০৬. পলাতক

০৬. পলাতক

বাসা থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে অনেক কষ্টে একটু একটু করে টাকাগুলো জমিয়েছিলাম, আমার তোষকের তলায় সেগুলো পেয়ে আম্মু নিয়ে গেছেন। আম্মু ধরে নিয়েছেন সেগুলো আমি চুরি করে এনেছি আর সেদিন রাত্রে ভাইয়ার রুমেও গিয়েছিলাম চুরি করতে। আম্মুর সন্দেহ পুরোপুরি মিথ্যা না আর সেটা চিন্তা করে আমি নিজের ভিতরে নিজে কেমন যেন ছোট হয়ে গেছি। আমার মনটা আসলে ভেঙ্গে গেছে, সত্যি সত্যি আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে। আমি আসলে খারাপ ছেলে, আমি চোর। শুধু যে নিজেকে চোর মনে হয় তা না আমি কেমন যেন ভীতু হয়ে গেছি। আম্মুর হাতে সেদিন ওরকম মার খেয়ে আমার ভিতরে কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে। যতক্ষণ বাসায় থাকি স্টোররুমে গুটিশুটি মেরে বসে থাকি, বাসার ভিতরে কোথাও আম্মুর গলার স্বর শুনলেই কেমন জানি চমকে উঠি। বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে যায়।

বাসা থেকে বের হলে আমি খানিকটা সাহস পাই। স্কুলে এলে খুব খারাপ লাগে না। প্রিয়াংকা মেয়েটা অনেকটা ম্যাজিকের মতো আমার মতো খারাপ ছেলের সাথেই সে কথাবার্তা বলে তাহলে অন্যদের সাথে তার কেমন বন্ধুত্ব হয়েছে সেটা আন্দাজ করা যায়। প্রিয়াংকার দেখাদেখি অনেক মেয়েই এখন সাহস করে ক্লাসের যেখানে ইচ্ছে সেখানে বসে যায়। মেয়েদেরকে সামনে বসতেই হবে সেই নিয়মটা আর নেই। রাজাকার স্যারের সেইটা নিয়ে মেজাজ খারাপ, কিন্তু কিছু বলতে পারেন না। আমাকে টি.সি. দিয়ে বিদায় করতে পারেন নাই সে জন্যে স্যার ভিতরে ভিতরে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেলেও কিছু করতে পরছেন না। স্যার বুঝে গেছেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাদের পক্ষে।

 

প্রিয়াংকা মেয়েটা বেশ মজার, তার মাথার মাঝে একটা পাগলামোর ভাব আছে। সেদিন ক্লাসে এসে দেখি সে সবাইকে নিয়ে কী একটা ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্রটা খুব মজার। আজকে নাকী শিউলির জন্মদিন, তাই যখন শিউলী ক্লাসে আসবে তখন হঠাৎ করে সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠবে, হ্যাপি বার্থডে! শুধু তাই না প্রিয়াংকা আর কয়েকজন মিলে মনে হয় শিউলির জন্যে গিফটও নিয়ে এসেছে। প্রিয়াংকা নিজে গিয়ে বাইরে দাড়িয়ে রইল, যখন দেখলো শিউলি আসছে তখন সে ভিতরে ছুটে এসে সবাইকে সাবধান করে দিলো। ক্লাসের সবাই যে যেখানে ছিল সেখানে দাড়িয়েই খুব স্বাভাবিক ভান করতে লাগলো। শিউলি কিছু জানে না, সে এসে তার ব্যাগ রেখে তার নিজের জায়গায় বসেছে। তখন কথা নাই বার্তা নেই হঠাৎ করে পুরো ক্লাসের সবাই মিলে বিকট সুরে চিৎকার করে উঠল, হ্যা-পি-বার্থ-ডে-শি-উ-লি!

শিউলি এমন ভাবে চমকে উঠল যে সেটা বলার মতো না! সবগুলি মেয়ে তখন নিজেরা হাত ধরাধরি করে শিউলিকে ঘিরে নাচতে লাগলো আর হ্যাপি বার্থডে গান গাইতে লাগলো! শিউলি চোখ বড় বড় করে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে, লজ্জায় মনে হয় সে মরে যাচ্ছে, তার মুখের রঙ লাল নীল বেগুনি হতে থাকে! সবকিছু মিলে পুরো ব্যাপারটা ন্যাকামির চূড়ান্ত, কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না দেখে আমার ভালই লাগলো। শিউলি ক্লাসের সবচেয়ে লাজুক আর চুপচাপ মেয়ে, তার মনে হয় অনেকটা আমার মতো অবস্থা, বন্ধু বান্ধব বেশি নাই। তাকে নিয়ে এত হৈচৈ সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না।

