০৬. পীরবাড়ি ১

উনসত্তরের শেষ দিকে আমাদের চলে আসতে হয় আকুয়ার পাট চুকিয়ে। এঁদো গলির ধারে খলসে মাছে ভরা পুকুর, তার পাশে, কড়ই নিম খেঁজুর আর সুপুরি গাছের বেড় দেওয়া নানির চৌচালা ঘর, উঠোনে কুয়ো ছাড়িয়ে নারকেল গাছের সার, তার ওপারে আরেক ফালি উঠোন, উঠোনের উত্তরে বৈঠক ঘর, দক্ষিণে শোবার, শোবার ঘরের সিঁড়ির কাছে পেশাবখানা, পশ্চিমে খাবার ঘর আবার আরেক ফালি উঠোন আরও পূবে, দাদাদের আর খড়ির ঘরের মাঝখানে, যে ঘর পরে কাকার ঘর হয়ে ওঠে, খড়ি রাখা হয় বৈঠকঘরের পাশে ঘুমটি ঘরের মত লাল একটি ঘরে–সব ফেলে আমরা, আমি, দাদা, ছোটদা, বাবা, মা, ইয়াসমিন উঠি এসে আমলাপাড়ায় বিশাল বাড়িতে। বাড়িতে বোতাম টিপলে বাতি জ্বলে, পাখা ঘোরে। বড় বড় ঘর, মস্ত মস্ত থাম বসানো বারান্দা। যেন রাজার বাড়ি এটি, রাজা নেই উজির নাজির নেই, বাড়ি খালি পেয়ে উঠে এসেছি। বাড়ির লাল নীল হলুদ বেগুনি কাচ লাগানো জানালাগুলো আমার চেয়ে মাথায় লম্বা। আটত্রিশটি সিঁড়ি নেমে গেছে ঘর থেকে উঠোনে। মন্দিরের দেয়ালে যেরকম খোপ থাকে, সে রকম খোপে ভরা ঘরের দেয়াল। খোপগুলো পরে বুজে ফেলেছিলেন বাবা, সিঁড়িগুলো ভেঙেও টানা ইস্কুলঘরের মত বারান্দা বানিয়ে ফেলেছিলেন। এম এ কাহহার নামে পাড়ার এক বিত্তবানের বাড়িতে বাবা দেখেছেন খোপহীন দেয়াল, টানা বারান্দা–আমি অনুমান করি, বাবা এ বাড়িটিকেও সেরকম আদল দিতে কিছু টেনেছেন, কিছু বুজেছেন। বড়লোক দেখলে, বাবাকে দেখেছি, একেবারে মিইয়ে যান। যেন বড়লোকের সব ভাল, তাদের বেঢপ বারান্দাও। তবু বাবা কখন কি করবেন কেউ জানে না, হঠাৎ হয়ত একদিন ট্রাক ভরে বালু এল বাড়িতে, সিমেন্ট এল, ইট এল–দেখে ধারণা হয় সম্ভবত ভাঙা গড়া কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, না ঘটা অবদি কারও সাধ্য নেই বোঝার কী ঘটতে যাচ্ছে। বাবার ইচ্ছের কথা কার সাধ্য আছে বোঝে! আমাদের বাড়িটিই পাড়ার আর সব বাড়ি থেকে উঁচু, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি নীল আকাশ রকম উঁচু। বাড়িটিতে আসবাব পত্র ঢোকানোর আগের রাতে আমি আর ছোটদা এসে এক রাত থেকেছিলাম, ছোটদা তাঁর গিটারখানা নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে, অনেক রাত অবদি গিটার বাজালেন ছোটদা, আর আমি গিটারের হলুদ জামাটির ওপর শুয়ে ছোটদা বলে ডাকলে গমগম করে সাতবার ছোটদা শোনা যেত, তা শুনেছি যেন রাজার সাত ছেলে বাড়ির সাত দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে আর আমাকে ভেঙচি কাটছে আমি যা বলি তাই বলে। আমি কোথায় বললে সাতটি কোথায়, তুমি বললে সাতটি তুমি ভেসে আসে কোত্থেকে যেন। বাড়িটির চারদিক জুড়ে নারকেল আর সুপুরি গাছ। উঠোনে তিরিশ রকম ফুল ফলের গাছ। এমন বড় বাড়ি, আমার বিশ্বাস হয় না, আমাদের। নতুন বাড়িতে আসার পর পর পর কিছু ঘটনা ঘটে, এক নম্বর জানলার শিক ভেঙে বাড়িতে চোর ঢুকে গয়নাগাটি টাকা পয়সা নিয়ে যায়। দঞ্চুনম্বর বাবাকে একদিন রিক্সায় সঙ্গে রাজিয়া বেগম, অলকা হলের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন মা। তিন নম্বর দাদা আর তাঁর বন্ধুরা পাতা নামে একটি পত্রিকা বের করেন, কবিতা গল্প ধাঁধা নিয়ে পাঁচমিশেলি পত্রিকা। সেই পাতা পত্রিকায় রামধনু নামে একটি কবিতা লিখে আমার নামে ছেপে দেন দাদা। কবিতার রচয়িতার নাম নাসরিন জাহান তসলিমা, যদিও বিদ্যাময়ী ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় ইস্কুলের খাতায় ঝুনুখালা খানিকটা ছোট করে আমার নাম তসলিমা নাসরিন লিখেছিলেন।

দাদা বললেন–সামনের সংখ্যায় তর নামে আরেকটা কবিতা ছাপাইয়াম।

মহানন্দো বলি–তাইলে আমি নিজে লিখবাম আমার কবিতা!

দাদা ফ্যাক করে হেসে ফেলেন–যা যা। তুই আবার লেখতে পারস নাকি!

মুহূর্তে বিষাদ আমাকে ছেয়ে ফেলে। ফ্রকের কোঁচড় ভরে জাম কুড়িয়ে দৌড়ে চলে যাই ছাদে। জামের রস রেগে বেগুনি হয়ে থাকে ফ্রক। আমার মন পড়ে থাকে কবিতায়।

এর পর থেকে দাদা বাড়ি না থাকলে তাঁর পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে কবিতার খাতা বের করে গোগ্রাসে পড়ি। আহা, এরকম আমিও যদি লিখতে পারতাম!

নতুন বাড়িতে আসার পর বাবা দেড় মণ ওজনের একটি গানের যন্ত্র কিনে আনলেন জার্মানি থেকে আসা এক লোকের কাছ থেকে। বন্ধুদের ডেকে এনে যন্ত্রটি দেখাতে লাগলেন দাদা আর বলতে লাগলেন মেইড ইন জার্মানি। হিটলারের বীরত্বে দাদা সবসময়ই বড় অভিভূত। হিটলারের দেশ থেকে আসা জিনিস নিয়েও। বন্ধুরা দু’চোখ ভরে যন্ত্র দেখে যায়। তারা এ যাবৎ হিজ মাস্টারস ভয়েজের কলের গানই দেখেছে, এমন যন্ত্র দেখেনি, বড় বড় ডিস্কে ফিতে লাগানো, একটির ফিতে আরেকটিতে ঘুরে ঘুরে জমা হয়। দেখে যাওয়ার পর পর নারায়ণ সান্যাল তার একক নাটিকা, পিন্টু তার গিটারের বাজনা, মাহবুব তার গলা ছেড়ে গাওয়া নজরুল গীতি ফিতেবন্দি করতে আসে। সবকিছুই আমাকে দেখতে হয় দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে, কাছে যাওয়ার কোনও অনুমতি আমি পাইনি। দাদা ভরাট গলায় নিজের আবৃত্তি করা রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কবিতাও ফিতেবন্দি করেন। দাদার রাতারাতি নাম হয়ে যায় শহরে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখার্জি, মান্না দের গান বাজে, দাদা আর ছোটদা দিনের বেশির ভাগ সময় বাদন যন্ত্রটির ওপর ঝুঁকে থাকেন। বড় ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখতে। দাদা বলেন–কিছু ধরবি না। দূরে দাঁড়াইয়া দেখবি।

দাদা বাড়ি না থাকলে আমি সে যন্ত্রও ছুঁয়ে দেখি। ইয়াসমিন ছুঁতে চাইলে বলি –দূরে দাঁড়াইয়া দেখ। কিছু ধরবি না। ও দূরে দাঁিড়য়ে দেখে। আমি যন্ত্রের দু’তিনটে বোতাম টিপলেই গান বাজতে শুরু করে। পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে শুয়ে গান শুনি। আমার বড় দাদা হতে ইচ্ছে করে।

বাড়িতে চুরি হওয়ার কারণে এরকম নিয়ম দাঁড়ায় জানালা দরজা সব বন্ধ রাখতে হবে। সে গরমে গা সেদ্ধ হলেও জানালা খুলে হাওয়া খাওয়া চলবে না। ভাঙা জানালায় বাবা আরও তিনটে করে শিক লাগিয়ে দিলেন, জেলখানার শিকের মত, লম্বা আর পাথারি। ঘরগুলো অন্ধকার হয়ে রইল। দিনের বেলাতেও আলো জ্বেলে লেখাপড়া খাওয়াদাওয়া করতে হয়। স্যাঁতসেঁতে ঘরে নিজেদের ইদূঁরের মত মনে হতে থাকে। রাজিয়া বেগমের সঙ্গে বাবাকে রিক্সায় দেখার পর থেকে মা শয্যা নিয়েছেন। রাঁধাবাড়া, নাওয়া খাওয়া ছেড়ে, শুকনো মুখে সারাদিন শুয়ে থাকেন। বাবার ঘর থেকে নিজের কাপড় চোপড় বিছানা বালিশ সরিয়ে অন্য ঘরে ঢুকেছেন। মা’কে দেখলে যে কেউ মনে করবে কঠিন এক ব্যারাম হয়েছে মা’র। চুলে তেল পড়ে না, চিরুনি পড়ে না। ঘামাচিতে গা ভরে গেছে, ঘামে শরীরের কাপড় লেপ্টে থাকে শরীরে। সারাদিন রা শব্দ নেই, বাবার বাড়ি ফেরার শব্দ শুনলে কেবল ছুটে এসে চিকন গলায় বিলাপ শুরু করেন –ওই তো, বেটির সাথে সারাদিন কাটাইয়া আইলা। বুঝি, এত বড় বাড়ি কিনছ, ওই বেটিরে বিয়া কইরা এই বাড়িতে তুলবা বইলা। মা’র বিলাপের কোনও জবাব কখনও দেন না বাবা। যেন কারও কোনও কথা তাঁর কানে ঢুকছে না। যেন কেউ তাঁকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছে না। যেন যে শব্দগুলো ভাসছে ঘরে, সেটি কিছুই না, বেড়ালের মিঁয়াও মিঁয়াও বা চুলোয় খড়ি পোড়ার শব্দ। মা যে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, অনর্গল চেচিয়ে যাচ্ছেন, বাবা তাঁর উপস্থিতি বা স্বর যেন টের পাচ্ছেন না এমন ঢঙে হাঁটাহাঁটি করেন উঠোনে ঘরে, বাচ্চাদের চাকরবাকরদের কুকুরবেড়ালের খবরটবর নেন, নানির বাড়ির পেছনের বস্তি থেকে নিয়ে আসা নতুন কাজের মেয়ে মণিকে ডাকেন ভাত দিতে, ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সর্ষের তেল মাখা চুল আঁচড়ে চলে যান বাইরে। মা পেছনে দাঁড়িয়ে বাবার গুষ্ঠি তুলে গাল পাড়েন–আমার বাবা ডাক্তারি পড়াইছে বইলা ডাক্তার হইছস, নাইলে তো চাষার ছেড়া চাষাই থাকতি। টেকার লুভে বিয়া করছিলি আমারে, এহন নিজের টেকা হইছে, আমারে ফালাইয়া আরেক বেডার বউ লইয়া রঙতামাশা করস। আল্লায় তরে ধ্বংস করব, তর এই বাবুগিরি থাকব না, দেমাগ কই যাইব! আমি তরে অভিশাপ দিতাছি, আমার বাপের নিমক যদি খাইয়া থাকস, তাইলে আমারে যন্ত্রণা দেওনের বিচার আল্লায় করব। তর চৌদ্দ গুষ্ঠি মরব কুষ্ঠ হইয়া। মা’র ধারণা বাবা আজ রাতে বা কাল সকালে রাজিয়া বেগমকে বিয়ে করে ঘরে তুলবেন। রাগে ফাটা মা’র সামনে কেউ দাঁড়াবার সাহস করে না। আমার মুখ ফসকে একদিন বেরিয়ে যায়–এত চিল্লাও ক্যা? এই ডা তো আর আকুয়া পাড়া না।

মা ঝড়ের মত উড়ে এসে আমার চুল ধরে এমন হেঁচকা টান দেন যে আমি চেয়ারে বসা ছিলাম সেটি উল্টে পড়ল পেছন দিকে, আর আমি গিয়ে ঠেকলাম দেয়ালে, মা আমাকে লাটিমের মত ঘোরালেন। দু’গালে কষে থাপ্পড় দিয়ে কর্কশ গলায় বলেন– হারামির বাচ্চা কস কি তুই! বাপে কুনওদিন ফিইরা চাইছে তগোর দিকে! বাপের পক্ষ লস! তা তো লইবিই! এক রক্ত তো! বদমাইশের রক্ত। রাক্ষুসি মাগি, তুই আমারে জন্ম থেইকা জ্বালাইতাছস! তই জন্মাইবার পর থেইকাই আমার কপাল পুড়ছে। তরে যে কেল্লিগা আমি ছডিঘরে নুন খাওয়াইয়া মাইরা ফেললাম না!

মা আক্ষেপ করেন আমাকে কেন লবণ খাইয়ে আঁতুড় ঘরেই মারেননি। আমার চোখ ভিজে যায় জলে। মা ফিরেও তাকান না আমার চোখের জলের দিকে।

মা’র ভাষা দিন দিন অশ্লীল হতে থাকে, দিন দিন মা’র গায়ে ঘামাচি বাড়তে থাকে, চোখের নিচে কালি পড়তে থাকে। কেবল বাবাকে নয়, বাড়িসুদ্ধ সবাইকে সকাল সন্ধে গালাগাল করেন। ছেলেমেয়েরাও নাকি তাঁর জন্মের শত্তুর। চাকরবাকররা দুধ কলা দিয়ে পোষা কালসাপ। মণি যা ভাত তরকারি দিয়ে যায় মা’র ঘরে তা থালসুদ্ধ ছুঁড়ে মারেন উঠোনে আশংকা ক’রে যে ষড়যন্ত্র করে কেউ তাঁকে বিষ খাওয়াতে চাচ্ছে। নানির বাড়ি থেকে মামা খালারা এলে মা তাঁদের ঘরে বসিয়ে বাবা আর রাজিয়া বেগমকে কেমন গায়ে গা লাগিয়ে রিক্সায় বসা দেখেছেন বর্ণনা করেন আর বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন। মা’র স্বপ্ন ছিল নতুন বাড়িতে নতুন করে সংসার সাজিয়ে তিনি নতুন জীবন শুরু করবেন।

এরকমই দিন যাচ্ছিল, আমাদেরও অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল সাত চড়ে রা নেই। বাবার দিকে মা একটির পর একটি ছুঁড়ে দেবেন যা ইচ্ছে তাই। কফ থুথু গু মুত। আমরা যে যার পড়ার টেবিলে মুখ গুঁজে বসে থেকে ভান করব যে কিছুই দেখছি না বা শুনছি না। আমি সাধারণত সেসময় জটিল অঙ্ক কষতে বসি, অঙ্ক কষার এই এক সুবিধে, মার্জিনে কাটাকুটি করার স্বাধীনতা জোটে, তাই করি আমি, যে কেউ দেখলে ভাববে অঙ্ক আমাকে বিষম দাবড়াচ্ছে। কিন্তু আমি যে জটিলতার অনেক বাইরে মনে মনে মেঘলা কোনও দুপুরে, কোনও এক ধুধু মাঠের কিনারে এক শান্ত পুকুরের ধারে বসে গাঙচিলের ওড়াওড়ি দেখি, তার ছবি আঁকি আর কারও পায়ের শব্দ পেলেই তা কেটে দিই অঙ্কের কাটাকুটির মত তা আমি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। বাবা না, মা না। এরকমই একসময়, মা যখন বাবা বাড়ি ফিরতেই বললেন দুষমনডা আইছে, বেডির সাথে যা কাম করনের তা কইরা আইছে। মাগিবাজ কুথাকার! চরিত্রহীন! বাবা, তখনও হাত মুখ ধোননি, শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরেননি, টাই ঢিলে হয়ে আছে, ধেয়ে গেলেন মা’র ঘরের দিকে বলতে বলতে পাইছস কি বেডি, আমার বাড়িতে থাকস, আমার খাস, অত জ্বালাস কেন আমারে, পাইছস কি! বাবার হুংকার শুনে আমি রুদ্ধশ্বাস বসে থাকি। মার্জিনে কাটাকুটি করার কলমটি কাঁপে, কলম ধরা আঙুলগুলোও। মা’র ও বাবাগো চিৎকার শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে মা’র ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বিভৎস এক কান্ড দেখি। দেখি বাঘের মত, বাঘ ঠিক কেমন করে লাফিয়ে মানুষের গায়ে কামড় দেয় তা নিজের চোখে কখনও না দেখেও আমার বিশ্বাস বাবা ঠিক বাঘের মতই মা’র গায়ে লাফিয়ে মা’র চুল টেনে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে লাথি কষাতে থাকেন বুকে পেটে। বাবার পায়ে বাটা কোম্পানির শক্ত জুতো, আগের চেয়ে আরও ঢিলে হয়ে আছে গলার টাইখানা। মা খাটের তলে সেঁধিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারেন না। আমার পেছনে দাদা এসে দাঁড়ান, ছোটদা, ইয়াসমিনও। আমরা, কয়েকটি ইঁদুর, নির্বাক দেখতে থাকি মা’র নাক মুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, শুনতে থাকি মা’র চিৎকার আমারে মাইরা ফেলল রে, আমারে বাঁচাও। আমাদের কারও সাহস হয় না দু’পা সামনে এগোতে। মা গোঙরাতে থাকেন, মেঝে ভেসে যায় মা’র পেচ্ছাবে। আরও কইবি এইসব, ক? তরে আইজ আমি মাইরাই ফালাইয়াম। বাবা বলতে থাকেন হাঁপাতে হাঁপাতে।

আর কইতাম না, পায়ে ধরি আমারে ছাইড়া দেইন। মা কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করেন পেচ্ছাবের ওপর আধন্যাংটো বসে।

কয়েকটি ইঁদুরকে দূর দূর তাড়িয়ে বাবা চলে যান নিজের ঘরে, গটগট করে জুতো ফেলতে ফেলতে মেঝেয়। মা সারারাত মেঝেয় শুয়ে কাঁদেন। আমার ইচ্ছে করে মা’র কাছে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে যে মা আর কাইন্দ না, দেইখ এর শোধ আমি একদিন তুলাম,. আমার সাহস হয় না। অর্ধেক রাত অবদি অঙ্কের খাতার ওপর ঝুঁকে থেকে রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে ঘুমহীন চোখে স্বপ্ন দেখতে থাকি এ বাড়ি থেকে জন্মের মত চলে যাচ্ছি অন্য কোথাও। দূরে কোথাও, কোনও এক অমল ধবল জীবনে।

এই ঘটনার পর হাশেম মামা রাস্তায় বাবাকে পিটিয়ে আধমরা বানিয়ে বাড়ি এনে বালুর বস্তার মত ছুঁড়ে দিয়ে বলেন–আমার বইনের গায়ে আরেকদিন হাত তুলছ কি তুমার লাশ কুত্তা দিয়া খাওয়াইয়াম।

ইস্পাতের মত শক্ত মানুষকেও সাতদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছে। বাবার ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছে মণি। বাবা সাতদিন আমাকে সকাল দুপুর কাছে ডেকে ডেকে বলেছেন লেখাপড়া কইরা বড় হও মা।

শেষের দিন, যে দিনটি পার হলেই তিনি গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবেন, সেদিন ছুটির দিন, আমাকে দুপুরবেলা কাছে ডেকে বললেন তোতাপাখির মত মুখস্ত কইরা ফালাও সবগুলা বই। ক্লাসে ফার্স্ট হইতে হইব। যারা তুমার ক্লাসে ফার্স্ট হয়, তারা যা খায় তুমিও ত তাই খাও, তাইলে হইবা না কেন? তুমার মাথায় কি ওগোর চেয়ে ঘিলু কিছু বেশি? কও বেশি কি না!

বাবার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে বলি– না।

যদিও আমার বরাবরই মনে হয়েছে ঘিলু খানিকটা কমই আমার মাথায় তবু বাবা যা শুনতে ইচ্ছে করেন তাই বলি। তা বলাই নিরাপদ কি না।

মা গো আমার মাথার চুলগুলায় হাত বুলাইয়া দেও তো মা। বাবা কোমল গলায় বলেন।

খাটের রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বাবার মাথায় আঙুল ডুবিয়ে দিই। যেন আঙুলগুলো আমার আঙুল নয়। যেন আমি দাঁড়িয়ে আছি এ আসলে আমি নই, অন্য কেউ। উদাস তাকিয়ে থাকি খোলা দরজার ওপাশে রোদ পড়ে কলপারের চৌবাচ্চার জল ঝিকমিক করছে, সেই জলের দিকে। ইচ্ছে করে হাত পা ছুঁড়ে জলে সাঁতার কাটি। আড়াইফুটি চৌবাচ্চার জলে সাঁতরে কতদূরই বা যাওয়া যায়। ঘুরে ফিরে চৌবাচ্চাতেই, কলপাড়েই, রোদ মাথায় করে দাঁড়িয়ে থাকা পেয়ারা গাছের তলেই, এ বাড়িতেই, যে বাড়িতে বেচারা আমাকে মুখে খিল এঁটে কারও না কারও ফরমাশ খাটতে হয়। আঙুলগুলো বাবার চুলে বেড়ালে মারা ইঁদুরের মত খুঁড়িয়ে হাঁটে।

বাবা ডাকেন মা, ও মা।

আমাকে সাড়া দিতে হয় জী বলে।

মুরব্বীরা ডাকলে জী বলতে হয়, মা তাই শিখিয়েছেন। জী না বলে হুঁ বা কী বলে উত্তর করলে মা বলেন, নেহাত বেয়াদবি করা। আদব কায়দা আমি কম জানি বলে মা’র অবশ্য বদ্ধ ধারণা। ঈদের সকালে মুরব্বিদের পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয় ছোটদের। সে আমার দ্বারা কিছুতে হয় না। মা ধাক্কা দিয়ে পাঠান যেন বাবার পা ছুঁই। আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি চৌকাঠে, তবু কারও, সে বাবা হোক মা হোক, পা ছুঁই না।

চুলগুলা জোরে টাইনা দেও। বাবা কাতর স্বরে বলেন।

বাবার মাথা ভরা ঘন কালো কোঁকড়া চুল। জোরে টানতে গিয়ে চুলের গোড়া থেকে আঙুলে উঠে আসে জমাট রক্ত। শুকিয়ে কালো বালির মত দেখতে। বাবা কি মরে যাবেন, আমার ভয় হতে থাকে। কি হবে মানুষটি চিৎ হয়ে মরে পড়ে থাকলে এই বিছানায়! আমি চুল টানতে টানতে দেখব বাবা আর শ্বাস ফেলছেন না, শিয়রের পাশে দাঁড়িয়েই থাকব দিন পার হলে রাত, বাবা আর বলবেন না অনেক হইছে মা, এইবার পড়তে বস গিয়া। লেখাপড়া কইরা মানুষের মত মানুষ হও।

চৌবাচ্চা থেকে রোদ সরে পেয়ারা গাছের মগডালে ওঠে। বাবা এরমধ্যে নাক ডাকতে থাকেন। নাক ডাকা লোকের মাথায় হাত বুলোলেই কি না বুলোলেই কি, পা টিপে টিপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই। দরজার বাইরে শরবতের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মা। কেউ যেন শুনতে না পায় বলেন যা তর বাবারে শরবতটা দিয়া আয়।

বাবা ঘুমাইয়া পড়ছে। আমিও স্বর নামিয়ে বলি।

গ্লাসটি হাতে ধরিয়ে মা বলেন তবু রাইখা আয়, ঘুম থেইকা উইঠা খাইবনে। লেবুর শরবত তর বাবার খুব পছন্দ।

ফরমাশ খাটা মেয়ে আমি, বাবার বিছানার পাশের টেবিলে ঠান্ডা লেবুর শরবত রেখে আসি। মা’র পরনে লাল একটি ছাপা শাড়ি। হাতখোঁপা করা চুল ঢাকা ছাপা শাড়ির আঁচলে। দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা বাবার দিকে মায়া-চোখে তাকিয়ে থেকে মা দিব্যি ঘরে গা গলিয়ে খাটের কিনারে দাঁড়িয়ে বাবার মাথার চুলে হাত বুলোতে থাকেন।

এই সুযোগে আমি লাপাত্তা। ছাদে দাঁড়িয়ে পেয়ারা চিবোতে চিবোতে প্রফুল্লদের বাড়ির উঠোনে পাড়ার মেয়েদের গোল্লাছুট খেলা দেখি। এ বাড়ির মাঠে সম্ভব নয় খেলাধুলো, অন্তত বাবা যদ্দিন বাড়িতে লাগাতার আছেন। বাবা বাড়ি থাকলে তাঁর নাগালের ভেতর থাকতে হয় বাড়ির সবাইকে। হাতের পেয়ারা তখনও শেষ কামড় পড়েনি, বাবার ডাক শুনি। দৌড়ে নিচে নেমে বাবার সামনে দাঁড়াই ফরমাশ পালন করতে। বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করেন শরবত কেডা দিছে?

মা। আমি চোখ নামিয়ে উত্তর দিই।

ক্যান দিছে? শরবত কি আমি চাইছি? বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আমার বেয়াদবির জন্য দু’গালে চড় কষাবেন এমন হাত নিশপিশ করা গা জ্বলা স্বরে বলেন।

আমি নিরুত্তর।

শরবত নিয়া উঠানে ফালাইয়া দে। বাবার নিরুত্তাপ কণ্ঠ।

নিঃশব্দে হুকুম পালন করি। পেয়ারা গাছের তলে গ্লাসখানা উপুড় করে ধরি।

কেউ যেন আমার ঘরে না আসে। বইলা দিস আমি কারও চেহারা দেখতে চাই না। কারও হাতের কিছু খাইতে চাই না। আমারে বিষ খাওয়াইয়া মারবার মতলব আমি বুঝি। কোনও শত্তুর যেন আমার বাড়িতে না থাকে।

আমি এবারও নিরুত্তর।

পরদিন ফজলিখালা বাড়ি এসে মা’র গায়ে হাত বুলিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন–দুনিয়াদারি ছাড় বড়বু। সিনেমা দেখা ছাড়। গুনাহর কাম আর কইর না। সংসারের মায়া ছাড়, স্বামী সন্তানের মায়া ছাড়, আল্লাহর পথে আস। এটাই শান্তির পথ।

মা সেই থেকে শান্তি খুঁজতে সিনেমায় নয় আর, আল্লাহর পথে পা বাড়ালেন। আল্লাহর পথ হচ্ছে নওমহলের পথ, ফজলিখালার শ্বশুর বাড়ির পথ। শ্বশুরের নাম আমিরুল্লাহ। অবাঙালি মুসলমান। ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশ ভাগের পর ভারতের মেদেনিপুর থেকে পূর্ববঙ্গে চলে এসে নওমহলের হাজিবাড়ি জঙ্গল সাফ করে একতলা একটি বাড়ি তুলে পাকাপাকি থাকতে শুরু করেছেন। প্রথম কিছুদিন কেরানিগিরি করেছেন পৌরসভার আপিসে। এরপর চাকরি ছেড়ে পাড়া পড়শিকে কোরান হাদিস পড়ে শোনান, পড়শিরা হাদিয়া তুলে দেন হাতে, ওরকমই ইঙ্গিত দেওয়া আছে যে আল্লাহ রসুলের কথা যিনি বলেন তাঁকে হাদিয়া দিলে আল্লাহ খুশি হন, বান্দার জন্য বেহেসত নসীব করেন। আমিরুল্লাহর সংসারে ফজলিখালার প্রবেশ অনেকটা উল্কা পতনের মত। ঘটক, আমিরুল্লাহর বিয়ের যোগ্য ছেলে মুসার জন্য কন্যা দেখতে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে শেষে এঁদো গলির ভেতর খলসে মাছে ভরা পুকুর পাড়ে নানির বাড়ি পৌঁছে। এবাড়িই, উঠোনের লোহার চেয়ারে বসে ঘটক সিদ্ধান্ত নেয়, শেষ বাড়ি।

ঘটকের কাছে কন্যার রূপের বর্ণনা শুনে আমিরুল্লাহ মুসাকে বগলে নিয়ে হাতে এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে পরদিনই হাজির নানির বাড়িতে। কী ব্যাপার, কাকে চাই? চাই ফজিলাতুননেসাকে। সে তো ইস্কুলে। বাড়ির লোকেরা টিনের ফুটোয় চোখ রেখে শাদা আলখাল্লা পরা ভিন ভাষায় কথা বলা অদ্ভুত মানুষদুটোকে দেখেন। ইস্কুল থেকে ফিরে ফজিলাতুননেসা দেখে ঘরের চেয়ারে বসা অচেনা দুই লোক তার পা থেকে মাথা অবদি গোগ্রাসে গিলছেন। কী কান্ড। কী কান্ড! ফজলিখালা দৌড়ে পগার পার। আমিরুল্লাহর চোখের তারা ফজলিখালাকে দেখে ঝলসে আছে তখনও। এমন সোনার বরণ মেয়ে তিনি আর দু’টি দেখেননি। নানার কাছে আমিরুল্লাহ হাত জোড় করে আবদার করেন–আপনি যদি রাজি হন, আজই, এখনই শাদি হয়ে যাক, পরে অনুষ্ঠানাদি করে না হয় মেয়ে তুলে নেব।

নানি শুনে আপত্তি করেন পর্দার আড়াল থেকে। ইশারা করেন নানাকে কাছে আসতে, ইশারা দেখেও চোখ ফিরিয়ে রাখেন নানা, জানেন পর্দার আড়ালে কি উত্তর অপেক্ষা করছে। নানি বেহিশেবি মানুষ নন, হুজুগে নাচেন না, উঠ ছেড়ি তর বিয়া লাগছে বলে মেয়েকে, ইস্কুল থেকে ফিরেছে সবে, জানে না কি হতে যাচ্ছে, ধরে বেঁধে কবুল বলাতে রাজি নন। নানির আপত্তির দিকে মোটে ফিরে না তাকিয়ে নানা জী হা জী হা বলে আমিরুল্লাহর কথায় মত দিয়ে বসলেন–তা যখন কইছেন, বিয়া অখনই করাইবেন, আপনের কথায় না করতে পারি কি! আপনে হইলেন আলেম মানুষ।

ফজলিখালাকে পাড়া খুঁজে বাড়ি এনে ঘাড় ধরে ভেতরের ঘরে একটি লাল শাড়িতে মুড়ে বসিয়ে দেওয়া হল। বড় মামা মন খারাপ করে বসেছিলেন সরতাআলু গাছের নিচে। নিজে তিনি ফজলিখালাকে পড়াতেন। আর বছর তিন পরেই মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হতে পারতেন ফজলিখালা। আর এমন সময় হুট করে মাইয়া মানসের এত নেকাপড়া লাগব না বলে নানা বাড়ির সবার মুখে খিল এঁটে বিয়ের ব্যবস্থা করছেন। খুশিতে বাগবাগ আমিরুল্লাহ সামনে রাখা চা বিস্কুট মুখে না তুলেই সূর করে সুরা গেয়ে ছ’শ টাকার কাবিনে দু’ঘরে দু’জনের মুখে কবুল শুনলেন। নানি অগত্যা বলেছিলেন– কাবিনের টেকাটা বাড়াইতে কন।

–আরে রাখো, আলেম মানষের লগে দর কষাকষি ঠিক না। নানা ধমকে থামিয়েছেন নানিকে।

ফজলিখালার বিয়েতে লোক নেমন্তন্ন করে পোলাও মাংস খাওয়ানো দিন কয়েক পরে ধুমধাম করেই হয়। পালকি চড়ে তিনি বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যান, কাঁদতে কাঁদতে। বড় মামা গলা ছেড়ে কাঁদছিলেন। বড়মামাকেও যেদিন হুট করে বেড়াতে নিয়ে যেয়ে হালিমা নামের শাদা ধবধবে ধুমসি এক গেঁয়ো মেয়েকে দিয়ে বিয়ে করিয়ে এনেছিলেন নানা, ফজলিখালার বিয়ের বছর তিন পরে, নানি কেঁদেছিলেন গলা ছেড়ে। বড় মামা ছিলেন বাড়ির সবচেয়ে লেখাপড়া জানা ছেলে। ছেলে আরও লেখাপড়া করে জজ ব্যারিস্টার হবে, নানির ইচ্ছে ছিল। বড়মামাকে বিয়ে করিয়ে আচমকা বাড়ি ওঠার পর উঠোনের সরতা আলু গাছটি নানা এক কোপে কেটে ফেলেছিলেন, শাদা বউকে আবার জ্বিনে ভূতে না ধরে। আমার অবশ্য দেখা হয়নি এসব, ঘটেছে আমার জন্মের অনেক আগে।

ফজলিখালা ছিলেন পাড়া বেড়াইন্যা মেয়ে। সারাদিন টই টই করে ঘুরতেন পাড়ায় পাড়ায়। সেই মেয়েকে মেদেনিপুরি আমিরুল্লাহ হাতে তসবিহ ধরিয়েছেন, মাথায় ঘোমটা পরিয়েছেন। বাড়ির চারদিক জুড়ে দেয়াল তুলেছেন যেন বাইরের লোকের বাড়ির বউএর দিকে চোখ না পড়ে, শ্বশুর শাশুড়ি আর স্বামীর সেবা করলেই যে আল্লাহকে খুশি করা যায় তা তিনি কিতাব খুলে পড়ে পড়ে ছেলেবউকে শুনিয়েছেন। ছেলেবউ মাথা নেড়ে জী আচ্ছা আব্বাজি বলে সবই মেনে নিয়েছেন।

ওলিআল্লাহর বাড়ি, আল্লাহতায়ালা স্বয়ং হাজিরা দেন বাড়িতে তাঁর পেয়ারা বান্দার সঙ্গে বাতচিত করতে। বাড়ির গাছে গাছে জিনও থাকে। বাড়িটিতে ঢোকার পর থেকে ফজলিখালাকে প্রায়ই জিনে ধরেছে, জিন একদিন দু’দিন থাকে, কখনও সাতদিন, আমিরুল্লাহ নিজে যখন জিন ছাড়ান ফজলিখালা ধপাশ করে পড়েন মেঝেয়, জিনেরা এভাবেই মানুষের শরীর ছেড়ে বের হয়।

জিনে ধরলে ফজলিখালা মাথার ঘোমটা ফেলে দেন, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যান একা একা বোরখা ছাড়া, রাস্তায় এর ওর সঙ্গে হেসে হেসে হাবিজাবি কথা বলেন, নওমহলের মোড়ে নিজের স্বামীকে দেখে ফজলিখালা নাকি একদিন বলেছিলেন কি মুসা ভাই কই যাইন? বাদাম খাইবাইন।

জিন ছাড়ানো এক বিষম ব্যাপার। ফজলিখালাকে রাস্তা থেকে সাড়াশির ধরে মত টেনে আনা হয় বাড়িতে। বাড়ির সবচেয়ে অন্ধকার ঘরে তাঁকে বন্দি করে আমিরুল্লাহ লাঠি হাতে ঢোকেন সে ঘরে। প্রথমে জিজ্ঞেস করেন–কি কারণ তোমার এইসব করার? ফজলিখালা বলেন–আমার কিছু ভালা লাগে না। আমার শহর সুদ্ধা ঘুইরা বেড়াইতে ইচ্ছা করে। আমার বাদাম খাইতে, পোড়াবাড়ির চমচম খাইতে ইচ্ছা করে। হি হি হি। আসলে ফজলিখালা তো আর কথা বলেন না, বলে শরাফত নামের জিন। তাঁর শরীরের মধ্যে শরাফত বসা, যা কিছু করছে ঘোমটা খুলে, বুকের কাপড় ফেলে সব শরাফতই। বিচ্ছিরি নাচ নাচছে, লাগামছাড়া কথা বলছে, সব শরাফত। ফজলিখালা তো আর এমন বেপর্দা বেশরম হতে পারেন না।

