‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’ নামের একটা বিষয় আছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকরা বাটারফ্লাই এফেক্টকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। ‘পৃথিবীর এক প্রান্তে প্রজাপতির পাখার কাঁপনে অন্যপ্রান্তে প্ৰচণ্ড ঘূর্ণিঝড় হতে পারে এই হল ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন কলেজের সামনের রাস্তায় বাটারফ্লাই এফেক্টের লীলাভূমি। কিছুদিন পরপর এইসব রাস্তায় ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে যার উৎপত্তি হয়ত রেইনফরেষ্টের কোনো গাছের পাতার কাঁপন।
ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তায় এই ঘটনাই এখন ঘটছে আমি তার একজন দর্শক।
দু’টা বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি দোতলা বাস। বাস দুটির অপরাধ কি কেউ বলতে পারছে না। বিনা অপরাধেতো কেউ শাস্তি পায় না। বাস দু’টি নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোনো অপরাধ করেছে।
হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে কয়েকটা প্রাইভেট কারের কাঁচ ভাঙা হয়েছে। মন হয় আরো হবে। গাড়ির কাঁচ ভাঙ্গার দৃশ্য সুন্দর। কাচগুলি পাউডারের মত গুড়া হয়ে যায়। গুড়া অবস্থায় ঝিকমিক করে আলো দেয়।
ঢাকা কলেজের পাশেই সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে পুলিশ ফাড়ি। সেখান থেকে কয়েকজন পুলিশ এসেছিল। ছাত্ররা ধাওয়া করে তারা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফেরত পাঠিয়েছে। পুলিশরা এখন সিগারেট ধরিয়ে রিল্যাক্স করছে। তাদেরকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। অল্পতেই ঝামেলা থেকে উদ্ধারের আনন্দ।
টায়ার জ্বালানো হয়েছে। টায়ার থেকে বুন্কা বুন্কা ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি মোটামুটি নিরীহ টাইপ একজনকে (তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র। চেনার উপায় কলেজের মনোগ্রাম বসানো হাফ হাতা সার্ট হিটলার টাইপ গোঁফ রেখেছে, কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে চার্লি চ্যাপলিনের ম,) জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ঘটনা কি?
তিনি বললেন, ঢাকা কলেজের এক ছাত্রকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে রাস্তায় ফেলেছে।
আমি আৎকে উঠে বললাম, বলেন কি। ঢাকা কলেজের ছাত্র পরিচয় পাবার পর তাকে তো কোলে করে নামানো দরকার ছিল। কোলে করে নামিয়ে টা টা বাই বাই বলে একটা ফ্লাইং কিস।
আপনি কে?
আমি কেউ না। দর্শক। আপনারা চমৎকার খেলা খেলছেন, দর্শক লাগবে না?
চার্লি চ্যাপলিন হঠাৎ উগ্ৰমূর্তি ধারণ করলেন। গলা উঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, হামিদ ভাই! হামিদ ভাই এদিকে আসেন। এই লোক ছাত্রদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।
হামিদ ভাই নামে যাকে ডাকা হল তিনি অসম্ভব ব্যস্ত। তিনি পেট্রোল দিয়ে গাড়িতে আগুন ধরানোর দায়িত্বে আছেন। পেট্রোল ভর্তি জেরিকেন নিয়ে ছোটাছুটি করছেন।
আমি বললাম, হামিদ ভাই ব্যস্ত আছেন যা করার আপনাকেই করতে হবে। একটা প্রশ্নের উত্তর দিনতো গাড়িতে আগুন দেয়ার পেট্রোল কি আপনাদের কাছে মজুদ থাকে?
প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই বিকট শব্দে দুটা ককটেল ফাটলো। একই সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমি তাকে টেনে কোলে তুললাম।
এর মধ্যে হামিদ ভাই এসে দাঁড়িয়েছেন। হামিদ ভাই এর পাশে আরেকজন তার হাতে চাপাতি। চাপাতি নিশ্চয়ই মেজে ঘসে রাখা হয়। সূর্যের আলোয় ঝক ঝক করছে।
হামিদ ভাই বললেন, এই লোক সমস্যা করছে? হ্যালো ব্রাদার আপনি কে?