গান গাওয়া শেষ হলে প্রিয়াংকা তার ব্যাগ খুলে শিউলির জন্যে একটা গিফটের প্যাকেট বের করলো। তার দেখা দেখি অন্যেরাও। কোনটাতে বই, কোনটাতে মাথার ক্লিপ, কোনটাতে কলম। কয়েকটা ছেলেও দেখি গিফট এনেছে, ছেলেরা মনে হয় গিফট কেনার ব্যাপারে বেশি সুবিধের না, চানাচুর না হয় চিপসের প্যাকেট কিনে এনেছে! শিউলি খুলে বের করা মাত্রই নিজেরাই কেড়ে নিয়ে খুলে সবাই মিলে খাওয়া শুরু করে দিল। আমি এসব হৈচৈ আনন্দ থেকে দূরে থাকি, আজকেও দূরে থেকে দেখলাম। দেখে ভালই লাগলো, মনে হলো সবাই মিলে খুব মজা করছে। প্রিয়াংকা মেয়েটা আসার আগে ছেলেরা আর মেয়েরা মিলে এক সাথে হৈচৈ করছে ব্যাপারটা চিন্তাই করা যেতো না।

বিকাল বেলা স্কুল থেকে বের হয়ে আসি হাঁটছি তখন হঠাৎ কোথা থেকে জানি প্রিয়াংকা ছুটে এসে আমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তোর বাসা কী এদিকে?

আমি হ্যাঁ না কিছু না বলে অস্পষ্ট একটা শব্দ করলাম। আমার বাসা কোথায় আমি সেটা কাউকে বলতে চাই না। স্কুল ছুটির পর আমি কোন দিনও বাসায় যাই না। রাস্তায় বের হয়ে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করে যখন অন্ধকার হয়ে যায় তখন চোরের মতো বাসায় ফিরে যাই। প্রিয়াংকা কী বুঝলো কে জানে নিজের মনে বকবক করতে লাগলো। আমি কোন কথা না বলে তার কথা শুনতে লাগলাম। মেয়েটা নিঃসন্দেহে একটা মজার মেয়ে, এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারে যে শুনতে খুব মজা লাগে।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি বললাম, কী হয়েছে?

প্রিয়াংকা ফিসফিস করে বলল, ঐ দেখ।

আমি প্রিয়াংকার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে এমন কিছু অস্বাভাবিক জিনিস। দেখতে পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখব?

প্রিয়াংকা চাপা স্বরে বলল, বাচ্চা মেয়েটাকে দেখছিস না?

আমি তখন ধুলায় ধূসর চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেলাম। রাস্তার ধুলোয় পা ছড়িয়ে বসে আপন মনে খেলছে। রুক্ষ লাল জটা বাধা চুল, ময়লা একটা ফ্রক পরে আছে। প্রিয়াংকা আবার গলা নামিয়ে বলল, এই মেয়েটাকে খুঁজছি কয়দিন থেকে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? এই মেয়ে কী করেছে?

কিছু করে নাই। মেয়েটার খুব শখ একটা লাল জামার।

তুমি কেমন করে জানো?

সেইদিন তার মায়ের সাথে বসেছিল তখন দেখেছে একটা ছোট মেয়ে লাল জামা পরে তার আম্মু-আব্বুর সাথে যাচ্ছে। তখন সে তার মাকে বলেছে, মা আমারে একটা লাল জামা কিনে দিবা? তার মা তখন কী করেছে জানিস?

কী করেছে?

ঠাস করে গালে একটা চড়। চড় দিয়ে বলে পেটের ক্ষিদায় জান বাঁচে না, লাল জামার শখ! মেয়ের শখ দেখো!

আমি বললাম, ও।

প্রিয়াংকা বলল, এত শক্ত একটা চড় খেয়েও কিন্তু মেয়েটা চোখের পানি ফেলে নাই। মায়ের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল।

আমি আবার বললাম, ও!

প্রিয়াংকা তার ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে বলল, এই মেয়েটার জন্যে একটা লাল জামা কিনেছি। কয়দিন থেকে মেয়েটাকে খুঁজছি, আজকে পেয়ে গেলাম!

আমি অবাক হয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রিয়াংকা মুখ টিপে হেসে বলল, প্যাকেটটা খুলে মেয়েটা যখন দেখবে ভিতরে একটা লাল জামা কী খুশি হবে চিন্তা করতে পারিস?

মেয়েটা লাল জামাটা পেয়ে কতটুকু খুশি হবে জানি না, কিন্তু লাল জামার প্যাকেটটা দেয়ার জন্যে এই ছোট নোংরা বাচ্চাটাকে দেখে প্রিয়াংকা যে অসম্ভব। খুশি হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রিয়াংকা প্যাকেটটা হাতে। নিয়ে বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে ডাকলো, এই যে, শুনো।

বাচ্চা মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো, মনে হলো একটু ভয়ে ভয়ে।

প্রিয়াংকা বলল, এই যে নাও। এইটা তোমার জন্যে।

মেয়েটা একটু ভয়ে ভয়ে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে হঠাৎ বুকে চেপে ধরল, দেখে মনে হলো সে ভয় পাচ্ছে যে কেউ বুঝি তার কাছ থেকে এটা কেড়ে নেবে। প্রিয়াংকা তাকে অভয় দেবার জন্যে একটু হাসলো কিন্তু বাচ্চা মেয়েটা তারপরেও খুব অভয় পেলো বলে মনে হলো না। প্যাকেটটা বুকে চেপে ধরে রেখে বড় বড় চোখে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রিয়াংকা তখন সোজা হয়ে দাড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে বলল, আয়। যাই।

আমি নিচু গলায় বললাম, প্যাকেটটা খুলে কী করে দেখবে না?

নাহ।

কেন?

আমি সেটা কল্পনা করে দেখে নেব। কল্পনা করে দেখতে আরো বেশি মজা!

আমি প্রিয়াংকার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, তুমি মাঝে মাঝেই এরকম করো?

প্রিয়াংকা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমি এটাকে বলি বিক্ষিপ্ত ভাবে আনন্দ বিতরণ। চিনি না জানি না সেরকম মানুষকে হঠাৎ করে কোনভাবে খুশি করে দেওয়া।

ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অসাধারণ, আমার সুন্দর করে কিছু বলা উচিত ছিল, কিন্তু আমি বললাম, ও।

প্রিয়াংকা বলল, তুই একটা জিনিস জানিস?

কী?

নিজেকে খুশি করা থেকে অন্যকে খুশি করার মাঝে অনেক বেশি আনন্দ!

আমি বললাম, ও!

প্রিয়াংকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোর সাথে কথা বলে কোন মজা নেই। তুই শুধু একটা শব্দ জানিস–সেটা হচ্ছে ও!

আমি বোকার মতো আবার বলে ফেললাম, ও!

আর সেটা শুনে প্রিয়াংকা হি হি করে হাসতে শুরু করল।

 

রাত্রিবেলা হঠাৎ খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটলো, আমাকে আম্মু ডেকে পাঠালেন। আমার বুকটা আতংকে ধ্বক করে উঠল, একবার মনে হলো দরজা খুলে পালিয়ে যাই। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে স্টোররুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে এলাম। আম্মু ভাইয়া আর আপুকে নিয়ে খাচ্ছেন, টেবিলে দুলি খালা খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। ইলিশ মাছের বড় বড় পেটি লাল করে ভাজা হয়েছে। একসময় আমার খুব প্রিয় খাবার ছিল ইলিশ মাছ, শেষবার কবে ইলিশ মাছ খেয়েছি মনে করতে পারলাম না। ভাতগুলো কী সুন্দর, চিকন এবং ধবধবে সাদা। ডাইনিং টেবিলে প্লেট-গ্লাসগুলো সুন্দর করে সাজানো, পাশে ন্যাপকিন ভাজ করে রাখা।

আম্মু প্লেটে ভাত নিতে নিতে চোখের কোণা দিয়ে আমাকে দেখে মুখ কুঁচকালেন, বললেন, ছিঃ, তোর গায়ে দেখি বোটকা গন্ধ।

আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। আপু আর ভাইয়া কী সুন্দর কাপড় পরে খেতে বসেছে, আর আমি ময়লা খাটো একটা পায়জামার ওপরে একটা ময়লা শার্ট পরে আছি। শরীরে গন্ধ থাকতেই পারে। আম্মু বললেন, তোর পড়াশোনার কী খবর?।

আমি কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার পড়াশোনার অবস্থা একেবারেই ভাল না, অঙ্ক ছাড়া আর কিছু পড়তে ইচ্ছে করে না। সেই অঙ্কেও পরীক্ষায় কোন নম্বর পাই না। স্যাররা যে নিয়মে করতে বলেন সেই নিয়মে না করলে নম্বর দেন না আর যদিও তাদের নিয়মে করি স্যাররা মনে করেন আমি নকল করেছি। প্রথম যখন আম্মু আমাকে ঘেন্না করতে শুরু করেছিলেন তখন আমার পুরো জগৎটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, এখন বেশ অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। মেনেই নিয়েছি যে এটাই হবে। তবে পড়াশোনা করাটা অন্য একটা ব্যাপার কারো মন ভেঙ্গে গেলে পড়াশোনা করতে পারে না। আম্মু স্কুলের বেতনই দিতে চান না, অনেক কষ্ট করে ভাইয়াআপুকে বলে সেটা জোগাড় করতে হয়। স্কুলের বইও আমার নেই, কিছু পুরানো বইয়ের দোকান থেকে কিনেছি, কিছু ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়ের কাছে থেকে চুরি করেছি। বইপত্র খাতা কলম না থাকলে মানুষ কেমন করে পড়ে? কাজেই আমি আম্মুর প্রশ্নের কোন উত্তর দিলাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

আম্মু ইলিশ মাছের পেটিগুলো ভাইয়া আর আপুর প্লেটে তুলে দিতে দিতে বললেন, কী হলো? কথার উত্তর দিস না কেন?

আমি এবারেও কিছু বললাম না, মাথাটা আরো নিচু করে ফেললাম।

আম্মু বললেন, পড়াশোনা করবি না কিছু না, চুরি-চামারি করে বেড়াবি আর আমি তোর পিছনে টাকা ঢালব সেটা হবে না। বুঝেছিস?

আমি মাথা নাড়লাম। আম্মু বললেন, শুনে রাখ, তুই যদি পাস করতে না পারিস তোর পড়াশোনা বন্ধ।

আমি আবার মাথা নাড়লাম, সত্যি কথা বলতে কী মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পড়াশোনা যে আমার জন্যে নয় সেটা বেশ কিছুদিন হলো আমি বুঝে গেছি, শুধু সেটার জন্যে কষ্ট করার কোন মানে হয় না। যখন আব্বু বেঁচেছিলেন, যখন সবাই আমাকে আদর করতো তখন আমার কতো রকম স্বপ্ন ছিল। এখন আমার কোন স্বপ্ন নেই, সবচেয়ে বড় কথা সেটা নিয়ে কোন দুঃখও নেই।

আম্মু বললেন, যা সামনে থেকে।

আমি সুড়ুৎ করে আমার স্টোররুমে চলে এলাম।

রাত ঠিক দশটার সময় আমার অতিথি চলে এলো, আমি আজকাল নেংটি ইঁদুরটার জন্যে অপেক্ষা করে থাকি। ছোট ছোট লাফ দিয়ে বেশ নির্ভয়ে সে আমার হাতে উঠে কুটুর কুটুর করে তার রুটিটা খেতে শুরু করলো। আমি ফিসফিস করে বললাম, কী খবর মিচকি মিয়া?

নেংটি ইঁদুর আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। আমি বললাম, মিচকি মিয়া। আজকে আমার জন্যে গুড নিউজ। আমার আর পড়াশোনা করতে হবে না! কী মজা, তাই না?

মিচকি মাথা নাড়লো, পড়াশোনা না করা যে অনেক আনন্দ সেটা সেও স্বীকার করে নিল। আমি বললাম, তার মানে বুঝেছিস? আমার বাসা থেকে পালানোর সময়টা এসে গেছে। একা একা থাকতে তোর মন খারাপ হবে। নাকী?

মিচকি আবার মাথা নাড়লো, আমি ধরে নিলাম তার মানে হচ্ছে হ্যাঁ। আমি বললাম, মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মিচকি রুটির প্রথম টুকরোটা শেষ করে দ্বিতীয় টুকরোর জন্যে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। আমি পকেট থেকে ছোট আরেকটা টুকরো বের করে তাকে ধরিয়ে দিলাম, সে সাথে সাথে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা খেতে শুরু করলো। এইটুকু একটা প্রাণী কিন্তু তার পেটের সাইজটা মনে হয় খারাপ না!

আমি বললাম, তুই ইচ্ছে করলে আমার সাথে যেতে পারিস। আমার পকেটে থাকবি। ঘুমাবি। ঘুরে বেড়াবি আমার সাথে। যাবি?

মিচকি তার খাওয়া নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিল যে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশি আগ্রহ দেখালো না।

 

আমি পরের দিন সকাল এগারোটার সময় বাসা থেকে পালিয়ে গেলাম। সেদিনই যে বাসা থেকে পালাব সেটা আমি আগে থেকে ঠিক করি নাই। দিনটি ছুটির দিন, স্কুল কলেজ অফিস সবকিছু বন্ধ কাজেই সবাই বাসায়। ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি শুনতে পাচ্ছি অন্য সবাই উঠে গেছে, ব্যস্ত গলায় কথা বলতে বলতে ঘরের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছে। ভাইয়া আপু আর আম্মুর কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল তারা কোথাও যাবে তাই তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছে। সবাই যদি সারাদিনের জন্যে চলে যায় তাহলে খারাপ হয় না, পুরো বাসাটা তাহলে আমি পেয়ে যাব, এই ছোট স্টোররুমের বাইরেও আমি একটু নাড়াচাড়া করতে পারব।

আমি শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন সবাই বের হয়ে যায়, তখন হঠাৎ ভাইয়ার গলার স্বর শুনতে পেলাম, তপু, এই তপু।

আমি একটু চমকে উঠলাম, এই বাসাতেও থাকলেও সবাই এমন ভাব করতো যে আমি আসলে এখানে নেই। আজকে ভাইয়া আমাকে ডাকছে, স্বীকার করে নিচ্ছে যে আমি আসলে এই বাসায় আছি। ব্যাপারটা কী? আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে স্টোররুম থেকে বের হয়ে এলাম। ভাইয়া তার ঘর থেকে আমাকে ডাকছে, আমি সাবধানে ঘরে ঢুকলাম। ভাইয়া বলল, তপু, দ্যাখ জুতো দুটি কী ময়লা হয়েছে। একটু পরিষ্কার করে দে দেখি।

ভাইয়া খুব স্বাভাবিক গলায় কথাটা বলল, যেন আমি সবসময় তার জুতো পরিষ্কার করে দিই। এই বাসায় আমার একটা নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছেকাল রাতে আম্মু বলেছেন পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে আমার পড়াশোনা বন্ধ, আজ সকালে ভাইয়া বলছে তার জুতো পরিষ্কার করে দিতে! আমি জুতো জোড়া তুলে নিলাম, একটা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে মুছে জুতোগুলো পরিষ্কার করে ব্রাশ দিয়ে খুব সুন্দর করে কালি করে দিলাম। আগে কখনো জুতো কালি করি নাই কিন্তু ভবিষ্যতে করতে হবে না সেটা কে বলেছে? একটু প্র্যাকটিস থাকা মন্দ নয়!

ভাইয়া জুতোগুলো পরে বলল, বাহ্! একেবারে আয়নার মতো চকচকে বানিয়ে ফেলেছিস। ভেরি গুড।

আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু ভাইয়া আর আপু সেজেগুজে বের হয়ে গেলো দশটার সময়, আমি বের হলাম এগারোটার সময়।

আমি দুলি খালাকে কিছু বলিনি কিন্তু দুলি খালা বুঝে গেলো। বুঝে গিয়েও দুলি খালা আমাকে থামানোর চেষ্টা করল না। আমি যখন আমার ব্যাগের ভিতরে আমার ময়লা কাপড়গুলো আর বীজ গণিতের বইটা ঢুকালাম তখন দরজার চৌকাঠ ধরে দুলি খালা দাড়িয়ে রইল। আমি যখন বের হয়ে যাচ্ছিলাম তখন দুলি খালা তার শাড়ির খুট থকে কয়েকটা দুমড়ানো-মোচড়ানো নোট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল, বলল, নেও। তোমার কাছে রাখো।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, দুলি খালা লাগবে না।

না লাগলেও রাখো।

আমি কোন কথা না বলে টাকাগুলো পকেটে রাখলাম। দুলি খালা বলল, সাবধানে থাকবা। তোমার কিন্তু খুব বড় বিপদ।

আমি কোন কথা বললাম না। দুলি খালা বলল, মানুযরে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে বাবা-মায়ের দোয়া। তোমার বাবা নাই। তোমার মা তোমার জন্যে দোয়া করে না। তোমার খুব বিপদ।

আমি বললাম, তুমি দোয়া করো।

আমি দোয়া করি। আমি সব সময় দোয়া করি। কিন্তু আমার দোয়া কুনো কাজে আসে না বাবা।

আমি আর কোন কথা না বলে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। ব্যাগটা হাতে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একবার পিছন ফিরে বাসাটাকে দেখে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম।

ছুটির দিন বলে রাস্তাঘাটে ভিড় একটু কম। আমি বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা নিরিবিলি জায়গায় দেওয়ালের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলাম। বাসা থেকে কোন কিছু চিন্তা না করে বের হয়ে এসেছি, এখন কী করব, কোথায় যাব বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবতে হবে।

 

আমি যখন কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছেছি তখন বিকাল হয়ে গেছে। ট্রেন স্টেশন মনে হয় কখনোই ফাঁকা হয় না, সব সময়েই হয় কোন ট্রেন যাচ্ছে না হয় কোন ট্রেন আসছে, মানুষজনের ভিড়। যারা যাচ্ছে এবং যারা আসছে তাদের চেহারায় এক ধরনের ব্যস্ততা থাকে। এদের ছাড়াও স্টেশনে অন্য এক ধরনের মানুষ থাকে, তারা কোথাও যায় না, তারা রেল স্টেশনেই থাকে, এটাই তাদের বাড়িঘর। তাদের চেহারায় কোন ব্যস্ততা নেই। আমার চেহারা নিশ্চয়ই এখন এদের মতো হয়ে গেছে, আমারও কোন ব্যস্ততা নেই। আমি হেঁটে হেঁটে ট্রেনগুলো দেখলাম। কোনটা কোথায় যাচ্ছে ট্রেনের গায়ে লেখা আছে কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোন কৌতূহল নেই। এর মাঝে কোন একটাতে উঠে পড়ব। ইচ্ছে করলে ছাদেও বসতে পারি, সেটা মনে হয় বেশি মজার হবে।

খুঁজে খুঁজে একটা ভাঙ্গাচোরা ট্রেন ঠিক করে আমি তার ছাদে উঠে পড়লাম। এটা নিশ্চয়ই আস্তে আস্তে যাবে, থামতে থামতে যাবে! সেটাই ভাল, আমার কোন তাড়াহুড়ো নেই। ট্রেনের ছাদে আমার মতো আরো অনেকে আছে। পা দুলিয়ে উদাস মুখে বসে আছে। ট্রেনের ছাদে উঠে বসলে হঠাৎ ভিন্ন একটা অনুভূতি মনে হয়। যারা প্লাটফরমে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে তাদেরকে অন্য একটা জগতের মানুষ বলে মনে হয়, মনে হয় আকাশের কাছাকাছি বসে আমি পৃথিবীর মানুষকে দেখছি।

ট্রেনের ইঞ্জিন যখন হুইসিল দিয়ে নড়তে শুরু করল তখন হঠাৎ মনে হলো মেয়ের গলায় কেউ যেন আমাকে ডাকছে! আমি অবাক হয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম এবং তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্যটা দেখতে পেলাম। আমি দেখলাম প্রিয়াংকা ট্রেনটার পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করছে, তপু–তপু—তপু–

আমি কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারলাম না কী করব! এই স্টেশনে প্রিয়াংকা কোথা থেকে এলো, যদি এসেই থাকে তাহলে আমাকে ডাকছে কেন? আর সত্যিই যদি আমাকেই ডাকছে তাহলে কেমন করে জানল আমি এখানে? ট্রেনটা তখন নড়তে শুরু করেছে, কী করব বুঝতে না পেরে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি, তখন প্রিয়াংকা আমাকে দেখে ফেলেছে, সে চিলের মতো চিৎকার করতে লাগলো, তপু, এই তপু নাম–নাম তাড়াতাড়ি–

চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে কীভাবে নামতে হয় আমার জানা নেই। দেখতে দেখতে ট্রেনটার গতি বেড়ে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে আমি যদি না নামি তাহলে আর নামতেও পারব না! আমি তাই আগেপিছে কিছু চিন্তা না করে একটা লাফ দিলাম, ট্রেনের ছাদ অনেকটা উঁচু, সেখান থেকে শক্ত প্লাটফর্মে লাফিয়ে পড়া সোজা ব্যাপার না। প্রথমে মনে হলো আমি বুঝি আঁতলে গেছি, হাড়গোড় সব ভেঙ্গে গেছে, আর কোন দিন বুঝি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব না। প্রিয়াংকা ছুটে এসে আমাকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে, চিৎকার করে বলছে, সর্বনাশ অপু! সর্বনাশ! ব্যথা পেয়েছিস? ব্যথা পেয়েছিস তুই?

আমি মাথা নাড়লাম। কোঁকাতে কোঁকাতে বললাম, ঠ্যাং-এর হাড়ি মনে হয় ভেঙ্গে গেছে।

প্রিয়াংকা চেঁচাতে লাগলো, সর্বনাশ! হায় আল্লা! এখন কী হবে?

আমি প্রিয়াংকাকে ধরে দুই পা হেঁটে বললাম, নাহ! মনে হয় ভাঙ্গে নাই শুধু মচকেছে।

প্রিয়াংকার মনে হয় জানে পানি ফিরে এলো। আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হলো? কাঁদছিস। কেন?

আমি এর আগে কখনো কাউকে তুই করে বলি নি, এই প্রথম সেটা করলাম এবং সেটা করেছি নিজের অজান্তেই।

প্রিয়াংকা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি! আমি সব জানি তপু।

আমি ভুরু কুচকে প্রিয়াংকার দিকে তাকালাম, জিজ্ঞেস করলাম, তুই সব কী জানিস?

তোর কথা! প্রিয়াংকা আমার হাত ধরে রেখে কান্না সামলাতে সামলাতে বলল, আজকে আমি তোদের বাসায় গিয়েছিলাম।

হঠাৎ করে মনে হলো আমার হৃৎপিণ্ড বুঝি থেমে গেছে। প্রিয়াংকা সব কিছু জেনে গেছে? আমার নিঃশ্বাস মনে হয় বন্ধ হয়ে গেলো, কোনমতে বললাম, আমার বাসায় গিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

আমি কঠিন গলায় বললাম, কেন?

প্লিজ তপু তুই রাগ করিস না। প্লিজ।

কেন গিয়েছিলি আমার বাসায়?

তুই অঙ্ক করতে এতো ভালবাসিস। তাই তোর জন্যে একটা গণিতের বই নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম তোকে খুশি করে দেব।

আমি প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুই আমার বাসা কেমন করে চিনেছিস?

লুকিয়ে তোর পিছু পিছু গিয়ে একদিন তোর বাসা চিনে এসেছি।

আমি বিস্ফারিত চোখে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, এই মেয়েটার কী মাথা খারাপ? প্রিয়াংকা আবার কাঁদতে লাগলো।

আমি বললাম, কাঁদছিস কেন? প্রিয়াংকা আমার হাত ধরে বলল, তোর এতো কষ্ট তপু। কেউ জানে না! আমি যদি আজকে তোর বাসায় না যেতাম, যদি দুলি খালার সাথে দেখা না হতো তাহলে আমিও জানতাম না।

আমি কোন কথা না বলে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রিয়াংকা বলল, দুলি খালা বলল তুই আর সহ্য করতে না পেরে বাসা থেকে চলে গেছিস! এটা হতে পারে না।

কী হতে পারে না?

আমরা সবাই আছি, আর কেউ তোকে সাহায্য করতে পারবে না? তুই একা একা সহ্য করতে না পেরে বাসা ছেড়ে চলে যাবি? জীবনটা শেষ করে দিবি?

আমি আস্তে আস্তে বললাম, আমার আসলে কোন জীবন নাই। আমি আসলে ভাল ছেলে না। আমি চোর। আমি পড়াশোনা করি না–আমি-

প্রিয়াংকা ফিসফিস করে বলল, তুই যে এখনো বেঁচে আছিস, তুই যে পাগল হয়ে যাস নাই সেটাই সাংঘাতিক ব্যাপার? প্লিজ তপু তুই এটা করিস না?

কী করব না?

তুই চলে যাস না।

আমি চলে যাব না? না।

আমি কিছুক্ষণ প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, কেন?

তুই বড় হয়ে বিখ্যাত একজন ম্যাথমেটিশিয়ান হবি–এখন যদি তুই তোর জীবনটা শেষ করে ফেলিস, কেমন করে হবে?

আমি অবাক হয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকালাম, আমি বড় হয়ে বিখ্যাত ম্যাথমেটিশিয়ান হব?

হবি না? নিশ্চয়ই হবি। সবাই বলেছে তুই অসম্ভব ভাল ছাত্র ছিলি হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিস। আসলে তুই পড়াশোনা ছেড়ে দিস নি–তুই আর পড়াশোনা করতে পারছিস না।

আমি কিছু বললাম না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রিয়াংকা আবার বলল, সবাই আমাকে বলেছে তুই রাস্তাঘাটে মারামারি করে আসিস বলে তোর হাতে পায়ে শরীরে কেটেফুটে থাকে। আসলে, আসলে-

প্রিয়াংকা কথাটা শেষ না করে আবার ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললো। আমি চোখ বড় বড় করে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার জন্যে কাঁদতে পারে পৃথিবীতে এরকম মানুষ আছে? প্রিয়াংকা কোনমতে চোখ মুছে বলল, তোর আব্বু মারা গেছে। তোর আম্মু এখন তোকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, তোর ভাই-বোন থেকেও নেই, ক্লাসে তোর বন্ধুবান্ধব নেই, তুই একাকত কষ্টের একটা জীবন! তুই আমাকে একটা সুযোগ দে, আমি তোর আম্মু হব, তোর ভাই হব, বোন হব, তোর বন্ধুবান্ধব হব–দেখিস তুই, খোদার কসম!

