০৬. নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে শক্তি ব্যবহারের ইতিহাস–এখানে শক্তি বলতে রাজনৈতিক শক্তি, সামাজিক শক্তি বা আধ্যাত্মিক শক্তির কথা বলা হচ্ছে না, এখানে শক্তি বলতে বোঝানো হচ্ছে বিদ্যুৎ বা তাপ এ ধরনের শক্তি। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে যে জাতি যত উন্নত খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই জাতি তত বেশি শক্তি–আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করছে। বৈদ্যুতিক শক্তি পাওয়ার জন্যে জেনারেটর বসাতে হয়, জেনারেটর চালানোর জন্যে দরকার জ্বালানি। সেই জ্বালানির বেশিরভাগই হচ্ছে তেল আর গ্যাস। তেল কিংবা গ্যাস পোড়ালে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যায়, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ার অর্থ হচ্ছে “গ্রীন হাউস এফেক্ট”, যার কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যায়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া। আর যখন সত্যি সত্যি সেটা ঘটবে তখন সবার আগে বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল পানির নিচে ডুবে যাবে!
সেজন্য কেউ বৈদ্যুতিক শক্তি তৈরি করা বন্ধ করে দেবে না, যতদিন যাবে তত বেশি বৈদ্যুতিক শক্তি এই পৃথিবীতে তৈরি হতে থাকবে। তবে সবাই চেষ্টা করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড না বাড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করতে, আর সেই তালিকায় সবার উপর হচ্ছে নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র। এই শক্তি হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করা যায় কোনো কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ না করে। এটুকু পড়ে একজনের ধারণা হতে পারে যে এখন সবারই উচিত অন্য কোনো শক্তি কেন্দ্র তৈরি না করে শুধুমাত্র নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না, তার কারণ নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের পক্ষে যেরকম জোরালো যুক্তি আছে তার বিপক্ষেও ঠিক সেরকম জোরালো যুক্তি আছে। তার মাঝে সবচেয়ে কঠিন যুক্তিটি হচ্ছে নিউক্লিয়ার বর্জ্য দিয়ে পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করার আশঙ্কা। নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র থেকে যে নিউক্লিয়ার বর্জ্য তৈরি হয় সেগুলো তেজস্ক্রিয় এবং এর তেজস্ক্রিয়তা কমে সহনীয় পর্যায়ে আসতে কমপক্ষে দশ হাজার বছরের প্রয়োজন। কাজেই নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসা তেজস্ক্রিয় বর্জকে কমপক্ষে দশ হাজার বৎসর কোনো একটা নিরাপদ জায়গায় বন্ধ করে রাখতে হবে। পৃথিবীর মানুষ এখনো কোনো কিছু তৈরি করে নি যেটা দশ হাজার বৎসর টিকে আছে–তাই আমরা জানি না যে ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়গুলো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখা আছে সেগুলো কোনোভাবে বের হয়ে এসে আমাদের পরিচিত, পৃথিবীটাকে একটা বিভীষিকাময় জগতে পাল্টে দেবে কী না। আমরা যেন আরাম-আয়েশে বেঁচে থাকতে পারি সেজন্যে কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটা বিপদের মুখে ঠেলে দেবার অধিকার কী আমাদের আছে?
শুধু যে ভবিষ্যতের বিপদের ঝুঁকি তা নয়, এই মুহর্তেও কিন্তু বিপদের ঝুঁকি রয়েছে। অতি সাম্প্রতিককালে রাশিয়ার চেরনোবিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি মাইল আইল্যান্ডে নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাশিয়ার চেরনোবিল শহরটিকেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হয়েছে, সেখান থেকে যে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বের হয়েছে সেটা শুধু চেরনোবিল বা রাশিয়াতে নয় সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে একথা সত্যি একটা প্রযুক্তিতে ঝুঁকি থাকে বলেই কিন্তু মানুষ কখনো সেই প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধ করে দেয় না। সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় গাড়ি এক্সিডেন্টে কিন্তু সে জন্যে আমরা কখনোই মানুষকে গাড়িতে ওঠা বন্ধ করতে দেখি না। একটা প্লেন দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ ভয়াবহ আতঙ্ক অনুভব করে। মাঝে মাঝেই প্লেন দুর্ঘটনা ঘটে, শত শত মানুষ মারা যায় কিন্তু তারপরেও সারা পৃথিবীর আকাশে প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার প্লেন উড়ছে। ঠিক সেরকম নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে বিপদের ঝুঁকি আছে তারপরেও মানুষ নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র তৈরি করছে। নূতন নূতন প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে আর মানুষ একটু একটু করে বিপদের ঝুঁকি কমিয়ে আনছে।
সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রায় সাড়ে চারশত নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র আছে আর এই শক্তি কেন্দ্রগুলো পুরো পৃথিবীর শক্তির চাহিদার 15 শতাংশ পূরণ করে। কোনো কোনো দেশ নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রকে খুব আন্তরিকতার সাথে নিয়েছে। ফ্রান্স হচ্ছে সেরকম একটি উদাহরণ, তাদের দেশের বিদ্যুতের চাহিদার 77%-ই আসে নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র থেকে। আমাদের পাশের দেশ ভারত যদিও তাদের শক্তির চাহিদার মাত্র 2 শতাংশ নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র থেকে পায় কিন্তু তারপরেও সেটির একটি আলাদা গুরুত্ব আছে, কারণ তারা নিজেদের বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদদের দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ধরনের প্রযুক্তি গড়ে তুলেছে।
নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র কেমন করে কাজ করে সেটা নিয়ে অনেকের ভেতরেই এক ধরনের কৌতূহল আছে। আসলে এর মূল ব্যাপারটি সেই প্রাচীন স্টিম জেনারেটরের মতো। 6.1 নং ছবির মাঝামাঝি দেখানো হয়েছে একটা জেনারেটর যেটা ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। জেনারেটর ঘোরানোর জন্যে রয়েছে টারবাইন, সেই টারবাইনটা ঘোরানো হয় উত্তপ্ত বাস্প দিয়ে। উত্তপ্ত বাষ্প তৈরি করার জন্যে একটি বয়লার থাকে, সেই বয়লারের পানি ফোঁটানো হয় সরাসরি নিউক্লিয়ার রি এক্টর থেকে আসা উত্তপ্ত পানি দিয়ে। নিউক্লিয়ার রি-এক্টরের ভেতর যে প্রচণ্ড উত্তাপের সৃষ্টি হয় এই পানি সেই উত্তাপকে সরিয়ে আনে, যদি কোনো কারণে উত্তাপটুকু সরিয়ে আনা না হয় মুহূর্তের মাঝে নিউক্লিয়ার রি-এক্টরটা গলে যাবে। কেউ যদি 6.1 নং ছবিটা একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাহলে মোটামুটি অনুমান করে নেবে টারবাইন ঘোরানোর পর যে বাষ্পটুকু রয়ে যায় সেটাকে আবার পানিতে রূপান্তর করার জন্যে অনেকটুকু তাপ সরিয়ে নিতে হবে, সে জন্যে রয়েছে বিশাল কুলিং টাওয়ার। ছবি দেখে যে বিষয়টি নিয়ে একটু প্রশ্ন থেকে যাবে, সেটি হচ্ছে নিউক্লিয়ার রি-এক্টরের ভেতরে যে কন্ট্রোল রডগুলো রয়েছে সেগুলো কী, আর সেটা কীভাবে নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের ভেতরে যে শক্তিটুকু তৈরি হয় সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সেটা বোঝার জন্যে আমাদের একটুখানি নিউক্লিয়ার পদার্থ বিজ্ঞান ঝালাই করে নিতে হবে। আমরা সবাই জানি সব কিছু তৈরি হয় পরমাণু দিয়ে আর পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। একটা পরমাণুর মোটামুটিভাবে পুরো ভরটুকুই থাকে নিউক্লিয়াসে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পরমাণুর তুলনায় সেটা খুবই ছোট। (সেটা কত ছোট সেটা বোঝানোর জন্যে বলা যায় একটা মানুষকে যদি চাপ দিয়ে তার পরমাণুকে গুঁড়িয়ে নিউক্লিয়াসের মাঝে ঠেসে নিয়ে আসা যায় তাহলে সেই মানুষটিকে আর খালি চোখে দেখা যাবে না, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে!) কিছু কিছু মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসের একটা বিশেষত্ব আছে। এমনিতে সেটা মোটামুটি স্থিতিশীল কিন্তু যদি কোনোভাবে তার ভেতরে একটা নিউট্রন ঢুকিয়ে দেয়া যায় হঠাৎ করে সেটা অস্থিতিশীল হয়ে ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে পড়ে। (6.2 নং ছবি) শুরুতে নিউক্লিয়াসের যে ভর ছিল ভেঙে যাবার পর দেখা যায় সেই ভর কমে গেছে। যেটুকু ভর কমে গেছে সেই ভরটাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত E = mc^2 সূত্র অনুযায়ী শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে।
শুধুমাত্র এই ব্যাপারটা দিয়ে কিন্তু নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র বোঝা যাবে না, সেটা বোঝার জন্যে 6.2 নং ছল্টিা আরেকটু ভালো করে দেখতে হবে। এই ছবিটাতে দেখানো হয়েছে নিউক্লিয়াসটা যখন ভেঙে যাচ্ছে তখন টুকরোগুলোর মাঝে কিছু নিউট্রনও আছে। যদি এই বাড়তি নিউট্রনগুলো অন্য নিউক্লিয়াসের ভেতর ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেগুলোও ভেঙে নতুন শক্তি আর নতুন নিউট্রনের জন্ম দেবে, সেই নতুন নিউট্রন নতুন নিউক্লিয়াসে ঢুকে আরো নতুন নিউট্রনের জন্ম দেবে এবং এভাবে প্রক্রিয়াটা চলতেই থাকবে! সত্যি সত্যি যদি এই প্রক্রিয়াটা চালিয়ে যাওয়া যায় তাহলে একে বলে চেইন রি-একশান। নিউক্লিয়ার রি এক্টরের ভেতর এই চেইন রি-একশান চালু রাখতে হয়। ব্যাপারটি যত সহজে বলা হলো আসলে সেটা করা এত সহজ নয়। প্রধান কারণ নিউক্লিয়ার শক্তি দিতে পারে এরকম নিউক্লিয়াসের সংখ্যা হাতেগোনা। সবচেয়ে পরিচিতটি হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235। খনিতে যে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায় তার মাঝে বেশিরভাগ ইউরেনিয়াম 238, ইউরেনিয়াম 235 মাত্র 0.7 শতাংশ। নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে ব্যবহার করার জন্যে ইউরেনিয়াম 235-এর পরিমাণ বাড়িয়ে কমপক্ষে 2 থেকে 3 শতাংশ করতে হয় (নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর জন্যে সেটা হতে হয় 90 শতাংশ।)। কাজেই নিউক্লিয়ার রি-এক্টরের ভেতরে ইউরেনিয়াম 235 সমৃদ্ধ জ্বালানি রাখতে হয়। যখন চেইন রি-একশন শুরু হয় সেখান থেকে অচিন্তনীয় তাপ বের হতে শুরু করে। আমরা আগেই বলেছি চেইন রি-একশন চালু রাখার জন্যে নিউট্রনের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। যদি কোনো কারণে নিউট্রন সরবরাহ কমে যায় তাহলে চেইন রি-একশান বন্ধ হয়ে যাবে। যারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন কন্ট্রোল রডগুলো কী! এগুলো আর কিছুই নয়, নিউট্রনকে শোষণ করতে পারে এরকম কোনো মৌল–ক্যাডমিয়াম হচ্ছে তার একটি উদাহরণ। কাজেই নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ। ক্যাডমিয়ামের তৈরি কন্ট্রোল রডগুলো রি-এক্টরের যত ভেতরে ঢোকানো হবে, শক্তি তৈরি হবে তত কম। যত বাইরে আনা হবে শক্তি জন্ম হবে তত বেশি। ভুল করে কেউ যদি পুরোপুরি বাইরে নিয়ে আসে ঘটে যেতে পারে প্রচণ্ড বিপর্যয়–যেমনটি ঘটেছিল চেরনোবিলে!