পাক্ষিক সুবৰ্ণ বের হয়েছে। চার রঙের ঝকঝকে কভার। সাত টাকা দাম। এই সংখ্যাতেই আতাহারের কবিতা থাকার কথা। গনি সাহেব সে রকমই বলেছেন। কাজেই সাত টাকা খরচ করে পত্রিকা কেনার মানে হয় না। সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে দুকপি সে পাবে। পত্রিকার তৃতীয় পাতায় বড় বড় করে লেখা–প্রকাশিত প্রতিটি লেখার জন্যে সম্মানী দেয়া হয়। এটা অবশ্যি ডাহা মিথ্যা কথা। গনি সাহেব এখন পর্যন্ত কোন লেখার জন্যে সম্পমানী দেননি। তবে সৌজন্য সংখ্যা দেন।
আতাহার সাত টাকা দিয়ে সুবর্ণ কিনল। নিজের কবিতা আছে কি-না এক্ষুণি দেখার দরকার নেই। আপাতত পত্রিকা পাঞ্জাবির পকেটে থাকুক। পরে শান্তিমত দেখা যাবে। সে দশ টাকা নিয়ে বের হয়েছিল–সাত টাকা পত্রিকা কিনতে গেল, দুটাকা গেল সিগারেটে। শুধুমাত্র এক টাকা সম্প্ৰল করে ঢাকা শহরে ঘোরা যায় না। আতাহার কি করবে বুঝতে পারছে না। টাকার সন্ধানে বাড়িতে ফিরে যাওয়া এই মুহূর্তে অর্থহীন। রশীদ সাহেব আজ ভোর ছটা থেকে তুর্কি নাচ নাচছেন। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পরীক্ষা দেয়নি এই খবর তিনি আজ ভোরবেলা পেয়েছেন। কে তাকে খবর দিয়েছে সেটা একটা রহস্য। আতাহার দেয়নি, মিলিও দেয়নি। এক হতে পারে, কালপ্রিন্ট নিজেই দিয়েছে। তারপর দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ভোর ছটায় আতাহারের ঘুম ভেঙেছে তার বাবার চিৎকারে।
বাড়িঘর সব জ্বলিয়ে দেব। আগুন দিয়ে ছারখার করে দেব। আমার প্রতিটি পয়সা অনেস্ট পয়সা। রক্ত পানি করা পয়সা। এই বৃদ্ধ বয়সে গাধার মত পরিশ্রম করছি। আর আজি–এই তার প্রতিদান? না, আমি কিছু রাখব না। আগুন দিয়ে সব জ্বলিয়ে দেব।
বক্তৃতা দিতে দিতেই তিনি ফরহাদের দরজায় প্রচণ্ড লাথি দিলেন। লাথির সঙ্গে সঙ্গে হুংকার–আইনস্টাইন হয়েছে। সহজ প্রশ্ন দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। আয় এখন কঠিন প্রশ্ন দেখ। তোর চামড়া আজ আমি খুলে নেব। জুতাপেটা করব। বাটা কোম্পানির জুতা কত শক্ত আজ পরীক্ষা হয়ে যাবে।
রশীদ সাহেব চিৎকার করেন, দরজায় লাথি দেন এবং দু হাতে প্রবলবেগে কড়া নাড়েন। আতাহারের ইচ্ছে করছে ছোট ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে, তবে এ রকম বিপদসংকুল অবস্থায় দরজা খোলার কোন মানে হয় না। আতাহার বাসি মুখে সিগারেট ধরিয়ে পশ্চিম রণাঙ্গন নিশ্চুপ হবার কামনা করতে লাগল। মা বাসায় থাকলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তবে মিলি আছে। সে বাবাকে সামলাবার চেষ্টা করবে। এখনো করছে না কেন তা বোঝা যাচ্ছে না।
মনে হয় ঝড়ের প্রথম ধাক্কাটা পার হবার জন্যে অপেক্ষা করছে।
রশীদ সাহেবের হৈ-চৈ হঠাৎ বন্ধ হয়। পশ্চিম রণাঙ্গন পুরোপুরি নিশাচুপ। আতাহারের ধারণা হল মিলি তাকে তার ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছে। এই ফাকে ঘর থেকে বের হয়ে আজ দিনের মত ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া দরকার। আজ আর কিছুতেই বাবার সামনে পড়া ঠিক হবে না।
আতাহার দরজা খুলে বের হল। বারান্দা ফাঁকা। সে মোটামুটি নিশ্চিন্ত মনে রান্নাঘরের দিকে গেল। মতির মা বা মিলি রান্নাঘরে থাকলে চা পাওয়া যাবে।
মিলি রান্নাঘরে ছিল। আতাহার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল, চা-টা কিছু হবে না। বাবার মেজাজ খুব খারাপ। হৈ-চৈ করে এখন শরীর খারাপ করেছে। বুক ধড়ফড় করছে। শুয়ে আছেন। তুই বাইরে কোথাও চা খেয়ে নে। আজ নাশতা—টাশতা কিছু বানোব না। মাকেও দেখতে যেতে হবে। মার অবস্থা ভাল না।
বলিস কি!
মা বার বার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। একবার মনে করে দেখতে যাবি।
আচ্ছা যাব। ফরহাদ করছে কি? বাবার ঠেলা খাবার পর তার অবস্থা কি?
সে তার মতোই আছে। পড়ছে।
সাব্বাস! মনে হচ্ছে বাপকা বেটা।
রসিকতা করিস না ভাইয়া। আমার মন-টন ভাল না।
যেখানে বাসার এই পরিস্থিতি সেখানে টাকার সন্ধানে বাসায় যাওয়া যায় না। সবচে ভাল বুদ্ধি হাসপাতালে চলে যাওয়া। মার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে উঠে দাঁড়ানো মাত্র মা বালিশের নিচ থেকে একটা নোট বের করে তার পকেটে খুঁজে দেবেন। সেটা একশ টাকার সবুজ নোট হতে পারে যা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেবে। আবার পঞ্চাশ টাকার লাল নোটও হতে পারে যা মনে করিয়ে দেবে প্রভাতের সূর্যোদয়ের কথা। সমস্যা একটাই–হাসপাতালে যেতে হবে হেঁটে হেটে। ভোরবেলা খালি পেটে হাঁটতে পারেন। শুধু স্বাস্থ্য-প্রেমিকরা। যাঁরা দীর্ঘ দিন নিরোগ দেহে বাঁচতে চান। সে নিজেও দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকতে চায়, তবে তার জন্যে খালি পেটে মাইলের পর মাইল হাঁটতে চায় না।
হাসপাতালের মেইন কলাপসিবল গেট বন্ধ। টুল পেতে দুজন দারোয়ান বসে আছে। দুজনেরই মনে হয় খারাপ ধরনের জণ্ডিস হয়েছে। চোখ গাঢ় হলুদ। আতাহার গেটের কাছে দাঁড়াতেহ একজন বলল, পাস। পাস আছে?
দিনের শুরুতেই মিথ্যা বলা ঠিক হবে না ভেবে আতাহার বলল, পাস নেই।
পাস ছাড়া ঢোকা যাবে না।
পাস কে দেয়?
অফিসে গিয়ে খোঁজ করেন।
অফিস কোথায়?
জানি না।
হাসপাতালের কাজ করেন। আর আপনাদের অফিস কোথায় জানেন না?
গেইটের মুখে ঝামেলা কইরেন না। পাস ছাড়া ঢুকামু না। সোজা কথা। পাস দেখান–ভিতরে ঢুকেন?
আতাহার ফিরে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে শুধুমাত্র কবিদের জন্যে একটা বিশেষ পাস থাকা উচিত–ইউনিভাসেল পাস। যে পাস দেখিয়ে যে কোন জায়গায় যাওয়া যাবে। বঙ্গভবনের গেটে পাস দেখালে মিলিটারী পুলিশ এটেনশন হয়ে স্যালুট দেবে। সিনেমা হলে পাস দেখালে হলের ম্যানেজার নিজে এসে ডিসিতে বসিয়ে দেবে। ইন্টারভ্যালের সময় হাতে কোকের বোতল ধরিয়ে দেবে।
রাস্তায় যেতে যেতে আতাহারের মনে হল সুবৰ্ণতে তার কবিতা খুব সম্ভব ছাপা হয়নি। আজ দিনটা অশুভ। এই দিনে কবিতা প্রকাশিত হবার মত শুভ কিছু হবে না। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে গনি সাহেবের এন্টাসিড কিনে দিয়েও ফল হয়নি। আতাহার পাঞ্জাবির পকেট থেকে পত্রিকা বের করল। যা ভেবেছিল, তাই। তার কবিতা নেই। তার মন ভয়ংকর খারাপ হয়ে গেল। পত্রিকাটা কুচি কুচি করে ছিড়তে পারলে রাগ কমার সম্ভাবনা আছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পত্রিকা ছেঁড়া ঠিক হবে না। লোকজন আড়চোখে তাকাবে। কাগজ ছেড়ার সঙ্গে পাগলামির একটা সম্পর্ক আছে। প্রাথমিক স্তরের পাগলরা কাগজ
আতাহার সুবর্ণ ছিড়ে ছিড়ে টুকরো টুকরো করল না, তবে নর্দমার দিকে জুড়ে দিল। পেটের খিদে এই মুহুর্তে ভালই জানান দিচ্ছে। সরকার থেকে কবিদের যদি খাদ্য পাস দিত তাহলে চমৎকার হত। সেই পাস যে কোন রেস্টুরেন্টে দেখালেই রেস্টুরেন্টের মালিক একগাল হেসে বলবে–স্যার, বসুন। কি খাবেন বলুন।
কি আছে। আপনার এখানে?
অনেক কিছুই আছে। আপনার কি খেতে ইচ্ছে বলুন দেখি।
ড়ুবা তেলে গোটা দশেক লুচি ভাজুন। ভুনা গরুর গোশত দিন। এক প্লেট কলিজি, আর এক প্লেট মুরগির মাংস। সিরকায় ভিজিয়ে বড় বড় পেঁয়াজ দিন। ইন্ডিয়ান মিষ্টি পেঁয়াজ না, বাংলাদেশী পেঁয়াজ। ঝােঝ আছে। এ রকম পেঁয়াজ। ভুটানের কাচামরিচের আচার আছে? থাকার কথা না। ঐ আচার আনিয়ে দিন। নাশতার পর পর তিন কাপ চ্যা খাব। রেডি রাখবেন। চায়ের সঙ্গে রথম্যান সিগারেট। দেখবেন যেন ড্যাম্প না হয়। নাশতার সঙ্গের সিগারেট ড্যাম্প হলে নাশতাটাই মাটি।
স্যার, আরাম করে বসুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব এসে যাচ্ছে। এই ফাকে একটু তেহারী কি চেখে দেখবেন? এই মাত্ৰ হাড়ি নেমেছে। আপনাকে দিয়ে বিসমিল্লাহ করি।
দিন, খেয়ে দেখি আপনাদের তেহারী। সঙ্গে ঝাল কাঁচামরিচ দেবেন। কাচামরিচ মিষ্টি হলে, খবৰ্দার, তেহারী খাব না।
সারা পথ খাওয়াদাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতে আতাহার সাজ্জাদাদের বাড়িতে উপস্থিত হল। গতকালের ভাঙা গাছ এখনো বাড়ির ওপর পড়ে আছে। তবে গাছ থেকে ঝরে পড়া ডাল, লতাপাতা, ভাঙা জানালার কাচের টুকরা পরিষ্কার করা হয়েছে। একটা গাছ বাড়িতে ভেঙে পড়ে আছে এই দৃশ্য এখন দেখতে ভালই লাগছে। এ বাড়িতে কোন ছেলেপূলে থাকলে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে। মজা করতে পারত। তার নিজেরই গাছ বেয়ে ছাদে উঠতে ইচ্ছে করছে।
বাড়ির দারোয়নের কাছ থেকে জানা গেল সাজ্জাদ আছে। সুসংবাদ, বলাই বাহুল্য। যাবতীয় সুসংবাদের সঙ্গে সামান্য হলেও দুঃসংবাদ মিশে থাকে। জানা গেল হোসেন সাহেব মাঝের ঘরে বসে আছেন। দোতলায় সাজ্জাদের ঘরে যেতে হলে মাঝের ঘর দিয়ে যেতে হবে। হোসেন সাহেবকে ডিঙ্গিয়ে সাজ্জাদের কাছে যাওয়া সম্ভব হবে না। সে কি ফিরে যাবে? ফিরে যাবেই বা কোথায়? ক্ষিদেয় প্ৰাণ যাচ্ছে। বাড়ির উপর হেলে পড়ে থাকা আমগাছটা সেদ্ধ করে দিলে খেয়ে ফেলতে পারে এমন অবস্থা।
নীতু বারান্দায় ফুলের টবে পানি দিতে এসে আতাহারকে দেখল। তার চোখে আগ্রহ বা অনাগ্রহ কিছুই দেখা গেল না। আতাহার বলল, কটা বাজে রে নীতু?
নীতু সঙ্গে সঙ্গে বলল, নটা চল্লিশ। ঘড়ি দেখল না বা দ্বিধা করল না। মনে হচ্ছে কম্পিউটারের মত তার নিজের ভেতর ঘড়ি ফিট করা আছে।
তোদের নাস্তা করা হয়ে গেছে?
আপনি আবারো নাশতা না করে এসেছেন?
হুঁ। লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়েছি বলতে পারিস।
ভাইয়ার ঘরে বসুন। নাশতা পাঠিয়ে দেব।
রোবটের গলায় কথা বলছিস কেন? মানুষের মত কথা বল।
মানুষের মতই কথা বলার চেষ্টা করছি। আপনার কাছে হয়তো বা রোবটের মত শুনাচ্ছে।
আমার উপর কোন কারণে কি রেগে আছিস?
রাগ-অভিমান এইসব উচ্চ শ্রেণীর ব্যাপার। আমার মধ্যে নেই। আমি আসলেই খানিকটা রোবট।
রোবট না, তুই হলি রোবটী–রোবটের স্ত্রীলিঙ্গ রোবটী।
আমার সঙ্গে কথা বলে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। দয়া করে ভাইয়ার ঘরে চলে ।
যব কিভাবে? সিঁড়ির গোড়ায় পাহারাদার।
বাবা ঘুমুচ্ছেন। চুপি চুপি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবেন। বাবা টের পাবেন না।
থ্যাংকস ফর দা টিপ। নাস্তা একটু তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিস নীতু। খিদেয় মারা যাচ্ছি।
নীতু জবাব দিল না। ঝাঝাড়ি দিয়ে টবে টবে পানি দিতে লাগল। তার চোখ-মুখ কঠিন হয়ে আছে। ঐ দিনের ঘটনার পর সে ঠিক করে রেখেছে আতাহারের সঙ্গে আবার দেখা হলে সে খুব খারাপ ব্যবহার করবে। এবং এক ফাঁকে জানিয়ে দেবে প্রেমে পড়ার ব্যাপারে ঐ দিন যে কথা বলেছিল সেটা আসলে অভিনয়। সে আতাহারের প্রেমে পড়েছে এটা শোনার পর আতাহারের মুখের ভাব কেমন হয় এটা দেখাই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য।
সাজ্জাদ হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার গায়ে পাতলা চাদর। চোখ লাল। সাজ্জাদের গায়ে জ্বর। কিছুক্ষণ আগে থার্মেমিটার দিয়ে জ্বর দেখা হয়েছে। একশ তিন। সাজ্জাদের ধারণা, থার্মোমিটারে কোন সমস্যা আছে। এতটা জ্বর তার নিজের কাছে মনে হচ্ছে না। গা খানিকটা ম্যাজ ম্যাজ করছে, চোখ জ্বালা করছে এ পর্যন্তই। একশ তিন জ্বর হলে ঘরে আটকা পড়ে থাকতে হবে। ব্যাপারটা ভয়াবহ।
আতাহারকে দেখে সাজ্জাদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল। আতাহার বলল, জ্বর না-কি?
হুঁ।
মুরগি-বসন্ত না তো? মুরগি-বসন্ত চারদিকে হচ্ছে। গায়ে কি র্যাশ বের হয়েছে?