প্রিয়াংকার কথা শুনে আমি হঠাৎ হেসে ফেললাম। আমাকে হাসতে দেখে প্রিয়াংকা একটু উৎসাহ পেলো, বলল, তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না? আমি ছোট হতে পারি কিন্তু আমি অনেক কিছু করতে পারি। তুই আমাকে সুযোগ দে। প্লিজ।

কীসের সুযোগ দেব?

বড় হয়ে একজন বিখ্যাত ম্যাথমেটিশিয়ান হবার।

ধুর! তোর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

প্রিয়াংকা মাথা নাড়ল, বলল, উঁহুঁ তপু। তুই আমার কথা অবিশ্বাস করিস। তা না হলে তুই বল, আমি কেমন করে ঢাকা শহরের এক কোটি লোকের মাঝে তোকে খুঁজে বের করলাম? খোদা যদি আমাকে সাহায্য না করতো। তাহলে আমি কী তোকে খুঁজে বের করতে পারতাম?

আমাকে স্বীকার করতেই হলো ঢাকা শহরের এক কোটি লোকের মাঝে একজনকে খুঁজে বের করে ফেলা খুব সহজ কথা নয়। খোদা নিশ্চয়ই সাহায্য করেছে। প্রিয়াংকা চোখ বড় বড় করে বলল, তার মানে কী বুঝেছিস? তার মানে এটা খোদার ইচ্ছা!

কোনটা খোদার ইচ্ছা?

যে তুই একজন বিখ্যাত ম্যাথমেটিশিয়ান হবি।

আমি আবার হাসলাম। এবারে শব্দ করে আর জোরে। অনেক দিন পর আমি সত্যি সত্যি হাসলাম–হাসলে যে এতো ভাল লাগে সেটা আমি কোন দিন জানতাম না। প্রিয়াংকা তার ব্যাগের ভেতর থেকে লাল কাগজ দিয়ে মোড়ানো। একটা বই আমার দিকে এগিয়ে দিল, বলল, এই নে। এই বইটা দেবার জন্যে তোর বাসায় গিয়েছিলাম।

আমি প্যাকেটটা খুলে দেখি একটা ইংরেজি গণিতের বই। বইটা খুলতেই ভেতরে নানা ধরনের সমীকরণ বের হয়ে এলো আর সেটা দেখে হঠাৎ আমার জিবে প্রায় পানি এসে গেলো। আমি নিজেও জানতাম গর্ণিত আমার এতো প্রিয় একটা বিষয়। আমি বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বললাম, চল যাই।

আগে কথা দে, তুই বাসা থেকে পালিয়ে যাবি না।

কথা দিলাম।

আমাকে ছুঁয়ে কথা দেয়।

ছুঁয়ে কথা দিলে কী হয়?

প্রিয়াংকা গম্ভীর গলায় বলল, কথা ভেঙ্গে ফেললে যাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিস সে মরে যায়।

আমি বললাম, আমি এসব বিশ্বাস করি না।

আমিও করি না। তবু ছুঁয়ে কথা দে। প্লিজ।

আমি প্রিয়াংকাকে ছুঁয়ে বললাম, ঠিক আছে কথা দিলাম।

গুড। প্রিয়াংকা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তার চোখ এখনো ভেজাএকজন মানুষের চোখে পানি কিন্তু মুখে হাসি–এটা ভারি বিচিত্র একটা ব্যাপার।

আমরা দুজন তখন হাঁটতে শুরু করলাম। বিকেল পড়ে এসেছে, বাসায় যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে। প্রিয়াংকা বলল, আগে আমাকে বাসায়। পৌঁছে দিতে হবে।

ঠিক আছে পৌঁছে দেব।

 

প্রিয়াংকাকে বাসায় পৌঁছে আমি যখন বাসায় রওনা দিয়েছি তখন হঠাৎ আমার মনে হলো আমি আর আগের তপু নই। আমি এখন অন্য রকম একজন তপু। প্রিয়াংকা আমার ভেতরে খুব বড় একটা পরিবর্তন করে ফেলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *