০৬. দোতলা তাঁবু

সম্রাট হুমায়ূন দোতলা তাঁবুর (ডুরসানা মঞ্জেল) বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি পশ্চিমের দিগন্তরেখায়। ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। সূর্য এখনো পুরোপুরি ওঠে নি। পশ্চিম আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সম্রাট প্রথম সূর্যকিরণ কপালে মাখতে চাচ্ছেন। এই মুহূর্তে হুমায়ূনের সৌভাগ্যের ঘাটতি যাচ্ছে। ছয় মাস পার হয়েছে, চুনার দুর্গ দখল হয় নি। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মীর আতশ পুরোপুরি ব্যৰ্থ। সে নৌকায় কামান বসিয়ে কামান দাগার হাস্যকর চেষ্টা করেছিল। কামান দাগামাত্র গোলার প্রবল বিপরীত ধাক্কায় দুটি বড় নৌকা কামান এবং বারুদসহ পানিতে ড়ুবে গেছে। কামানের সঙ্গে তিনজন কামানচিও পানিতে। তারা সাঁতার না জানার কারণে পানির নিচ থেকে উঠে আসতে পারে নি।

পশ্চিম আকাশের মেঘ পরিষ্কার হচ্ছে না, বরং গাঢ় হচ্ছে। ঘন কালো মেঘের যে বিচিত্র সৌন্দর্য আছে তা হুমায়ূন আগে লক্ষ করেন নি। আকাশের এই ছবি এঁকে ফেলতে পারলে ভালো হতো। তার ছবি আঁকার হাত এখনো সেই পর্যায়ে আসে নি। আফসোস!

আলামপনা!

হুমায়ূন পেছনে তাকালেন। জওহর আবাতাবচি (আবতাব শব্দের অর্থ পানি। আবতাবচি—যে পানি সরবরাহ করে। সম্রাটকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্ব জওহর আবিতাবচি’র।) সম্রাটের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি।

জওহর! সুপ্ৰভাত।

জওহর লজ্জায় মাথা নিচু করল। সে কিছু বলার আগেই সম্রাট তাকে সুপ্ৰভাত জানালেন। কী লজ্জা! কী লজ্জা!

জওহর আমতা আমতা করে বলল, সুপ্ৰভাত মহান সম্রাট। আমি আপনার জন্যে সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। কিছুক্ষণ আগে রুমী খাঁ দলবল নিয়ে চুনার দুর্গে প্রবেশ করেছে। শের খাঁ’র ছেলে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমার হৃদয় এই মুহুর্তে আনন্দে পূর্ণ। আমার কাছে তুমি কী উপহার প্রার্থনা করা?

আপনার স্নেহ। আল্লাহপাক সাক্ষী, আপনার স্নেহ এবং করুণা ছাড়া আমার আর কিছুই চাইবার নেই। আমি আমৃত্যু আপনাকে পানি খাইয়ে যেতে চাই।

তা-ই হবে। আমি দু’টি রাজকীয় ফরমান জারি করব। কলমচিকে আসতে বলো।

রাজকীয় ফরমানের প্রথমটিতে লেখা হলো, জওহর আবিতাবচি আজীবন সম্রাটকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্বে থাকবে। তাকে এক হাজারি মসনদদারি দেওয়া হলো।

দ্বিতীয় ফরমানে রুমী খাঁকে মীর আতশ উপাধি দেওয়া হলো। তাকে চুনার দুর্গের আপাতত দায়িত্ব দেওয়া হলো। দুর্গের বন্দিদের যেন প্রাণহানি না হয়। সম্রাট দুর্গের প্রতিটি বন্দির প্রাণের জিম্মাদার।

ফরমানজারির পর হুমায়ূন এক পেয়ালা বেদানার রস খেলেন। অজু করে আল্লাহপাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে সূরা ফাতেহা পাঠ করলেন। জওহর সারাক্ষণই সম্রাটের পাশে বসে রইল।

জওহর।

জি আলামপনা।

আমি ছদ্মবেশে কিছুক্ষণের জন্যে শহর ঘুরতে বের হব। হযরত ওমর রাজিআল্লাহুতালা আনহু এই কাজ করতেন।

উনি রাতে বের হতেন। দিনে না।

রাতের আলোয় কিছুই দেখা যাবে না। আমি দিনের আলোয় বের হব। তুমি আমাকে ঘোড়া ব্যবসায়ীর মতো সাজিয়ে দাও। চাদরে আমার ঠোঁট থাকবে ঢাকা। মানুষের পরিচয় লেখা থাকে ঠোঁটে। ঠোঁট ঢাকা মানুষ হলো পরিচয়হীন মানুষ।

 

পাশাপাশি দুটি ঘোড়া চলছে। একটিতে সম্রাট হুমায়ূন অন্যটিতে জওহর আবিতাবচি। অনেক দূর থেকে তাদেরকে অনুসরণ করছে সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী। তেমন প্রয়োজনে নিমিষের মধ্যে ছুটে এসে তারা সম্রাটকে ঘিরে ফেলবে। ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ালেও সম্রাটের নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা নেই।

শহর শান্ত। দোকানপাট খুলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। চুনার দুর্গ পতনের কোনো প্রভাব শহরে পড়ে নি। শহরের কেন্দ্রে হরিসংকীর্তন হচ্ছে। সেখানে ছেলেবুড়ো ভিড় করেছে। সম্রাট কিছুক্ষণ হরিসংকীর্তন শুনলেন।

একজন নাগা সন্ন্যাসীকে দেখা গেল। গায়ে ভস্ম মেখে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঘুরছে। তাকে ঘিরে একদল ছেলেমেয়ে। নাগা সন্ন্যাসী তার সাধনদণ্ডে কাসার একটি ঘণ্টা ঝুলিয়ে দিয়েছে। যখন সে হাঁটছে ঘণ্টায় ঢং ঢেং শব্দ হচ্ছে। সম্রাট নাগা সন্ন্যাসীর সঙ্গে জওহর আবিতাবিচির মাধ্যমে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তিনি হিন্দুস্থানি ভাষা জানেন না।

আপনি নগ্ন ঘুরছেন কেন?

আমি নাগা সন্ন্যাসী, সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি বলেই নগ্ন।

আপনি তো লজ্জাও বিসর্জন দিয়েছেন। লজ্জা বিসর্জনের জিনিস না।

তোর কাছে না, আমার কাছে লজ্জাও বিসর্জনের।

আপনি গোপন অঙ্গে ঘণ্টা বেঁধেছেন কেন?

সবাইকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যেই ঘণ্টা।

আপনি তো সবই বিসর্জন দিয়েছেন। গোপন অঙ্গও বিসর্জন দিন। এর তো আপনার প্রয়োজন নেই।

আমাকে নিয়ে তুই মাথা ঘামাচ্ছিস কী জন্যে? তুই ঘোড়া বেচাতে এসেছিস, ঘোড়া বিক্রি কর। পুণ্য কামাতে চাইলে আমার সেবা কর।

সম্রাট তাকে দশটা তাম্রমুদ্রা দিয়ে শহরের বাইরে চলে গেলেন। নদীর পাড় ঘেঁসে ঘেঁসে যাচ্ছেন। তার অদ্ভুত লাগছে। মধুর বাতাস। পশ্চিম আকাশের মেঘ এখন ভেলার মতো পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা তালগাছ বাঁকা হয়ে নদীর দিকে ঝুঁকে আছে। একদল শিশু তালগাছে উঠে সাবধানে মাথা পর্যন্ত যাচ্ছে, সেখান থেকে ঝাপ দিয়ে নদীতে পড়ছে। তাদের কী আনন্দ! সম্রাট বললেন, দেখো জওহর। ওদের কী আনন্দ!

জওহর কিছু বলল না। হুমায়ূন বললেন, সম্রাটের পুত্র-কন্যারা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত।

জওহর বলল, তাঁদের জন্য অন্য আনন্দ। মহান আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন কে কী আনন্দ পাবে। সম্রাট বললেন, চলো এগুই। আরও কোনো আনন্দদৃশ্য হয়তো সামনেই আছে।

সম্রাট এগুলেন। প্রায় দু’ক্রোশ এগুবার পর তিনি থমকে দীড়ালেন। সামনে নলখাগড়ায় ঢাকা শ্মশানঘাট। বৃষ্টির সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্যে চারদিক খোলা শ্মশানবন্ধু ঘর। ঘর ভর্তি নানান বয়সী। নারী। তারা কলকল করে কথা বলছে।

চারদিক লোকে লোকারণ্য। ঢোল বাজছে, কাঁসার ঘণ্টা বাজছে। কিছুক্ষণ পরপর সবাই মিলে গগনবিদারী চিৎকার দিচ্ছে—সতী মাই কি জয়।

চারজন পুরোহিত আসন করে বসে আছে। মন্ত্রপাঠ চলছে। পুরোহিতদের দক্ষিণ দিকে নদীর কাছাকাছি ডোমরা বসেছে কলসিভর্তি চোলাই মদ নিয়ে। তাদের চোখ রক্তবর্ণ।

সম্রাট বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হচ্ছে?

সতীদাহ হবে আলামপনা। মৃত স্বামীর সঙ্গে ভূরী জীবিত স্ত্রীকে চিতায় পোড়ানো হবে।

এই সেই সতীদাহ! আমি সতীদাহের কথা শুনেছি, আগে কখনো দেখি নি।

দেখার জিনিস না। হিন্দুস্থানি বর্বরতা চলুন ফিরে যাই।

যে মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারা হবে তাঁর সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?

আলামপনা। সে কথা বলার মতো অবস্থায় এখন থাকবে না। সবাই তাকে ঘিরে আছে। তাকে নিশ্চয়ই আরক খাওয়ানো হয়েছে। সে এখন নেশাগ্রস্ত।

একদল মানুষ দেখছি লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। এরা কারা?

সবসময় দেখা গেছে আগুন লাগানোমাত্র সতী দৌড় দিয়ে চিতা থেকে পালাতে চায়। তখন লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে চিতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং আগুনের উপর মেয়েটিকে চেপে ধরে রাখা হয়।

নরকের বর্বরতা।

অবশ্যই।

আমি এই মুহুর্তে ফরমান জারি করে সতীদাহ বন্ধ করতে চাই।

আলামপনা। গুস্তাকি মাফ হয়। আপনার সমস্ত প্ৰজা হিন্দু। আপনি ওদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে তারা বৈরী হয়ে উঠবে। আপনার জন্যে শাসনকার্য পরিচালনা দুষ্কর হবে।

আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই।

ঘোড়ার ব্যবসায়ী হিসেবে তারা আপনার সঙ্গে মেয়েটিকে কথা বলতে দেবে না।

তাদেরকে তুমি বলো আমি মোঘল সম্রাট হুমায়ূন এবং আমার রক্ষীবাহিনীকে কাছে এগিয়ে আসতে বলো।

চিতায় ঘিয়ের আগুন জ্বলে উঠেছে। সেখানে প্রায় সত্তর বছর বয়সী। এক চুলপাকা বৃদ্ধের শবদেহ। তার চুলে আগুন ধরতেই নিমিষে সব চুল জ্বলে গেল। আগুন ভালোমতো জ্বলে উঠলে সতী স্বেচ্ছায় হেঁটে হেঁটে চিতায় উঠবে। তাকে ভাং-এর শরবত খাওয়ানো হয়েছে। তার চিন্তাশক্তি কাজ করছে না। ঢোলের বাদ্য আকাশ স্পর্শ করছে। শশানঘরের তরুণীরা একে একে আসছে। সতী মেয়েটির কপালে সিঁদুর দিচ্ছে। সেই সিঁদুর নিজের কপালে ঘষছে এবং উপুড় হয়ে পড়ে মেয়ের পায়ে পড়ে তাকে প্ৰণাম করছে। বাজনাদাররা আধাপাগলের মতো নাচছে। হঠাৎ বাদ্যবাজনা থামল। সম্রাট হুমায়ূন এগিয়ে এলেন।

তাঁর ঘোড়া এসে থামল সতীদাহের মেয়েটির সামনে। বারো-তের বছর বয়সী একটি মেয়ে। পরনে লালপোড়ে শাড়ি। গা-ভর্তি অলংকার। কী সুন্দর সরল মুখ, বড় বড় চোখ! ভয়ে আতঙ্কে সে থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটির সঙ্গে কোথায় যেন সম্রাটের কন্যা আকিকা বেগমের মিল আছে।

তোমার নাম কী? বলো, নাম বলো।

অম্বা।

তোমার স্বামী মারা গেছে। সে চিতায় পুড়ে কয়লা হবে। তুমি তো বেঁচে আছ, তুমি কেন মরবে?

অম্বার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে ক্ষীণস্বরে বলল, আমি মরতে চাই না। এরা আমাকে মেরে ফেলবে।

সম্রাট ঘোড়া থেকে নামলেন। অম্বার কাছে এগিয়ে গেলেন। গলা নিচু করে বললেন, আমি নিজের হাতে তোমাকে পানি খেতে দেব। তুমি বিসমিল্লাহ বলে সেই পানি খাবে। মনে থাকবে?

অম্বা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সে খানিকটা হকচকিয়ে গেছে। মেয়েটির আত্মীয়স্বজন এবং জড়ো হওয়া লোকজন এগিয়ে আসতে চাচ্ছে কিন্তু সম্রাটের রক্ষীবাহিনীর কারণে কাছে আসতে পারছে না। তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। হুমায়ূন তাদের দিকে তাকিয়ে গলা উঁচু করে বললেন, অম্বা নামের এই মেয়েটা এইমাত্র আমার হাতে বিসমিল্লাহ বলে পানি খেয়েছে। বিধর্মীর হাতে পানি খাওয়ার কারণে তার জাত গেছে। বিসমিল্লাহ বলায় মেয়েটি মুসলমান হয়ে গেছে। আমার আইনে কোনো মুসলমান মেয়েকে সতী হিসেবে দাহ করা যাবে না।

সম্রাট হুমায়ূন অম্বাকে নিয়ে শিবিরের দিকে রওনা হলেন। মাতাল ডোমের দল লাঠিসোটা নিয়ে পিছন পিছন ছুটল। তাদের সঙ্গে পুরোহিতের দল। বাজনাদারদের দল। মহিলাদের দল। ‘সতী’ কন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে—এ হতে দেওয়া যায় না।

সম্রাটের নির্দেশে তীরন্দাজরা তীর ছুঁড়ল। অব্যৰ্থ তীরের আঘাতে চারজন পুরোহিতের তিনজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হতভম্ব দল উল্টাদিকে দৌড়াতে শুরু করল।

 

মাগরেবের নামাজের শেষে সম্রাট দরবার বসিয়েছেন। চুনার দুর্গ দখলে এসেছে। দুর্গের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে সেই বিষয়ে পরামর্শসভা বসেছে। বাংলামুলুক অভিযানে কখন রওনা হতে হবে—সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আজকের সভা গুরুত্বপূর্ণ। আমীররা সবাই উপস্থিত। রুমী খাঁ, (মীর আতশ) উপস্থিত। দরবারে খাসের নিয়ম ভঙ্গ করে চারজন নর্তকী উপস্থিত। এদেরকে আনা হয়েছে চুনার দুর্গ থেকে। গুরুত্বপূর্ণ সভায় নর্তকীরা কখনোই উপস্থিত থাকে না। আজ তারা কেন উপস্থিত বোঝা যাচ্ছে না। নর্তকীরা ভীতসন্তস্ত্ৰ। তারা মাথা নিচু করে আছে। কিছুক্ষণ পরপর একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। একজন গোপনে অশ্রুবর্ষণ করছে।

সম্রাট চুনার দুর্গ দখলে আসার কারণে আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। সবাই বলল, আমীন।

আমীর বেগ মীরেক-কে চুনার দুর্গের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সবাই বলল, অতি উত্তম সিদ্ধান্ত।

সম্রাট সবাইকে ভোজসভায় আহবান জানালেন। মীর আতশ বললেন, অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপন মিটিংয়ে নর্তকীরা উপস্থিত। এর কারণ বুঝতে পারছি না।

সম্রাট বললেন, এরা আমার কাছে একটা অভিযোগ করেছে। অভিযোগ গুরুতর। আমার ধারণা অভিযোগ মিথ্যা। যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট করে এদের হত্যা করা হবে।

বৈরাম খাঁ বললেন, অভিযোগ কী?

হুমায়ূন বললেন, অভিযোগ হচ্ছে রুমী খাঁ দুর্গে প্রবেশের পরপর সাড়ে তিন শ মানুষের দুই হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করা হয়েছে। রুমী খাঁ, এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

রুমী খাঁ বললেন, ঘটনা সত্য। আমি যা করেছি। মহান সম্রাটের নিরাপত্তার জন্য করেছি। যে সাড়ে তিন শ মানুষের দুই হাত কেটে ফেলা হয়েছে, এরা সবাই দুর্ধর্ষ কামানচি। এরা যেন আর কখনো সম্রাটের বাহিনীর উপর কামান চালাতে না পারে সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। শক্রকে সমূলে বিনাশ করতে হয়।

হুমায়ূন বললেন, আপনাকে সাহসী মানুষ ভেবেছি। আপনি নিতান্তই কাপুরুষের মতো একটি কাজ করেছেন। আমি কাপুরুষ অপছন্দ করি।

যুদ্ধক্ষেত্রে কাপুরুষতা একটি সৎ গুণ। অনেক সময় কাপুরুষতা যুদ্ধজয়ে ভূমিকা রাখে।

সম্রাট বললেন, দুর্গের মানুষজন দুর্গ সমর্পণ করেছেন। কাজেই দুর্গ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না। আপনি যে ভয়াবহ অন্যায় করেছেন, তার শাস্তি আপনারও দুই হাত কেটে নেওয়া।

উপস্থিত আমীরদের একজন বললেন, সম্রাটকে আমি তাঁর আদেশ পুনর্বিবেচনা করার জন্যে অনুরোধ করছি। সম্রাটের কামানবহর পরিচালনার দায়িত্ব রুমী খাঁর উপর। শের খাঁনের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধযাত্রা করব। যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে। কামানের উপর। অর্থাৎ রুমী খাঁর নৈপুণ্যের উপর। যার রণকৌশলে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট তাকে মীর আতশ সম্মানে সম্মানিত করেছেন।

হুমায়ূন বললেন, যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করে মহান আল্লাহপাকের ইচ্ছায়। কাপুরুষ রুমী খাঁর নৈপুণ্যে না। আগামীকাল ফজরের নামাজের পর মীর আতাশের দুই হাত কনুই থেকে কেটে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছি।

সম্রাট দরবার ছেড়ে উঠে পড়লেন। মাগরেবের নামাজের সময় হয়েছে। তিনি অজু করার জন্যে উঠে পড়লেন। রুমী খাঁকে গ্রেফতার করে তার তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। রুমী খাঁ সেই রাতেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন।

 

অম্বার জায়গা হয়েছে হুমায়ূনের মেয়ে আকিকা বেগমের তাঁবুতে। অম্বা অতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে গেছে। একদিন আগের ঘটনার স্মৃতি কিছুই তার মনে নেই। অম্বা আকিকা বেগমের তাঁবুর জাকজমক দেখে হতভম্ব। চারজন খোজা প্রহরী সারাক্ষণ তাঁবু পাহারা দিচ্ছে। আকিকা বেগমের সেবায় নিযুক্ত আছে আটজন দাসী। দু’জন দাসীর হাতে ময়ুরের পালকে বানানো বিশাল পাখা। তারা সারাক্ষণই হাওয়া করছে।

আকিকা বেগম অম্বাকে খুবই পছন্দ করেছে। সে তার সঙ্গে পদ্ম ফুল পাতিয়েছে। আকিকা বেগম তার গলার নীলকান্তমণির মালা অম্বার গলায় পরিয়ে দিয়েছে। এখন চলছে। ধাঁধার আসর। ধাধার উত্তর যে দিতে পারবে না, তাকে সঙ্গে সঙ্গে নাকে মাটি ঘষতে হবে। দু’জনের হাতেই মাটির দলা।

আকিকা বলল, দিনে রাজপ্রসাদে থাকে রাতে থাকে জঙ্গলে, ফজরের ওয়াক্তে থাকে মাটির নিচে। এটা কী?

অম্বা বলল, জানি না।

আকিকা বলল, মাটি ঘষো।

অম্বা নাকে মাটি ঘষল।

আকিকা বলল, এখন তোমার পালা।

অম্বা বলল, তার এক শ’ চোখ। কিন্তু সে চোখে দেখে না।

আকিকা : এক শ’ চোখ কিন্তু চোখে দেখে না। আমি জানি না এটা কী।

এর নাম আনারস।

আনারস আবার কী? এক ধরনের ফল। বাঙ্গালমুলুকে পাওয়া যায়।

আকিকা বেগম আনারস ফল বাঙ্গালমুলুক থেকে আনার হুকুম দিল। ফল দেখার পর সে নাকে মাটি ঘষবে। আকিকা বেগমের নির্দেশে দু’জন অশ্বারোহী আনারসের সন্ধানে গেল। অম্বা হতভম্ব। বাচ্চা একটি মেয়ের এত ক্ষমতা!

 

শের খাঁ গোপন বৈঠকে বসেছেন। চুনার দুর্গ হাতছাড়া হওয়ায় তাকে মোটেই বিচলিত বলে মনে হচ্ছে না। শের খাঁ’র দুই পুত্র এবং তিনজন সেনাপতি বৈঠকে উপস্থিত। শের খাঁ বললেন, আমি নিশ্চিত সম্রাট হুমায়ূনকে আমরা পরাজিত করব। আমার পরিকল্পনা নির্ভুল। চুনার দুর্গ দখলের জন্যে হুমায়ূন ছয় মাস অপেক্ষা করেছেন। এই ছয় মাস আমি শক্তি সঞ্চয় করেছি। সম্রাটের প্রধান স্তম্ভ রুমী খাঁ গত। এটা আমাদের জন্যে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

উপস্থিত সবাই বলল, মারহাবা।

শের খাঁ বললেন, এখানে উপস্থিত সবার প্রতি আমার একটি কঠিন নির্দেশ আছে। সম্রাট হুমায়ূনকে কোনো অবস্থাতেই হত্যা করা যাবে না।

শের খাঁর পুত্র জলাল খাঁ বললেন, কেন না?

শের খাঁ বললেন, হুমায়ূন আমার পরম শত্রু এটা সত্যি, কিন্তু তিনি এমন শক্র যাকে আমি শ্রদ্ধা এবং সম্মান করি। তিনি মহান মানুষদের একজন। এই মানুষটির অন্তর স্বর্ণখণ্ডের মতো উজ্জ্বল। সেখানে কলুষতার কণামাত্ৰও নাই।

শের খাঁ’র উজির বললেন, শক্ৰ সম্পর্কে এমন প্রশংসাসূচক বাক্য দুর্বলতার নামান্তর।

শের খাঁ বললেন, আমি অবশ্যই এই মানুষটির প্রতি দুর্বল। আমি সম্রাটের লেখা একটি কবিতা পাঠ করছি। পাঠ শেষ হওয়ামাত্র আপনারা বলবেন, মারহাবা।

অশ্ব অশ্বারোহীর বন্ধু নয়।
যেমন বন্ধু নয় বায়ু, মেঘমালার।
বন্ধু হবে এমন যাদের সঙ্গে কখনো দেখা হবে না।
দু’জনই থাকবে দু’জনের কাছে অদৃশ্য।
দৃশ্যমান থাকবে তাদের ভালোবাসা।

শের খাঁ’র উজির নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বললেন, মারহাবা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *