বাংলায় ঐতিহাসিক গবেষণার সমস্যা
ভারতের ইতিহাসে গবেষণা করিবার উচ্চ আকাঙ্ক্ষা আমার মনে প্রথম জেগে উঠে, বি-এ পরীক্ষা দিবার পরই, ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে। আর আজ সে দিন হইতে ষাট বৎসর পরে এই দীর্ঘকালের মধ্যে আমাদের দেশে ঐতিহাসিক গবেষণার কি প্রগতি হয়েছে তা বিচার করিবার অবসর পেয়েছি। এই ষাট বৎসরে বাঙ্গলা দেশে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছে তাহা তুলনা করিয়া দেখিলে আশ্চর্য্য হইয়া যাই। আমাদের দেশের প্রবীণ লেখক ও নবীন গবেষক ছাত্র ইতিহাস-চর্চার প্রণালীতে এবং রচিত ইতিহাসের উৎকর্ষে আশ্চর্য্য উন্নতি সাধন করেছেন এবং সে উন্নতি এ পর্যন্ত ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই সব কর্মী বছর বছর উচ্চ হইতে উচ্চতর, কঠিন হইতে কঠিনতর স্তরে উঠেছেন।
দু’একটা দৃষ্টান্ত দিলেই এই সত্যটি পরিষ্কার বুঝান যাবে। বৌদ্ধ ধর্ম্ম ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের আদি যুগের কর্মী কৃষ্ণবিহারী সেন অথবা রামদাস সেনের পাশে আজকার দিনের বেণীমাধব বড়ুয়া অথবা প্রবোধচন্দ্র বাগচির রচনা রাখা যাউক। অথবা ব্রিটিশ-যুগের ইতিহাসে রজনী গুপ্ত এবং অক্ষয় মৈত্রের গ্রন্থ ও প্রবন্ধের পাশে আমাদের সমসাময়িক ব্রজেন বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য নবীন গবেষকের শ্রমফল বসাইয়া বিচার করা যাইক। প্রাচীন হিন্দু-যুগের গবেষণায় সেই সেকালে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদিত বৃহদ্দেবতা ও ললিত-বিস্তরের সঙ্গে ত্রিশ বত্রিশ বৎসর পরে অধ্যাপক ম্যাকডনেল-সম্পাদিত বৃহদ্দেবতা এবং লিউমান-সম্পাদিত ললিতবিস্তর তুলনা করা যাউক।
অথচ ইংরেজী শিক্ষার সেই প্রথম যুগের ভারতীয় গবেষকগণ প্রত্যেকে অসাধারণ প্রতিভাশালী ছিলেন এবং যথাসাধ্য শ্রমও করেছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের শ্রমফল জগতের পণ্ডিতসভায় খাঁটি জিনিষ বলিয়া স্থান অধিকার করিতে পারে নাই, পরবর্ত্তী কর্মীদের রচনা তাহা বাতিল করিয়া দিয়াছে।
এই পার্থক্যের কারণ দুটি। প্রথমতঃ বর্তমানের কর্মীরা এক ভিন্ন প্ৰণালী মেনে চলে, এবং দ্বিতীয়ত: এখন আমাদের হাতে যে ঐতিহাসিক উপাদান এসে জমা হয়েছে তাহা রামদাস সেন বা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের যুগ থেকে অনেক বেশী, ফলে তাঁহারা ও আমরা যেন দুটি ভিন্ন দেশের, ভিন্ন যুগের লোক। এখন আর সিয়ার-উল-মুতাখরীনের হাজী মুস্তাফাকৃত ইংরেজী অনুবাদের উপর নির্ভর করিয়া আলীবর্দী ও সিরাজ, মিরজাফর ও নবাব কাসিম আলীর ইতিহাস লেখা চলে না।
গবেষণার এই নবীন প্রণালীর দুইটি ধারা- প্রথমটি এই যে, গবেষককে একেবারে আদিতম ঐতিহাসিক উপাদান অর্থাৎ দলিলে পৌঁছিতে হবে। সর্ব্বপ্রথম সাক্ষীর এজাহার যতদূর সম্ভব বাহির করিতে হইবে এবং তাহা আদি ও অ’ বিকৃত আকারে, অর্থাৎ সাক্ষীর নিজের কথাগুলি পড়িতে হইবে, তাহার অনুবাদ বা পরবর্ত্তী কালের অন্য লেখকের গ্রন্থে দেওয়া সংক্ষিপ্তসার পড়িলে চরম সত্যে পৌঁছান যায় না। আমাদের মধ্যে প্রথম যুগে বৌদ্ধ শাস্ত্রচর্চ্চা আরম্ভ হয়, বির্ণফ যে সংস্কৃত হইতে ফরাসী অনুবাদ এবং সঙ্কলন প্রকাশ করেন অথবা কাউএল ও রিডাভিডস্ পালি গ্রন্থের যে ইংরাজী অনুবাদ ছাপাইয়াছেন তাহার উপর নির্ভর করিয়া সে প্রণালী এখন অচল হয়েছে। আমাদের হালের গবেষকগণ আদি পালি এবং নেপাল ও মধ্য-এশিয়ায় পাওয়া সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্য না পড়িয়া এক কথাও লিখিতে পারেন না।
তেমনি মুঘল ইতিহাসের ক্ষেত্রেও। খাফি খাঁ তাঁহার ইতিহাস হায়দরাবাদে বসিয়া ১৭৩৪ সালে সমাপ্ত করেন। শাহজাহান (রাজত্ব শেষ ১৬৫৮ সালে) এবং আওরংজীব (মৃত্যু ১৭০৭ সালে) এই দুই বাদশা সম্বন্ধে খাঁফি খাঁ প্রত্যক্ষদর্শী নহেন; অথচ যেহেতু খাঁফি খাঁর পার্সী ইতিহাসের এই অংশটা এলিয়ট ও ডসন ইংরাজীতে অনুবাদ করে ছেপেছেন, অতএব আমাদের সেকালের কর্মীদের এই অনুবাদের উপর নির্ভর করা ভিন্ন পন্থা ছিল না। কিন্তু ইহাতে মৌলিক গবেষণা হইতে পারে না। ঐ দুই বাদশার হুকুমে লিখিত পার্সী ইতিহাসই আদি উপাদান। অবশ্য তাহার মধ্যে খোশামোদ ও অতিরঞ্জনের সম্ভাবনা পদে পদে বিচার করিয়া কষ্টিপাথরে ঘষিয়া তবে খাঁটি সত্য লাভ করিতে হইবে। কিন্তু ঐ বাদশাহের সরকারী ইতিহাস, অর্থাৎ পার্সী বাদশানামা, আলমগীরনামা ইত্যাদি পর্যন্ত আদিতম উপাদান নহে। এগুলি পরে রচিত গ্রন্থ। তাদের ভিত্তি অপর এক শ্রেণীর পার্সী দলিল, যাহার নাম আারাৎ অর্থাৎ হাতে লেখা সংবাদপত্র, এবং ডেস্প্যাচ্ অর্থাৎ কর্মচারীদের পক্ষ হইতে পাঠান রিপোর্ট বা চিঠি। এগুলি বাদশাহী দপ্তরখানায় জমা রাখা হইত, এবং ইহা পড়িয়া ঐসব ‘নামা’ বা সরকারী ইতিহাসের লেখক তাঁহাদের গ্রন্থের তথ্য সংগ্রহ করিতেন, যেমন আজকাল সব দেশে সরকারের পক্ষ হতে গত দুই বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সঙ্কলন করা হচ্ছে। আমি আওরংজীবের রাজ্য-কালের এবং অষ্টাদশ শতাব্দী ধরিয়া, মারাঠা আবদালী শিখ রাজপুতদের দিল্লীর তখৎ ঘিরিয়া সন্ধি-বিগ্রহের সহস্র আবারাৎ ও পত্র সংগ্রহ করিয়া কাজে লাগাইয়াছি।
এই হল ইতিহাস-রূপিণী ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে অক্লান্ত যাত্রা। তার পর নবীন প্রণালীর দ্বিতীয় ধারা হচ্ছে এই যে, সবগুলি সাক্ষীকে একত্র করতে হবে। যত বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন স্থানে, আমার নির্বাচিত বিষয়ের উপাদানগুলি আছে তাহা সংগ্রহ করে পড়তে হয়, ভিন্ন ভিন্ন দলের সাক্ষীর জবানবন্দীর ঘাতপ্রতিঘাত সন্দেহের চোখে নিরপেক্ষভাবে বিচার করে তবে প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্য আবিষ্কার করা যায়। যেমন, ভাওয়াল-সন্ন্যাসীর মোকদ্দমায় সাবজজের সামনে কুমারের পক্ষে এক হাজার এবং রাণীর পক্ষে ৯৯৯ জন সাক্ষী– অথবা ঐমত ডাকা হয়। যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত একতরফা বিচারের রায় মাত্র তাহা স্থায়ীভাবে গৃহীত হতে পারে না।
এইরূপে সব দেশ থেকে সব ভাষায় লেখা ঐতিহাসিক মালমসলা সংগ্রহ করবার সুযোগ আজকাল যেমন হয়েছে তাহার দশ ভাগের এক ভাগও ষাট বৎসর আগে ছিল না। এর কারণ এখন একরকম খুব সস্তা ফটোগ্রাফ হয়েছে যাহাতে বিলাতের দুষ্প্রাপ্য বই বা হস্তলিপির অবিকল ছবি আমরা এদেশে বসে আনাতে পারি, এগুলিতে হাতে নকল করার ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা ও বিরাট ব্যয় নাই আর জগতে যত বিখ্যাত গ্রন্থাগার আছে তাহাদের মুদ্রিত গ্রন্থ ও হস্তলিপি, শিলালিপি, মুদ্রা প্রভৃতির অতি বিস্তৃত বর্ণনাপূর্ণ তালিকা ছাপা হয়েছে। এই সব Catalogue raisonne গুলি পর্যন্ত আশ্চর্য্য শিক্ষাপ্রদ।
বিগত ষাট বছরে আমাদের মধ্যে মৌলিক গবেষণায় এত উন্নতি হয়েছে, তাহা যে ইউরোপীয়দের শিক্ষা, দৃষ্টান্ত ও সংঘর্ষের ফলে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। ভারত স্বাধীন হওয়ার ফলে এই ইউরোপীয় শিক্ষা ও সংঘর্ষ বন্ধ হইয়াছে। এই রাজনৈতিক বিপ্লবের ফলে আমাদের মধ্যে ঐতিহাসিক গবেষণার উৎকর্ষ যাহাতে দিন দিন নিকৃষ্ট এবং অবশেষে বিনষ্ট হইয়া না যায়, সেদিকে আমাদের শিক্ষক ও চিন্তারাজ্যের নেতাদের সজাগ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। কারণ গবেষণার জীবনমন্ত্র হচ্ছে ক্রমোন্নতি, eternal progression; এই রাজ্যে কোথায়ও পৌঁছিয়া সন্তুষ্টচিত্তে বসিয়া থাকিবার, ঘুমাইবার সাধ্য নাই; থাকিলেই অবনতি, এবং পশ্চাদ্গমনেই মৃত্যু। সেইজন্য আমাদের দেশে মৌলিক গবেষণাকে স্থায়ী এবং প্রাণবন্ত করিতে হইলে দুটি জিনিষ চাই- গুরুপরম্পরা ও গ্রন্থভাণ্ডার। অর্থাৎ যতটুকু জ্ঞান আজ পর্যন্ত লাভ করিয়াছি তাহা চালাইবার, বাড়াইবার জন্য আমাদের পুত্রপৌত্রদের মধ্য হইতে ক্রমাগত নেতা সৃষ্টি করিতে হইবে। জ্ঞানের প্রদীপ একবার নিবিলে আবার জ্বালান কঠিন।
এই সব গুরু ও তাঁহাদের শিষ্যগণ মাতৃভাষা ও বিশ্বভাষা (অর্থাৎ ইংরাজী) ছাড়া আবশ্যক মত আর কোন কোন ভাষা শিখিতে বাধ্য। মারাঠী ও পার্সী ভাষা না জানিলে মহারাষ্ট্রের এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর দিল্লী-সাম্রাজ্যের ইতিহাসে গবেষণা মৌলিক হইতে পারে না, সত্যফলপ্রসূ হইতে পারে না। এক শিবাজীর জীবনী রচনা করিতে গিয়া আমাকে ভাল করিয়া পার্সী ও মারাঠী ভাষা, এবং কাজ চলার মত পর্তুগীজ ও ফরাসী ভাষা শিখিতে হয়, তা ছাড়া ইংরাজী, সংস্কৃত ও রাজস্থানী ডিঙ্গল ভাষা ত আছেই।
দ্বিতীয় সমস্যা, উপকরণের পুঁজী, অর্থাৎ উচ্চ শ্রেণীর এবং পূর্ণাঙ্গ লাইব্রেরী এদেশে আমাদের হাতের কাছে রাখিতে, গড়িতে হইবে। এইসব গবেষণার লাইব্রেরীতে হস্তলিপি ও দলিলের ত কথাই নাই, ছাপান প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পুস্তক, পণ্ডিত-সমিতির পত্রিকার ধারাবাহিক সেট, প্ৰামাণিক এসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্বকোষ, যেমন Encyclopaedia of Islam 8 ভলুমে সম্পূর্ণ– যাহা এখন আড়াই হাজার টাকায়ও পাওয়া যায় না, এলিয়ট ও ডসন ৮ ভলুম– যাহার দাম এখন এক হাজারে পৌঁছিয়াছে অথচ দু-তিন বৎসর পরেও এক সেট বাজারে দেখা দেয় না- এবং বিস্তৃত ম্যাপ সংগ্রহ, ও জগতের সব বিখ্যাত লাইব্রেরীগুলির হস্তলিপির ও মুদ্রার কেটেলগ, এ সমস্ত জুটাইয়া পূর্ণাঙ্গ করিতে হইবে। গবেষণার কাজে এরূপ পূর্ণাঙ্গ reference libraryর যে কত মূল্য তাহা অনেকে জানেন না। সেই ভুক্তভোগী গবেষক ছাত্ৰ যে কাজ করিতে করিতে একখানা দুষ্প্রাপ্য হস্তলিপি বা পুরাতন মুদ্রিত পুস্তকের অভাবে হঠাৎ বাধা পাইয়াছে, এবং কোন কূলকিনারা দেখিতে পাইতেছে না, সেই জানে।
পুণার মহারাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় দু’বৎসর হইল স্থাপিত হইয়াছে। এখানে প্রধানতঃ হিন্দু-যুগের ইতিহাস ও সাহিত্যে গবেষণা হইবে। সুতরাং তাঁহারা অধ্যাপক দেবদত্ত ভাণ্ডারকরের ব্যক্তিগত গ্রন্থ ও পত্রিকা-সংগ্রহ বত্রিশ হাজার টাকায় কিনিয়া কলিকাতা হইতে পুণায় লইয়া গিয়া তৎক্ষণাৎ এই ক্ষেত্রে কাজ আরম্ভ করিতে সক্ষম হইয়াছেন। আমেরিকার সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়
জগদ্বিখ্যাত জর্মান ঐতিহাসিক ফন্ রাঙ্কের সমস্ত লাইব্রেরী- পুস্তক, হস্তলিপির পুঁথি, তাঁর নিজ হাতে লেখা নোট, তর্জ্জমা ও সংক্ষিপ্তসার, এমন কি খণ্ড খণ্ড কাগজ পর্যন্ত কিনিয়া বার্লিন হইতে মার্কিন দেশে লইয়া গিয়া, তাহা সাজাইয়া তালিকা বাহির করিতেছে, গবেষকগণ ঐ শহরে ছুটিয়া যাইবে। আর ভারতের কি দশা, তাহা আমিই জানি, যখন আমার নিজস্ব লাইব্রেরীর সাহায্য লইবার জন্য ব্যাকুল অসহায় গবেষকগণ আমাকে চিঠি লেখে। আমার লাইব্রেরী কোন কোন বিভাগে ভারতবর্ষে অতুলনীয় হইলেও এটা একজন মধ্যবিত্ত লোকের গড়ে তোলা, একটা ব্যক্তিগত নিজস্ব সম্পত্তি। আমরা চাই কোন জাতীয় প্রতিষ্ঠানে সর্বসাধারণের জন্য এরূপ সংগ্রহ রাখা।
১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ একবার কাশীতে যান। সেখানকার বঙ্গসাহিত্য সভার অভ্যর্থনার উত্তরে তিনি একটি মর্মান্তিক দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন- “আমরা কি চিরদিনই ইউরোপের কাছে ঋণী থাকব? চিরকালই কি তাদের কাছে ভিক্ষা চাইব? আমাদের সৃষ্টি-করা কিছুই কি বিশ্বজগৎকে দিতে পারব না? আমাদের দেশে অনেক উচ্চশিক্ষিত এলোপাথিক ডাক্তার আছেন, যাঁদের মধ্যে প্রত্যেকে লক্ষ টাকার বেশী উপার্জ্জন করেছেন, অথচ তাঁহারা কেহই একটি নূতন ঔষধ বাহির করিতে পারেন নাই, ক্ষ্যাপা কুকুরে কাটার অব্যর্থ ঔষধ, ডিপথেরিয়ার ঔষধ, ইত্যাদি সব সাহেবেরা গবেষণা করে বাহির করেছেন, জগৎকে দিয়াছেন। আমরা কোন ব্যারামেরই বিশ্বমানবের গৃহীত ঔষধ আবিষ্কার করিতে পারি নাই। আবার, ভারতে এত ছোট ছোট উপভাষা আছে, তাহার ব্যাকরণ ও শব্দকোষ সাহেব মিশনরীরা চর্চ্চা করে প্রকাশ করিতেছেন; অসংখ্য ছোট অসভ্য জাতি আছে, তাহাদের ধর্ম, রীতিনীতি জনশ্রুতি ও ছড়া, এসবই সাহেবেরা লিপিবদ্ধ করছেন। বঙ্গের বাহিরে অসংখ্য শিক্ষিত অবস্থাপন্ন বাঙ্গালী আছেন, তাঁহাদের পক্ষে এই কাজগুলি করবার প্রচুর সুবিধা আছে, অথচ তাঁহাদের কেহই এদিকে দৃষ্টি দেন না। ভারতের এই দৈন্য কিসে ঘুচবে?”
গবেষণার প্রণালী ও উপকরণ সম্বন্ধে যে এত কথা বলিলাম, তাহা আমাদের সমস্যার অন্তরের কথা নহে। চৈতন্যচরিতামৃতে ভক্তির নানা ভাবে ব্যাখ্যা করিবার পর রামানন্দ বলিতেছেন, “এহ বাহ্য”- এটা বাহিরের কথা, ভক্তিশাস্ত্রের মূল তত্ত্ব নহে। সেইরূপ যদি আমাদের দেশে মৌলিক গবেষণাকে সজীব সবল রাখিতে হয় তবে আমাদের কর্মীদের চাই চিত্তশুদ্ধি। অর্থাৎ ঐতিহাসিক গবেষণার সত্য-সন্ধানী নিষ্কাম সাধককে দেশ-কাল-সমাজের ক্ষুদ্র গণ্ডীর বাহিরে যাইতে হইবে, স্বদেশী লোকের শস্তা বাহবা পাইবার লোভ সম্বরণ করিতে হইবে। হোগলকুড়ীয়া বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে এই রচনার জন্য ডাক্তার উপাধি দিবেন, অথবা ছকুখানসামা সেকেণ্ড লেনের সাহিত্যসভা আমার এই গ্রন্থ পুরস্কৃত করবেন– এইরূপ আকাঙ্ক্ষা প্রকৃত গবেষকের আদর্শ হইতে পারে না। বাহিরের বিশ্বসভায়– যাহাকে republic of letters বলা হয় সেই সৰ্ব্বজনীন পণ্ডিতসমাজে– যতক্ষণ পর্যন্ত আমার গবেষণা স্বীকৃত হয় নাই ততক্ষণ আমি নিজ শ্রমফলে সন্তুষ্ট থাকতে পারি না, এই কঠোর ব্রত বুক পেতে নিতে হবে। এই মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে, আমাদের মধ্যে কম কৰ্ম্মীই নিজ সাধনার সিদ্ধিতে পৌঁছিতে পারে। কিন্তু এই মন্ত্র ভুলিলে আমরা নিশ্চয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হইব। ইহাই আমার শেষ বাণী।[১]
[প্রবাসী, ভাগ ৫০, খণ্ড ২, সংখ্যা ৩, পৌষ, ১৩৫৭ ৷
১। বঙ্গীয় ইতিহাস-পরিষদ্ কর্তৃক অর্ঘ্যদান উপলক্ষে আচার্য্যের অভিভাষণ