আমিরুল্লাহ নরম স্বরে বলেন–শোন, তোমার তো আমরা কোনও ক্ষতি করিনি। তুমি কেন আমাদের এত ঝামেলা করছ বাপু। ছেড়ে যাওনা ছেলেবউকে। ছেলে বউ আমাদের কত সতীসাধ্বী। এমন আর কটা বউ হয়। এই বউকে তুমি আর জ্বালিও না বাপু। ছেড়ে যাও।

ফজলিখালা লাফিয়ে ওঠেন বিছানায়, নাচতে শুরু করেন গান গেয়ে–আয় তবে সহচরি হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি গাহিবি গান।

আমিরুল্লাহ চোখ নামিয়ে নেন ছেলেবউএর উদ্বাহু নৃত্য দেখে।

–তোমাকে কি করে বিদেয় করতে সে কিন্তু আমি জানি বাপু।

আমিরুল্লাহ কঠিন স্বরে বলেন।

শুনে লাফ দিয়ে নামেন বিছানা থেকে ফজলিখালা। শাড়ি তুলে পায়ের গোড়ালির ওপর নিজেকে লাটিমের মত ঘোরান। খিলখিল হেসে বলেন–তুমি আমার কচু করবা।

আমিরুল্লাহ মুখের পেশি কঠিন হতে থাকে।

— তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।

— হ্যাঁ তাই যামু। আমার যেমন ইচ্ছা করে তাই করুম। বাধা দিবি তো তোদেরে মাইরা ফালামু কইলাম। বটি দিয়া কুবাইয়া মারুম। আমারে চিনস নাই! ফজলিখালা হাত পা ছুড়তে ছুঁড়তে বলেন।

আমিরুল্লাহ এবার হাতের লাঠিটি শক্ত করে ধরেন। ছেলেবউ হাত পা ছোঁড়ে যেমন, তিনি লাঠিও ছোঁড়েন ছেলেবউএর পিঠে, ঘাড়ে, মাথায়। এমন মার কখনও খাননি ফজলিখালা, নানা তাঁকে এক চড় কষিয়েছিলেন পিঠে সন্ধেয় পড়তে বসে বইএর ওপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিলেন বলে, পরদিনই তাঁকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে পেট ভরে পোড়াবাড়ির চমচম খাইয়েছিলেন।

ফজলিখালার মনে হয় হাড়গোড় তাঁর সব ভেঙে যাচ্ছে। তিনি কাতর স্বরে বলতে থাকেন–আর করুম না, ছাইড়া দেন আমারে।

–ছেড়ে যাবি তো! আমিরুল্লাহ হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন।

–হ। ছাইড়া যামু। সত্যি কইলাম ছাইড়া যামু।

ফজলিখালা উপুড় হয়ে পড়েন শ্বশুরের পায়ে।

–নাম কি তোর?

–শরাফত।

–থাকিস কোথায়?

–নিম গাছে।

ফজলিখালার ক্লান্ত শরীর হেলে পড়ল মেঝেয়। চোখ অনেকক্ষণ তিনি খুললেন না। হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে বসলেন, সামনে শ্বশুরকে দেখে তড়িঘড়ি ঘোমটা মাথায় দিয়ে বললেন–আব্বাজি আপনি এখানে? ঘর এত অন্ধকার কেন!

ফজলিখালা উঠে সোজা কলতলায়, বলতে বলতে–আব্বাজির অযুর পানি তো এখনও দেওয়া হয়নি, বেলা কম হল নাকি! উঠোনে দাঁড়িয়ে আমিরুল্লাহ বউ ছেলে মেয়ে সবাই দেখল জিন ছেড়ে যাওয়ার পর ফজলিখালা কি করে আগের সেই ফজলিখালা হয়ে উঠলেন। সকলে হাঁফ ছাড়লেন।

শরাফত নামের জিনটি প্রায়ই আছড় করে ফজলিখালার ওপর। কিন্তু জিন ফিনের ঝামেলা না হলে তিনি বেশ আল্লাহভক্ত, শ্বশুর স্বামীর বড় বাধ্য। হি হি হি হাসেন না, ঘোমটা খসে না মাথা থেকে। মাঝে মাঝে জিন তাড়ানোর কারণে পিঠে তাঁর কালশিরে দাগ পড়ে। ফর্সা সুডোল পিঠখানায় কালো দাগ, চাঁদের গায়ে কলঙ্ক।

ফজলিখালা মা’র গা থেকে হাত সরিয়ে চোখের জল ওড়নায় মুছতে মুছতে বলেন –এটাই শান্তির পথ বড়বু, আব্বাজির মজলিশে আসো, আল্লাহ রসুলের কথা শোনো। আখেরাতে কাজ দেবে। দুনিয়াদারি আর কদিনের বল। এক পলকের।

মা দুনিয়াদারির মোহ দূর করতেই চান। বাবা যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ালে মা’র যেন কিছু আসে না যায়, যেন আল্লাহর ধ্যানে মত্ত থেকে সব ভুলে যেতে পারেন। আব্বাজি, বুঝলে বড়বু, তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে বললেই তুমি কবরের আযাব থেকে মুক্তি পাবে, পুলসেরাত পার হয়ে যাবে তরতর করে। হাশরের ময়দানে পাল্লাখানা ভারি হওয়া চাই তো! সংসারের জালে এত জড়িয়ে গেলে কি সম্বল নিয়ে ওইপারে যাবে?

মা মাথা নাড়েন। ঠিক কথা। আখেরাতের সম্বল কিছুই নেই মা’র, মা’র তাই মনে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেও আজকাল গাফিলতি হয়। কোরান শরিফের ওপর ধুলো জমছে। তাক ধেকে নামানো হয় না অনেকদিন। এ কালে সুখ হল না, পরকালেও যদি না হয়! আচমকা মা’র মনে ভয় ঢোকে।

ফজলিখালা মা’কে নছিহত করে পাঙ্গাস মাছের পেটি দিয়ে ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে কালো বোরখায় গা ঢেকে হাজিবাড়ি জঙ্গল সাফ করে বানানো শ্বশুরবাড়ি চলে যান। নওমহলে।

পরদিন থেকে বাড়িতে নাস্তার পাট চুকলেই মা বোরখা চাপান গায়ে।

কোথায়? নওমহল।

সপ্তাহ যায়। মাস যায়। মা কোথায় যাও? নওমহল।

ব্যস কারু মুখে রা নেই। আমরা চার ভাই বোন খাবার টেবিলে বা সোফায় বা বারান্দায় বসে থেকে দেখি মা আমাদের পেছন ফেলে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। নওমহলের নেশা চাপলে বাড়ির কারু সাধ্য নেই যে পথ আগলায় মা’র। এ নেশা আল্লাহর নেশা, আফিমের চেয়েও কড়া।

মাস গেলে পর মা’র মনে কী উদয় হয় কে জানে, বোরখার তলে আলুথালু শাড়ি, উড়োখুড়ো চুল, হঠাৎ মাঠে খেলতে নামা আমার বাহু ধরে হেঁচকা টেনে বলেন চল। বাড়ির বাইরে যে কোনও জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হলেই আমার ফূর্তি লাগে। ফুরফুরে হাওয়ায় রিক্সায় চড়ে বেড়ানোর আনন্দ কী বাড়িতে বসে পাব আর! ইস্কুল-ইউনিফর্মের পাজামা, যেহেতু এর বাইরে আর কোনও পাজামা নেই আমার, তখনও হাফপ্যান্ট পরার বয়স যেহেতু, পাজামার ওপর লম্বা একটি জামা পরিয়ে, ইস্কুলের ভাঁজ করা শাদা ওড়না যেটিকে বেল্টের ভেতর ঢুকিয়ে পরতে হয় ভাঁজ খুলে সেটিতে মাথা আর বুক ঢেকে, যদিও তখনও ওড়নায় বুক ঢাকার বয়স হয়নি আমার, বুকে কিছু গজায়নি যেহেতু, আমাকে রিক্সায় ওঠান মা। নিজেকে কিম্ভুত লাগে দেখতে। তবু বাড়ির বাইরে বেরোনোর সুযোগ মা’কে অমান্য করে হাতছাড়া করি না। রিক্সায় বসে সিনেমার পোস্টার দেখতে দেখতে, দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে আর বিচিত্র সব মানুষ দেখতে দেখতে নওমহলে পৌঁছই। এত শীর্ঘ গন্তব্যে পৌঁছতে মোটেও ইচ্ছে করে না। রিক্সা যদি দিন রাত ভরে এমন নিয়ে চলত আমাকে আরও দূরে কোথাও!

পীর আমিরুল্লাহর হাজিবাড়ির জঙ্গল সাফ করা বাড়ি আমি জানি না কবে হয়ে উঠেছে ছোটখাট এক শহর মত। বিস্তর এলাকা জুড়ে ছোট ছোট ঘর। সবচেয়ে উঁচু, দালানের, চুনকাম করা ঘরটি আমিরুল্লাহর। মা আমিরুল্লাহর মুরিদ হওয়ার পর থেকে তাঁকে তালইসাব ডাকা বাদ দিয়ে হুজুর ডাকেন, পীরসাব যে কোনও ব্যক্তি সম্পর্কের উর্ধে। এ বাড়িতে মা’র প্রথম কাজ আমিরুল্লাহকে কদমবুসি করা তিনি ঘুমিয়ে থাকুন কি খাবার খেতে থাকুন কি অযু করতে থাকুন। তাঁকে কদম বুসি করে কেবল মা’র নয় সকলেরই কাজ শুরু করতে হয়। উনুনে আগুন ধরানো, কি ফজরের নামাজে দাঁড়ানো, কি পেশাব পায়খানায় যাওয়া। যেহেতু আল্লাহতায়ালার পেয়ারা বান্দা আমিরুল্লাহ, শুধু কি পেয়ারা বান্দা, রীতিমত আল্লাহর ওলি, আল্লাহতায়ালা প্রায়ই দেখা দেন তাঁর ওলিদের, আমিরুল্লাহর সঙ্গেও প্রায়ই আল্লাহতায়ালার সাক্ষাৎ ঘটে। অবশ্য কখন ঠিক ঘটে কেউ জানে না। মা অনুমান করেন গভীর রাতে। মা’র ধারণা কথাবার্তা ওঁরা আরবিতেই বলেন। মা’র আরও ধারণা আল্লাহর নিজের মাতৃভাষা আরবি। ভাষাটি শিখলে, মা ভাবেন, তিনি নিজেও সম্ভবত আল্লাহর সঙ্গে পরকালে দু’একটি বাক্য বিনিময় করতে পারবেন। ভাষাটি শেখার ইচ্ছে খুব মা’র। মা জিভ বেরিয়ে আসা সারমেয়র মত তাকিয়ে থাকেন আরবি জানা লোকের দিকে। মা’র জিভ থেকে লালার মত বেরিয়ে আসতে থাকে বেহেসতের লোভ। মা’র দু’চোখের পাতা আবেশে নুয়ে আসে ভেবে যে গভীর রাতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালার সঙ্গে কথা বলেন হুজুর। আমিরুল্লাহ তুষ্ট হলে মা’র মত পাপীর প্রতি আল্লাহতায়ালা সদয় হবেন হয়ত, গুনাহ তিনি কম করেননি, পাগলের মত যাত্রা সিনেমায় দৌড়েছেন। আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন কি এই গুনাহগারকে! হুজুরকে কদমবুসি সেরে মা পীরের ঘরের মেঝেয় বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। সাফ করা নালার মত দু’চোখ মা’র, পথে না আটকে গড়িয়ে কেবল নামে। গাল বেয়ে, বুক বেয়ে, শাড়িতে, ব্লাউজে নামে। গোলাপি দুটো ফোলা ঠোঁট শুকিয়ে চড়চড় করে ফজলিখালার, তিনি মা’র কাঁধে হাত রেখে ঠান্ডা গলায় বলেন–আল্লাহ কেন ক্ষমা করবেন না, তুমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। আল্লাহ ক্ষমাশীল! আল্লাহ মহান। তিনি তোমাকে ক্ষমা করবেনই। আল্লাহর কাছে হাত ওঠালে আল্লাহ কখনও ফেরান না।

আমিরুল্লাহকে তুষ্ট করতে কেবল মা নন, আরও যুবতী পায়ের ওপর খাড়া।

বিকেলের চা নাস্তা সেরে আমিরুল্লাহ বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই মা এবং আর সব যুবতী নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি বাঁধান কে হুজুরের বাহু নেবেন, কে পা নেবেন, কে মাথা। পায়ের প্রতি লোভ বেশি মা’র। ভাগে পা পড়লে মা’র মুখ তারাবাতির মত ঝলসে ওঠে, ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকে হাসি। পা মানে নোংরা, তোমার নোংরা জায়গায় যখন হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তার মানে তোমার নোংরাও আমার কাছে পবিত্র। টেপাটেপির কাজ চলে দু’ঘন্টা। এরপর হুজুরের জন্য এক এক করে বাড়িয়ে দিতে থাকেন যুবতীরা কমলার রস, লেবুর শরবত, দুধের ক্ষীর। হুজুরের জন্য খাবার আসে ঝকঝকে রূপোর রেকাবি করে, রুই মাছের দোপিঁয়াজা, কচি মুরগির ঝোল, বাসমতি চালের ভাত, খেয়ে ঢেকুর তুললে তবক দেওয়া পান, হুজুরের আবার পানের বড় নেশা। মেঝেয় শীতল পাটিতে বসে পান সেজে দেন ছেলে-বউ। একটি করে পান মুখে নেন হুজুর, ছ’ সাত চিবোন দিয়ে ফক করে ফেলেন চিলমচিতে, পানের পিচকি ছিটকে পড়ে যুবতীদের গায়ে। গায়ে পড়া পিচকি জিভে চাটেন কেউ কেউ, বেশির ভাগই হুমড়ি খেয়ে পড়েন চিলমচির ওপর। কে আগে হুজুরের চিবোনো পান বা পানের রস পাবেন তাই নিয়ে কুরুক্ষেত্র বেধে যায়। কাড়াকাড়ি দেখলে আমার কেমন ভয় ধরে যায়, মা’কে দেখেছি সিনেমার টিকিট কাটতে গিয়ে এরকম কাড়াকাড়ি চুলোচুলি বাঁধাতে। অলকা হলে মেয়েদের টিকিট কাটার কোঠায় মেয়েরা যখন চুলোচুলি শেষে হাতে টিকিট নিয়ে বেরিয়ে আসে, সারা শরীর ঘামে ভেজা, ব্লাউজের বোতাম ছেঁড়া, খোঁপা খুলে চুল হয়ে আছে কেইচ্যা খাউড়ি পাগলির চুলের মত কিন্তু মুখে তারাবাতির খুশি, হাতে শক্ত করে ধরা টিকিট। মা’দের এই পানের পিচকির জন্য কাড়াকাড়ি মনে হয় যেন বেহেসতের অমৃত নিয়ে কাড়াকাড়ি। মা’র তাই মনে হয়, এ যে সে মানুষের চিবোনো পান বা পিচকি নয়, এ সেই মানুষের মুখের পান, যে মানুষের সঙ্গে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা গভীর রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে চুপি চুপি কথা বলেন, যে মানুষ চোখ বুজে গড়গড় করে বলে দিতে পারেন আল্লাহতায়ালার অসীম ক্ষমতার কথা, মহানুভবতার কথা, আল্লাহতায়ালা কখন কোথায় কি বলেছেন, কী ইঙ্গিত করেছেন কাকে– সব। এমন মানুষের মুখের পান খেলে বেহেসত নিশ্চিত না হয়ে যায় না। অবশ্য আমিরুল্লাহ পীরও তাই বলেছেন ইঙ্গিতে। চোখ ছোট করে বাচ্চাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গেলে লোকে যেমন রহস্যের হাসি হেসে বলে, তেমন করে, যে– টিকিট চাও বেহেসতের? তবে চোখ কান খোলা রাখো বান্দারা, কি করলে আল্লাহ খুশি হবেন, তা বুঝে নাও। তোমাদের আল্লাহ বুদ্ধি দিয়েছেন।

মা চিলমচি থেকে তুলে আমিরুল্লাহর মুখের পান মুখে পোরেন। আমি বসা থাকি কাড়াকাড়ির ঠিক পেছনে, একা, ভীত, শরমে মাঝে মাঝে লাল হয় মুখ আমার। বেহেসতে মা’র পেছন পেছন মা’র আঁচল ধরে পৌঁছে যাওয়া যাবে এরকম একটি বিশ্বাস কাজ করে আমার ভেতর। ফজলিখালা বসা ছিলেন কাড়াকাড়ির ডানে। তিনি শুকনো চোখে তাকাচ্ছিলেন কাড়াকাড়ির দিকে, ভাগ চাচ্ছিলেন না চিবোনো রসের। চাইবেন কেন, তাঁর, মা’র ধারণা, টিকিট কেনাই আছে, শুয়ে বসে ইহকালের সময়টুকু পার করলেই চলে। তিনি তো আর যাত্রা সিনেমায় গিয়ে পাপ কামাই করেননি। ফজলিখালা কুরুক্ষেত্রে খানিকটা উবু হয়ে মা’র কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেন–মুখের পান কেন, আল্লাহর ওলির কফ থুতুও মাথায় নিলে সওয়াব হবে।

কথাটি মনে গাঁথে মা’র।

কফ থুতুর ব্যাপারে যাওয়ার আগে মা একশ গোটার একটি তসবিহ হাতে দিয়ে আমাকে বসিয়ে দেন দক্ষিণের ঘরের মেঝেয়। কাগজে ছাল্লাল্লাহু আলা মহাম্মাদ লিখে দিয়ে যান যেটি গুণে গুণে পড়তে হবে পাঁচশ বার, পড়লে মা বলেন সওয়াব হয়। পীর বাড়িতে মা সওয়াব কামাতে আসেন, আমারও যেন আল্লাহর পথে এসে সওয়াব কামানো হয়, মা তাই গোল্লাছুটের মাঠ থেকে তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন এখানে। গোল্লাছুট থেকে ছুটে হাওয়ার রিক্সায় ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ হয়ত বেশি, কিন্তু একটি অদ্ভুত বাড়িতে যে বাড়িতে কারও খেলতে মানা, কারও উচ্চস্বরে কথা বলা মানা, যে বাড়িতে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবদি ঢাকা কাপড় একচুল সরা মানা, সে বাড়িতে তসবিহ হাতে নিয়ে বসে থাকার চেয়ে মুতের গন্ধঅলা পেশাবখানায় খামোকা বসে থাকাও ভাল।

সন্ধের মুখে হুজুর মজলিশ বসান। মা আমাকে দক্ষিণের ঘর থেকে সাঁড়াশির মত ধরে নিয়ে যান মজলিশ ঘরে। ওড়না মাথা থেকে খসে পড়লে কনুইয়ের গুঁতো মেরে মা আমাকে সতর্ক করেন। রিক্সায় তিনি আমাকে বলে বলে নিয়ে এসেছেন যেন হুজুরকে দেখামাত্র কদমবুসি করি, যেন মাথা থেকে আমার কাপড় না সরে। হুজুরকে কদমবুসিও আমি করিনি, মাথা থেকে কাপড়ও সরেছে। মজলিশ ঘরে মেয়েদের কাতারে মা আমাকে বসিয়ে নিজে বসেন আসন গেড়ে। পর্দার আড়ালে মেয়েদের বসার নিয়ম, পর্দার বাইরে ছেলের দল। ফাঁক দিয়ে দেখি বড় বড় কিতাব সামনে নিয়ে গদিতে বসে দু’তিনটে খোলা কিতাবের ওপর ঝুঁকে পড়ে আরবি বাক্য আওড়াচ্ছেন হুজুর, শুনে শ্রোতারা আহা আহা করে ওঠেন। চশমার কাচ মুছতে মুছতে হুজুর বলেন যারা ঈমান না আনবে, ঈমান যাদের নেই, তাদের আল্লাহতায়ালা দোযখের আগুনে কি করে পুড়বেন, তা কি জানেন আপনারা? দোযখের ভয়ংকর আগুনে আপনারা পুড়বেন! সূর্য মাথার এক হাত ওপর নেমে এলে যেমন তাপ, সেরকম তাপের আগুন। আর সহস্র সাপ বিচ্ছু কামড়াবে আপনাদের! আপনাদের খেতে দেওয়া হবে ফুটোনো পানি আর পুঁজ। আল্লাহতায়ালা আপনাদের জিহবাকে টেনে আনবেন আপনাদের মাথার ওপর, কিলক দিয়ে আটকে দেবেন সেই জিহবা। আল্লাহ আপনাদের ছুঁড়ে ফেলবেন আগুনে। সেই আগুনে জ্বলবে আপনাদের শরীর, পুড়বে, কিন্তু আপনারা মরবেন না, আল্লাহ আপনাদের মারবেন না, বাঁচিয়ে রাখবেন শাস্তি পোহাতে। সাপ পেচিয়ে থাকবে আপনাদের শরীর, বিচ্ছু কামড়াবে। দুনিয়াদারির আরাম বেশিদিন নয় বান্দারা। শেষ জমানা শুরু হয়ে গেছে। দজ্জাল আসবে যে কোনও সময়। প্রস্তুত থাকুন। কেয়ামত এই আসছে আসছে। শিঙ্গা ইসরাফিলের মুখে। আল্লাহর আদেশ পেতে আর দেরি নেই।

পর্দার আড়ালে কান্নার রোল ওঠে। ছেলেরা রুমালে চোখ মোছেন, কেউ কেউ হু হু করে কাঁধ ঝাকিয়ে কাঁদেন। কে জানে কার ঈমান আছে, কার নেই।

দুনিয়াদারি দিয়ে কিস্যু হবে না ভাইসব। আখেরাতের সম্বল করুন। আল্লাহর পথে আসুন। মহান পরওয়ারদিগারের ক্ষমা পেলে আপনারা কবরের আযাব থেকে বাঁচবেন, দোযখের যন্ত্রণা থেকে বাঁচবেন। দোযখের আগুন তো আর দুনিয়ার আগুন নয়, এ আগুনের চেয়ে সত্তরগুণ বেশি তার ধার।

আমি তসবিহ হাতে চুপচাপ বসে থাকি মা’র পেছনে। মা’র কান্না দেখে আমার মায়া হয়। মা’র শরীর ফুলে ফুলে ওঠে কান্নার দমকে। এত মানুষ আগুনের ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে, আমার অবাক লাগে। এ ঠিক বাচ্চাদের ভয় দেখানোর মত, পেটানো হবে হুমকি দিলে অনেক বাচ্চাই তো ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। আমাকেও সম্ভবত আর সবার মত কাঁদা উচিত ভেবে আমি অপেক্ষা করতে থাকি চোখের জলের, চোখে আমার কিছুতেই জল আসে না। বরং দোযখে মানুষকে আল্লাহ যেভাবে আগুনে পোড়াবেন তার বর্ণনা শুনে আল্লাহকে বড় নিষ্ঠুর মনে হতে থাকে।

কবরের আযাব আর দোযখের দীর্ঘ বিভৎস বর্ণনার পর মোনাজাতের হাত তোলেন পীরসাব হে আল্লাহ, তুমি তোমার বান্দাদের ক্ষমা করে দাও। তাদের সব পাপ তুমি ক্ষমা কর। তুমি তো ক্ষমাশীল, তুমি মহান, তুমি পরওয়ারদিগার। তোমার পাপী বান্দাদের ক্ষমা কর, তোমার দরবারে আমি ওদের হয়ে ভিক্ষে চাইছি আল্লাহ।

হুজুরের গলার স্বর চড়ায় উঠতে থাকে, আর বান্দাদের কান্নার শব্দও তাল মিলিয়ে ওপরে ওঠে। আমি জবুথবু বসে থাকি, চোখের তারা আমার এদিক ওদিক ঘোরে। পর্দার ভেতরে বাইরে। এ এক আজব জগত বটে।

বাবা খবর পেয়েছেন মা আজকাল নিয়মিত পীরবাড়ি যান। আমিরুল্লাহ পীরের মুরিদও হয়েছেন তিনি। বাড়িতে তিনি ঘোষণা করে দিলেন এ বাড়ির কারও আর পীরবাড়ি যাওয়া চলবে না, বাবার আদেশ কেউ যদি অমান্য করে এ বাড়িতে থাকা তার চলবে না। ঘোষণা শুনে মা তাচ্ছিলউ-গলায় বললেন–আমার বাঁয় ঠ্যাঙ্গেরও ঠ্যাকা নাই এই কাফেরের বাড়িতে থাকনের। আল্লাহ খোদার নাম নাই। এই বাড়িত থাকলে আমার লাইগা বেহেসত হারাম হইয়া যাইব।

মা পীরের মুরিদ হওয়ার পর বাড়িতে আর রাঁধেন বাড়েন না। সকালে বাজারের থলে এলে মণি মা’কে জিজ্ঞেস করতে আসে কি দিয়ে কি হবে, লাউ দিয়ে মাছ নাকি কুমড়ো দিয়ে মাংস, শাক হবে কি না, ডাল পাতলা হবে নাকি ঘন। মা বলে দেন–তগোর যা খুশি রান।

মণি দিশা পায় না। মা এরকম আগে কখনও করেননি। মণি আনাজপাতি কুটে দিত, মা নিজে হাতে রান্না করতেন। এখন পুরো রান্নাবান্নার ভার মণির একা সামলাতে হবে। ভাঁড়ার ঘরের চাবিটিও মা মণির হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। মশলাপাতি, আনাজপাতি, যা খুশি মণিই বার করবে, মণিই রাঁধবে। মণিই বুঝবে কি দিয়ে কি। হঠাৎ এত স্বাধীনতা পেয়ে মণির নিজেকে বিবিসাব বিবিসাব বলে মনে হয়।

নওমহলে পানের পিচকি – কফ থুতু – মজলিশ মোনাজাতের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে মা জায়নামাজেই বসে থাকেন বেশির ভাগ সময়। নামাজ শেষে তসবিহ গোণেন। তসবিহ গোণা শেষে কোরান পড়েন সুর করে, কোরান শেষে আবার নামাজ। ফজর জোহর আসর মাগরেব এশা তো আছেই, নফল নামাজও পড়েন। সংসারে মন নেই মা’র। ছেলেমেয়ে খেলো কি না খেলো তা নিয়ে ভাবার সময়ও নেই। ধীরে, যদিও এত ধীরে কথা মা কখনও বলেন না, গম্ভীর কণ্ঠে, যদিও কণ্ঠে গাম্ভীর্য কখনও ছিল না তাঁর, বলেন–বাবারা, দুনিয়াদারির লেখাপড়ায় কোনও কাম হইব না। আখেরাতের সম্বল কর। নামাজ রোজা কর। তোমার বাপের মত কাফের হইও না। আল্লাহর নাম লও। আল্লাহই দয়াশীল, আল্লাহই তুমাদেরে ক্ষমা করবেন। কায়দা সিফারা পড়। কোরান শরিফ পড়। আমি তুমাদেরে কইতাছি, আল্লাহ আমারে দিয়া তুমাদেরে নছিহত করতাছেন। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। তিনি সব দেখেন, সব শুনেন। আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না।

মা’র মুখ গরমে ঝরে পড়া শুকনো পাতার মত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আবার বলেন–তুমার বাপে নামাজ পড়ে না। নামাজ যে না পড়ে সে কাফের। এই কাফেরের সংসারে আমি আছি তুমাদের লাইগা। কাফেররে রাইন্ধা বাইড়া খাওয়াইলে আমার গুনাহ হইব। তুমরা যদি আল্লাহর পথে না আসো, তাইলে আমি যেইদিকে দুইচোখ যায়, চইলা যাইয়াম। যাও মা, অযু কইরা আসো, নামাজ পড়বা।

মা আমাকে ইঙ্গিত করেন। আমার গা হিম হয়ে যায়। অযু করে মা’র সঙ্গে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে হাত দুটো খানিক বুকে রাখা, খানিক হাঁটুতে রাখা, খানিক নুয়ে থাকা, খানিক কপাল ঠেকানো মাটিতে—- এর মত অস্বস্তির কাজ আর নেই। কিন্তু মা’র আদেশ, পালন করতেই হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর মাকে দেখতে দমোদর নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন।

বাবা বাড়ি ফিরে আমাকে জায়নামাজে বসে থাকতে দেখে হাঁক দেন–নাসরিন, এদিকে আয়।

জায়নামাজ থেকে এক লাফে বাবার ডাকে উঠে যাই। এ এক ধরনের মুক্তি বটে। বাবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আমি অনুমান করি অন্তত নামাজ জাতীয় জরুরি ব্যাপার নিয়ে আমি যেহেতু মগ্ন ছিলাম, খেলাধুলো বা আড্ডা জাতীয় অজরুরি ব্যাপারে নয়, সুতরাং এ যাত্রা রেহাই আমি ঠিকই পাব। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি আচমকা ঘাড় ধরে উল্টোদিকে ধাক্কা দেন, ধাক্কাটি আমাকে পড়ার টেবিলের সামনে এনে থামায়। দাঁত কটমট করে বাবা বলেন–লেখাপড়া ছাইড়া এইগুলা আবার কি শুরু করছস! মায়ের অষ্টকাডি হইছস। আল্লাহরে ডাকলে আল্লাহ ভাত দিব? নাকি নিজের ভাতের ব্যবস্থা নিজে করতে হইব। যা পড়তে ব। পড়ার টেবিল ছাইড়া উঠছস কি পিটাইয়া হাড় গুঁড়া কইরা ফালাব।

মা ফোঁসেন জায়নামাজে বসে। মেয়ে নামাজ পড়ছে, আর একে ডেকে নিয়ে দুনিয়াদারির পড়ায় বসানো! মেয়েকেও নিজের মত কাফের বানানোর ইচ্ছে কি না! হুজুর মা’কে বলেছেন মাথা ঠান্ডা রাখবে হামিমা। পীর বাড়িতে মা’র নতুন নাম দেওয়া হয়েছে, ঈদুল ওয়ারা বেগম পাল্টে হামিমা রহমান। যারাই যায়, বয়স যার যতই হোক, সবারই নাম বদল করেন পীরসাব। রেনুর নাম এখন নাজিয়া, হাসনার নাম মুতাশ্বেমা, রুবির নাম মাদেহা। হামিমা এখন পীরসাবের কথামত মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেন। মা আর কতটুকুনই বা ঠান্ডা করতে পারেন মাথা! ঠান্ডারও তো একটা সীমা আছে। ছেলে মেয়েদের তো আর বাবা বিয়োননি, সে কাজটি মা করেছেন। ছেলে মেয়েদের ওপর তাঁর অধিকার যদি তিল পরিমাণ না থাকে তবে আর এ বাড়িতে থাকার তাঁর মানে কী!

বাবা কাপড় পাল্টে পেটের ওপর লুঙ্গির শক্ত গিঁট দিয়ে আমার পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলেন–আমার কথামত না চললে বাড়ি থেইকা বার হইয়া যা। থাকস ক্যান? আমার খাস, আমার পরস, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন কইরা এই বাড়িত থাকতে হইব। আর তা না হইলে যা, বাড়ি বাড়ি গিয়া ভিক্ষা কইরা খা। যাস না ক্যান। না করি নাই ত। কাফেরের বাড়িতে থাকবি না। চইলা যাইবি। যা ।

এসব কথা মা’কে উদ্দেশ্য করে বলছেন বাবা, সে স্পষ্ট বুঝি। নামাজ পড়া সে আমার ইচ্ছেয় ঘটেনি, নামাজ ছেড়ে উঠে আসা সেও আমার ইচ্ছেয় নয়। সুতরাং বাবা মা’র এ লড়াইয়ে আমার ভূমিকা নেহাতই তুচ্ছ অনুমান করে স্বস্তি বোধ করি। বাবা ঘর ছাড়লে মা এসে ঢোকেন ঘরে, বলেন–তা চইলা ত যাইয়ামই। বাইন্ধা রাখতে পারবি আমারে তরা? ভাবছস আমার জায়গা নাই যাওয়ার। কাফেরের সাথে থাকনের চেয়ে বনে জঙ্গলে পশুর সাথে থাকা অনেক ভালা। যেদিন যাইয়াম সেইদিন বুঝবি। কাউরে ত জানাইয়া যাইতাম না। চুপ কইরা চইলা যাইয়াম। ছেলেমেয়েগুলারেও বানাইতাছে নিজের মত শয়তান। এগোর সাথে থাকলে জীবনে যা সওয়াব কামাইছি, সব যাইব আমার।

মা’র কথাগুলোও বাবাকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু বলাবলি সব এ ঘরে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁরা যেহেতু পরষ্পরের ছায়া মাড়ান না, গর্জন বর্ষণ সব আমার ঘরে এবং আমার ঘাড়ে।

মা তাঁর বাণী শেষ করে হঠাৎ আমার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসানো চড় লাগিয়ে বলেন নামাজ থইয়া উইঠা আইছস ক্যা? আল্লাহরে ডরাস না? অত সাহস তর কোত্থেকা অইছে? শয়তান সবসময় আল্লাহর ইবাদত থেইকা মানুষেরে সরাইয়া লয়। তুইও শয়তানের ডাকে সাড়া দিয়া নামাজ অর্ধেক ফালাইয়া উইঠ্যা পড়লি। দোযখের আগুনে পুড়বি দাউ দাউ কইরা, তখন কুনো বাপ তরে বাচাইতে পারব?

চড় খেয়ে মাথা ঝিমঝিম করে আমার।

রাত পার হয়ে দিন হলে মা নতুন উদ্যমে শুরু করেন তাঁর নছিহত আমার ওপর, যেহেতু আমি জন্ম নিয়েছি এক পবিত্র দিনে। ইস্কুল থেকে ফিরলে মা ওত পেতে থাকেন, কখন খপ করে ধরে আমাকে কোরান পড়াতে বসাবেন। বিকেলে মাঠে এক ঝাঁক মেয়ে আসে গোল্লাছুট খেলতে, তাদের নিয়ে মাঠে যেই না আয়োজন করছি খেলার, মা ডাকেন। খেলা ফেলে আমাকে অযু করে কোরান শরিফ নিয়ে বসতে হয়। মাথায় ওড়না। পায়ে পাজামা। দল বসে থাকে আমার অপেক্ষায়, মাঠে। আর আমাকে তখন পড়তে হয় আলহামদুলিল্লাহ হি রাব্বিল আল আমিন আর রাহমানির রাহিম…কুলহুআল্লাহু আহাদ আল্লাহুসসামাদ ..

মা’কে বলি, গলায় অসন্তোষ–কি পড়ি, এইগুলার মানে কিছু তো জানি না।

মা ঠান্ডা গলায় বলেন–মানে জানতে হইব না। আল্লাহর কিতাব পড়লেই সওয়াব হইব।

কোরান পড়া থেকে মা এই মুক্তি দেবেন, এই আমি দৌড়ে মাঠে খেলতে যাব এরকম ভাবতে ভাবতে মা’র সঙ্গে সুর করে কলব থেকে মা যেভাবে বলেন সেভাবে কোরানের সুরাগুলো পড়ে ফেলতে ফেলতে আর ফাঁকে ফাঁকে জানালার বাইরে তাকাতে তাকাতেই দেখি হঠাৎ ঝুপ করে সন্ধে নেমে পড়েছে। মাঠে অপেক্ষা করা গোল্লাছুটের মেয়েরা যে যার বাড়ি ফিরে গেছে। গলার ভেতর জমে থাকে কষ্টের কফ। পড়া শেষে মা যেমন যেমন বলেন, কোরানের গায়ে চুমু দিয়ে রেহেল থেকে সরিয়ে তুলে রাখি আলমারির সবচেয়ে ওপরের তাকে। সকালে সুলতান ওস্তাদজি আসেন আরবি পড়াতে। তা নাকি যথেষ্ট নয়, বিকেলেও কোরান পড়া চাই। এমনিতে আরবির মাস্টার নিয়ে আমি যথেষ্ট অশান্তিতে ছিলাম। লোকটি জালালি কবুতরের গুয়ে শাদা হয়ে থাকা বারান্দায় বসে আমাকে সিফারা পড়ান। গুয়ের গন্ধে নাক কুঁচকে থাকলে কী আল্লাহর কালাম পড়তে গেলে মুখটা এত ব্যাঙের মত কইরা রাখস ক্যা? বলে মাথায় মোটা আঙুলের গিঁটে ঠং করে টোকা মারেন। আলিফ লাম যবর আল, লাম খাড়া জরর লা, ইয়াও পেশ হু–পড়তে গিয়ে লাম ইয়াও পেশ লাহু বলাতে দাড়িঅলা এক সকালে বারান্দার সিঁড়ির কাছ থেকে চমৎকার লাল নীল হলুদ রঙের পাতাবাহার গাছের শক্ত ডাল ভেঙে এনে আমাকে দাঁত খিঁচে বললেন– হাত পাত। শিক্ষকের কথা মান্য করতে হয় বলে হাত পেতেছিলাম। সপাং সপাং মেরে হাত আমার লাল করে ছেড়েছিলেন সুলতান ওস্তাদজি। এখন বিকেলেও মা’র হাতের মার খেতে হবে, কোরান পড়তে গিয়ে ঝিমোলাম কি ভুল করলাম পড়ায়, মা কান মলে দেবেন, পিঠে দুমাদুম কিল দেবেন, গালে কষে থাপ্পড় লাগাবেন। আমার নাকি মন নেই পড়ায়, মা’র ধারণা। আমার মন দুনিয়াদারির লেখাপড়ায়, খেলাধুলায়, নাচগানে। আমার কপালে দোযখ লেখা, মা স্পষ্ট বলে দেন।

আমার খেলা মাটি করে সারা বিকেল কোরান পড়িয়ে মা বেশ ধীরে, গম্ভীর গলায় দাদাকে সামনে পেয়ে বলেন–নোমান, তুই নামাজ শুরু করছ নাই?

দাদা হেসে জবাব দেন–হ মা। শুরু করাম।

— তরা যদি নামাজ রোজা না করস, তগোরে শেষ বারের মত জানাইয়া দিতাছি আমারে তরা পাইবি না। আমি যেদিকে খুশি চইলা যাইয়াম।

হুমকি শুনে দাদা বারান্দার চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে একগাল হেসে বলেন — বিশ্বাস করেন মা। কসম কাইটা কইতাছি নামাজ শুরু করাম। আপনে যাইয়েন না।

আমি বারান্দায় এসে বড় শ্বাস নিই। খেলার মাঠখানা খাঁ খাঁ করে। মাঠ থেকে দমকা হাওয়া উড়ে এসে সোজা বুকের ভেতরে ঢুকে হু হু, হু হু করে।

সপ্তাহ গেলে মা আবার পাড়েন কথা–তুই যে নামাজ শুরু করবি কইলি। কই!

— এই তো মা, শুক্রবার থেইকাই শুরু করাম। দাদা গম্ভীর স্বরে বলেন।

শুক্রবার এলে দাদাকে বলেন মা–যা মসজিদে যা, জুম্মা পইড়া আয়।

দাদা ঘাড় চুলকে বলেন–শইলডা ভাল লাগতাছে না। সামনের শুক্রবার থেইকা আল্লাহর নাম নিয়া যা থাকে কপালে শুরু করামই করাম।

শুনে মা খুশি হন। বলেন–কলমাগুলা শিখাইছিলাম মনে আছে?

— তা মনে থাকব না ক্যান? কি যে কন মা, কলমা মনে না থাকলে তো মুসলমানই না।

মা খাবার টেবিলে দাদার পাতে মুরগির রান তুলে দেন। দাদা কলমা মুখস্ত রেখেছেন, সামনের শুক্রবার থেকে নামাজ ধরবেন।

সামনের শুক্রবারে দাদার উত্তর–আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতা লড়ে না। আল্লাহ হও কইলে হয় সব। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারও কিছু করার শক্তি নাই। আল্লাহর হুকুম ছাড়া আমি পড়ি কেমনে নামাজ! আল্লাহ আমারে দিয়া নামাজ পড়াইতাছেন না। আল্লাহ না শুরু করাইলে আমি কেমনে শুরু করি। আমার কি কোনও শক্তি আছে শুরু করার!

আমি যদি কই আমার শক্তি আছে, তাইলে তো শেরক করা হইয়া গেল। লা শরিকা লাহু। আল্লাহর কোন শরিক নাই। আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। দাদা সুর করে মারফতি গান গেয়ে ওঠেন–আল্লায় যেমনে নাচায় তেমনে নাচি, পুতুলের কি দোষ?

দাদার ওপর হাল ছেড়ে দিয়ে আমাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে মা জিজ্ঞেস করেন — এই তুই নামাজ পড়ছস?

— বাবা কইছে আমারে ইস্কুলের পড়া পড়তে। আমি দৌড়ে যেতে যেতে পড়ার টেবিলের দিকে, বলি।

— নাক টিপলে এহনো দুধ বাইড়ব, ত্যাড়া ত্যাড়া কথা কওয়া শিখছস। যেমন বাপ, তেমন তার পোলাপান। আল্লাহ খোদা মানে না। তগোরে দিয়া আল্লাহ ভাল কাম করাইবেন কেমনে, তগোর উপরে তো শয়তান ভর করছে। শয়তানে তগোরে আল্লাহর নাম লইতে দেয় না। ইবলিশের দোসর হইছস।

মা হাউমাউ করে হঠাৎ কেঁদে উঠে বলেন–এই বাড়িতে শয়তান ঢুকছে। সব কয়টা কাফের হইয়া গেছে। ছেলেমেয়েদের উপরে ভরসা আছিল আমার। এরা নষ্ট হইয়া গেছে। আল্লাহ তুমি আমারে এদের কাছ থেইকা দূরে সরাইয়া নেও।

আল্লাহতায়ালা মা’র কথা রাখেন না। মা’কে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরান না। মা আমাদের দেয়াল ঘেরা বাড়িটিতে, ফুল ফলে ছাওয়া অবকাশে থেকেই যান। বাবার হুমকিও বিশেষ কাজে আসে না। মা নিয়মিত নওমহলে মিষ্টির দোকানের পেছনে আমিরুল্লাহর বাড়ি যেতে থাকেন। বৃহষ্পতিবার রাতের মজলিশে হাদিস কোরানের ব্যাখ্যা শুনে কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে বাড়ি ফেরেন। মা’র বিশ্বাস কেয়ামতের আর বেশি দিন নেই, তড়িঘড়ি তাই আখেরাতের সম্বল করতে হবে। মা’র বিশ্বাস পীর আমিরুল্লাহ আল্লাহর কাছে তদবির করে মা’র জন্য একখানা বেহেসতের টিকিট নেবেন। আমিরুল্লাহ ইঙ্গিতে মা’কে তাই বুঝিয়েছেন।

ছেলেমেয়েকে আল্লাহর পথে আনার হাল একরকম ছেড়ে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন মা। ছেলেমেয়ে দুনিয়াদারির লেখাপড়া শিখেছে, শয়তান ওদের বে-নামাজি বানাচ্ছে। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেন মা। আখেরাতের ময়দানে সবাই ইয়া নবসি ইয়া নবসি করবে। কারও দিকেও কারওর ফিরে তাকানোর সময় থাকবে না।

আল্লাহর পথে মা গেছেন ঠিকই, কিন্তু এ পথ প্রথম যেরকম মনে হয়েছিল, মোটে সস্তার পথ নয়। মা’কে আমিরুল্লাহ খানিকটা আভাস দিয়েছেন যে, মানুষকে বেহেসতের পথ দেখিয়ে নিতে গেলে পথে নানান বাধা বিপত্তিতে পড়তে হয়, পথ সুগম করতে হলে কড়ি দরকার হয়। কড়ি ছাড়া নবীজিও পথ চলতে পারেননি। টাকাকড়ি যা ঢালা হয় পথের উদ্দেশে, তার একটি নাম আছে, হাদিয়া। মা’র জন্য হাদিয়া যোগাড় করা খানিকটা মুশকিলের। টুকরো সদাইপাতির জন্যও এখন আর টাকা পয়সা পড়ে না মা’র হাতে। যা কিছু কেনেন, বাবা নিজেই। এ বাড়িতে আসার পর মা’র অলকা সিনেমা হল যেমন, আমার ইস্কুল যেমন বাড়ির কাছে, বাবার তাজ ফার্মেসি, যেখানে বসে বিকেলে রোগী দেখেন সেটিও কাছে, প্রায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। আমপট্টি নয়ত দুর্গাবাড়ির বাজার থেকে বাবা নিজে হাতে সদাই কিনে বাড়ি আসেন। মা’র গলায় সোনার মালা গলাতেই ছিল বলে চোর হাতাতে পারেনি। মাতৃ জুয়েলার্স হাঁটা পথ বাড়ি থেকে, মা এক দুপুরে মালাটি বিক্রি করে টাকা দিয়ে আসেন পীরবাড়িতে, পীরের হাদিয়া। ভাঁড়ার ঘর থেকে চাল ডাল তেল সরিয়ে পীর বাড়িতে দিয়েও একরকম স্বস্তি হয় মা’র, যে, একেবারে খালি হাতে তিনি কোরান হাদিস শুনতে আসেন না।

বাবা হাতখরচ বন্ধ করে দেওয়ার পর রিক্সাভাড়াও আজকাল মা’র মেলে না। মা হেঁটে হলেও পীর বাড়িতে যান, পীর বাড়িতে যাওয়া তাঁর চাইই। আমার জ্বর হল কি, দাদার পা ভাঙল কি ইয়াসমিন গাছ থেকে পড়ে মাথা ভাঙল, মা তাঁর যাত্রা বন্ধ করেন না। কেবল বৃহষ্পতিবারের মজলিশে নয়, ইস্কুল থেকে ফিরে সোমবার, মঙ্গলবারেও দেখি মা নেই। মা কোথায়? পীরবাড়ি। মা আমাদের প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি ঘটনায় দিন দিন অনুপস্থিত থাকেন। বাবার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। দিনে তিনি দু’বেলা বাড়ি এসে খোঁজ নেন বাড়িঘর সংসার সব হাওয়ায় উবে গেছে নাকি আছে। বাবা ভাঁড়ার ঘরে তালা দেন, কালো ফটকেও, রাত ন’টার পর। এসব মা’কে আরও বেশি উন্মাদ করে তোলে। তিনি ভাবেন শয়তান তাঁকে প্রাণপণ বাধা দিচ্ছে আল্লাহর পথে, তিনি আরও পণ করে আল্লাহর ধ্যানে বসেন, আমিরুল্লাহ পীরের খেদমতে প্রাণমন উজাড় করে দেন। বাড়ির কালো ফটক বন্ধ পেয়ে তিনি ফিরে যেতে থাকেন পীর বাড়িতে। মা’র উপস্থিতি রাতেও কমতে থাকে।

সাত রাত মা’র অনুপস্থিতি সহ্য করার পর বাবা দাদাকে নওমহল পাঠান মা’কে নিয়ে আসতে। মহাসমারোহে ফেরত আসার পর বাড়িতে মা’র আদর বেড়ে যায়। তাঁকে ছাড়া এ বাড়ি অচল হয়ে পড়ছে, এ কথা তিনি অনুমানে বোঝেন। বাবাকে শুনিয়ে মা আমাদের বলেন–তরা যদি নিয়মিত নামাজ পড়ছ, তাইলে তগোর সাথে আমি থাকবাম। নাইলে না। সোজা কথা।

শুনে, সোফায় হেলান দিয়ে বাবা নরম গলায় বলেন–নামাজ পড়। কোরান পড়। তুমারে কেউ বাধা দিছে? তুমার ওই পীরবাড়িতে যাইতে অয় ক্যান? পীরবাড়িতে যারা যায় না তারা কি বেহেসতে যাইব না? পোলাপানের লেখাপড়া আছে। তাদের দেখাশুনা কর না, পীরবাড়িতে রাইতদিন পইড়া থাক। নামাজ রোজা করতে হইলে সংসার ছেলেমেয়ে ফালাইয়া করতে হয় নাকি! এইসব বুদ্ধি তুমারে দেয় কে? যত্তসব ধান্দাবাজের কবলে পড়ছ!

মা রুখে ওঠেন–খবরদার ধান্দাবাজ কইবা না। আল্লাহর ওলিরে তুমি ধান্দাবাজ কও? এত বড় সাহস! তুমার জিববা খইসা পড়ব কইলাম। তুমার মত কাফেরের সাথে আমার কুনো সম্পর্ক নাই। আমার জীবন তুমি ছারখার কইরা দিছ। এই সময় যদি আমারে ফজলি আইসা আল্লাহর পথে না নিয়া যাইত, আমি ত সিনেমা হলে উল্টা সেন্ডেল পইরা দৌড়াইতাম। আমি অন্ধ আছিলাম, আল্লাহর পথে গিয়া এহন আমার চোখ খুলছে। এই মায়া মহব্বত সব মিথ্যা। এহন আমি বুঝি দুনিয়াদারিতে ডুবলে সব্বনাশ। আখেরাত আমারে পার করব কে? কেউ না। স্বামী সংসার ছেলে মেয়ে কেউ আপন না। এক আল্লাহই আপন।

ফজলিখালা মা’কে বলেছেন–বেনামাজির সাথে ঘর করলে তোমার গুনাহ হবে বড়বু। দুলাভাই নামাজ পড়েন না, যারা নামাজ পড়ে না, তারা কাফের। আর কাফেরের সাথে যারা ওঠাবসা করে, তাদেরও আল্লাহতায়ালা কাফেরের সঙ্গে দোযখের আগুনে পোড়াবেন।

মা দোযখের আগুনে পুড়তে চান না। এই সংসারদাহে তিনি যথেষ্ট পুড়েছেন আর নয়। মা’র হাতে তসবিহর গোটা দ্রুত নড়তে থাকে। মা’র ঠোঁটও তালে তালে নড়ে, সাল্লিআলা সাইয়াদেনা মহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। অন্ধকার ঘরে তসবিহর গোটাগুলো বেড়ালের চোখের মত জ্বলে। মা জেগে থাকেন সারারাত, সারারাত জায়নামাজে।

মধ্যরাতে মা’র কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। বালিশ থেকে মাথা তুলে বলি– মা কান্দো ক্যান?

মা উত্তর দেন না। কেঁদেই চলেন।

— মা ঘুমাইবা না? বিছনাত আসো। মা’কে বলি।

মা কান্না থামান না, ঘুমোতেও আসেন না।

ভোরে ফজরের নামাজ শেষ করে বিছানায় আসেন। সকালে মা’কে জিজ্ঞেস করি– রাইতে কানতাছিলা কেন মা?

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেন–কবরের আযাবের কথা ভাইবা কানতাছিলাম। ফেরেসতা যহন সাওয়াল জিগাস করব, কি উত্তর আমি দিব! কবরে দুইদিকের মাটি এমন চাপা দিব, এমন চাপা, যে—- মা’র কণ্ঠ বুজে আসে।

মা’কে বেঁধে রাখা যাবে না এ যেমন আমরাও বুঝেছি, বাবাও। তিনি আর কালো ফটক তালা দেওয়ার ঝুঁকি নিলেন না। ফটক খোলা থাক, মা যখন খুশি বাড়ি ফিরুন, তবু ফিরুন। আমার ধারণা, বাবা এই যে মা’র বাড়ি ফেরা চান, সে মা’র প্রতি ভালবাসায় নয়, মা যেন আমাদের গতিবিধি নজর রাখেন, কোনও দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে কারণে। এর মধ্যে আমার আরবির মাস্টার, মা’র ছোটবেলার সুলতান ওস্তাতজি, মারা যাওয়ার খবর এলে বাবা বলে দিলেন আর আরবি পড়তে হবে না, ইস্কুলের পড়ালেখা কর মন দিয়ে।

মা’র চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে শুনে। তিনি আল্লাহর কাছে সেজদায় পড়ে কাঁদেন– আমার ছেলেমেয়েদের তুমি ঈমানদার কর আল্লাহ। ওদেরে তুমি কবরের আযাব থেইকা মুক্তি দাও। ওদেরে তুমি দোযখের আগুন থেইকা বাঁচাও, বেহেসত নসীব কর। তুমি ক্ষমাশীল। তুমি দীন দুনিয়ার মালিক আল্লাহ। তুমি পরওয়ারদিগার।

মা গাছের নারকেল, পেয়ারা, আম, জাম, কাঁঠাল বোরখার তলে করে নিয়ে যেতে থাকেন পীরবাড়ির লোকদের খাওয়াতে। পাকঘরে যাওয়া প্রায়ই ছেড়েই দিয়েছিলেন, নতুন করে আবার যাওয়া শুরু করেন, খোঁয়াড়ের কচি মুরগি ধরে জবাই করে নিজে হাতে তেলে মশলায় রেঁধে বাটি ভরে নিয়ে কালো ফটক পার হন নিঃশব্দে। পীরকে খেতে দেবেন। পুরোনো দু’চারটে শাড়িও নেন, ফজলিখালা কাঁথা বানানোর জন্য চেয়েছেন। হুজুর কথা দিয়েছেন মা’র কবরে এসে ফেরেসতা যখন সাওয়াল জিজ্ঞেস করবেন, সেই জবাবের উত্তর, হুজুর নিজে দেবেন। শিগরি তিনি গাউছুল আজম হচ্ছেন। গাউছুল আজমকে আল্লাহতায়ালা নিজের গোপন তথ্য জানান। স্বপ্নে এ সুসংবাদ হুজুর পেয়েছেন। মা’র বড় সাধ একবার আল্লাহর দেখা পেতে। তার মত পাপীকে আল্লাহ কি আর দেখা দেবেন! মা’র চোখে জল জমে। বোরখার তলে এক হাতে ধরে রাখেন মুরগির মাংস ভরা বাটি, আরেক হাতে চোখের জল মোছেন!

এক রাতে পীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে বোরখা খুলতে খুলতে মা বিড়বিড় করেন বলেন–হুমায়রা আল্লাহু লেহা একটা সোনার লকেট বানাইছে। তিন ভরি দিয়া ছয়টা চুরিও বানাইছে। আমারে কি কেউ দেয় কিছু? আমার মত নিঃস্ব ত আর কেউ নাই দুনিয়ায়।

বোরখা খুলে মা চেঁচিয়ে মণিকে ডাকেন ভাত দিতে।

ভাত দেওয়ার পর ঠান্ডা ভাত দেস কেন? গরম ভাত নাই! আমারে কি পাইছস তরা? আমি মইরা গেলে তগোর সবার শান্তি। আমি কি বুঝি না? কেডা আমারে কি দেয় এই সংসারে! কিচ্ছু না। ভালা একটা কাপড় নাই পিন্দনের। কেডা দেহে? বলে মা থাল ঠেলে উঠে যান !

মণি ভাতের থালা নিয়ে পাকঘরে চলে যায় গরম করতে। মা আমার পড়ার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলেন যেন বাবা ঘরে বসেই শুনতে পান–মাইনষে তাগোর বউরে সোনা দিয়া মুড়াইয়া রাখে। আর আমি কি পাই! এই বাড়িতে দারোয়ান গিরি করনের লাইগা আমারে রাখা হইছে। মানসে ত দারোয়ানরেও বেতন দেয়। আমি ত বেতন ছাড়া কাম করতাছি এই বাড়িত!

মা’কে নিচু গলায় বলি–তুমি ত মা। তুমি বেতন নিবা ক্যা?

মা ধমকে থামান আমাকে–আমার কি দিয়া চলে! আমারে দেয় কেডা? বাপে বিয়া দিছিল ডাক্তারএর সাথে, কত শখ আছিল আমার বাপের যে জামাইয়ে আমার ভাই বইনরে লেহাপড়া করাইব। কই, করাইছে কাউরে? কারও খোঁজ লয়? আমার হাত দুইডা আইজ কত দিন ধইরা খালি। মাইনষের বউগুলার শইলে কত গয়না। আমারে ফহিরনির মত রাইখা আবার আবদারের সীমা নাই, ছেলেমেয়ে দেখ, ছেলেমেয়ে মানুষ কর!

যখন আমার ছ’বছর বয়স, পীরবাড়ি থেকে খবর এনেছিলেন ফজলিখালা, দুনিয়াতে দজ্জাল বের হচ্ছে, দজ্জাল মস্ত এক রামদা নিয়ে মানুষের ঈমান পরীক্ষা করবে। যার ঈমান নেই, তাকে কুপিয়ে পাঁচ টুকরো করবে। দজ্জালের ভয়ে নানির বাড়িতে প্রায় সবাই তখন দিনে দু’বেলা কলমা পড়তে শুরু করল। দজ্জাল আজ আসে কাল আসে এরকম। দজ্জাল এসে আমাকে টুকরো করছে, এরকম স্বপ্ন দেখে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত আমার। শরাফ মামা বললেন–ছোটবুর বাড়িত সবার ঈমান আছে। দজ্জাল ওগোরে কিচ্ছু করতে পারব না। মা’রও একই কথা–ফজলির আর চিন্তা নাই। ওই বাড়ির সবারই ঈমান মজবুত।

এক একটি দিন যায় আর শরাফ মামাকে, ফেলুমামাকে, মা’কে জিজ্ঞেস করি–কই, দজ্জাল ত আইল না!

মা বলেন–যে কোনও সময় আইব। তালই সাব কইছে শুনলাম দজ্জাল আওনের পরই কেয়ামত অইব।

— কেয়ামত অইলে কী হইব মা? মা’কে জিজ্ঞেস করলে — কী আর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–ইসরাফিল শিঙ্গায় ফুঁ দিব। পৃথিবী ধ্বংস হইয়া যাইব। আল্লাহর সৃষ্টি এই আসমান জমিন কিছুই আর থাকব না।

পৃথিবী কি করে ধ্বংস হবে তা অনুমান করে নিয়েছিলাম। আকাশ এসে চাপ দেবে পৃথিবীর ওপর, বাড়ি ঘরগুলো সব চ্যাপ্টা হয়ে যাবে, মানুষ মরতে থাকবে পিঁপড়ের মত। বিশাল বিশাল কড়ই গাছ, নিম গাছ, নারকেল গাছ, খেজুর গাছ সব মাটির তলায় ডেবে যাবে। দজ্জালের ঈমান পরীক্ষায় বাঁচলেও কেয়ামতে মরতেই হবে।

আমরা নানির বাড়ি ছাড়ার ঠিক আগে আগে, ফজলিখালা নতুন খবর নিয়ে আসেন সোনার গয়না পরা হারাম। শুনে বাড়ির মেয়েমানুষেরা যার যার সোনার গয়না খুলে রাখল। হাশেম মামার বিয়ে হয়েছে সবে। নতুন বউ গা ভরা গয়না পরে বসে থাকেন। পাড়ার বউঝিরা এসে ঘোমটা সরিয়ে বউএর মুখ দেখে যায়।

— পারুল, সোনার গয়না খুলে রাখ। শেষ জমানা চলে আসছে। এ সময় গয়না গাটি পরলে আল্লাহ গুনাহ দেবেন। বলে ফজলিখালা নিজেই হাশেম মামার বউএর গা থেকে গয়না খুলে যেন মরা ইঁদুর হাতে নিচ্ছেন এমন করে গয়নার লেজ ধরে ফেলে রাখলেন দূরে।

হাশেম মামা বলেছিলেন–ছোটবু, নতুন বউএর গা থেইকা গয়না গাটি খুলা নাকি অমঙ্গল জানতাম!

ফজলিখালা চিকন গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন–মঙ্গল অমঙ্গলের তুই কি বুঝস হাশেম! পরশু রাতে আব্বাজি নবীজিকে স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নের মধ্যেই নবীজি বলেছেন সোনার গয়না শরীরের যে অংশে পরা থাকবে, সে সব অংশ দোযখের আগুনের পুড়বে।

নানি ফজলিখালাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–তর গয়নাগুলা কই রাখছস?

ফজলিখালা তসবিহ জপতে জপতে বললেন–গয়না দিয়ে কি হবে মা, ওগুলো হুমায়রার আব্বা বিক্রি করতে নিয়ে গেছে।

নানির কপালে ভাঁজ পড়েছিল দুটো।

বছর গড়ালো, পীর বাড়িতে সোনার গয়না পরা হালাল হয়ে গেছে। খোলা বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে মা’র দুঃখি মুখের দিকে তাকিয়ে বলি– সোনার গয়না পরা ত হারাম! পীর বাড়ির সবাই না সোনার গয়না পরা ছাইড়া দিছিল! মা আমার উত্তর দেন না। এমন চোখ করে তাকান যেন সত্যি সত্যি শয়তান ভর করেছে আমার ওপর। আমি নই, যা কিছুই বলছি আমি, বলছে শয়তান।

এর কিছুদিন পর, মাতৃ জুয়েলার্স থেকে বাকিতে একজোড়া অনন্ত বালা নিয়ে আসেন মা। জুয়েলার্সের মালিক বাবার বন্ধু মানুষ। মা বলে আসেন বাবাই গয়নার দাম কিস্তিতে কিস্তিতে দিয়ে দেবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *