দুর্ভাগ্য
নদীর ধারে এসে পড়লুম।
সোনালি রোদ মাখানো আকাশ, আনন্দ-ঝরানো বাতাস, ঢেউয়ের সঙ্গে গান দোলানো নদীর নাচ-প্রকৃতির এইসব স্বাভাবিক আশীর্বাদকে এতদিন ভুলেছিলুম কীসের মোহে!
এই তো পাখি ডাকছে, গাছের সবুজ ঝিলমিল করছে, ঘাসেঘাসে রংবেরঙা ফুল ফুটছে— সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষ এদের দেখে আসছে, তবু এরা কারুর চোখে পুরানো নয়!
তুচ্ছ জ্ঞানের সাধনা—যার মোহে মানুষ উচ্চাকাঙক্ষার দিবাস্বপ্ন দেখে নিজের প্রকৃতির সীমা লঙ্ঘন করতে চায়। আর সেইসব মানুষই শ্রেষ্ঠ ও সুখী, নিজেদের গণ্ডি-ঘেরা ক্ষুদ্র গ্রামকেই যারা মনে করে সমগ্র পৃথিবী!
অনেকদিন পরে আজ মুক্ত প্রকৃতিকে বড়ো ভালো লাগল। আপনমনে বেড়িয়ে বেড়াতে লাগলুম—বাসায় ফেরবার কথা একবারও মনে হল না।
এমন সময়ে নদীর ওপার থেকে একখানা নৌকা এসে এপারে ভিড়ল। একটি লোক নৌকা থেকে নীচে নেমেই চেঁচিয়ে উঠল, আরে, আরে, অজয় যে! কী ভাগ্যি, এখানে এসেই প্রথমে তোমার সঙ্গে দেখা!
এ যে আমার বাল্যবন্ধু প্রণব! ছুটে গিয়ে তার দুই হাত চেপে ধরলুম।
প্রণব আমার মুখের পানে চেয়ে বলল, ভাই অজয়, তোমার এ কী চেহারা হয়েছে। তোমাকে দেখলেই মনে হয় যেন কতকাল তুমি ঘুমোওনি! ব্যাপার কী? তোমার কি অসুখ হয়েছে?
প্রণব, তুমি ঠিক ধরেছ! আমার অসুখ হয়নি বটে, কিন্তু কাজের তাড়ায় বহুদিন আমার ভাগ্যে বিশ্রাম জোটেনি। আজ আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে—এখন আমি স্বাধীন। যাক সে কথা—আগে বাড়ির কথা বলো। বাবা, অশোক আর মমতার খবর কী?
সবাই ভালো। কিন্তু সবাই তোমার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কতকাল তুমি দেশে যাওনি চিঠিতেও নিজের কথা ভালো করে লেখোনি। সেইজন্যেই তোমার বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব কথা এখানে নয়—চলল তোমার বাসায় যাই।
বুক কেঁপে উঠল। বাসা!
কিন্তু উপায় নেই। প্রণবকে নিয়ে বাসায় না গেলে তো চলবে না। ফিরলুম। আসতেআসতে কেবলই ভাবতে লাগলুম গেল রাতের কথা।
বাসার কাছে এসে দাঁড়ালুম। ওর দোতলা ঘরে সেই ভয়ানক রাক্ষসটা এখনও কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে? প্রণব যদি তাকে দেখে তাহলে কী হবে? হয়তো সে বিকট আর্তনাদ করে ভয়ে ওছত হয়ে পড়বে আর তার চিৎকার শুনে রাজ্যের লোক ছুটে আসবে, পুলিশের আবির্ভাব হব, চারদিকে মহা হইচই পড়ে যাবে। তখন আমি কী করব? কী জবাবদিহি দেব?
প্রণবকে কিছুক্ষণ নীচে অপেক্ষা করতে বলে আমি নিজের বাড়ির ভেতরে ঢুরুলুম।
বাড়ি চুপচাপ। সিঁড়ির ওপর দিয়ে বিদ্রোহী পা দুটোকে কোনওরকমে চালিয়ে নিয়ে দোতলায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
ওই সেই ঘর! দরজা বন্ধ! দরজায় খানিকক্ষণ কান পেতে রইলুম। ভৈতরে কোনও শব্দ নেই। তবে কি তার কৃত্রিম দেহে জীবনের যে শিখা জ্বেলে দিয়েছিলুম, এরই মধ্যে আবার তা নিবে গিয়েছে?
সভয়ে, কম্পিত হস্তে হঠাৎ ধাক্কা মেরে দরজা খুলে ফেললুম।
ঘরের ভেতরে কেউ নেই। ছুটে আমার শোওয়ার ঘরে গেলুম। সেখানেও কেউ নেই। মুক্ত—আমি রাহুমুক্ত। বিপুল আনন্দে চিৎকার করে প্রণবকে ডাকলুম।
প্রণব যখন ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল, আমি তখন পাগলের মতন অট্টহাসি হাসছি আর হাসছি।
প্রণব সবিস্ময়ে বললে, ভাই অজয়, ব্যাপার কী? দোহাই তোমার, অমনভাবে আর হেসো না!
আচম্বিতে আমার ভ্রান্ত চোখ যেন দেখলে সেই দৈত্যটা আবার ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল। আমি চিৎকার করে বললুম, রক্ষা করো প্রণব, আমাকে রক্ষা করো! বলে অজ্ঞান হয়ে মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়লুম!
তারপর প্রবল জ্বরের আক্রমণে শয্যাগত হয়ে কেটে গেল মাসের পর মাস। কখনও জুর ছাড়ে, আবার তেড়ে আসে। কখনও কমে, কখনও বাড়ে। কখনও আচ্ছন্নের মতো শুয়ে থাকি, কখনও বিকারের ঘোরে প্রলাপ বকি।
বাবা নিশ্চয়ই আমার কাছে এসে পড়তেন, কিন্তু তিনি এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন রেলপথে এতদূর আসবার ক্ষমতা তার নেই। এবং চিকিৎসকরা বললেন, আমাকে স্থানান্তরিত করবার চেষ্টা করলে পীড়াবৃদ্ধির সম্ভাবনা। কাজেই আমার সেবার ভার নিতে হল একা প্রণবকেই। আর আমার পক্ষে তার চেয়ে যোগ্য লোক এ সংসারে কে আছে?
দীর্ঘকাল পরে আমি যখন আরোগ্যলাভ করলুম পৃথিবীতে তখন বসন্তের আগমন হয়েছে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে গাছে-গাছে নতুন পাতার শ্যামল সমারোহ। কানে আসছে গীতকারী পাখিদের উচ্ছ্বসিত ভাষা। নিশ্বাস টানলেই পাই বাগানে ফোটা তাজা ফুলের সৌরভ। চারদিকে নবজীবনের উৎসব, এরই মধ্যে পাখি, ফুল, পাতার মতন আমারও যে একটুখানি ঠাঁই আছে, এই ভেবে মন পুলকিত হয়ে উঠল।
কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বললুম, ভাই প্রণব, তুমি এখানে না থাকলে আমি আজ কোথায় থাকতুম? এই সুন্দর পৃথিবী থেকে হয়তো আমার অস্তিত্বই মুছে যেত। আমি কেমন করে তোমার ঋণ পরিশোধ করব?
প্রণব বললে, চুপ করো অজয়। আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে ঋণের কথা উঠতেই পারে না। ও প্রসঙ্গ থাক। আপাতত তুমি যখন সেরে উঠেছ, তোমার সঙ্গে আমি একটি বিষয়। নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
আবার বুক দুরুদুরু করে উঠল। প্রণব কী নিয়ে আলোচনা কররে? তবে কি আমি বিকারের ঘোরে আমার সমস্ত গুপ্তকথা প্রকাশ করে ফেলেছি?
প্রণব বললে, কথাটা যে কী, আমার মুখে শোনবার দরকার নেই। তোমার বাবার একখানা চিঠি এসেছে, পড়ে দ্যাখো।
প্রণবের হাত থেকে বাবার পত্রখানি নিয়ে পাঠ করতে লাগলুম–
বাবা অজয়,
দীর্ঘকাল রোগভোগের পর তুমি আরোগ্যলাভ করেছ। কিন্তু তবু আমার আনন্দলাভ করবার উপায় নেই, কারণ ভগবান আমাকে সে সুখ থেকে বঞ্চিত করেছেন। বজ্রাহত বৃক্ষের মতন আজ আমি একেবারেই ভেঙে পড়েছি। শেষবয়সে আমাকে যে এই মহা দুর্ভাগ্যের দুর্বহ ভার বইতে হবে, এটা কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি।
তোমার ছোট্টভাই অশোককে আর তুমি দেখতে পাবে না। আজও তার কোল ছাড়বার বয়স হয়নি। কিন্তু এই বয়সেই অশোককে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
কিন্তু এ সাধারণ মৃত্যু নয়। কারণ, অশোক মারা পড়েছে হত্যাকারীর হাতে। আমার সেই ফুলের মতন সুন্দর, পবিত্র ও কোমল শিশু—যাকে দেখলে সবাই ভালোবাসতে চাইত, তাকেই হত্যা করেছে কোনও নিষ্ঠুর নরপশু।
অকারণে শোকোচ্ছ্বাসে পত্র পরিপূর্ণ করে লাভ নেই—শোকপ্রকাশ করে কেউ কোনদিন মৃত্যুকে বাঁচাতে পারেনি। এখানে ব্যাপারটা যতদূর পারি গুছিয়ে বলবার চেষ্টা করব।
গত তেসরা ফাল্গুন অশোককে নিয়ে আমি আর মমতা সান্ধ্যভ্রমণে বেরুই। তুমি জানো, এটি আমার পুরোনো অভ্যাস। ছেলেবেলায় তুমিও আমার সঙ্গে রোজ বেড়াতে বেরুতে।
অশোক বাগানের এদিকে-ওদিকে ছুটোছুটি করে আপন মনে খেলা করছিল, মমতা আর আমি বসেছিলুম একখানি বেঞ্চিতে।
সন্ধ্যা যখন হয় হয়, তখন আমরা বাড়ি ফেরবার জন্যে গাত্রোত্থান করলুম। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও অশোকের সাড়া পাওয়া গেল না।
তখন ভয় পেয়ে আমরা চারদিকে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলুম। অনেকক্ষণ পরে রাতের অন্ধকার যখন জমাট হয়ে উঠেছে, তখন বাগানের বাইরে একটি ঝোপের মধ্যে পাওয়া গেল অশোকের মৃতদেহ। কোনও পিশাচের কঠিন আঙুলের ছাপ তখনও তার কণ্ঠের ওপরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
অশোকের দেহের পাশে পড়েছিল একখানা খণ্ড খণ্ড ফটোগ্রাফ। সেখানা তোমারই ছবি—তোমার যাওয়ার আগের দিনে যা তোলা হয়েছিল।
ছবিখানা তোমার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ওপরে ছিল, ঘটনাস্থলে কেমন করে এল প্রথমটা তা বুঝতে পারিনি। তারপর আন্দাজ করেছি, শিশু-বুদ্ধির কোনও খেয়ালে অশোক বেড়াতে যাওয়ার সময়ে ছবিখানা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছবিখানা এমন খণ্ডখণ্ড অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে কেন, তার কারণ আমি জানি না।পুলিশ তদন্ত আরম্ভ করেছে, কিন্তু এখনও খুনির কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি। এবং এই শিশুহত্যার উদ্দেশ্যই বা কী তাও কেউ অনুমান করতে পারছে না।
তোমার মা পরলোকে গিয়ে এই দারুণ আঘাতের ব্যথা থেকে মুক্তিলাভ করেছেন বটে, কিন্তু মমতাকে নিয়ে আমি বিব্রত হয়ে পড়েছি। অশোকের মায়ের স্থান নিয়েছিল মমতাই, তাকে হারিয়ে তার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। সে দিনরাত কাদছে আর ঘনঘন মূৰ্ছা যাচ্ছে। মমতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি আমার নেই।
অজয়, পত্রে আমি এর বেশি আর কিছু লিখতে চাই না—লেখবার শক্তিও আমার নেই। নিজেকে বড়োই একাকী বলে মনে করছি। এখন তোমাকে আমার কাছে পেতে চাই। ইতি—
তোমার হতভাগ্য পিতা
সেইদিনই প্রণবের সঙ্গে দেশের দিকে যাত্রা করলুম।