আজকের দিনটা শুরু হয়েছে খুব খারাপ ভাবে। সকাল থেকেই বিরাট এক ঝামেলা। অন্তু জ্বরে অচেতন। তার মুখ দিয়ে লালা ভাঙছে। হাসান এসে তাকে কোলে করে নিচে নামিয়েছে। রিকশা করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ইলা জামানকে বলল, তুমি যাও না একটু সাথে। জামান মহা বিরক্ত হয়ে বলল–আমি সাথে গিয়ে করব কি?
জ্ঞান নেই। আমার কেন জানি ভয় লাগছে। না হয় আমি সঙ্গে যাই।
তোমার যাবার দরকার নেই। যা করার ঐ করবে। ভ্যাবদা ধরনের ছেলে। এরা কাজ গুছাতে ওস্তাদ। ডাক্তারদের হাতে পায়ে ধরে দেখবে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।
ইলার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি ধরনের কথাবার্তা। পরের বাড়ির একটা ছেলে। এত ছোটাছুটি করছুে অথচ লোকটার এত্বটুকু গরজ নেই। দিব্যি শর্টিপেন্ট পরছে। যদি ছেলেটার কিছু হয়? অবস্থা আরো খারাপ হলে তো আত্মিীয়জনদের খবর দিতে হবে।, আমি বেরুচ্ছি, বুঝলে। তেমন কিছু হলে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে টেলিফোন করে দিও। আর ভয়ের কিছু নেই। ওয়ার্কিং ক্লাসের লোকদের এত অল্পতে কিছু হয় না। দুএকটা স্যালাইন ট্যালাইন পড়লেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
ওর আত্মীয়স্বজনদের কোন খবর দেয়া দরকার না?
পাগলের মত কি সব কথা যে তুমি বল। ওর আত্মীয়স্বজন আমি পাব কোথায়? এদের কি কোন ঠিকানা আছে না পোস্ট বক্স নাম্বার আছে? শোন, হাসানকে বলে রেখে। গেট যেন খুলে রাখে। অফিস থেকে আবার যেতে হবে জয়দেবপুর।
ফিরতে দেরি হবে?
হুঁ হবে। গেট খোলা রাখতে বলবে।
দারুণ দুশ্চিন্তায় ইলার সময় কাটতে লাগল। তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি হাসান রিকশা নিয়ে ফিরে এসে বলবে–ভাবী, রাস্তার মধ্যে এই কাণ্ড হয়েছে। মরে গেছে বুঝতে পারি নি। এখন কি করব?
হাসান এগারটার দিকে ঘামতে ঘুমিতে ফিরে এল। সে অসাধ্য সাধন করেছে। অন্তুকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।
এক নম্বর ওয়ার্ডে আছে ভাবী। সিট নেই, বারান্দায় শুইয়ে রেখেছে। সিট হলে বিছানায় তুলে দিবে। জমাদারকে দশটা টাকাও দিয়ে এসেছি–বকশিস। জমাদার-টমাদার এরা অনেক কিছু করতে পারে।
জ্ঞান এসেছে?
হ্যাঁ, এসেছে। আসার সময় দেখে এসেছি কথাটথা বলছে। স্যালাইন দিচ্ছে। ডাক্তার সাহেব বললেন–ভয়ের তেমন কিছু নেই।
ভাই, তুমি আমার বিরাট উপকার করেছ।
ভর্তি করাতে খুব ঝামেলা হয়েছে। কেউ কোন কথা শুনে না। এদিকে অচেতন এই ছেলে নিয়ে আমি করি কি। আমার আবার অল্পতেই চোখে পানি এসে যায়। চোখে পানি এসে গেল। তাই দেখে একজন ডাক্তার ব্যবস্থা করলেন। ডাক্তারদের মধ্যেও ভাল মানুষ আছে ভাবী।
তা তো আছেই।
ডাক্তার সাহেব ভেবেছেন অন্তু আমার ভাই। আমি তাঁর ভুল ভাঙাই নি। ভাই ভেবেছে ভাবুক। কাজের ছেলে শুনলে হয়ত গা করবে না।
এস হাসান, ভেতরে এসে বস। কিছু খাবে?
জ্বি-না।
একটু কিছু খাও। এস লক্ষ্মী ভাই।
হাসান লজ্জিত মুখে ভেতরে ঢুকল। নিচু গলায় বলল, কোন চিন্তুা করবেন না ভাবী। দুপুরবেলা আমি আবার যাব।
ইলা বলল, হাসপাতাল থেকে কি খাওয়া-দাওয়া দেয়?
তা দেয়। আমি তিন টাকা দিয়ে একটা ভাব কিনে দিয়ে এসেছি। পাঁচটা টাকা বেঁচেছিল। ওর হাতে দিয়ে হেঁটে চলে এসেছি।
সে কি!
খামোকা টাকা খরচ করে লাভ কি বলেন? তাছাড়া হাঁটতে আমার ভালই লগি।
ইলা হাসানকে চা-বিসর্কিট এনে দিল। হাসান মাথা নিচু করে খাচ্ছে। এক পলকের জন্যেও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে না। তার পরনে আকাশী রঙের একটা শার্ট। শাঁটটা নতুন, তবে পেটের কাছে পয়সার সাইজের একটা পোড়া দাগ আছে। হাসনি একটা হাত সব সময় সেখানে দিয়ে রেখেছে।
বেচারার শার্ট বোধহয় এই একটাই। সব সময় এই একটা শার্টই গায়ে দিতে দেখা যায়। ইলা মনে মনে ঠিক করে ফেলল–আজই সে একটা শার্ট কিনবে। খুব। সুন্দর একটা শার্ট।
ভাবী যাই।
আচ্ছা ভাই এস।
আমি দুপুরে আবার যাব। আপনি চিন্তা করবেন না ভাবী।
হাসান পুরোপুরি চলে গেল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইলা বলল, কিছু বলবে?
ভাবী, আপনি ভাইজানকে আমার জন্যে একটা চকিরির কথা বলবেন। যে কোন চাকরি। ছোট হলেও ক্ষতি নাই।
ইলা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। হাসান মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল–এখানে আর থাকতে পারছি না ভাবী। প্রেসে সীসা চুরি হয়েছে। সবাই বলছে আমি চুরি করেছি। আমার কোথাও যাবার জায়গা নাই।
আমি ওকে বলব। অবশ্যই বলব। আজই বলব। কিন্তু ও বোধহয় কিছু করতে পারবে না।
আপনার আর কেউ চেনা নাই? খুব ছোট চকিরি হলেও আমার কোন অসুবিধা নাই।
ইলাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে এত বড় একটা পুরুষ মানুষ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ইলা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
হাসান নিজেকে সামলে নিল। হঠাৎ কেঁদে ফেলাতে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। অস্বস্তি ঢাকতে পারছে না। ইলা পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে হাসিমুখে বলল, তোমাকে বলেছিলাম আমাকে আপা ডাকতে। তুমি কিন্তু ভাবীই বলে যাচ্ছি।
মনে থাকে না।
মনে না থাকলে তো হবে না। মনে থাকতে হবে।
হাসান চলে যেতে ধরল। ইলা দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। তার মনে হচ্ছে হাসান আরো কিছু বলতে চায়। বলার সাহস পাচ্ছে না। ইলা বলল, কিছু বলবে?
হাসান হড়বড় করে বলল, আমার সম্পর্কে কিছু শুনেছেন আপা?
না, কি শুনব?
পরে বলব। আজ যাই আপা। বাজারে যেতে হবে।
অনেকদিন পর ইলা আজ আবার ঘুরতে বের হয়েছে। ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। হাসানকে বলা আছে, সে লক্ষ্য রাখবে। রাতি করে ফিরলেও আজ কোন সমস্যা নেই–জামানের ফিরতে দেরি হবে। জয়দেবপুরে এই মানুষটা কি করছে? কে জানে। কি করছে। এখন আর জানার আগ্রহ হচ্ছে না।
ইলা আজ কোথায় যাবে কিছু ঠিক করে নি। রিকশায় উঠে ঠিক করবে। বেশ কিছু টাকা সঙ্গে নিয়েছে। কত সে নিজেও জানে না। গুনে নেয় নি। জামানের মানিব্যাগ থেকে চোখ বন্ধ করে কয়েকটা নোট তুলে নিয়েছে। ইলা ঠিক করে রেখেছে–সব টাকা খরচ করবে। আবার ফ্ল্যাটে ফিরে আসবে খালি হাতে। সঙ্গে কিছু থাকবে না। কিছু থাকলে জামান টের পেয়ে যাবে।
ভাইয়ার জন্যে কোন একটা উপহার কিনতে পারলে ভাল হত। তা কেনা যাবে না। ভাইয়া কোন এক প্রসঙ্গে জামানকে বলে ফেলতে পারে। তাদের বাড়ির কারোর জন্যেই কিছু কেনা যাবে না। কি বিশ্রী সমস্যায় ইলা পড়েছে। টাকা আছে কিন্তু খরচ করতে পারছে না।
কোথায় যাওয়া যায়? ভূতের গলিতে জামানের বড় বোন থাকেন। হঠাৎ তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলে কেমন হয়? ভদ্রমহিলা চমকে উঠবেন কারণ তাদের বাড়িতে যাওয়া ইলার নিষেধ। জামান বিয়ের পরদিনই বলেছে–আমার কোন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ রাখবে না। আমার বড় বোন যদি আসে দরজাও খুলবে মা। দরজা খোলাও নিষেধ।
কেন?
আমি তাদের পছন্দ করি না।
তারা কি করেছে?
এত ইতিহাস বলতে পারব না। পছন্দ করি না। করি না। চাই না এদের সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ থাকুক।
জামানের বড় বোনকে ইলার অবশ্যি বেশ পছন্দ হয়েছিল। মোটামুটি মানুষ। চোখমুখে ভীত ভীত ভাব। অকারণেই চমকে উঠছেন। তিনি ইলাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, আমি ভূতের গলিতে থাকি। ভূতের গলিতে ঢুকেই একটা ওষুধের দোকান–ডেল্টা ফার্মেসী। ফার্মেসীর উল্টো দিকে তিনতলা বাড়ির দোতলায় থাকি। মনে থাকবে?
থাকবে।
ফার্মেসীটার নাম কি বল তো?
ডেল্টা ফার্মেসী।
তুমি আসবে তো?
আসব।
জামানকে না জানিয়ে আসবে। জামানকে বললে সে আসতে দেবে না। অকারণে রাগ করবে। কি দরকার?
ইলার বিয়ের সময় জামানের বড় বোন ছাড়াও বাজিতপুর থেকে জামানদের অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন। জামানের বাবা এসেছিলেন। ভদ্রলোকের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। হাত ধরে ধরে চলাফেরা করতে হয়। জামান তাঁকে বলল, আপনি কি জন্যে এসেছেন? তিনি থতমত খেয়ে বললেন–বিবাহ দেখতে আসলাম।
আপনি তো চোখেই দেখেন না। বিবাহু দেখবেন কি? খামোকা বাজে ঝামেলা করেন। আসা যাওয়ার খরচ আছে না? যাওয়ার সময়ও তো ভাড়া দিতে হবে। হবে না?
হবে।
তাহলে? এতগুলা মানুষ নিয়ে এসেছেন। থাকবেন কোথায়?
তোমার এইখানে থাকব। আর যাব কই?
দুই রুমের ফ্ল্যাট–থাকবেন বললেই তো হয় না। এ রকম উল্টাপাল্টা কাজ আর করবেন না। আপনি থাকতে চান খান–অন্যদের আমি হোটেলে দিয়ে আসব।
তাহলে আমাকেও হোটেলে দিয়ে আস। সবাই এক সঙ্গে থাকি।
সেটাও মন্দ না।
জামানের বাবা হোটেল থেকেই বাড়ি চলে গেলেন। প্রতি পনের দিন পরপর চিঠি লেখেন। জামান সেই সব চিঠির বেশির ভাগই পড়ে না। হাতে চিঠি দিলে হাই তুলে বলে–ফেলে দাও। কি লেখা আমি জানি–আমি ভাল আছি, তুমি কেমন আছ? গত সপ্তাহে মনি অর্ডার পাইয়াছি। টাকার পরিমাণ আরো কিছু বাড়াও–দ্রব্যমূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাইয়াছে … ইলা কিছু কিছু চিঠি পড়েছে। আসলেই তাই। চিঠিগুলিতে টাকা-পয়সী ছুড়ি অন্য কোন কিছুরই উল্লেখ নেই।
ইলা প্রথম গেল বায়তুল মুকাররাম, সেখান থেকে রিক্সা করে নিউ মার্কেট। নিউ মার্কেট থেকে বেবিটেক্সি নিয়ে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ। সেখানে সুন্দর একটা শপিং সেন্টার না-কি হয়েছে। সে কিছুই কিনল না। ঘুরে ঘুরে বেড়াল। ঐ শপিং সেন্টারে একটা বাচ্চা মেয়ে এক প্যাকেট চকলেট কেনার জন্যে খুব চাপাচাপি করছিল। মা কিছুতেই কিনে দেবে না। ইলা এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি কিনে দিলে আপনি কি রাগ করবেন? মেয়েটির মা অবাক হয়ে বললেন, আপনি কিনে দেবেন কেন? সে কি!
যদি আপনি অনুমতি দেন তবেই কিনতে পারি, প্লীজ।
চকলেটের টিনটা কিনতে চারশ টাকা চলে গেল। টাকাটা দেবার সময় ইলার বুক খানিকক্ষণ খচখচ করল। এতগুলি টাকা! সেই খচখচ ভাব স্থায়ী হল না। বাচ্চা মেয়েটি চকলেটের টিন হাতে লাফাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আন্টিকে স্নামালিকুম দাও। বল–চকলেটের জন্যে ধন্যবাদ।
মেয়েটি কোন কিছু বলাবলির ধার দিয়ে গেল না। সে সমানে লাফাচ্ছে।
ইলা যাত্রাবাড়িতে উপস্থিত হল একটার দিকে। সুরমা দরজা খুলে দিলেন। ইলা হাসিমুখে বলল, কেমন আছি মা? রান্না হয়েছে? প্রচণ্ড খিদে। ভাত খাব। বাসা খালি কেন? কেউ নেই?
না।
গেল কোথায়?
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, দুপুর বেলায় কেউ বাসায় থাকে না-কি? রুবা গেছে পিকনিকে। লঞ্চে করে মানিকগঞ্জ যাবে। আবার ফিরে আসবে।
ভাইয়া? ভাইয়া কোথায়?
জানি না কোথায়। বাউণ্ডুলেটার সঙ্গে কোথায় কোথায় যেন ঘুরছে। ছোঁড়াটি। বাবুর মাথা খেয়েছে। এখন বলছে ভাতের হোটেল দিবে। বাবু তাতেই লাফাচ্ছে।
তুমি মনে হয় খুব রাগ করছ।
রাগ করব না? ভদ্রলোকের ছেলে ভাতের হোটেল দেবে কেন?
ইলা হাসিমুখে বলল, লোকের ছেলেরা দেবে পোলাওয়ের হোটেল।
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, সব কিছু নিয়ে হাসবি না। এটা কোন হাসিঠাট্টার বিষয় না। হাতমুখ ধুয়ে আয়। ভাত বাড়ি।
ভাত খাব না মা। এখন চলে যাব।
একটু আগে না বললি খাবি।
এখন বলছি–খাব না। কারণ একটা জরুরী কাজ বাকি আছে।
জরুরী কাজটা কি?
তোমাকে বলা যাবে না।
ভূতি খেয়ে যা। কতক্ষণ লাগবে ভাত খেতে?
একবার তো মা বললাম, খাব না। কেন বিরক্ত করছ?
সুরমা বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইলা বাথরুমে ঢুকল। অনেক সময় নিয়ে গোসল করল, বের হয়ে এল হাসিমুখে।
ভাত দাও মা।
সুরমা ভাত বাড়লেন। তিনি আগ বাড়িয়ে আর কোন কথাবার্তায় গেলেন না। খাবার আয়োজন খুবই নগণ্য। ডুলি, বেগুন ভর্তা, ভাত। ইলার জন্যে একটা ডিম ভাজা করা হয়েছে। খেতে খেতে ইলা বলল, ভাইয়ার ব্যবসা মনে হয় জলে ভেসে গেছে। সুরমা তিক্ত গলায় বললেন, সঙ্গ দোষে ওর সব গেছে। ছোটলোকটা মাথার মধ্যে একেক বার একেকটা জিনিস ঢোকায়–বাবু লাফায়। আরে গাধা, তোর নিজের বুদ্ধিশুদ্ধি নেই।
ছোটলোক কাকে বলছ মা, নাসিম ভাইকে?
আর কাকে বলব!
আমরা কি বড়লোক?
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, তুই কি এর মধ্যে প্যাঁচ ধরছিস নাকি? তোদের সঙ্গে তো কথাবার্তা বলাই মুশকিল। রাগের মাথায় ছোটলোক বলেছি।
কোন সময়ই এটা বলা উচিত না মা। কারণ তুমি ভাল করেই জান নাসিম ভাইকে শুধু ভাইয়া না, আমি, রুবা, আমরা দুজনই খুব পছন্দ করি। আমাদের খুব পছন্দের একজন মানুষকে তুমি কথায় কথায় ছোটলোক বলতে পার না।
সুরমা কঠিন গলায় বললেন, বলে বিরটি অন্যায় করেছি–এখন আমাকে কি করতে হবে। পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে?
তোমার বিরক্তি মেজাজ হয়েছে মা। মনে হয় ব্লাড প্রেসার আরো নেমে গেছে। দুধ-ডিম কি তুমি ঠিকমত খাচ্ছ?
সুরমা কিছু বললেন না। মা এবং মেয়ে দুজন দুজনের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। সুরমাই প্রথম চোখ নামিয়ে নিলেন। ইলা হাসিমুখে বলল, চোখে চোখে তাকিয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় তুমি কখনো জিততে পার না মা। তুমি সব সময় হেরে যাও। কোনদিন পারবে না।
এটা কি ধরনের কথা?
ইলা হেসে ভাত খাওয়া শুরু করল। খাওয়া শেষ করে সহজ ভঙ্গিতে বলল, ঘরে পান আছে মা? একটা দাও তো।
সুরমা পান এনে দিলেন। ইলা বলল, আমি খানিকক্ষণ ঘুমুব মা। তুমি আমাকে ঠিক পাঁচটার সময় ঢেকে দেবে।
আমার ঘরে ঘুমুবি? ঐ ঘরটায় আলো আসে না। আরাম করে ঘুমুতে পারবি। রুবার খরে রোদ আসে।
আমার ঘরটা এখন হয়েছে রুবার ঘর?
বিয়ের পর–স্বামীর ঘরই ঘর। আর কোন ঘর–ঘর না।
জামানের সঙ্গে তোমার মিল আছে মা। জামানও এই ভাবে কথা বলে।
সুরমা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, জামান জামান করছিস কি রে?
কি বলব? জামান সাহেব? নাকি মিস্টার জামান?
সুরমা কিছু বললেন না। ইলা হাসিমুখে বলল, তুমি আমাকে খুব ভয় পাও–তাই না মা? সুরমা ক্ষীণ গলায় বললেন, বিয়ের পর তুই কি রকম পাগলাটে হয়ে গেছিস। আমি তোকে ভয় পাব কেন?
ভয় পাও না, তাহলে এমন ফিসফিস করে কথা বলছ কেন?
সুরমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ইলা রুবার ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। শুধু দরজা না, জানালাও বন্ধ করল। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল।
পাঁচটায় ইলাকে ডেকে তোলার কথা। সুরমা জেগে বসে রইলেন। ঠিক পাঁচটায় দরজা ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে ইলা বলল, ধাক্কাধাক্কি করবে না তো মা। আমার এখনো ঘুম আসে নি। তোমাকে ডাকতে হবে না। আমি নিজেই উঠব।
দিন খুব খারাপ করেছে ইলা। ঝড়বৃষ্টি হবে।
হোক।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে তোর বাসায় যাবি কিভাবে? বাবু রাত দশট-এগারটার আগে বাসায় ফেরে না! তোকে দিয়ে আসবে কে?
আমাকে দিয়ে আসতে হবে না। আমি এখানেই থাকব। তুমি আর বিরক্ত করো না তো মা। আমি এখন ঘুমুব।
ইলার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে আগে। রুবা ফেরে নি। ঘরে সুরমা একা। তাঁর মনে হচ্ছে রুবার কোন একটা সমস্যা হয়েছে। হয়ত লঞ্চ ডুবে গেছে। কিংবা লঞ্চের উপর ছোটাছুটি করতে গিয়ে পা পিছলে রুবা পানিতে পড়ে গেছে। রুবা সাঁতার জানে না।
সুরমা তাঁর মনের অস্থিরতা কিছুতেই কমাতে পারছেন না। বাবুও বাসায় নেই, কাকে তিনি কি বলবেন? ইলার ঘুম ভাঙতে তিনি ব্যাকুল গলায় বললেন, রুবা তো এখনো ফিরল না। বলে গিয়েছিল চারটার সময় ফিরবে।
ইলা হাই তুলতে তুলতে বলল, পিকনিক-টিকনিকে গেলে খানিকটা দেরি হয়। এসে যাবে।
তোর দুশ্চিন্তা লাগছে না?
না।
ইলা চুল আঁচড়াল। শাড়ি ঠিকঠাক করে, হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, যাই মা।
চলে যাচ্ছিস?
হুঁ।
তুই না বলেছিলি থাকবি।
থাকব না। ভাল লাগছে না। জামান সাহেব যদি কোন কারণে আজ আগেভাগে এসে পড়েন তাহলে তালাবন্ধ বাসা দেখে কি করবেন কিছুই বলা যায় না। আমাকে হয়ত কেটে কুচিকুচি করে তেল মসলা দিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলবেন।
সুরমা স্তম্ভিত গলায় বললেন, তোর কি মাখাটাথা খারাপ হয়ে গেছে?
ইলা হুসিল। সুন্দর করে হাসল। সেই হাসি দেখে সুরমা ভরসা পেলেন। আদুরে গলায় বললেন, থেকে যা না। রাতে বাবু ফিরলে তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। জামাইকে বুঝিয়ে বলবে।
বুঝিয়ে কি বলবে?
বলবে–রুবা বাসায় ফিরছিল না, আমি ভয়ে অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করছিলাম। আমাকে সামাল দেবার জন্যে তুই থেকে গেছিস। তুই থাকতে চাচ্ছিলি না–আমিই জোর করে রেখে দিয়েছি …।
মা তুমি তো খুব গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পার।
সুরমার মুখ কালো হয়ে গেল। ইলা বলল, মা আমি যাচ্ছি। রুবাকে নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করবে না। ও আমার মত বোকা মেয়ে না–ধর, যদি লঞ্চ ডুবেই যায়, সে ঠিক সাঁতরে পারে উঠে আসবে। সে সাঁতার জানে না। তারপরেও কোন না কোনভাবে ঠিকই ম্যানেজ করবে।
সুরমা বললেন, আমার উপর তৈীর এত রাগ কেন রে ইলা?
তোমার উপর আমার এত রাগ কেন তা তুমি ভাল করেই জান মা।
আমি যা করেছি, তোর ভালর জন্যেই করেছি।
ভালর জন্যে করেছ?।
হ্যাঁ। আজ তুই বুঝতে পারছিস না। একদিন বুঝতে পারবি।
সেই একদিনটা কবে?
যেদিন তোর বড় মেয়ের বিয়ের বয়স হবে সেদিন। আজ আমি যা করেছি সেদিন তুইও ঠিক তাই করবি।
ইলা আবার হাসিল। সুরমা এগিয়ে এসে মেয়ের হাত ধরলেন। ইলা বলল, হতি ছুড়ি মা। মসলা পিষে পিষে তোমার হাতে কড়া পড়ে গেছে। আমার ব্যথা লাগছে। সুরমা হাত ছড়িলেন না। কোমল গলায় বললেন–বোস। একটু বেসি। কেতলি চুলায় দিয়ে এসেছি। পানি ফুটছে। চা খেয়ে যা। তোর সঙ্গে খাব বলে আমিও চা খাই নি।
ঠিক আছে মা, বসছি। যাও, চা বানিয়ে আন।
চা বানাতে বানাতে সুরমা ঠিক করে ফেললেন–ইলাকে গুছিয়ে কথাগুলি কি করে বলবেন। অসংখ্যবার তিনি নিজের মনে কথাগুলি গুছিয়ে রেখেছেন। কখনো বলতে পারেন নি। আজ হয়ত বলতে পারবেন।
এক বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তিনি মা হিসেবে সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। তিনি যেভাবে পরিস্থিতি সামলেছেন–অন্য মায়েরাও ঠিক একইভাবে পরিস্থিতি সমিলাবেন। তিনি কোন ভুল করেন নি। এই ব্যাপারটা ইলাকে বোঝাতে হবে। ইলা অবুঝ নয়। সে বুঝবে।
ব্যাপারটা শুরু হয় এই ভাবে। তিনি বছর দুই আগে ভয়ংকর আতংক নিয়ে লক্ষ্য করেন নাসিম এ বাড়িতে এলেই তার বড় মেয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ফেল করা আই এ, পসি এক ছেলে। যার বাবা মোটর মেকানিক। কিছুদিন পরপর বিয়ে করা যার প্রধান হবিগুলির একটি। যার সর্বশেষ বিয়েটি হল জনৈক রিকশাওয়লার টৌদ্দ বছরের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে। ইলার রুচি এত নিচে কি করে নামে তিনি ভেবে পান না। তাঁর এম. এ. ক্লাসে পড়া মেয়ে কেন নাসিম নামের রাস্তার একটা ছেলের গলার স্বর শুনলে আনন্দে ঝলমল করে উঠে? কি আছে এই ছেলের? যেমন তার ভাঁড়ের মত চেহারা ঠিক তেমনি ভাঁড়ের মত আচার-আচরণ। হো হো করে হাসা ছাড়া এই ছেলে আর কি পারে। তার কোন কাজটা স্বাভাবিক। একদিন সন্ধ্যায় রিকশায় করে একটা স্যুটকেস, একটা ট্রাংক নিয়ে উপস্থিত। দাঁত বের করে বলল, কয়েকটা দিনের জন্যে আশ্রয় দিতে হয় খালা। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ভদ্রভাবে বের করে নি, স্পঞ্জ পেটা করেছে।
রুবা বলল, স্পঞ্জ পেটাটি কি?
জুতা পেটার চেয়েও নিম্নমানের। স্পঞ্জ স্যান্ডেল নিয়ে তাড়া করেছে …
কেন?
কে জানে কেন? রাত বারটার সময় মদফদ খেয়ে বাসায় ফিরেছে। ঐ জিনিস খেলে পিতাজীর মেজাজ থাকে খারাপ। নতুন মার সঙ্গে বোধহয় হয়েছে গণ্ডগোল। রাগ ঝাড়ার লোক পায় নি। আমাকে পেয়েছে। স্পঞ্জের স্যাঙুেল নিয়ে তাড়া করেছে। হা হা হা।
সুরমা বললেন, হাসছ কেন? এর মধ্যে হাসির কি আছে?
ব্যাপারটা খুবই হাসির ছিল খালা। আপনি দেখেন নি তো, তাই বুঝতে পারেন। নি। দেখলে বুঝতেন। বাবা আমার পিছনে পিছনে ছুটছে। ভয় পেয়ে আমার হয় বেনি ছুটছে দুদিকে। নতুন মা ছুটছে আরেক দিকে। ভয়াবহ অবস্থা। এর মধ্যে আমার নতুন মা আবার আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। নতুন মার অবস্থা খেকে বাবার মন দুঃখে নরম হয়ে গেল। স্যান্ডেল হাতে মার দিকে ছুটে গেলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–ব্যথা লাগছে ময়না?
গল্প শুনে সুরমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল আর হেসে ভেঙে পড়ছে তাঁর বড় মেয়ে! তার এত আনন্দ?
ইলা বলল, নাসিম ভাই তুমি আমাদের সঙ্গে কতদিন থাকবে?
যতদিন থাকতে দিস ততদিন।
সারক্ষীবন থাকতে হবে। আমরা তোমাকে যেতে দেব না।
ইলার কথা শুনে সুরমার গা হিম হয়ে গিয়েছিল। মেয়ে কি বুঝতে পারছে সে কি সর্বনাশা কথাবার্তা বলছে। এই বুদ্ধি কি মেয়ের আছে? মেয়ের যে এই বুদ্ধি নেই তা পুরোপুরি বুঝতে তাঁর দেরি হল না। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইলার বিয়ে নিয়ে। যাকে পান তাকেই বলেন। অনেকে আগ্রহী হয়ে আসে। মেয়ে দেখে খুশি হয়। খুশি নাহার কোন কারণ নেই। কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে ভেঙে যায়। আজকাল শুধু রূপে বিয়ে হয় না। রূপের সঙ্গে আরো অনেক কিছু লাগে। সেই অনেক কিছু তার নেই। তিনি লক্ষ্য করেন যতবার বিয়ে ভাঙে ততবারই আনন্দের আভা দেখা যায় ইলার চোখেমুখে। যেন খুব সুখের কোন ঘটনা ঘটেছে। সুরমা নিজেকে বুঝিয়েছেন–এটা আর কিছুই না–ভুনি। মেয়ে অভিনয় করছে। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া যে কোন মেয়ের জন্যেই ভয়াবহ অপমানের ঘটনা।
সুরমার ধারণা যে ঠিক না তার প্রমাণ পেলেন এক রাতে। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়েছেন। শরীর ভাল না। গভীর রাতে দরজায় ধাক্কা পড়ল। ইলা চাপা গলায় ডাকল, মা। একটু দরজা খোল।
তিনি বিস্মিত হয়ে বিছানা ছেড়ে নামলেন। বাতি জ্বালালেন, দরজা খুললেন। ইলা দাঁড়িয়ে আছে। তার এতদিনের চেনা মেয়েকে তিনি চিনতে পারছেন না। যেন অন্য কোন মেয়ে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে। থরথর করে কাঁপছে। তিনি বললেন, কি হয়েছে রে?
তোমার সঙ্গে কথা বলব।
আয় ভেতরে আয়। তোর কি শরীর খারাপ?
না। শরীর খারাপ না, শরীর ভাল। বাতি নেভাও মা।
বাতি নিভাতে হবে কেন?
আলো জ্বালা থাকলে কথা বলতে পারব না।
সুরমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। ইলা কি বলবে তিনি বুঝতে পারছেন। সেই
কথা শোনার মত সাহস তাঁর নেই।
বল কি বলবি।
আমার বিয়ে নিয়ে তুমি যে চরিদিকে ছোটাছুটি করছ তার দরকার নেই মা।
দরকার নেই কেন?
আমি আমার নিজের পছন্দমত একটা ছেলেকে বিয়ে করব।
আছে এ রকম কেউ?
ইলা জবাব দিল না। সুরমা ইলার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনলেন। তিনি শান্তু গলায় বললেন, সেই ছেলেটা কি নাসিম? ইলার কান্নার শব্দ বাড়ল। এবারো জবাব দিল না।
সুরমা বললেন, তুই যে মাসিমকে বিয়ে করতে চাস তা কি সে জানে?
না জানে না।
কিছুই জানে না?
না।
তুই তাকে চিঠিফিঠি কিছু দিয়েছিস?
না।
আমার গা ছুঁয়ে বল।
গা ছুঁয়ে কিছু বলতে হবে না মা। নাসিম ভাই কিছুই জানে না।
তুই শুয়ে থাক বিছানায় আমি তোর গায়ে হাত বুলিয়ে দি।
ইলা বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়ল। তিনি মেয়ের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে ক্ষীণ গলায় বললেন, তুই আমাকে বললি কেন? তুই নিজে কেন তোর কথা তাকে বললি না।
আমার লজ্জা লাগল। আমার মনে হচ্ছিল–আমার কথা শুনে উনি হো হো করে হেসে ফেলবেন। সবার সামনে আমাকে ক্ষ্যাপাবেন।
ইলা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। সুরমা বললেন, কাঁদিস না–যা বলার আমি বলব।
কবে বলবে?
কালই বলব।
নাসিম ভাইকে বলবে?
না তাকে প্রথমে বলব না। আগে তার বাবার সঙ্গে কথা বলব। তুই কাঁদিস না।
ইলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে না। তুমি তাকেই বল।
আচ্ছা বলব। মাসিমকেই বলব।
তুমি এত ভাল কেন মা?
মা হিসেবে যা করার তিনি করেছেন। ইলার মাথা থেকে ভূত দূর করেছেন। তিনি যা করেছেন যে কোন মা তাই করবে। তিনি তাঁর মেয়ের সাময়িক আবেগের দিকে তাকান নি। মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছেন। তাঁর সূক্ষ্ম কৌশল মেয়ে ধরতে পারে নি। জামানের সঙ্গে বিয়ে ঠিকঠাক হবার পর সে আপত্তি করে নি। বিয়ে করেছে।
এখন মনে হচ্ছে ইলা তাঁর সূক্ষ্ম চাল ধরে ফেলেছে। ধরে ফেলারই কথা। ইলা বোকা মেয়ে নয়। বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে এখন যে কষ্ট পাচ্ছে তা সাময়িক কষ্ট। স্বামীর সংসারে এক সময় মন বসে যাবে। ছেলেমেয়ে হবে। পুরানো কথা কিছুই মনে থাকবে না।
সুরমা যে কাজটি করেছিলেন তাঁর জন্যে তাঁর মনে কোন অপরাধ বোধও নেই। তিনি এমন কোন অন্যায় করেন নি। এক সন্ধ্যায় নাসিমকে গোপনে ডেকে এনে বলেছিলেন–বাবা তোমার কাছে আমি একটা অনুরোধ করব। তুমি কি রাখবে?
নাসিম হকচকিয়ে গিয়ে বলেছে–অবশ্যই রাখব খালা। আপনি একটা কথা বলবেন আমি রাখব না। তা কি করে হয়!
আমি তোমার কাছে হাত জোড় করছি বাবা।
ছিঃ ছিঃ খালা–কি করছেন আপনি।
নাসিম এসে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করল। সুরমা বললেন, তুমি কি ইলাকে ডেকে একটু বলবে যে তুমি তাকে ছোটবোনের মত দেখ।
তাই তো দেখি খালা।
আমি জানি বলেই বলছি। তুমি তাকে বল–ইলাকে তুমি ছোটবোনের মতই স্নেহ কর। তুমি চাও তার একটা ভাল বিয়ে হোক।
তা তো খালা আমি সব সময় চাই। এরকম ভাল একটা মেয়ে তার একটা ভাল বিয়ে-তো হতেই হবে। ইলার মত সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবীতে খুব কম আছে। চার পাঁচটার বেশি না।
তাহলে বাবা তুমি ইলাকে একটু বল।
এটা বলার দরকার কি?
সুরমা খানিকক্ষণ ইতস্তুত করে বললেন, বলার দরকার আছে। তার ধারণী তুমি তাকে অন্য চোখে দেখ। এই ভেবে সে হয়ত মনে কষ্ট পায়।
নাসিম ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সুরমা বললেন, এই সব কথা তাকে বলার দরকার নেই। তুমি শুধু বল যে তুমি তাকে ছোটবোনের মৃত দেখ।
খালা আমি আল্পই বলব। ইলা গেছে কোথায়?
বাবুর সঙ্গে কোথায় যেন গেছে। তিন ভাইবোন মিলে গেছে। তুমি বরং চলে যাও। অন্য একদিন এসে বলে।
জ্বি আচ্ছা।
আর শোন বাবা। তুমি নিজেও এখন একটা বিয়ে-টিয়ে কর। আমরা দেখি।
করব খালা। একটু সামলে সুমলে উঠি তারপর। খালা আজ যাই।
সুরমা যা করেছেন নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই করেছেন। আজ সে তা বুঝতে পারছে না। একদিন পরিবে। আজ সে তার মাকে ক্ষমা করতে পারছে না। একদিন অবশ্যই পারবে।
সুরমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখেন ইলা চলে গেছে। কিছু বলে যায় নি। তিনি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। রুবা রিকশা করে ফিরছে। মাকে দেখে সে খুব হাত নাড়ছে। রুবার হাতে লাল রঙের বিরাট এক বেলুন।
ইলাদের বাসার সামনের রাস্তাটা আজ অন্ধকার। আবারো বোধহয় ঢিল ছুঁড়ে স্ট্রিট ল্যাম্প ভাঙা হয়েছে। আকাশ মেঘলা বলেই চারদিক অন্ধকার। রিকশা থেকে নেমেই ইলা তাদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল। ফ্ল্যাটের সবগুলি বাতি জ্বলছে। ইলার বুক ধকধক করা শুরু হয়েছে। ফ্ল্যাটের সব আলো জ্বলার অর্থ একটাই–জামান আজ সকাল সকাল ফিরেছে। তার কাছে চাবি আছে, ঘরে ঢুকেছে তালা খুলে। কতক্ষণ আগে সে এসেছে জানতে পারলে ভাল হত। হাসানকে জিজ্ঞেস করে গেলে হয়।
ইলা রিকশা ভাড়া দিল। ভয়ে ভয়ে সে এগুচ্ছে। তার হাত-পা কাঁপছে। এটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোন অসুখের পূর্ব লক্ষণ। নয়ত সে এত ভয় পাবে কেন?
ভাবী?
ইলা চমকে উঠল। সিঁড়ির মুখে অন্ধকারে মিশে হাসান দাঁড়িয়ে আছে। নীল শার্টের ছোঁড়াটা হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বেচারার জন্যে শার্টটা কেনা হয় নি। কাল একবার যেতে হবে।
ভাবী একটা খারাপ খবর আছে।
ইলা দাঁড়িয়ে আছে। হসান তাকে কি খারাপ খবর দিতে পারে সে বুঝতে পারছে না।
কি খবর?
অন্তুর শরীর খুবই খারাপ।
সে কি?
ডাক্তার বলছেন–বাঁচবে না। ঠোঁটের ঘা থেকে নানান সব সমস্যা হয়েছে। আজ বিকেলে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে চিনতে পারল না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
কি বলছ এসব?
ভাবী আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। ছেলেটা এদিক ওদিক কাকে যেন শুধু খুঁজে। বোধহয় আপনাকে খুঁজে। আপনি কি যাবেন?
হ্যাঁ যাব।
ভাইজান এসেছেন। ভাইজানকে বললাম, উনি চান না যে আপনি যান।
তুমি এখানে থাক আমি তোমার ভাইজানের সঙ্গে কথা বলে আসি।
দরজা খোলাই ছিল। ইলা ঘরে ঢুকে দেখে জামান চা খাচ্ছে। নিজেই বানিয়েছে। শুধু চা না। পিরিচে বিসকিট আছে। ইলা সহজ গলায় বলল, কখন এসেছ?
জামান চা খেতে খেতে বলল, দুপুরে।
ইলা নিজ থেকেই বলল, আজ দুপুরে চলে আসবে তা তো বলে যাও নি। বলে গেলে ঘরে থাকতাম। দুপুরে খেয়েছ?
কোথায় খেয়েছ? বাসায় না বাইরে?
বাইরে।
ঘরে খাবার তৈরি ছিল। ফ্রীজে রেখে দিয়েছিলাম।
জামান কিছু বলল না। সে নিঃশব্দে চা খাচ্ছে। সে যে ইলার উপর খুব রেগে আছে তা মনে হচ্ছে না। ইলী বলল, অপুর শরীর খুব খারাপ ত কি তোমাকে হাসান বলেছে?
হ্যাঁ বলেছে।
আমি ওকে একটু দেখে আসব। হাসান নিচে আছে ও আমাকে নিয়ে যাবে।
বস অমিরা সামনে।
ইলা বসল। জামান চায়ের কাপ নামিয়ে শান্তু গলায় বলল, দেখতে যাবার কোন দরকার নেই। যদি সত্যি সত্যি মরে যায় নানান যন্ত্রণা হবে। ডেডবড়ি নিয়ে সমস্যা হবে। পত্রপত্রিকায় লেখা হবে। কি দরকার।
আমি বাচ্চাটাকে দেখতে যাব না?
না। খাল কেটে কুমীর আনতে হবে না।
ইলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জামান তার বিস্মিত দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, আর তুমি যদি মনে কর আমার চড় খেয়ে অন্তু মারা যাচ্ছে সেটাও ভুল কথা। চড় তাঁকে ঠিকই মেরেছিলাম। পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলেছে সেটাও সত্যি। সামান্য ঠোঁট কাটা থেকে কেউ মরে যায় না। নানান অসুখ-বিসুখ এই ছেলের আগেই ছিল।
তোমার এতটুকুও খারাপ লাগছে না?
লাগছে মা কেন লাগছে। খারাপ লাগাটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। প্রশ্রয় দিলে যে যন্ত্রণা হবে তা সামাল দেয়া যাবে না। পেছনের ফ্ল্যাটের ব্যাপারটাই ধর। তিনটা ছেলে ঐ বাড়িতে ঢুকল। ছেলে তিনটাকে সবাই চেনে। কেউ কি বলেছে তাদের কথা? কেউ বলে নি। বলবে না।
তুমি কি বলছ কিছু বুঝতে পারছি না। ছেলে তিনটাকে সবাই চেনে মানে কি?
সবাই চেনে মানে সবাই চেনে। পালের গোদা আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে।
তোমাকে কে বলেছে?
জামান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি জানি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে হাসানকে জিজ্ঞেস কর। জিজ্ঞেস না করাই ভাল। আমরা খোঁজখবর করছি এটা প্রচার হলেও অসুবিধা। আসল কথা হচ্ছে–চুপচাপ থাকতে হবে। সব সময় পর্দার আড়ালে থাকতে হবে। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে। অন্তুর মরে যাওয়াটা দুঃখের ব্যাপার, কিন্তু আগ বাড়িয়ে ভালবাসা দেখাতে গেলে হবে ভয়াবহ ব্যাপার।
তুমি আমাকে যেতে দেবে না?
না।
ঠিক আছে যাব না। আমি হাসানকে বলে আসি যে যেতে পারব না। ও গিয়ে দেখে আসুক।
তুমি থাক। আমি বলে আসছি–ওরও যাবার দরকার নেই।
জামান শর্টি গায়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল। ইলার নিজের শরীর খুব খারাপ লাগছে। গা গুলাচ্ছে। বমি আসছে। ইলা বেসিনের কাছে গিয়ে মুখ ভর্তি করে বমি করল।
জামান হাসানকে ডেকে রাস্তার কাছে নিয়ে গেছে। কথা বলছে নিচু গলায়।
কেমন আছি হাসান?
জ্বি ভাল।
তুমি অন্তুর ব্যাপারে আর খোঁজখবর করবে না।
জি আচ্ছা।
ছেলেটা মরে গেলে সবার যন্ত্রণা। তোমারও যন্ত্রণা।
তুমি কি ইলার কাছে প্রায়ই যাও? ভাবী ডাকলে যাই। টুকটাক কাজ করে দি।
এখন থেকে ডাকলেও যাবে না। ইলার এমন কিছু কাজ নেই যে তোমাকে করে দিতে হবে। যখন-তখন তার কাছে গেলে লোকজন নানান কথা বলতে পারে। টাকাটা রাখ আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও। ভাংতি ফেরত দেয়ার দরকার নেই।
জ্বী আচ্ছ।
জামান দাঁড়িয়ে আছে। হাসান সিগারেট আনতে যাচ্ছে। হাঁটছে মাথা নিচু করে। জামানের মনে হল এই ছেলের জন্মই হয়েছে মাথা নিচু করে থাকার জন্যে।