নকুলীশপাশুপত দর্শন / নকুলীশপাশুপতদর্শন / নকুলীশপাশুপত-দর্শন
এই দর্শনাবলম্বীরা পরম-কারুণিক মহাদেবকেই পরমেশ্বর এবং জীবগণকে পশু কহে। জীবের অধিপতি বলিয়া পরমেশ্বর পশুপতিও বলা যায়, যে কোন বিষয় সম্পাদন করিতে হইলে অস্মদাদির যেমন অন্ততঃ হস্ত পদাদিরও সহায়তা অবলম্বন করিতে হয়, সেইরূপ অন্য কোন বস্তুর সহায়তা অবলম্বন না করিয়াই জগদীশ্বর জগজ্জাত নির্ম্মাণ করিয়াছেন বলিয়া তাঁহাকে স্বতন্ত্র কর্ত্তা বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে, এবং অস্মদাদির দ্বারা যে সমস্ত কার্য্য সম্পন্ন হইতেছে তাহারও কারণ পরমেশ্বর এই নিমিত্ত তাঁহাকে সর্ব্বকার্য্যের কারণ বলিলেও বলা যায়।
এস্থলে কেহ কেহ এইরূপ আপত্তি করিয়া থাকেন যে, যদি সকল কার্য্যেরই কারণ পরমেশ্বর, তবে এককালেই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান এই তিন কালের কার্য্য না হয় কেন? এবং কেনই বা সকল সময় সকল কার্য্য না হয়? যেহেতু কারণস্বরূপ জগদীশ্বর সর্ব্বদাই সর্ব্বত্র বিরাজমান রহিয়াছেন, এবং কি নিমিত্তই বা মুক্তিতে ইচ্ছা করিয়া ঘোরতর ক্লেশকর তপঃকরণে, পারলৌকিন সুখাভিলাষে যজ্ঞাদি কর্ম্মে ও সুখস্বচ্ছন্দতাবাঞ্ছা করিয়া ধনোপার্জ্জনাদিতে বুদ্ধিমান জনগণের প্রবৃত্তি জন্মে? পরমেশ্বর যাহা করিবেন তাহাই হইবে, চেষ্টা করিয়া তদতিরিক্ত কিছুই করিতে পারিব না, এরূপ বিবেচনা করিয়া বরং নিবৃত্ত হইবারই সম্ভবনা। কিন্তু এরূপ আপত্তি যে কেবল ভ্রান্তিমূলক, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, তাহা স্পষ্টরূপেই প্রতীয়মান হইবে, পরমেশ্বর স্বেচ্ছাক্রমে যাবৎ বিষয় সম্পাদন করিতেছেন। তাঁহার যখন যে বিষয়ে ইচ্ছা হয় তখনই সেই বিষয় সম্পাদিত হইয়া থাকে। এক কালে সকল কার্য্য হউক, অথবা সর্ব্বদা সকল কার্য্য হউক, এরূপ পরমেশ্বরের ইচ্ছা হয় না, সুতরাং এককালে তাবৎ কার্য্য বা সর্ব্বদা সকল কার্য্য হইতে পারে না। ঈশ্বরের ঐরূপ ইচ্ছা হইলে অবশ্যই ঐরূপ হইত সন্দেহ নাই। মুমুক্ষু ব্যক্তি যোগাভ্যাসে, স্বর্গাভিলাষী যজ্ঞাদি কর্মে এবং সাংসারিক সুখেচ্ছ ব্যক্তি ধনোপার্জ্জনাদিতে প্রবৃত্ত হউক এইরূপ ঈশ্বরের ইচ্ছা হয় বলিয়াই ঐ সমস্ত বিষয়ে ঐ সকল ব্যক্তিদিগকে প্রবৃত্ত হইতে হয়। তাঁহার ইচ্ছা কখনই বৃথা হয় না। পরমেশ্বর সকলের প্রভুস্বরূপ এবং তাঁহার ইচ্ছা আদেশস্বরূপ, সুতরাং প্রভুর আদেশ উল্লঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া অগত্যা সকলকে ঐ সমস্ত বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতে হয়। ইহা যুক্তি বিরুদ্ধ হইতেছে না, কারণ যদি পরমেশ্বরের ইচ্ছাক্রমেই সকল কর্ম্ম সম্পন্ন হয়, তবে তাঁহার ইচ্ছা হইলে ঐ সমস্ত বিষয়ে ঐ সকল ব্যক্তির প্রবৃত্তিরূপ কার্য্য না হইবে কেন? এইরূপে স্বেচ্ছাক্রমে তাবৎ কার্য্য সম্পাদন করিয়া থাকেন বলিয়া, ঈশ্বরকে স্বেচ্ছাচারী বলিয়াও নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে।
এই মতে মুক্তি দুই প্রকার, দুঃখসকলের অত্যন্ত নিবৃত্তি ও পারমৈশ্বর্য্য প্রাপ্তি। দুঃখাত্যন্তনিবৃত্তিরূপ মুক্তি হইলে, আর কোন কালেই কোন দুঃখ জন্মে না, এজন্য ঐ মুক্তিকে চরমদুঃখনিবৃত্তি কহে। দৃকশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি ভেবে পারমৈশ্বর্য্যমুক্তিঈ দ্বিবিধ; দৃকশক্তি দ্বারা কোন বিষয় অবিজ্ঞাত থাকেনা, যত সূক্ষ্ম যত ব্যবহিত বা যত দূরস্থ হউকনা কেন; স্থূল অব্যবহিত ও অদূরবর্ত্তী বস্তুর ন্যায় দৃষ্টিগোচর হয়, এবং যে বস্তুর যে গুন বা যে দোষ আছে, তাহাও জানা যায়। ফলতঃ সকল বিষয়ই দৃকশক্তিমান ব্যক্তির জ্ঞান অভিলাষ হয়, তখনই তাহা সুসম্পন্ন হইয়া থাকে। ক্রিয়াশক্তি মুক্ত ব্যক্তির কেবল ইচ্ছামাত্র অপেক্ষা করে। মুক্ত ব্যক্তির ইচ্ছা হইলে, অন্য কোন কারণ অপেক্ষা না করিয়াই অবিলম্বে তাঁহার মনোরথ পূর্ণ হয়। এইরূপ দৃকশক্তি ও ক্রিয়াশক্তিরূপ মুক্তি পরমেশ্বরের তত্তৎ শক্তি সদৃশ, এজন্য উহাকে পারমৈশ্বর্য্য-মুক্তি কহে। পূর্ণপ্রজ্ঞদর্শনে কথিত ভগভদ্দাসত্ব প্রাপ্তিকে মুক্তি বলা উক্তি মাত্র, কারণ মুক্ত ব্যক্তিকে যদ্যপি দাসত্বরূপ অধীনতা-শৃঙ্খলে বদ্ধ হইতে হইল, তবে তাহাকে কিরূপে মুক্ত বলা যাইতে পারে। দেখ, অমূল্য মণিমাণিক্যরত্নাদি-বিনির্ম্মিত-শৃঙ্খলা-বদ্ধ ব্যক্তিকেও বদ্ধই কহিয়া থাকে, কেহই তাহাকে মুক্ত কহে না। অতএব অন্ধকে পদ্মলোচন বলায় ন্যায়, ভগবদ্দাসত্বরূপ অধীনতাপাশে বদ্ধ ব্যক্তিকে মুক্ত বলা নিতান্ত যুক্তিবিরুদ্ধ ও হাস্যাস্পদ, সন্দেহ নাই।
এই মতে প্রধানধর্ম্মসাধনকে চর্য্যা বিধি কহে। চর্য্যা দুই প্রকার; ব্রত ও দ্বার। ত্রিসন্ধ্য ভস্মম্রক্ষণ, ভস্মশয্যায় শয়ন ও উপহার, এই তিনকে ব্রত কহে। হ হ হা করিয়া হাস্যরূপ হসিত, গান্ধর্ব্বশাস্ত্রানুসারে মহাদেবের গুণগানরূপ গীত, নাট্যশাস্ত্রসম্মত নর্ত্তনরূপ নৃত্য, পুঙ্গবের চীৎকারের ন্যায় চীৎকাররূপ হুড়ুক্কার, প্রণাম ও জপ এই ছয় কর্ম্মকে উপহার বলে। এরূপ ব্রত জনসমাজে না করিয়া অতি গোপনে সম্পাদন করিতে হয়। দ্বাররূপ চর্য্যা—ক্রাথন, স্পন্দন, মন্দন, শৃঙ্গারণ, অতিতৎকরণ, অবিদদ্ভাষণ ভেবে ছয় প্রকার। সুপ্ত না হইয়াও সুপ্তের ন্যায় প্রদর্শনকে ক্রাথন কহে; এবং বায়ুসম্পর্কে কম্পিতের ন্যায় শরীরাদির কম্পনকে স্পন্দন, খঞ্জ ব্যক্তির অনুরূপ গমনকে মন্দন, পরমরূপবতীস্ত্রীসন্দর্শনে বাস্তবিক কামুক না হইয়াও কামুকের ন্যায় কুৎসিত ব্যবহার প্রদর্শনকে শৃঙ্গারণ, কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য পর্য্যালোচনা পরিশূন্যের ন্যায় বগর্হিত কর্ম্মানুষ্ঠানকে অবিতৎকরণ, এবং নিরর্থক(১) বা বাধিতার্থক(২) শব্দোচ্চারণকে অবিতদ্ভাষণ কহে। এই মতে তত্ত্বজ্ঞানই মুক্তির সাধন। শাস্ত্রান্তরেও তত্ত্বজ্ঞান, মুক্তির সাধন বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে বটে, কিন্তু শাস্ত্রান্তর দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান হইবার সম্ভাবনা নাই বলিয়া এই শাস্ত্রই মুমুক্ষুগণের একমাত্র অবলম্বনীয়। বিশেষরূপে যাবতীয় বস্তু জানিতে না পারিলে তত্ত্বজ্ঞান হয় না। কিন্তু যাবতীয় বস্তুর বিশেষরূপে জ্ঞান শাস্ত্রান্তর দ্বারা হইবে সম্ভবনা নাই, যেহেতু শাস্ত্রান্তরে সকল বিষয় বিশেষরূপে নির্দিষ্ট হয় নাই; দেখ! শাস্ত্রান্তরে কেবল দুঃখনিবৃত্তিকেই মুক্তি কহিয়াছে; আর যোগের ফল কেবল দুঃখনিবৃত্তি, কার্য্যজাত অনিত্য এবং কারণস্বরূপ পরমেশ্বর কর্ম্মাদিসাপেক্ষ এইরূপ নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু এই শাস্ত্রে পারমৈশ্বর্য্য প্রাপ্তি ও দুঃখনিবৃত্তি এই উভয়ইরূপ মুক্তি, এবং ঐ উভয়ই যোগের ফল, কার্য্য সকল নিত্য এবং পরমেশ্বর সতন্ত্র কর্ত্তা, এইরূপ অনেক অধিক নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। অতএব এই শাস্ত্র যে শাস্ত্রান্তর হইতে উত্তম তাহাতে আর সন্দেহ কি?(৩)
——————
১. যথা জড়বজড়াং ইত্যাদি।
২. যথা সূর্য্য আকাশ হইতে আমার বাটীতে পতিত হইয়াছেন ইত্যাদি।
৩. এস্থানে মাধবাচার্য্য এমন সংক্ষেপে এই দর্শনের পদার্থনির্ণয়াংশ সন্নিবেশিত করিয়াছেন যে, তদ্দ্বারা ঐ দর্শনাভিজ্ঞ ব্যতীত কাহারো বিলক্ষণরূপে তাৎপর্য্যার্থ অবগত হইবার সম্ভাবনা নাই। সুতরাং তদনুবর্ত্তী হইয়া তদংশ উদ্ধৃত করিলে অস্মদাদির নিরর্থক বাগাড়ম্বর মাত্র হয়। কিন্তু বাহুল্যরূপে নির্দ্দেশ করাও বিবেচনাসিদ্ধ হইতেছে না, কারণ তাহা হইলে ঐ অংশই এক খানি পুস্তক লইয়া উঠে এবং প্রকৃত বিষয়ের সহিত তাদৃশ সম্পর্ক থাকে না, এজন্য এস্থলে ঐ অংশ এক কালে পরিত্যাগ করা গেল।