০৬. পায়জামায় পিশাচ

০৬. পায়জামায় পিশাচ

পরবর্তী দিনগুলো ম্যাড-আইকে হারানোর বেদনা পুরো বাড়ি আচ্ছন্ন করে রাখল। যদিও হওয়ার নয়, তবুও হ্যারি মনে মনে কামনা করল অর্ডারের অন্যান্য সদস্যের মতো ম্যাড-আইও লড়াইয়ের অনেক অভিগ্যতা নিয়ে থপথপ শব্দে ভারী পায়ে পেছনের দরোজা দিয়ে আসবেন। ম্যাড-আইকে হারানোর দুঃখ এবং অপরাধবোধ এমনভাবে হ্যারিকে আকড়ে ধরেছে যে, সে কোনক্রমেই এই কষ্ট থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। এই বোধ থেকেই ভেতরে একটা জেদ চাপল তার; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হরক্রুক্স খুঁজে বের করে ধ্বংস করতেই হবে।

ভালো চিন্তা, কিন্তু তুমি এই ব্যাপারে এখন কিছু করতে পারবে না রন হরক্রুক্স শব্দটি মুখ থেকে না উচ্চারণ করে বলল। যতক্ষণ না তোমার বয়স সতেরো হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি ট্রেস-এর আওতাধীন, তোমার সকল যাদুমন্ত্র অর্ডার জেনে যাবে। এবং আমরা যে কোনো জায়গার মতো এখানে বসেও পরে পরিকল্পনা করতে পারি,তাই না? অথবা, সে ফিসফিস করে বলল, তুমি কী জানেনা ইউ-নো-হোয়াট এখন কোথায়?

না, হ্যারি বলল।

আমার মনে হয় হারমিয়ন বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা করেছে, রন বলল। বলেছে, এই বিষয়ে কথা বলার জন্য তোমার এখানে আসার অপেক্ষায় আছে সে।

ওরা সকালের নাস্তার টেবিলে বসে কথা বলছিল। মি.উইসলি এবং বিল এই কিছুক্ষণ আগে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছেন। মিসেস উইসলি উপরে গেছেন হারমিয়ন এবং জিনির ঘুম ভাঙাতে। আর ফ্লয়ার ঝিমাতে ঝিমাতে উঠে গেছে স্নান করতে।

ট্রেস ভেঙে যাবে এ মাসের একত্রিশ তারিখে, হ্যারি বলল। তারমানে আমাকে অপেক্ষায় থাকতে হবে মাত্র চারদিন। তারপর আমি পারব

পাঁচ দিন।, রন ওর ভুল সংশোধন করে দিয়ে বলল। বিয়ের দিন পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। বিয়েতে না থাকলে ওরা আমাদেরকে মেরেই ফেলবে।

হ্যারি বুঝতে পারল ওরা বলতে সে ফ্লয়ার এবং মিসেস উইসলির কথা বলছে।

এটা একটা বিশেষ দিন, রন বলল। মনে হলো হ্যারি বিষয়টি মানতে চাচ্ছে, ওর কাছে তখন গুরত্ব অন্য বিষয়।

ওরা কি বুঝতে পারছে না যে আমাদের কাজটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

অবশ্যই ওরা জানে না, রন বলল। ওরা কোনো ইঙ্গিতও পায়নি। এখন তুমি কথাটা বলেছ বলেই আমি তোমার সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করছি।

রন দরোজার দিকে তাকিয়ে ভালো করে উঁকি দিয়ে দেখল মিসেস উইসলি ফিরে আসছেন কি না। যখন দেখল আসছেন না–তখন হ্যারির দিকে ঝুকল।

 আমরা কি করতে যাচ্ছি; মাম চেষ্টা করছেন হারমিয়ন এবং আমার কাছ থেকে জানতে এবং এর থেকে বিরত রাখতে। মাম এরপর তোমার কাছ থেকেও জানার চেষ্টা করবেন। তুমি শক্ত থেকো। ড্যাড এবং লুপিনও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এই বিষয়ে।

কিন্তু যখন আমরা বলেছি যে ডাম্বলডোর আমাদের ছাড়া আর কারো কাছে না বলতে তোমাকে বলেছেন, তখন ওরা ক্ষান্ত দিয়েছে। কিন্তু মাম দেননি। একেবারে নাছোরবান্দা।

রনের কথা, কয়েক ঘণ্টার ভেতর সত্য বলে প্রমাণিত হলো। দুপুরের খাবারের আগে মিসেস উইসলি হ্যারিকে সবার কাছ থেকে কৌশলে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। একটি মোজা যে কার, সম্ভবত হ্যারির রুকস্যাক থেকে পরে গিয়ে থাকতে পারে, এই ছুতায় তিনি হ্যারিকে নিয়ে গেলেন উঠোনে মোজাটা দেখানোর জন্য। তারপর, হ্যারিকে কিচেনের এক কোণে ধোয়ামোছা করার জায়গাটায় ফাঁকা পেয়ে তিনি শুরু করলেন

রন এবং হারমিয়নের কথাবর্তায় মনে হচ্ছে যে তোমরা তিনজনই হগোয়ার্ড ছেড়ে দিচ্ছ। তিনি অতি স্বাভাবিক স্বরে, হালকাভাবে জিজ্ঞেস করলেন।

ওহ, হ্যারি বলল, কিছুটা ঠিক।

এক কোণে ঝোলানো জামা থেকে পানি চুঁইয়ে পড়ছে, মনে হয় মিসেস উইসলির ব্লাউস।

আমি কী জানতে পারি, তোমরা আর পড়ালেখা করবে না কেন? মিসেস উইসলি জানতে চাইলেন।

ব্যাপার হলো, ডাম্বলডোর কিছু কাজ… মানে… আমার উপর দিয়ে গেছেন। ইতস্তত করে হ্যারি বলল। রন এবং হারমিয়নও সেটা জানে। এবং তারাও সে কারণে আমার সঙ্গে কাজটি করতে চায়।

কী ধরনের কাজ?

আমি দুঃখিত, সেটা আমি আপনাকে বলতে পারছি না।

বুঝলাম, কিন্তু সহজ করে বললে বলতে হয়, আর্থার এবং আমার সেটা জানার অধিকার আছে। এবং আমি নিশ্চিত যে মিস্টার এবং মিসেস গ্র্যানজারেরও এ বিষয়ে জানার অধিকার আছে, এবং তারাও আমার কথায় একমত হবেন! মিসেস উইসলি বললেন। হ্যারি এই আক্রমণের ভয়ে ছিল। সে নিজের সঙ্গে জোর করেই সরাসরি মিসেস উইসলির চোখের দিকে তাকাল। তাকিয়ে লক্ষ্য করল তার চোখেও জিনির মতো বাদামি আভা। এতে কোনো কাজ হলো না।

ডাম্বলডোর চাননি যে আর কেউ বিষয়টি জানুক, মিসেস উইসলি। আমি দুঃখিত। রন এবং হারমিয়নের আমার সাথে আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার।

তোমার নিজেরও যাওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। তিনি সোজাসাপটা বললেন। তোমাদের কারো এখনো বয়স হয়নি। খুবই খারাপ কথা। ডাম্বলডোরের যদি কোনো কাজ থেকেই থাকত, তাহলে তার হাতে তো পুরো অর্ডারই ছিল। অর্ডারের সবাই তার আদেশ পালন করত। হ্যারি, তুমি অবশ্যই তার কথাটা ভুল শুনেছ। হয়তো তিনি নিজেই কোনো কাজ করতে চেয়েছিলেন যেটা তুমি শুনেছ। আর তুমি মনে করছ যে কাজটি তোমাকে করতে হবে।

আমি কিছুই ভুল শুনিনি। হ্যারি সাদামাটাভাবে বলল। সেটা আমাকেই বলা হয়েছে।

হ্যারি তার হাত থেকে মোজাটি ফিরিয়ে দিল। মোজাটি হ্যারির বলে মনে করা হয়েছিল। মোজার উপর সোনালি রঙের গাছ অঙ্কিত।

আর এই মোজাটি আমার না। আমি পাডলমেয়ার ইউনাইটেড পছন্দ করি না।

ওহ্, নিশ্চয়ই করো না। হঠাৎ হ্যারিকে চমকে দিয়ে তার স্বাভাবিক কণ্ঠ ফিরিয়ে এনে বললেন। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। ঠিক আছে হ্যারি, তোমাকে আমরা যখন এখানে পাচ্ছি, নিশ্চয়ই ফ্লয়ার এবং বিলের বিয়ের অনুষ্ঠান সাজানোর কাজে সাহায্য করতে তুমি কিছু মনে করবে না, তাই না? এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।

না… অবশ্যই আমি কিছু মনে করব না, হঠাৎ আলোচনার বিষয়বস্তু পাল্টে যাওয়ায় হ্যারি অপ্রতিভ হলো।

লক্ষী ছেলে। তিনি বললেন। তিনি হাসতে হাসতে কিচেন থেকে বের হয়ে গেলেন।

সেই সময় থেকে মিসেস উইসলি–হ্যারি, রন এবং হারমিয়নকে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে এতটা ব্যস্ত রাখলেন যে ওদের অন্য কিছু চিন্তা করার কোনো সময় থাকল না। তার এমন আচরণের ব্যখ্যাটা হয়তো এ রকম হতে পারে যে মিসেস উইসলি চাচ্ছেন ওরা যাতে সদ্য ঘটে যাওয়া ভয়ানক ঘটনার কথা এবং ম্যাড আইর কথা ভুলে থাকতে পারে। দুদিন ধরে এক নাগারে কাটলারি বোয়ামোছা করা, রঙের সমন্বয় ঘটানো, ফুল ও ফিতা দিয়ে সাজানো, বাগানের পরিচর্যা করা এবং মিসেস উইসলিকে ক্যানাপি তৈরিতে সাহায্য করার ভেতর দিয়ে সময় কাটল। কিন্তু হ্যারির মিসেস উইসলির অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ হলো। তিনি যে কাজগুলো ওদের করতে দিয়েছেন–আসলে রন, হ্যারি ও হারমিয়নকে একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। সেই প্রথম রাত থেকে, যখন হ্যারি ওদের বলেছে যে ভোল্ডেমর্ট ওলিভ্যাভারের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে–তখন থেকেই হ্যারির আর তেমন কোনো সুযোগই হয়নি ওদের দুজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলার।

আমার মনে হয়, মা ভাবছেন, যদি তোমাদের তিন জনকে একত্রিত হওয়া এবং পরিকল্পনা করা বন্ধ রাখতে পারেন, তাহলে তোমাদের যাওয়াটা বিলম্বিত করতে পারবেন। তৃতীয় রাতে জিনি খাবার টেবিলে বসে নিচু স্বরে হ্যারিকে বলল।

এরপর কি ঘটতে পারে বলে তিনি মনে করেন? হ্যারি শান্তভাবে বলল। তিনি কি মনে করেন, আমাদের এখানে খাবার তৈরির কাজে আটকে রাখবেন আর অন্য কেউ একজন সে সময় ভোল্ডেমর্টকে ধ্বংস করার কাজটি করবে?

সে কোনো চিন্তা না করেই কথাগুলো বলল। দেখল জিনির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

তাহলে তো কথাটা ঠিক? জিনি বলল। তুমি আসলেই সেটা করতে চাচ্ছ?

আমি-না-আমি রসিকতা করছিলাম।

ওরা একে অন্যের দিকে তাকাল। জিনিকে দেখে মনে হলো ও ভীষণ আহত হয়েছে। হঠাৎ হ্যারির মনে পড়ল যে হগোয়ার্ডে মাঠের পৃথক এক কোণে কয়েক ঘণ্টা নষ্ট হওয়ার সেই সময়ের পর এই প্রথম সে জিনির সঙ্গে একা। হ্যারি নিশ্চিত যে বিষয়টি জিনিরও মনে আছে। দরোজা খুলে যেতেই তারা দুজনে লাফ দিয়ে উঠল। মি.উইসলি, কিংসলে এবং বিল ঘরের ভেতর ঢুকল।

ওরা এখন প্রায়ই অন্যান্য অর্ডার সদস্যদের সঙ্গে রাতের খাবার খায়। কারণ সদরদপ্তর হিসাবে ১২ নং গ্রিমোল্ড প্লেসের বদলে বারোয় সরিয়ে আনা হয়েছে। মিসেস উইসলি সবাইকে ব্যাখ্যা করেছেন যে ডাম্বলডোরের মৃত্যুর পর ডাম্বলডোরের মনোনীত ঘিমোল্ড প্লেসের গোপনীয়তা রক্ষাকারীরা সবাই এখানে সিক্রেট কিপার হয়েছে।

আমরা প্রায় বিশ জন আছি যাদের ফিদেলিউস চার্মের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ফলে ডেথ-ইটারদের বিশগুণ বেশি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের কাছ থেকে গোপন সংবাদ বের করে নেওয়ার। আমরা খুব বেশি সময় এটাকে ধরে রাখার আশা করতে পারি না।

কিন্তু স্নেইপ নিশ্চই এরই মধ্যে ডেথ-ইটারদের কাছে ঠিকানা বলে দিয়ে থাকতে পারে? হ্যারি জানতে চাইল।

ম্যাড-আই স্নেইপের বিরুদ্ধে কয়েকটি কার্স প্রস্তুত করে রেখেছিল, যদি সে আবার ওখানে কখনো যায় বা যদি সে স্থানের ব্যাপারে মুখ খুলতে চায় তাহলে আশা করি কার্সগুলো তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে বা তার মুখ বন্ধ রাখতে যথেষ্টই শক্তিশালী। কিন্তু যতই কার্স করা থাকুক, এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পারি না। ওই জায়গাটিকে সদরদপ্তর হিসাবে এখনো ব্যবহার করা হলে তা পাগলের কাজ হতো, জায়গাটা নিরাপত্তার জন্য এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সদর দপ্তর বারোয় সরিয়ে আনা হয়েছে।

কিচেনে এমন গাদাগাদি অবস্থা যে কাটা চামচ নাড়াবার মতো অবস্থা নেই। হ্যারির মনে হলো সে জিনির পাশে একেবারে চাপাচাপি করে বসে আছে। মুখে না বললেও এমন একটা ভাব তাদের মধ্যে বিনিময় হলো যে তারা পাশাপাশি না বসে কয়েক জনের পর পর বসলে ভালো হতো। হ্যারি খুব করে চেষ্টা করেও চিকেন কাটার সময় জিনির হাতের সঙ্গে ঘষা না লাগিয়ে পারল না।

ম্যাড-আইর কোনো খবর নেই? হ্যারি বিলকে জিজ্ঞেস করল।

কোনো খবর নেই, বিল বলল।

ওরা মুডির জন্য কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠান করতে পারল না। কারণ বিল এবং লুপিন তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা জানা খুবই কঠিন যে সে আসলে কোন স্থানে পড়ে থাকতে পারে। কারণ সে সময় ছিল অন্ধকার, স্পষ্ট কিছু দেখা যায়নি, লড়াইতে কার কি হয়েছে বলা মুশকিল।

দ্য ডেইলি প্ৰফেটে তার মৃত্যু সম্পর্কে বা তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি, বিল বলতে থাকল। কিন্তু সেটা দিয়ে বিষয়টি বোঝা যাবে না। বর্তমানে পত্রিকাটি অনেক বিষয়েই নীরব।

এই যে আমি ডেথ-ইটারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আন্ডার-এজ যাদু ব্যবহার করলাম, সেটার শুনানির জন্যও কর্তৃপক্ষ এখনো আমাকে ডাকেনি? হ্যারি টেবিলের অন্য প্রান্তে বসা মি. উইসলির উদ্দেশ্যে বলল এবং মি. উইসলি শুধু মাথা নাড়লেন। কারণ ওরা জানে যে আমার এ ছাড়া উপায় ছিল না, অথবা ওরা হয়তো চায় না আমি বিশ্বের সকলকে বলি যে ভোল্ডেমর্ট আমাকে আক্রমণ করেছিল?

পরেরটা আমার মনে হয়। মিগিয়র স্বীকার করতে চায় না যে ইউ-নো-হু। তার মতো শক্তিশালী, সে এটাও স্বীকার করে না যে আজকাবানে কত বড় জেল পলায়নের ঘটনা ঘটেছে।

হ্যাঁ, সত্য কথাটি জনগণকে বলা হয় না কেন? হ্যারি বলল। এতটা শক্ত করে সে হাতের ছুরিটা ধরল যে তার ডান হাতের পেছনের দিকে প্রায় বুজে আসা ক্ষত-দাগটি আরো স্পষ্ট হলো: আমি মিথ্যা কথা বলতে পারব না।

মন্ত্রণালয়ে এমন কেউ নাই যে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? রন ক্ষোভের সঙ্গে জানতে চাইল।

অবশ্যই রন, কিন্তু তারা সবাই আতঙ্কিত, মি. উইসলি বললেন। আতঙ্কিত এ কারণে যে এরপর হয়তো সে নিজেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। তাদের সন্তানরা হয়তো আক্রান্ত হবে। চারদিকে জোর একটা অপপ্রচার আছে; অবশ্য আমি নিজে বিশ্বাস করি না যে হগোয়ার্ডের মাগল স্টাডিজের প্রফেসর পদত্যাগ করেছেন। তাকে কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ক্রিমগিয়র তার অফিসে সারাক্ষণ নীরব হয়ে আছেন। আমি আশা করছি যে তিনি হয়তো কোনো একটা পরিকল্পনা করছেন।

মিসেস উইসলি যাদুর মাধ্যমে প্লেটগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলেন এবং সবাইকে আপেলের চাটনি পরিবেশন করলেন। এ সময়টাতে সবাই নীরব রইল।

আমাদের অবশ্যই একটি ব্যবস্থা করতে হবে যে কী করে তোমাকে ছদ্মবেশের মাধ্যমে গোপন করা যায়, হ্যারি, ফ্লেয়ার বলল। সবার সামনে তখন আপেলের তৈরি চাটনি। সে দ্বিধা নিয়ে বলল, বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাদের অতিথিদের কেউই ডেথ-ইটার না। কিন্তু আমি জোর দিয়ে এ কথাও বলতে পারি যে শ্যাম্পেন পান করে কেউ মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলবে না।

এই কথা থেকে হ্যারি বুঝতে পারে যে ফ্লয়ার এখনো হ্যাগ্রিডকে সন্দেহ করছে।

হ্যাঁ, এটা একটা পয়েন্ট, মিসেস উইসলি বললেন। টেবিলের অন্য প্রান্তে তিনি বসে আছেন। তার চশমাটি নাকের ডগায়। যে লম্বা কাগজটিতে তিনি কাজের বিশাল ফিরিস্তি লিখেছেন এখন সেটির উপর চোখ বুলাচ্ছেন। এখন কথা হলো, রন, তুমি কী তোমার রুমটি পরিষ্কার করার কাজ শেষ করেছ?

কেন? উচ্চস্বরে রন বলল। ধপাস করে হাতের চামচটা নামিয়ে রাখল এবং তার মায়ের দিকে তাকাল। আমার রুম পরিষ্কার করতে হবে কেন? রুমটি যেমন আছে তাতে ভালোই তো আছি, আমি আর হ্যারি!

ভুলে যাচ্ছ কেন, আমরা এখানে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তোমার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি বাচ্চা ছেলে

ওরা কি আমার বেডরুমেই বিয়ে করবে? রন ক্ষেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। না কি! ওখানে আবর্জনার স্তৃপ জমে আছে।

মায়ের সাথে এভাবে কথা বলে না, মিসেস উইসলি কঠিন স্বরে বললেন। তোমাদের যা বলা হয়েছে সেভাবে কাজ কর।

রন ওর বাবা-মায়ের সামনে চুপ হয়ে গেল আর কথা বাড়াল না। তারপর চামচটা তুলে নিয়ে আপেলের অবশিষ্ট চাটনিটুকু গবগব করে মুখে পড়তে থাকল।

আমি সাহায্য করতে পারি। এর কিছু দায়িত্ব আমারও আছে, রনের উদ্দেশে হ্যারি বলল। কিন্তু মিসেস উইসলি তার কথার মাঝখানে বাধ সাধলেন।

না প্রিয় হ্যারি, বরং তুমি আর্থারকে সাহায্য কর মুরগির আবর্জনা পরিষ্কার করতে। আর হারমিয়ন, আমি খুবই খুশি হবো যদি তুমি মশিয়ো এবং ম্যাডাম ডেলাকুরের চাদরগুলো পাল্টে দাও। তুমি নিশ্চই জানো তারা আগামীকাল সকাল এগারটায় চলে আসছেন।

কিন্তু কাজ করার সময় দেখা গেল তেমন কোনো মুরগির আবর্জনা নাই, এই নিয়ে খুব একটা করার কিছু ছিল না।

মল্লিকে এ নিয়ে কিছু বলবে না, মি. উইসলি হ্যারিকে কাজ করা থেকে বিরত রেখে বললেন। টেড টঙ্কস সিরিয়াসের মটরবাইকে যা ছিল তা সব পাঠিয়ে দিয়েছে, আমি সেগুলো এখানে লুকিয়ে রেখেছি। বলা যায়–এখানেই আছে। অদ্ভুত কিছু জিনিস–একটি একজস্ট গ্যাসকিন, এটাই নাম বলে আমার মনে হয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাটারি, এবং সবচেয়ে বড়কথা কীভাবে ব্রেক কাজ করে তা দেখার সুযোগ এখানে পাওয়া যাবে। সবগুলোকে একত্র করে আমি আবার লাগাবার চেষ্টা করব, অবশ্য মলি যখন থাকবেনা,আর আমার হাতে যখন সময় থাকবে।

ওরা যখন ঘরে ফিরে এলো তখন মিসেস উইসলিকে কোথাও দেখা গেল না। সুতরাং হ্যারি ফট করে উপরে রনের বেডরুমে চলে গেল।

আমি করতে পারছি, আমি করেছি! ও হ্যারি, তুমি, হ্যারিকে প্রবেশ করতে দেখে রন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রন বিছানায় আবার শুয়ে পড়ল যেখান থেকে সে একটু আগে উঠে এসেছিল। রুমটি সবসময়ের মতোই আগোছালো হয়ে আছে। পরিবর্তনের মধ্যে শুধু দেখা গেল হারমিয়ন এক কোণে বসে আছে। হার মিয়নের পায়ের পাতার ওপর তার হলুদ-বাদামি তুলতুলে বিড়াল ক্রুকশ্যাঙ্ক বসে আছে আর সে বই বাছাই করছে। দুই প বইয়ের মধ্যে কিছু বই দেখল তার। হ্যারি ক্যাম্প খাটের ওপর বসতেই হারমিয়ন বলল, হাই হ্যারি।

আরে, তুমি ফাঁকি দিয়ে এখানে কীভাবে?

আহ্, রনের মাম ভুলে গেছেন যে গতকালই তিনি আমাকে এবং জিনিকে মশিয়ে এবং ম্যাডাম ডেলাকুরের জন্য বিছানার চাদর পাল্টাতে বলেছিলেন, হারমিয়ন বলল।

হারমিয়ন তখন নিউমারোলজি এন্ড গ্রামাটিকা এক স্কুপে এবং অন্য স্থূপে দ্য রাইজ এ্যান্ড ফল অব ডার্ক আর্ট বইগুলো পৃথক করছিল।

আমরা এই মাত্র ম্যাড-আইর ব্যাপারে কথা বলছিলাম, রন বলল হ্যারিকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি হয়তো বেঁচে আছেন।

কিন্তু বিল নিজে দেখেছে তার গায়ে কিলিং-কার্স আঘাত করেছে। হ্যারি বলল।

রন বলল, হ্যাঁ, কিন্তু বিল নিজেও তো আক্রান্ত ছিল। সে কী করে নিশ্চিত হলো যে সে যা দেখেছে তা সঠিক?

যদি কিলিং-কার্স লক্ষ্যভ্রষ্টও হয়, তারপরও ম্যাড-আইকে হাজার ফিট নিচে পড়তে হয়েছে। হারমিয়ন ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের কুইডিশ টিমের বই হাতে নিয়ে বলল।

তিনি হয়তো ঢাল হিসাবে শিল্ড-চার্ম ব্যবহার করতে পারতেন।

ফ্লয়ার বলেছে বিস্ফোরিত হওয়ার পর ওর হাত থেকে যাদুদণ্ডটি ফসকে গিয়েছিল। হ্যারি বলল।

আচ্ছা ঠিক আছে, তোমরা যদি ওর মৃত্যুটাই চাও-, রন ক্ষোভের সঙ্গে বালিশটাকে আছড়ে দিয়ে আরেকটু সঠিক পজিশনে রাখতে রাখতে বলল।

অবশ্যই আমরা তাকে মৃত দেখতে চাই না! হারমিয়ন বলল। তার আঘাতটা প্রচণ্ড ছিল বলে মনে হয়। এটা খুবই মর্মপীড়াদায়ক, খুবই কষ্টের যে তিনি মারা গেছেন। আমরা বাস্তবতার কথা বলছি।

এই প্রথম, হ্যারি কল্পনা করল ম্যাড-আইর শরীরের কথা। ডাম্বলডোরের শরীর যেমন ভেঙে গিয়েছিল হয়তো তেমন তারও হয়েছে। ডাম্বলডোর মারা যাওয়ার পরও তার একটি চোখ কোটরের ভেতর ঘুরছিল। কথাটা ভেবে, তার প্রচণ্ড কষ্টের সঙ্গে অস্বাভাবিক এক হাসির মিশ্রণ ঘটল।

ডেথ-ইটাররা সম্ভবত জালের মতো করে তাকে ঘিরে রেখেছিল। সে কারনেই কেউ তাকে দেখতে পায়নি। রন ধীর মস্তিষ্কে বলল।

 হ্যারি বলল, হ্যাঁ, অনেকটা হয়তো বার্টি ক্রোচের মতো। প্রথমে বার্টি হাড়ের মতো হয়ে গেল এবং ক্রমান্বয়ে হ্যাগ্রিডের সামনের বাগানেই ঝরে পড়ে।

এমন কথা বলো না! হারমিয়ন প্রায় কেঁদে ফেলল। হ্যারি ঠিক সময় মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল হাতে ধরা স্পেলম্যান সিলাব্যারির বইটার ওপর হারমিয়নের চোখ থেকে টপ টপ জল পড়ছে।

আহ, না, হ্যারি বলল। সে পুরানা ক্যাম্প-খাট থেকে উঠে বসার জন্য চেষ্টা করতে করতে বলল, হারমিয়ন, আমি তোমার মন খারাপ করার জন্য

বিছানার স্প্রিঙে কচকচ শব্দ করে রন তড়াক করে উঠে দাঁড়াল এবং হ্যারির আগেই হারমিয়নের কাছে গেল। এক হাত দিয়ে সে হারমিয়নকে আগলে ধরল। অন্য হাত পকেটে ঢুকিয়ে একবারেই নোংরা একটি রুমাল বের করল যেটা কিছুক্ষণ আগেই সে কিচেনে অভেন পরিস্কার করতে ব্যবহার করেছে। দ্রুত গতিতে সে তার যাদুদণ্ডটি টেনে বের করল এবং নেকড়াটির দিকে ধরে বলল, টেরগো।

যাদুদণ্ডের কারণে তেল লাগা ময়লার অধিকাংশই উবে গেল। রনকে সন্তোষ্ট মনে হলো। সে এখন মোটামুটি পরিষ্কার রুমালটি হারমিয়নের হাতে দিল।

 ওহ্… ধন্যবাদ রন… আমি দুঃখিত, সে নাকের পানি পরিষ্কার করল। খুবই দুঃখজনক, তাই না? ডাম্বলডোরের পর আবার… আমি… আমি কল্পনাও করতে পারি না যে ম্যাড-আই মারা যাবে। তাকে খুবই দৃঢ়, খুবই শক্তিশালী বলে মনে হতো!

হ্যাঁ, আমি জানি, রন ওকে জড়িয়ে ধরে বলল। কিন্ত তুমি জানো সে এখানে থাকলে কী বলত?

সর্বক্ষণ সতর্ক থাকবে। হারমিয়ন চোখ মুছতে মুছতে বলল।

ঠিক বলেছ, মাথা দুলিয়ে রন বলল। তার ব্যাপারে যা ঘটেছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে বলত। তবে আমি যে শিক্ষাটি পেয়েছি তা হলো ওই ছোট ভীরু, হাদারাম মুন্ডুঙ্গুসকে বিশ্বাস করা যাবে না।

হারমিয়ন শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল এবং নিচু হলো আরো দুটো বই তুলে নেওয়ার জন্য। এক সেকেন্ড পরে রন হারমিয়নের কাঁধ থেকে তার হাতটা সরিয়ে নিল; হারমিয়নের হাতে ধরা বই-কেস থেকে তার পায়ের উপর, মনস্টার বুক অব

মনস্টারস ভারী মোটা বইটা পড়ে গেল। বইটা রনের গোড়ালিতে লেগেছে।

আমি দুঃখিত…. আমি দুঃখিত, হারমিয়ন উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল। হ্যারি বইটি রনের পায়ের ওপর থেকে টেনে তুলল এবং বন্ধ করল।

এই বইগুলো নিয়ে তুমি কী করছ? রন একটু খুঁড়িয়ে বিছানায় যেতে যেতে বলল।

বাছাই করছি, আমরা যখন হরক্রুক্সকে খুঁজতে যাব তখন কোন কোন বই আমরা সঙ্গে নিতে পারি, হারমিয়ন বলল।

ওহ্, তাই, রন বলল। নিজর কপালে হাত দিতে দিতে হেসে আবার বলল, আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে আমরা ভোল্ডেমর্টকে ধ্বংস করতে যাব।

হা… হা… হারমিয়ন বলল। মাথা নিচু করে স্পেলম্যান সিলবারির দিকে তাকাল। ভাবছি, যাদুর প্রতীকগুলো কি আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারব? বুঝতে -ও পারি, তাই আমার মনে হয় এটি আমরা সঙ্গে নিতে পারি নিরাপত্তার জন্য।

সে সিলাব্যারির বইটা দুই স্কুপের মধ্যে যেটি বড় সেটির উপর রাখল। তারপর হাতে তুলে নিল হগোয়ার্ড : একটি ইতিহাস গ্রন্থটি।

শোনো, হ্যারি বলল।

সে বসে আছে সোজা হয়ে। রন এবং হারমিয়ন দুজনই তার দিকে ভিন্নমত এবং প্রত্যাখ্যানের মিশ্র ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে।

আমার মনে আছে তুমি ডাম্বলডোরের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর আমার সঙ্গে আসতে চাওয়ার কথা বলেছিলে। হ্যারি শুরু করল।

ওই যে, আবার শুরু করেছে। রন চোখ পাকিয়ে হারমিয়নের দিকে তাকিয়ে বলল।

আমরা তো জানি সে বলবেই, হারমিয়ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল এবং এবার বইয়ের দিকে নজর দিল। জানো, আমি এই হগগায়ার্ড: একটি ইতিহাস বইটি সঙ্গে নেব। এমনকি যদি আমরা সেখানে ফিরে নাও যাই, তারপরও এ বইটি আমার সঙ্গে না থাকলে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব না

শোনো! হ্যারি বলল।

না! তুমি বরং আমার কথা শোনো, হারমিয়ন জেদ ধরে বলল। আমরা তোমার সঙ্গে যাবই। এবং এটা কোনো নতুন কথা নয়, এই ব্যাপারে অনেক মাস আগে, বলতে পার বছর আগে, সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। সত্যি সত্যিই।

কিন্তু-

একদম চুপ, রন বলল।

তোমরা কি নিশ্চিত যে এভাবে বিষয়টি ভেবেছ?

দেখা যাক, হারমিয়ন হ্যারির কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে বলল। ট্রাভেলস এন্ড ট্রলস বইটি ছুঁড়ে তূপের ওপর ফেলে তীব্র চোখে তাকাল। আমি কয়েক দিন ধরে গোছগাছ করছি। সুতরাং এক মুহূর্তের নোটিশে আমরা রওয়ানা হতে প্রস্তুত আছি। তোমার অবগতির জন্য বলছি, কয়েকটা জটিল যাদু জানা ও অন্যান্য সহায়ক উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছে ইতিমধ্যে। বলার অপেক্ষা রাখে না রনের মায়ের নাকের ডগা থেকে লুকিয়ে ম্যাড-আইর সব পলিজিউস পোশন পাচার করে নিয়ে এসেছি।

আমি বাবা-মায়ের স্মরণশক্তিকেও কিছুটা বদলে দিয়েছি, যাতে তারা নিজেদের ওয়েন্ডেল এবং মনিকা উইলকিনস মনে করেন এবং তাদের জীবনের আকাক্ষা হলো অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়া, যা তারা ইতিমধ্যে করেছেন। এর ফলে ভোল্টেমর্টের জন্য কঠিন হয়ে যাবে তাদেরকে খুঁজে বের করা এবং আমার সম্পর্কে বা তোমার সম্পর্কে অনুসন্ধান করা। সত্যি বলতে কি, দুর্ভাগ্যবশত তোমার সম্পর্কে তাদের কাছে আমি খানিকটা বলেছি।

ধর যদি আমি হরক্রুক্সকে ধরতে গিয়ে জীবন নিয়ে ফিরে আসি, তখন আমি বাবা-মায়ের ওপর থেকে ম্যাজিক স্পেল তুলে নেব। আর যদি না আসি, ঠিক আছে, আমার মনে হয় একটা ভালো চার্মই ব্যবহার করেছি যাতে তারা নিরাপদ এবং শান্তিতে থাকতে পারেন। ওয়েন্ডেল এবং মনিকা উইলকিনস জানে না যে তাদের একটি মেয়ে আছে। বুঝতে পেরেছ?

হারমিয়নের চোখ আবার ভিজে উঠেছে। রন বিছানা থেকে আবার উঠে এলো। আরো একবার তার হাতটা হারমিয়নের কাঁধের উপর রাখল। হ্যারির কথা বলার কৌশলের অভাব দেখে তার দিকে নিঃশব্দে বিরক্ত মুখে তাকাল রন। হ্যারি কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মনে মনে অপদস্থ হলোরনের ভাব দেখে। কারণ রন কাউকে কৌশল শেখায় এমনটি সে আর কখনো দেখেনি।

আমি… হারমিয়ন… আমি দুঃখিত… আমি বুঝতে পারিনি…

তুমি কী বুঝতে পারোনা যে রন এবং আমি ভালো করেই জানি, আমরা তোমার সঙ্গে থাকলে কী ঘটতে পারে? আমরা সব জানি। রন, হ্যারিকে দেখাও তুমি কী করেছ।

নাহ, ও এই মাত্র খেয়েছে। রন বলল।

দেখাও! ওর জানার প্রয়োজন আছে।

 আচ্ছা ঠিক আছে। হ্যারি, তুমি একটু এদিকে এসো।

দ্বিতীয়বারের মতো হারমিয়নের উপর থেকে রন হাত সরিয়ে নিল এবং ভারী পা ফেলে দরোজার দিকে গেল।

সিমন।

কেন? হ্যারি রনের পেছনে পেছনে ছোট জায়গাটিতে নামতে গিয়ে বলল।

ডিসেন্ডো! রন গুনগুন করে হাতের যাদুদণ্ডটি নিচু ফলস সিলিং-এর দিকে ধরে বলল।

ওদের ঠিক মাথার উপর একটি ছোট ডালা খুলে গেল এবং একটি মই ওদের দিকে সোজা নেমে এলো। একটি ভয়ানক চুচু শব্দ এবং গোঙানোর শব্দ আসছে মাথার ওপরের ওই চারকোনা জায়গাটি থেকে। এর সাথে আসছে অনেকটা খোলা নর্দমার মতো একটি তীব্র দুর্গন্ধ।

এটাই তাহলে তোমার পিশাচ, তাই না? হ্যারি জানতে চাইল। সে এই প্রাণীটিকে এর আগে দেখেনি শুধু মাঝেমাঝে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়া শব্দ শোনা ছাড়া।

হ্যাঁ,এটাই, রন বলল। সে মই বেয়ে উপরে উঠল। এসো, এবং ওকে দেখ।

হ্যারি রনের পেছনে মই বেয়ে কয়েক পা উঠল। ছাদের নিচে ফলস সিলিং এ মাচাং-এর ওপর ছোট একটি জায়গা। সে মাথা এবং কাঁধ উপরে তোলার পর দেখতে পেল প্রাণীটি কয়েক ফুট দূরে গুটি পাকিয়ে আছে। প্রায় অন্ধকার জায়গাটিতে বিশাল মুখ হা করে ঘুমিয়ে আছে।

কিন্তু… কিন্তু এটা তো দেখতে… পিশাচরা কি পায়জামা পড়ে?

না, রন বলল। ওদের সাধারণত লাল চুলও হয় না অথবা গায়ে ফুস্করি দাগও হয় না।

হ্যারি এবার কিছুটা অনুধাবন করতে পারল এবং ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলো। আকারে এবং গঠনে দেখতে অনেকটা মানুষের মতো, হ্যারির চোখ অন্ধকারে কিছুটা সয়ে আসতেই সে পরিষ্কার দেখতে পেল এটির পরনে রনের একটি পুরনো পায়জামা। সে আগে জানত যে পিশাচদের পশম হয় না এবং গায়ে রঙিন ভেজা ফঞ্চুরির দগদগে দাগ হয় না। বরং ওরা হয় হালকা-পাতলা গড়নের এবং পশমহীন।

এটাই যে আমি, নিশ্চই বুঝতে পেরেছ?

না, আমি বুঝলাম না। হ্যারি বলল।

রুমে ফিরে গিয়ে তোমাকে বলব সব। গন্ধটা নাকে লাগছে চল তারাতারি এখান থেকে যাই। রন বলল। ওরা মই বেয়ে নিচে ফিরে এলো। রন মইটা ভজ করে আবার সিলিঙে ঠেলে দিল। ওরা ফের হারমিয়নের সঙ্গে যোগ দিল। হার মিয়ন তখনও বই নাড়াচাড়া করছে।

আমরা যখন ওই কাজে চলে যাব, পিশাচটা তখন নেমে এসে আমার রুমে থাকবে। রন বলল। আমার মনে হয় সেও এই অপেক্ষাতেই আছে। তবে বলা। শক্ত কতটা সে পারবে, কারণ সে শুধু গোঙাতে এবং লালা ফেলতেই পারে। আর কেউ কিছু তাকে বললে সে মাথা দোলায়। যা হোক, সে আমার রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে তার গায়ের স্প্যাটারগ্লোইটে আক্রান্ত সকল দুর্গন্ধ নিয়েই। খুবই ভালো পরিকল্পনা, তাই না?

হ্যারি পরিকল্পনার দুর্বলতার দিকগুলো ভাবছিল।

এ ছাড়া আর কি করা যেতে পারে, রন বলল। হ্যারি যে তার এমন একটি বুদ্ধিমত্তার কাজ ধরতে পারেনি তা দেখে সে পরিষ্কার হতাশ হলো। দেখো, আমরা তিনজন যখন হগোয়ার্টে ফিরব না, তখন সবাই চিন্তা করবে যে হারমিয়ন এবং আমি তোমার সঙ্গে আছি, ঠিক? তারমানে হলো এরপর ডেথ-ইটাররা সরাসরি আমাদের বাড়িতে গিয়ে তুমি কোথায় আছ সে সম্পর্কে খোঁজ করবে।

কিন্তু আমার বেলায় আশা করি তাদের মনে হবে, আমি আমার মা-বাবার সঙ্গে কোথাও গিয়েছি। এখন অনেক মাগলরা তো পালিয়ে থাকার কথা ভাবছে। হারমিয়ন বলল।

কিন্তু, আমি তো আমার পুরো পরিবারকে লুকোতে পারব না। এতে খুবই সন্দেহের উদ্রেক হবে, তাছাড়া সবাই কাজকর্ম ছেড়ে কোথাও চলে যেতেও পারে না। রন বলল। সুতরাং আমরা এমন একটি গল্প তৈরি করব যেন আমি স্প্যাটারগ্রোইট হওয়ার কারণে খুবই অসুস্থ। সে কারণেই স্কুলে যেতে পারছি না। যদি কেউ অনুসন্ধান করতে আসে, মা আর বাবা তাদেরকে আমার বিছানায় শোয়া পিশাচটাকে দেখাবে। যেন আমি শুয়ে আছি, আমার সারা গায়ে ফুসকুড়ি। স্প্যাটারগ্রোইট সত্যিই খুব সংক্রামক। সুতরাং তাদের কেউ আমার কাছাকাছি যাবে না। সে যে কথা বলতে পারে না, সেটা কোনো সন্দহের কারণ হবে না। বরং তারা ভাববে, কারো ফাঙ্গাস থাকলে তার কণ্ঠস্বর পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাই সে কথা বলতে পারে না।

তোমার মাম এবং ড্যাড এই পরিকল্পনায় রাজি আছেন? হ্যারি জানতে চাইল।

ড্যাড আছেন। তিনি ফ্রেড এবং জর্জকে পিশাচে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করেছেন। আর মাম…তুমি মার মনোভাব বুঝতে পেরেছ নিশ্চই। তিনি আমাদের যাওয়াটা মেনে নেবেন না, ঠিক যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা না যাই।

ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে এল। হারমিয়ন বইগুলো একটি স্কুপ থেকে আরেক ভূপের উপর রাখছে টুকটাক শব্দ করে। রন বসে তার কাজ দেখছে। আর হ্যারি একবার রনকে আরেকবার হারমিয়নকে দেখছে। কিছু বলার ভাষা তার নেই। তারা তাদের পরিবারকে রক্ষার জন্য যেসব প্রস্তুতি নিয়েছে তা থেকে হ্যারি বুঝতে পারল যে ওরা সত্যিই তার সঙ্গে যাবে এবং এ সিদ্ধান্ত কতটা বিপজ্জনক তারা সেটাও জানে। হ্যারির বলতে ইচ্ছা করল এর অর্থ তার কাছে কী, কিন্তু বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো শব্দ সে খুঁজে পেল না।

এই নীরবতার ভেতর চার ফ্লোর নিচ থেকে মিসেস উইসলির চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো।

জিনি সম্ভবত ন্যাপকিন রিঙে ধুলো-ময়লা রেখে দিয়েছে। রন বলল। আমি জানি না কেন ডেলাকুর পরিবার বিয়ের অনুষ্ঠানের দুদিন আগে আসছেন।

ফ্লয়ারের বোন হবে নববধুর সঙ্গী ব্রাইডমেইড। রিহার্সেলের জন্য তাকে থাকতে হবে। তার বয়স কম। সে একা আসবে কি করে। আনমনাভাবে ব্রিক উইথ এ বানশি বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হারমিয়ন বলল।

হ্যাঁ, কিন্তু অতিথীরা তো আর মায়ের কাজকর্মে সাহায্য করতে যাচ্ছেন না, রন বলল।

আসলে আমাদের প্রথমে যেটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা হলো, আমরা এখান থেকে প্রথমে কোথায় যাব। হারমিয়ন বলল। সে না তাকিয়েই বিনের ভেতরে ডিফেনসিভ ম্যাজিক্যাল থিওরি বইটি ছুড়ল এবং অ্যান অ্যাপ্রাইজাল অফ ম্যাজিক্যাল এডুকেশন ইন ইউরোপ বইটি হাতে তুলে নিল। হ্যারি, আমি জানি তুমি বলেছিলে যে প্রথমে গোড্রিচ হলোতে যেতে চাও। আমি বুঝতে পারি কেন। কিন্তু… ধর… আমাদের কি হরক্রুক্সের বিষয়টিতে প্রাধান্য দেয়া উচিত নয়?

হরক্রুক্সগুলো কোথায় আছে, যে কোনো একটার খবরও আমরা যদি জানতাম, তাহলে তোমার কথায় আমি একমত হতাম যে সেখানেই আমাদের প্রথম যাওয়া উচিত। হ্যারি বলল। হ্যারির মনে হলো না যে হারমিয়ন সত্যিকার অর্থে তার গোড্রিচ হলোতে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। ওখানে ওর বাবা মায়ের কবর তাই সেখানে যাওয়ার একমাত্র কারণ নয়। এ জায়গাটির বিষয়ে তার একটা গভীর অনুভূতি রয়েছে এটা সত্যি, তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস অনেক প্রশ্নের উত্তর সে এখান থেকেই পাবে। হয়তোবা খুবই সাধারণ কারণ, এ জায়গাটিতেই ভোল্টেমর্টের কিলিং-কার্স থেকে সে বেঁচে গিয়েছিল। এখন তার সামনে আবার চ্যালেঞ্জ এসেছে ঘটনার পুনরাবৃত্তির। হ্যারি সেই জায়গাটিতে যেতে চাচ্ছে যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল। সে পূর্বের ঘটনাটা বুঝতে চায়।

তোমার কি মনে হয় না যে ভোল্টেমর্টের গড্রিচ হলোর ওপর নজর রাখছে? হারমিয়ন জানতে চাইল। সে হয়তো চিন্তা করতে পারে যে তোমার যখন সময় হবে, যখন থেকে তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবে–তখন তুমি তোমার মা-বাবার কবর দেখতেও যাবে?

এ কথাটা হ্যারির মনে হয়নি। সে এর বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর জন্য গলদঘর্ম হতে থাকল। ইতিমধ্যে রন কথা বলে উঠল। সে ভিতরে ভিতরে যা চিন্তা করছিল সে কথাটাই এখন বলল।

আর.এ.বি লোকটি কে, তুমি জানো, এ হলো সেই লোকটি যে আসল লকেটটি চুরি করেছিল। তার কথায় হারমিয়ন মাথা দোলালো।

সে তার নোট-এ বলেছে যে ওটা সে ধ্বংস করতে যাচ্ছে। সে এই কথাই বলেছে, তাই না?

হ্যারি ওর নিজের রুকস্যাকটি কাছে টেনে নিল। ভেতর থেকে নকল হরক্রুক্স টেনে বের করল যার ভেতর আর.এ.বির নোটটি তখনো ভাজ করা আছে।

আমি আসল হরক্রুক্সটি চুরি করেছি এবং যত তাড়াতাড়ি পারি এটাকে ধ্বংস করতে চাই। হ্যারি পড়ল।

যদি ইতিমধ্যে লোকটি ধ্বংস করে দিয়ে থাকে, তাহলে কী হবে? রন বলল।

অথবা মেয়েলোকটি, হারমিয়ন বাধা দিয়ে বলল।

যাই হোক, রন বলল। তাতে একটা কাজ আমাদের কমে গেল।

হা, কিন্তু আমরা এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আসল লকেটের জন্য, তাই? হারমিয়ন বলল। সত্যিই এটা ধ্বংস হয়েছে কি না আমরা তা খুঁজে দেখব।

এবং এক সময় যদি আমাদের হাতে আসে, তাহলে তুমি হরক্রুক্স ধ্বংস করবে কীভাবে?

ঠিক বলেছ, হারমিয়ন বলল। এটাই আমি এখন গবেষণা করছি।

কীভাবে? হ্যারি জানতে চাইল। আমার তো মনে হয় না যে হরক্রুক্স সম্পর্কে লাইব্রেরিতে কোনো বই আছে?

না, নাই, হারমিয়ন বলল। তার মুখটা গোলাপি হয়ে উঠল। ডাম্বলডোর সব সরিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তিনি বইগুলো ধ্বংস করেননি।

রন চোখ বিস্ফারিত করে হারমিনের দিকে তাকাল। তুমি হলক্স বিষয়ে বইগুলো হস্তগত করলে কীভাবে?

ঠিক চুরি করিনি, হারমিয়ন বলল। অস্থির-অসহায়ভাবে হ্যারি এবং রনের দিকে তাকাল। ডাম্বলডোর লাইব্রেরির শেলফ থেকে সরিয়ে নিলেও ওগুলো ছিল লাইব্রেরিরই বই। যাহোক, যদি তিনি চাইতেন যে কেউ যেন বইগুলো না পায় তাহলে আরো সতর্কতার সঙ্গে সেগুলো আসল কথা বল! রন বলল।

হ্যাঁ, এটা খুবই সহজ কাজ ছিল। হারমিয়ন নিচুস্বরে বলল। আমি শুধু একটি সামোনিং চার্ম ব্যবহার করেছি। তোমরা জানো চার্মটা হলো–এসিও! এবং বইগুলো আকারে ছোট হয়ে ডাম্বলডোরের স্টাডি রুমের জানালা দিয়ে সোজা মেয়েদের ডরমেটরিতে চলে এসেছে।

কিন্তু তুমি এটা কখন করলে? হ্যারি জানতে চাইল। হারমিয়নের প্রতি তার অবিশ্বাস এবং সমর্থনের একটি মিশ্রভাব তৈরি হলো।

ডাম্বলডোরের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ঠিক পরপর, হারমিয়ন বলল। তার গলার স্বর আরো নিচু হয়ে এসেছে। ঠিক যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে স্কুল ত্যাগ করব এবং হরক্রুক্স খুঁজতে যাব, তার পরপরই। আমি যখন আমার জিনিসপত্র আনতে উপরে গিয়েছিলাম তখন আমার মনে হয়েছে যে এ সম্পর্কে আরো বেশি জানলে

খুব ভালো হবে, এবং আমি ছিলাম একা সেখানে… সুতরাং আমি চেষ্টা করলাম… আর সঙ্গে সঙ্গে কাজ হলো। ওগুলো সোজা জানালা দিয়ে উড়ে চলে এলো… আর আমি গুছিয়ে নিলাম। সে ঢোক গিলল এবং সোজাসুজি বলল, আমার বিশ্বাস হয় না যে এতে ডাম্বলডোরের খুব রাগ হতো। এটা এমন না যে আমরা হরক্রুক্স তৈরির জন্য তথ্য ব্যবহার করছি, তাই না?

আমরা কী এই বিষয়ে তোমাকে দূষছি? রন বলল। আসল কথা বল, বইগুলো এখন কোথায়?

হারমিয়ন অল্প একটু সময় খুঁজেই পের ভেতর থেকে একটি মোটা ভলিউম বের করে আনল। বইটার চামড়ার বাঁধাই ঢিলে হয়ে গেছে। তাকে একটু বিমর্ষ দেখা গেল এবং এমনভাবে বইটা ধরে রাখল যেন কোনো একটা কিছু এইমাত্র মারা গেছে।

এই বইতেই পরিষ্কারভাবে আছে যে কীভাবে হরক্রুক্স বানাতে হয়। সিক্রেট অব দি ডার্কেষ্ট আর্ট–এটি একটি সাংঘাতিক বই। সত্যিই ভয়ানক, অশুভ যাদু দিয়ে ভরা। আমি ভাবছি কখন ডাম্বলডোর এগুলো লাইব্রেরি থেকে সরিয়েছেন… যদি তিনি হেডমাস্টার হওয়ার আগে এগুলো সরিয়ে না থাকেন, তাহলে আমি নিশ্চিত যে ভোল্ডেমর্ট এর থেকে তার প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনা পেয়ে গেছে।

সে সত্যিই সত্যিই বই পড়ে থাকে, তাহলে কেন সে স্লাগহর্নের কাছে জানতে চাইবে যে, কী করে হরক্রুক্স বানাতে হয়? রন বলল।

না, সে শুধুমাত্র জানতে চেয়েছিল যে, যদি একজন তার আত্মাকে সাতখণ্ডে ভাগ করে তাহলে কি হয়। হ্যারি বলল। ডাম্বলডোর যখন তাদের সম্পর্কে শস্লাগহর্নকে জিজ্ঞেস করেন তখন তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে রিডল ইতিমধ্যে জানে যে কী করে হরক্রুক্স তৈরি করতে হয়। আমার মনে হয় তোমার কথা ঠিক হারমিয়ন, এভাবেই সে হলক্স তৈরির বিষয়ে জেনে থাকতে পারে।

এবং আমি এই বিষয়গুলো সম্পর্কে যত বেশি পড়েছি, হারমিয়ন বলতে থাকল, ততই বিষয়টি ভয়ানক মনে হয়েছে, আর আমার বিশ্বাস কমেছে আমাদের জানা তার ছয়টি হরক্রুক্স বানানোর তথ্যের ওপর। বইতে সতর্ক করা আছে, আত্মা খণ্ডিত করে মাত্র একটি মাত্র হরক্রুক্স বানাতে গিয়ে একজন তার আত্মাকে কতটা ভঙ্গুর ও দুর্বল করে।

হ্যারির মনে পড়ল ভোল্টেমর্টের শয়তানের অধিক খারাপ চলাফেলার ডাম্বলডোরের উক্তি।

নিজেকে এক জায়গায় করার কি কোনো উপায় নেই? রন জানতে চাইল। হ্যাঁ, নির্লিপ্ত হেসে হারমিয়ন বলল। কিন্তু তা হবে ভয়ানক কষ্টের। কেন, কীভাবে করা যায় এটা? হ্যারি বলল।

অনুতাপ, হারমিয়ন বলল। তোমাকে সত্যি সত্যিই অনুধাবন করতে হবে যে তুমি কী করেছ। বইতে একটি ফুটনোট দেওয়া আছে। এমনকি ব্যাথাটি তোমাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আমার মনে হয় না যে ভোল্ডেমর্টে এটা করতে চেষ্টা করছে। তোমার কি মনে হয়?

না, হ্যারির উত্তর দেয়ার আগেই রন বলল। বইতে কি লেখা আছে কীভাবে হরক্রুক্স ধ্বংস করা যায়?

হ্যাঁ, হারমিনে বলল। সে এমনভাবে দুর্বল পাতাগুলো উল্টাতে থাকল যেন নষ্ট হয়ে যাওয়া শিরা-উপশিরাগুলো পরীক্ষা করছে। কারণ এখানে ডার্ক উইজার্ডদের সতর্ক করা হয়েছে যে তারা যাদুর স্পেল ব্যবহারকালে তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে যেন সচেতন থাকে। সেখানে থেকে আমি যা পেয়েছি তাহলো, হ্যারি যেমন রিডলের ডায়েরির বেলায় যা করেছিল, সেটা ছিল হরক্রুক্স ধ্বংসের যে অল্প কয়েকটি নিরাপদ মাধ্যম আছে তার একটি।

সেটা কী, ব্যাসিলিস্ক-এর বিষাক্ত থাবা দিয়ে আঘাত করা? হ্যারি জানতে চাইল।

ওহ, তাহলে আমরা যথেষ্ট ভাগ্যবান যে অনেক ব্যাসিলিস্কের থাবা পেয়েছি, রন বলল। আমি ভাবছিলাম যে এগুলো দিয়ে আমরা কী করব।

ব্যাসিলিস্কের থাবা হতেই হবে তা নয়, হারমিয়ন শান্তভাবে বলল। এটা এমন ধ্বংসকর কিছু হতে হবে যে হরক্রুক্স নিজে থেকে আর সেরে উঠতে না পারে। ব্যাসিলিস্কের থাবার বিষের শুধু একটি প্রতিষেধক আছে। এবং এটি অবিশ্বাস্যরকমের কম দেখা যায়।

ফিনিক্স-এর চোখের জল, হ্যারি মাথা নেড়ে বলল।

ঠিক, হারমিয়ন বলল। সমস্যা হলো, খুব কম উপাদানই আছে ব্যাসিলিস্কের বিষের মতো ধ্বংসাত্মক। এবং সেগুলো ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক। এ সমস্যাটি আমরা সমাধান করতে চাচ্ছি। কারণ হরক্রুক্স খণ্ড-বিখণ্ড বা দুমড়ে-মুচড়ে বা চূর্ণ বিচূর্ণ করলেই চলবে না। তোমাকে এমনভাবে বিনষ্ট করতে হবে যাতে যাদুর মাধ্যমেও মেরামত করা না যায়।

এমনকি আমরা ধ্বংস করার পরও তার ভিতরেও প্রাণ থেকে যেতে পারে, রন বলল।কেন, এর ভিতরের আত্মাটুকু অন্য কিছুর ভেতর কি আশ্রয় নিতে পারে না?

কারণ হরক্রুক্স মানুষের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত।

হ্যারি এবং রনের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার নয়, ওদের ঘোরের মধ্যে দেখে হারমিয়ন দ্রুত বলল, ধর, আমি যদি ঠিক এই মুহূর্তে একটি তলোয়ার তুলে নিই, এবং সেটা দিয়ে তোমাকে আঘাত করি, তাতে আমি তোমার আত্মার কিছুই করতে পারব না।

সেটাই হবে আমার জন্য স্বস্তিদায়ক, আমি নিশ্চিত, রন হেসে বলল। হ্যারিও হাসল।

প্রকৃতপক্ষে তাই হওয়া উচিত। কিন্তু আমার পয়েন্টটি হলো, তোমার শরীরের যাই হোক না কেন তা থেকে তোমার আত্মা মুক্ত থাকবে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, হারমিয়ন বলল। কিন্তু হরক্রুক্সের বেলায় বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর শরীরের ভেতরে আত্মার টুকরাগুলোর টিকে থাকাটা নির্ভর করবে এর ধারণ ক্ষমতার ওপর, যাদু করা শরীর বা পাত্রের ওপর। এই আত্মা ছাড়া হরক্রুক্স টিকে থাকতে পারে না।

ওই ডায়েরির ওপর আমি যখন আঘাত চালিয়েছিলাম তখন ওটার এক ধরনের মৃত্যু হয়েছিল। হ্যারি বলল। মনে পড়ল ফুটো হয়ে যাওয়া পাতাগুলো থেকে কীভাবে রক্তের মতো কালি ঝরেছিল। এবং ওটা ধ্বংস হওয়ার সময়। ভোল্টেমর্টের এক টুকরা আত্মার চিৎকার শোনা গিয়েছিল।

এবং ডায়েরিটা এক সময় যখন সঠিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল তখন এর মধ্যে এক টুকরা আত্মা আটকা পড়েছিল। যা আর পরে টিকে থাকতে পারেনি। তোমার ধ্বংস করার আগে জিনি চেষ্টা করেছিল ডায়েরিটা পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে ওঁর কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার। কিন্তু এটি স্বাভাবিকভাবেই ফিরে এসেছিল আবার নতুন হয়ে।

বিষয়টা ভেবে দেখ, বলে রন একটু সময় নিল। ডায়েরির ওই আত্মা-টুকরা ছিল জিনির নিয়ন্ত্রণে,তাই না? তাহলে সেটা স্বক্রিয় হলো কী করে?

যাদুর আধারটুকু যতক্ষণ আস্ত থাকবে, আত্মার টুকরা ততক্ষণ লাফিয়ে যে কারো ভেতরে এবং বাইরে যাতায়াত করতে পারবে। যদি, কেউ একজন মানষিকভাবে ওগুলোর নৈকট্য অনুভব করে–আমি বলছি না যে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখলে বা এটা স্পর্শ করলেই হবে। রন কিছু বলার আগেই আবার সে বলল। জিনি তার হৃদয়টা দিয়ে দিয়েছিল ডায়েরির প্রতি। সে নিজেকে ভয়ানক নাজুক করে ফেলেছিল। নিজেকে ভয়ঙ্কর বিপদের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। তুমি খুবই সমস্যায় পড়বে যদি তুমি হরক্রুক্স-এর ওপর অধিক দুর্বল হয়ে যাও অথবা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

আমি ভাবছি ডাম্বলডোর কী করে রিং ভাঙলেন, হ্যারি বলল। আমি কেন যে আগে তাকে জিজ্ঞেস করিনি? আমি কখনোই সত্যিকার অর্থে…।

তার কণ্ঠস্বর নেমে গেল। সে চিন্তা করতে থাকল আর কী কী বিষয়ে ডাম্বলডোরকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। এবং হেডমাস্টার মারা যাওয়ার পর থেকেই হ্যারির মনে হচ্ছে যে সে অনেক সুযোগ নষ্ট করেছে। ডাম্বলডোর বেঁচে থাকলে অনেক বেশি জানা যেত, সবকিছু জানা যেত…

বেড রুমের দরোজা দরাম করে খুলে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেতেই সব নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। হারমিয়ন তীক্ষ্ণ একটি শব্দ করল এবং সিক্রেট অব দি ডার্ক বইটি হাত থেকে ফেলে দিল। কশ্যাঙ্ক দৌড়ে বিছানার নিচে চলে গেল। সে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। রন লাফিয়ে বিছানা থেকে নামল এবং নিচে ফেলা। চকোলেট ফ্রগ র‍্যাপারের ওপর পা পড়ায় পিছলে গেল। তার মাথাটা বিপরীত দেয়ালের সঙ্গে বুকে গেল। আর হ্যারি স্বভাবগতভাবেই নিজের যাদুদণ্ডটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার চোখের সামনে দেখল মিসেস উইসলি। মিসেস উইসলির চুলগুলো এলামেলো। মুখটা রাগে কঠিণ হয়ে আছে।

আমি খুবই দুঃখিত তোমাদের খোসগল্পের আসর ভেঙে দেওয়ার জন্য, তিনি বললেন। তার গলা কাঁপছে। আমি জানি তোমাদের বিশ্রাম প্রয়োজন…কিন্তু ওদিকে আমার রুমে বিয়ের উপহারগুলো সব তূপ হয়ে আছে। ওগুলো গুছাতে হবে। এবং আমার মনে হলো তোমরা এ কাজে আমাকে সাহায্য করতে সম্মত হবে।

ওহ হ্যাঁ, হারমিয়ন বলল। সে পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াল। তাকে বেশ ভীত দেখাচ্ছে। চারদিকে বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হ্যাঁ আমরা…আমরা খুবই দুঃখিত যে…

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে সে হ্যারি এবং রনের দিকে তাকিয়ে তারপর মিসেস উইসলির পেছনে পেছনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

এটা অনেকটাই খণ্ডকালীন কাজের মতো, গলার স্বর নামিয়ে অভিযোগের সুরে রন বলল। সে তখনো মাথার ঠুকে যাওয়া জায়গাটা ডলছে। ওরা দুজনেই হারমিয়ন ও মিসেস উইসলিকে অনুসরণ করল। তবে কোনো জব স্যাটিসফেকশন ছাড়াই। এই বিয়েটি যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় আমি বেঁচে যাই।

হ্যাঁ, হ্যারি বলল তখন আর হরক্রুক্সকে খোঁজা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো কাজ থাকবে না। তখন একেবারে হলি ডের মতো সময় কাটবে, তাই না?

রন হাসতে শুরু করল। কিন্তু মিসেস উইসলির রুমে তাদের কাজ করার জন্য যে বিশাল উপহারের স্থূপ অপেক্ষা করছে তা দেখে সে দমে গেল।

পরের দিন সকাল এগারটায় ডেলাকুর পরিবার চলে এলো।

কিন্তু, ফ্লয়ারের পরিবারকে এখনই আসতে দেখে হ্যারি, রন, হারমিয়ন এবং জিনি যথেষ্ট বিরক্ত হলো। মন খারাপ করে রন উপরে গেল কোন মোজা জোড়া ম্যাচ করবে তা দেখতে। আর হ্যারি তার চুল সোজা করার কাজে মন দিল। যখন ওদের সবার কাছে নিজেদেরকে পরিপাটি মনে হলো তখন রোদ্রজ্জ্বল উঠানে নেমে এসে অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

হ্যারি এই জায়গাটিকে কখনো এমন সাজানো-গোছানো দেখেনি। দরোজার সামনে বড় দাগলা পানি সেদ্ধ করার ডেকচিগুলো নেই, ওয়েলিংটন বুটের দাগগুলো নেই, তার বদলে দরোজার দুপাশে বড় দুটি পাত্রে ফ্লাটারবাই ঝোপ দেখা যাচ্ছে। চারদিকে কোনো বাতাস না থাকা সত্ত্বেও মন্থরভাবে পাতাগুলো নড়ছে। একটা মৃদুমন্দ ছন্দ বয়ে যাচ্ছে। মুরগিগুলো দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উঠোন ঝাড়ু দেয়া হয়েছে এবং পাশের বাগানটি ঝরঝরে হয়েছে। বাগানটি থেকে লতাপাতা ও আগাছা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হ্যারির মনে হলো স্বাভাবিক সৌন্দর্যের ভাবটা চলে গিয়ে বাগানটাকে বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। হ্যারি বাগানের আগোছালো প্রাকৃতিক ভাবটাই পছন্দ করে।

অর্ডার এবং মন্ত্রণালয় মিলে বারোতে অগণিত নিরাপত্তা স্পেল ব্যবহার করেছে তার সঠিক সন্ধান করা হ্যারির কাছেও কঠিন। সে শুধু জানে যে কারো পক্ষে সরাসরি ম্যাজিকের দ্বারা এখানে আসা সম্ভব নয়। সে কারণেই মি.উইসলি ডেলাকুরদের আনতে পাশের পাহাড়ের চূড়ায় গিয়েছেন। ওখানেই তারা পোর্টকিতে করে নামবেন। উচ্চকণ্ঠে হাসির শব্দে ভেসে আসায় তারা চলে এসেছেন সেটা বোঝা গেল। মনে হলো হাসির শব্দটি মি.উইসলির। একটু পরেই মি.উইসলিকে গেটের কাছে দেখা গেল। দুহাত ধরা লাগেজ এবং সামনে অপূর্ব সুন্দর লম্বা সোনালি চুলের একজন নারী, পরনের সবুজ পাতার ঢিলে পোশাক, তিনি ফ্লয়ারের মা হতে পারেন।

মামান, চিৎকার করে উঠল ফ্লয়ার। দৌড়ে সামনে গেল তাদের জড়িয়ে ধরতে, পাপা!

মঁসিয়ে ডেলাকুর তার স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের কাছে কিছুই না। তিনি স্ত্রীর চেয়ে একমাথা খাটো এবং শরীরটা ভারী। মুখে খোচাখোচা কালো দাড়ি। কিন্তু তাকে ভালো মানুষ বলে মনে হয়। তিনি মিসেস উইসলির দিকে এসে দুগালে দুবার করে চুমু দিয়ে মিসেস উইসলিকে নারভাস করে দিলেন।

তোমরা গভীর সংকটের ভেতর দিয়ে কাটিয়েছ, গভীর গলায় তিনি বললেন। ফ্লয়ার বলল যে তোমাদের খুবই পরিশ্রম ও ঝামেলা যাচ্ছে।

ওহ, এটা কিছু না, কোনো ব্যাপার না, মিসেস উইসলি নরম সুরে বললেন, কোনো সমস্যাই হয়নি।

রন ওর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটালো একটি বামন ভূতকে লক্ষ্য করে লাথি দিয়ে। বামনটি পেছনের ফ্লাটারবাই ঝোপ থেকে ওর দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছিল।

ডিয়ার লেডি! মসি ডেলাকুর বললেন, তিনি তখনো তার মোটা হাত দিয়ে মিসেস উইসলির একটি হাত ধরে হাসছেন। আমাদের দু-পরিবারের মধ্যে যে বন্ধন তৈরি হচ্ছে সে জন্য আমরা সম্মান বোধ করছি। আমি আমার স্ত্রীকে আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি, অ্যাপোলিন!

ম্যাডাম ডেলাকুর শান্তভাবে সামনে এগিয়ে এলেন এবং তিনিও সামনের দিকে ঝুঁকে মিসেস উইসলিকে কিস করলেন।

কি যে ভালো লাগছে। তিনি বললেন, আপনার স্বামী আমাদেরকে অনেক মজার মজার গল্প বলছিলেন।

মি. উইসলি তার স্বভাবসুলভ হাসলেন; মিসেস উইসলি তার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে মি.উইসলি নীরব হয়ে গেলেন। এবং এমন একটা ভাব করলেন যেন রোগে শয্যাগ্রস্ত কোনো নিকট-বন্ধুর বিছানার পাশে বসে আছেন।

এবং অবশ্যই আপনারা আমার ছোট মেয়ে গ্যাব্রিয়েলেকে দেখেছেন! ডেলাকুর বললেন। গ্যাব্রিয়েলে হলো ফ্লয়ারেরই ছোট সংস্করণ, দেখতে অবিকল ফ্লয়ার। এগারো বছর বয়স। কোমর পর্যন্ত খাঁটি সোনালি চুল। সে মিসেস উইসলির দিকে তাকিয়ে একটা উজ্জ্বল হাসি দিল এবং তাকে জড়িয়ে ধরল। জিনি উচ্চশব্দ করে কাশি দিল।

আচ্ছা, ভেতরে আসুন, মিসেস উইসলি আনন্দের সঙ্গে বললেন। তিনি ডেলাকুর দম্পতিকে পথ দেখিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। বেশ অনেকবার নো প্লিজ! আফটার ইউ!, নট এট অল! বাক্যগুলো বলতে শোনা গেল।

অল্প সময়ের ভেতরই বোঝা গেল যে ডেলাকুর দম্পতি খুবই আনন্দদায়ক, উৎসাহী অতিথী। তারা সব ব্যাপারেই খুব সম্ভষ্ট হলেন এবং বিয়ের অনুষ্ঠান প্রস্তুতে সহায়তা করলেন। মঁসিয়ে ডেলাকুর অতিথীদের বসার স্থান থেকে শুরু করে নববধুর সঙ্গীদের জুতোর ব্যাপারেও ঘোষণা দিলেন চারমেন্ট, খুবই সুন্দর!। মিসেস ডেলাকুর অধিকাংশ গৃহকর্মে যোগ দিলেন এবং অল্প সময়ের ভেতর অভেন পরিষ্কার করে ফেললেন। গ্যাব্রিয়েলে সারাক্ষণ তার বড় বোনের সঙ্গে সঙ্গে রইল। চেষ্টা করল তার দ্বারা যা সম্ভব তা করে সাহায্য করতে। সে ফ্রেঞ্চ ভাষায় দ্রুত কথা বলে যেতে থাকল।

অসুবিধার দিক হলো বারো নামের বাড়িটা খুব বেশি মানুষের থাকার উপযোগী করে বানানো হয়নি। ফলে মি. এবং মিসেস উইসলি বসার ঘরে ঘুমাতে। গেলেন। সিয়ো এবং মাদাম ডেলাকুর প্রতিবাদ করলে এক রকম ধমক দিয়েই তারা তাদেরকে নিজেদের বেডরুমে ঘুমাতে পাঠালেন। গ্যাব্রিয়েলে ঘুমাতে গেল ফ্লয়ারের সঙ্গে পারসির পুরাতন রুমটিতে। রোমানিয়া থেকে চার্লি আসার পর বিলের সাথে থাকবে। চার্লি তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।

ফলে ওদের একসঙ্গে শলা-পরামর্শ করার পরিস্থিতি প্রায় রইল না। সে কারণে মরিয়া হয়ে হ্যারি, রন এবং হারমিয়ন মুরগিগুলোকে খাবার দেওয়ার দায়িত্ব। নিয়েছে। যাতে সবার কাছ থেকে ওরা দূরে সরে থাকতে পারে।

কিন্তু এখনো তিনি আমাদের একা ছাড়ছেন না, রন ক্ষোভের সঙ্গে বলল। কারণ ওরা দ্বিতীয়বার উঠোনে একত্র হওয়ার চেষ্টা করতেই দেখা গেল মিসেস উইসলি হাতে কাপড় ধোয়ার বড় বালতি নিয়ে হাজির হয়েছেন।

ওহ, খুব ভালো কথা, তোমরা মুরগিগুলোকে খাবার দিয়েছ, ওদের দিকে আসতে আসতে মিসেস উইসলি বললেন। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আগামীকাল লোকজন আসার আগেই আমরা এগুলোকে আটকে রাখো… এটা করতে হবে কারণ বিয়ের অনুষ্ঠানের সামিয়ানা হবে এখানে। তিনি মুরগীর খোপের ওপর হেলান দিয়ে একটু সময় নিয়ে বললেন। তাকে ক্লান্ত দেখা যাচ্ছিল। মিলামেন্টের ম্যাজিক মারকুজ এসে পৌঁছবে এখনি… ওরা খুবই ভালো। বিলরা ওদের এগিয়ে নিয়ে আসতে গেছে… ওরা যখন আসবে তুমি বরং বাড়ির ভিতরে থেকো হ্যারি। এ জায়গায় এতসব স্পেল, যে কারণে বিয়ের আয়োজনকে জটিল করে তুলেছে।

আমি দুঃখিত, হ্যারি বিনয়ের সঙ্গে বলল।

ওহ, এভাবে বলো না ডিয়ার, সঙ্গে সঙ্গে মিসেস উইসলি বললেন। আমি আসলে ওভাবে বলিনি..ওয়েল, তোমার নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসলে আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তুমি তোমার জন্মদিনটি কীভাবে পালন করতে চাও হ্যারি। শত হলেও সতেরোতম, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ…।

আমি এ নিয়ে হৈচৈ চাই না, হ্যারি দ্রুত উত্তর দিল। সে সকলের বাড়তি কাজ ও ঝক্কি-ঝামেলার সম্ভাবনার কথা ভাবল। মিসেস উইসলি, সত্যিকারে একটি নরমাল ডিনার হওয়াটাই ভালো… দিনটা হলো বিয়ের ঠিক আগের দিন…

আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যদি তাই মনে কর। আমি রামুস এবং টঙ্কসকে আমন্ত্রণ জানাব, নাকি? আর হ্যাগ্রিডকে?

তাহলে তো কথাই নেই, হ্যারি বলল। কিন্তু দয়া করে খুব চাপ কাঁধে নেয়া দরকার নেই।

না, না মোটেই না… এটা কোনো সমস্যা না… তিনি হ্যারির দিকে তাকালেন… একটি গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি তার চোখে। তারপর একটু করুণ হাসলেন। এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। হ্যারি পেছন থেকে তাকিয়ে রইল। তিনি তার যাদুদণ্ডটি ধোয়া কাপড়ের ওপর ধরলেন, ভেজা কাপড়গুলো শুকোনোর জন্য আপনা আপনি উপরে উঠে ঝুলে গেল। হঠাৎ হ্যারির ভিতরে দুঃখবোধ হলো মিসেস উইসলির অসুবিধাগুলোর জন্য এবং সে নিজেও যে তাদের বেদনার কারণ হয়েছে, সেজন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *