খিয়ারের খেতমজুর থেকে নিজের গ্রামে বর্গাচাষী হওয়ার হাউস মেটাতে তমিজকে শুনতে হয় মেলা কথা। তার নাই গোরু, নাই লাঙল জোয়াল মই; বীজচারা কেনার পয়সাও নাই, লোকে তাকে জমি দেয় কোন ভরসায়? তমিজ জোড়হাতে কারুবারু করে, এখন মণ্ডল তাকে এসব দিক, ধান উঠলে ফসলের ভাগাভাগি করে সব কিছুর দাম ধরে না হয় কেটে নেবে।
তা নেওয়া চলে, এতোকাল যে একেবারে চলে নি তাও নয়। কিন্তু শরাফত মণ্ডলের বড়ো বেটা আবদুল আজিজ বড়ো হুঁশিয়ার মানুষ। সে থাকে জয়পুরে, জয়পুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি, জমিজমার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, জমির মাপজোঁক থেকে শুরু করে খাজনা ট্যাকসের আঁটঘাট আর ফাঁকফোকর তার মতো জানে এমন মানুষ লাঠিডাঙার কাছারিতেও কেউ আছে কি-না সন্দেহ। গোরু, লাঙল, জোয়াল, মই, বীজ ধানের দামের আধাআধি সে আগাম দাবি করে। গোরু নাই, লাঙল নাই, তবু বর্গা করার সখ? ঠিক আছে, করো। কিন্তু শর্ত মেনে জমিতে নামো।
আবদুল কাদের বলে, এরা তো অনেক দিনের মানুষ। এর বাপও আমাদের বাড়িতে এক সময়–।
কিন্তু চাষাদের বাড়াবাড়ি সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে, টাউন হয়ে করতোয়া পেরিয়ে ঐ দাপাদাপি এই পুব এলাকায় আসতে আর কততক্ষণ? খিয়ার এলাকায় চাষারা ফসলের ভাগ চায় দুইভাগ, নিজেরা দুইভাগ নিয়ে জমির মালিকের গোলায় তুলে দিয়ে আসবে এক ভাগ। তা চাও; চাইতে তো আর ট্যাকসো লাগে না। কিন্তু একটা কথা,-জমি তো আর হেঁটে হেঁটে জোতদারের বাড়িতে এসে হাজির হয় না। একি কামারপাড়ার অর্জুনগাছের বক যে উড়াল দিয়ে বিল পেরিয়ে এসে বসলো মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছে? এক এক ছটাক জমি করতে মানুষের শরীরের এক এক পোয়া রক্ত নুন হয়ে বেরিয়ে যায়, সে খবর রাখো? জাহেল চাষার গো আবদুল আজিজ দেখে খিয়ার এলাকায়। সেই গোঁ এখানকার চাষার শরীরে চাগিয়ে উঠতে কতোক্ষণ? কাউকে খাতির। করার দরকার নাই, নিয়ম অনুসারে জমি বর্গা নাও। না পোষালে কেটে পড়ো।
আবদুল আজিজের এসব উদ্বেগ আর ভবিষ্যদ্বাণীর জবাব তমিজ দেবে কী করে? আবদুল কাদের যে আবদুল কাদের, যে কি-না ইংরেজিতে নিজের নাম এক টানে লেখে এম. এ. কাদের, সভাসমিতি করা মানুষ, সুযোগ পেলেই মানুষকে ধরে ধরে হিন্দুর জুলুমের কথা ফাঁস করে দেয়, সেই জুলুম থেকে বাঁচতে মুসলিম লীগের নিশানের নিচে সবাইকে জড়ো হতে বলে, সে পর্যন্ত খালি নাক খেটে আর মাথা চুলকায়। হাজার হলেও ভাইজান তার চাকরি করে জয়পুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে, ডান হাত বাম হাত দুটোই তার ভারী সচল। কয়েক দিনের জন্যে বাড়ি আসায় সকালে হাগার পর ছোচা ছাড়া বাম হাতের কাজকাম বন্ধ, সেই নিস্ক্রিয়তার শোধ সে তোলে জিভ আর টাকরার অবিরাম ব্যবহার করে।
পশ্চিমে ধান কাটতে গিয়ে আধিয়ারদের কাণ্ডকারখানা তো তমিজ দেখে এসেছে। নিজের চোখেই, এসব দাপাদাপি সে নিজেই কি আর পছন্দ করে? জমি হলো জোতদারের, ফসল কে কী পাবে সেটা তো থাকবে মালিকের এখতিয়ারে। অথচ ফসলের বেশিরভাগ দখল করতে আধিয়াররা নেমে পড়ে হাতিয়ার হাতে। তাদের ফন্দি ঠেকাতে এবার পাঁচবিবিতে কয়েকজন জোতদার ধান কাটতে জমিতে কামলা লাগিয়েছিলো নিজেরাই। পুব থেকে গিয়ে তমিজও এক জমিতে কাজ পেয়ে গেলো। জোতদার নাকি পুলিসের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছিলো। তা পুলিস যাবে আর কতত জায়গায়?-সেদিন ভালো মজুরির চুক্তিতে আপখোরাকি কাজে নেমেছিলো তমিজ। ধুমসে কাজ করছে, যত তাড়াতাড়ি পারে ধান কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু দুপুর হতে না হতে এতোগুলো মানুষের হৈ হৈ শুনে ভাগ্যিস সময়মতো দৌড় দিয়েছিলো। চাষাদের বৌঝিরা পর্যন্ত ঝাটা খুন্তি বঁটি নাকড়ি নিয়ে তাড়া করে। ধানখেতের ভেতর দিয়ে, কাটা ধানের আঁটি ডিঙিয়ে এবং কখনো সেগুলোর ওপর পা রেখে ছুটতে না পারলে ঝটা কি খুন্তির দুই একটা ঘা কি তমিজের গায়ে পড়তো না? কয়েকটা বাড়ি যে পড়ে নি তাই বা কে জানে বাপু? মেয়েমানুষের হাতে মার খেয়ে কেউ কি তা চাউর করে বেড়ায়? ওদের ঝাঁটার ঘা খেয়ে কিংবা কোনোভাবে এড়িয়ে জোতদারের উঠানে ওঠার আগে থেকেই আধিয়ারদের এরকম বাড়াবাড়ি তমিজের একেবারেই ভালো লাগে নি। জমি হলো লক্ষ্মী, লক্ষ্মীর বেটাবেটি হলো তার ফসল। সেই ফসল নিয়ে টানাটানি করলে জমির গায়ে লাগে না? ফসল হলো জমির মালিকের জানের জান। তাই নিয়ে টানাহ্যাচড়া করলে বেচারা বাচে কী করে? মাঝির বেটা বলে জমির বেদনা বুঝবে না বললে তমিজ খুব কষ্ট পায়। তার বাপ দাদা পরদাদা সব মাছ ধরে খেয়ে এসেছে, এটা ঠিক। তার জন্মের অনেক আগে নাকি পোড়াদহ মেলার সবচেয়ে বড়ো বাঘাড় মাছটা আসতো তার বাপের দাদা বাঘাড় মাঝির হাত দিয়ে। এই কারণে সম্মানসূচক মানুষটার নামটি তমিজের বাপ, অর্জন করে এবং এমন কি আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও তার আসল নামটি চাপা পড়ে যায়। পূর্বপুরুষের এই খ্যাতি ভোগ করেছে তমিজের বাপ অব্দি। তমিজের। জন্মের আগে পর্যন্ত তমিজের বাপকে সবাই চিনতো বাঘাড় মাঝির লাতি বলে, তার পরিচয় পাল্টে যায় তমিজের জন্মের পর। তবে তমিজকে সবাই চেনে তমিজ বলেই।
তা বাপু এই বংশের মানুষ তো এক কালে চাষবাসের কাজই করতো। বাঘাড় মাঝির বাপ বুধা মাঝির দাদা না পরদাদা না-কি তারও দাদা সোভান ধুমা। বিলের এপারে গিরিরডাঙার অর্ধেক, অর্ধেক না হলেও সিকি জমির জঙ্গল কেটে বসত করলো কে?–সোভান ধুমা ছাড়া আবার কে? করতোয়ার পশ্চিমে কোথায় খুব গোলমাল করে কাদের তাড়া খেয়ে সোভানের বাপ এখানে যখন আসে এই তল্লাট জুড়ে তখন খালি জঙ্গল আর জঙ্গল। সোভানের মা ছিলো চার জন, ভাইবোন পঁচিশ তিরিশ জনের কম নয়। এর মধ্যে প্রায় সবই বেটাছেলে। মাঝি হওয়ার আগে তাদের বংশে বেটি পয়দা হয়েছে কম। আরে, বিলের পশ্চিমে এতো বড়ো জঙ্গল কেটে চাষের জমি বার করা কি মেয়েছেলের কাম নাকি? জঙ্গলও জঙ্গল! জঙ্গল জুড়ে তখন বাঘ, ভালুক বুনো শুওর আর সাপ। প্রথম দিকে গাঁইগুঁই করলেও জানোয়ারগুলো তটস্থ থাকতো সোভান আর তার ভাইদের ভয়ে। শেষে এমন হলো যে, সোভানের গায়ের গন্ধ পেলে বাঘ পর্যন্ত আর পালাবার দিশা পায় না। ধরতে পারলে সোভান ধুমা বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চড়িয়ে। তাকে দিয়ে লাঙল টানায়।
তারপর কবে, সোভান ধুমার নাতি না তার নাতির বেটার আমলে একবার আসামে না রংপুরে না-কি দিল্লিতেই হবে, না বার্মায় কোথায় ভূমিকম্প হলে কোথাকার বড়ো এ গাঙের পানি সব এসে পড়লো পুবের যমুনায়। যমুনা তখন কী?-মানুষ শুনে হাসে, যমুনা তখন একটা রোগা খাল। তার ওই ছিপছিপে গতরে যমুনা কুলাতে পারে না, অতো পানি সে রাখে কোথায়? ক্রোশকে ক্রোশ-জমি আর বাঘ ভালুক শুওর আর সাপ আর মানুষ আর ঘরবাড়ি আর হাঁসমুরগি আর গোরুবাছুর সাবাড় করে সে কেবলি হাঁসফাঁস করে। যমুনার বদহজম হলে পানির ঘোলা স্রোতের অনেকটাই সে উগরে দিলো বাঙালি নদীতে। প্রবল স্রোতের দলছুট একটা ধারা বাঙালি থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়লো এই কাৎলাহার বিলে। কাৎলাহার বিল তো তখন একটু জলা মাত্র, তার উত্তর সিথানে পাকুড়গাছে মুনসি আরস পেতে বসেছে সোভান ধুমার আমলেই, কিংবা তার বেটার সময়েও হতে পারে। মুনসি না থাকলে কাহারকে তখন আর পুছতো কে? মুনসি থাকায় পানি খুব টলটলে, গিরিরডাঙার জঙ্গল-কেটে বসত-করা মানুষ ঐ পানি খায়। কিন্তু ওই জলা কি আর বাঙালির দলছুট স্রোতের মতো পানি ওইটুকু গতরে রাখতে পারে? গিরিরডাঙা ড়ুবলো, কামারপাড়া বাদে নিজগিরিরডাঙা তখনো জঙ্গল, সেটাও ড়ুবলো। গিরিরডাঙার চাষের জমি আর গোরুবাছুর আর হাঁসমুরগি আর বৌবেটাবেটি নিয়ে মানুষকে ভেসে যেতে দেখে মুনসির আর সহ্য হলো না, পাকুড়গাছ থেকে সে তার জোড়া পা পঁচিশ তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ গজ বাড়িয়ে বিলের দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ে মারলো এক লাথি। সেখানে কতোদিন আগে জঙ্গল কেটে তৈরি চাষের জমি আর বাড়িঘর সব ভেঙে পড়লো, বানের পানি গলগল করে ঢুকে পড়লো পাড়-ভাঙা বিলের ভেতর। বাঙালি নদীর স্রোত দুটো ধারায় এসে পাকুড়গাছে কদমবুসি করে গাছের দুই ধার দিয়ে এসে মিশলো বিলের পানিতে। একটি ধারা মুছে গেছে অনেক দিন আগেই। পাকুড়গাছের পেছনে অনেকটা জায়গা সেই স্রোতের স্মৃতিতে এখনো নাকি ভিজে ভিজেই থাকে। মায়ের কাছে তমিজ গল্প শুনেছে, টাউনের রমেশ উকিল এখানে চাষবাসের জন্যে কাশবন ইজারা নিয়েছিলো। তমিজের বাপকে নাকি সে ওখানে লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলো তার ভাগ্নে টুনুবাবুর সঙ্গে। তখন রমেশ উকিলের কথায় তার বাপ কান দেয় তো পাকুড়তলার উত্তরে না হলেও তিন বিঘা জমির মালিক হয়। তাদের জায়গাজমি খেয়েই তো বিলের গতর এতো মোটা। ঐ বান না হলে আর মুনসি তাদের বাঁচাতে বিলের গায়ে লাথি না মারলে এইসব জমি তো তাদেরই থাকে। যাদের জমি খেয়ে মুনসির বিলের গতর বাড়ে, তাদের রেজেকের ব্যবস্থাও করে দেয় মুনসি নিজেই। তার লাথিতে মাটি ভেঙে পানিতে ড়ুবে গেলে লাঙল হারিয়ে যায় বিলের ভেতরে। মুনসির হুকুমে সেখান থেকে ভেসে ওঠে তৌড়া জাল, প্যালা জাল, এমন কি মস্ত বড়ো বেড় জাল পর্যন্ত।
মুনসির ইশারায় সোভান ধুমার বংশ হয়ে গেলো মাঝি। তা এখন বিল তো আবার খুঁজতে শুরু করেছে। আট বছর আগে বড়ো বানের পর পলি পড়ে বিল ছোটো হয়ে এসেছে। কতো কতো মাঝি কাঁধে জাল আর বৌদের কোলে-কাখে ছেলেমেয়েদের তুলে দিয়ে চলে গেলো পুবে যমুনার দিকে। আবার কেউ কেউ বিলে পানির ওপর পুরু সর-পড়া মাটিতে লাঙল ঢোকাবার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু নতুন জমি যা উঠবে সবই নাকি শরাফত মণ্ডলের, জমিদারকে টাকা দিয়ে গোটা বিল সে পত্তন নিয়েছে। কিন্তু তমিজের কেমন খটকা লাগে, বিলের নতুন জমিতে চাষবাস করার হক এখন কার?—বোবঝা, ভালো করে বুঝে দেখো। কিন্তু সে নিজেও হিসাবটা ভালো করে বুঝতে পারে না। জমির মালিক না হোক, জমিতে বর্গা তো করতে পারবে, না কী কও?-কিন্তু তার উত্তেজনা ও উদ্বেগ ও খানিকটা হাহাকারও বটে, সবটাই মিনতি হয়ে প্রকাশের জন্যে ছটফট করে, কিন্তু তাও.আর হয়ে ওঠে না। তবে তার হয়ে কথা বলে কাদের, ভাইজান, এই চ্যাংড়াক জমি দিলে ফসল মার যাবি না। চ্যাংড়াটা খাটতে পারে খুব। গরিব মাঝির বেটা, বেয়াদবি করার সাহস পাবি না।
সেটা আবদুল আজিজও আঁচ করতে পারে। মাঝিদের বেটা, তার ওপর গরিবের মধ্যেও গরিব। চাষ করতে শুরু করলেও ভালোভাবে চাষা হতে আরো দুই পুরুষ লাগবে। লাঙল হাতে নিতে না নিতে আরো কয়েকটা চাষার সঙ্গে জোট বাঁধার সময় কোথায় তার?—ঠিক আছে। কিন্তু আবদুল আজিজ একজন সরকারি কর্মচারী, তার বেতন আসে ডিস্ট্রিক্ট ট্রেজারি থেকে। তাকে চলতে হয় বৃটিশ রাজের তৈরী রুলস অনুসারে। বৃটিশ রাজ আর যাই করুক, তোমরা এটা বলো সেটা বলল, কিন্তু আইনের ফাকি তারা সহ্য করে না। বৃটিশ খেদাতে তোমরা উঠে পড়ে লেগেছো, দেশটা তোমাদের হাতে পড়লে এর হালটা কী হয় তখন দেখে নিও। তা এখনো আইনকানুন বলে কিছু আছে, চাষেরও নিয়ম আছে। এখন পর্যন্ত ফসল ভাগ হয় আধাআধি। পুঁজিও খাটাও তবে আধাআধি, এতোকাল তাই তো চলে আসছে। লাঙল গোরু নাই, ঠিক আছে ভাড়া বাবদ আধাআধি পয়সা দিয়ে বর্গা নাও।
আবদুল আজিজের কথা শেষ হলে আবদুল কাদের মুখ খোলে, ভাইজান, আধিয়ারের সাথে নগদ পয়সার কারবার কী চলে নাকি? ফসল উঠলে ওর ভাগ থেকে ক্যাটা নিলেই হবি। তমিজ পয়সা পায় কোথায়?
জগদীশ সাহার মোকাম এখান থেকে কয় দিনের রাস্তা? আজিজ পরামর্শ দেয়, হাঁটার কষ্ট হলে না হয় সাইকেলটা দে।
জগদীশ সাহার নাম মুনসির ইশারায় কি মাথার ওপর আমগাছের ডালপাতার আলোছায়ার কারসাজিতে তমিজের সামনে একটা ভাঙাচোরা গোরুর আদল পায়, গলায় বাঁধা দড়ির টানে সেটা কেবলি সামনের দিকে চলে। দড়ি-ধরা হাতের মালিককে দেখা যায় না, কিংবা দেখার সাহস তমিজের হয় না বলে ওটা রয়ে যায় তার চোখের আড়ালেই। তমিজের বাপের আসল গোরু তবু সেদিন বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলো, এখন এ বেটা ভূতুড়ে গোরুর সেই টানটাও নাই। এর খুরের লাথিতে নিজের টলোমলো করা পা সামলাতে তমিজের প্রাণপণ জোর খাটাতে হয়। তমিজের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি খানিকটা এসে বর্তায় কাদেরের ঠোঁটে, সেই তেজে তার জিভ বলকায়, হিন্দু জমিদার আর হিন্দু মহাজনের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই তো লীগের পাকিস্তানের লড়াই। হিন্দু মহাজন মুসলমান চাষার রক্ত চুষে শেষ করে ফেললো। আর আপনি এখন এই ছোঁড়াটাকে পাঠাবেন সেই মহাজনের বাড়ি? নাঃ। ওকে জমি বর্গা দিয়ে কাজ নাই। গলার ঝাঝ দ্বিগুণ করে তমিজকে সে নির্দেশ দেয়, তমিজ, তুই যা। জমি তোক দেওয়া যাবি না। মাঝির বেটা, যা, খালে বিলে মাছ ধরা খা। যা ভাগ।
আঃ। তোমরা কী শুরু করলা? বিলের প্রসঙ্গ ওঠায় শরাফত তাড়াতাড়ি করে কথা বলে। বিল থেকে সরিয়ে রাখার জন্যেই মাঝিদের সে জমি বর্গা দেওয়ায় আগ্রহী। ছেলেটা আবার সেই বিলের কথাই তুললো। ছেলেদের কথা কাটাকাটিতে লোকটা মাথা গলায় না। খানকা ঘরের একটু উঁচু বারান্দায় আধশোয়া হয়ে সে বসেছিলো ইজি চেয়ারের খয়েরি ও সবুজ ভোরা-কাটা ক্যানভাসে। কয়েক গজের মধ্যে আমগাছের নিচে হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আজিজ এবং বেঞ্চে বসে কথা বলে কাদের। শরাফত তাদের কথা ঠিকই শুনছিলো, তবে তার চোখ ছিলো বাড়ির সীমানা পেরিয়ে কাৎলাহার বিলের ওপারে নিজগিরিরডাঙার চাষাদের গ্রামের পেছনে বৃষ্টির পানিতে ছপছপ-করা জমির দিকে। বকের ঝাঁকের ফেলে-আসা অর্জুনগাছের কয়েক গজ পরেই কামারদের ছেড়ে-যাওয়া ভিটা চাষ করে দেড় বিঘা জমিতে এবার কলা লাগানো হয়েছে। এই গোটা এলাকার এতো জায়গা নিয়ে কলার আবাদ এই প্রথম করলো শরাফত মণ্ডলই। সারি সারি শবরি কলার গাছে কলাপাতা রঙ ভাদ্রের ঘোলা রোদে একটু ময়লা দেখালেও শরাফত একটুও দমে না। কারণ চশমা ছাড়াই কলাপাতার আসল রঙ সে দিব্যি দেখতে পায়। ওপারের রোদবৃষ্টি, গাছপালা, আলোছায়া, জমিজমা, মানুষজন, গোরুবাছুর সবই তার খুব চেনা। আজ এপারের বাসেন্দা হলে কী হয়, জন্ম তো তার ওপারেই, দলিল দস্তাবেজে তার সাকিন লেখা থাকে : গ্রাম—নিজগিরিরডাঙা। আবদুল আজিজ আজকাল সব দলিলে লিখতে শুরু করেছে : হাল সাকিন–গিরিরডাঙা। কালাহার বিল পুরষ্ট হতে শুরু হওয়ার অনেক আগেই শরিকদের সঙ্গে গোলমাল করে এপারে এসে ঘর তোলে শরাফতের বাপ। শরাফত তখন একেবারেই শিশু। সেবার কী যেন হলো, আল্লার ইচ্ছা বুঝতে পারে কে?-কালাহারে মাছ মরলো একেবারে ঝাঁক বেঁধে। গিরিরডাঙার মাঝিদের জালে কেবল মরা মাছই ওঠে, বিলের পচা মাছ খেয়ে মাঝিপাড়ায় কলেরা লাগলো। অভাবে পড়ে কয়েকজন মাঝি নিজেদের বাড়িঘর জমিজমা বেচে দিলে শরাফতের বাপ কিছু জমি কিনে এপারে চলে আসে। বাপের কি পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে কিংবা জমি বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে শরাফত যে এতোক্ষণ চুপচাপ ছিলো তা কিন্তু নয়। বিলের ওপারে জমি তার কম নাই। খোদার রহমতে পূর্বপুরুষের গ্রামে সে কম জমি করে নি। মোষের দিঘির দক্ষিণে জমিটা তার বাপের আমলের, বাপের আমল থেকে জমিটা নিজেরাই চাষ। করেছে, বছর পাঁচেক হলো অর্ধেক দিয়েছে হুরমতুল্লাকে বর্গা করতে। মোষের দিঘির ধার ঘেঁষে সবটাই জমিদারের খাস জমি, পতিত হয়েই রয়েছে। উত্তরে হুরমতুল্লার ভিটা, ভিটার সঙ্গে লাগোয়া বিঘা তিনেক জমি হুরমতুল্লা এখনো হাতছাড়া করে নি। তার ভিটার দক্ষিণে ভবানীর মাঠ, প্রায় আধ ক্রোশ জায়গা খা খা পড়ে থাকে। ওপারের গাঁয়ের গোরু চরাবার জায়গা ওটা, জমিদার কাউকে পত্তন দেয় না। এর পরই মণ্ডলের এক দাগে ১২ বিঘা জমি, একটা জলা, তারপর ফের কামারপাড়ায় কেনা তার চার বিঘা জমি। বিলের দক্ষিণে সাত দাগে তার আটচল্লিশ বিঘা জমি, এর বেশিরভাগ বর্গা করে হামিদ সাকিদার। গিরিরডাঙায় তার জমি একেবারে কম নয়, কিন্তু সেগুলো বড়ো এলোমেলো। মাঝির জাত জমি আর গুছিয়ে করবে কী করে? এদিকে সস্তায় পেলে মণ্ডল জমি ছাড়ে না, তবে তার মনোযোগটা নিজগিরিরডাঙার জমির দিকেই বেশি। হামিদ সাকিদারের ওপর বেশ ভরসা করা যায়। ওপারের উত্তরের জমিও অর্ধেকটা নিজে লোক দিয়ে চাষ করার ব্যবস্থা আগের মতোই রেখে বাকিটা হুরমতুল্লাকে বর্গা দিলে ছেলেরা মোটেই সায় দেয় নি। তাদের কথা, হামিদ সাকিদারই করুক। কিন্তু শরাফতের হিসাব অন্যরকম, নিজের পূর্বপুরুষের গ্রামে প্রজা একটা বাড়লো। তা ছাড়া ভিটার কাছাকাছি বলে নিজের অল্প জমির সঙ্গে এই জমিটার যত্ন হুরমতুল্লা একটু বেশিই নেবে। আবার নিজের দূর সম্পর্কের আত্মীয় এই মানুষটাকে বশে রাখা যাবে। কিন্তু জমির বাকিটা হুরমতুল্লা এতো চাইলেও তাকে দিলো না কেন তা শরাফতুই জানে। তবে মোষের দিঘির উত্তরের জমি, পুবের জমি ও পশ্চিমের জমি পত্তন পেলে এটা হয়তো সে হুরমতকেই দেবে। মোষের দিঘির ঘেঁষা জমিগুলো নিয়ে গতবার পোড়াদহের মেলায় নায়েববাবুর সঙ্গে শরাফতের একটু আলাপও হয়েছিলো। আশাও পাওয়া গেছে। খাস জমি রাখার ব্যাপারে জমিদারবাবুর আগ্রহ নাকি দিন দিন কমে আসছে। ছেলেরা তার কলকাতা থেকে নড়তেই চায় না। কলকাতাতেই ব্যবসা করার নাম করে জমিদারি থেকে টাকা সরানো ছাড়া জমিদারিতে তাদের কোনো আগ্রহই নাই। নায়েববাবু বলে, বিষয় সম্পত্তিতে বাবুও উদাসীন হয়ে উঠেছে, এটাকে নায়েববাবু বৈরাগ্যই বলতে চায়। শুনে উত্তেজনা ও উৎসাহে শরাফত পায়ের গতি আর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। তবে মেলার ভেতর হাঁটতে হাঁটতে পায়ের তাল সে রাখে হুঁশিয়ার হয়েই। দুদিন পর পনেরো সেরি দুটো রুই মাছ আর হাতিবান্ধার তিন হাঁড়ি দৈ নিয়ে লাঠিডাঙার কাচারিতে নায়েববাবুর সঙ্গে দেখা করে খুব হুশিয়ার হয়ে মোষের দিঘি পত্তন নেওয়ার কথা তোলে। নায়েববাবুর হাবেভাবে বোঝা যায় কিছু খরচপাতি করলে ওটা পাওয়া যেতে পারে। পেলে দিঘির চারপাশ মিলে এক দাগে বিঘা বিশেক জমি শরাফতের দখলে আসে। জোত এরকম এক দাগে হলে হিসাব রাখতে সুবিধা, জমিতে গিয়ে চোখও জুড়ায়। ওদিকে দক্ষিণে অর্জুনগাছের একটু ওপাশে কামারপাড়ার অনেকটাই শরাফত কিনে ফেলেছে। কেবল দশরথ আর নারদ আর ওদিকে গৌরাঙ্গ আট বিঘা জমি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে। ওরা উঠে গেলেই ওখানে এক দাগে সতেরো বিঘা জমি হয়। আহা! তা হলে নিজের বাপের গ্রামের অর্ধেকের বেশির মালিক হতে পারে সে।এখন তার ছেলেরা যদি সামান্য এক মাঝির বেটাকে জমি বর্গা দেওয়া নিয়ে এতো তর্ক করে তো সম্পত্তি রাখতে পারবে এরা? ভাইয়ে ভাইয়ে তর্কাতর্কি মনোমালিন্যে পৌঁছুতে কতোক্ষণ? একেক দাগে বিঘার পর বিঘা জমির সম্ভাবনা আর ছেলেদের বিবাদের আশঙ্কা তাকে বঞ্চিত করছিলো ইজি চেয়ারের নিরঙ্কুশ আরাম। থেকে এবং একই সঙ্গে তাকে বাধ্য করছিলো চুপ করে থাকতে। নইলে তার সামনেই তার নিজের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আলোচনা কি ঝগড়াঝাটি তার সহ্য করার কথা নয়। কিছু না হোক, গোরু দুটোর মুখের সামনে খড়ের কুচির পরিমাণ কমে এসেছে। এবং কাঁঠালতলায় বাঁশের বাতায় ঘেরা মাটির চারিতে মাড়নুন মেশানো পানি থেকে বকনাটা বারবার মুখ তুলে নিচ্ছে, এসব ব্যাপারে রাখাল ছোঁড়াটাকে অন্তত বার কয়েক ধমক দিতোই। ধমকের কুচি লাগতো তার ছেলেদের গায়েও। কিন্তু শরাফত হঠাৎ করে এতোটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, ইজিচেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে সে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে, জবান যখন দেওয়া হছে, জমি তমিজকেই দেওয়া লাগে।
এই সিদ্ধান্ত শরাফত নিয়েছে ছেলেদের মুখের দিকে চেয়ে নয়। বড়ো ছেলেটা সুযোগ পেলেই আইন নিয়ে তড়পায়। বর্গাচাষাদের সঙ্গে এতে আইন তড়পালে চলে না। জোতজমি ঠিক রাখতে হলে, সম্পত্তি বাড়াতে হলে কখন কী করতে হয় তা আগে থেকেই কোথাও ঠিক করা থাকে না। আবদুল আজিজ রাগ করতেপারে; কিন্তু কয়েক বছরের সরকারি চাকরি তার রাগ পোষার ক্ষমতাকে অনেকটা নিংড়ে ফেলেছে। এই ছেলেকে সামাল দেওয়া শরাফতের কাছে ডালভাত। সে বরং কাদেরের একটা ভুলকে ভেঙে দিতে বেশি মনোযোগ দেয়, কাদের, শোনো, টাকা লগ্নি করা হলো জগদীশের পেশা, এই ব্যবসায় না গেলে ওর বাপের লগ্নি করা টাকাও তো উদ্ধার করবার পারতো না। এটাই হলো ব্যবসা, ব্যবসার ভালোমন্দ দেখলে চলে? তোমরা যদি কও, হিন্দু মহাজনের টাকা নেওয়া হবি না, তা হলে মানুষ যাবি কুটি? আজই জগদীশ টাকা লগ্নি করা বন্ধ করে তো কালই মেলা মানুষ না খায়া মরবি। কার্তিক মাসে মানুষের পেট তো চালায় জগদীশই।
তার সুদটা তোলে কীভাবে তাও তো জানেন।
ওটা ওর ব্যবসা। জানা শুন্যাই মানুষ টাকা লেয়। জগদীশের ধর্মেও তো সুদ খাওয়া পাপের কাম লয়।
আবদুল কাদেরের মৌন যে সম্মতির লক্ষণ নয় এটা জেনেও শরাফত মণ্ডল বিরক্ত হয় না। ছোটো ছেলের পাগলামিগুলোকে প্রশ্রয় দিতে তার ভালোই লাগে। বংশের এই ছেলেটাই বছর তিনেক কলেজে আসা যাওয়া করেছে। দুই চান্সে আই এ পাস করে বি এ পড়ার বায়না ধরেছিলো। কিন্তু তা হলে তাকে যেতে হয় রাজশাহী। রাজশাহী যাওয়া মানে মাসে মাসে টাকা গোনা তো আছেই, তা ছাড়া ছেলেকে নাগালের বাইরে। ছেড়ে দেওয়া হয়। যেভাবে সভাসমিতি শুরু করেছে দূরে পড়তে গেলে পড়াশোনা সে ছেড়েই দিতো। তবে এখন বাড়ির ভাত খেয়ে যতো খুশি সভা করে বেড়াক শরাফতের আপত্তি নাই। জেলার নেতারা গোলাবাড়ি এলে তার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে, তাদের বাড়িতেও আসে। দিনকাল যা পড়ছে এসব ছাড়া আর গতি নাই। গোলাবাড়িতে কেরোসিনের দোকানটা দেওয়ার বুদ্ধি ওর মাথায় এলো; সে তো এইসব যোগাযোগের ফলেই। আবার গ্রামের গরিব ছোটোলোকদের খাতির করতেও ছেলেটা তার বেশ পটু। এটার দরকার কম নয়। আবদুল আজিজ বলুক আর নাই বলুক, শরাফত ঠিকই জানে, অবস্থা ওদিকে সুবিধার নয়। আইনকানুনের ধার বেশি ধারলে শেষে সবই ফসকে যাবে। শরাফতকে সবই বিবেচনা করতে হয়। কাদের তমিজকে কথা দিয়েছে, তাকে এতোদিন আশায় আশায় রেখে এখন ফিরিয়ে দিলে ছোঁড়াটা হয় কাৎলাহার বিলে মাছ, চুরি শুরু করবে, চুরি করতে করতেই একদিন বিলের হক দাবি করে বসবে। নইলে সে চলে যাবে খিয়ারে। খিয়ারের চাষাদের বেয়াদবি দেখতে দেখতে তারও মাথাটা বিগড়ে যাবে না কে বলতে পারে?
শরাফত বলে, বুলুর জমি এখন দেওয়ার দরকার নাই। তমিজ বরং বিলের ওপারে মমাষের দিঘির কাছে হুরমতুল্লার পাশের জমিটা বর্গা করুক। হুরমতুল্লার বাড়িতে মণ্ডলের গোরু লাঙল মই জোয়াল সব থাকবে, তমিজ সব ব্যবহার করবে। তবে যাই নিক, সব কিছুর দাম ধরে ফসলেই সে শোধ করবে ধান কাটার পর। তবে সেখানে কয়েক মাসের হিসাবে কিছু লাভ শরাফতকে দিতে হবে। মুসলমান বলে সুদ সে নেবে না, কিন্তু মুনাফা নিলে কাদের নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না।
সুদ নিতে মুসলমানের অসুবিধা আছে কি নাই, তা নিয়ে আবদুল কাদের মাথা ঘামায় না। সে তো আর মাদ্রাসায় পড়া কাঠমোল্লা নয়, রীতিমতো কলেজে পড়ে আই এ পাস করেছে, তার মধ্যে ওসব গোঁড়ামি থাকবে কেন? টাউনে মুসলিম লীগ অফিসে কি সিরইলে ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে কি ঝাউতলায় সাদেক উকিলের বৈঠকখানায় পাকিস্তানের আলাপ একবার শুরু হলে কতো নামাজের ওয়াক্ত কোন দিক দিয়ে চলে যায় কেউ খেয়াল করে না। আবদুল কাদেরের সহ্য হয় না হিন্দুদের জুলুম। এর সঙ্গে মুসলমানদের হারাম হালালের সম্পর্ক কী? কিন্তু এসব কথা সাদেক উকিল কি ইসমাইল হোসেনের মতো গুছিয়ে বলা কাদেরের সাধ্যের বাইরে।
তার আমতা আমতা কথা এবং আজিজের উসখুস-করা নীরবতা অগ্রাহ্য করে শরাফত বলে, তমিজ, ভালো জমিখান তোক দিলাম। বাপের আমল থ্যাকা ঐ জমি নিজেরা চাষ করিছি। উঁচা ভাঙা জমি, আমনের ফসল হবি ভালো। তার বাপের আমলে গোবর ছাড়া আর কোনো সার ছিলো না, গোবর ছাড়া অন্য সার দেওয়াকে তারা গণ্য করেছে শুনা বলে। তো তার দাদার আমলে ওই জমিতে একেক বিঘা জমিতে ধান উঠেছে ছয় মণ, সাড়ে ছয় মণ। বাপজান লিজে লাঙল ধরলে সাড়ে সাত মণ ধান না তুল্যা ছাড়ে নাই।
তাদের দাদার নিজের হাত লাঙল ধরার বিবরণ আবদুল আজিজ বা আবদুল কাদের উপভোগ করে না। আজিজ ছোটোখাটো হলেও সরকারি চাকরি করে, শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সঙ্গে তার ওঠাবসা, মাত্র দুই পুরুষ আগে মাঠে নিজের হাতে লাঙল ধরার কথা শুনলে তারা ওর দিকে তাকাবে। আর তাদের মধ্যে যাদের বাপেরা এখনো ভোর হতে না হতে লাঙল ঠেলতে শুরু করে তারা তো এই নিয়ে আজিজকে পাকেপ্রকারে টিটকিরিই দেবে।
তবে বিরক্ত হবার সুযোগ কাদেরের কম। তমিজকে জমি বর্গা দেওয়ায় বাপের প্রতি সে গদগদচিত্ত। তমিজটা এখন তার বশেই থাকবে। গিরিরডাঙায় মাঝিদের দাপট এখনো কম নয়। মাঝিদের মধ্যে এই তমিজটাই গোলাবাড়ি গেলে একবার না একবার তার দোকানে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে, লীগের ছেলেদের কথাবার্তা মন দিয়ে শোনে। একে দিয়েই মাঝিপাড়াটা কাদের নিজের দিকে টানতে পারবে। আবার দলের নেতাদের সামনে সে দাখেল করতে পারবে তমিজকে, এরকম কর্মী এই এলাকায় আর পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া, এসব মাঝি আর চাষা আর কলুদের মধ্যে ভেদাভেদ রাখলে পাকিস্তানের ডাকে সাড়া দেবে কে? সেখানে তার দাদা পরদাদার লাঙল ধরার কথায় সংকোচ করার কী আছে? তবু হালুয়া চাষা দাদা সম্বন্ধে বাপের স্মৃতিচারণে সেও অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করে। বাপ যে তাদের আরো কততদূর নিয়ে যায়, বংশকে নামিয়ে আনে। কোন পর্যায়ে এই নিয়ে দুই ভাইই কাতর হয়ে পড়লে বাড়ির ভেতর থেকে শরাফতের দ্বিতীয় বিবির ক্যা গো, বেলা গেলো কোটে, এখনো তোমরা ড়ুব দিলা না, ভাত খাবা কখন গো?—এই তাগাদা এসে আবদুল আজিজ ও আবদুল কাদেরকে উদ্ধার করে।