এই বাবু, যাস কোথায়? শুনে যা এদিকে।
বাবু এগিয়ে গেল। বাকের ভাই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ অস্বাভাবিক গভীর। বাবু ভয়ে ভয়ে বলল, কি?
বাসায়?
কেউ না। লম্বা করে, ফর্সা মত একটা ছেলে ঢুকল, মুনা ছিল সাথে। কে সে? চোখে চশমা।
বাবু তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিতে পারল না। অসহায় ভাবে এদিক-ওদিক তাকাল। কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না।
এই ছেলের সাথেই মুনার বিয়ে হচ্ছে নাকি?
হুঁ।
এটা বলতে এতক্ষণ লাগল কেন? টান দিয়ে বাঁ কান ছিঁড়ে ফেলব। আমার সাথে ফাজলামি। বিয়েটা কবে?
সামনের মাসের তিন তারিখে।
বাকের সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে হঠাৎ উদাস হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বলল যা ভাগ। বাবু তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। লজ্জায় তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে সে পানি সামলানোর চেষ্টা করছে। বাকের সব সময় তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সে যখন ক্লাস ফাইভে। পড়ত তখন বাকের একবার একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল বাবু বহু চেষ্টা করেও বের করতে পারেনি। সে ফিরছিল স্কুল থেকে। হঠাৎ বাকেরের সঙ্গে দেখা, সাইকেলে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। বাবুকে দেখে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ল। কড়া গলায় ডাকল এই এদিকে আয়! বাবু এগিয়ে যেতেই কথা নেই বার্তা নেই প্রচণ্ড এক চড়। বাবু কিছু বুঝে উঠবার আগেই বাকের সাইকেলে উঠে চলে গেল। যেন কিছুই হয়নি।
আজকের রাগের কারণটা অবশ্যি স্পষ্ট। বাবু সে কারণ ভালই বুঝতে পারে। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ, এককালে মুনা আপার সঙ্গে বাকের ভাইয়ের কিছুটা ভাব ছিল। কে জানে বিয়ের দিন এসিড-ট্যাসিড ছুড়ে মারবে হয়ত। দারুণ মন খারাপ করে বাবু ঘরে ফিরল। সে বড় ভয় পেয়েছে।
মুনা বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। মামুনের সঙ্গে কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কেনার কথা। সংসার তৈরি হবার আগেই সংসারের জন্যে জিনিসপত্র কেনার কথা ভাবতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। আবার ভালও লাগে। আজ তারা কিনবে চায়ের কাপ পিরিচ। রান্নার জন্যে বাসন কোসন। গত রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর মুনা একটা লিস্ট করেছে। তার সারাক্ষণই ভয় এই বুঝি বকুল জেগে উঠে চোখ কচলে জিজ্ঞেস করবে, কি করছ আপা? বকুলের ঘুম খুব পাতলা। একটু নড়াচড়া হলেই জেগে উঠে বলে, কি হয়েছে আপা? কি হয়েছে?
মুনা ঘর থেকে বেকবার আগে বলে গেল ফিরতে দেরি হবে। বকুলকে বলল ভাত চড়িযে দিতে। বকুল চাপা হেসে বলল, ভাত কজনের জন্যে রান্না হবে? ঠিক করে বলে যাও।
কজনের জন্যে রান্না হবে মানে?
মামুন ভাইও কি এখানে খাবেন?