আমি বললাম, আলাপ পরিচয় পরে হবে। এই মেয়েটাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আপনাদের কাপ্তকারখানা দেখে বেচারি। আনন্দে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
হামিদ ভাই বললেন, অল্পের উপর ছাড়া পেয়ে গেলেন। এই মেয়ে না থাকলে আপনার আজ খবর ছিল।
চাপাতি ভাইয়া চাপাতি দুলিয়ে কি খবর হতে পারে তার নমুনা দেখালেন।
যে মেয়েটি আমার কোলে তাকে আমি চিনি। তার নাম তানিজা। বেচারী নিশ্চয়ই তার বাবা কিংবা মা’র সঙ্গে এই এলাকায় কেনাকাটা করতে গিয়ে বাটারফ্লাই এর চক্রে পড়েছে।
তানিজকে ডাক্তারখানায় নেয়ার আগেই তার জ্ঞান ফিরল। সে বেশ স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে সামান্য কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি বললাম, তানিজা আমাকে চিনেছ?
তানিজা হ্যাঁ সূচক মাথা নাডুল। ফিসফিস করে বলল, মা কোথায়?
আমি বললাম, মা নিশ্চয়ই তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোমার কোনো ভয় নেই। আমি যথাসময়ে তোমাকে তোমার মা’র হাতে তুলে দেব। আইসক্রিম খবে?
হুঁ।
কোন ফ্লেভার?
ভ্যানিলা। আপনার পা খালি কেন?
তানিজা! আমি সব সময় খালি পায়েই থাকি।
কেন?
মাটি হচ্ছে আমাদের মা। মায়ের স্পর্শ শরীরে সারাক্ষণ লাগানো আনন্দের ব্যাপার না?
তানিজা বলল, মাটি মা হলে আপনি তো মা’কে পাড়িয়ে তার উপর হাঁটছেন।
আমি তানিজার যুক্তিতে চমৎকৃত হলাম। শিশুরা মাঝে মাঝে সুন্দর যুক্তি দেয়।
প্রথমে তানিজকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। সেখানে কেউ নেই। দরজায় তালা লাগানো; বাসায় কাজের মেয়ে আছে। সে তালাবদ্ধ যাতে বের হতে না পারে। কাজের মেয়ের কাছে মেসের ঠিকানা দিয়ে এলাম।
পেনসিল ওসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করে জানলাম হারানো শিশুর বিষয়ে এখনো কেউ থানায় যোগাযোগ করে নি।
তানিজা তার মায়ের মোবাইল নাম্বার জানে সেখানে টেলিফোন করা হল। কেউ ধরল না। তানিজা তার বাবা কোন অফিসে চাকরি করে তা বলতে পারল না।
তানিজ দুপুরে কি খাবে?
পিজা খাব। আর ঠাণ্ড কোক খাব। মা আমাকে ঠাণ্ড কোক খেতে দেয়
না।
ঠাণ্ডা কোক খেলে কি হয় জান?
না।
টনসিল ফুলে যায়। জ্বর হয়।
তাহলে তো বিরাট সমস্যা।
দুপুরে আমরা পিজা খেলাম। তানিজা ঠাণ্ড কোক খেতে খেতে বলল, মামা চল এখন মা’কে খুঁজে বের করি।
মেয়েটা কিছুক্ষণ হল আমাকে মামা ডাকা শুরু করেছে। গোপন কথা বলা শুরু করেছে। আজ তার জন্মদিন এটা জানলাম। জন্মদিনে তার মা রাতে তাকে পিজাহাটে নিয়ে যাবে বলেছিল। এখন যেহেতু দুপুরে পিজা খাওয়া হয়েছে, রাতে না খেয়েও চলবে।
মামা তুমি কি জান আমার বাবা আমাদের সঙ্গে থাকে না।
জানি না তো।
মা’র সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা থাকে। মা বাবাকে বলল, এই মুহুর্তে তুমি বের হয়ে যাবে। বাবা বলল, এত রাতে আমি কোথায় যাব? মা বলল, জাহান্নামে যাও। বাবা বলল, জাহান্নাম আমি কোথায় পাব?
তোমার বাবাকেতো মনে হচ্ছে রসিক মানুষ।
হুঁ। মা রসিক মানুষ পছন্দ করে না। মা বাবাকে ডাকে গোপাল ভাঁড়।
গোপাল ভাঁড় কে তুমি চেন?
আমি চিনি না। আমার মনে হয়। সে দুষ্ট লোক। তাই না?
হতে পারে।
বড়দের ঝগড়া করতে হয় না।
অবশ্যই হয় না।
বাবাকে বকে দিও।
নিশ্চয়ই বিকে দিব।
মা’কে কিন্তু বকা দিও না। মা খুব রাগী। বকা দিলে মা রাগ করবে।
খুব রাগী হলে তাকে বকা দেব না। রাগী মেয়েদের আমি খুবই ভয় পাই।
আমি আমার মা’কে অল্প ভয় পাই। বাবা বেশি ভয় পায়।
অল্প ভয় পাওয়াই ভাল।
আমরা আবার ঢাকা কলেজের সামনে ফিরে গেলাম। অস্থির মা মেয়ের সন্ধানে সেখানেই ঘোরাঘুরি করার কথা। তাকে পাওয়া গেল না। ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তা পুরোপুরি স্বাভাবিক। গাড়ি চলছে, রিকশা চলছে। ফুটপাত দখল করে হকাররা বসে আছে। কর্মহীন মহিলারা জামা কাপড় দেখে বেড়াচ্ছে। কিছুই তাদের পছন্দ হচ্ছে না। কলেজের ভেতর ক্লাসও মনে হয় শুরু হয়েছে। আমি নিশ্চিত চাপাতিওয়ালা বিছানার নিচে চাপাতি রেখে কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রির ক্লাস করছে।
তানিজা বলল, মা’কে পাওয়া না গেলে অসুবিধা নাই। মামা আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
আমি বললাম, আমারও কোনো অসুবিধা নাই। রাতে জন্মদিনের কেক কাটার ব্যবস্থা করতে হবে।
মামা আমি চিড়িয়াখানায় যাব। আমাকে কেউ চিড়িয়াখানায় নিয়ে যায় নি। মা বলেছিল জন্মদিনে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে।
চল চিড়িয়াখানায় যাই।। জীবজন্তু দেখে আসি।
রাতে আমি খাব বাৰ্গার।
বাৰ্গারের সঙ্গে ঠাণ্ড কোক খাবে না?
হুঁ খাব।
চিড়িয়াখানার জীবজন্তু দেখে আমি তানিজকে নিয়ে চলে গেলাম সোনারগাঁ হোটেলে। মেয়েটাকে কিছুক্ষণের জন্যে এলিতার হাতে দিয়ে দেয়া যাক। তানিজা এখন বিরতিহীন কথা বলে আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।
এলিতা আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলে বলল, কি ব্যাপার?
আমি বললাম, তুমি আমাকে একশ ডলার দিয়েছ। আমার পেমেন্ট ঠিক হয় নি। বাকি টাকাটা নিতে এসেছি।
একদিন কাজ করেছ একশ ডলার দিয়েছি।
এয়ারপোর্টে তোমাকে আনতে গিয়েছিলাম। ঐ দিনের হিসবাতো ধর নি।
সরি। আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। তোমার সঙ্গে এই মেয়েটা কে?
ওকে পথে কুড়িয়ে পেয়েছি। ওর নাম তানিজা।
পথে কুড়িয়ে পেয়েছ মানে কি? তোমাদের দেশে কি এমন শিশু পথে কুড়িয়ে পাওয়া যায়?
আমি বললাম, হ্যাঁ আমাদের দেশে কুড়িয়ে পাওয়া যায়। যথাসময়ে বাবা মা এসে তাদের নিয়ে যায়। তোমার দেশে যে সব শিশু হারিয়ে যায়। তাদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। গত বছরের স্ট্যাটিসটিকসে এসেছে তিনশ পনেরো জন শিশু হারিয়েছে যাদের খোঁজ কেউ জানে না। ভুল বলেছি?
এলিতা জবাব দিল না। চুপ করে রইল।
তুমি কি তানিজকে কিছুক্ষণ রাখতে পারবে? রাত দশটা পর্যন্ত। রাত দশটার মধ্যে তার বাবা এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে।
তারা জানবে কিভাবে যে এই মেয়ে আমার কাছে আছে?
জানবে। যে কোনোভাবেই হোক জানবে।
এলিতা বলল, আমি কোনো ঝামেলায় জড়াব না। এই মেয়েকে রাখব না।
আমি বললাম, আজ তোমার জন্মদিন। জন্মদিনে একা একা থাকবে?
জন্মদিন জান কিভাবে?
তুমি নিজের সম্পর্কে যে ই-মেইল পাঠিয়েছ। সেখানে জন্মদিন লেখা আছে। ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার কি জান? আজ তানিজা মেয়েটিরও জন্মদিন।
এলিতা তানিজার তাকিয়ে বলল, হ্যাপি বার্থডে তানিজা। তানিজা মিষ্টি করে হাসল। তানিজা এখনো কথা বলা শুরু করে নি। কথা বলা শুরু করলে এলিতা বুঝবে কি জিনিস রেখে যাচ্ছি।
এলিতার কাছ থেকে একশ ডলার নিয়ে সোনারগাঁ হোটেলের বেকারি থেকে জন্মদিনের কেক কিনে এলিতার ঘরে পাঠিয়ে দিলাম।
কেকের উপর ফুল লতা পাতার ফাঁকে বাংলায় লেখা
তানিজা
এলিতা
হারিয়ে যাওয়া সব সময়ই আনন্দময়।
এলিতার এই বাংলা পড়ে বুঝতে পারার কথা।
মেসে ফিরে দেখি তানিজার মা আমার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। আমাকে দেখেই তাঁর প্রথম কথা, আমার মেয়ে কই?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আপনার মেয়েকে উপহার হিসেবে একজনকে দিয়ে এসেছি। ঐ মেয়ের ছিল জন্মদিন। জন্মদিনের উপহার।
কি বললেন?
কি বললাম তাতো শুনেছেন। তারপরেও আরেকবার স্পষ্ট করে বলছি, আপনার মেয়েকে উপহার হিসেবে একজনকে দিয়ে এসেছি।
আমি আপনাকে খুন করে ফেলব।
খুন করতে চাইলে করতে পারেন। আসুন ঘরে আসুন। কি পদ্ধতিতে খুন করবেন। সেটা শুনি।
আমি আপনাকে র্যাবের হাতে তুলে দিব। র্যাব আপনাকে ক্রসফায়ারে মারবে।
ক্রসফায়ারে মেরে ফেললে তো আপনি মেয়ের কোনো সন্ধান পাবেন না। ক্রসফায়ারের কথা। আপাতত ভুলে যান। আসুন শর্ত নিয়ে আলোচনা করি।
শর্ত মানে। কিসের শর্ত?
যে শর্তে আমি আপনাকে তানিজার সন্ধান দিতে পারি।
মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যাবেন! আবার শর্ত দেবেন? মগের মুলুক পেয়েছেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমার কাছে মগের মুলুক না। আমার কাছে বাংলা মুলুক। আপনার কাছে মগের মুলুক। স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যাবেন। মেয়ে হারিয়ে ফেলবেন। যে আপনার মেয়েকে খুঁজে পেয়েছে তাকে ক্রসফায়ারে দেবেন?
কথার কচকচানিতে আমি যাব না। এক্ষুনি আমার মেয়েকে দিতে হবে। যদি না দেন তার পরিণাম ভাল হবে না।
আপনি চিৎকার বন্ধ করে স্বামীকে নিয়ে আসুন। দু’জনে মুচলেকা দিন কখনো ঝগড়া করবেন না। তারপর মেয়ের সন্ধান দেব। তার আগে না। ভাল কথা আপনার হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই। আপনার মেয়ে দেশের বাইরে চলে যাবে। মনে হয় ইন্ডিয়ায় যাবে। জানেন নিশ্চয়ই ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে গরু আসে, বিনিময়ে আমরা নানান বয়সের মেয়ে পাচার করি।
আমার শেষ কথাতে কাজ হল। তানিজার মা টেলিফোন করে তানিজার বাবাকে আনলেন। এই ভদ্রলোক মেয়ে হারানোর কথা কিছুই জানতেন না। সব শুনে তার হার্ট এ্যাটাকের মত হল। বুকে হাত দিয়ে বিড় বিড় করে বললেন, শাহানা আমার বুকে ব্যথা করছে। আমার বুকে ব্যথা করছে।
শাহানা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কাগজে কি লিখতে হবে বলুন। আমরা লিখে দিচ্ছি।
আমি বললাম, কিছু লিখতে হবে না। দু’জন এক সঙ্গে মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবেন এটাই যথেষ্ট। আপনার মেয়ে আছে সোনারগাঁ হোটেলে রুম নাম্বার ৭৩২, এই রুমে একটা পরী থাকে। পরীটার নাম এলিতা। আপনার মেয়েকে পরীর হেফাজতে রেখে এসেছি।
মা-বাবা দুজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তারা আমার কথায় পুরোপুরি বিভ্ৰান্ত। আমি বললাম, দেরী করবেন না চলে যান।
তানিজার বাবার মনে হয় আবার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। তিনি বুকে হাত দিয়ে কুঁ কুঁ শব্দ করছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েকে দেখতে পাবেন। উঠে দাঁড়ান তো।
তানিজার বাবা বললেন, ভাই আপনি চলুন আমাদের সঙ্গে।
আমি বললাম, আজ রাস্তায় রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটব তারপর আমার এক খালাতো ভাই বাদলের সন্ধানে যাব। ওকে অনেক দিন দেখি না।
তানিজার বাবা কাদো কঁদো গলায় বললেন, ভাই মেয়েটাকে পাব তো?
আমি বললাম, অবশ্যই পাবেন। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে ভালবাসা এবং মমতায় তাকে রাখবেন। আপনাদের মধ্যে ঝগড়া হলে এই মেয়ে আবারো হারিয়ে যাবে। এটা যেন মাথায় থাকে। দ্বিতীয়বার হারিয়ে গেলেও ফেরত পাবেন। তৃতীয়বার হারালে আর পাবেন না। একে বলে দানে দানে তিন দান। তিনের চক্ৰ।
বেল টিপতেই মেজো খালু (বাদলের বাবা)। দরজা খুলে দিলেন, আমাকে দেখে হাহাকার ধ্বনি তুললেন, হিমু সর্বনাশ হয়ে গেছে। তোমার খালা চলে গেছেন।
খালা চলে গেলে খালুর খুশি হওয়া উচিত। উনি মনের সুখে ছাদে বোতল নিয়ে বসতে পারবেন। হাহাকার ধ্বনির অর্থ বুঝলাম না।
খালু হতাশ গলায় বললেন, দুপুরে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছে। সে শাহরুখ খানের প্রোগ্রাম দেখবে। আমি বললাম পুরুষ মানুষের স্টেজে ফালাফালি করবে। এটা দেখার কি আছে। তোমার খালা বলল, আমি তোমার সঙ্গে বাস করব না; আমি বললাম, নো প্রবলেম। গো টু শাহরুখ খান। তার কোমড় জড়িয়ে ধরে নৃত্য কর। কথা শেষ করার আধঘণ্টার মাথায় সে স্যুটকেস গুছিয়ে চলে গেল।
আমি বললাম, শাহরুখ খানের কাছে নিশ্চয়ই যান নি। নিজের বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। আপনি এত অস্থির হচ্ছেন কেন?
খালু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, মূল ঘটনা তুমি বুঝতে পারিছ না। তোমার খালা কিংখানের কাছে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। সে আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আমার বোতল নিয়ে গেছে।
বলেন কি! উনিও বোতল ধরেছেন?
সব কিছু নিয়ে ফাজলামি করবে না। ঘটনা বুঝার চেষ্টা কর। আমি একটা সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কি এনে রেখেছি। শুভদিন দেখে বোতল খুলব। তোমার খালা চলে গেছেন এটা একটা শুভ দিন। বরফ গ্লাস সব নিয়ে বোতলের খোঁজ করতে দেখি বোতল নাই। তোমার অতি চালাক খালা আমাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে এই কাজ করেছে। এখন কি করি বল।
বরফ মেশানো পানি খেয়ে শুয়ে থাকবেন?
আবার ফাজলামি? তুমি গাড়ি নিয়ে যাও। তোমার অতি চালাক খালার কাছ থেকে বোতল রিলিজ করে নিয়ে আস।
আমি বললাম, খালা মদের বোতল নিয়ে তার বাবার বাড়িতে যাবেন না। আপনার বোতল তিনি কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন।
কোথায় লুকিয়ে রাখবে?
নিজের শোবার ঘরে রাখবেন না। সেখানে ধর্মের বই পত্ৰ আছে। বোতল ভেঙ্গে ফেলেও দিবেন না। বাঙ্গালী মেয়েরা দামি জিনিস তা সে যতই ক্ষতিকর হোক, ফেলে না। ডেট এক্সপায়ার হওয়া অষুধও জমা করে রাখে।
খালু ধমক দিয়ে বললেন, মূল কথায় আসা। তোমার বুদ্ধিমতী খালা বোতল কোথায় লুকিয়েছে?
আমার ধারণা তার বাথরুমে। বেসিনের নিচের কাবার্ডে যেখানে ফিনাইল জাতীয় জিনিসপত্র থাকে, কিংবা বাথরুমে ডাক্টবিনে।
খালু অলিম্পিকের দৌড় দিয়ে ছুটে গেলেন এবং অলিম্পিকের সোনা পাওয়ার মত মুখ করে বোতল কোলে ফিরে এসে জড়ানো গলায় বললেন, “হিমু ছাদে আসো।” বোতল কোলে নিয়েই তাঁর নেশা হয়ে গেছে।
দু’জন ছাদে বসে আছি। খালু সাহেব আশংকাজনক গতিতে বোতল নামিয়ে দিচ্ছেন। আমার প্রতি মমতা এবং ভালবাসায় তিনি এখন সিক্ত।
হিমু।
জি খালু সাহেব।
আমি যে তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করি তা-কি তুমি জান?
জানতাম না। এখন জেনেছি।
তোমাকে দেখলে বিরক্ত হবার মত ভাব করতাম, এটা আসলে অভিনয়। আমি সেই ব্যক্তি যে মনের ভাব গোপন রাখতে পছন্দ করে। এই বিষয়ে কবিগুরুর একটা লাইন আছে। এখন মনে পড়ছে না। মনে করার চেষ্টা করছি।
চেষ্টা করার দরকার নেই। মনে পড়লে পড়বে।
আমার কি ধারণা হিমু, আমি তোমার খালাকেও পদ করি? তাকে গো টু কিংখান বলা ঠিক হয় নি। হিমু! তোমার কি ধারণা বেহেশতো দোজখ এই সব কি আছে? (পেটে জিনিস বেশি পড়লে খালু সাহেব ধর্ম নিয়ে আলোচনায় চলে যান।)
আমি বললাম, ধর্ম আলোচনাটা থাক।
তোমার কি ধারণা আমি মাতাল হয়ে গেছি? এখনো আমার লজিক পরিষ্কার দশ থেকে উল্টা দিকে গুনতে পারব। দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক ৷ হয়েছে?
হয়েছে।
একশ থেকে উল্টা দিকে গুনে এক পর্যন্ত আসতে পারব। শুরু করব?
না। আপনার নেশা কেটে যেতে পারে। ঘুমিয়েও পড়তে পারেন।
ঘুমিয়ে পড়বা কেন?
সংখ্যা নিয়ে গুনাগুনি শুরু করলে ঘুম আসে। মানুষ ভেড়া গুনতে শুনতে ঘুমায়।
খালু সাহেব গ্লাসে বড় একটা চুমুক দিয়ে গণনা শুরু করলেন, একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই… …
বিরাশি পর্যন্ত এসে তিনি গভীর ঘুমে আছন্ন হলেন। আমি ‘নেশা’ বিষয়ে আমার বাবার উপদেশ মনে করার চেষ্টা করলাম।
নেশা
পুত্র হিমু। নেশাগ্ৰস্ত মানুষের আশেপাশে থাকা আনন্দময় অভিজ্ঞতা। নেশাগ্ৰস্ত মানুষে মনের দরজা খুলে এবং বন্ধ হয়। কখন খুলছে কখন বন্ধ হচ্ছে তা সে বুঝতে পারে না। তুমি নেশাগ্ৰস্ত মানুষের পাশে থেকে এই বিষয়টি ধরতে চেষ্টা করবে। মহাপুরুষরা কোনো নেশার বস্তু গ্ৰহণ করা ছাড়াই তার মনের দরজা খুলতে পারেন এবং বন্ধ করতে পারেন। আমি নিশ্চিত একদিন তুমিও তা পারবে।