ষষ্ঠ অধ্যায় – দেবীর আশ্বাস প্রদান
দেবী বলিলেন,–ব্ৰহ্মন! তুমি যাহা বলিলে, তাহা সত্য। এজগতে আমি ভিন্ন শঙ্করকে মোহিত করিতে পারে, এরূপ কেহ নাই। ১
মহেশ্বর দারপরিগ্রহ না করিলে সনাতন সৃষ্টি-চক্র চলিবে না, এতৎসমস্তও তুমি প্রতিপাদন করিয়াছ। ২
এই জগৎপতি মহাদেবকে ভুলাইতে আমারও স্বাভাবিক যত্ন আছে। আজ আবার তোমার কথায় তাহা দ্বিগুণতর প্রগাঢ় হইল। ৩
হর যাহাতে বিমোহিত হইয়া যন্ত্রচালিতের ন্যায় আপনা হইতেই দার পরিগ্রহ করেন, অমি তদ্বিষয়ে যত্ন করিব। ৪
মহাভাগ! লক্ষ্মী যেমন বিষ্ণুর বশবর্তিনী, তদ্রূপ আমিও সুচারু মূর্তি ধারণ করত তাহারই বশীভূতা হইব। ৫।
আর সেই প্রিয় মহাদেব, যাহাতে আমার বশবর্তী হন, তাহাও করিব। অধিক কি, মহাদেবকে আমি সামান্য-সংসারীর ন্যায় করিয়া ফেলিব। ৬।
হে বিধাতঃ! আমি কল্পান্তরেও প্রতি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ে আকুলতাশূন্য মহেশ্বরের রমণীরূপে অনুসরণ করিব। ৭
হে পিতামহ! আমি প্রতি সৃষ্টিতেই দক্ষপত্নীর গর্ভে উৎপন্ন হইয়া মনো হররূপে শঙ্করের সহিত মিলিত হইব। ৮
তাহাতেই দেবগণ, বিষ্ণুমায়া জগন্ময়ী যোগনিদ্রারূপিণী আমাকে শঙ্করী এবং রূদ্রাণী বলিয়া স্তব করিবে। ৯
জন্মিবামাত্র জীবকে আমি যেমন মোহিত করিয়া থাকি, প্রমথপতি শঙ্করকেও তদ্রূপ মোহিত করিব। ১০
পৃথিবীতে যেমন সাধারণ প্রাণী, রমণীর বশে থাকে, শঙ্কর ততোধিক স্ত্রীর বশতাপন্ন হইবেন। ১১
তিনি হৃদয়মন্দিরে সমাধিলীলা ভঙ্গ করিয়া মুগ্ধ হইবার জন্যই আমাকে বিদ্যারূপে গ্রহণ করিবেন ১২
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–হে দ্বিজোত্তমগণ! ভগবতী বিষ্ণুমায়া ব্রহ্মাকে এই কথা বলিয়া তাহার সমক্ষেই তথা হইতে অন্তর্হিতা হইলেন। ১৩
তিনি অন্তর্হিত হইলে লোক-পিতামহ ব্রহ্মা, যথায় কামদেব, অনুচরগণের সহিত অবস্থিত ছিলেন, তথায় গমন করিলেন। ১৪।
হে মুনিপুঙ্গবগণ! তিনি মহামায়ার বাক্য স্মরণ করত অতিশয় আনন্দিত হইতে লাগিলেন এবং তখন আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিলেন। ১৫
অনন্তর মদন, মহাত্মা বিরিঞ্চিকে হংসযানে আসিতে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ ব্যস্ততার সহিত উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ১৬
মনোভব, হৃষ্টচিত্ত সৰ্ব্বলোক-বিধাতাকে আসনে বসাইয়া হর্ষোৎফুল্ল নয়নে বন্দনা করিলেন। ১৭
অনন্তর ভগবান্ বিধাতা, বিষ্ণুমায়া যাহা বলিয়াছিলেন, সেই কথা মদনকে আনন্দিত করত, হর্ষ-বিজড়িত-মধুরস্বরে বলিতে লাগিলেন। ১৮
বৎস মনোভব! পূর্বে আমি মহাদেবকে মোহিত করিতে প্রস্তাব করিলে তুমি যে আমাকে বলিয়াছিলে, “বরাবর মোহিত করিয়া রাখিতে পারে, এমন এক জন রমণী সৃজন করুন”, আমি তদনুসারে কার্যসিদ্ধির জন্য মন্দরপৰ্ব্বতের গুহামধ্যে একাগ্রচিত্তে জগন্ময়ী যোগনিন্দ্রা দেবীর স্তব করি। ১৯-২০
বৎস! তখন তিনি আপনিই সন্তোষসহকারে আমার প্রত্যক্ষণোচর স্বীকার করেন ‘আমি শম্ভুকে মোহিত করিব’। ২১
মনোভব! তিনি অচিরকালমধ্যেই দক্ষগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়া সত্যই শঙ্করকে মোহিত করিবেন। ২২
মদন বলিলেন,–ব্ৰহ্মণ! জগন্ময়ী বা যোগনিদ্রা কাহার নাম? তপোনিষ্ঠ মহাদেবকে কেমন করিয়া তিনি বশীভূত করিবেন? ২৩
সেই দেবীর প্রভাব কিরূপ? তিনি কে? উঁহার অবস্থিতিই বা কোথায়? হে লোক-পিতামহ! এই সকল কথা আমি আপনার নিকট শুনিতে ইচ্ছা করি। ২৪
সমাধিত্যাগ করিয়া নয়ন উন্মীলন করিলে যাহার দৃষ্টিগোচরে আমরাও ক্ষণকাল থাকিতে পারি না, সেই মহাদেবকে তিনি কেমন করিয়া মোহিত করিবেন? ২৫
ব্ৰহ্মন! জ্বলন্ত অনল-সন্নিভ নয়নত্রয় ও বিকট জটাজূটে ঘোরদর্শন শূলপাণিকে দেখিয়া তাহার সম্মুখে কে থাকিতে পারে? ২৬
এবংবিধ শূলপাণিকে সম্পূর্ণরূপে মোহিত করিতে অভিলাষিণী হইয়া যিনি তাহা স্বীকার করিয়াছেন, তাহার তত্ত্ব শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি। ২৭
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–চতুরানন কিছু বলিতে ইচ্ছা করিলেও, শিবকে মোহিত করা সম্বন্ধে মনোভবের সেই অনুৎসাহব্যঞ্জক বাক্য শ্রবণ করিয়া “কাম মহাদেবকে ভুলাইতে পারিবে না”, এই ভাবিতে ভাবিতে বারংবার নিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন। ২৮-২৯
নানারূপধারী, মহাবল-পরাক্রান্ত, লোলজিহ্বা, ভীষণাকৃতি চঞ্চলস্বভাব “গণ”–তাহার নিঃশ্বাসবায়ু হইতে উৎপন্ন হইল। ৩০
তাহাদিগের কেহ তুরঙ্গানন, কেহ কেহ গজানন, কতিপয় ব্যক্তি সিংহ ব্যাঘ্ৰানন; কাহারও মুখ কুকুরের ন্যায়, কাহারও বরাহের ন্যায়, কাহারও বা গর্দভের ন্যায় মুখ, কেহ ভল্লুকানন, কেহ বিড়লানন, কেহ শরভানন, কেহ শুকানন, কাহারও কাহারও বদন বানরের ন্যায়, কাহারও শৃগালের ন্যায়; কোন কোন ব্যক্তির মুখ সর্পের ন্যায়, কতকগুলি ব্যক্তির আকৃতি গোরুর ন্যায়, কাহারও কাহারও মুখ গোরুর ন্যায়, কাহারও বা মুখ পক্ষীর ন্যায়। ৩১-৩৩
অত্যন্ত দীর্ঘাকৃতি, অতি খর্বাকৃতি, অতিশয় স্থূল, অত্যন্ত কৃশ, পিঙ্গল লোচন, নির্মল নেত্র, ত্রিনয়ন, একনয়ন, স্থূলোদর, এককৰ্ণ, ত্ৰিকৰ্ণ, চতুঙ্কর্ণ, স্থূলকর্ণ, মহাকর্ণ, বিস্তৃতকর্ণ, কর্ণহীন, দীর্ঘনয়ন, স্থূলনয়ন, সূক্ষ্মনেত্র, দৃষ্টিহীন, চতুস্পদ, পঞ্চপদ, ত্রিপদ, একপদ, হ্রস্বপদ, দীর্ঘপদ, স্থূলপদ, মহাপদ, একহস্ত, চতুর্হস্ত, দ্বিহস্ত, ত্রিহস্ত, হস্তহীন, রিরূপাক্ষ, গোধাকার, মনুষ্যাকার, শিশু মারানন, ক্রৌঞ্চাকৃতি, বকাকার, হংসরূপী, সারসরূপী, মদ্গু-মুখ, কুররাস্য, কঙ্ক-বদন, কাকানন, অৰ্দ্ধকৃষ্ণ, অৰ্দ্ধরক্ত, কপিলবর্ণ, পিঙ্গলবর্ণ, নীলবর্ণ, শুক্লবর্ণ, পীতবর্ণ, হরিদ্বর্ণ এবং বিচিত্রবর্ণ এইরূপ নানা দলে বিভক্ত সেই “গণ” শঙ্খ, পট্ট, মৃদঙ্গ, ডিণ্ডিম, গোমুখ এবং পণবাদি বাদ্য বাজাইতে লাগিল! ৩৪-৪০
হে বিপ্রশ্রেষ্ঠগণ! তাহারা সকলেই উন্নত নিবিড় পিঙ্গল জটাজুটে ভীষণ তর; সকলেই রথারোহী। ৪১
তাহাদিগের হস্তে শূল, পাশ, খড়্গ, ধনু, শক্তি, অঙ্কুশ, গদা, বাণ, পট্টিশ এবং প্রাস। ৪২
নানা প্রহরণধারী মহাবলসম্পন্ন সেই “গণ” ঘোরতর শব্দ করত ব্রহ্মার সম্মুখে ‘মার কাট’ বলিতে লাগিল। ৪৩
তাহারা তথায় ‘মার কাট” ইত্যাদি শব্দ করিতে থাক; বিধাতা সেদিকে দৃকপাত না করিয়া যোগনিদ্রার প্রভাব কীৰ্ত্তন করিতে আরম্ভ করিলেন। ৪৪
অনন্তর, মদন, সেই “গণ’ দর্শনে ব্রহ্মার কথায় বাধা দিয়া তাহাকে সম্বোধনপূর্বক গণগণসম্মুখেই বলিতে লাগিলেন,–প্রভো! ইহারা কি কাৰ্য করিবে? থাকিবে কোথায়? ইহাদিগের নামই বা কি? ৪৫
যাহা ইহাদিগের প্রকৃত কাৰ্য্য; যথায় ইহারা থাকিবে, এবং ইহাদিগের যে নাম, তৎসমুদায় স্থির করিয়া দিয়া পরে আমার নিকট মহামায়ার প্রভাব কীৰ্ত্তন করিবেন। ৪৬
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–সৰ্ব্বলোক-পিতামহ ব্রহ্মা মদনের এই কথা শ্রবণে তাহার সহিত পরামর্শ করিয়া গণদিগের কর্মাদি নির্দেশ করত তাহাদিগকে বলিলেন,–ইহার জন্মিবামাত্র স্পষ্টভাবে বারংবার ‘মার মার’ বলিয়াছিল এইজন্য ইহাদিগের নাম হউক ‘মার’। ৪৭-৪৮
আর মারাত্মক অর্থাৎ কামের অধীন বা সাংঘাতিক বলিয়াও ইহারা ‘মার’ নামে অভিহিত হউক। ইহার অবারিতভাবে সকল প্রাণীরই বিঘ্ন সাধন করিবে। ৪৯
হে মনোভব! তোমার অনুগমন করাই ইহাদিগের প্রধান কাৰ্য্য হইবে। তুমি যখন যখন নিজ কার্য সাধনেদ্দেশে যথায় যথায় গমন করিবে, তখন তখন ইহারাও তোমার সাহায্যার্থ তথায় তথায় যাইবে। ৫০
তুমি যাহাদিগের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিবে, ইহারা তাহাদিগের মন উচ্চাটন করিবে; জ্ঞানীদিগের জ্ঞানপথেও সৰ্ব্বদা বিঘ্ন করিবে। ৫১
সকল প্রাণিগণ যাহাতে সংসার বন্ধনের অনুকূল কাৰ্য্য করে, বিঘ্ন থাকিলেও ইহারা সৰ্ব্বতোভাবে তাহা করিবে। ৫২
ইহারা বেগশালী ও কামরূপী হইয়া সৰ্বত্ৰ থাকিতে পারিবে। তুমি এই গণের অধিনায়ক হইবে। আর ইহারা নিত্যকর্মীদিগের পঞ্চযজ্ঞাংশ-ভোগী ও উদকশায়ী হইবে। ৫৩
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর তাহারা সকলে অভিলাষ অনুসারে কাৰ্য শ্রবণ করিয়া বিধাতা ও মদনের চতুর্দিকে দণ্ডায়মান রহিল। ৫৪
হে মুনিশ্রেষ্ঠগণ! পৃথিবীতে কেহই তাহাদিগের মাহাত্ম্য ও প্রভাব বর্ণন করিতে পারে না, যেহেতু তাঁহারা বিশেষ তপোনিষ্ঠ। ৫৫
তাহাদিগের স্ত্রী পুত্র নাই, তাহারা সকলেই মাহাত্মা সন্ন্যাসী, সতত নিস্পৃহ এবং ঊৰ্দ্ধরেতা। ৫৮
অনন্তর ব্রহ্মা মদনের নিকট পুনরায় যোগনিদ্রার মাহাত্ম সম্পূর্ণরূপে বর্ণন করিতে আরম্ভ করিলেন। ৫৭
যিনি অব্যক্তকে সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন ভাবে ব্যক্তরূপে বিভক্ত করিয়া প্রয়োজন সিদ্ধি করেন, তাহার নাম বিষ্ণুমায়া। ৫৮
যিনি ব্রহ্মাণ্ডের নিম্ন, অন্তর এবং অধোদেশে অবস্থিত হইয়া পুরুষকে তাহা হইতে পৃথক করিবার পর স্বয়ং অপসৃত হন, তাহারই নাম যোগনিদ্রা। ৫৯
যিনি যোগিগণের মন্ত্র-মৰ্ম্মোদঘাটনে তৎপর, পরমানন্দস্বরূপা সত্ত্ববিদ্যা, তাহাকেই জগন্ময়ী বলা যায়। ৬০
গর্ভমধ্যে জীবের তত্ত্বজ্ঞানোদয় হইলেও সে সূতিপবনে প্রেরিত হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়, তৎক্ষণাৎ তাহাকে যিনি তত্ত্বজ্ঞানশূন্য করেন, আর পূর্বপূৰ্ব জন্মের সংস্কার বলে আহারাদিকাৰ্য্যে সতত প্রবৃত্ত করিয়া মোহ, মমতা ও সংশয় উৎপাদন করিয়া থাকেন। ৬১-৬২।
যিনি জীবকে পুনঃপুনঃ ক্রোধ লোভ মোহমধ্যে নিক্ষেপ করিয়া যেই চিন্তাকুল জীবকে নিরন্তর কামসাগরে নিক্ষেপ করত আমোদযুক্ত ও ব্যসনাসক্ত করেন, তাহারই নাম মহামায়া। সেই শক্তিবলেই তিনি জগদীশ্বরী। ৬৩-৬৪
মহত্তত্ত্ব অহঙ্কার প্রভৃতি সৃষ্টিকারণ বস্তুর উৎপত্তি-হেতু বলিয়া জগতে তাহাকে অনন্তরূপিণী উৎপত্তি শক্তি বলিয়া থাকে। ৬৫
যেমন বীজনিঃসৃত অঙ্কুরের ক্রমবিকাশ মেঘের জলে হয়, সেইরূপ তিনি উৎপন্ন জীবের ক্রম পুষ্টি সাধন করিয়া থাকেন। সেই সৰ্ব্বসৃষ্টিকরাই সৃষ্টি শক্তি; তিনিই খ্যাতি, তিনিই ঈশ্বরী। ৬৬
তিনি ক্ষমাশীল ব্যক্তিগণের নিত্য ক্ষমা, তিনি দয়ালুদিগের দয়া; সেই নিত্যদেবী জগতের অভ্যন্তরে নিত্যরূপে প্রকাশমানা। ৬৭
সেই পরাৎপরা দেবী, জ্যোতিঃম্বরূপে ব্যক্ত-অব্যক্ত প্রকাশ করিতেছেন; সেই বৈষ্ণবীই বিদ্যারূপে যোগিগণকে মুক্তি দিতেছেন। ৬৮
তিনিই আবার অবিদ্যারূপে সাংসারিকদিগকে সংসারবন্ধনে, দৃঢ়বদ্ধ করিতেছেন, তিনিই লক্ষ্মীরূপে কৃষ্ণের সহচারিণী হইয়া তাহার মনোহরণ করিতেছেন। হে মনোভব! আমার কণ্ঠে তিনিই ত্রয়ীরূপে সতত অবস্থিত। ৬৯
সেই দিব্য মূর্তি পরাৎপরা, সৰ্ব্বত্রস্থায়িনী সৰ্ব্বত্রগামিনী এবং সর্বময়ী, তিনি স্ত্রীরূপে নিখিল প্রাণীকেই সৰ্ব্বতোভাবে মোহিত করিয়া রাখিয়াছেন, অধিক কি তাহার প্রভাবে নারায়ণ প্রভৃতিও সর্বদা বিমোহিত। ৭০
ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত। ৬