মুনা ধমক দিতে গিয়েও দিতে পারল না। মামুন ইদানীং বেশ কয়েকবার এখানে ভাত খেয়েছে। বকুল বলল, মামুন ভাই আজ এখানে খেলে মুশকিল হবে। খাবার কিছু নেই, ডিমও নেই।
মুনা কোনো উত্তর না দিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়ল। মামুনের রাতের এখানে খাওয়ার ব্যাপারটা তার নিজেরও পছন্দের নয়। কিন্তু সে আজকাল রাত আটটার দিকে হঠাৎ এসে পড়ে এবং বসার ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। মামা তার সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। তাতে সে কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করে না। বকুল যখন গিয়ে বলে মামুন ভাই, আপনি কী এখানে খাবেন? সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ। দাও ভাত দাও।
ঘরে খাবার কিন্তু খুব খারাপ।
অসুবিধা নেই।
আসুন তাহলে। ভাত বাড়ছি।
মামুন সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে। যেন ভাতের জন্যেই এতিক্ষণ বসে ছিল। এমন লজ্জা লাগে। মুন্নার। মামুন কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই কোনো উৎসাহ নেই।
বকুল বলল–মুনা আপা, এই শাড়িতে কিন্তু তোমাকে ভাল লাগছে না। বদলে যাও। সবুজ শাড়িটা পর। মুনা গম্ভীর গলায় বলল, শাড়ি-টাড়ি নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। যা পরেছি সেটাই যথেষ্ট। তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
রাগ করছ, কেন?;
পাকামো কথা শুনে রাগ করছি।
বকুল আহত স্বরে বলল, পাকা কথা কি বললাম? শাড়িটাতে তোমাকে মানাচ্ছে না। এর মধ্যে পাকামির কি আছে?
মুনা লক্ষ্য করল বকুল বেশ শীতল স্বরে তর্ক করছে। এই স্বভাব তার আগে ছিল না। আগে সে কোনো কথার জবাব দিত না। আজকাল দিচ্ছে। প্রেমে পড়লে মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র পাল্টায়। বকুল কারো প্ৰেমে-ট্রেমে পড়িনি তো? মুনা বলল, চায়ের পাতা শেষ হয়েছে বোধ হয়। বাবুকে দিয়ে আনিয়ে রাখা।
টাকা? টাকা দেবে কে? দোকানে এখন বাকি বন্ধ।
মুনা নিঃশব্দে একটা দশ টাকার নোট বের করল। শওকত সাহেব ঘরে না থাকলে টুকিটাকি কেনা এখন মুশকিল। শওকত সাহেব আগে সংসার খরচের কিছু টাকা লতিফাকে দিতেন। ইদানীং দেন না। আধা সের লবণ কেনার টাকাও এখন তার কাছে চাইতে হয়।
বকুল বলল, তুমি ফিরবে। কখন আপা?
সন্ধ্যার আগেই ফিরব। কেন?
না এমনি জিজ্ঞেস করলাম। শাড়িটা বদলে যাও আপা। প্লিজ। আর যাবার আগে মার সঙ্গে দেখা করে যাও। আজ বেশ কয়েকবার তোমাকে খোঁজ করেছেন। খুব নাকি জরুরি।
কই আগে তো বলিসনি?
আগে মনে ছিল না। এখন মনে পড়ল।
মুনা শাড়ি বদলাল না। বকুলের কথায় শাড়ি বদলানোর কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া এটা এমন কোনো খারাপ না। গত সপ্তাহেই বকুল বলেছিল সুন্দর মানিয়েছে। এক সপ্তাহ আগে যে শাড়িতে মানায় এক সপ্তাহ পরে তাতে মানায় না, এ কেমন কথা?
লতিফা আজ বেশ সুস্থ। গত রাতে ভাল ঘুম হয়েছে। সকালে নাশতা খেয়েছেন। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছেন। সারাদিন একবারও জ্বর আসেনি। অনেক দিন পর প্রথমবারের মত র্তার মনে হয়েছে হয়ত শরীর আবার আগের মত হবে। সংসার ফিরে পাওয়া যাবে। তাকে কেউ আর এড়িয়ে চলবে না।
মুনা বলল, তুমি ডেকেছিলে নাকি মামি?
লতিফা উজ্জ্বল চোখে বললেন, বোস তুই। অনেক কথা আছে। আমার পাশে বোস।
তোমার শরীর আজ মনে হয় ভাল?
হুঁ। জ্বর নেই। দেখা গায়ে হাত দিয়ে দেখ।
মুনা তাঁর কপালে হাত লাগাল। গা ঠাণ্ডা। জ্বর সত্যি সত্যি আসেনি। লতিফা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–কি, জ্বর আছে?
না। এখন বল কি বলবে। আমার হাতে সময় নেই। এক জায়গায় যাব।
দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে আয়।
এমন কি কথা দরজা বন্ধ করতে হবে?
আহ বন্ধ করতে বলছি কর না।
মুনা অবাক হয়েই দরজা বন্ধ করল। লতিফা বিছানায় উঠে বসলেন। গতকাল বকুলের স্কুলের একজন মিসট্রেস বাসায় এসেছিলেন। মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কে? রেহানা আপা?
হুঁ। বকুলের জন্যে একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। খুবই ভাল ছেলে। ভাল বংশ। উনার দূর-সম্পর্কের আত্মীয়।
মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, এই সব আমি শুনতে চাই না। বাদ দাও তো।
সবটা না শুনেই এ রকম করিস কেন? সবটা আগে শোন। বাবা-মার একমাত্র ছেলে। জাপানে গেছে গত বছর। কম্পিউটার না কিসে যেন ডিগ্রি করেছে। বকুলকে সে দেখেছে। খুব পছন্দ হয়েছে।
দেখল কোথায়?
ছেলে এই মিস্ট্রেসের কাছে গিয়েছিল। তারপর উনি বকুলকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে যান। বকুল অবশ্যি কিছু বুঝতে পারেনি।
মুনা বলল বুড়ো ছেলে, বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, ওর মাথা-টাথা কি খারাপ নাকি? এইসব চিন্তা বাদ দাও তো মামি। লতিফা অবাক হয়ে বললেন–এরকম ছেলে পরে তুই পাবি কোথায়? ছেলের ছবি আছে। ছবি দেখ তুই। ছবি দেখার পর…।
আমার ছবি-টবি দেখতে হবে না।
আগেই রাগ করছিস কেন? বকুলের একটা ভাল বিয়ে হোক এটা তুই চাস না?
চাইব না কেন, চাই। কিন্তু ওর বিয়ের বয়স হতে হবে তো? কেন এত ব্যস্ত হয়েছ? মেট্রিকটা অন্তত পাস করতে দাও। ছেলে অপেক্ষা করুক।
না, ছেলে অপেক্ষা করতে পারবে না। তিন মাসের ছুটিতে এসেছে, বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে। তুই অমত করিস না। তোর মামার সঙ্গে কথা বলছিলাম, সে রাজি আছে।
আমাদের রাজি আর অরাজিতে কিছু আসে যায় না। বকুল কিছুতেই রাজি হবে না। কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে। কেন বুঝতে পারছি না?
লতিফা গম্ভীর স্বরে বললেন, না ও কাঁদবে না।
বুঝলে কি করে কাঁদবে না?
বকুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওর মত আছে। বলেছে আমাকে।
বল কি তুমি!
লতিফা টেনে টেনে বললেন, রাজি কেন হবে না বল? মেয়ে তো বোকা না। যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। কোনটাতে ভাল হবে সেটা সে জানে।
জানলে তো ভালই। বিয়ে দিয়ে দাও। আর কি?
মুনা মুখ কালো করে উঠে দাঁড়াল।
যাচ্ছিস কোথায়? কথা শেষ হয়নি আমার।
কথা শোনার আমার তেমন কোনো ইচ্ছা নেই। তোমরা নিজেরা নিজেরাই শোন।
বকুল ভাত চাপিয়েছে। তার মুখ একটু বিষন্ন। মুনা আপা অকারণে তার ওপর এতটা রাগ করবে। সে ধারণাও করেনি। সবাই তার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করে কেন? বকুল দেখল মুনা দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে অবাক হয়ে বলল, তুমি এখনো যাওনি?
না।
কী করছিলো? এতক্ষণ মার সঙ্গে এমন কি আলাপ?
মুনা কড়া গলায় বলল, গতকাল তোর টিচার এসেছিল। এই কথা তুই আমাকে বললি না কেন?
তুমি রাগ করবে। এজন্যে বলিনি।
শুনলাম জাপানের ঐ ছেলের সঙ্গে বিয়েতে তোর মত আছে। মামিকে নাকি তুই বলেছিস?
বকুল জবাব দিল না। মুনা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, কথার জবাব দে। চুপ করে আছিস কেন?
বকুল থেমে থেমে বলল মা আমাকে খুব আগ্রহ করে বলছিল। তার মুখের ওপর না বলতে খারাপ লাগল। মা বেশিদিন বাঁচবে না। তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছিল না।
মুনা তাকিয়ে রইল বকুলের দিকে। বকুল সহজ স্বরে বলল তোমার মা যদি এ রকম অসুস্থ হত আর সে যদি তোমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের কথা বলত তাহলে তুমিও রাজি হতে। হতে না?
এ রকম বাজে তর্ক কার কাছে শিখেছিস?
বকুল জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। আজ সে একটা ছাপা শাড়ি পরেছে। এত সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। মুনা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আরো কড়া কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। প্রতিমার মত একটি কিশোরীকে কোনো কড়া কথা বলা যায় না। মুনা কোমল স্বরে বলল, কাঁদছিস কেন তুই? বকুল চোখ মুছে বলল, তোমরা সবাই আমার সঙ্গে এ রকম করবে। আর আমি কাঁদতে পারব না?
সেকেন্ড পিরিয়ডে রীতা আপার ক্লাস। ইংলিস সেকেন্ড পেপার। রীতা। আপাকে ছাত্রীরা আড়ালে ডাকে রয়েল বেঙ্গল। ভয়ানক রাণী। এবং তিনি বেছে বেছে এমন সব ছাত্রীদের পড়া জিজ্ঞেস করেন যারা সেদিন শিখে আসেনি। সবার ধারণা কপালের মাঝখানে তার একটা তিন নম্বর চোখ আছে, যেই চোখ দিয়ে তিনি দেখে ফেলেন কে পড়া করেছে কে করেনি।
বকুল বসে বসে ঘামছিল। রীতা। আপা ক্লাসে ঢুকে প্রথম প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করবেন তাকে। প্রথম দাঁড়াতে বললেন। তারপর শীতল চোখে তাকবেন। ক্লাসের সমস্ত সাড়াশব্দ যখন থেমে যাবে তখন প্রশ্ন করবেন। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করবেন আলাদা আলাদা ভাবে। এবং এমন প্রশ্ন করবেন যার উত্তর ক্লাসের কেউই জানে না।
আজও তাই হল। রীতা। আপা ক্লাসে ঢুকেই বললেন বকুল দাঁড়া। বকুল দাঁড়াল। আপা তাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, কমন রুমে চলে যা। রেহানা। আপা তোকে ডাকছেন। বই-খাতা নিয়ে যা।
রেহানা আপা দারুণ ব্যস্ত। হাতে একগাদা কাগজপত্র কিন্তু মুখ হাসি হাসি। বকুল তার পাশে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, বকুল তুই বাড়ি চলে যা। আজ বিকেল পাঁচটার সময় তোকে দেখতে আসবে, মাকে বলবি। সাজগোজ বেশি দরকার নেই। ছেলের মা আর এক ফুফু আসবে। খবর না দিয়ে হঠাৎ গিয়ে দেখার কথা। সেজেগুজে থাকলে বুঝে ফেলবে। বুঝেছিস?
বকুল মাথা নাড়ল। সে বুঝেছে।
যা একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যা। শাড়ি পাবে থাকবি! কামিজটামিজ না। আর শোন, দুপুরে কাঁচা হলুদ গায়ে দিয়ে গোসল করবি, রঙ খুলবে। আবশ্যি তোর রঙ খারাপ না। চাপা রঙ। এটাই ভাল।
বকুল সরাসরি বাড়ি এল না। গেল টিনা ভাবীদের বাড়ি। অনেক দিন পর আসা। টিনা ভাবী ঘুমুচ্ছিল। সে ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিল।
কেমন আছ ভাবী?
আর কেমন আছি। আমাদের খোজখবর কে করে? তোর ফজলু ভাই দারুণ রেগে আছে, তোকে মজা দেখাবে। কাবলিওয়ালা দেখতে এলি না কেন?
বাসা থেকে আসতে দেয়নি। মুনা। আপা নট বলে দিয়েছিল।
এরকম দারোগা আপা জোগাড় করলি কোথেকে?
বকুল মৃদু হাসল।
তোর এই আপাকে আমার একেবারেই সহ্যই হয় না। কি রকম পুরুষ পুরুষ মেয়ে।
বকুল অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। মুনা। আপার নামে কেউ কিছু বললে তার খারাপ লাগে। টিনা ভাবী বললেও লাগে। যদিও তার প্রায়ই মনে হয় টিনা ভাবীকেই সে সবচে বেশি ভালবাসে।
তোর বিয়ে হচ্ছে। এ রকম একটা গুজব শোনা যাচ্ছে, এটা কি সত্যি?
বলেছে কে তোমাকে?
যেই বলুক, সত্যি কি না বল?
না। সত্যি না।
টিনা ঘাড় কাত করে হাসতে লাগল।
বকুল বলল, হাসছ কেন?
এমনি।
এই কদিনের মথ্যে তোমার পেট অনেকখানি বড় হয়ে গেছে ভাবী।
তা হয়েছে। আমার মনে হয় যমজ। দু’জন আছে। এখানে।
যমজ হলে ভালই হয়।
তোর হোক তখন বুঝবি–ভাল কি মন্দ। রাতে ঘুমুতে পারি না। সবচে অসুবিধা হয় তোর
ভাইয়ের; বেচারা ক’দিন ধরে দারুণ মনোকষ্টে আছে।
কেন? তা বলা যাবে না।
টিনা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। বকুল লজ্জা পেয়ে গেল। টিনা বলল, তুই এমন টমেটোর মত লাল হয়ে গেলি কেন? বুঝতে পেরেছিস নাকি কি জন্যে মনোকষ্টে আছে?
না।
আবার মিথ্যা কথা। ঠিকই বুঝেছিস। আজ তুই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবি। তোর ফজলু ভাই আসুক, তারপর যাবি। সে অনেক’দিন তোকে না দেখে মন খারাপ করে আছে।
আজ থাকতে পারব না ভাবী, আমার কাজ আছে।
কি কাজ? এত কাজের লোক হলি কবে থেকে? বাস গল্প করব। বিছানায় পা উঠিয়ে বস না।
বকুল বসল। টিনা এসে বসল। তার পাশে। একটা হাত রাখল বকুলের কোলে। মৃদু স্বরে বলল, তুই দিন দিন যা সুন্দর হচ্ছিস। আমারই লোভ, লাগে।
কি যে বল তুমি।
যে তোকে বিয়ে করবে। সে প্রথম তিন মাস এক ফোটাও ঘুমুতে দেবে না। সারা রাত জাগিয়ে রাখবে। যদি না রাখে আমার নাম বদলে ফেলব।
থাক তোমার নাম বদলানোর দরকার নেই।
টিনা মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল আমার চেহারা-ছবি তো দেখছিস। এই আমাকেই তোর ভাই এক মাস রাতে ঘুমুতে দেয়নি। সারা রাত জেগে থাকি দিনের বেলায় ফ্যাক পেলেই ঘুমাই। শ্বশুর বাড়িতে সবাই হাসাহাসি করে।
বকুল কিছু বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, এখন আর তোমাকে জাগায় না?
না। আগের মত না।
বকুল তিনটা পর্যন্ত থাকল সেখানে। টিনা ভাবীর সঙ্গে কথা বলা একটা নেশার মত। কিছুতেই আসতে ইচ্ছা করে না। পুরুষদের নিয়ে এমন সব মজার মজার গল্প সে জানে শুধু শুনতে ইচ্ছা! করে। আজ সে একটা গল্প বলেছে যে শুনলেই গা বিমঝিম করে।
টিনা ভাবীর এক খালার বিয়ে হয়েছে রাজশাহীতে। টিনা ভাবী তখন মাত্র মেট্ৰিক দিয়েছে। সেও গিয়েছে বিয়েতে। সমবয়সী মেয়েরা শাড়ি পরে ছুটোছুটি করছে। সেও করছে। রাত নটার সময় বর এল। সবাই ছুটে গেল গেট ধরতে। সে গেল ছাদে। সেখান থেকে সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে দেখা যাবে। তখন হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ছাদে পাঞ্জাবি পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, খুকী ভয় লাগছে? তারপর…।
গল্প শেষ হবার পর বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, তুমি ফজলু ভাইকে বলেছ। এই ঘটনা?
পাগল হয়েছিস? সবাইকে সব কথা বলা যায়! মেয়েদের অনেক কথা পুরোপুরি গিলে ফেলতে হয়।
ঐ লোকটির সঙ্গে আর দেখা হয়েছিল?
না। আর হলেই কি? তুই দেখি গল্প শুনে ঘামতে শুরু করেছিস। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক কষ্ট রে বকুল।
এ সময় বাড়িতে মা ছাড়া অন্য কারো থাকার কথা নয়। কিন্তু বকুল অবাক হয়ে দেখল বাবা খালি পায়ে বারান্দায় ক্যাম্পখাটে বসে আছেন। তারও কি অফিস ছুটি? নাকি তিনি খবর পেয়েছেন রেহানা আপা আসবেন ছেলের মাকে নিয়ে?
শওকত সাহেবের মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ। খালি গায়ে থাকার জন্যেই হয়ত তাকে দেখাচ্ছে বুড়ো মানুষের মত। তিনি বকুলের দিকে না তাকিয়েই বলল আজি ক্লাস হয়নি? কি অবস্থা, তিন মাস পর মেট্রিক পরীক্ষা।
বকুল কিছু বলল না। মেট্রিক পরীক্ষার এখনো অনেক দেরি। সেদিন মাত্র ক্লাস টেইনে হাফ ইয়ার্লি হল। কিন্তু বাবার মাথায় কি করে যেন তিন মাস ঢুকে গেছে।
স্কুলে পড়ায় না?
পড়ায়।
আর পড়া। পড়াশোনা কি দেশে আছে? ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দে।
বকুল পানি নিয়ে এল। শওকত সাহেব তৃষ্ণার্তের মত পানি পান করলেন। তৃষ্ণ মিটাল না।
আয়েক গ্ৰাস পানি দে।
সরবত বানিয়ে দেব? ঘরে কাগজি লেবু আছে।
দে! তোর মার শরীর আজ কেমন?
ভাল।
ভাল? এর নাম ভাল। বিছানা থেকে নামতে পারে না। আর শরীর ভাল। খাওয়া-দাওয়া করেছে?
আমি তো জানি না। সকালে স্কুলে চলে গেলাম।
যা আগে খোঁজ নিয়ে আয়। মা-বাপের দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস। এটা আবার বলে দিতে হয়। কেন?
লতিফা জেগেই ছিলেন। বকুলকে ঢুকতে দেখে মাথা উঁচু করে বললেন–তোর বাবা এসেছে নাকি? কথা শোনা যাচ্ছে।
দরজা খুলল। কিভাবে?
দরজা খোলা ছিল বোধ হয়।
না। আমি নিজের হাতে বন্ধ করলাম। তুই জিজ্ঞেস করে আয় দরজা খুলল। কিভাবে?
জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমি পারব না।
জিজ্ঞেস করতে অসুবিধা কি? তোকে তো খেয়ে ফেলবে না।
বকুল বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকাল। অসুস্থ হবার পর লতিফাব এমন হয়েছে। সামান্য ব্যাপারে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
বকুল, তোর বাবা রোজ এমন সকাল সকাল বাড়ি আসছে কেন?
রোজ আসছে নাকি?
কালও তো একটার সময় চলে এসেছে। এর আগের দিন এসেছে দুটার সময।
অফিসে কাজ-টাজ বোধ হয় বেশি নেই।
কাজ থাকবে না কেন? কি যে বলিস! যা তো জিজ্ঞেস করে আন্য রোজ এত সকাল সকাল আসে। কেন?
আমি জিজ্ঞেস করতে পারব না। মা।
তাহলে ডেকে দে, আমি জিজ্ঞেস করছি।
ঠিক আছে দিচ্ছি। তুমি কিছু খেয়েছিলে মা?
দুধ-মুড়ি খেয়েছি। যা তোর বাবাকে আসতে বল।
শওকত সাহেব নিঃশব্দে সরবত খেলেন। গ্রাস শেষ করে বিবক্ত স্বরে বললেন, ছেকে দিতে পারলি না, লেবুর ছোবরায় গ্লাস ভর্তি। কোনো একটা কাজ ঠিকমত করতে পাবিস না, না?
বকুল চুপ করে রইল। শওকত সাহেব বললেন, তোব মা কিছু খেয়েছে?
হ্যাঁ। দুধ-মুড়ি।
রোজ দুধ-মুড়ি। মুড়ির মধ্যে আছেটা কি? এর চাইতে এক বাটি ডাল খেলে পুষ্টি বেশি হয়। যত বেকুবের মত কাজ।
বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, মা তোমাকে ডাকে।
এখন তার ভ্যাজর ভ্যাজার শুনতে পাবিব না। আমার পাঞ্জাবি এনে দে বাইরে যাব।
কখন ফিরবে?
শওকত সাহেব জবাব দিলেন না। ছেলে-মেয়েদেব সব কথার তিনি জবাব দেন না।
রেহানা। আপা আসাব কথা বিকাল পাঁচটায, তিনি চারটিাব মধ্যেই চলে এলেন। তার সঙ্গে অসম্ভব বেঁটে অতিরিক্ত মোটা এক মহিলা। ইনিই সম্ভবত ছেলেবে মা। আবেকজন তার মত বেটে কিন্তু দারুণ রোগা ছেলের ফুফু হবেন। বেহানা আপা বকুলকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল শাড়ি পরতে বলেছিলাম না? এখনো স্কুলেব ড্রেসই পরে আছিস? মাথায় বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু আছে না সবটাই গোবব?
আপনি বলেছিলেন পাঁচটার সময় আসবেন।
পাঁচটার সময় আসব বলেছি বলেই তুই পাঁচটা বাজার দুমিনিট আগে কাপড় বদলাবি? আব তুই পা ছুয়ে সালাম করলি না কেন?
এখন করব?
এখন কববি কোন অজুহাতে? যাবার সময় করিস। আব্বা মুখ এমন আমসি কবে আছিস কেন? হাসিমুখে থােক। তাই বলে কথায্য কথায় হাসার দবকার নেই।
ছেলের মাকে বকুলের পছন্দ হল। খুব রসিক মহিলা। ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মজার মজার রসিকতা করতে লাগলেন। এবং এক ফাঁকে বকুলকে বললেন আমাকে দেখে অনেকেই মনে করে আমার ছেলেমেয়েগুলি বোধ হয়। আমার সাইজের। আসলে তা না, ওরা সবাই ওদেব বাবাব মত লম্বা। তবে আমি নিশ্চিত আমার নাতিগুলি হবে আমার সাইজের। এই বলে তিনি খুব হাসতে লাগলেন। হাসি এমন আন্তরিক যে সবাই তাতে যোগ দিল। বকুলের সঙ্গে তার কথাবার্তা হল খুবই কম। একবার শুধু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ভাল নাম কি মা? তার উত্তর শোনার জন্যেও অপেক্ষা করলেন না, অন্য প্রশ্ন করলেন। বেশ মহিলা।
যাবার সময় বকুল পা ছুঁয়ে সালাম করতেই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। অনেক’দিন বকুলকে এমন ভাবে কেউ আদর করেনি।