০৬. ফখরুদিন সাহেবের মেজাজ

ফখরুদিন সাহেবের মেজাজ অল্পতেই খারাপ হয়। দেশের মাটিতে সেই মেজাজ প্রকাশের যথেষ্ট পথ থাকলেও বিদেশে সম্ভব হয় না। আজ একের পর এক যে-সব কাণ্ড ঘটেছে, তাতে তার মাথা খারাপ হয়ে গেলেও দোষের ছিল না। তিন্তি তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে। প্লেনে তার পাশের সহযাত্ৰিণী অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হাড়-হড় করে বমি করল, তার খানিকটা এসে পড়ল তাঁর গায়ে। তিনি মুখ বিকৃত করে বললেন, ইটস অলরাইট। এয়ার হোস্টেস সাবান-পানি দিয়ে তাঁর কোট কয়েকবার মুছে দিল। তবু বমির উৎকট গন্ধ গেল না। টয়লেটে গিয়ে কাপড় বদলানো যেত। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একটিমাত্র ব্রিফকেস। বড় সুটকেস দু’টি লাগেজ-কেবিনে।

প্লেন থেকে নামার সময়ও ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল। সিঁড়িতে বেকায়দায় পা পড়ে পা মচকে গেল।

ইমিগ্রেশন অফিসারের সঙ্গেও কিছু কথা কাটাকাটি হল। অফিসারটি বলল, তুমি লন্ডনে কী জন্য যাচ্ছ?

তিনি বললেন, তা দিয়ে তোমার কী দরকার? আমার পাসপোর্টে ভিসা দেয়া আছে। সেই ভিসায় আমি ঢুকব।

তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। কেন যাচ্ছ, বিজনেস ট্রিপ, না প্লেজার ট্রিপ?

ফখরুদ্দিন সাহেব বিরস গলায় বললেন, সর্দি ঝাড়ার জন্যে যাচ্ছি। তোমার এই দেশ নাকের সর্দি ফেলার জন্যে অতি উত্তম।

তুমি কী আমার সঙ্গে রসিকতা করবার চেষ্টা করছ?

হ্যাঁ, করছি।

তোমার ব্রিফকেস খোল, হ্যাঁন্ডব্যাগ খোল। চেকিং হবে।

এক বার হয়েছে।

আরো দশ বার হবে। তোমার সঙ্গে টাকা পয়সা কী পরিমাণ আছে?

যথেষ্টই আছে।

পরিমাণটা বল।

পরিমাণ তোমাকে বলার প্রয়োজন দেখছি না। লিখিতভাবে আগেই এক বার বলা হয়েছে।

সুবোধ বালকের মতো আরো এক বার বল।

যদি বলতে না চাই?

তুমি এস আমার সঙ্গে।

কোথায়?

তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

অতি উত্তম প্রস্তাব। চল, যাওয়া যাক।

ফখরুদিন সাহেবকে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হল। যখন ছাড়া পেলেন, তখন তাঁর শরীর অবসন্ন। একটু পর পর বমি আসছে। বমির বেগ সামলাতে হচ্ছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা।

হোটেলে পৌঁছেই বাংলাদেশে কল বুক করতে চাইলেন। বলা হল–স্যাটেলাইটে ডিসটারবেন্স আছে, ওভারসিজ, কল ছ ঘণ্টার আগে করা যাবে না।

হেলেনার খোঁজে তার নাসিং হোমে টেলিফোন করলেন। এ্যাটেনডেন্ট নার্স বলল, পেসেন্ট।

ফখরুদ্দিন সাহেব বললেন, আমি ওর স্বামী।

নার্স মধুর হেসে বলল, তুমি পেসেন্টের স্বামীই হও বা প্রেমিকই হও, হার্টের রুগীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা যাবে না। সকাল আটটায় টেলিফোন করো, কেমন? এখন শান্ত হয়ে ঘুমাও। রাত কত হয়েছে সেটা বোধহয় তুমি জান না। গুড নাইট।

রুম-সার্ভিসকে কফি দিতে বলেছিলেন। সেই কফি এল এক ঘণ্টা পর। চুমুক দিয়ে তার মনে হল, তিনি কুইনাইন-গোলা গরম পানি খাচ্ছেন।

সারা রাত তাঁর ঘুম হল না। ছটফট করতে লাগলেন। শেষরাতের দিকে প্রবল জ্বরে সমস্ত চেতনা আচ্ছান্ন হয়ে এল। তাঁর মনে হল এই হোটেলে তাকে মরতে হবে। আত্মীয়-পরিজনহীন নির্জন একটি ঘরে। শেষ মুহুর্তে পানি পানি করে চেঁচাবেন–কেউ শুনবে না। কোনো প্রিয় মানুষের মুখ দেখতে চাইবেন, দেখতে পারবেন না।

প্রিয় মুখ এই সংসারে তার নেই। বাবার মুখ আবছাভাবে মনে পড়লেও মার মুখ মনে পড়ে না। বাবার মুখও অস্পষ্ট, তার মুখে বসন্তের দাগ ছিল। মাথায় চুলগুলি ছিল। লালচে ধরনের কোঁকড়ানো। স্মৃতি বলতে এই। অবশ্যি এ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা কোনোকালেই ছিল না। যা চলে গিয়েছে, তা নিয়ে বুক চাপড়ানো এক ধরনের বিলাসিতা। এই বিলাসিত কবি এবং শিল্পীর জন্যে ঠিক আছে। তার জন্যে ঠিক নয়। তার চোখ পেছনের দিকে নয়, সামনের দিকে।

তিনি রুম-সার্ভিসের বোতাম টিপলেন। লাল বাতি জ্বলে জ্বলে উঠছে। কেউ আসছে না। অসম্ভব ক্ষমতাবান লোকেরা প্ৰায় সময়ই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যায়।

দরজায় নক হচ্ছে। কেউ বোধহয় এসেছে। ফখরুদিন সাহেব বহু কষ্টে বললেন, কাম ইনি।

লাল চুলের বেঁটেখাটো একজন মহিলা উঁকি দিল। ভয-পাওয়া গলায় বলল, তোমার কী হয়েছে?

ফখরুদিন সাহেব জবাব দিতে পারলেন না। শূন্যদৃষ্টিতে তাকালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *