর পরে কতবার দেখা হল, আমরা দুজনে এমন ভাব করলাম যেন এমন একটি ঘটনা কোনো দিন ঘটে নি। কিংবা কে জানে, হয়ত সত্যি এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। হয়ত এটা একটা স্বপ্নদৃশ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *