দুপরের ক্লান্ত ঘড়িটা যে সাড়ে-তিনটের ঘরে ঢুকে পড়েছে তা সোমনাথ এবার বুঝতে পারলো। কমলা বউদি ঠিক এই সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো এই সময় কমলা বউদি বাড়ির লেটার বাক্সটা দেখেন। পিওন আসে তিনটে নাগাদ এবং তারপর থেকেই বাবা ছটফট করেন। মাঝে-মাঝে জিজ্ঞেস করেন, “চিঠিপত্তর কিছু এলো নাকি?” বাবার নামে প্রায় প্রতিদিনই কিছু, চিঠিপত্তর আসে। চিঠি লেখাটা বাবার নেশা। দনিয়ার যেখানে যত আত্মীয়স্বজন আছেন বাবা নিয়মিত তাঁদের পোস্টকার্ড লেখেন। তার ওপর আছেন অফিসের পুরানো সহকমীরা। রিটায়ার করবার পরে তাঁরাও দ্বৈপায়নের খোঁজখবর নেন।
সোমনাথেরও চিঠি পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিদেশী এক এমব্যাসির বিনামূল্যে পাঠানো একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাড়া তার নামে কিছুই আসে না। এই পত্রিকা পাবার বুদ্ধিটাও সুকুমারের। দুখানা পোস্টকার্ডে দুজনের নামে চিঠি লিখে দিয়েছিল দিল্লীতে এমব্যানির ঠিকানায়। বলেছিল, “পড়িস না পড়িস কাগজটা আসুক। প্রত্যেক সপ্তাহে পত্রিকা এলে পিওনের কাছে সুকুমার মিত্তির নামটা চেনা হয়ে যাবে। আসল চাকরির চিঠি যখন আসবে তখন ভুল ডেলিভারি হবে না।”
এই সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাড়া গত সপ্তাহে সোমনাথের নামে একটা চিঠি এসেছিল। বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির বিশেষ যন্ত্রে প্রতিদিন পাঁচ মিনিট দৈহিক কসরত করলে টারজনের মতো পেশীবহুল চেহারা হবে। ডাকযোগে মাত্র আশি টাকা দাম। বিফলে মূল্য ফেরত। বিজ্ঞাপনের চিঠি পেয়ে প্রথমে বিরক্তি লেগেছিল। তারপর সোমনাথের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। বম্বের কোম্পানি কষ্ট করে নাম-ঠিকানা জেনে চিঠি পাঠিয়ে তাকে তো কিছু, সম্মান দিয়েছে। চাকরিতে ঢুকলে, সোমনাথ ওই যন্তর একটা কিনে ফেলবে—পয়সা জলে গেলেও সে দুঃখ পাবে না।
এ-ছাড়া সোমনাথের পাঠানো রেজিস্টার্ড অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ ফর্মগুলো দু-তিনদিন অতর ফিরে আসে। নিজের হাতে লেখা নিজের নাম সোমনাথ খুঁটিয়ে দেখে। তলায় একটা রবার-স্ট্যাম্পে কোম্পানির ছাপ থাকে—তার ওপর একটা দুর্বোধ্য হিজিবিজি পাকানো রিসিভিং ক্লার্কের সই।
আজও কয়েকটা অ্যাকনলেজমেন্ট ফর্ম ফিরেছে। সেই সঙ্গে সোমনাথের নামে একটা চিঠিও এসেছে। কয়েকদিন আগে বক্স নম্বরে একটা চাকরির বিজ্ঞাপনের উত্তর দিয়েছিল। তারাই উত্তর দিয়েছে। লিখেছে অবিলবে ওদের কলকাতা প্রতিনিধি মিস্টার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। মিস্টার চৌধুরী মাত্র কয়েকদিন থাকবেন, সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করা উচিত।
ঠিকানা কীড্ স্ট্রীটের। সময় নষ্ট না করে সোমনাথ বেরিয়ে পড়লো। বউদি জিজ্ঞেস করলেন, “বেরচ্ছো নাকি?”
ফর্সা সাদা শার্ট প্যান্ট ও সেই সঙ্গে টাই দেখে কমলা বউদি আন্দাজ করলেন চাকরির খোঁজে বেরচ্ছে সোমনাথ।
মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন, ওর একটা চাকরি করে দাও ঠাকুর। বিনা অপরাধে ছেলেটা বড় কষ্ট পাচ্ছে।”
কমলার মনে পড়লো, কী আমুদে ছিল সোমনাথ। সবসময় হৈ-চৈ করতো। বউদির পিছনেও লাগতো মাঝে মাঝে! বলতো, “বউদি আপনাকে একদিন আমাদের কলেজে নিয়ে যাবো। মেয়েগুলোকে দেখলে, মডার্ন স্টাইল কাকে বলে আপনার ধারণা হয়ে যাবে। অফিসারের বউ হয়েছেন, কিন্তু আপনার গেয়ো স্টাইল পাল্টাচ্ছে না।”
কমলা হেসে বলতো, “আমরা তো সেকেলে, ভাই। তোমার বিয়ের সময় বরং দেখেশনে আধুনিকা মেয়ে পছন্দ করে আনা যাবে।”
সোমনাথ বলতো, “সেসব দিনকাল পাল্টেছে। এখন সব মেয়ে নিজের পছন্দ মতো তো আগে থেকেই ঠিক করে রাখছে, কাকে বিয়ে করবে।”
কমলা বলতো, “আমরাও তো কলেজে পড়েছি। তখন তো এমন ছিল না।”
সোমনাথ বলতো, সেসব দিনকাল পাল্টেছে। এখন সব মেয়ে নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করতে চায়।”
কমলার জন্মদিনে সোমনাথ একবার কাগজের মুকুট তৈরি করেছিল। ঝলমলে রাঙতা, লাগানো মুকুট বউদিকে পরতে বাধ্য করেছিল সে—তারপর ছবি তুলেছিল।
কাজলের সঙ্গে বুলবুলের বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল যখন, তখন সোমনাথই গোপন তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল। সহপাঠিনী সম্বন্ধে সোমনাথ বলেছিল, “দীপান্বিতার বেজায় ডাঁট। ওর সঙ্গে মেজদার বিয়েটা লাগলে, বউদি বেশ হয়। ওর তেজ একেবারে মিইয়ে যাবে!”
সন্ধ্যের আগেই সোমনাথ ফিরে এলো। সে যখন শার্ট খুলেছে তখনই কমলা ওর ঘরে ঢুকলো। সোমনাথের মুখে যেন একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
কীড স্ট্রীটের মিস্টার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছে সোমনাথ। চাকরিটা সেলস লাইনের। কলকাতার বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে। তাতে সোমনাথের মোটেই আপত্তি নেই। কিন্তু লোকটা কিছু টাকা চাইছে।
লোকটাকে অবিশ্বাস করতে পারতো সোমনাথ। কিন্তু খোদ এম-এল-এ গেস্ট হাউসে বসে ভদ্রলোক কথাবার্তা বললেন। সোমনাথের চোখে-মুখে দ্বিধার ভাব দেখে মিঃ চৌধুরী বললেন, “চারশ’ টাকা মাইনের চাকরির জন্যে আড়াইশ’ টাকা পেমেন্ট আজকালকার দিনে কিছু নয়। রেল, পোস্টাপিস, ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি এখন নিলামে উঠছে। বহলোক ছ’মাসের মাইনে সেলামী, দিতে রাজী রয়েছে।”
সোমনাথের মনে যতটুকু সঙ্কোচ ছিল, কমলা তা কাটিয়ে দিলো। সে বললো, “বাবা শুনলে, হয়তো রেগে যাবেন। কড়া প্রিন্সিপিলের লোক—উনি এইসব ঘষঘাষে রাজী হবেন না। কাজলকেও অতশত বোঝাতে পারবো না। কিন্তু সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে সযোগটা ছেড়ে লাভ কী? আমার কাছে আড়াইশ’ টাকা আছে।”
সংসার-খরচের টাকা থেকে লুকিয়ে বউদি যে টাকাটা দিচ্ছেন সোমনাথ তা বুঝতে পারলো। আগামীকাল কীড্ স্ট্রীটের এম-এল-এ কোয়ার্টারের সামনে লোকটার সঙ্গে দেখা করবে সোমনাথ। ভদ্রলোক চব্বিশ ঘণ্টার সময় দিয়েছেন।
প্রবল উত্তেজনার মধ্যে সময় কাটছে। মিস্টার চৌধুরী বলছেন, “এখন আড়াইশ’ দিয়ে বিহারে পোস্টিং নিন, তারপর আরও আড়াইশ’ খরচ দেবেন, কলকাতায় ট্রান্সফার করিয়ে দেবো।”
ভোরবেলার দিকে চাকরি পাবার স্বপ্ন দেখলো সোমনাথ। আড়াইশ’ টাকা পকেটে পরে মিস্টার চৌধুরী একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। তাই নিয়ে বাড়িতে চা আনন্দের উত্তেজনা। বাবা মুখে কিছু না বললেও, বেশ জোর গলায় বড় বউদিকে আর এক কাপ চায়ের হুকুম দিচ্ছেন। সোমনাথকে সামনে বসিয়ে অফিসের পলিটিকস সম্বন্ধে সাবধান সকতে বলছেন। কী করে কম স্থানে সবার মনোহরণ করতে হয় সে সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্ছেন।
ভূতপূর্ব কলেজবান্ধবী এবং বর্তমানে বউদি বুলবুলেরও খুব আনন্দ হয়েছে। বুলবুল বলছে, “কোনো কথা শুনছি না সোম—প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই সায়েবপাড়ায় একখানা ইংরেজী সিনেমা দেখাতে হবে এবং ফেরবার পথে পাক স্ট্রীটে গোল্ডেন ড্রাগনে চাইনিজ ডিনার।” সোমনাথ রাজী হয়েও রসিকতা করছে, “পয়সা সস্তা পেয়েছো? সিনেমা দেখাবো, কিন্তু নো চাইনিজ ডিনার।” বুলবুল রেগে গিয়ে বলছে, “আমাকে খাওয়াবে কেন? তার বদলে যাকে নিয়ে যাবে তার নাম আমি জানি না, এটা ভেবো না!”
চীনে রেস্তরাঁর দোতলায় নিয়ে যাবার সোমনাথের অন্য কেউ আছে এমন একটা সন্দেহ বুলবুল অনেকদিন থেকেই করছে। হাজার হোক কলেজে প্রতিদিন সোমনাথকে দেখেছে
সে। আর এসব ব্যাপারে মেয়েদের সন্ধানী চোখ ইলেকট্রনিক রাডারকে হারিয়ে দেয়।
সোমনাথের চাকরিতে সবচেয়ে খুশী হয়েছেন কমলা বউদি। বউদি কিন্তু কিছুই চাইছেন না। মাঝে মাঝে শুধু ছোট দেওরের পিঠে হাত দিয়ে বলছেন, “উঃ! যা ভাবনা হয়েছিল। আজই কালীঘাটে যেতে হবে আমাকে। কাউকে না বলে পঞ্চাশ টাকা মানত করে বসে আছি।” . বুলবুল বললো, “নো ভাবনা দিদি! ঐ পঞ্চাশ টাকাও সোমের প্রথম মাসের মাইনে থেকে ডেবিট হবে।”
কিন্তু এসবই স্বপ্ন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। কোথায় চাকরি? চাকরির ধারেকাছে নেই সোমনাথ।
সকালবেলা বউদি চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেন, “কখন যাবে? টাকাটা বার করে রেখেছি!”
টাকাটা পকেটে পরে যথাসময়ে সোমনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।
সোমনাথ ফিরতে দেরি করছে কেন? কমলা অধীর আগ্রহে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো। এখনও সোমনাথের দেখা নেই।
সাতটা নাগাদ সোমনাথ বাড়ি ফিরলো। ওর ক্লান্ত কালো মুখ দেখেই কমলার কেমন সন্দেহ হলো।
চিবুকে হাত দিয়ে সোমনাথ চুপচাপ বসে রইলো। বউদির দেওয়া টাকা নিয়ে সোমনাথ এম-এল-এ কোয়ার্টারে লোকটার সঙ্গে দেখা করেছিল। মিস্টার চৌধুরী নোটগুলো পকেটে পরে সোমনাথকে ট্যাক্সিতে চড়িয়ে ক্যামাক স্ট্রীটের একটা বাড়ির সামনে নিয়ে গিয়েছিলেন। “আপনি বসুন, আমি ব্যবস্থাটা পাকা করে আসি,” এই বলে লোকটা সেই যে বেপাত্তা হলো আর দেখা নেই। আরও পনেরো মিনিট ওয়েটিং ট্যাক্সিতে বসে থেকে তবে সোমনাথের চৈতন্য হলো, হয়তো লোকটা পালিয়েছে। ভাগ্যে পকেটে আরও একখানা দশ টাকার নোট ছিল। না হলে ট্যাক্সির ভাড়াই মেটাতে পারতো না সোমনাথ।
বড় আশা করে বউদি টাকাটা দিয়েছিলেন। সব শুনে বললেন, “তুমি এবং আমি ছাড়া কৈউ যেন না জানতে পারে।”
খুব লজ্জা পেয়েছিল সোমনাথ। সব জেনেশুনেও একেবারে ঠকে গেলো সোমনাথ। বউদি বললেন, “ওসব নিয়ে ভেবো না। ভালো সময় যখন আসবে তখন অনেক আড়াইশ’ টাকা উসল হয়ে যাবে।
তবু অস্বস্তি কাটেনি সোমনাথের। বউদিকে একা পেয়ে কাছে গিয়ে বলেছিল, “খুব খারাপ লাগছে বউদি। আড়াইশ’ টাকার হিসেব কী করে মেলাবেন আপনি?”
বউদি ফিসফিস করে বললেন, “তুমি ভেবো না। তোমার দাদার পকেট কাটায় আমি ওস্তাদ! কেউ ধরতে পারবে না।”
জানাজানি হলে ওরা দুজনেই অনেকের হাসির খোরাক হতো। এই কলকাতা শহরে এমন বোকা কেউ আছে নাকি যে চাকরির লোভে অজানা লোকের হাতে অতগুলো টাকা তুলে দেয়?
নিজের ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে সোমনাথের। পরের দিন দুপুরবেলায় বউদিকে একলা পেয়ে সোমনাথ আবার প্রসঙ্গটা তুলেছিল। “বউদি, কেমন করে অত বোকা হলাম বলুন তো?”
“বোকা নয়, তুমি আমি সরল মানুষ। তাই কিছু গচ্চা গেলো। তা যাক। মা বলতেন বিশ্বাস করে ঠকা ভালো।”
বউদির কথাগুলো ভারি ভালো লাগছিল সোমনাথে। কৃতজ্ঞতায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছিল। বউদির এই স্নেহের দাম সে কীভাবে দেবে? বউদি কিন্তু স্নেহ দেখাচ্ছেন এমন ভাবও করেন না।
কিন্তু ঠকে যাবার অপমানটা ঘরে-ফিরে সোমনাথের মনের মধ্যে এসেছে। এই কলকাতা শহরে এত বেকার রয়েছে, তাদের মধ্যে সোমনাথই-বা ঠকতে গেলো কেন?
এই ভাবনাতে সোমনাথ আরও দুর্বল হয়ে পড়তো, যদি-না দুদিন পরেই বেকারঠকানো এই জোচ্চোরটাকে গ্রেপ্তারের সংবাদ খবরের কাগজে বেরতো। কীড, স্ট্রীটে এম-এল-এ হোস্টেলের সামনেই লোকটা ধরা পড়েছিল। সোমনাথের লোভ হয়েছিল একবার পুলিশে গিয়ে জলঘোলা করে আসে, লোকটার আর-একটা কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়। কিন্তু বউদি সাহস পেলেন না। দুজনে গোপন আলোচনার পরে, ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
মোমনাথের আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরে এসেছে। সোমনাথ একাই তাহলে ঠকেনি, আরও অনেকেই এই ফাঁদে পা দিয়েছে এবং সোমনাথের থেকে বেশি টাকা খুইয়েছে।