॥ ছয় ॥
দুপুরের ফাঁকা রাস্তায় তৃণা একটু বেশি তাড়াতাড়ি হাঁটছিল। পিছনে কে যেন আসছে! ফিরে দেখল। কেউ না। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে, পিছনে কে আসছে। কে যেন চুপিচুপি আসছে। কার চোখ তীব্রভাবে, গোয়েন্দার মতো নজর করছে তাকে। কেউ নয়। তবু তৃণা প্রাণপণে হাঁটে। বড় রাস্তায় তুখোড় রোদ। দোকান বাজার বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা, তৃণা কি আজ খুন হবে? গোপন থেকে কোন আততায়ি কেবলই আসে তৃণার দিকে?
তৃণা চারধারে তাকায়। কেউ নয়। উল্টোবাগে চলে এসেছে অনেকখানি। বাসস্টপটা এখনও বেশ দূরে। তৃণা বেশি হাঁটতে পারে না। হাঁটা জিনিসটা বড্ড ক্লান্তিকর। রিকশাতেও সে কখনও ওঠে না। বড় মায়া হয়। দুপুরের পিচ-গলা রাস্তায়, এই চাবুক রোদে রোগা মানুষগুলো রিকশা টানে, তাতে সওয়ার হতে একদম ভাল লাগে না তার।
ল্যান্সডাউনের মোড়ে পেট্রলপাম্পের কাছ ঘেঁষে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সিওলা হাঁটু তুলে বসে ছোট্ট একটা বই পড়ছে। সম্ভবত রেসের বই, কিংবা গীতাও হতে পারে। একা ট্যাক্সিতে তৃণা ওঠে না। ভয় করে। কিন্তু শরীরটা কেমন যেন কাঁপছে। ভয় করছে। উৎকণ্ঠা।
সাহস করে দু’পা এগোল তৃণা।
ভাই, ট্যাক্সি কি যাবে?
যাবে। ট্যাক্সিওলা গভীরভাবে বলে।
ট্যাক্সিটা দক্ষিণদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। তৃণা উঠতেই ট্যাক্সিটা ওই দিকেই চলতে থাকে, তৃণা কিছু বলেনি। তখন সে সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল রেবার ঘরে সে বসে আছে, আর রেবা হৃদয়হীনা রেবা তার দিকে স্বচ্ছ শীতল চোখে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই সে তার ছেলেকে দেখতে পায়। মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান মনু তাকে কোলে করে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। কী সুন্দর মনুর গায়ের গন্ধটুকু। আবার দেখে শচীন পিং পং টেবিলের ওপাশে বসে আছে, বলছে–তোমাকে আজকাল আমি লক্ষ করি না…
ভ্রূ কোঁচকায় তৃণা। তার সংসারে সে আজকাল আর নেই। কেউ তাকে লক্ষ করে না। এ কেমন? সে ও বাড়ির কারও মা, কারও গৃহকত্রী। তার অতবড় পতন, ওই কলঙ্ক, পরকীয়া ভালবাসা, এ সব ওদের একেবারেই কেন উত্তেজিত ও দুঃখিত করে না? কেন ওদের শান্তি ও স্বাভাবিকতা অক্ষুন্ন আছে? এ কি শচীনের ষড়যন্ত্র! শচীন কি ওদের শিখিয়ে রেখেছে ওর দিকে তাকিয়ো না, কথা বোলো না, ওকে উপেক্ষা করো। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই।
ট্যাক্সিওলা আয়না দিয়ে তাকে দেখছিল। ঘোট আয়না, তাতে শুধু মধ্যবয়স্ক ও জোয়ান চেহারার ট্যাক্সিওলার ক্রুর চোখদুটো দেখা যায়। ফট করে চোখ পড়তেই চমকে উঠল তৃণা। আতঙ্কিত একটা শব্দ উঠে এসেছিল গলায়। অস্ফুট শব্দটা মুখে হাত চাপা দিয়ে আটকাল। বলল, থামুন।
এইখানে নামবেন? বলে ট্যাক্সিওলা গাড়ি আস্তে করল।
এইখানেই। বলে তৃণা অবাক হয়ে দেখে, সে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে এসেছে, এদিকে তার আসার কথা নয়। সে যাবে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে বাসস্টপে। বার বার সে কেন তবে সে-জায়গা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে অন্যমনস্কতায়, বিভ্রমে? তৃণা আস্তে করে বলল, এটা কোন জায়গা! দেশপ্রিয় পার্ক?
হ্যাঁ, এখানেই নামবেন? বলে মধ্যবয়স্ক জোয়ান লোকটা তার দিকে পরিপূর্ণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। লোকটার মুখে ঘাম, অশিক্ষার ছাপ! বন্যজন্তুর মতো একটা কামস্পৃহা লক্ষ করে তৃণা। বুকটা একটু কেঁপে ওঠে। গাড়ির দরজার হাতলটা কিছুতেই খুলতে পারছিল না তৃণা। খুব তাড়াহুড়ো করছিল। একবার মনে হল, লোকটা কোনও কৌশলে দরজাটা আটকে দেয়নি তো! যাতে তৃণা খুলতে না পারে! লোকটাই হঠাৎ তার প্রকাণ্ড ঘেমো হাতটা বাড়িয়ে তৃণার হাতটা ঠেলে লকটা খুলে দিল।
তৃণা নেমে চলে যাচ্ছিল। খুব তাড়া। লোকটা পিছনে থেকে খুব একটা ব্যঙ্গের গলায় বলল, ভাড়াটা কে দেবে?
তাড়াতাড়িতে আর ভয়ে কত ভুল হয়। তৃণা ব্যাগ খুলে ভাড়া দিয়ে দিল। লজ্জায় কান-মুখ ঝাঁ ঝাঁ করছে।
ট্যাক্সিওলার চোখের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি পালানোর জন্যই তৃণা এলোপাথাড়ি খানিক হাঁটল উদভ্রান্তের মতো, চলে এল রাসবিহারী অ্যাভিনিউ পর্যন্ত। কিছুতেই তার মনে পড়ছিল না এখান থেকে কোন রুটের বাস ফাঁড়ি পর্যন্ত যায়। মনটা বড় অশান্ত, বুকের মধ্যে কেবলই একটা পাখা ঝাপটানোর শব্দ, কাকাতুয়াটা ডাকছে…তৃণা…তৃণা…তৃণা…।
আজ দুপুরের কলকাতাকে নিঝুমপুর নাম দেওয়া যায়। কেউ কোথাও নেই। ফাঁকা হু-হু. মন-কেমন-করা রাস্তা, রোদ গড়াচ্ছে, তৃণা ফাঁড়ির কাছে বাসস্টপে যাবে, কিন্তু সে বড় অনেক দূরের রাস্তা বলে মনে হয়। সে বড় অফুরান পথ। কোনওদিনই বুঝি যাওয়া যাবেনা। বেলা একটা বেজে গেছে। তৃণার গায়ের চ্যানেল নাম্বার সিক্সের গন্ধটা অল্প অল্প করে উবে যাচ্ছে হাওয়ায়, বাতাসে চুল এলোমেলো।
রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবল তৃণা। কী করে যাবে! সেই বারোটায় যাওয়ার কথা ছিল। দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতেই আবার হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করে পিছু ফিরে চাইল তৃণা। কে তার পিছনে আসছে? কে তাকে লক্ষ করছে নিবিষ্টভাবে?
আতঙ্কিত তৃণা হঠাৎ দেখল, একটা বিয়াল্লিশ নম্বর বাস মোড় নিচ্ছে। মনে পড়ল, এই বাসটা ফাঁড়ি হয়ে যায়। চলন্ত বাসটার সামনে দিয়ে হরিণ-দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল তৃণা। বিপন্নার মতো চিৎকার করে বলল, বেঁধে ভাই, বেঁধে…
প্রাইভেট বাস, যেখানে সেখানে থামে। এটাও থামল। তৃণা ভর্তি বাসটায় একটু কষ্ট করে উঠে পড়ে।
দেবাশিস যে উন্নতি করেছে তা এমনি নয়। কতগুলো অদ্ভুত গুণ আছে তার। একটা হল ধৈর্য। তৃণা বাস থেকে নামতে নামতেই দেখল, বাসস্টপে দেবাশিসের গাড়ি থেমে আছে। আর সামনের জানালা দিয়ে অবিরল সিগারেটের ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে।
ক্লান্ত তৃণা হাতের তেলোয় চেপে চুল ঠিক করতে করতে এগিয়ে গেল। খুব ফ্যাকাশে একটু হাসল।
দেবাশিস কিন্তু গম্ভীর। দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, উঠে পড়ে। তৃণা ঝুপ করে সিটে বসে বলল, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছ। আজ আমার বড় দেরি হয়ে গেল।
দেবাশিস মাথা নেড়ে বলল, ঠিক উল্টো।
মানে?
দেরিটা আমারই হয়েছে। তুমি আসার দুমিনিট আগে আমি এলাম। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, তুমি এসে ফিরে গেছ। আমিও চলে যাব যাব করছিলাম, হঠাৎ দেখি তুমি বাস থেকে নামলেতোমার দেরি হল কেন?
তৃণা একটু খাস ফেলে চোখ বুজে বলে, ঠিক বেরোবার মুখেই কতগুলো ইনসিডেন্ট হয়ে গেল। রেবির ঘরে গিয়েছিলাম, ও ছিল না। হঠাৎ এসে বিশ্রী ব্যবহার করল। আর শচীনবাবুর সঙ্গেও একটু কথা কাটাকাটি, সেই থেকে মনটা এমন বিচ্ছিরি, আর অন্যমনস্ক, রাস্তা ভুল করে অনেকদূর চলে গিয়েছিলাম। তোমার দেরি হল কেন?
দেবাশিস গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, তোমার সঙ্গে মিল আছে। ফুলির বাসায় রবিকে পৌঁছে দিয়ে বেরোবার সময়ে দেখি দোতলার রেলিং ধরে রবি…উঃ! মনশ্চক্ষে দৃশ্যটা দেখে একবার শিউরে ওঠে দেবাশিস। তারপর আস্তে করে বলে, রবিকে ফুলি কেড়ে রাখতে চাইছে। রবিও আর আমার সঙ্গ তেমন পছন্দ করে না।
তৃণা চুপ করে থাকে। একটা গভীর শ্বাস চাপতে গিয়ে বুকের ভিতরটা কুয়োর মতো গভীর গর্ত হয়ে যায়। অনেকক্ষণ বাদে সে বলল, কী ঠিক করলে, রবিকে ওখানেই রাখবে?
রাখতে চাইনি। তবু রয়েই গেল বোধ হয়। ওকে রেখে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে ভীষণ অন্যমনস্ক ছিলাম। দুটো ট্রাফিক সিগন্যাল ভায়োলেট করেছি, পুলিশ নাম্বার নিয়েছে। পার্ক সার্কাসে একটা বুড়ো লোককে ধাক্কাও দিয়েছি, তবে সে মরেনি। কিছুক্ষণ ওইরকম র্যাশ ড্রাইভ করে দেখলাম, আর গাড়ি চালানো উচিত হবে না। আস্তে আস্তে গাড়িটা নিয়ে অফিসে গেলাম। বন্ধ অফিস খুলে অনেকক্ষণ ফাঁকা ঘরে বসে রইলাম। ঠিক নরমাল ছিলাম না। সময়ের জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছিল। রবি কেন আমাকে আর তেমন পছন্দ করছে না বলো তো! আমি তো ওকে সব দিই। তবু কেন? বুঝলে তৃণা, আজ ফাঁকা অফিস ঘরে বসে আমার মতো কেজো মানুষের চোখে জল এল।
আস্তে চালাও, তুমি বড় অন্যমনস্ক। গাড়ি টাল খাচ্ছে।
দেবাশিস সামলে গেল। গাড়ি চালাতে চালাতে বলে, অফিসে বসেই একটা ডিসিসন নিলাম। তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে গেলাম ফুলির বাড়িতে। তখন গাড়ি চালানোর মতো মনের অবস্থা নয়। গিয়ে বললাম–ফুলি, আজ থেকেই রবি তোর কাছে থাকল। ফুলির সে কী আনন্দ! ওই মোটা শরীর নিয়েও লাফ ঝাঁপ দৌড়োদৌড়ি লাগিয়ে দিল! রবি ঘুমোচ্ছিল, আমি আর ওকে ডাকিনি। ঘুমন্ত কপালে একটা চুমু রেখে চলে এসেছি। ছেলেটা বুঝি পর হয়ে গেল। যাকগে।
তৃণা কাঁদছিল। নীরবে, একটু ফোঁপানির শব্দ হচ্ছিল কেবল। দেবাশিস হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁয়ে বলল, কেঁদো না। সব কিছু কি একসঙ্গে পাওয়া যায়?
তৃণা মুখ না তুলে কান্নায় যতিচিহ্ন দিয়ে দিয়ে বলে, আমিও চলে এসেছি। চিরকালের মতো, আর ফিরব না।
দেবাশিস একটু গম্ভীর হল। শান্ত গলায় বলে, ভালই করেছ। শচীন কিছু বলল না?
অনেক কথা বলল। তত্ত্বকথা। আমাকে সাহসের সঙ্গে তোমার কাছে চলে আসতে উপদেশ দিল।
দেবাশিস একটু কুঁচকে বিষয়টা ভেবে দেখে। তারপর বলে, শচীন ভেবেছে ও আমাকে চান্স দিচ্ছে। আই অ্যাম রেডি ফর দি ক্যাচ তৃণা। শচীন ইজ আউট।
তৃণা ঝুঁকে বসে কাঁদতে লাগল। দেবাশিস কাঁদতে দিল তৃণাকে। একবার কেবল বলল, তোমার খিদে পায়নি তৃণা? আমার কিন্তু পেয়েছে।
তৃণা সে কথার উত্তর দিল না। কেবল নেতিবাচক মাথা নাড়ল।
কান্নাটা বড়ই বিরক্তিকর। একটা মেয়ে সামনের সিটে উপুড় হয়ে বসে কাঁদছে— এ একটা সিন। গাড়ির কাচ দিয়ে বাইরে থেকেই দেখা যায়। অনেকে দেখছেও। দেবাশিস একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। বাড়িতে আজ রান্না হয়নি। ইচ্ছে ছিল রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেবে। কিন্তু তৃণার এই বেসামাল অবস্থায় রেস্টুরেন্টে যাওয়া সম্ভব নয়। বাড়িতেই যেতে হয়। আজ সকাল পর্যন্ত কী তীব্র পিপাসা ছিল তৃণার জন্য। এখনও কি নেই? কিন্তু কেবলই রবির কথা মনে পড়ছে, রবিকে ফুলির কাছে রেখে এল দেবাশিস। বদলে কি তৃণাকে পেল চিরকালের মতো? দুজনকে দুদিকের পাল্লায় বসিয়ে দেখবে নাকি কোনদিকটা ভারী?
কিছুতেই কিন্তু ভাবা যাচ্ছে না যে তৃণা চলে এসেছে চিরকালের মতো। হাতের নাগালে বসে আছে। একই ফ্ল্যাটে এরপর থেকে তারা থাকবে। দেবাশিস ভেবেছিল, এ এক অসম্ভব প্রেম। দুটো নৌকো, স্রোত…আরও কী কী যেন।
তৃণা বাথরুমে স্নান করছে। দেবাশিস বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করে। বিকেল চারটে বাজে মোটে। প্রীতম একবার চা দিয়ে গেছে। তারপর দোকানে গেছে খাবার আনতে। তৃণা এলে তারা খাবে।
দেবাশিস সিগারেট ধরিয়ে তার ফ্ল্যাটের বিশাল জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়। বহু নীচে ফুটপাথ। এই সেই খুনি জানলা। অত নীচে কী করে, কোন সাহসে লাফিয়ে পড়েছিল চন্দনা? হাত পা হঠাৎ নিশপিশিয়ে ওঠে তার।
ভাল করে পর্দা সরিয়ে পাল্লা খুলে ঝুঁকে দেখল দেবাশিস। ঝিম ঝিম করে ওঠে মাথা। অবলম্বনহীন শূন্যতা তাকে দু হাত বাড়িয়ে আকর্ষণ করে, এসো এসো। সাততলার ওপর সারাদিন, সব ঋতুতেই প্রচণ্ড হাওয়া খেলা করে, কী বাতাস? মার মার করে ছুটে আসছে ঠাণ্ডা, বুক জুড়োনো বাতাস। তবু অত হাওয়াতেও দেবাশিসের মুখে ঘাম ফুটে ওঠে। কত নীচে ফুটপাথ! কী তীব্র আকর্ষণ অধঃপাতের! সবসময়েই, অবিরল পৃথিবী তার বুকের কাছে সবাইকে টানছে। যখন জানলার চৌকাঠের অবলম্বন। জীবনে শেষবারের মতো ছেড়ে দিয়েছিল চন্দনা, ফুটপাথ স্পর্শ করবার আগে এই যে অবলম্বনহীন দীর্ঘ শূন্যতা বেয়ে নেমে গিয়েছিল তার শরীর, এই শূন্যতাটুকু কীভাবে অতিক্রম করেছিল ও? বাঁচতে ইচ্ছে করেনি ফের? কারও কথা মনে পড়েনি? কেঁদেছিল? এই পথটুকু, এই শূন্যতাটুকুতে চন্দনা কি চন্দনা ছিল? খুব জানতে ইচ্ছে করে। দেবাশিস কোমর পর্যন্ত শরীরের ওপরের অংশ ঝুলিয়ে দিল জানলার বাইরে! চেয়ে রইল নীচের দিকে। পোকার মতো মানুষ হাঁটছে, গাড়ি যাচ্ছে, একটা-দুটো গাছ, কালো মিশমিশে রাস্তা। কী ভয়ংকর! মুখের সিগারেটটা বাতাসে পুড়ে গেল দ্রুত। শেষ অংশটা ছুড়ে দিল দেবাশিস। বাতাসে খানিকটা ভেসে গেল, তারপর অনেক অনেকক্ষণ ধরে পড়তে লাগল নীচে…নীচে…নীচে…।
বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ। তৃণা বেরিয়ে এল। দে
বাশিস শরীরটা তুলে আনল ভিতরে। বাতাস লেগে চোখে জল এসে গেছে।
তৃণার কান্না আর বিষণ্ণতা স্নানের পর ধুয়ে গেছে। কিছুটা গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। শোওয়ার ঘরে দুটো একা খাট, বিছানা পাতা। তার পাশে একটা পর্দা-ঘেরা সাজবার ঘর। জানলার পাশেই লম্বা আয়না-লাগানো সাজবার টেবিল। তৃণা সেখানে গিয়ে বসল। চন্দনা এখানে বসে সাজত।
তৃণা নিজেকে আয়নায় দেখল। কিছু তেমন দেখবার নেই। একটু সামান্য সাজগোজ করল। চুলটা ফেরাল। কোনওদিনই সে খুব একটা সাজে না।
আয়নায় দেবাশিসের ছায়া পড়ল। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে একটু হাসি। চুলগুলো খুব এলোমেলো।
বলল, কেমন লাগছে তৃণা?
তৃণা বিষণ্ণ হেসে বলল, ভালই।
আজ থেকে…বলে চুপ করে দেবাশিস। কী বলবে?
তৃণা কথাটা পূরণ করে নিল মনে মনে। লজ্জায় মাথা নোয়াল। বলল, তুমি যাও দেব। স্নান করে এসো।
দেবাশিস আঙুলে ধরা সিগারেটটা তুলে দেখাল, বলল, যাচ্ছি। সিগারেটটা শেষ করে নিই।
অন্তত ও ঘরে যাও। পুরুষের সামনে আমি সাজতে পারি না।
ও। বলে দেবাশিস পর্দার ওপারে গেল। ওখান থেকেই বলল, শোনো তৃণা, তোমার যা যা দরকার প্রীতমকে দিয়ে আনিয়ে নাও। আজ রোববার, দোকান অবশ্য সবই বন্ধ।
কী আনাব? আমার কিছু দরকার নেই।
এক কাপড়ে তো বেরিয়ে এসেছ।
চন্দনার শাড়ি টাড়ি কিছু নেই?
না। সব বিলিয়ে দিয়েছি।
কেন দিলে?
রবির জন্য। ও সব থাকলেই তো ওর মায়ের কথা মনে পড়ত।
তৃণা বেশ ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ একথায় বুকে একটা ধাক্কা খেল। তবু হেসে বলে, তবু কি মনে পড়ে না?
পড়ে। সেটা চেপে রাখে। আমার ফ্ল্যাটটা কিন্তু আমি সাজাইনি, চন্দনা সাজিয়েছিল। সেইভাবেই সব আছে। এক একবার ভাবতাম সাজানোর প্যাটার্ন পাল্টে দিই। কিন্তু সময় পাইনি, এত কাজ। সেই সাজানো ঘরে চন্দনার কথা ওর মনে তো পড়বেই। এবার তুমি সাজাও।
দূর বোকা। মনে পড়া কি ওভাবে হয়! তুমি জানো না।
দেবাশিস একটা শ্বাস ফেলে বলল, আর রবির জন্য আমার ভাবনা নেই। ফুলির বাড়ির দঙ্গলে মিশে গেলে আর কিছু ওর মনে থাকবে না।
সিগারেটটা শেষ হয়েছে?
হয়েছে।
এবার যাও। আমার এখন খুব খিদে পাচ্ছে।
তোমার কী কী দরকার বললে না?
অনেক কিছুই দরকার। কিছু তো আনিনি। সে পরে হলেও চলবে।
লজ্জা কোরো না। এ তো আর পরের বাড়ি নয়। তোমার নিজের।
তৃণা একটু শ্বাস ফেলে বলল, তাই বুঝি?
নয়?
তৃণা একটু হেসে বলে, এত সহজে কি নিজের হয়? অনেক সময় লাগবে। আমাকে একটু সময় দিয়ো, তাড়া দিয়ো না।
দেবাশিস একটু উষ্মভরে পরদার ওপাশ থেকে বলে, কেন? সময় লাগবে কেন?
লাগবে না! গাছ উপড়ে দেখো তার শিকড়ের সবটা কি একবারে উঠে আসে? কত শিকড় বাকড়ের হেঁড়া সুতো কিছু কিছু মাটির মধ্যে থেকে যায়।
তৃণা—
উঁ।
গাছ তো একটানে ওপড়ানো হয়নি। দীর্ঘকাল ধরে তার শিকড়ের মাটি ক্ষয় হয়ে ছিল না কি!
আবার বলছি, তুমি বোকা।
কেন?
উপমা দিয়ে কি সব বোঝানো যায়? গাছের সঙ্গে মানুষের কিছু তফাত আছেই।
পরদা সরিয়ে উত্তেজিত দেবাশিস ও ঘরে চলে এল হঠাৎ। মেঝেতে তৃণার কাছে বসে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে বলল, তৃণা, আমি বড় কাঙাল।
জানি তো।
আজ আমার কেউ নেই।
তৃণা তাকিয়ে রইল।
দেবাশিস বলল, আর আমাকে এখন ও সব ভয়ের কথা বোলো না। তোমারও যদি ভেঁড়া শেকড় অন্য জায়গায় থেকে থাকে তবে আমার কী হবে? আজ থেকে রবিও পর হয়ে গেল।
তৃণা স্নিগ্ধস্বরে বলল, রবির জন্য তোমার বুকের ভিতরটা কেমন করে দেব, তা বোঝো না!
ভীষণ বুঝি।
ওটুকু কি আমার হতে নেই?
দেবাশিস চুপ করে গেল। জোব্বা জামার পকেট থেকে ফের সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনল। ধরাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।
তৃণা তেমনি স্নিগ্ধস্বরে বলল, আমরা তো আর ঠিক সকলের মতো হতে পারি না।
দেবাশিস বলল, তাও ঠিক। তবে আমরা কী রকম হব তৃণা।
খুব সুখী হব না, একটু কী যেন থেকে যাবে দুজনের মধ্যে!
তুমি কী ভীষণ স্পষ্ট কথা বলছ আজ তৃণা!
আজই বলে নেওয়া ভাল।
কেন? আজই কেন?
তৃণা চোখ মুছে হাসিমুখে বলে, আজ সপ্তাহের ছুটির দিন। তোমার সময় আছে। কাল থেকে তো তুমি আবার ব্যস্ত মানুষ। তোমার কি আর সময় হবে?
তুমি কথাটা ঘোরালে তৃণা। তু
মি বাথরুমে যাও। আমার খিদে পেয়েছে।
দেবাশিস তবু বসে রইল। চুপচাপ। অনেকক্ষণ বাদে মুখ তুলে বলে, তৃণা।
বলো।
মানুষকে তার সব সম্পর্ক থেকে ছিঁড়ে আনা যায় না। একজনকে ভাল না বাসলেই যে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল এমন নয়। আবার কাউকে ভালবাসলেই যে নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠল এও নয়। তবে ভালবাসা দিয়ে আমার কী করব?
তৃণা কপালটা টিপে ধরে বলল, ও, আবার সেই তত্ত্বকথা! জানো না মেয়েরা তত্বকথা ভালবাসে না! মাথা ধরেছে, তুমি তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এসো।
টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে প্রীতম। বড় রেস্টুরেন্টের দামি সব খাবার। প্রীতমের মুখে খুব একটা হাসি নেই। কেবল বিনয় আছে।
দেবাশিস যখন খাওয়ার টেবিলের ধারে এসে বসল তখনও তৃণা নিজের কপাল টিপে আছে, বলল, তোমার চাকরকে পাঠিয়ে একটু মাথা ধরার বড়ি আনিয়ে দাও।
দেবাশিস মৃদুস্বরে বলে, ও তোমার চাকর। অবশ্য পাঠানোর দরকার নেই। মাথাধরার বড়িটড়ি আছে বোধ হয়। খুঁজতে হবে।
খিদে চেপে রাখলে, বা কাঁদলে আমার মাথা ধরে।
দেবাশিস চোখ তুলে ইঙ্গিতে প্রীতমকে সরিয়ে দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে তৃণার একখানা হাত ধরে বলল, তুমি প্রস্তুত হয়ে আসোনি জানি। হুট করে চলে এসেছ। তাই কাঁদছ। কিন্তু আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম তোমার জন্য।
তৃণা হেসে বলল, খুব প্রস্তুত! একখানা শাড়িও যদি কিনে রাখতে। কাল আমাকে বাসি কাপড়ে সকালবেলাটা কাটাতে হবে, যতক্ষণ শাড়ি কেনা না হয়।
একটা দিন সময় দাও! প্লিজ। কাল থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ দোকান বন্ধ।
তৃণা মাথা নেড়ে বলল, সময়! সময়। দাঁড়াও, সময় নিয়ে কী একটা কবিতার লাইন মনে আসছে—
এল না। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়!
দেবাশিস বলে, খেয়ে একটু রেস্ট নাও। শোওয়ার ঘরের পরদাগুলো টেনে দিচ্ছি, ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকো একটু।
তুমি কোথায় যাবে?
কোথাও না। তোমার কাছেই বসে থাকব। বক বক করব।
তৃণা সস্নেহে হাসল।
পাঁচটা প্রায় বাজে। সাততলা ফ্ল্যাটের শার্শির গায়ে অত্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি রোদ এসে পড়েছে। এখনও অনেক বেলা আছে। অন্ধকার হতে এখনও অনেক বাকি। পরদায় ঢাকা শোওয়ার ঘরে শুয়ে আছে তৃণা। গায়ে খয়েরি পরদার আলোর আভা। দুটো বড়ি খাওয়ার পর আস্তে আস্তে মাথাধরাটা সেরে যাচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। তবু কি ঘুম আসে! দেবাশিস অনেকক্ষণ মাথাটা টিপে দিল। ঝিম মেরে শুয়ে ছিল তৃণা, ঘুমের ভান করে। সে ঘুমিয়েছে মনে করে দেবাশিস উঠে গেছে পা টিপে টিপে।
ঘরটা ঠিক অন্ধকার হয়নি। আবার আলোও নেই। সাততলার ওপর খুবই নিরাপদ আশ্রয়। একা শুয়ে আছে তৃণা। মাথা ধরা সেরে গেছে। নরম বিছানায় এলিয়ে আছে ক্লান্ত শরীর। এ একরকমের আলস্য। সুন্দর আলসেমি। কিন্তু ঘুম হবে না। আরও কতকাল ঘুম হবে না তৃণার।
সে চোখ চেয়ে দেখল ছাদের মসৃণ রং, চৌকো দেয়াল। দেয়ালে রহস্যময় আলো। চেয়ে থাকতেই সেই সুড়সুড়ির মতো একটা অনুভব। কে যেন দেখছে। খুব নিবিষ্টভাবে দেখছে তাকে।
চমকে উঠল তৃণা। মাথাটা একবার তুলে চারদিকে তাকাল। আবার মাথাটা বালিশে রেখে চোখ বোজে! কিন্তু অবিরল তার ওই অনুভূতি হয়, কে যেন দেখছে। ভীষণ দেখছে। চন্দনার ভূত? নাকি তার মনেরই প্রক্ষেপ? সে নিজেই হয়তো। ভাবতে ভাবতে মুখটা আস্তে ফেরাল তৃণা। চোখটা আপনা থেকেই খুলে গেল। আর ভীষণভাবে চিৎকার করে উঠে বসে সে কে? কে?
খাওয়ার ঘরের দিকটার দরজার পরদার ওপাশে যে দাঁড়িয়ে ছিল সে পরদাটা আস্তে সরিয়ে মুখ বাড়াল ভিতরে। ভার গলায় বলে, আমি, প্রীতম।
তৃণা অবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ে থেকে বলে, কী চাও?
চাকরটা একটু ভয়ের হাসি হেসে বলে, সাহেব বলে গেলেন আপনি ঘুম থেকে উঠলে খবর দিতে, উনি একটু কোথায় বেরোলেন। এক্ষুনি আসবেন।
কোথায় গেছেন?
বলে যাননি। গাড়ি নিয়ে গেলেন দেখেছি।
ও।
তৃণার বুকের ভিতরটা এখনও ঠক ঠক করছে। শ্লথ আঁচল টেনে নিয়ে সে উঠল। বলল, দাঁড়াও। তোমাদের ঘরটরগুলো আমাকে একটু দেখিয়ে দাও। চিনে রাখি।
চাকরটা উত্তর করল না, খুশিও হয়নি। তবু এক রকম বিরক্তি বা ঘেন্না চেপে রাখা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ও হয়তো ভাবছে, সাহেব রাস্তার মেয়েছেলে ধরে এনেছে, রাখবে। দেবাশিস তো ওকে বলেনি যে তৃণা আসলে কে! বললেও বুঝবে না। এমন অবস্থার দুটি মানুষের ভিতরকার প্রেমের সত্য কে কবে বুঝেছে। সবাই একটা কিছু ধরে নেয়।
শোওয়ার ঘর দুটো। একটা খাওয়ার ঘর। একটা বসবার। অনেকটা জায়গা নিয়ে খোলামেলা ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় শোওয়ার ঘরটা রবির। সেখানে অনেক খেলনা, ট্রাইসাইকেল, ছবির বই, ছোট্ট ওয়ার্ডরোব। এই ঘরটায় একটু বেশিক্ষণ থাকল তৃণা। চাকরটাকে বলল, এককাপ কফি করে আনন।
ফোনটা বাজছে বসবার ঘরে। বাজছেই। চাকরটা রান্নাঘরে। ওখান থেকে শুনতে পাবে না। তৃণা ইতস্তত করছিল, ফোন কি সে ধরবে? পরমুহূর্তেই ভাবল অমূলক ভয়। এ বাড়িতে যদি তাকে থাকতেই হয় তবে এ সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলাই উচিত। সে উঠে এল বসবার ঘরে। ফোন হাতে নিয়ে অলস গলায় বলে, হ্যালো।
একটা কচি গলা শোনা গেল বাপি?…ওঃ…থেমে গেল স্বরটা। তারপর নম্বরটা বলে জিজ্ঞেস করল— এটা কি ওই নম্বর?
তৃণা বুঝে নিল, রবি। ফোনের গায়ে লেখা নম্বরটা তৃণারও তো মুখস্থ। বলল, কে বলছ?
তুমি কে? বলে কচি গলাটা অপেক্ষা করল। হঠাৎ ভয়ার্ত গলায় বলল, মা?
তৃণা এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। ফোনটা কানে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। রবি ফোন করছে। যদি তৃণা রং নাম্বার বলে ফোন ছেড়ে দেয় তো রবি আবার ফোন করবে, শুধু আজ নয়, কালও করবে। হয়তো প্রায়ই বাবার সঙ্গে দরকার পড়বে তার, তৃণা কোথায় পালাবে? পালাবেই বা কেন? তবু প্রথম ধাক্কাটা সামলানোর জন্য একটু সময় দরকার। সে চোখ বুজে বলল, রং নাম্বার।
ফোন রেখে দিল। ভেবে পেল না, রবি কেন মা কিনা জিজ্ঞেস করল।
প্রীতম কফি করে এনেছে। সেই সময়েই ফোনটা আবার বাজে। প্রীতম তার দিকে তাকায়। তৃণা ঘাড় হেলিয়ে বলে, রবি ফোন করছে। ওকে আমার কথা বোলো না।
প্রীতম ফোন তুলে নিয়ে বলে, হ্যালো। রবিবাবু?
– না তো। ফোন বাজেনি।
–…
–সাহেব বাইরে গেছেন।
–…
– না আমি একা। তুমি আর আসবে না?
–…
চাঁপাদি আসবে না? আচ্ছা বলে দেব। তোমার সব জিনিস কাল পাঠিয়ে দেব।
–আচ্ছা তুমি আসবে না কেন?
–…
–এলে বলব। ছাড়ছি।
ফোন রেখে প্রীতম একবার আড়চোখে তৃণার দিকে চেয়ে বাইরে চলে গেল।
সাড়ে পাঁচটা। দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।
তৃণা ভেবেছিল দেবাশিস এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুলেই অপ্রস্তুত। দেবাশিস নয়। টেরিলিন পরা দিব্যি ঝকমকে একজন যুবা পুরুষ। সেও একটু অপ্রস্তুত। বলল, দেবাশিস নেই?
না। বেরিয়েছে।
ও। বলে খুব কৌতুহলভরে চেয়ে দেখল তৃণাকে।
তৃণা কি ওকে বসতে বলবে?
লোকটা নিজেই বলে, রবি নেই?
না।
লোকটার চোখে স্পষ্টই একটা প্রশ্ন–আপনি কে? কিন্তু লোকটা সে প্রশ্ন করে না, ভদ্রতায় বাধে। তাই বলল, আমি রবির মামা।
ও? আসুন।
বসে আর কী হবে! কেউ নেই যখন! বলতে বলতেও যুবকটি কিন্তু ঘরে আসে। একটু ইতস্তত করে বসে। একটা শ্বাস ফেলে হাতে হাত ঘসে বলে, আপনি ওর রিলেটিভ বোধ হয়।
তৃণা মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ।
চন্দনা আমার দিদি ছিল।
তৃণা তার এলো চুলের জট আঙুলে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, বুঝেছি, বুঝেছি। বসুন, ও এসে পড়বে। যুবকটি ঘড়ি দেখে বলে, একটু বসতে পারি। আমি ভাবলাম–বলে একটু কথা সাজিয়ে নিয়ে বলে, আসলে কাল আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। বলছিলাম কী দেবাশিসদা তো যাবেনই, সেইসঙ্গে আপনিও… যদিও ঠিক আচমকা এভাবে–
তৃণার ছেলেটির জন্য মায়া হয়। বুঝতে পারছে না, বুঝতে চাইছে। বলল, কফি খান। ও এসে পড়বে।
ছেলেটি প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে তাকে দেখতে থাকে! চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নেয়। কিন্তু দেখে। তৃণা কফি বানাতে বলবার ছল করে উঠে এল। রান্নাঘরে প্রীতমকে খবর দিয়ে শোওয়ার ঘরে গিয়ে বসে রইল চুপচাপ। শুনল, ওঘরে প্রীতমের সঙ্গে কথা বলছে লোকটা। চাপা স্বর। এরকমই হবে এর পর থেকে। তৃণার জায়গাটা স্থির হতে অনেক সময় লাণবে। অনেক সময়। তৃণা শুষ্কমুখে বসে থাকে। চুলের জট ছাড়ায় অনামনে।
দেবাশিসের ফিরতে ছ’টা বেজে গেল। তখনও ছেলেটা বসে আছে সামনের ঘরে। আর দেবাশিসের হাতে কয়েকটা শাড়ির প্যাকেট, রজনীগন্ধার ডাঁটি, কসমেটিক্সের বাক্স, খাবারের বাক্স। চন্দনার ভাই সে সব দেখে অবাক। পর্দার ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটা দেখল তৃণা।
না, দেবাশিস খুব একটা ঘাবড়াল না। চালাক লোকরা এরকম বিপদে পড়লে খুব গম্ভীর হয়ে যায়। দেবাশিসও হল। দু-চারটি কী কথা হল ওদের। ছেলেটা চলে গেল।
দেবাশিস বেশ হাঁক ছেড়ে ডাকল— তৃণা।
তৃণা ঘরের মাঝখানটায় গিয়ে পরদা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, কী?
দেবাশিস একগাল হাসি হেসে বলল, সব এনেছি।
কোত্থেকে?
তোমাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে হঠাৎ মনে পড়ল যাদবপুরে যখন থাকতাম তখন দেখেছি ওই অঞ্চলে রবিবারে দোকান খোলা থাকে। গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম, দেখো তো সব!
সব দেখে তৃণা হেসে কুটিপাটি। বলল, কী এনেছ এ সব?
কেন?
এ রংচঙে শাড়ি আমি পরি নাকি?
পরো না?
এসব তো রেবা পরে। আর অত কসমেটিক্স! হায় রে আমি কবে আবার ও সব আলট্রা মডার্ন লিপস্টিক মাখি, কিংবা কাজল!
দেবাশিস হেসে বলে, এবার মেখে। বুড়ি সাজা তোমার কবে ঘুচবে বলো তো!
মেয়ে বড় হয়েছে দেব, কদিন পরেই প্রেম করবে। এখনই করছে কি না কে জানে!
দেবাশিস হেসে বলে, বাঙালি মেয়েদের ওই হচ্ছে রোগ। তুমি সাজবে না কেন তৃণা?
তৃণা শুধু হাসল। স্নিগ্ধ হাসি। বলল, রবি ফোন করেছিল।
দেবাশিসের মুখের হাসিটা মরে গেল, বলল, কী বলল?
আমি ধরেছিলাম। রং নাম্বার বলে ছেড়ে দিয়েছি। পরে আবার ফোন করেছিল, তখন প্রীতম ধরে।
দেবাশিস একটু ভেবে বলল, থাকগে।
উঠে পোশাক পালটে এল দেবাশিস। চা খেল ফের।
ডাকল—তৃণা।
উঁ।
কীভাবে শুরু করা যায় বলো তো!
কী? কীসের কথা বলছ?
বুঝতে পারছ না?
না তো।
তোমার আর আমার এই জীবনটা।
শুরু আবার করবে কীভাবে?
ধরো, বিয়ে হলে পুরুতের মন্ত্র, ফুলশয্যা-টয্যা দিয়ে একটা শুরু করা যায়। রেজিষ্ট্রি করলে তারও সরকারি মন্ত্র আছে। আমরা কী দিয়ে শুরু করব?
তৃণা লজ্জা পেয়ে বলে, ও সব বোলো না। কানে লাগে। আমরা কিছু শুরু করলাম, নাকি শেষ করে এলাম?
তোমার কি তাই মনে হয়? তার উত্তরে বলা যায় যে একটা শেষ না করলে অন্যটা শুরু করা যায় তৃণা।
ফের তত্ত্বকথা।
তুমি যে শুরুটাকে শেষ বলছ!
শোনো দেব, আমি কিছু শেষ করে আসিনি। শুরুর কথাও ভাবিনি। আমি বাড়িতে ভূতের তাড়া খেয়ে বেরিয়ে এসেছি। আমি কী করছি আমি নিজেও জানি না। মাথার ভিতরটায় বড় গণ্ডগোল। আজ আমি কিছু ভাবতে পারছি না। শুধু একটা জিনিস জানি।
কী তৃণা? আগ্রহে দেবাশিস ঝুঁকে বসে।
তোমাকে আমার ভীষণ দরকার এ সময়ে। আর কিছু না।
তৃণা, তবে আমরা সেই আদিমভাবে শুরু করব। যখন কোনও অনুষ্ঠান ছিল না, কেবল শরীর ছিল।
ছিঃ। ওভাবে বোলো না।
দেবাশিস হেলান দিয়ে বসে বলে, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম বদমাশ। মেয়েদের হাতে চিঠি খুঁজে দিতাম। বসন্তবাবুর বাড়ির ছাদে প্রত্যেকদিন ঘুড়ি গোঁত্তা মেরে নামিয়ে দিতাম তাতে লেখা থাকত আই লাভ ইউ। বসন্তবাবুর মেয়ে রানিকে উদ্দেশ করে। তখন শুরু করার কোনও প্রবলেম ছিল না। ভাবতে শিখিনি, রচনা করতে শিখিনি, সাজাতে শিখিনি, ওই ভাবেই শুরু করতাম। চন্দনার সঙ্গেও হুট করে শুরু। প্রথমে শরীর, তারপর ভালবাসার চেষ্টা, যেন ফ্রাস্টেশন অ্যান্ড দি এভ, তোমাকে নিয়ে তো সেভাবে শুরু করা যায় না। আজ আমার মস্ত প্রবলেম।
আজকের দিনটা অত ভেবো না। মাথা ঠাণ্ডা করো।
দেবাশিস শ্বাস ছেড়ে বলে, আজকের দিনটা অদ্ভুত। বুঝলে? আজ রবিকে পার্মানেন্টলি ওর পিসির বাড়িতে দিয়ে এলাম। আর তারপরই শুনলাম তুমি চলে আসছ।
শচীন কিছু বলল না?
কী বলবে?
অধিকার ছেড়ে দিল এক কথায়? তুমিই বা কী বলে এলে?
তৃণা ভ্রূ কুঁচকে বলে, কী বলব? আমি কিছু বলে আসিনি।
দেবাশিস চমকে উঠে বলে, বলে আসোনি?
না। আমি প্রায়ই যেমন বেরোই তেমনি বেরিয়ে এসেছি।
আমার কাছে এসেছ সে কথা কেউ জানে না?
না।
কাউকে বলোনি?
বোকা।
কেন?
তুমি না ফিরলে ওরা তো থানা পুলিশ করবে। হাসপাতালে খোঁজ নেবে।
নেবে! বলছ?
নেবে না?
আমার তো মনে হয় না। ওরা কি জানে যে আমি আছি?
তুমি বোকা তৃণা। বলে আসলেই হয়। শচীনবাবু কি তোমাকে কামড়াত?
তা নয়। ওরা আমাকে নিয়ে বহুকাল ভাবে না। আজ একটু ভাবুক।
দেবাশিস মাথা নেড়ে বলে, তা হয় না।
বলেই উঠে গেল দেবাশিস। ডায়াল করতে লাগল। তৃণা ওর কাছে গিয়ে বলল, ফোন কোরো না। কিছুক্ষণের জন্য আমাকে নিরুদ্দেশ থাকতে দাও। ওরা ভাবুক।
তা হয় না। মাথা নাড়ল দেবাশিস। ফোন কানে তুলে শুনে বলল, এনগেজড।
তৃণা একটা নিশ্চিন্তের খাস ফেলল।
দেবাশিস ঘুরে বলল, আমি যা করব তা পাকাঁপাকি। কোনও অনিশ্চয়তা থাকবে না, দ্বিধা থাকবে।