নারীবাদের সহি সবক
পঁচিশ বছর আগেও নারীবাদ শব্দটা বাংলা ভাষায় ছিলো না। মোটামুটি তখনই বাঙালি নারীদের নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলাম, কিন্তু তাতে এ শব্দটা ব্যবহার করিনি। আমি। তখনো নারীদের উন্নতি বোঝানোর জন্যে যে-পরিভাষা চালু ছিলো, তা হলো: নারীস্বাধীনতা অথবা নারীমুক্তি। ‘নারীপ্রগতি’ এবং নারীদের আধুনিকতা’ কথা দুটোও আমি ব্যবহার করেছিলাম। আমার ধারণা ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে দু-একজন করে নারীবাদ শব্দটা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন। সাম্যবাদ, সমাজবাদ, পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাশিবাদ ইত্যাদির অনুকরণে ফেমিনিজমের অনুবাদ করা হয় নারীবাদ। ইংরেজিতে শব্দটা আসে ল্যাটিন ফ্যামিনা শব্দ থেকে, তার সঙ্গে ইজন্ম লাগিয়ে। সে যাই হোক, নারীবাদ ঠিক কী বস্তু সেটা আমাদের সবার কাছে দশ-পনেরো বছর আগেও পরিষ্কার ছিলো না, এখনো সম্ভবত নেই। এমন কি, যারা এ বিষয়ে লেখেন, তাদের সবার ধারণাও যে খুব পরিষ্কার, তা মনে হয় না। বস্তৃত, অনেকে এ শব্দটা ব্যবহার করেন ঢালাওভাবে–নারীমুক্তি অথবা নারীস্বাধীনতা–এই অর্থে।
ইংরেজিতে ১৮৩৭ সালে যখন এই শব্দটা প্ৰথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়, তখনো ঢালাওভাবেই ব্যবহৃত হয়েছিলো। নারীবাদ বললে তখন বোঝাতো নারীদের অধিকার আদায়ের অথবা তাদের উন্নতির আন্দোলন। কিন্তু এখন ফেমিনিজম কথাটার একটা বিশেষ তাৎপৰ্য আছে। নারীবাদেরও থাকা উচিত।
যাঁরা গরিবদের প্রতি দয়া করার কথা বলেন অথবা দাবি জানান গরিবদের অবস্থা উন্নত করার, তারা সবাই সমাজতন্ত্রী অথবা কমিউনিস্ট নন। কমিউনিজম এবং সমাজতন্ত্রের সঙ্গে একটা মতবাদ অথবা রাজনৈতিক ধারণার যোগ আছে। মানবিকতার কথা বললেই সমাজতান্ত্রিক অথবা কমিউনিষ্ট হওয়া যায় না; বরং সমাজতান্ত্রিক অথবা কমিউনিস্ট তাঁদেরই বলা যায়, নিজেদের যারা শোষিত একটি গোষ্ঠীর–প্রোলেটারিয়েট গোষ্ঠীর–সদস্য বলে চিহ্নিত করেন এবং পুঁজিবাদী শোষণ দূর করার উদ্দেশে একটা বিশেষ সমাধানে বিশ্বাস করেন। ফেমিনিজম অথবা নারীবাদও তেমনি। সত্যিকার অর্থে ফেমিনিস্ট সেই নারীরা, যারা নিজেদের গণ্য করেন। পুরুষদের হাতে নির্যাতিত নারীসমাজের একজন সদস্য হিশেবে। নারীদের অবস্থা উন্নত করার কথা বললেই তাই নারীবাদী বলা যায় না–বড়ো জোর তাদের বলা যায় নারী-দরদী। নারীবাদীকে তাঁর অধিকার এবং তা আদায় করার পন্থা সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
এক
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, পুরুষরা প্রধানত মাংসপেশী আর উপার্জনের ক্ষমতা দিয়ে প্রাচীন কাল থেকে নারীদের বন্দী করে রেখেছেন। বন্দী করে। রেখেছেন চার দেয়াল এবং পর্দার বেড়া তৈরি করে। তারপর সেই বন্দী নারীদেরই যথেচ্ছ শাসন ও শোষণ করেছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের এই বন্দীত্ব এবং নিচু অবস্থানকেই স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। ঐতিহ্যিক সমাজে এখনো নারীদের তুলনায় পুরুষরা উচ্চতর আসন অধিকার করে আছেন। এখনো পুরুষরা প্ৰায় সবাই বিশ্বাস করেন যে, নারীরা তাদের চেয়ে ছোটো–শারীরিক শক্তিতে তো বটেই, এমন কি, মননশক্তি, সাধারণ বুদ্ধি, ব্যবস্থাপনা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায়ও। যা আশ্চর্যের বিষয় তা হলো: মেয়েরা নিজেরাও একে স্বাভাবিক, এমন কি, ন্যায্য বলে মেনে নিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে নারীরাও বিনা তর্কে এই মূল্যবোধে বিশ্বাস করে এসেছেন এবং তাদের কন্যাদেরও তাদের শৈশব থেকে এটা মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই নারীপুরুষের ভেদ বজায় ছিলো এবং এখনো অনেকটাই আছে। ফলে লিঙ্গবৈষম্যকেই স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা হয়। এতে আরও মনে করা হয় যে, পুরুষরা নারীদের থেকে প্রাকৃতিকভাবেই শ্রেষ্ঠ এবং নারী ও পুরুষের ভিন্ন ভূমিকাই পালন করার কথা।
কেবল শারীরিক শক্তি এবং উপার্জনের ক্ষমতা দিয়েই নয়, নারীবাদীদের মতে, ধর্মের দোহাই দিয়েও পুরুষরা নারীদের নিমাবস্থানকে স্থায়ী করে রাখার চেষ্টা করেছেন। ধর্মের বিধানসমূহ বিশ্লেষণ করলে এই দাবির মধ্যে সত্যতা নেই–তা বলা যায় না। মনু যেভাবে নারীদের নিচু চোখে দেখেছেন এবং নারীদের সম্পর্কে যেবিধান দিয়েছেন, বর্তমান কালের ম্যাসকুলিষ্ট অর্থাৎ পুরুষবাদীরাও তা মেনে নিতে লজ্জা পাবেন। মনুর মতে, নারীদের অন্তঃকরণ নির্মল নয়; বেদস্মৃতিতে তাদের অধিকার নেই; তাঁরা ধৰ্মজ্ঞানবর্জিত; মিথ্যা পদাৰ্থ পুরুষ পেলেই তাঁরা সম্ভোগে মিলিত হতে চান; তাদের চিত্তের স্থিরতা নেই; পুরুষ দেখলেই তাদের মনে কামভাব জেগে ওঠে; শয্যা, আসন, ভূষণ, কাম, ক্ৰোধ, কুটিলতা এবং পরহিংসা তাদের সহজাত প্ৰবৃত্তি। নারীরা নরকের দ্বার এবং নরকের কীট।
খৃস্টধর্ম অনুসারেও নারীরা বহু পাপের উৎস। তাঁরা পুরুষদের তুলনায় নিকৃষ্ট। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে সন্তান জন্মদান, বাড়ি এবং স্বামীর। সে জন্যে ধর্মের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ নেই। এখনো খৃস্টধর্মের কোনো কোনো শাখা মহিলাদের ধর্ম প্রচারের ভূমিকা দিতে রাজি নয়। ইসলামেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় নিকৃষ্ট। পুরুষের তুলনায় তাদের মননশক্তিও কম। দুজন নারীর সাক্ষ্য তাই একজন পুরুষের সমান। এমন কথা চালু আছে যে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক স্বৰ্গ পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেছিলেন যে, নরকে যারা শাস্তি পাচ্ছে, তারা বেশির ভাগই নারী। নারীরা ধর্ম প্রচার করবে–এটাও ইসলামে প্রত্যাশিত নয়। মোট কথা, সব ধর্মেই নারীদের অনেক হেয় করে দেখা হয়েছে। অন্তত নারীরা যে পুরুষের তুলনায় নিকৃষ্ট-ধর্মে ধর্মে মারামারি থাকলেও এই ব্যাপারে সব ধর্মই একমত।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ধর্মপ্রচারকরা সবাই ছিলেন পুরুষ, সে জন্যে তাঁরা নারীদের হীনাবস্থাকেই ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে স্থায়িত্ব এবং দৈব মর্যাদা দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ নারীদের চিরকাল বশে রাখার জন্যেই পুরুষরা এসব ধমীয় অনুশাসন তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁর মতে, ধর্মপ্রচারকরা নারী হলে এসব বিধান হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।
মোট কথা, শারীরিক শক্তি, উপার্জন ক্ষমতা এবং ধর্মীয় বিধান–যে-প্রক্রিয়া দিয়েই হোক না কেন, পুরুষরা নারীদের চিরদিন নিজেদের তুলনায় ছোটো করে রেখেছেন এবং হেয় করে দেখেছেন। নারীরাও বিরোধিতা না-করে মুখ বুজে। সেই নির্যাতন এবং শোষণকে মেনে নিয়েছেন। এই মূল্যবোধ অস্বীকার করে পুরুষের মতো অধিকার লাভ করার আন্দোলন শুরু করা তাদের পক্ষে আদৌ সহজ ছিলো না। কারণ পুরুষরা খুশি মনে অথবা বিনা বাধায় তাদের উচ্চাসন এবং বর্ধিত অধিকার ছেড়ে দেবেন, এটা স্বাভাবিক নয়। সে অধিকার নারীদের সংগ্রাম করেই আদায় করতে হয়েছে। এ আন্দোলন বেশি দিন আগে শুরুও হয়নি।
গোড়াতে এ আন্দোলন ছিলো মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা-ও পুরুষরা সহজে দিতে চাননি। কারণ, প্রথমত তাঁরা বিশ্বাসই করতেন না যে, লেখাপড়া শেখার মতো মননশক্তি মেয়েদের আছে। কিন্তু যখন তাঁরা দেখলেন যে, নারীরা লেখাপড়া শিখতে পারেন, তখন তাঁরা আশঙ্কা করলেন যে, শিক্ষার সুযোগ দিলে মেয়েরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবেন। এই বঙ্গদেশে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজ বিশ্বাস করতো যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে নিৰ্ঘাৎ বিধবা হবেন। এমন কি, মহিলারাও এটা বিশ্বাস করতেন। তা ছাড়া, সমাজ মনে করতো। যে, শিক্ষা দিলে মহিলারা হবেন স্বামী এবং অন্য গুরুজনদের অবাধ্য। ঘরের কাজেও তাদের মন থাকবে না। সে জন্যে গোটা উনিশ শতক ধরে স্ত্রীশিক্ষা-বিরোধী শক্তি প্রবলভাবে কাজ করেছে। কেশব সেনের মতো প্ৰগতিশীল সমাজ-সংস্কারকও বলেছিলেন যে, বিদ্যালয়ে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, তার সবগুলো মেয়েদের উপযোগী নয়। যেমন অঙ্ক এবং বিজ্ঞান শেখালে মেয়েদের কমনীয়তা নষ্ট হতে পারে। স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে মুসলিম সমাজে বিরোধিতা ছিলো আরও বেশি। সে জন্যে বিশ শতকের প্রথম তিন দশক ধরে চেষ্টা করেও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বেশি। মুসলমান মেয়েকে তাঁর স্কুলে আনতে পারেননি।
মেয়েদের শিক্ষার প্রতি এই যে বিরোধিতা, তা কেবল ভারতবর্ষ অথবা অনুন্নত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও স্ত্রীশিক্ষা— বিশেষ করে নারীদের উচ্চশিক্ষা–সহজে প্ৰচলন করা যায়নি। এর বিরুদ্ধে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে নারীবাদীদের রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে। অক্সফোর্ড-কেমব্রিজও ১৯২০ এর দশকের আগে পর্যন্ত মেয়েদের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অধিকার স্বীকার করে নেয়নি। সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনো অধিকার ১৮৮৫ সালের আগে পর্যন্ত সে দেশে ছিলো না। ১৯২৮ সালের আগে পর্যন্ত ভোট দেওয়ার অধিকারও ছিলো না তাদের। শিক্ষা, সম্পত্তি এবং ভোটের অধিকার আদায় করার জন্যে উনিশ শতকের মধ্য ভাগ থেকে আরম্ভ করে বিশ শতকের প্রথম সিকি ভাগ পর্যন্ত নারীবাদীদের নানা ধরনের আন্দোলন করতে হয়েছে–আন্দোলন করতে হয়েছে সেই পুরুষ সমাজের বিরুদ্ধে যারা ঐ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও মনে করতেন, মেয়েদের মননশক্তি নেই অথবা থাকলেও আছে। পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। এই আন্দোলন করতে গিয়ে বিশ শতকেও নারীকর্মীদের কারাবাস করতে হয়েছে। শতাব্দীর শেষে এসেও তসলিমা নাসরিনের মতো নারীকর্মীকে নির্বাসনে যেতে হয়েছে।
শিক্ষা এবং ভোটাধিকার আদায় করার জন্যে যারা আন্দোলন করেছিলেন, তাঁদের বলা যেতে পারে প্রথম যুগের নারীবাদী। কিন্তু আজকের নারীবাদীদের চোখে তাঁরা নারী-জাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন, যথার্থভাবে নারীবাদী ছিলেন না। অত্যাধুনিক নারীবাদীরা এ ধরনের ন্যূনতম অধিকার ছাড়া সমাজ এবং সংসারে নারীদের অবস্থান সম্পর্কেই অনেক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।
সত্যি বলতে কি, আজও অনেক দেশে শিক্ষাদীক্ষায় মেয়েদের ন্যায্য অধিকার নেই। অথবা থাকলেও পুরুষ সমাজ এবং পুরুষ-শাসনে অন্ধ কিছু নারী সেই অধিকার দিতে চান না। বরং সেই অধিকার হরণ করতে চান। যেমন, কিছু কাল আগে আফগানিস্তানে মধ্যযুগীয় ধারণা নিয়ে যখন তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছিলো, তখন তারা মেয়েদের শিক্ষার অধিকার তো হরণ করেই ছিলো, এমন কি, যে-নারীরা শিক্ষিত ছিলেন, তাঁদের পর্দার আড়ালে ঠেলে দিয়ে তাঁদের শিক্ষাকে অস্বীকার করেছিলো। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, মহিলা ডাক্তারদের চিকিৎসা করার অধিকার পর্যন্ত তারা কেড়ে নিয়েছিলো। ইরানে আয়াতউল্লাহ খোমেনি এসেও মহিলাদের অন্তত এক প্ৰজন্ম পিছিয়ে দিয়েছেন। যে-ইরানী নারীরা রীতিমতো উচ্চশিক্ষা লাভ করে আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন, ইসলামী বিপ্লব-পরবর্তী নারীরা তার অনেকটাই বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন–পােশাকে, চলাফেরায় এবং পরিবারের বাইরে সামাজিক ভূমিকা পালন করায়। আজও সৌদী আরবের মতো কতোগুলো মুসলিম দেশে মেয়েদের ভোটাধিকার নেই। সৌদী আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানো পর্যন্ত নিষেধ। এ ধরনের বৈষম্য দূর করার ধারণা থেকেই নারীবাদী চিন্তার জন্ম হয়েছিলো।
এমন কি, নারীদের বাঁচার অধিকার নিয়েও কোনো কোনো সমাজে নারীকমীদের আন্দোলন করতে হয়। কারণ, পৃথিবীর বহু সমাজে এখনো পুত্ৰ সন্তানকে কন্যা সন্তানের চেয়ে বেশি বাঞ্ছিত বলে মনে করা হয়। আফ্রিকা এবং এশিয়ার বহু দেশ সম্পর্কেই এ কথা সত্য। এমন কি, ভারত অথবা চীনের মতো বেশ উন্নত দেশেও পুত্র এবং কন্যার মধ্যে এই ভেদ বজায় রয়েছে। ভারতের বহু জায়গায় কন্যা সন্তান মেরে ফেলার কথা প্রায়ই শোনা যায়। ভারতে নতুন যা ঘটছে, তা হলো: স্ক্যান করে যদি জানা যায় যে, গর্ভস্থ সন্তানটি কন্যা–তা হলে সেই মায়েরা গর্ভপাত করাচ্ছেন। আর, চীনে একটি মাত্র সন্তান রাখার আইন গৃহীত হওয়ার পর থেকে সেখানে ব্যাপক হারে কন্যা সন্তান হত্যার খবর অনেক বারই প্ৰকাশিত হয়েছে। বহু বছর ধরে এই রীতি চলার ফলে চীনের বহু জায়গায় এখন নারী-পুরুষের অনুপাতে সমতা নেই। অনেক জায়গায়। তাই বিয়ের জন্যে পাত্রী জোটানো একটা সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
দুই
নারীবাদের সূচনা
ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ছিলো সাম্য, মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্বের। এর সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে নারীরা ১৭৮০-র দশকের শেষ দিকে সমানাধিকার দাবি করেছিলেন। কিন্তু বিপ্লব থিতিয়ে এলে অল্পকালের মধ্যে এ দাবি তার তেজ হারিয়ে ফেলে। ফলে নেপোলিয়নের সময়ে যে-আইন প্রণীত হয়, তাতে এই অধিকার অগ্রাহ্য করা হয়। তার কয়েক দশক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন গৃহীত হয়, তখনো এই দাবি তোলা হয়েছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারে উদারপন্থী নেতারাও যথেষ্ট উদার হতে পারেননি।
সত্যিকারের নারীবাদী কণ্ঠ প্ৰথমে শোনা যায় মেরি ওলস্টোনক্রাফটের গ্রন্থে। নারীদের অধিকার সম্পর্কে তাঁর সেই বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো। ১৭৯২ সালে। এ গ্রন্থ নারীপুরুষ সবাইকেই ভাবিয়ে ছিলো তখন। কিন্তু এর পরিপ্রেক্ষিতে কোনো নারীবাদী আন্দোলন সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়নি, কারণ তার পরিবেশ তখনো তৈরি হয়নি। সেই আন্দোলনের সূচনা লক্ষ্য করি ১৮৪৮ সালে। তখন বেশ কিছু মার্কিন নারীকর্মী একটি সম্মেলনে নারীদের জন্যে অধিকতর সুযোগসুবিধার দাবি জানান নিউ ইয়র্ক শহরে। এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এলিজাবেথ স্ট্যানটন এবং লুক্রেশিয়া মট। তারা যে-ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাকে তাঁরা নারী স্বাধীনতার ঘোষণা বলেন। তাতে শিক্ষা ও ভোটের অধিকারসহ আইন, বাণিজ্যিক ও উপার্জনের সুযোগসুবিধা, বেতন ইত্যাদিতে নারীদের সমানাধিকার দাবি জানান তারা। বলা যেতে পারে নারীবাদের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় সেই সভায়। তারপর ইউরোপ হয়ে এখন সারা বিশ্বেই এই সচেতনতা কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে–যদিও তার মাত্রা এক-এক সমাজে এক-এক রকম। শিক্ষাদীক্ষায় যে-সমাজ যতো অগ্রসর এবং উন্নত, সে সমাজে নারীদের অধিকার ও সম্মান ততো বেশি স্বীকৃত হয়েছে। অনুন্নত সমাজে নারীরা এখনো পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছেন। জাতিসঙ্ঘ্য ১৯৫২ সালে নারীদের সমানাধিকারের দাবি স্বীকার করে নেয় নিউ ইয়র্কের ঘোষণায়। নিঃশর্তভাবে এতে নারী এবং পুরুষদের অধিকার সমান বলে স্বীকৃত হয়েছে। তা ছাড়া, বেইজিং সম্মেলনে নারীদের ক্ষমতায়নের ঘোষণাও দেওয়া হয় এক দশক আগে। তা সত্ত্বেও আজও বিশ্বের বহু দেশে নারীদের ন্যায্য এবং মৌলিক অধিকার গৃহীত হয়নি।
তিন
নারীবাদের বিভিন্ন শাখা
ধর্ম এবং কমিউনিজমের যেমন অনেকগুলো শাখা-প্ৰশাখা আছে, নারীবাদেরও তেমনি অনেকগুলো ধারা আছে। এক দল যাঁদের নারীবাদী বলে মনে করেন, অনেকে আবার তাঁদের আদৌ নারীবাদী বলে স্বীকারই করেন না। যেমন, তত্ত্বগতভাবে পুরুষদের পক্ষে নারীবাদী হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, একজন পুরুষ নিজেকে নির্যাতিত নারীসমাজের সদস্য হিশেবে চিহ্নিত করতে পারেন না। তিনি বড়ো জোর হতে পারেন নারী-দরদী। এই নারী-দরদী পুরুষরা নারীদের সমানাধিকারের কথা বললেও নির্যাতিত নারীসমাজের হয়ে পুরুষদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেননি। সুতরাং সত্যিকারের নারীবাদীরা এঁদের নারীবাদী বলে মেনে নিতে নারাজ। কিন্তু নারীজাগরণের ইতিহাস-লেখকদের অনেকে এই নারী-মুক্তির সমর্থক পুরুষদেরও নারীবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বঙ্গদেশে প্রথম যিনি নারী-জাগরণের কথা লিখিতভাবে প্ৰকাশ করেন, তিনি রামমোহন রায়। সেদিক দিয়ে তিনি বঙ্গদেশের প্রথম নারীবাদী। তার পর ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, দুৰ্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখ যে-সমাজসংস্কারকরা নারীদের শিক্ষা এবং মর্যাদা দানের জন্যে আন্দোলন করেন, তারাও সবাই সীমিত অর্থে নারীবাদী। কিন্তু আগেই বলেছি, বর্তমানে নারীবাদের যে-সংজ্ঞা প্রচলিত আছে, তাতে নারীবাদী বলে ঐরা বিবেচিত হতে পারেন না। শুধু এ জন্যে নয় যে, ঐরা পুরুষ; বরং এটাই বড়ো কারণ যে, এঁরা সবাই নারীদের সমানাধিকারের দাবিও করেননি। কেউ কেউ কেবল শিক্ষা দান করে এবং পর্দা থেকে অংশত মুক্ত করে নারীদের অবস্থা কিঞ্চিৎ উন্নত করার দাবি জানিয়েছিলেন। এমন কি, কেউ কেউ নারীদের উচ্চশিক্ষার বদলে সীমিত শিক্ষা দানের পক্ষপাতী ছিলেন।
যে-নারীদের সত্যিকারভাবে নারীবাদী বলে স্বীকার করা হয়, তাদের আমরা তিন ভাগে ভাগ করে দেখতে চাই–নরমপন্থী, মধ্যপন্থী আর চরমপন্থী। নরমপন্থীরা নারীদের ন্যূনতম অধিকার থাকলেই সন্তুষ্ট। চরমপন্থীরা পুরুষদের তুলনায় নারীদের শ্ৰেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। তা ছাড়া, তারা অনেকে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যে চরম ব্যবস্থা নিতে চান। এঁদের বলা যায়, জঙ্গী নারীবাদী। কিন্তু মধ্যপন্থীরা কেবল বিশ্বাস করেন যে, নারী আর পুরুষের অধিকার সমান। ইংরেজিতে দুই লিঙ্গের এই সমান অধিকারকে বলা হয়: জেন্ডার ইগালিটারিয়ানিজম। যারা এই মতে বিশ্বাসী তাদের চোখে নারীও মানুষ এবং পুরুষদের মতো সমান মানুষ। এঁরা এমনও বিশ্বাস করেন। যে, কেবল নারীদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে পুরুষের বিরোধিতা করলে তার ফলে এক ধরনের লিঙ্গবৈষম্য প্রকাশ পেতে পারে। এঁদের দাবি হলো ন্যূনতম। তাঁরা চান যে, শিক্ষা, উপার্জন, ঘরের কাজ, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা ইত্যাদিতে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার এবং সমান সুযোগ থাকবে।
বাঙালিদের মধ্য থেকে দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, নরমপন্থী নারীবাদী ছিলেন কৃষ্ণভাবিনী দাস। তিনি সমাজ-সংসারে নারীদের অধিকতর মর্যাদা থাকার কথা লিখেছিলেন তাঁর প্রথম গ্ৰন্থ ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলায় (১৮৮৫)। ইউরোপের নারীদের দেখে দেশের নারীদের দুর্দশা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন যে, আমাদের দেশের নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ কখনোই পান না। তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে তিনি তাই প্রথমেই তাদের ভালো শিক্ষা দানের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি নিজে মেয়েদের স্কুল খুলে সেখানে শিক্ষা দেওয়ার কাজও করেছিলেন। তা সত্ত্বেও নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদা পাবেন–এ কথা তিনি বলেননি।
অপর পক্ষে, তাঁর দু দশক পরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রথম সত্যিকারের নারীবাদী হিশেবে আত্মপ্ৰকাশ করেন। কারণ তিনি শুধু নারীদের অবস্থার উন্নত করতে হবে–এ কথা বলেননি, বরং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা রীতিমতো যুক্তি দিয়ে বলেছেন। সেই সঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, নারীদের কেবল উপার্জনের অধিকার থাকাই উচিত নয়, বরং তাদের অবশ্যই উপার্জন করতে হবে। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না-থাকলে তাঁরা সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ অথবা পরিবারে সমান সম্মান পেতে পারেন না।
সত্যি বলতে কি, ১৯০০/০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর মতিচূরের একাধিক প্ৰবন্ধ বিশ্লেষণ করলে তাঁকে শুধু সমানাধিকারবাদী বলা যায় না। নারীদের পুরুষের সমান হতে হবে–এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো আদর্শ দেখানো যাচ্ছে না বলেই তিনি লিখেছেন নারীদের হতে হবে পুরুষদের সমান। পুরুষরা যা যা করতে পারেন, তার মতে, নারীরা তার সবই করতে পারেন। এমন কি, পুরুষের মতো তারা মাঠে গিয়ে কৃষিকৰ্মও করতে পারেন। কিন্তু এর অতিরিক্ত তাদের এমন কিছু গুণ আছে, যা পুরুষদের নেই। তিনি যেভাবে এ কথা লিখেছেন, তা থেকে ধারণা হতে পারে যে, তার মতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা শ্ৰেষ্ঠ, যদিও সরাসরি তিনি এ কথা লেখেননি। সুলতানার স্বপ্ন গ্রন্থে তিনি পুরুষদের ঘরের কাজের দায়িত্ব দান করে নারীদের দিয়ে দেশ ও সমাজ পরিচালনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি নারী-শাসিত আদর্শ সমাজের যে-ছবি এঁকেছিলেন, তা পুরুষ শাসিত সমাজের তুলনায় অনেক উন্নত এবং সংঘাতবর্জিত। এ থেকেও মনে হতে পারে যে, তিনি নারীদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করতেন।
তবে তাঁর সম্পর্কে আরও একটা কথা বলা দরকার যে, তিনি জঙ্গী নারীবাদী ছিলেন না। কারণ নারীদের অবস্থা উন্নত করার কাজে সহায়তা করার জন্যে তিনি পুরুষদের আহবান জানিয়েছেন। তাঁদের তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, নারী এবং পুরুষ সমান না-হলে অসমান চাকাওয়ালা গাড়ির মতো গোটা সমাজই এক জায়গায় দাড়িয়ে ঘুরপাক খেতে থাকবে। সুতরাং পুরুষদের উচিত তাদের নিজেদের উন্নতির জন্যেই নারীদের শিক্ষিত করে তোলা। কিন্তু তিনি পুরুষদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নারীস্বাধীনতা অর্জনের কোনো সুপারিশ করেননি। সেদিক থেকে তিনি অত্যাধুনিক নারীবাদীদের মতো নন।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে তুলনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার আগে থেকে হওয়ায়, সেখানে নারীবাদী মনোভাব যতোটা দানা বেঁধেছে, মুসলমান-প্রধান বাংলাদেশে ততোটা বঁধেনি। মুসলমান সমাজে এমনিতেই রক্ষণশীলতা বেশি। তার ওপর, সেখানে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন হয় তুলনামূলকভাবে দেরিতে এবং বর্তমানে সেখানে নারীদের শিক্ষার হার পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় যথেষ্ট নিচুতে। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের মধ্যে নারীবাদী চিন্তা যাদের রচনায় বেশ লক্ষ্য করা যায়, তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন মহাশ্বেতা দেবী, কেতকী কুশারী ডাইসন, নবনীতা দেবসেন, সুস্মিতা সেন, বুলা চৌধুরী এবং সংযুক্তা দাশগুপ্ত। অপর্ণা সেনও চলচ্চিত্রে নারীবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তবে এরা কেউ কট্টর নারীবাদী নন। বাংলাদেশে পূরবী বসু, দিলারা হাশিম, মালেকা বেগম, সেলিনা হোসেন, সনিয়া আমিন প্ৰমুখের রচনায় নারীবাদী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সত্যিকারের নারীবাদের চেয়ে বাংলাদেশে বরং নারীদের অতি হীন অবস্থা থেকে খানিকটা উপরে টেনে তোলার মতো মনোভাব অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়।
নারীবাদীদের মধ্যে যাঁরা রীতিমতো জেহাদী, তাঁরা হলেন নারীশ্রেষ্ঠত্ববাদী। অর্থাৎ তাঁরা মনে করেন যে, নারীরা পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাদের মতে, পুরুষরা যা যা করতে পারেন, নারীরা তা সবই পারেন। তদুপরি, নৈতিক এবং অন্যান্য দিক দিয়ে পুরুষের থেকে তাদের অবস্থান উচ্চতর। যেমন, মেরি ডেলির মতে পুরুষদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গেলে বিশ্বের অবস্থা অনেক উন্নত হবে। এই নারীবাদীরা নারীদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অনেক সময়ে পুরুষদের হেয় এবং নিন্দা করেন। বলা বাহুল্য, পুরুষদের পক্ষে এই ধারণা অথবা দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এই নারীরাও তাই পুরুষদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না অথবা পুরুষদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করাও তাদের পক্ষে শক্ত। এঁরা অনেকে আবার পুরুষদের আন্তরিকভাবেই ঘূণা করেন। যৌনতার দিক দিয়েও এদের অনেকে তাই লেসবিয়ান অর্থাৎ নারীদেরই যৌনসঙ্গী হিশেবে নির্বাচন করেন।
চরমপন্থী নারীবাদের প্রত্যক্ষ শিকার হলেন পুরুষরা। এর ফলে দেখা দিতে পারে পুরুষ নির্যাতন এবং পুরুষদের প্রতি বৈষম্য। সে জন্যে মধ্যপন্থী নারীবাদীরা নারীশ্রেষ্ঠত্ববাদী ধারণা সমর্থন করেন না। তাঁরা বরং অনেকে মনে করেন যে, এই মত মেনে নিলে নারী ও পুরুষ সমান–এই ধারণাকে অস্বীকার করতে হয়। তাদের মতে, এ রকমের নারীবাদ এক ধরনের লিঙ্গবৈষম্যের কথা বলে। সুতরাং সেটা আদর্শ স্থানীয় হতে পারে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল সমাজে নারীশ্রেষ্ঠত্ববাদী থাকা প্ৰত্যাশিত নয়। তবে কেউ কেউ হয়তো তসলিমা নাসরিনের মতো নারীবাদীকে উগ্ৰ নারীবাদী বলতেও পারেন। নারীরা পুরুষদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ–এটা তসলিমা নাসরিন বিশ্বাস করেন কিনা, সেটা তাঁর রচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা না-গেলেও, তিনি যে পুরুষদের ঘৃণা করেন, সেটা অনেক সময়ে প্রকাশ পায়। কেবল তাই নয়, যেহেতু পুরুষরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীদের শাসন ও শোষণ করেছেন, সুতরাং তিনিও পুরুষদের ব্যবহার করে ছিবড়ের মতো ফেলে দিতে চান–এ কথা তিনি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন।
বস্তুত, নারীদের রক্ষা করার জন্যে অনেক সময়ে পুরুষদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা অসম্ভব নয়। বিশেষ করে গাৰ্হস্থ্য সহিংসতায় পুরুষদেরই সাধারণত দায়ী করা হয়। কর্মস্থানে যৌন হয়রানির অভিযোগ করলেও সাধারণত পুরুষদের বিশ্বাস না-করে নারীদেরই বিশ্বাস করা হয়। ধর্ষণের অভিযোগ করলেও সাধারণত পুরুষদেরই সন্দেহ করা হয়। বাংলাদেশের নারী নির্যাতন আইনে পুরুষদের প্রতি বৈষম্য দেখানো হয়েছে বলে আমার ধারণা। এ কথা ঠিক যে, নারীদের রক্ষা করার ব্যাপারে এ আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং এ ধরনের পুরুষ-প্রধান সমাজে নির্যাতনের হাত থেকে নারীদের বাঁচানোর জন্যে কঠোর আইন থাকাও উচিত, কিন্তু এই আইনের ফলে কখনো কখনো পুরুষরা অন্যায্যভাবে অসুবিধায় পড়তে পারেন। পশ্চিমা বিশ্বেও গাৰ্হস্থ্য সহিংসতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের দায়ী করা হলেও কখনো কখনো মহিলারাও দায়ী থাকেন। কিন্তু মহিলারা দায়ী এটা সাধারণত কেউ বিশ্বাস করে না।
নারীবাদ সবচেয়ে প্রবলভাবে প্ৰকাশ পেয়েছিলো। ১৯৭০-এর দশকে। তখন নারীরা নতুন-পাওয়া নারীবাদের স্বাদে বিশেষ উচ্ছসিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯০এর দশক থেকে তাদের মধ্যে এ সম্পর্কে নতুন করে ভাববার প্রবণতা দেখা দেয়। তাঁরা অনেকেই প্রশ্ন করেন, সংসারে সমানাধিকার পেলেই কি নারীরা সবচেয়ে সুখী হবেনা? ১৯৭০-এর দশক থেকে তারা কেউ কেউ এ অধিকার ভোগ করে লক্ষ্য করেছেন যে, সমানাধিকার পেলেই জীবনে সবচেয়ে বেশি পরিপূর্ণতা এবং সুখ লাভ করা যায় না। স্বামী অথবা পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে মারামারি করে অধিকার আদায় করেই সংসারে শান্তি আসে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে সংসারে দুঃখ নেমে আসে। বাস্তবের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা অনুভব করেন যে, সুখ এবং তৃপ্তি কেবল অধিকারের ওপর নির্ভর করে না। ক্ষমতার চেয়ে আনন্দ বড়ো। এই চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে আরম্ভ হয়। উত্তর-নারীবাদী বা পোষ্ট-ফেমিনিস্ট আন্দোলন। এখনো এই আন্দোলন চলছে। এখনো এই বিতর্ক শেষ হয়নি।
চার
নারীমুক্তির ধারা
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে নারীদের মধ্যে শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটে–যদিও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার অধিকার স্বীকার করে নেয়নি। এমন কি, চাকরি-বাকরিতেও তাদের অধিকার তেমন গৃহীত হয়নি। তখনো মেয়েদের চাকরি বললে বোঝাতো শিক্ষকতা আর নার্সিং। তারপর নারীরা ঘরের বাইরের কাজে ব্যাপক সংখ্যায় এগিয়ে আসেন প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে। তখন পুরুষদের অনেকেই গিয়েছিলেন যুদ্ধে। নিহতও হয়েছিলেন লাখ লাখ। ফলে কলকারখানা চালানো থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র ধরনের কাজে মহিলাদেরই অংশ নিতে হয়েছিলো। এমন কি, যুদ্ধের প্রস্তুতির কাজেও তাঁরা সাহায্য করেছিলেন। যুদ্ধের সময়ে এই দেশসেবার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯১৮ সালে তাদের ভোটের অধিকার না-দিলেও নির্বাচনে প্ৰতিযোগিতা করার অধিকার দেওয়া হয়। ভোটের অধিকার তারা লাভ করেন আরও দশ বছর পরে–১৯২৮ সালে। ইংল্যান্ডের ভোটাধিকারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমিলি ডেভিস, এমিলিন প্যাঙ্কহ্যাক্ট, এলিজাবেথ গ্যারেট অ্যান্ডারসন প্রমুখ নারীবাদী। এঁদের মধ্যে প্যাঙ্কহ্যাস্ট এই অধিকার আদায় করতে গিয়ে কারা বরণ করেছিলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকে চাকরি-করা মহিলার সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও তাদের চাকরির ক্ষেত্রে যদ্দূর সম্ভব বৈষম্য বজায় রাখে পুরুষ সমাজ। উচ্চপদে না-বসানো, একই কাজের জন্যে তাদের কম বেতন দেওয়া, কতোগুলো কাজের জন্যে তাদের অনুপযুক্ত বিবেচনা করা–এসব ছিলো সেই বৈষম্যের অংশ। কিন্তু নারীবাদীদের অব্যাহত আন্দোলনের ফলে গত বিশ-পাঁচিশ বছরে পুরুষরা তাদের অধিকার প্রায় সবটাই স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখনও ব্যবস্থাপনার কাজে অথবা কর্মস্থানে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে পুরুষ সমাজ রক্ষণশীলতা দেখায়। কিন্তু নারীদের অধিকার মেনে নিতে পুরুষ সমাজ বাধ্য হয়েছে। তা ছাড়া, নারীরা এখন এমন সব পেশায় নামছেন, যাতে আগে তাদের কল্পনা করা যেতো না। বাস, লরি, ট্রেন, বিমান ইত্যাদি চালানো, বাড়িঘর নির্মাণের মতো তথাকথিত পুরুষালি কাজ তাঁরা এখন করছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। এমন কি, এখন তাঁরা নিজেরাই ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং ক্রমবর্ধমান মাত্রায় তাতে সাফল্য লাভ করছেন।
ইংল্যান্ডের মতো পশ্চিমা অন্য দেশগুলোতেও মোটামুটি একই সময়ে নারীদের অধিকার বৃদ্ধির আন্দোলন চলেছে এবং তাতে সাফল্য এসেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভোটাধিকারের কথা বলা যেতে পারে। ইংল্যান্ডের অনেক আগেই তাদের উপনিবেশ অষ্ট্রেলিয়া এবং নিউজীল্যান্ডে ভোটাধিকার দেওয়া হয় ১৯০২ সালে। ইউরোপের মধ্যে সবার আগে নারীদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। ফিনল্যান্ডে–১৯০৬ সালে।
নরওয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, জাৰ্মেনি ও সুইডেন, আয়ারল্যান্ড এবং ফ্রান্স এই অধিকার মেনে নেয়। যথাক্রমে ১৯১৩, ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯১৯, ১৯২১ এবং ১৯৪৫ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নারীদের ভোটাধিকার দেয়। ১৯২০ সালে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভোটাধিকার স্বীকার করে নিলেও পশ্চিমা জগতে দীর্ঘকাল রাজনীতিতে নারীদের নেতৃত্ব পুরুষরা মেনে নেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজও কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। ইংল্যান্ডে প্রথম নারী প্ৰধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে— ভারতের পনেরো বছর পরে। ফ্রান্সের নারীরা খুব আধুনিক বলে তাদের খ্যাতি-অখ্যাতি দুইই আছে। কিন্তু সেই ফ্রান্সে এখনো কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। জাৰ্মেনিতে সবেমাত্ৰ মহিলা চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন।
বেশির ভাগ দেশে নারীদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হলেও পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব এখনো আনুপাতিকভাবে খুব কম, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে। ২০০৪ সালে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে পার্লামেন্টে নারী সদস্যদের হার ছিলো শতকরা ৩৬ থেকে ৪৫। তারপর আইসল্যান্ড, জার্মেনি, নেদারল্যান্ডস এবং স্পেনে শতকরা ৩০ থেকে ৩৬। কিন্তু যে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে নারীবাদের সূচনা হয়েছিলো, সে দু দেশে এই হার ছিলো যথাক্রমে ১৫ এবং ১৮।
বাঙালি নারীদের দিকে তাকালে লক্ষ্য করি যে, গত অর্ধ-শতাব্দীতে তাদের বৈপ্লবিক উন্নতি হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত শিক্ষা ধীরে ধীরে চালু হলেও, ডিগ্রি নিয়ে তারা পরিবারকে অলংকৃত করতেন। কাজে লাগাতেন না। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে তাঁরা অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসেন। বিশেষ করে দেশবিভাগ এবং দাঙ্গা-পরবর্তী পশ্চিম বঙ্গে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে মহিলারা রাতারাতি অর্থনৈতিক কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রক্ষণশীল সমাজে মহিলাদের পক্ষে অবাধ নির্বাচনে জয়ী হওয়া এখনো শক্ত।
উপার্জন, ভোটাধিকার ইত্যাদি ছাড়া নারীবাদীদের আর-একটা বড়ো দাবি হলো রান্নাবান্না-সহ ঘরের কাজে পুরুষদের সমান অংশ গ্রহণ। অর্থাৎ এ দায়িত্ব কেবল নারীদের নয়, পুরুষদেরও তা সমানভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু পুরুষ-সমাজ এর বিরোধিতা করে যুক্তি দেখায় যে, তারা উপার্জন করেন, সুতরাং নারীরা ঘরের কাজ করবেন— যেন উপার্জন করাটা ঘরের কাজের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। এর কারণ, পুরুষদের উপার্জন করার বিষয়টা যতোটা স্পষ্টভাবে সবার চোখে পড়ে, নারীদের ঘরের কাজ তেমন করে পড়ে না। ধরেই নেওয়া হয় যে, সেটা চাকরির মতো কোনো কঠিন কাজ নয়, তাতে কোনো যোগ্যতা লাগে না এবং সেটা জন্মগতভাবে নারীদেরই দায়িত্ব। পুরুষ মোট কতো উপার্জন করলেন, সেটা বেতনের হিশেবে নির্দিষ্টভাবে বলা যায়। কিন্তু নারীরা ঘরের কাজ বাবদে কোনো টাকা পয়সা পান না বলে এই কাজের কোনো সুনির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। সাম্প্রতিক কালে জাতিসজেঘর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘরের কাজের মূল্য নির্ধারণ করা হলে দেখা যাবে যে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি উপার্জন করেন। আর যে-নারীরা বাইরেও কাজ করেন, তাদের উপার্জন পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি। কেবল তাই নয়, জাতিসজ্যের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি সময় ধরে কাজ করেন।
আধুনিক কালে ঘরের কাজ নিয়ে স্বামীস্ত্রীর দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে দানা বেঁধেছে, বিশেষ করে পশ্চিমা জগতে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীশ্ৰী দুজনই চাকরি করেন। তেমন অবস্থায় রান্না করবেন কে? ঘরের আর-পাঁচটা কাজ করবেন কে? সন্তান লালনপালন করবেন কে? পুরুষরা এসব দায়িত্ব সহজে স্বীকার করে নেননি, এখনো সহজে স্বীকার করেন না। এখনো বহু পরিবারে মহিলারাই ঘরের কাজ পুরোপুরি করেন। অথবা বেশির ভাগ করেন। কিন্তু সংসারের শান্তি বজায় রাখার জন্যে পুরুষরা একটাদুটো করে এসব কাজে মহিলাদের সাহায্য করতে আরম্ভ করেছেন। এখন পশ্চিমা জগতে বহু পরিবারেই রান্নার খানিকটা স্বামীরা করেন। এমন কি, এ রকম পরিবারও আছে যেখানে রান্নার পুরো দায়িত্বই স্বামীদের।
বাংলাদেশে অথবা পশ্চিম বঙ্গে নারীদের অধিকার আদায় করার জন্যে এবং সে সম্পর্কে সচেতনতা জাগিয়ে তোলার জন্যে যে-নারীরা লড়াই করছেন, তারা এখনো রান্নার কাজে সহায়তা করার জন্যে স্বামীদের ডাক দেননি। তার কারণ এই যে, এ অঞ্চলে রান্নার কাজ গৃহিণীরা নিজেরাই কম করেন, অথবা আন্দীে করেন না–এখনো কাজের লোক পাওয়া যায় বলে। কিন্তু যখন কাজের লোক পাওয়া যাবে না, তখন যে এই প্রশ্ন নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিতর্ক এবং বিরোধ দেখা দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। এবং কে কী কাজ করবেন তা নিয়ে সংসারে সংসারে যে মন কষাকষি চলবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। সেই দ্বন্দ্বের শেষে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা কী দাঁড়াবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে ঘরের কাজ নারীবাদের একটা প্রধান প্রশ্ন।
নারীবাদের আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিবারের আয়তন। পুরুষরা স্ত্রীর গর্ভ সঞ্চার করেই খালাস। কিন্তু স্ত্রীদের সেই সন্তান দীর্ঘ ন মাস গৰ্ভে ধারণ করতে হয়। এবং সন্তান জন্মের পরও মাকেই সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব নিতে হয়। সন্তান মানুষ করা মোটেই সহজ কাজ নয়। তা সত্ত্বেও এখনো বহু সমাজে মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের গর্ভ ধারণ করতে বাধ্য করা হয়। নারীবাদীদের মতে, গৰ্ভ ধারণ করা অথবা না-করার অধিকার থাকা উচিত পুরোপুরি নারীদের। এই জন্যে পশ্চিমা জগতে সন্তানসংখ্যা সীমিত রাখার যে-সচেতনতা দেখা দেয়, তা থেকেই শুরু হয় গর্ভপাতের আইন প্রণয়ন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল আবিষ্কারের গবেষণা। কিন্তু সেখানে প্রধান বাধা আসে ধর্মের তরফ থেকে। ক্যাথলিকরা কোনো রকম জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করেন না। গর্ভপাতের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমন কি, পিল খাওয়াতেও নয়। সংযম পালনই তাদের জন্যে একমাত্র ব্যবস্থা। বলা বাহুল্য, এটা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা অথবা যুক্তির কথা নয়।
তাই নারীবাদীদের একটা গোষ্ঠী নারীদের গর্ভপাত এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করেন। বিশেষ করে ধর্ষিতা মহিলারা গর্ভবতী হলে অবশ্যই তাঁদের গর্ভপাতের অধিকার থাকা উচিত বলে তাঁরা দাবী করেন। তাঁদের এই দাবির মুখে বিশ শতাব্দীতে গর্ভপাতের অধিকার অনেক দেশেই স্বীকৃত হয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রযুক্তিতে উন্নত কিন্তু মনোভাবের দিক দিয়ে মৌলবাদী দেশের একাংশ এখন গর্ভপাতের বিরুদ্ধে রীতিমতো সহিংস আন্দোলন করছে। যারা গর্ভপাত করান তেমন ডাক্তারদের পর্যন্ত তারা হত্যা করেছে অথবা ভয়ভীতি দেখিয়েছে। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে এই অধিকার বহাল রাখার জন্যে নারীবাদীরা জেহাদী মনোভাব দেখাচ্ছেন। এ ব্যাপারে নারীবাদীদের একাংশ এমনই কট্টরবাদী যে, অনেকে তাদের বলেন ফেমিনাৎসি—অর্থাৎ নারীবাদের নাৎসি। জঙ্গী নারীবাদী। এ শব্দটি প্রথম বারের মতো ব্যবহৃত হয় ১৯৯০ সালে।
তবে স্বীকার করতে হবে আন্দোলন ছাড়াই ১৯৬০ সাল থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল বাজারে বের হওয়ার পর থেকে পশ্চিমে সন্তানের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। অরক্ষিত যৌনকর্মের পরের দিন সকালে পিল খেয়ে গর্ভনিরোধের ওষুধও আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে কার্যকরভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এখন আছে। তা ছাড়া, অনেক পরিবারে স্বামীশ্ৰী আগে থেকেই সন্তান না-নেওয়ার সংকল্প করেন। তারা মনে করেন। যে, সন্তান নিলে জীবন উপভোগ করার সুযোগ অনেক কমে যাবে। কর্মজীবী বহু মহিলা আবার মনে করেন যে, সন্তান নিলে কর্মস্থানে উন্নতির প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়বেন। এই সমস্ত কারণে পশ্চিমা জগতে কোনো কোনো দেশে জন্মের হার এতো কমে গেছে যে, সেসব দেশে মোট জনসংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বলা যেতে পারে, এসব দেশে গর্ভপাতের যে-অধিকার রয়েছে, তা নীতিগত অধিকার, বাস্তবে তার প্রয়োগ অতো ব্যাপক নয়।
অনেক পুরুষসমাজেই দেখা যায় যে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে অংশত নারীদেরই দায়ী করা হয়। ধর্ষিতা নারী কী ধরনের পোশাক পরেছিলেন এবং সাজগোজ করেছিলেন, কেমন আচরণ করেছিলেন, ধর্ষককে যদ্দুর সম্ভব শারীরিকভাবে বাধা দিয়েছিলেন। কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু ধর্ষণ করার দায় যে পুরুষের সেটা এক কথায় স্বীকার করে না। ধর্ষিতা নারীকেই প্রমাণ করতে হয় যে, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ভারতে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর চার লাখের বেশি। ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এই সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আংশিকভাবে নারীদেরই দায়ী করেছে। তাদের বক্তব্য হলো মেয়েরা ধর্ষণের আগে অনেক ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় পোশাক পরেছিলেন এবং উস্কানিমূলক আচরণ করেছিলেন।
পাকিস্তানের মতো ইসলামী দেশে ধর্ষণ প্রমাণ করার দায় পুরোটাই নারীদের ওপর। তার অর্থ প্ৰমাণ করতে না-পারলে সেই নারী কেবল অপমান সহ্য করতেই বাধ্য হবেন না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শাস্তিও পেতে পারেন। পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী যদি চারজন পুরুষ সাক্ষ্য দেন যে, তারা দেখেছেন একজন পুরুষ এক মহিলাকে ধর্ষণ করছে, তা হলেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে। অন্যথায় নয়। এর থেকে অন্যায্য আইন হওয়া শক্ত। কিন্তু তবু এ আইন পাকিস্তানে প্রচলিত আছে। এই আইনের বিরুদ্ধে মুখতারান মাই নামে এক ধর্ষিতা নারী যে-অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার জন্যে তিনি সারা বিশ্বের নারীবাদীদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন। ধর্ষণের জন্যে মহিলাদের দায়ী করার এই মনোভাব নারীবাদীরা দূর করতে চান ।
নারীদের অধিকার সম্পর্কিত আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যৌনতা। যৌনকর্ম নারী এবং পুরুষ উভয়ের সমান উপভোগ করার কথা। কিন্তু অল্পকাল আগেও মনে করা হতো যে, নারীদের যৌনতার অস্তিত্বই নেই অথবা এই কর্মে তাদের ভূমিকা নিতান্তই নিক্রিয় এবং এতে তাঁদের তৃপ্তি-অতৃপ্তির কোনো প্রশ্ন ওঠে না। নারীদের যৌনতাকে সাধারণত পাপ এবং নোংরা বিষয় বলে গণ্য করা হতো। ব্যাপকভাবে মনে করা হয় যে, তাদের যৌনতা আছে শুধু পুরুষদের তৃপ্ত করার জন্যে। এ ব্যাপারে পুরুষদের স্বার্থপরতার সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত আরবী ভাষী এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। এই দেশগুলোতে মেয়েদের যৌনাঙ্গের একটা অংশ (ক্লাইটারিস) কেটে ফেলে খতনা দেওয়ার নিয়ম এখনো ব্যাপকভাবে চালু আছে। এসব দেশ থেকে যারা পশ্চিমে চলে এসেছেন, তারা সেসব দেশেও গোপনে গোপনে এই রীতি অনুসরণ করেন বলে অনেক সময়ে জানা যায়। এভাবে খতনা করলে মেয়েদের যৌনসুখ অনুভব করার ক্ষমতা অনেকাংশেই হ্রাস পায়। ফলে নারীকে তৃপ্ত করার দায় থেকে বীর পুরুষরা অব্যাহতি পান।
বস্তৃত, মানব সভ্যতার গোড়া থেকেই বহু নারী সারাজীবনে হয়তো কখনোই সত্যিকার যৌনসুখের স্বাদ পেতেন না। কিন্তু তা নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন সচেতনতা অথবা অভিযোগ ছিলো না। তারা যা পেতেন, মনে করতেন, সেটাই স্বাভাবিক এবং তাই নিয়েই সুখী থাকতেন। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল বাজারে চালু হওয়ার পর তাঁদের মধ্যে এ সচেতনতা অনেক বৃদ্ধি পায়। কারণ তারা গর্ভের আশঙ্কা না-করেই যৌনকর্মে অধিকতর অংশ গ্রহণের সুযোগ পান। তা ছাড়া, পিলের দৌলতে মেয়েরা প্ৰথম বারের মতো যৌনস্বাধীনতার আস্বাদও লাভ করেন। এর ফলে বিবাহ-বহির্ভূত যৌন অভিজ্ঞতাও বৃদ্ধি পায়। চিরাচরিত সতীত্বের মাপে এটাকে যেমনই মনে করা হোক না কেন, এ থেকে কোনো কোনো নারী তুলনা করেও যৌনসুখের মান বিচার করার সুযোগ পান।
যারা বিবাহ-বহির্ভূত যৌনতার স্বাদ পাননি, তাঁরাও ১৯৫০-এর দশক থেকে উন্নতমানের যৌনবিজ্ঞানের বই পড়ে নারীদের যৌনতা সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পান। এ বিষয়ে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত অ্যালফ্রেড কিন্সলির সেক্সয়াল বিহেবিয়ার ইন দ্য হিউম্যান ফিমেইল এবং উইলিয়াম মাস্টার্স ও ভ্যার্জিনিয়া জনসনের হিউম্যান সেক্সয়াল রেসপন্স (১৯৬৬) রীতিমতো পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সত্যিকারের জনপ্রিয়তা লাভ করে অ্যালেক্স কমফর্টের দ্য জয় অব সেক্স (১৯৭২)। এই গ্রন্থটি প্রকাশের পর ৭০ সপ্তাহ ধরে তা বেস্টসেলারের তালিকায় ছিলো। এসব বই থেকে নারীরা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে, তারাও পুরুষদের সমান যৌনসুখ পেতে পারেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নারীরা যে-অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন লাভ করেন, তাও তাদের অধিকতর স্বাধীনচেতা করেছিলো। এসবের মিলিত ফল হলো: ১৯৬০-৭০-এর দশক থেকে যৌনস্বাধীনতার প্রসার।
সচেতনতা লাভের ফলে নারীবাদীরা নারীদের যৌনতার ইতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরতে চান। বহু শতাব্দী ধরে এ সম্পর্কে পুরুষ সমাজে যে-একপেশে এবং স্বার্থপরতার মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিলো, তাঁরা তার স্বরূপ উন্মোচন করেন। যৌনতার বিষয়ে পুরুষ সমাজে যে-দ্বৈত মূল্যবোধ রয়েছে, তাঁরা তারও সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন যে, পুরুষরা যৌনবিষয়ে সক্রিয় হলে তার কোনো বদনাম হয় না, বরং সেটাকেই স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা হয়। অপর পক্ষে, কোনো নারী যৌনতার ব্যাপারে উৎসাহী এবং সক্রিয় হলে তাকে চরিত্রহীন, বেশ্যা, ছেনাল ইত্যাদি বলে নিন্দা করা হয়। এই বৈষম্য এবং ভণ্ডামি দূর করা নারীবাদীদের একটি বড়ো লক্ষ্য। পুরুষরা তাঁদের নিজেদের বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক রাখাকে প্রায় নির্দোষ বলে গণ্য করেন, কিন্তু তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে শতকরা এক শো ভাগ সতীত্ব দাবি করেন।
এই রকমের ভণ্ডামির আরও দৃষ্টান্ত হলো পুরুষমুখী সমাজে পুরুষের ভুল-ত্রুটি, অন্যায়কে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা হয়, কিন্তু নারীদের নয়। যেমন, কোনো পুরুষ অসঙ্গত অথবা ক্রুদ্ধ আচরণ করলে তার কারণ ব্যাখ্যা করে হয়তো বলা হয় যে, কোনো কারণে তার মেজাজ ভালো ছিলো না, অথবা সে মানসিক চাপের মুখে ছিলো। কিন্তু মেয়েরা এমন আচরণ করলে সমাজ তা সহানুভূতির চোখে দেখে না। কোনো ছেলে বদমায়েসি করলে অথবা, ধরা যাক, কোনো মেয়ের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করলে তার তেমন নিন্দা হয় না–বরং ছেলেরা আমনই হয় বলে তার সাফাই গাওয়া হয়, কিন্তু মেয়েরা একই ধরনের কিছু করলে সমাজে তার অনেক নিন্দা হয়। এমন কি, কোনো পুরুষ কর্মস্থানে দক্ষতা দেখালে সেটাকে তার স্বাভাবিক ক্ষমতা এবং সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ বলে বিবেচনা করা হয়; অপর পক্ষে, কোনো নারী দক্ষতা দেখালে তাঁকে ন্যায্য কৃতিত্ব দেওয়া হয় না। বরং তাঁকে কেউ সাহায্য করেছে অথবা দৈবক্রমে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বলে তার কাজকে ছোটো করে দেখা হয়। নারীবাদীরা এই মনোভাবও আমূল বদলে ফেলতে চান।
নারীবাদীরা ভাষায় যে-লিঙ্গবৈষম্য আছে, তাও দূর করতে চান। ভাষা বিশ্লেষণ করলে লক্ষ্য করা যায় যে, সব ভাষাই কমবেশি পুরুষশাসিত সমাজের তৈরি। সে জন্যে ভাষায় অনেক শব্দ থাকে যাতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। যেমন, ইংরেজিতে বলা হয়: ম্যান ইজ মর্টাল। এখানে ম্যান বলতে নারীও বোঝানো হয়। মনুষ্যজাতিকে বলা হয় ম্যানকাইন্ড। এখানেও ম্যান অর্থ তাবৎ মানুষ, কেবল পুরুষ নয়। কিন্তু ম্যান শব্দটি পুংলিঙ্গবাচক।
ংলায়ও এ রকমের বহু লিঙ্গবৈষম্যমূলক দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, বাংলায় বলা হয় মানব জাতি–যদিও তার মধ্যে মানবীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঙ্গদেশে এক সময় কন্যাসন্তান এতোই অবাঞ্ছিত ছিলো যে, মেয়ে জন্মালে তাকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য করার জন্যে বলা হতো মেয়েছেলে। সমাস করার সময় সংক্ষিপ্ত শব্দটি আগে এবং লম্বা শব্দটি পরে রাখতে হয়। কিন্তু যেমন রাজপুরুষ। কিন্তু স্বামী এবং স্ত্রী সমাস করলে স্ত্রীস্বামী না-বলে বলা হয়। স্বামীস্ত্রেী। তেমনি বাবামা। এরও কারণ পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে পুরুষ শ্ৰেষ্ঠ, সতরাং ব্যাকরণেও লিঙ্গবৈষম্য বজায় রাখতে হয়। সভা যিনি পরিচালনা করেন তাঁকে বলা হয় সভাপতি। কিন্তু মহিলা সভাপতিকে সভাপত্নী বলা হয় না। নারীবাদীরা এ ভাষার বিরোধী। পশ্চিমা বহু দেশে তাই লিঙ্গবৈষম্যমূলক বহু পরিভাষার পরিবর্তে এখন উভয় লিঙ্গে ব্যবহার করার মতো শব্দ তৈরি হয়েছে। যেমন, সভাপতির বদলে বলা হয় চেয়ার পার্সন। বাংলায় অধ্যাপক শব্দের প্রতিশব্দ তৈরি হয়েছে অধ্যাপিকা। কিন্তু তারপরও বহু শব্দ থেকে যাচ্ছে, যা লিঙ্গবৈষম্যমূলক। যেমন মন্ত্রী। বাংলাদেশের দুজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রধানমন্ত্রীই বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শব্দটি শুনতে অবশ্য অতো খারাপ লাগে না। কিন্তু বাংলাদেশে কখনো মহিলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তাকে কী বলা হবে, তা চিন্তার বিষয়–নিশ্চয় রাষ্ট্রপত্নী নয়। এ রকমের আর-একটি শব্দ অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষা এখনো ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেখিনি, যদিও পশ্চিমঙ্গ এবং বাংলাদেশে বহু মহিলা অধ্যক্ষ আছেন।
সবশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নারীবাদীদের লক্ষ্য সব সমাজে অভিন্ন নয়। আফ্রিকার একটা অনুন্নত সমাজে যা প্রাগ্রসর নারীবাদী ধারণা বলে মনে হতে পারে, ইউরোপের একটা উন্নত সমাজে তা আগে থেকেই অর্জিত হয়েছে বলে হয়তো আন্দীে নারীবাদীদের কাছে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হবে না। কারণ, সেটাকেই ন্যূনতম প্রত্যাশা বলে গণ্য করা হয়। যেমন, বিবাহ এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকার।
স্বাধীনভাবে বিবাহ করার অধিকার পুরুষ ও মহিলা–উভয়ের জন্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ওপর। সারা জীবনের সুখ এবং শান্তি নির্ভর করতে পারে। তা সত্ত্বেও পশ্চিমা জগতে এটা কোনো নারীবাদী বিতর্কের বিষয় নয়। কারণ, সেখানে এ অধিকার দীর্ঘকাল আগে থেইে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে এটা এখনো একটা নারীবাদী বিতর্কের বিষয় বলে বিবেচিত হতে পারে। তাই বাঙালি নারীবাদীরা এ সম্পর্কেও আন্দোলন করেন।
এ রকম, নারীদেরও পুরুষের মতোই বিবাহবিচ্ছেদের সমান অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু অনেক সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার যথেষ্ট পরিমাণে নেই। যেমন, খৃস্টধর্ম অনুযায়ী নারী-পুরুষ কারোই এ অধিকার নেই। এখনো ক্যালিকদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ খুবই অবাঞ্ছিত বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু ধর্মীয় এ বাধা সত্ত্বেও ষোড়শ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একটি-দুটি করে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটতে থাকে। ইংল্যান্ডে বিবাহবিচ্ছেদ আইনী সমর্থন লাভ করে সপ্তদশ শতাব্দীতে।
খৃষ্টানদের মতো হিন্দুদেরও বিবাহ হলো দৈব ঘটনা। সুতরাং অবিচ্ছেদ্য। সে জন্যে হিন্দুদের মধ্যেও বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত ছিলো না। তবে ১৯৫৫ সালে ভারতে যে-পারিবারিক আইন গৃহীত হয়, সে আইন অনুযায়ী হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখদের জন্যে এ অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, যদিও সর্বক্ষেত্রে নয়। বাংলাদেশের হিন্দুরা দেশের আইন অনুযায়ী বিবাহ করতে পারেন। মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে বিবাহ আইনগত চুক্তি, অতএব এ চুক্তি বাতিল করা সম্ভব। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের অধিকার অনেক কম। যেমন, পুরুষরা তিনবার তালাক বললেই বিবাহ ভেঙে যায়, কিন্তু মহিলারা শুধু তালাক বলে বিবাহ ভাঙতে পারেন। না। তার জন্যে তাদের আইনের আশ্রয় নিতে হয়। স্বামীদের কোনো কারণ দেখানোর দরকার নেই, কিন্তু নারীদের দেখাতে হয় শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতন, স্বামীর অন্য যৌনসম্পর্ক অথবা এ ধরনের কোনো কারণ।
যতো দিন সম্ভব ছিলো পুরুষরা ততোদিন নারীদের শাসন এবং শোষণ করেছেন। কিন্তু শিক্ষার বিকাশ এবং অর্থনৈতিক সাবলম্বন লাভের ফলে নারীদের মধ্যে যে-সচেতনতা দেখা দেয়, তা থেকেই নারীবাদের সূচনা। পুরুষ প্রথমত বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, নারীরা পুরুষদের মতো মননশক্তির অধিকারী অথবা সংসারের কাজ ছাড়া কোনো কাজ করতে সমর্থ। কিন্তু যখন নারীরা প্রমাণ করলেন যে, তাদের মননশক্তি পুরুষদের মতোই এবং তাঁরা যে-কোনো কাজই করতে পারেন, তখন পুরুষ সমাজ সহজে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থান ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। নারীদের তা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আদায় করে নিতে হয়েছে। গোড়ার দিকে এ কাজে কিছু পুরুষও তাদের সহায়তা করেছেন।
সমাজ কতোটা রক্ষণশীল তার ওপর নির্ভর করে এক-এক সমাজে নারীবাদীদের কতোটা বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবার কতোটা অধিকার নিয়ে নারীরা সন্তুষ্ট হবেন, তাও নির্ভর করেছে, সে সমাজ কতোটা আধুনিক অথবা কতোটা রক্ষণশীল তার ওপর। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, ক্যাথলিক সমাজে এখনও নারীদের ধমীয় বিধান শিথিল করার আন্দোলন করতে হচ্ছে, কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট সমাজ করতে হচ্ছে না। ক্যাথলিকদের কাছে যৌন-স্বাধীনতা এখনো অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, অথচ সুইডেনের মতো দেশে দু দশক আগে সেটাই ছিলো নারীবাদী আন্দোলনের একটা প্রধান বিষয়। বাঙালি নারীবাদীদের কাছেও যৌনস্বাধীনতা এখনো তেমন প্রাসঙ্গিক নয়, যদিও কালে কালে তা হওয়া অসম্ভব নয়। মুসলমানদের মধ্যেও নারীমুক্তির ধারণা যথেষ্ট বাধার মুখোমুখি হয়েছে।
আবার, পর্দা প্ৰথা থেকে মুক্তি পাওয়া মুসলমান ছাড়া কোনো সমাজেই একটা আন্দোলনের বিষয় নয়। কিন্তু বিরাট মুসলিম বিশ্বে নারীবাদীদের কাছে এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, নারীদের বন্দী করে রাখার যতো উপায় আছে, পর্দা তার প্রধান হাতিয়ার। ধমীয় বিধান দিয়ে যেহেতু একে পালনীয় বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সে জন্যে এই বিধান অস্বীকার করে নারীদের মুক্ত করার জন্যে আরও সময় লাগবে বলে মনে হয়। গত পঞ্চাশ বছরে শিক্ষা এবং নারীদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ফলে সমাজের একাংশে যেভাবে পর্দা খসে পড়েছে, তা থেকে অবশ্য মনে হয়, কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন থাকলেও কালে কালে পর্দা প্রথা থাকবে না। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত হওয়ায় এবং বিশ্বায়নের হাওয়া লাগায়ও আন্তর্জাতিক আবহাওয়া কোনো দেশ অথবা কোনো সমাজই পুরোপুরি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে বলেও মনে হয় না। সেদিক দিয়ে মনে হয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বে নারীমুক্তির যে-দৃষ্টান্ত শক্ত ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়েছে, তা রক্ষণশীল সমাজগুলোকেও কমবেশি প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে এবং একদিন নারীরাও পুরুষদের মতো একই অধিকার লাভ করবেন। এবং সে অধিকার লাভের পরই নারীও মানুষ বলে স্বীকৃতি লাভ করবেন। আপাতত পুরুষরা পুরোপুরি মানুষ, নারীরা নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ।
(অন্যদিন, ঈদ সংখ্যা, ২০০৬)