দূর থেকে দেখলাম, ছোটচাচার সঙ্গে মগবাজারের ফুফুর কী নিয়ে যেন লেগে গেছে। বড়োফুফু উত্তেজিত হয়ে কী সব বলছেন। ছোটচাচা তেমন সাড়াশব্দ করছেন না।
ছোটচাচার স্বভাব মিনমিনে। আড়ালে-আড়ালে থাকাই তাঁর স্বভাব। গলার স্বর উঁচু করে কিছু বলতে পারেন না। সব সময় ভীত-সন্ত্রস্তাভাব। যেন মহা কোনো অপরাধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমাদের গেঞ্জির মিলের দায়িত্ব কিছু দিন ছিল তাঁর উপর। লোকসান-টোকসান দিয়ে এমন অবস্থা করলেন যে শেষ পর্যন্ত মিল বিক্রি করে দিতে হল। এখন কী-যেন একটা ব্যাবসা করেন। এবং মনে হয়। ভালোই টাকা পয়সা আয় করেন। ছোটচাচার বিয়ে হয়েছে আজ দশ বৎসর। কোনো ছেলেপূলে হয় নি। ছোটচাচী যথেষ্ট সুন্দরী, তবু সারাক্ষণ সাজসজ্জা করেন। তাঁকে যখনই দেখা যাবে তখনি মনে হবে এই বুঝি কোনো পাটিতে যাচ্ছেন। কিংবা কোনো বৌভাতের অনুষ্ঠান থেকে এলেন। বাবুভাইয়ের ধারণা ছোটচাচীর জন্যেই চাচা এতটা মিনমিনে হয়েছেন। কথাটা পুরোপুরি অসত্য নয়।
চাচা এ বাড়িতে থাকেন ছায়ার মতো। ছোটচাচী থাকেন হৈ-চৈ করে। সৰ্ব্বক্ষণই তাঁর কাছে গেষ্ট আসছে। এক বার শোনা গেল, কোন এক গুপ থিয়েটারের হয়ে তিনি নাকি নাটক করবেন। তাঁর ভূমিকা হচ্ছে মোড়লের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর। ছোটচাচী নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে এনে মুখস্থ করলেন। নাটক অবশ্যি হল না। দাদা ভেটো দিয়ে সব ভেঙে দিলেন।
মগবাজারের ফুফু, ছোটচাচার সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনো গোপন আলাপ করছিলেন, কারণ আমাকে দেখেই কথাবার্তা থেমে গেল। আমি বললাম, কী নিয়ে আলাপ করছিলেন আপনারা?
ছোটচাচা মিহি স্বরে বললেন, তেমন কিছু না।
বড়ফুফু, ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, মা-র গয়না নিয়ে আলাপ করছিলাম, এমন গোপন কিছু না।
কী গয়না?
মা-র প্রায় দেড় শ ভরি গয়না আছে। সব বাবা স্টীলের আলমারিতে তুলে রেখেছেন।
তাতে কী হয়েছে?
গয়নাগুলি সব আছে কিনা আলমারি খুলে দেখা দরকার। গয়নাগুলিতে আমাদের দাবি আছে। স্মৃতিচিহ্ন।
আমি চুপ করে রইলাম। বড়োফুফু থেমে থেমে বললেন, গয়নার পুরো হিসাব থাকা দরকার। ছোটচাচা বেশ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, আমি একটু বাবার ওখানে গিয়ে বসি।–বলেই প্ৰায় পালিয়ে গেলেন।
বড়োফুফু। থমথমে স্বরে বললেন, এটা এমন মেনা বিড়াল যে, এর মাথায় কাঁঠাল ভাঙলেও বুঝতে পারবে না।
কে ভাঙবে কাঁঠাল?
তোর বাবা, আর কে? আমি কি কিছু বুঝতে পারি না? ঠিকই পারি।
আমি চুপ করে গেলাম। বড়োফুফু, বললেন, খোঁজ নিয়েছিলি?
কি খোঁজ নেব?
মেয়েটার বাড়ি কোথায়। বাবা কী করে।
ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেই পারেন।
আমি পারলে আর তোকে জিজ্ঞেস করি কেন?
মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে?
হুঁ। শাহানা বলল খুব নাকি লক্ষ্মী মেয়ে।
তা লক্ষ্মী বলতে পারেন।
আর শোন, ওদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন দরকার।
আজ রাতেই দরকার?
অসুবিধা কি?
শাহানাকে জিজ্ঞেস করলেই হয়।
না, ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই না। মেয়েকে দিয়ে কোনো মেয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর করতে নেই। ঠিক খবর পাওয়া যায় না।
ঠিক আছে।
আর মেয়েটির একটা ছবি দরকার। ফরিদকে পাঠাব।
এই সব আমাকে বলছেন কেন?
কাকে বলব। তাহলে?
শাহানাকে বলেন, কিংবা বড়োচাচীকে বলেন।
বিয়ে-শাদির ব্যাপারে শাহানাকে জড়াতে চাই না! মেয়েটা অলক্ষুণে। আর তোর বড়োচাচীর কথা আমাকে কিছু বলিস না। ওর মাথায় কিছু আছে নাকি? মেয়েমানুষের এত কম বুদ্ধি থাকে, তা বড়োভাবীকে দেখেই প্রথমে জেনেছি, বুঝলি?
গেট খোলার শব্দে তাকিয়ে দেখি, ছোটফুফা এসে ঢুকছেন। গাড়ি গেটের বাইরে রাখা। ছোটফুফা কখনো গাড়ি ভেতরে ঢোকান না। ঢোকালে নাকি রের করতে সময় লাগে। ছোটফুফা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, বাবার অবস্থা কি?
বেশি ভালো না।
ক্লিনিকে ট্রান্সফার করা দরকার। পিজির ডাক্তার আমিনের সঙ্গে কথা বলেছি। কেবিনের অসুবিধা হবে না। ফাইন্যান্স মিনিস্টার জামাল সাহেবের কথা বলতেই মন্ত্রের মতো কাজ হল। দেশের যে কী অবস্থা! রেফারেন্স ছাড়া কাজ হয় না। আপা, আপনি কেমন আছেন?
ভালো। তুমি কেমন?
আর আমি! আমার কথা কে জিজ্ঞেস করে বলেন? একটা পাটির সঙ্গে কথা বলার জন্য কোরিয়া গিয়েছিলাম। খাওয়াদাওয়ার কি যে কষ্ট আপা!
তাই বুঝি?
আর বলেন কেন। খাওয়াদাওয়ার দিক দিয়ে জাপান ভালো। রাইস এবং চিকেনকারী পাওয়া যায়। এক্সেলেন্ট টেষ্ট।
ছোটফুফার কথাবার্তায় আমার গা জ্বালা করতে লাগল। এই লোকটি একটি মরণাপন্ন রুগী দেখতে এসে কোরিয়া-জাপান করছে। আমি বললাম, ছোটফুফা, আমি দোতলায় আছি। দরকার হলে ডাকবেন।
এই দাঁড়াও, আমিও যাব।
আপনি দাদাকে দেখে আসেন।
চট করে দেখেই আসছি। তুমি দাঁড়াও।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ছোটফুফা প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন। চোখ কপালে তুলে বললেন, অবস্থা তো বেশ খারাপা!
খারাপ তো বটেই।
রাত কাটবে না। কি বল?
না কাটারই কথা।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। ডাক্তারদের সার্কেলে আমার ভালো যোগাযোগ আছে। একটা মেডিকেল বোর্ড তৈরি করা দরকার।
আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, বাবাকে বলেন। বলে নিয়ে যান।
ছোটফুফা চুপ করে গেলেন। সিঁড়ির মাথায় বাবুভাই দাঁড়িয়ে ছিল। বারান্দা অন্ধকার বলে তার মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। ছোটফুফা বললেন, বাবু নাকি? সব অন্ধকার করে রেখেছি কেন?
বাবুভাই জবাব দিল না। ফুফা বললেন, চল, তোমাদের ঘরে গিয়ে বসি।
আমাদের ঘরে বাতি নেই।
বাতি লাগবে না, তোমরা আছ তো?
বাবুভাই বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি থাকব না। টগরকে বলে দেখেন।
আরে, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ঘরে ঢুকেই ফুফা চাপা গলায় বললেন, কিসের গন্ধ? গন্ধ পাচ্ছে না? আমরা জবাব দিলাম না। বাবুভাই বললেন, কি বলতে চাচ্ছিলেন যেন?
আমার শ্বশুর সাহেব সম্পর্কে। শুনলাম তাঁর গ্রামের বাড়ি এবং বিশ বিঘা জমি নাকি স্কুল আর কলেজ ফাণ্ডে দিয়ে যাচ্ছেন?
জানি না, দিতে পারেন।
কি আশ্চৰ্য, তাকে গ্রামের লোকে দালাল বলে, আর তাদের জন্যে এটা করার মানে?
দালালী করেছিলেন, কাজেই দালাল বলে। সেই জন্যে দান-খয়রাত করবেন না?
আরে–তুমি বুঝতে পারছি না, দানটা অপাত্রে হচ্ছে না?
অপাত্রে হবে কেন? গ্রামের গরিব মানুষেরা পাবে।
দান-খয়রাত যোগ্য পাত্রে হওয়া উচিত। ওরা কী বলবে জান? ওরা বলবে, নাম কামাবার জন্যে করেছে। বলবে এবং শালা দালাল বলে গালি দেবে।
দিক না। দাদা তো আর শুনবে না। সে তো ভোগেই যাচ্ছে।
ফুফা অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বললেন, এক জন মানুষ মারা যাচ্ছে, তাঁর সম্পর্কে এ রকম অশ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলা তোমরা! আশ্চর্য!
শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধার কোনো ব্যাপার না। যেটা সত্যি সেটা বললাম।
মদের গন্ধ পাচ্ছি, মদ খাচ্ছিলে নাকি?
জ্বি, তা খাচ্ছিলাম।
আমি তাদের দু জনকে সেখানে রেখে নিঃশব্দে বের হয়ে এলাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, দু জনে এবার লেগে যাবে। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। খোলা ছাদে বসে একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে। কিছু ভালো লাগছে না।