না তো।
বের হবে। শুরুতে হেভি জ্বর আসে, তারপর র্যাশ ট্যাশ বের হয়ে ছোরা বেড়া। ভাইরাসের বেশ কিছু চেঞ্জ হয়েছে। মুরগি-বসন্তের মুরগি ভাব নেই–এখন রীতিমত শক্তিশালী। ঘোড়ার মতই শক্তিশালী। চিকেন পক্স নাম পাল্টে হর্স পক্স রাখার পাঁয়তারা হচ্ছে।
ভয় দেখাচ্ছিস না-কি?
ভয় দেখাব কেন? যেটা সত্যি সেটা বললাম। তোর জ্বর কি এখন একশ তিন?
হুঁ।
যা ভেবেছি তাই। প্রথম দু-তিনদিন জ্বর তিন-চারে উঠানামা করবে। তোর এখানে বেশিক্ষণ বসাও নিরাপদ না–আমি নাশতা খেয়েই বিদেয় হচ্ছি।
যাবি কোথায়?
গনি ভাইয়ের কাছে একটু যাব। কয়েকটা মিষ্টি কথা উনাকে বলব।
এই সংখ্যায় তোর কবিতা যাওয়ার কথা ছিল?
না, যায়নি। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এন্টাসিড-ফিড কিনে দিয়েছি–ছাগলটা বলেছিল এই সংখ্যায় যাবে।
পত্রিকা অফিসে যাবি?
হুঁ।
পত্রিকা অফিসে যাওয়া ঠিক হবে না। হৈ-চৈ হবে। লোক জানাজানি হবে। সন্ধ্যার পর চল বাসায় গিয়ে ধরি।
তুই যাবি?
অবশ্যই যাব।
জ্বর গায়ে যাবি?
শুয়ে শুয়ে জ্বরকে প্রশ্রয় দেয়ার কোন মানে হয় না। গ্রেট গনিকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।
কিভাবে শিক্ষা দিবি?
সাজ্জাদ চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, বড় এক বালতি গু ওর বারান্দায় ঢেলে রেখে আসব।
আতাহার তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে জ্বর সাজ্জাদের মাথায় উঠে গেছে। আবোল— তাবোল বকছে। সাজ্জাদ অবশ্যি আবোল-তাবোল ব্যকার মানুষ না।
সাজ্জাদ আতাহারের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, বিশ-পঁচিশ সের টাটকা ঘু ফেলতে পারলে আর দেখতে হবে না। জন্মের শিক্ষা হয়ে যাবে।
বিশ-পঁচিশ সের টাটকা গু তুই পাবি কোথায়?
পাওয়া যাবে। ঢাকায় মেথর পট্টি বলে একটা জায়গা আছে। সুইপার, মেথররা পরিবার নিয়ে থাকে। ওদের সাথে আমার ভাল খাতির। আমাকে পীরের মত জানে। ঠিকানা দিয়ে এলে ওরাই ব্যবস্থা করবে। প্রয়োজনবোধে প্রতি পনেরো দিন অন্তর অন্তর গু-চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। যেদিন সুবৰ্ণ বের হবে সেদিনই তিন বালতি গু।
আতাহার সাজ্জাদের গায়ে হাত রাখল। সে যা ভেবেছিল তাই–জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। যা বলছে জ্বরের ঘোরে বলছে। তাকে বরফ-পানিতে চুবিয়ে রাখা দরকার।
সাজ্জাদ বলল, জ্বর কেমন দেখলি? খুব বেশি?
হ্যাঁ।
আমারো তাই ধারণা–মাথার বল বিয়ারিং সব লুজ হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে–মাথা ঘুরছে। সিগারেট ফেলে দে তো–সিগারেটের গন্ধ অসহ্য লাগছে।
আতাহার সিগারেট ফেলে দিল। সাজ্জাদ বলল, তুই নিজেও বিদেয় হ। তোকে দেখতেও অসহ্য লাগছে।
কুমার জন্য নাশত আনতে গেছে। নাশতা খেয়ে তারপর চলে যাব। এখন কিছু খাইনি।
নিচে গিয়ে নাশতা-ফাসত যা খাবার খা। নাশতার গন্ধে আমি বমি করে দেব।
তোর মাথায় মনে হয় পানি ঢালা দরকার।
কিচ্ছু ঢালার দরকার নেই। আমি চাচ্ছি জ্বরটা ভালমত উঠুক। জ্বরতপ্ত মাথায় একটা কবিতা লিখব। ইন্টারেস্টিং এক্সপেরিমেন্ট। নিজে অসুস্থ হলে–চারপাশের জগৎটাকেও অসুস্থ মনে হয়— সেই সময়ের সৃষ্টিও অসুস্থ হবার কথা। অসুস্থ কবিতা কেমন হয় দেখি।
আতাহার চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়াল। সাজ্জাদ চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আত্যুহার বলল, ডাক্তার-টাক্তারের ব্যবস্থা করা দরকার না?
কোন কিছুরই ব্যবস্থা করতে হবে না। ও আচ্ছা, একটা কাজ করতে পারবি?
কি কাজ?
কণাকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে আনবি।
কণাটা কে?
খুবই সাদামাটা ধরনের মেয়ে–তবে অসাধারণ। সাদামাটা বলেই অসাধারণ। মেয়েটাকে আমি মোটেই গুরুত্ব দেইনি। কাল রাতে প্রচণ্ড জ্বর এল, তখনই শুধু মেয়েটার কথা মনে পড়তে লাগল। এখন জ্বর আসছে, এখন আবার তার কথা মনে পড়ছে।
কণা থাকে কোথায়?
থাকে কোথায় জানি না। খুঁজে বের করবি।
খুঁজে বের করব কি ভাবে?
ঋতু নামে একটা পেইনটিং-এর দোকান আছে। তার পাশে একটা বড় ফার্মেসী। কণার স্বামী সেই ফার্মেসীর সেলসম্যান।
ঋতু পেইন্টিং-এর দোকানটা কোথায়?
আমি জানি না কোথায়। খুঁজে বের কর। Use your brain.
খোঁজে বের করব কি ভাবে?
আরে, তুই তো গাধার মত কথা বলছিস। পাঁচ মিনিটে খুঁজে বের করা যায়।
কিভাবে?
যে কোন একটা পেইনটিং-এর দোকানে যাবি। এক দোকান অন্য দোকানের খোঁজ রাখে। ওদের বললেই ঋতু কোথায় বের হয়ে পড়বে।
কণার স্বামীর নাম কি?
কণার স্বামীর নাম জানি না। তার সম্পর্কে শুধু এইটুকু জানি–সে চিড়িয়াখানা পছন্দ করে না।
তোর নাম বললে চিনবে?
না–আমাকে চিনবে না। আমাকে চেনার দরকারও নেই–কনার চিড়িয়াখানা দেখার শখ। ওকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে আনবি। বিকলপ ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়ে যাবি।
আমার কাছে একটা টাকা আছে।
তুই তো দেখি ফকিরেরও অধম হয়ে গেছিস। নীতুর কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে যা। হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? আলজিব দেখা যাচ্ছে। মোটেই ইন্টারেস্টিং দৃশ্য না। মুখ বন্ধ করে চলে যা–গোট লস্ট।
আতাহার চিন্তিত মুখে নিচে নামল। সাজ্জাদকে নিয়ে চিন্তা, তারচেয়েও বেশি চিন্তা সিঁড়ির গোড়ায় হোসেন সাহেব বসে আছেন। ঘুমুচ্ছিলেন, এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুম ভেঙেছে। তবে আজ দিনটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। বুড়ো মানুষ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা দিনে একবার ঘুমিয়ে পড়লে সহজে জাগার কথা না। বিড়ালের মত নিঃশব্দে নেমে যেতে হবে। প্রয়োজনে হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হবে।
কে, আতাহার না?
জ্বি চাচা,
এ রকম পা টিপে টিপে নামছ কেন?
আপনি ঘুমুচ্ছিলেন–পায়ের শব্দে আবার ঘুম ভেঙে যায় কি-না।
ঘুমুচ্ছিলাম না। ঝিম ধরে পড়েছিলাম। কাল সারারাত বলতে গেলে অঘুমা কেটেছে।
কেন?
সাজ্জাদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে রাত এগারোটা বেজে গেল। সে ঘরে ফিরেছে। এগারোটা দশে। জ্বর নিয়ে ফিরেছে। এমন জ্বর যে শরীরে ধান রাখলে–ধান ফেটে খই বের হবে। বাথটাবে পানি দিয়ে–বরফ দিয়ে জ্বর কমাতে কমাতে তিনটা বেজে গেলো। কাল রাতে খুবই চিন্তায় পড়েছিলাম। গ্লোবাল এটমসফিয়ার চেঞ্জ হচ্ছে। নানান ধরনের নতুন নতুন ভাইরাসের জন্ম হচ্ছে। নিউ ভাইরাস, নিউ ডিজিজ। পত্রিকায় পড়েছ ফ্লেশ ইটিং ভাইরাসের কথা?
জ্বি না।
ভয়াবহ ধরনের ভাইরাস। সরাসরি মাংস খেয়ে ফেলে। ভবিষ্যতে আরো কত কি হবে! দাঁড়িয়ে আছ কেন বাবা–বোস।
আতাহার মাথা চুলকে বলল, একটা খুব জরুরি কাজ আছে চাচা।
জরুরি কাজ তো থাকবেই। পৃথিবীর সব কাজই জরুরি–কার্লাইলের একটা কথা আছে– Most trivial job–is the most important job.
আতাহার বসবে কি বসবে না, মন স্থির করতে পারছে না। তাকে আরো কিছুক্ষণ এ বাড়িতে থাকতে হবে। নাশতা না খেয়ে সে বেরুতে পারবে না। খিদের চোটে এখন মাথা ঘোরা শুরু হয়েছে। নাশতা না খেয়ে সে বেরুতে পারবে না। খিদের চোটে এখন মাথা ঘোরা শুরু হয়েছে। নাশতা তৈরি হলে নীতু তাকে আলাদা ঘরে নিশ্চয়ই ডেকে নিয়ে যাবে। তখন মুক্তি পাওয়া যাবে। আশা করা যায়, নাশতা ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। দুটা পরোটা ভজতে তিন ঘণ্টা লাগার কথা না।
আতাহার
জ্বি চাচা।
আউট অব দ্য ট্ৰেক তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি–কিছু মনে করো না। কণা মেয়েটি কে?
কার কথা বললেন?
কণা। কাল রাতে জ্বরের ঘোরে সাজাদ কণা কণা বলে চেঁচাচ্ছিল। তার পছন্দের কেউ থাকলে তুমি আমাকে বলতে পার। ফ্যামিলি ব্র্যাকগ্রাউন্ড যদি ভাল হয়—আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নেই। এইসব ব্যাপারে আমি খুবই লিবারেল। যুগ পাল্টাচ্ছে— যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও পাল্টাতে হবে। আমাদের সময় আর এখনকার সময় তো এক না। তোমার চাচীকে যখন বিয়ে করি তখন তার বয়স ছিল ওনলি থারটিন। বিয়ের আগে আমি তাকে চোখেও দেখিনি। আমার এক মামা-শ্বশুর মুনশি সদরুদ্দিন পাশা–খুলনার নাম করা উকিল, সুফি মানুষ। তিনি আমাকে বললেন, হোসেন, সারা জীবনের জন্যে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যােচ্ছ–একবার চোখের দেখাও দেখবে না? মেয়ে ফর্সা না কালো, কানা না খোড়া, জানার দরকার না? আমাদের ধর্মে বিবাহের আগে কন্যা দেখার বিধান আছে। আমি বললাম, মামা, আপনারা তো দেখেছেন। আমার দেখার কোন দরকার নেই। বিয়ে হয়ে গেল। তোমার চাচীকে প্রথম দেখলাম বাসর রাতে। সে এক অভিজ্ঞতা। চল্লিশ বছর আগের কথা, এখনো মনে হয় এই তো সেদিন …
আতাহার নীতুর জন্যে অপেক্ষা করছে। এত দেরি করছে কেন মেয়েটা? কতক্ষণ লাগে দুটা পরোটা বানাতে?
আতাহার!
জ্বি চাচা।
বাসর রাতের ঘটনাটা শোন। খুবই ইন্টারেস্টিং–বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দই শ্ৰবণ। ইংরেজ্বি ১৯৪০ সন–বৃটিশ পিরিয়ড। বিয়ের আসরে খুলনার কালেক্টর মিস্টার কেলভিন সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। কেলভিন সাহেবের স্ত্রীর নাম–এলেনা, অনিন্দ্য সুন্দরী। অল্প অল্প বাংলা জানেন। অতি মিশুক স্বভাব …
পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিৰ্ঘাৎ নীতু। আতাহার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এক্ষুণি মুক্তি পাওয়া যাবে। এখন ডাবল আগ্রহের সঙ্গে বৃদ্ধ ছাগলের বিয়ের গল্প শোনা যেতে পারে। যদিও বন্ধুর বাবাকে বৃদ্ধ ছাগল বলা ঠিক হচ্ছে না। মানুষটা খারাপ না। তার গল্পগুলি খারাপ। দুনিয়ার ডালপালা নিয়ে গল্প শুরু করে। গল্প বলা শিখানোর কোন স্কুল থাকলে এই ছাগলাকে সে নিজ খরচে ভর্তি করিয়ে দিত।
আতাহার ভাই, আপনার নাশতা দেয়া হয়েছে। আসুন।
হোসেন সাহেব ব্যস্ত হয়ে উঠলেন–যাও যাও, নাশতা খেয়ে আসা। তারপর জমিয়ে আডডা দেব। হাটের উপর একটা ধাক্কা চলে যাবার পর ঘরেই বসে থাকি। আমার বাসররাতের গল্প একটা অসাধারণ গল্প। তুমি ছেলের বয়েসী, তোমাকে বলা ঠিক হচ্ছে না। তবু শুনে রাখা–সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে … কি যেন শ্লোক–দ্বাদষ বর্ষেন্তু পুত্র … মনে পড়ছে না। স্মৃতি বিভ্রাট হচ্ছে। নীতু মা, আমাকে চিনি—দুধ ছাড়া এক কাপ চা।
আতাহার খুব আশা করেছিল নাশতায় পরোটা-গোশত থাকবে। তার আশা ভঙ্গ হল। রুটি, মাখন, কলা, একটা সিদ্ধ ডিম। ছোট্টগ্রাসে হলুদ রঙের কি যেন দেখা যাচ্ছে–মনে হচ্ছে কমলার রস–ইংলিশ ব্রেকফার্স্ট।
মিস রোবটী মুখ কালো করে নাশতার টেবিলে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ অন্যদিনের চেয়েও গভীর। আতাহার বলল, নীতু, সাজ্জাদের শরীর-টরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। ওকে বরফের মধ্যে চুবাতে হবে।
নীতু জবাব দিল না। মনে হচ্ছে এই সংবাদ সে জানে।
আর শোন, আমাকে এক হাজার টাকা দিতে হবে। ভাবিস না যে আমার নিজের জন্যে দরকার। আর যাই করি, বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করি না! সাজ্জাদের জন্যেই টাকা দরকার। আমার কথা বিশ্বাস না হলে সাজ্জাদের কাছ থেকে ভেরিফাই করতে পারিস।
নীতু বলল, আপনাকে এত কথা বলতে হবে না। নাশতা খান–আমি টাকা এনে দিচ্ছি।
টাকাটা কি জন্যে দরকার শুনতে চাস না?
আপনার বলার ইচ্ছা হলে বলতে পারেন। আমি আগ বাড়িয়ে শুনতে চাই না।
কণা নামের একটা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানার বাঁদর দেখিয়ে আনতে হবে।
কণাটা কে?
জানি না কে। চাঁদের কণা হবে।
আপনি সত্যি জানেন না কে?
না।
জ্বরের ঘোরে কাল রাতে ভাইয়া কণা কণা বলে চেঁচাচ্ছিল। আমার ধারণা, খুব খারাপ ধরনের কোন মেয়ে–ভয়ংকর খারাপ। ভাইয়া আজেবাজে জায়গায় যায়। আপনিও হয়ত যান। ঐ মেয়ে সেই সব জায়গার।
হতে পারে–কবি চণ্ডিদাস বলেছেন–
যেথা যার মজে মন
কিবা হাড়ি কিবা ডোম।।
নীতু ভুরু-টুরু কুঁচকে বলল, এই জাতীয় একটা মেয়ের সঙ্গে ভাইয়ার পরিচয়ে আপনি মনে হয় খুব খুশি।
আমার খুশি-অখুশি কোন ব্যাপার না। সাজ্জাদ খুশি হলেই আমি খুশি। তাছাড়া তুই যা ভাবছিস তা না, কণা মেয়েটা খুবই ভদ্র একটা মেয়ে। কারোর বিবাহিতা লক্ষ্মী টাইপ স্ত্রী। যার সংসার আছে–পুত্রকন্যা আছে।
আতাহার ভাই, প্লীজ, আপনার বকবকানি শুনতে আর ইচ্ছা করছে না। বাবার সঙ্গে থেকে থেকে আপনারও বিশ্ৰী কথা বলা রোগ হয়েছে।
আতাহার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, টাকাটা নিয়ে আয়— আমি ব্যাক ডোর দিয়ে খালাস হয়ে যাই।
এখন কি আপনি কণার কাছে যাবেন?
না, এখন আমি যাব দি গ্রেট গনি ভাইয়ের কাছে। ব্লাফার অব দি সেঞ্চরী। সুবৰ্ণ পত্রিকার মালিক। কবিতা ছাপবে বলে কথা দিয়ে ছাপেনি।
ভাল হয়নি বলে ছাপেনি।
কি বলিস, ভাল হয়নি! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। শুনিবি? আমার মুখস্থ আছে।
মাফ করুন–কবিতা শুনব না। টাকা এনে দিচ্ছি–বিদেয় হোন।
নীতু খামে ভরে তিনটা পঁচিশ টাকার নোট নিয়ে এল। একটা বাড়তি নোট কেন আনল সে জানে না। সে কি আতাহার ভাইকে উপহার দিচ্ছে? গোপন উপহার? আতাহার ভাই খাম খুলে তিনটা নোট দেখে ভাববেন–ভুলে চলে এসেছে। তারপর নীতুর সেই ভুলের জন্যে তিনি আনন্দিত হবেন। নীতু জানে, তার টাকার খুব দরকার। বেচারার দুটা পাঞ্জাবি, একটা শার্ট। গত এক বছরে সে এই তিনটা কাপড়ই আতাহার ভাইকে ঘুরে-ফিরে পরতে দেখছে। তার মধ্যে একটা পাঞ্জাবির অবস্থা ভাল না। রং-টং জ্বলে বিশ্ৰী হয়ে আছে। তার বোধহয় সেটাই পছন্দ। আজিও সেটাই পরে আছেন। গত ঈদের পর নীতুর ধারণা হয়েছিল, আতাহার ভাই নিশ্চয়ই নতুন কোন শার্ট বা পাঞ্জাবি পরে আসবেন। রোজার ঈদে সবাই নতুন কাপড় পরে। কিন্তু আতাহার ভাই ঈদের দেখা করতে এলেন সেই কুৎসিত পাঞ্জাবিটা পরে। নীতু সেদিন যে শাড়িটা পরেছিল তার দাম নহাজার টাকা। শাড়িটা খুবই সুন্দর–হালকা সবুজের উপর সোনালী কাজ। সবুজ এবং সোনালী রঙ এক সঙ্গে যায় না। কিন্তু শাড়িটাতে সোনালী কাজ সুন্দর ফুটেছিল।
শাড়ি যত সুন্দরই হোক নীতুর গায়ে মানায়নি। কোন ভাল কাপড়ই তার গায়ে মানায় না। আয়নায় নিজেকে দেখেই সে বুঝেছে তাকে দেখাচ্ছে গেছো পেত্নীর মত। লম্বা কোন বঁশিগাছের মাথায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকলেই তাকে মানাবে। অন্য কোথাও মানাবে না। ঈদের শাড়ি খুলে ফেলা যায় না বলে সে খেলেনি। আতাহার ভাইয়ের সামনে এই শাড়ি পরে বের হবার সময় সে লাজায় প্রায় মরে যাচ্ছিল। আতাহার ভাই তাকে দেখে বিদ্রুপ মাখা কঠিন কোন কথা অবশ্যই বলবেন। হো হো করে হাসতে হাসতে বলবেন, এই শাড়ি পরে তোকে তো পেত্নীদের রানীর মত লাগছে রে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আতাহার ভাই সেদিন তাকে দেখে মুগ্ধ গলায় বলেছিলেন–তোকে তো সম্রাস্ত্রীর মত লাগছে রে নীতু। প্রথমে নীতু ভেবেছিল ঠাট্টা। যখন টের পেল ঠাট্টা না, তখন আনন্দে তার চোখে পানি এসে যাবার মত হওয়ায় সে দ্রুত সরে গেলো।
ঈদের দিনের সেই শাড়ি সে আর পরেনি। যত্ন করে তুলে রেখেছে। শুধু শাড়িটা না, সেদিন সে যা যা পরেছিল সবই তুলে রেখেছে। চুল বেঁধেছিল সাদা ফিতায়–সেই ফিতা, স্ট্রাইপ দেয়া জুতা সব তোলা আছে। কোন এক বিশেষ উপলক্ষে সে আবার পারবে। কে জানে হয়ত আতাহার ভাইয়ের বিয়ের দিনই পরবে।
নীতু গম্ভীর মুখে আতাহারকে খাম এনে দিল। তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল যখন সে দেখল আতাহার ভাই খাম পকেটে না ঢুকিয়ে টাকা বের করে গুনতে বসেছে।
আতাহার বিরক্ত গলায় বলল, নীতু, তোর টাকা বেশি হয়ে গেছে। পঁচিশ টাকা বেশি দিয়ে দিয়েছিস।
দিয়েছি যখন রেখে দিন।
রেখে দেব মানে! ধর, নে।
নীতু নোটটা হাতে নিল। আতাহার বলল, এখন দয়া করে পেছনের দরজা দিয়ে আমাকে বের করে দে। চাচার সামনে পড়তে চাচ্ছি না।
নীতু বলল, আরেক কাপ চা খেয়ে যাবেন?
না। দি গ্রেট গনিকে ধরতে হবে। দেরি করলে অফিসে পাব না।
গনি সাহেবের অফিসটা কোথায়?
সেগুনবাগিচায়।
আমি ঐ দিকেই যাব। বড় ফুপুর বাসায়। চলুন আপনাকে নামিয়ে দি।
বাসায় রোগী ফেলে তুই ফুপুর বাসায় যাবি কি জন্যে? ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মত সেবা কর।
ভাইয়া কারো সেবা নেবে না। এখন জ্বর মাথায় নিয়ে দরজা বন্ধ করে কবিতা লিখছে। কাজেই আমার থাকা না থাকা সমান।
গাড়িতে উঠেই নীতু বলল, ঐ দিন আপনার মুখের ভঙ্গি দেখে খুব মজা পেয়েছি আতাহার ভাই।
কোন দিন?
ঐ যে, যেদিন আপনি জিজ্ঞেস করলেন–তুই কি আমার প্রেমে পড়েছিস? আর আমি বললাম—হুঁ।
এইসব কথাবার্তা ড্রাইভারের সামনে বলাটা কি ঠিক হচ্ছে?
নীতু কাঁধ বঁকিয়ে বলল, কোন অসুবিধা নেই। শুনুন আতাহার ভাই, ঐ দিন প্রথম আমি টের পেলাম যে, আসলে আমি খুব বড় মাপের অভিনেত্রী।
প্রতিটি মেয়েই খুব বড় মাপের অভিনেত্রী। জন্মসূত্রেই তারা অড্রে হেপবর্ণ।
আমার অভিনয়-ক্ষমতা তাদের চেয়েও ভাল। কারণ ঐ দিন। আপনার সঙ্গে আমি চমৎকার অভিনয় করলাম–চোখে পানি পর্যন্ত নিয়ে এলাম। আপনি বুঝতেও পারলেন না। ভাবলেন সত্যি। চোখ-মুখ কি রকম হয়ে গেল। হিহিহি।
অভিনয় ছিল না-কি?
অভিনয় তো বটেই। আমি শুধু শুধু আপনার প্রেমে পড়তে যাব কেন?
প্রেমে তো মেয়েরা শুধু শুধুই পড়ে।
আমি পড়ি না। যাই হোক, ঐ দিন আপনার সঙ্গে অভিনয় করাটা ঠিক হয়নি। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
আচ্ছা বেশ, ক্ষমা করলাম।
আপনার কি মন খারাপ লাগছে আতাহার ভাই?
মন খারাপ লাগবে কেন?
নীতু তার ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল, একটা ছেলে যখন শুনে কোন মেয়ে তার প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছে তখন সেই ছেলে প্রচণ্ড মানসিক তৃপ্তি লাভ করে। মেয়েটা কালো কুচ্ছিত হলেও কিছু যায় আসে না। মেয়েটা দেখতে কেমন সেটা তখন ছেলেটার মনে থাকে না–তার মনে থাকে শুধু প্রেমের ব্যাপারটা। প্রেমের তো কোন বর্ণ নেই। কালো মেয়ের প্রেম যেমন, রূপবতী মেয়ের প্রেমও একই রকম …
তুই তো দেখি প্রেমবিশারদ হয়ে গেছিস রে নীতু। বকবকানি বন্ধ কর।
নীতু চুপ করে গেল এবং একটু হকচকিয়ে গেল। আতাহার বলল, তোর অভিনয় ভাল হয়েছে। আমি বুঝতেই পারিনি অভিনয়। বাসায় ফিরে সেই রাতে তোকে স্বপ্নও দেখে ফেললাম।
কি স্বপ্ন দেখলেন?
তুই কি পাগল হয়েছিস? কি স্বপ্ন দেখলাম–আমি তোকে বলব না-কি? পরে তুই এই নিয়ে হাসাহাসি করবি।
আতাহার ভাই, আমি কোনদিন হাসাহাসি করব না।
অবশ্যই হাসাহাসি করবি। প্রেমের অভিনয় দেখিয়ে তুই আমার আক্কেল গুড়ুম করে দিয়েছিস। তোর কাছে স্বপ্ন বলে ধরা খাব না-কি? আমাকে এই রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দে।
ওখানে গেলে ট্রফিক জ্যামে আটকা পড়বি। আমাকে নামিয়ে দে। নীতু ড্রাইভারকে গড়ি থামাতে বলল। সে মূর্তির মত বসে আছে। তার ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কীদে। কেন সে বলল–অভিনয়। এটা বলে তার লাভটা কি হল?
আতাহার নেমে গেছে। নীতু তাকিয়ে আছে। কিছুতেই সে তার চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। সেও কি গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়বে? ছুটে গিয়ে আতাহার ভাইকে বলবে–আতাহার ভাই, গাড়িতে যা করেছি। সেটা অভিনয়। আমি আর কোনদিন আপনার সঙ্গে অভিনয় করব না। কোনদিন না।