বৃহস্পতিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
বহিরাক্রমণের ব্যাপারে দিন দিন দেশের মধ্যে উত্তেজনা দারুণ বাড়ছে। এ নিয়ে যে সাজো সাজো রব উঠেছে, তুমি এখানে থাকলে তার আঁচ হয়ত তোমার গায়েও এসে লাগত; অন্যদিকে, এ নিয়ে আমরা যে হৈচৈ জুড়ে দিয়েছি কে জানে, হয়ত নিতান্তই অকারণে তাই দেখে তুমি আমাদের উপহাস করতে।
কাগজগুলোতে এখন শুধু বহিরাক্রমণ ছাড়া কথা নেই; তাতে বলা হচ্ছে, হল্যাণ্ডে যদি ইংরেজদের সৈন্য নামে, তাহলে দেশটির প্রতিরক্ষায় জার্মানরা সর্বশক্তি নিয়োগ করবে; যদি দরকার হয়, দেশ বানের পানিতে ভাসিয়ে দেবে। ফলে, লোকজনদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড়।
লেখার সঙ্গে কয়েকটা ম্যাপ ছাপিয়ে দেখানো হয়েছে হল্যাণ্ডের কোন্ কোন্ অংশ পানির তলায় চলে যাবে। এটা আমস্টার্ডামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য বলে, প্রথম কথা হল, রাস্তায় এক মিটার পানি দাঁড়ালে আমরা তখন কী করব? এ বিষয়ে দেখা যাচ্ছে নানা মুনির নানা মত।
‘যেহেতু আদৌ হেঁটে বা সাইকেলে যাওয়া চলবে না, সুতরাং পানি ঠেলে ঠেলে আমাদের যেতে হবে।‘
‘একেবারেই না, বরং চেষ্টা করে সাঁতরাতে হবে আমরা সবাই স্নানের পোশাক আর টুপি পরে যথাসম্ভব পানির ভেতর দিয়ে ডুবে ডুবে যাব যাতে আমরা যে ইহুদী সেটা লোকে ধরে না ফেলে।’
‘কী যা-তা বকছ, ইঁদুরে কুটুস করে পায়ে কামড়ালে দেখব মেয়েরা কত সাঁতার কাটে!’ (বক্তা স্বভাবতই একজন পুরুষমানুষ–দেখা যাবে, চিৎকার করে কে পাড়া মাথায় করে!)
‘যে যতই বলো, বাড়ি থেকে যে আমরা বেরোবো সে গুড়ে বালি। এখনই যা নড়বড় করছে তাতে বান এলে গুদামঘরটা নির্ঘাত ধ্বসে পড়বে।‘
‘শুনুন, শুনুন। রসিকতা রাখুন, আমরা চেষ্টা করব একটা নৌকো যোগাড় করতে।‘
‘কী দরকার? তার চেয়ে আমি বলি কি, চিলেকোঠা থেকে আমরা প্রত্যেকে নেব একটা করে কাঠের পাকিং বাক্স আর হাল বাইবার জন্যে একটা করে সুপের বড় হাতা!’
‘আমি রয় করে হেঁটে যাব; ওতে কম বয়সে আমি ছিলাম ওস্তাদ।’
‘হেংক ফান সাণ্টেনের তার দরকার হবে না, ওর বউকে উনি পিঠে নেবেন, তাহলেই ভদ্রমহিলার রপায় চড়া হবে।
এ থেকেই ধরনটা তুমি মোটের ওপর আঁচ করতে পারবে। তাই না, কিটি?
এই সব গালগল্প শুনতে মজার হলেও হয়ত আদতে ব্যাপারটা উল্টো। বহিরাক্রমণ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় একটা প্রশ্ন না উঠেই পারে না–জার্মানরা আমস্টার্ডাম ছেড়ে চলে গেলে আমরা তখন কী করব?’
‘আমরাও শহর থেকে চলে যাব এবং যে যতটা পারি বেশভুষা পাল্টে ফেলব।
‘উঁহু, যাবে না। যাই ঘটুক, থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে একমাত্র কাজ হবে দাঁতে দাঁত দিয়ে এখানেই থেকে যাওয়া। নইলে জার্মানরা ঝেটিয়ে সবাইকে খোদ জার্মানিতে চালনা করবে, যেখানে তারা সবাই মারবে। এদের অসাধ্য কিছু নেই!’
‘যা বলেছ, ঠিক তাই। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ ঠাঁই, সুতরাং আমরা এখানেই থাকব। আমরা চেষ্টা করব যাতে মিস্টার কুপহুইস সপরিবারে চলে এসে এখানেই আমাদের সঙ্গে থাকেন। এক বস্তা কাঠের গুড়ো যোগাড় করে আনতে পারলে আমরা মেঝেতেই শুতে পারি। মিপ আর কুপহুইসকে বলা যাক এখনই ওঁরা এখানে কম্বল আনতে শুরু করে দিন।
আমাদের ষাট পাউণ্ড ভুট্টার ওপর বাড়তি কিছু আনিয়ে নিতে হবে। হেংককে বলা যাক আরও মটরশুঁটি আর বিন্ যোগাড় করতে; আমাদের এখন ঘরে আছে ষাট পাউণ্ডের মতো বি আর দশ পাউণ্ডের মতো মটরশুঁটি। মনে থাকে যেন আমাদের হাতে আছে পঞ্চাশ টিন সব্জি।’
‘মা-মণি, অন্যান্য খাবার আমাদের কতটা কী আছে, একটু হিসেব করে দেখবে?
‘মাছ দশ টিন, দুধ চল্লিশ টিন, পাউডার-দুধ দশ কেজি, বনস্পতি তিন বোতল, জমানো মাখনের চারটি বয়াম, জমানো মাংস চার বয়াম, দুটো বেতে-মোড়া স্ট্রবেরির বোতল, দুই বোতল র্যাস্পবেরি, কুড়ি বোতল টমেটো সস, দশ পাউণ্ড ওটমিল, আট পাউণ্ড চাল; সবসুদ্ধ এই।
‘ভাঁড়ারে যা আছে তা খুব খারাপ নয়। কিন্তু যদি বাইরের লোক আসে এবং সঞ্চিত খাবারের প্রতি সপ্তাহে হাত পড়ে, তাহলে এই দৃশ্যত বেশিটা আর তখন আসলে বেশি থাকবে না। বাড়িতে কয়লা আর জ্বালানি কাঠ, আর সেই সঙ্গে মোমবাতি, যা আছে যথেষ্ট। যদি আমরা সঙ্গে টাকাকড়ি নিয়ে যেতে চাই, তাহলে এসো আমরা সবাই আমাদের জামাকাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায় এমন ছোট ছোট সব টাকার থলি বানিয়ে নিই।
‘যদি হঠাৎ পালাতে হয় তাহলে সঙ্গে জরুরি কি কি জিনিস নেব তার একটা লিস্ট এখনি বানিয়ে ফেলতে হবে এবং রুকস্যাকগুলো প্যাক করে তৈরি রাখতে হবে।
পানি যদি অতটাই গড়ায় তাহলে আমরা দুজন লোককে খবরদারির জন্যে রাখব একজন থাকবে সামনে এবং একজন থাকবে পেছনের চিলেকোঠায়। আমি বলি, এত খাবারদাবার যোগাড় করে হবেটা কি, যদি পানি, গ্যাস বা ইলেকট্রিসিটি আদৌ না থাকে?‘
‘তখন আমরা স্টোভে রাঁধব। পানি ফিল্টার করে ফুটিয়ে নেব। কিছু বেতে মোড়া বড় বড় বোতল পরিষ্কার করে নিয়ে তাতে পানি জমিয়ে রাখব।‘
সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করে কেবল এইসব কথা। বহিরাক্রমণ আর শুধু বহিরাক্রমণ; পেটের জ্বালা, মৃত্যু, বোমা, আগুন নেভানো, স্লিপিং ব্যাগ, ইহুদীদের কূপন, বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদি ইত্যাদি–এই নিয়ে কুটচক্ৰচাল।
এর কোনোটাই ঠিক মন প্রফুল্ল করার জিনিস নয়। গুপ্ত-মহলবাসী ভদ্রমহোদয়েরা বেশ খোলাখুলি অমঙ্গলের সঙ্কেত দিচ্ছেন। হেংক-এর সঙ্গে নিম্নোক্ত সংলাপের তার পরিচয় মিলবে–
গুপ্ত-মহল–’আমাদের ভয়, জার্মানরা সরে গেলে ওরা শহর থেকে ঝেটিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।’
হেংক–’অসম্ভব, ওদের হাতে এত ট্রেনই নেই।’
গু-ম–’ট্রেন কেন? আপনি কি ভাবছেন বেসামরিক লোকদের ওরা যানবাহনে করে নিয়ে যাবে? সে প্রশ্নই ওঠে না। ওরা ব্যবহার করবে যে যার ‘পা-গাড়ি’।’ (ডুসেলের মুখের বুলিই হল–চরণদাস বাবাজী।)
হেংক–’আমি ওর একবর্ণও বিশ্বাস করি না। তোমরা সবকিছুর শুধু অন্ধকার দিকটাই দেখ। বেসামরিক লোকদের ঝেটিয়ে নিয়ে গিয়ে ওরা করবেটা কী?’
গু-ম—‘জানেন না গোয়েবলস বলেছে, আমরা যদি পিছিয়ে আসি তাহলে দখল করা সমস্ত দেশের দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে চলে আসব।’
হেংক–’ওরা তো বলার কিছু বাকি রাখেনি।‘
গু-ম—‘আপনি কি মনে করেন জার্মানরা এসবের ঊর্ধ্বে কিংবা তারা খুব হৃদয়বান লোক? ওরা স্রেফ মনে করে–যদি আমাদের ডুবতে হয় তাহলে যারা মুঠোর মধ্যে আছে তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা ডুবব।‘
হেংক–’ওসব গিয়ে দরিয়ার লোকদের বলুন; আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না।’
গু-ম—‘এটাই সবসময় হয়ে থাকে; ঘাড়ে এসে পড়ার আগে কেউ বিপদ দেখতে পায় না।‘
হেংক–’আপনারা তো নিশ্চয় করে কিছুই জানেন না; সবটাই আপনাদের শুধু অনুমান।
গু-ম–’আমরা হলাম সবাই পোড়-খাওয়া মানুষ; আগে জার্মানিতে, এখন এখানে। রুশদেশেই বা কী ঘটছে?’
হেংক–ইহুদীদের কথা বাদ দিন। আমার মনে হয় রুশদেশে কী ঘটছে কেউই তার খবর রাখে না। প্রচারের জন্যে ইংরেজ আর রুশরা অনেক কিছু নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলছে। ঠিক জার্মানদেরই মতন।
গু-ম–’বাজে কথা, ইংরেজরা বেতারে সবসময় সত্যি কথাই বলছে। অতিশয়োক্তি আছে এটা ধরে নিয়েও বলা যায় যে, সত্যি যা ঘটছে তা অতিশয় খারাপ। কেননা পোল্যাণ্ড আর রুশদেশে লক্ষ লক্ষ লোককে ওরা যে স্রেফ কোতল করেছে আর গ্যাস দিয়ে মেরেছে, তা তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।‘
এইসব কথোপকথনের দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে তোমাকে কষ্ট দেব না। আমি নিজে খুব চুপচাপ থাকি এবং এইসব হৈ-হট্টগোলে মোটেই মাথা গলাই না। এখন আমি এমন পর্যায়ে পৌঁচেছি, যেখানে বাঁচি বা মরি এ নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। আমি না থাকলেও দুনিয়া যেমন চলছে তেমনি চলবে। যা ঘটবার তা ঘটবে; বাধা দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই।
আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি এবং শুধু কাজ করে যাই এই আশায় যে, পরিণামে সব কিছু ভালো হবে।
তোমার আনা।
.
শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
ঝকঝক করছে রোদ, আকাশ গাঢ় নীল, সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে আর আমি কী আকুল হয়ে অপেক্ষা করছি–মনে মনে চাইছি–সবকিছু। কথা বলে মনের ভার হালকা করতে, খাচা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে, বন্ধুদের সঙ্গ পেতে, নিরিবিলিতে একা থাকতে। সেই সঙ্গে কী যে ইচ্ছে করছে… চিৎকার করে কাঁদতে! আমি জানি কাঁদলে বুকটা একটু হালকা হত; কিন্তু পারছি না। আমি অস্থির হয়ে কেবল এ-ঘর ও-ঘর করছি, বন্ধ জানালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছি আর বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে, যেন বলছে; তুমি কি শেষ অবধি আমার। মনোবাসনাগুলো চরিতার্থ করতে পারো না?’ আমার বিশ্বাস, এ হল আমার মধ্যে নিহিত বসন্ত; আমি অনুভব করছি বসন্তের উনীলন; আমার সারা দেহ মনে তার সাড়া পাচ্ছি। সহজে পারছি না স্বাভাবিক হতে, সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে, জানি না কী পড়ব, কী লিখব, কী করব, শুধু জানি আমি ব্যাকুল হয়ে আছি।
তোমার আনা।
.
রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
শনিবারের পর আমি আর ঠিক আগের আমি নেই; ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। কিভাবে কী হল বলছি। আমি আকুল ভাবে চাইছিলাম–এবং এখনও চাইছি–কিন্তু… এখন এমন কিছু ঘটেছে, যাতে সেই চাওয়ার তীব্রতা সামান্য, নেহাতই সামান্য, হ্রাস পেয়েছে।
আমার যে কী আনন্দ–অকপটেই তা স্বীকার করব–যখন রাত পোহাতেই আজ সকালে চোখে পড়ল পেটার সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেটা মামুলি গোছের। তাকানো নয়, আমি জানি না কী তার ধরন, আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।
আমি ভাবতাম পেটার ভালবাসে মরগটকে, কিন্তু কাল হঠাৎ আমার কেমন যেন মনে হল সেটা ঠিক নয়। আমি বিশেষ ভাবে চেষ্টা করলাম তার দিকে খুব বেশি না তাকাতে, কেননা ওর দিকে চাইলেই ওর চোখও আমার দিকে ফেরে আর তখন–হ্যাঁ, তখন আমার মধ্যে একটা মধুর অনুভূতি জেগে ওঠে, কিন্তু খুব ঘন ঘন সেটা যেন বোধ না করি।
আমি প্রাণপণে একা হতে চাই। বাপি আমার মধ্যেকার ভাবান্তর লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু তাকে আমার সব কথা বলা সত্যিই সম্ভব নয়। আমাকে বিরক্ত করো না, নিজের মনে থাকতে দাও’–এই কথা সারাক্ষণ চিৎকার করে আমার বলতে ইচ্ছে করছে। কে জানে, হয়ত এমন দিন আসবে যখন আমি এত একা হয়ে পড়ব যতটা একা হতে আমি চাই না।
তোমার আনা।
.
সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
রবিবার আমি আর পিম ছাড়া বাকি সবাই ‘জার্মান ওস্তাদের অমর সঙ্গীত’ শোনবার জন্যে রেডিওর পাশে বসেছিল। ডুসেল অনবরত রেডিওর চাবিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। তাতে পেটার এবং অন্যরাও জ্বালাতন বোধ করছিল। আধঘন্টা সহ্য করার পর পেটার খানিকটা রেগেমেগে জিজ্ঞেস করে উনি চাবি নিয়ে নাড়াচাড়া বন্ধ করবেন কিনা। ডুসেল একেবারেই ওকে পাত্তা না দিয়ে জবাব দেন, ‘এটাকে আমি ঠিকঠাক করছি।’ পেটার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঁকে যা-তা বলে। মিস্টার ভান ডান ওর পক্ষ নিলে ডুসেলকে ঘাট মানতে হয়। এই হয়েছিল ব্যাপার।
কারণটা এমনিতে খুব একটা গুরুতর ছিল না, কিন্তু পেটারকে দেখে মনে হল এ নিয়ে ও খুব বিচলিত। যাই হোক, ছাদের ঘরে আমি যখন আলমারিতে বই খুঁজছি, পেটার আমার কাছে এসে পুরো ব্যাপারটা বলতে শুরু করল। আমি কিছুই জানতাম না, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পেটার যখন দেখল সে একজন মনোযোগী শ্রোতা পেয়েছে তখন সে বেশ গড় গড় করে বলে চলল।
বলল, ‘আর দেখ, আমি সহজে কিছু বলি না। কেননা আমি বিলক্ষণ জানি, বলতে গিয়ে ফল হবে এই যে, আমার কথা আটকে যাবে। আমি তো-তো করতে থাকব, লজ্জায় লাল হব এবং যেটা মনে আছে সেটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে গিয়ে কথা খুঁজে না পেয়ে মাঝপথে চুপ করে যাব। কাল ঠিক তাই হয়েছিল, আমি সম্পূর্ণ অন্য কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু একবার শুরু করে দিয়ে কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেল–জঘন্য ব্যাপার। আমার একটা বিশ্রী অভ্যেস ছিল; আমার মনে হয় আজও সেটা থাকলে ভালো হত। আগে কারো ওপর রেগে গেলে তর্কাতর্কির ভেতর না গিয়ে সোজা তাকে ঘুষি মেরে বসতাম। আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি, এই পদ্ধতিতে আমি কিছু করতে পারব না। আমি তোমাকে তারিফ করি সেই কারণেই। কথা খুঁজে পাচ্ছি না, এমন কখনও তোমার হয় না, মানুষকে তুমি বলো ঠিক যে কথাটা তুমি বলতে চাও। কোনো কথা কখনও তোমার বলতে বাধে না।
আমি বললাম, তুমি খুব ভুল করছ। আমার মনে থাকে এক কিন্তু বলবার সময় সাধারণত একেবারে ভিন্ন ভাবে বলি। তাছাড়া আমি একটু বেশি বকবক করি এবং বড় বেশি। সময় নিই, সেটাও কম খারাপ নয়।
শেষ বাক্যটাতে এসে মনে মনে আমি না হেসে পারলাম না। কিন্তু আমার তখন ইচ্ছে, পেটার তার নিজের কথা বলে চলুক; তাই কোনো উচ্চবাচ্য না করে মেঝেতে একটা কুশনের ওপর পুঁটুলি পাকিয়ে বসে ওর দিকে উত্তর্ণ হয়ে চেয়ে রইলাম। এ বাড়িতে আরেকজন আছে যে আমার মতন একই রকম ক্ষেপে আগুন হয়। আমি দেখলাম মনের সুখে ডুসেলের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে পেরে পেটারের ভালোই হয়েছে। আমার দিক থেকে কাউকে লাগানো ভজানোর ভয় ওর নেই। সেদিক থেকে আমিও বেজায় খুশি, কেননা আমাদের দুজনের মধ্যে যে একটা সত্যিকার সহমর্মিতা গড়ে উঠেছে এটা অনুভব করতে পারছি। আমার মনে পড়ে, একদিন আমার মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে ঠিক এমনই একটা সম্পর্ক ছিল।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি, আজ মারগটের জন্মদিন। সাড়ে বারোটায় পেটার এল উপহারের জিনিসগুলো দেখতে এবং কথা বলতে বলতে থেকে গেল যতক্ষল থাকলে চলত তার চেয়েও বেশি–যেটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। বিকেলের দিকে আমি গেলাম কিছুটা কফি আনতে এবং তারপর আলু আনতে। কেননা বছরের এই একটা দিন আমি চেয়েছিলাম আদর দিয়ে ওকে একটু মাথায় চড়াতে। আমি গেলাম পেটারের ঘরের ভেতর দিয়ে; সঙ্গে সঙ্গে পেটার তার সমস্ত কাগজপত্র সিঁড়ি থেকে সরিয়ে নিল। ওকে আমি জিজ্ঞেস করলাম ছাদের ঘরের কজা দেওয়া দরজাটা বন্ধ করে দেব কিনা। বলল, ‘বন্ধ করে দাও। যখন আসবে, দরজায় টোকা দিও, আমি খুলে দেব।’
ওকে ধন্যবাদ দিয়ে ওপরে গেলাম। বড় জালাটার মধ্যে কম করে দশ মিনিট ধরে সবচেয়ে ছোট আলুগুলো ঘুড়লাম। ততক্ষণে আমার কোমর দরে গেছে এবং ঠাণ্ডাও লেগেছে। স্বভাবতই ডাকাডাকি না করে আমি নিজেই টানা দরজাটা খুলেছি। এ সত্ত্বেও পেটার সঙ্গে সঙ্গে নিজের থেকেই আমার কাছে এসে আমার হাত থেকে প্যান্টা নিল।
বললাম, ‘অনেক খুঁজে পেত ক্ষুদে আলু বলতে বেছে এইগুলো পেয়েছি।‘
‘বড় জালাটা দেখেছিলে?’
‘কোনোটাই দেখতে বাকি রাখিনি।‘
বলতে বলতে সিঁড়ির গোড়ায় এসে আমি দাঁড়িয়েছি। পেটার তখনও হাতের প্যাটা তন্ন তন্ন করে দেখছে। পেটার বলল, ‘ব্যস্ রে, সেরা আলুগুলোই তো বেছে এনেছ।’ তারপর ওর হাত থেকে প্যান্ট ফেরত নেবার সময় বলল, বাহাদুর মেয়ে!’ সেই সময় ওর চাহনিতে ফুটে উঠেছিল এমন একটা শান্ত স্নিগ্ধ ভাব যে, তাতে আমার ভেতরটা মধুর আবেশে ভরে উঠল। আমি বস্তুতই দেখতে পেলাম পেটার আমার মন পেতে চাইছে এবং যেহেতু সে দীর্ঘ প্রশস্তিবাচনে অপারগ সেইজন্যে সে চোখ দিয়ে কথা বলছিল। আমি অতি সুন্দরভাবে বুঝতে পারছিলাম ও কী বলতে চাইছে এবং সেজন্যে নিজেকে ধন্য মনে করছিলাম। আজও সেইসব কথা আর তার সেই চাহনি স্মরণ করে মন আনন্দে ভরে ওঠে।
নিচে নামতেই–মণি বললেন আমাকে আরও কিছুটা আলু আনতে হবে, রাতের খাবারের জন্যে। আমি তো ওপরে যাওয়ার জন্যে তক্ষুনি এক পায়ে রাজী।
পেটারের ঘরে ঢুকে ওকে ফের বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। যখন আমি সিঁড়িতে পা দিয়েছি, পেটার উঠে পড়ে দরজা আর দেয়ালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শক্ত হতে আমার বাজু ধরে জোর করে আমাকে আটকাতে চাইল।
বলল, আমি যাচ্ছি।’ উত্তরে আমি বললাম তা দরকার নেই, কেননা এবারে আমাকে তত ছোট ছোট আলু বাছতে হবে না। বুঝতে পেরে পেটার আমার হাত ছেড়ে দিল। আলু নিয়ে নামার সময় ও এসে টানা দরজাটা খুলে আবার আমার হাত থেকে প্যাটা নিল। দোরগোড়ায় এসে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী করছ? পেটার জবাব দিল, ফরাসী’। ওর অনুশীলনগুলো একটু দেখতে পারি কিনা জেনে নিলাম। তারপর হাত ধুয়ে এসে ওর সামনাসামনি ডিভানটাতে গিয়ে বসলাম।
ফরাসী ভাষার কয়েকটা জিনিস গোড়ায় ওকে বুঝিয়ে দিলাম। তারপরই আমাদের কথা শুরু হয়ে গেল। পেটার বলল ওর ইচ্ছে, পরে ওলন্দাজ-অধিকৃত পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে চলে গিয়ে কোনো বাগিচায় বসবাস করবে। পারিবারিক জীবন, কালোবাজার–এইসব প্রসঙ্গের পর ও বলল–নিজেকে ওর একেবারেই অপদার্থ মনে হয়। আমি ওকে বললাম এর মধ্যে নিশ্চয়ই হীনমন্যতার জট আছে। ইহুদীদের প্রসঙ্গ ও তুলল। বলল ও যদি খ্রীস্টান হত তাহলে ওর পক্ষে অনেক কিছু সহজ হয়ে যেত এবং যদি যুদ্ধের পরে হতে পারে। ও শুদ্ধীকরণ চায় কিনা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তাও সে চায় না। বলল, যুদ্ধ মিটে গেলে কে আর জানছে সে ইহুদী?
এতে আমি একটু মনঃক্ষুণই হলাম এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে সবসময় ওর স্বভাবে একটু মিথ্যের ছোঁয়া থাকে। বাপি সম্পর্কে, লোকচরিত্রের প্রসঙ্গে এবং আরও যাবতীয় বিষয়ে বাদবাকি কথাবার্তা বেশ খোশমেজাজে হল। কিন্তু কী কথা হয়েছিল এখন আর ঠিক মনে নেই। আমি যখন উঠলাম ঘড়িতে যখন সাড়ে চারটে বেজে গেছে।
সন্ধ্যেবেলায় পেটার অন্য একটা কথা বলেছিল। আমার কাছে সেটা ভালোই লেগেছিল। একবার ওকে আমি এক চিত্রতারকার ছবি দিয়েছিলাম; ছবিটা গত দেড় বছর ধরে ওর ঘরে টাঙানো রয়েছে। ছবিটা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে পেটার বলল ওটা ওর খুব প্রিয়। আমি ওকে পরে কখনও আর কিছু ছবি দেব বলায় পেটার জবাব দিল, ‘না। ওটা যেমন আছে থাক। রোজই আমি ছবিগুলো চেয়ে চেয়ে দেখি; এখন ওরা হয়ে পড়েছে আমার হলায়গলায় বন্ধু।’
এখন আমি আরও ভালো করে বুঝতে পারি, পেটার কেন সব সময় মুশ্চির সঙ্গে লেপটে থাকে। ও খানিকটা স্নেহের কাঙাল তো বটেই। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম পেটারের অন্য একটা বক্তব্যের কথা। ও বলেছিল, নিচের ক্রটির কথা মনে হলেই যা ঘাবড়ে যাই, নইলে ভয় কাকে বলে আমি জানি না। কিন্তু সে দোষও আমি কাটিয়ে উঠছি।’
পেটারের সাংঘাতিক হীনমন্যতা। যেমন, পেটার সর্বক্ষণ মনে করে সে হল মাথামোটা আর আমরা খুব চতুর। ওর ফরাসী চর্চায় আমি সাহায্য করলে হাজার বার আমাকে ও ধন্যবাদ দেয়। একদিন আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে বলব–’থামো তো, ইংরেজি আর ভুগোলে তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো।‘
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
যখনই আমি ওপর তলায় যাই, আশায় আশায় থাকি ওর হয়ত দেখা পাব। কেননা আমার জীবনে এখন একটা উদ্দেশ্য এসেছে, এখন কিছু একটা প্রত্যাশা করতে পারি, সবকিছুই আমার কাছে আজ রমণীয় হয়ে উঠেছে।
অন্তত আমার অনুভবের উৎস তো সর্বদাই হাজির; আমার কোন ভয় নেই, কেননা মারগটকে বাদ দিলে আমি তো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভেবো না আমি প্রেমে পড়েছি; কেননা প্রেমে আমি পড়িনি। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা কোনো সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, যা আমাদের দেবে বল ভরসা আর বন্ধুত্ব–আমি এটা সবসময় অনুভব করি। একটা কোনো ছুতো পেলেই এখন আমি ওপরে ওর কাছে চলে যাই। আগে একটা সময় ছিল যখন পেটার কী করে কথা শুরু করবে জানত না। এখন আর তা নয়। বরং তার উল্টো। যাবার সময় আমার এক পা যখন ঘরের বাইরে–তখনও পেটারের কথা শেষ হতে চায় না।
মা-মণি আমার আচরণে তেমন খুশি নন; সবসময়ে বলেন, আমাকে নিয়ে ঝামেলা হবে এবং আমি যেন পেটারকে না জ্বালাই। আশ্চর্য, উনি কি এটা বোঝেন না যে আমার ঘটে কিছুটা বুদ্ধি আছে? পেটারের ছোট ঘরটাতে যখনই যাই মা-মণি আমার দিকে এমন আড়চোখে তাকান। সেখানে নিচে নেমে এলেই জিজ্ঞেস করেন এতক্ষণ কোথায় ছিলাম। আমার গা রী রী করে। খুব জঘন্য লাগে।
তোমার আনা।
.
শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
আবার সেই শনিবার এবং তাতেই সব স্পষ্ট হয়ে যায়।
সকালটা ছিল চুপচাপ। ওপর তলায় গিয়ে আমি কিছুটা বাড়ির কাজে সাহায্য করেছি; কিন্তু ওর সঙ্গে দু-একটা ঠুনকো কথা ছাড়া হয়নি। আড়াইটে নাগাদ সবাই যখন শুতে কিংবা পড়তে যে যার ঘরে চলে গেছে, আমি কম্বল আর যা কিছু সব নিয়ে টেবিলে বসে লেখাপড়া করতে খাস কামরায় চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম, কাধের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল; তখন আমার কী বিশ্রী মনের অবস্থা কী বলব। ইস! ‘ও’ যদি একবার এসে আমার দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। চারটে নাগাদ আবার আমি ওপরে গেলাম। আবার তার দেখা পাব, মনে এই আশা নিয়ে গেলাম খানকতক আলু আনতে। যখন আমি গোসলের ঘরে চুল ঠিক করছি, ঠিক তখনি সে মালখানায় বেখোর খোঁজে নিচে নেমে গেল।
হঠাৎ আবার চোখ ফেটে পানি চলে আসার উপক্রম হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি শৌচাগারে ছুটে যাই। যেতে যেতে তাড়াতাড়ি একটা পকেট-আয়না টেনে নিই। তারপর সেখানেই পুরো জামাকাপড়সুদ্ধ বসে পড়ি আর আমার লাল আঁচলে চোখের পানি পড়ে কালো কালো দাগে ভরে যায়। আমার এত মন খারাপ লাগছিল বলার নয়।
আমার মনের মধ্যে তখন এই রকম হচ্ছিল। ইস্, এভাবে আমি কখনই পেটারের কাছে যেতে পারি না। বলা যায় না, ও হয়ত আমাকে আদৌ পছন্দ করে না এবং মনের কথা বলার মত কাউকেই ওর দরকার নেই। হয়ত আমার কথা ও নেহাত ওপরসা ভাবে। আমাকে হয়ত আবারও সেই সাথীহারা একা হয়ে যেতে হবে, পেটার থাকবে না। হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই আমার না থাকবে আশ্বাস না কোনো স্বস্তি; হয়ত এরপর হাপিত্যেশ করারও কিছু থাকবে না। ইস্, আমি যদি ওর কাধে আমার মাথা রাখতে পারতাম, নিজেকে যদি এত নিঃসঙ্গ, এত পরিত্যক্ত মনে না হত! ও আমার কথা আদৌ চিন্তা করে কিনা এবং অন্যদের দিকেও ঠিক একই ভাবে তাকায় কিনা, কে জানে! ও আমাকে বিশেষ ভাবে দেখে, এটা হয়ত ছিল আমারই মন গড়া। ও পেটার, শুধু যদি আমি তোমার চক্ষুকর্ণের গোচর হতাম! যা ভয় করছি তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে তা হবে আমার সহ্যের বাইরে।
যাই হোক, অবিরল অশ্রুধারার মধ্যেও একটু বাদে মনে হল যে আবার নতুন আশ্বাস আর প্রত্যাশা ফিরে এসেছে।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
বাইরে ভারি সুন্দর আবহাওয়া। কাল থেকে মনে আমার বেশ ফুর্তির ভাব। প্রায় রোজ সকালেই ছাদের ঘরে চলে যাই যেখানে পেটার কাজ করে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিচের দমবন্ধ ভাব দূর করি। মেঝেতে একটা জায়গা আছে, সেখান থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে নীল আকাশ দেখি। নিষ্পত্র একটা চেস্টনাট গাছ, তার ডালে ডালে রূপোর মতন জ্বলজ্বল করে বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সী-গাল আর অন্যান্য পাখি।
একটা মোটা কড়িকাঠে মাথা ঠেকিয়ে পেটার দাঁড়িয়ে। আমি বসলাম। খোলা হাওয়ায় আমরা নিঃশ্বাস নিচ্ছি। বাইরে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত। দুজনেই বুঝছি, কথা বললেই এই মোহজাল ছিঁড়ে যাবে। অনেকক্ষণ আমাদের এইভাবে কেটে গেল। পেটারকে যখন কাঠ চেলা করতে মকায় যেতে হল, তখন আমার উপলব্ধি হল মানুষটা খুব চমৎকার। পেটার মই বেয়ে ওপরে উঠে গেল; ওর দেখাদেখি আমিও উঠলাম।
মিনিট পনেরো ধরে ও কাঠ চেলা করল। এ পর্যন্ত আমরা কেউ একটাও কথা বলিনি। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখছি! দেখেই বোঝা যায় ও কতটা জোয়ান সেটা সর্বশক্তিতে দেখানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু সেই সঙ্গে আমি চেয়ে দেখছি খোলা জানলার বাইরে আমস্টার্ডামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, ছাদের পর ছাদ আর দূর দিগন্তে, তার রঙ এমনই ফিকে নীল যে বোঝাই দায়, কোথায় তার শেষ আর কোথায় শুরু। আমি মনে মনে বললাম, ‘যতদিন এর অস্তিত্ব আছে আর আমি বেঁচে থেকে দেখব এই রৌদ্রালোক, নির্মেঘ আকাশ, এ যতক্ষণ আছে আমি অসুখী হতে পারি না।’
যারা সন্ত্রস্ত, যারা নিঃসঙ্গ অথবা যারা অসুখী, তাদের পক্ষে সবচেয়ে প্রশস্ত হল বাইরের কোথাও চলে যাওয়া, এমন জায়গায় যেখানে জ্যোতিলোক, নিসর্গ আর ঈশ্বরের সঙ্গে তারা। একা হতে পারবে। কারণ, একমাত্র তখনই কেউ অনুভব করে সবকিছু যথোচিত আছে; এবং প্রকৃতির শুদ্ধ সৌন্দর্যের মাঝখানে মানুষ খুশি হোক, ঈশ্বর তাই চান। এ যতদিন আছে, এবং এ জিনিস নিশ্চয় চিরদিই থাকবে। আমি জানি, যখন যে অবস্থাই আসক, প্রত্যেকটি, সন্তাপে। সব সময়ই সান্ত্বনা মিলবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সব কষ্টের উপশম ঘটায় প্রকৃতি।
আমি এমন একজনের সঙ্গে এই পরম সুখানুভূতি ভাগ করে নিতে চাই, এ ব্যাপারে যার জ্ঞানবোধগুলো আমারই মতন। মন বলছে, হয়ত সেটা ঘটতে খুব বেশি দেরি হবে না।
তোমার আনা।
.
একটা ভাবনা
এখানে এত কিছু পাই না, তার পরিমাণ এত বেশি এবং আজ এতদিন ধরে; তোমার মতোই আমি বঞ্চিত। বাইরের জিনিসপত্রের কথা তুলছি না, সেদিক থেকে বরং আমাদের দেখবার লোক আছে; আসলে আমি বলছি ভেতরের জিনিসের কথা। তোমার মতন, আমি চাই স্বাধীনতা আর খোলা হাওয়া, কিন্তু এখন আমার ধারণা, বহু কিছু আছে যাতে আমাদের অভাব পুষিয়ে যায়। আজ সকালে জানালার ধারে বসে বসে এটা হঠাৎ আমার উপলব্ধি হল। আমি বলছি ভেতরের ক্ষতিপূরণের কথা।
যখন আমি বাইরে তাকিয়ে সরাসরি নিসর্গ আর ঈশ্বরের গহনে চোখ রাখলাম, তখন আমি সুখ পেলাম, সত্যিকার সুখ। আর দেখ পেটার, যতক্ষণ আমি এখানে সেই সুখ পাই প্রকৃতি, সুস্থ সবলতা এবং আরও অনেক কিছুর আনন্দ, সর্বক্ষণই তা পাওয়া যায়। সমস্ত সময়ই সেই সুখ মনের মধ্যে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।
ধনদৌলত পুরোটাই খোয়া যেতে পারে, কিন্তু তোমার আপন হৃদয়ে সেই সুখ শুধুমাত্র অবগুণ্ঠিত হতে পারে; যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে ততদিন আবারও তা তোমাকে সুখ এনে দেবে। যতদিন তুমি অকুতোভয়ে জ্যোতির্লোকে দৃষ্টি ফেরাতে পারবে, ততদিন তুমি জানছ অন্তরে তুমি শুদ্ধ এবং চাইলেই সুখ পাবে।
.
রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
প্রিয়তম কিটি,
সেই কোন্ ভোর থেকে অনেক রাত অবধি পেটারের কথা ভাবা ছাড়া আমি প্রায় আর কিছুই করি না। ঘুমোবার সময় আমার চোখে পটে থাকে ওর ছবি, ওকে নিয়ে আমার স্বপ্ন এবং যখন চোখ খুলি তখনও ‘ও আমার দিকে তাকিয়ে।
আমার খুব মনে হয়, বাইরে যেমনই দেখাক, প্রকৃতপক্ষে পেটার আর আমার মধ্যে খুব একটা তফাত নেই। কেন বলছি–আমাদের দুজনেরই মা থেকেও নেই। ওর মা-র হালকা স্বভাব, ফষ্টিনষ্টি করতে ভালবাসেন, ছেলের মনে কী হচ্ছে তা নিয়ে ওঁর বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আমার মা আমার সম্পর্কে চিন্তা করেন, কিন্তু তার মধ্যে সংবেদনশীলতা এবং মাতৃসুলভ বৃত্তির অভাব। পেটার আর আমি, আমরা দুজনেই আমাদের ভেতরকার অনুভূতিগুলোর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ি, এখনও আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি, রুক্ষ ব্যবহার পেলে মনে খুব লাগে। কেউ যদি তেমন করে, আমার মনে হয় যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলে, আমি আমার মনের ভাব গোপন করে গটগটিয়ে চলি, গলাবাজি করি আর মেজাজ দেখাই–যাতে প্রত্যেকে ঝেটিয়ে দূর করে দিতে চায়।
পেটার এর ঠিক উল্টো। ও ঘরে ঢুকে খিল এঁটে দেয়, কথা প্রায় বলে না বললেই হয়, চুপচাপ বসে সুখস্বপ্ন দেখে এবং তার মতো করে নিজেকে ও আড়াল করে রাখে।
কিন্তু কখন কিভাবে আমরা শেষ পর্যন্ত পরস্পরের কাছে পৌঁছব? আমি ঠিক জানি না, আমার সহজ বুদ্ধি আর কতদিন এই উৎকণ্ঠাকে সামাল দিয়ে চলবে।
তোমার আনা।
.
সোমবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
প্রিয়তম কিটি, কি দিনে কি রাত্রে–এটা একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে। প্রায় সারাক্ষণই ওকে দেখি অথচ ওর কাছে যেতে পারি না। আমাকে দেখে কেউ যাতে বুঝতে না পারে, তার জন্যে যখন আমি আসলে মুষড়ে পড়ি তখনও নিজেকে আমার হাসিখুশি দেখাতে হবে।
পেটার ভেসেল আর পেটার ফান ডান মিলে এখন পেটারে একাকার হয়ে গেছে। পরমপ্রিয় আর সজ্জন এই পেটার; ওর জন্যে আমার কী যে আকুলিবিকুলি কী বলব।
মা-মণি ক্লান্তিকর, বাপির মিষ্টি স্বভাব এবং সেইজন্যেই আরও ক্লান্তিকর। মারগট সবচেয়ে বেশি ক্লান্তিকর, কারণ ও চায় আমি হাসিখুশি ভাব নিয়ে থাকি। আমি বলি আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
চিলেকোটায় পেটার আমার কাছে এল না। তার বদলে মটকায় উঠে গিয়ে ছুতোরের কিছু কাজ করল। একবার করে আওয়াজ হয় চটাস্ আর খটাস, অমনি আমার বুকের মধ্যে যে ধড়াস্ করে ওঠে। আর আমি ততই বিমর্ষ হয়ে পড়ি। দূরে ঘণ্টা বাজছে ‘শুদ্ধ দেই, শুদ্ধ আত্মার সুরে (পুরোনো ঘড়িওয়ালা মিনারে ঘন্টা বাজে গানের সুরে)। আমি ভাবপ্রবণ হয়ে পড়ছি–আমি তা জানি; আমি মন-ভাঙা আর ভোতা হয়ে পড়ছি–তাও জানি। কে আছ, আমাকে বাঁচাও!
তোমার আনা।