পরের দিন ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই কাকুকে আর আমার পাশে দেখলাম না। দেখি, উনি ওর বিছানাতেই ঘুমুচ্ছেন। মনে মনে ভাবলাম, হয়তো নেশার ঘোরে আমার পাশে শুয়েছিলেন। তারপর নেশা কেটে যাবার পর ভোর রাত্রের দিকে হয়তো ঘুম ভাঙতেই উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমার পাশ থেকে নিজের বিছানায় চলে যান। তাই কাকুকে অপরাধী ভাবতে পারলাম না।
এই সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা আমি নিশ্চয়ই স্বীকার করব। কাকু যখন আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিলেন, তখন আমার খারাপ লাগেনি; বরং একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের স্বাদ পেয়ে ভালোই লেগেছিল। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা স্বীকার করবে না কিন্তু এ সব কথা সর্বৈব সত্য যে যৌবনে পুরুষের স্পর্শ মেয়েদের ভালোই লাগে। বিশেষ করে সে পুরুষ যদি ঘৃণার পাত্র না হয়, তাহলে খারাপ লাগার কোনো প্রশ্নই নেই।
দিনগুলো আগের মতোই কেটে যাচ্ছে। কাকুর ব্যবহারে মুহূর্তের জন্যও কোনো অমার্জিত ভাব দেখতে পাই না। মনে মনে ওর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। তারপর আবার একদিন মাঝরাত্রে কাকুকে আমার পাশে আবিষ্কার করলাম। সেদিন আমি নেশা করিনি। ঘুম ভাঙতেই সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম না। দেখি, আগের দিনের মতোই উনি আমার বুকের পর আলতো করে হাত রেখে অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। আমি আস্তে ওর হাতটা সরাতেই উনি আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন। আমি অনেকক্ষণ জেগে জেগে আবছা আলোয় ওর দিকে চেয়ে রইলাম। বিশ্বাস কর ভাই, আমি ওকে খারাপ ভাবতে পারলাম না; রবং কাকুর প্রতি আমার দারুণ মায়া হল। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই আমি অবাক। দেখি, আমিই কাকুকে জড়িয়ে শুয়ে আছি।
এইভাবে মাঝে মাঝে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই একটা বছর পার হল।
কবিতা, আজকে তুমি একটু ড্রিঙ্ক করবে?
আমি হাসতে হাসতে বলি, কেন কাকু? আজ তো আপনার জন্মদিন না।
আজ শনিবার।
তাতে কি হল?
কাল আমারও অফিস নেই, তোমারও ইউনিভার্সিটি নেই।
তাতে কি হল?
সব ব্যাপারে কাকুকে নিঃসঙ্গ রাখছ কেন? একটু থেমে বললেন, না হয় আমার মতো অপদার্থের জন্য তুমি একটু খারাপই হলে।
না, না, ভালো খারাপের কোনো ব্যাপার নয়।
তাহলে প্লিজ গিভ মি কোম্পানি।
গত এক বছরে কাকুর অনুরোধে আমাকে দুতিন দিন হুইস্কি খেতে হয়েছে কিন্তু ঠিক উপভোগ করিনি। সেই শনিবার সন্ধ্যায় আমি প্রথম হুইস্কি খেয়ে সত্যি আনন্দ পেলাম।
এক পেগ শেষ হবার পর আমিই কাকুকে বললাম, কাকু আরেক রাউন্ড হোক।
কাকু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?
বেশ লাগছে।
প্রথম পেগ শেষ করতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগলেও সেকেন্ড পেগ আধ ঘণ্টায় শেষ হতেই কাকু আবার গেলাস ভরে আনলেন। আমি আপত্তি করলাম না। ওই গেলাস নিয়েই আমি ডাইনিং টেবিলে বসলাম। সামান্য কিছু খেলাম। তারপর গেলাসের বাকি হুইস্কিটুকু গলায় ঢেলে দিয়েই দুহাত দিয়ে কাকুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমাকে শুইয়ে দিন।
শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
না, না, বরং বেশ ভালো লাগছে।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি, আমরা দুজনে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছি। আস্তে আস্তে আমি আবিষ্কার করলাম, আমরা দুজনে রোজই এক বিছানায় শুই। তবে ভাই, বিশ্বাস কর, কাকু কোনো দিনের জন্যও আমার কাছ থেকে এর বেশি দাবি করেননি।
তারপর আমি এম. এ. পাশ করলাম। ভালোই রেজাল্ট হল। রিসার্চ শুরু করলাম। সারাদিনে এত পরিশ্রম করতে হয় যে বাড়ি ফেরার পরই ঘুমিয়ে পড়ি। অধিকাংশ দিনই জানতে পারি না, কখন সালাউদ্দিন চলে যায় বা কাকু বাড়ি ফিরে আসেন।
সাড়ে সাতটা-আটটার সময় ঘুম ভাঙার পর স্নান করি। দু-এক ঘণ্টা লেখাপড়া করি। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে হয়তো দুজনে গল্পগুজব করি।
একদিন কাকু ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বললেন, রিসার্চ তো প্রায় শেষ হয়ে এলো, এরপর কি করবে?
আগে শেষ হোক। তারপর ভেবে দেখব।
কাকু বলেন, কি আর করবে? কোথাও ভালো চাকরি নিয়ে চলে যাবে।
চলে গেলেও আপনি মাঝে মাঝে আমার কাছে আসবেন।
তোমার স্বামী হয়তো আমার যাতায়াত পছন্দ করবেন না।
আমি বিয়ে-টিয়ে করছি না।
বিয়ে তোমাকে করতেই হবে।
কেন?
কেন আবার? তোমার মতো সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েকে অনেকেই বিয়ে করতে চাইবে।
অন্যের ইচ্ছায় তো আমি বিয়ে করব না।
অন্যের আগ্রহে তোমারও বিয়ে করার ইচ্ছা হবে।
তার কোনো মানে নেই।
.
মানে আছে কবিতা। কাকু আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কাঁধের ওপর দুটো হাত রেখে বললেন, তুমি তো কোনোদিন হুইস্কি খেতে না কিন্তু আমার আগ্রহে আজকাল মাঝে মাঝে ড্রিঙ্ক কর, তাই না?
আমি মাথা নাড়ি। এবার কাকু বলেন, আমি নিজে আগ্রহ করে তোমার কাছে কিছু দিন শোবার পরে…
বুঝেছি।
আমার যদি আরও এগিয়ে যাবার ইচ্ছা থাকত তাহলে হয়তো…
না কাকু, সে ইচ্ছা আপনার হবে না।
আমি কথার কথা বলছি, আমি আগ্রহ দেখালে তুমিও হয়তো বাধা দেবে না।
আমি কোনো কথা বলি না। মুখ নীচু করে বসে থাকি।
কিছুক্ষণ পরে কাকু আমার দুটি হাত ধরে বললেন, অনেক রাত হয়েছে। চল, শুতে যাই।
আমি নিঃশব্দে কাকুর সঙ্গে শুতে যাই।
কাকু ঘুমিয়ে পড়েন কিন্তু আমি জেগে থাকি। নানা কথা ভাবি, কাকুর কথা, আমার কথা। হয়তো বাবা-মা দাদুর কথাও ভাবি। ভাবি, আমার জীবনটা কি বিচিত্রভাবে ঘুরে গেল। কবছর আগে যাকে চিনতাম না, যে আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল আজ আমি তারই পাশে শুয়ে। আছি।
হঠাৎ পাশ ফিরে শুয়ে কাকুকে দেখি। একটু হাসি। ঘুমিয়ে পড়লে কাকুকে শিশুর মতো মনে হয়। ক্লান্ত, শ্রাত, অসহায়। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, ঘুমোলে কী সবাইকে এমন অসহায় মনে হয়?
আস্তে আস্তে ওর মুখে, মাথায় হাত দিই। হঠাৎ গলার কাছে হাত দিয়ে দেখি ভিজে গেছেন। নিজের আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিই। পাঞ্জাবির বোতামগুলো খুলে দিই। কাকুর মুখের সামনে মুখ নিয়ে দেখি। ওর নিঃশ্বাস আমার মুখে এসে পড়ছে। বেশ লাগছে। ওকে যেন ভালো লাগে। নিজেই নিজেকে বলি, কাকু তো বাবার চাইতে সাত-আট বছরের ছোট। তার মানে উনি মোটামুটি
আমার চাইতে দশ-বারো বছরের বড়। ব্যাস! আমি বোধহয় একটু ঘনিষ্ঠ হই। ঘুমের ঘোরেই। কাকু আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নেন। আমি আপত্তি করি না, ওকে দূরে সরিয়ে দিই না। পারি না। ওকে দূরে সরিয়ে দেবার মতো শক্তি আমি হারিয়ে ফেলি।
ভাই, তোমার কাছে স্বীকার করছি, সেদিন সেই অন্ধকার রাত্তিরে আমি কাকুকে ভালোবাসলাম আর সেই ভালোবাসার আগুনে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম।
বেশ কিছুকাল পরের কথা। আমার রিসার্চ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু রেজাল্ট বেরোয়নি। প্রায় সারা দিনই বাড়ি থাকি। তাছাড়া সালাউদ্দিন আজমীর শরীফএ তীর্থ করতে গেছে বলে আমিই রান্নাবান্না করি। দুপুরের দিকে কলিংবেলে বাজতেই দরজা খুলে দেখি, একজন তিরিশ-বত্রিশ বছরের সুন্দরী মহিলা।
আমি কিছু বলার আগেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন, সালাউদ্দিন আছে?
না, ও আজমীর গিয়েছে।
তার মানে ওর ফিরতে দেরি হবে।
আপনি কি সালাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?
উনি একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনিই কি কবিতা?
হ্যাঁ। আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না।
আপনি আমাকে চিনবেন না। হেমন্তবাবুর সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয়।
এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। বললাম, আপনি ভিতরে আসুন। উনি ভিতরে এলেন, বসলেন। আমি ওর সামনের সোফায় বসে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নামটা জানতে পারি?
আমার নাম রমলা।
আপনি কি কাকুর অফিসে কাজ করেন?
আপনি বুঝি হেমন্তকে কাকু বলেন?
বিচিত্র হাসি হেসে উনি এই প্রশ্ন করতেই আমার সারা শরীর জ্বলে উঠল। খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, হ্যাঁ উনি আমার কাকু।
উনি একবার খুব ভালো করে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, আপনার কাকু তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাই দ্য ওয়ে মাইশোর সিঙ্কের শাড়িটা আপনার পছন্দ হয়েছিল তো?
ওর কথা শুনে আমার গা জ্বলে গেল। বললাম, সবই তো বুঝলাম কিন্তু আপনার পরিচয়টা জানতে পারলাম না।
আপনার মতো হেমন্তও আমার বন্ধু।
তার মানে?
রোজ অফিস ফেরত আমার কাছে যায়। আগে মাঝে মাঝে রাত্তিরটা আমার কাছেই কাটাত কিন্তু আজকাল আপনার জন্য রাত্তিরে আর আমার কাছে থাকে না।
আপনি কি এই সব আজেবাজে কথা বলতে আমার কাছে এসেছেন?
উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না। এই দিকে একটু কাজ ছিল। তাই ভাবলাম, একবার আপনাকে। দেখে যাই।
আপনার দেখা হয়েছে?
দরজার দিকে এগোতে এগোতে রমলা আরেকবার আমাকে ভালো করে দেখে বললেন, হ্যাঁ দেখলাম। বেশ লোভনীয় জিনিস।
উনি বেরিয়ে যেতেই আমি দরজা বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইলাম। কাকুর উপর রাগে দুঃখে ঘেন্নায় সারা শরীর জ্বলে গেল। তারপর মনে মনে ঠিক করলাম, না, আর এখানে নয়।
সুপর্ণাকে টেলিফোন করলাম, শোন তোর সঙ্গে আমার খুব জরুরি দরকার।
কেন, কী হল?
তোর বরকে দিয়ে আমার একটা উপকার করিয়ে দিতে হবে।
কাজটা কি, তাই বল।
তুই বাড়িতে আছিস?
আর কোথায় যাব?
তাহলে আমি আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি নিয়ে সুপর্ণার বাড়ি গেলাম। সোজাসুজি বললাম, কাকুর চরিত্র ভালো নয়। আমি আর একদিনও ওখানে থাকতে চাই না।
ও সঙ্গে সঙ্গে বলল, এখন তো আমার শ্বশুর-শাশুড়ি নেই, তুই আমার এখানে চলে আয়।
দরকার হলে আসব কিন্তু তোর বরকে দিয়ে Y. W. C. A-তে আমার একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।
সে ব্যবস্থা হয়তো ও করে দেবে কিন্তু তাতে দু-এক মাস সময় লাগবেই।
কিন্তু আমি আর একদিনও কাকুর ওখানে থাকতে চাই না।
তুই আজই এখানে চলে আয়। তারপর ওখানে ঘর পেলেই চলে যাস।
তোর বরের মত না জেনে আমি আসতে পারি না।
আমার বর তোকে ওর আপন বোনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।
তা তো জানি কিন্তু তবুও তার মতামত না জেনে আমার আসা উচিত নয়।
ঠিক আছে, আজ রাত্রে আমি ওর সঙ্গে কথা বলে রাখব।
তুই আমাকে টেলিফোন করিস, তবে কাকু অফিস যাবার আগে করিস না।
এগারোটা নাগাদ করব।
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
পরের দিন দুপুরের দিকে সুপর্ণা ওর বরের অফিসের গাড়ি নিয়ে আমার কাছে এলো। আমি আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হলাম। কাকুকে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে এলাম-আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। আপনার কাছে এই কবছর থেকে আমি যে অপরিসীম অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, তা আমার ভবিষ্যত জীবনের পাথেয় হয়ে রইবে। আমি যাচ্ছি। আর কোনোদিন আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা নেই। আপনিও আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন না। সব শেষে জানাই, আপনার বান্ধবী রমলা এসেছিল।
অকস্মাৎ আমার জীবন আবার মোড় ঘুরল।
তোমার দুজনে আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।