০৬. তিতলী কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে

তিতলী কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে

তিতলী কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। অপেক্ষা করছে বাবার জন্যে। মতিন সাহেব বাথরুমে ঢুকেছেন। বাথরুম থেকে বের হলে তিতলী রিকশা ভাড়া চাইবে। একবার না। তিতলীকে কয়েকবার চাইতে হবে। তিনি শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মানিব্যাগ খুলে দুটা দশ টাকার নোট বের করবেন। আসা-যাওয়ার রিকশা ভাড়া বাবদ পনের টাকা আর পাঁচ টাকা টিফিনের জন্যে। টাকাটা চাওয়া মাত্র দিয়ে দিলে কী হয়? একসঙ্গে কয়েকদিনের টাকা দিয়ে দিলে রোজ রোজ চাইতে হয় না।

মতিন সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, অস্থির হয়ে পড়েছিস কেন? টাকা টাকা করে তুই তো দেখি দরজা ভেঙে বাথরুমে ঢুকে পড়ার ব্যবস্থা করেছিস। স্বভাব থেকে অস্থিরতা দূর কর। অস্থির মানুষ কোথাও গিয়ে পৌঁছতে পারে না।

রাগে-দুঃখে তিতলীর কান্না পেয়ে যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলার মুকুলে সে অবশ্যই বলত, তুমি নিজ তো খুব সুস্থির মানুষ। তুমি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছ?

বাবার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলার সম্পর্ক তার না। তিতলী চাপা নিঃশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইল। মতিন সাহেব তাঁর শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন। টেবিলের ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগ বের করবেন। তিতলীর প্রতীক্ষার অবসান হবে। তিতলী বাবার পেছনে পেছনে গেল। মতিন সাহেব ড্রয়ারের দিকে গেলেন না। খাটের ওপর বসতে বসতে বললেন, আজকের কাগজটা দিয়ে যা। আর তোর মাকে বল এক কাপ চা দিতে। চিনি দিয়ে যেন আবার শরবত না বানায়। এক কাপে এক পোয়া চিনি না দিয়ে তো সে আবার চা বানাতে পারে না।

আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা।

খবরের কাগজটা দিতে আর তোর মাকে চায়ের কথা বলতে কতক্ষণ লাগবে? কথা বলে তুই যে সময়টা নষ্ট করছিস তারচে’ কম সময়ে কাগজটা দিয়ে যেতে পারতি। মাকেও খবর দিতে পারতি।

তিতলী কাগজ এনে বাবার হাতে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। সুরাইয়া মেয়েকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন, কী রে এখনো কলেজে যাস নি?

তিতলী বলল, বাবাকে এক কাপ চা দাও। আর আমাকেও এক কাপ চা দাও। আজ কলেজে যাব না।

যাবি না কেন?

যেতে ইচ্ছা করছে না।

সুরাইয়া কলেজ প্রসঙ্গে আর কিছু বললেন না। মনে হলো মেয়ে কলেজে না যাওয়ায় তিনি খুশিই হয়েছেন। তিতলী যেদিন কলেজে না যায় সেদিন মাকে নানান কাজে সাহায্য করে। দুপুরে রান্নার সময় বলে–মা তুমি একটা মোড়া এনে মোড়ায় চুপচাপ বসে থাক আমি তোমার রান্না করে দিচ্ছি। রোজ রোজ রান্না করতে তোমার নিশ্চয়ই বিরক্তি লাগে। আজ সব রান্না আমি রাধব তুমি শুধু বাবার ভাত রাঁধবে।

তিতলীর হাতে কোনো মন্ত্রটন্ত্র আছে–যাই রাধে খেতে ভালো হয়।

কলেজে যাবি না কেন?

বললাম তো ইচ্ছা করছে না।

অসুবিধা হবে না?

কোনো অসুবিধা হবে না। কলেজে পড়াশোনা কিছু হয় না মা। টিচাররাও আসেন না। যারা আসেন হড়বড় করে দু-এক কথা বলে যান। তারা কী বলেন–আমরা কেউ শুনিও না। আমরা নিজেদের মতো ফিসফিস করে গল্প করি। কাটাকুটি খেলা খেলি।

বলিস কী!

সত্যি কথা বললাম মা। আমরা কলেজে যাই গল্পগুজব হইচই করার জন্যে। পড়াশোনা যাদের করার তারা ঘরে বসে করে।

কলেজে তাহলে খুব খারাপ অবস্থা?

খারাপ হবে কেন ভালো অবস্থা।

সুরাইয়া চায়ের কাপে চা ঢাললেন। তিতলী কাপ হাতে বাবার ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। চট করে বাবার কাপে একটা চুমুক দিয়ে দেখে নিল চিনি ঠিক আছে কি না। কাজটা ঠিক হলো না। চা এঁটো করে দেয়া হলো। তবে বাবা-মার চা এঁটো করা যায়।

মতিন সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, টেবিলের ওপর পেপারওয়েটে টাকা চাপা দেয়া আছে নিয়ে যা।

তিতলী টাকাটা নিল।

মতিন সাহেব বললেন, এদিক থেকে লালমাটিয়া কলেজে কোনো মেয়ে পড়ে না? তাহলে দুজনে শেয়ার করে যেতে পারতিস। খরচও বঁচিত। দুজন একসঙ্গে যাবার একটা সিকিউরিটিও আছে। কলেজের নোটিশ বোর্ডে একটা নোটিশ দিয়ে দিবি।

তিতলী অবাক হয়ে বলল, কী নোটিশ দেব?

সহযাত্রী চেয়ে বিজ্ঞপ্তি।

তিতলী বলল, আচ্ছা। টাকাটা যে সেভ হচ্ছে সেটা বড় কিছু না–সিকিউরিটিটা আসল। দিনকাল খুবই খারাপ। চারিদিকে সিকিউরিটি প্রবলেম।

তিতলী বাবার সামনে থেকে চলে গেল। বাবার বক্তৃতা মার্কা কথা শুনতে অসহ্য লাগছে। এরচে’ মার সঙ্গে গল্প করার অন্য আনন্দ। মা যত না গল্প করবেন তারচে’ বেশি গল্প শুনতে চাইবেন। সামান্য গল্পও মা মুগ্ধ হয়ে শোনেন। এই ধরনের মানুষকে গল্প শুনিয়ে খুব আনন্দ।

সুরাইয়া মেয়ের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বললেন, নাদিয়ার কি হয়েছে তুই জানিস?

তিতলী বিস্মিত হয়ে বলল, না তো। ওর আবার কী হবে! সুরাইয়া বললেন, আমি নাশতা খাবার জন্যে ডাকতে গেলাম দেখি বই পড়ছে ঠিকই কিন্তু চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে–কিছু বলে না।

আমি জেনে আসছি কী ব্যাপার। মা শোন আজ দুপুরে আমি রাধব। কী রাধবি? ঘরে তো বাজারই নেই। বাবা বাজারে যাবে না? বাবাকে দিয়ে এক কেজি ভালো গরুর গোশত আনিয়ে দাও তো মা। আমি কাটা পেঁয়াজ দিয়ে একটা গোশত রান্না করব। প্রমীদের বাড়িতে একদিন খেয়েছিলাম। খেতে খুব ভালো। আমি প্রমীর আম্মার কাছে সব জেনে এসেছি। ঘরে কি সিরকা আছে মা? সিরকা লাগবে। সিরকা ছাড়া হবে না।

ঘরে তো সিরকা নেই।

সিরকা আনিয়ে দাও না মা। রান্নাটা একবার রাঁধতে না পারলে ভুলে যাব। একবার রাঁধলে আর ভুলব না।

সিরকা টিরকার কথা বললে তোর বাবা আবার রেগে যায় কি না কে জানে।

এটা আবার কী ধরনের কথা মা? বাবাকে তুমি ভয় পাও কেন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। তোমাদের এ রকম কেন? তোমাদের দেখে মনে হয় একজন গুরুমশাই আরেকজন প্ৰাইমারি ক্লাসের ছাত্রী।

তিতলী উঠে দাঁড়াল। তার চা শেষ হয় নি। খেতে ভালো লাগছে না। তিতলী জানে তার মা তার চায়ের কাপের চাটুকু এক সময় চুমুক দিয়ে খাবেন। তিনি অপচয় সহ্য করতে পারেন না।

নাদিয়া নিঃশব্দে পড়ছে। তিতলী ঘরে ঢুকতেই সে বই থেকে মাথা না সরিয়ে বলল, কলেজে যাও নি। আপা?

তিতলী বলল, আজ কলেজে যাব না। আজ আমার ছুটি।

নাদিয়া বই থেকে মুখ ঘুরিয়ে বড় বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাসিই বলে দিচ্ছে বড়। আপার কলেজে না যাওয়ার সংবাদে সে খুব আনন্দিত। যদিও তার আনন্দিত হবার কিছু নেই–সে বই রেখে আপার সঙ্গে গল্প করতে বসবে না। বিকেলে একবার কিছুক্ষণের জন্যে উঠবে। ছাদে হাঁটতে যাবে, তাও একা একা। ছাদ থেকে নেমে আবারো বই নিয়ে বসবে।

খানিকক্ষণ বিরক্ত করি?

কর। কিন্তু আপা বেশিক্ষণ না।

দিনরাত যে এত পড়িস তোর ভালো লাগে?

হুঁ।

যে হারে পড়াশোনা করিসি সব বই তো তোর মুখস্থ হয়ে যাবার কথা।

নাদিয়া লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, সব বই তো আমার মুখস্থই।

মুখস্থ! তাহলে আর পড়ার দরকার কী?

না পড়লে ভুলে যাব না?’

ভুলে গেলে ভুলে যাবি। সামান্য এস.এস.সি. পরীক্ষার জন্যে জীবনটা নষ্ট করে ফেলবি। তোকে দেখে মনে হয় তুই মানুষ না–একটা যন্ত্র।

নাদিয়া বলল, আপা তুমি অনেকক্ষণ বিরক্ত করে ফেলেছ। এখন যাও। তোমাকে আর সময় দেয়া যাবে না।

আসল কথা যা বলতে এসেছিলাম সেটা বলা হয় নি।

আসল কথা কী? মা সকালে নাশতা নিয়ে এসে দেখে তুই বই পড়তে পড়তে काछिन। दो श्शरछ?

কিছু হয় নি।

আমাকে বলতে কোনো অসুবিধা আছে?

না খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। আপা। এই জন্যে বলতে ইচ্ছে করছে না।

কাউকে কিছু বলবি না–আবার ফিঁচ, ফিঁচ করে কাঁদবি এটা কেমন কথা?

আর কাঁদব না।

আমরা তিন বোনের কেউ কাঁদলে মা মনে খুব কষ্ট পায়। কী জন্যে কাঁদছিস এ জন্যেই মাকে সেটা জানানো দরকার।

মাকে কিছু জানাতে হবে না। আপা–তোমাকে বলছি তুমি শুনে রাখ। ফুফুর বাসায় যে গিয়েছিলাম সেখানে জামান ভাইয়া আমাকে একটা চিঠি দিয়েছে। কুৎসিত একটা চিঠি। কেউ যে কাউকে এমন কুৎসিত চিঠি দিতে পারে তাই আমি জানতাম না।

কী লেখা চিঠিতে?

কী লেখা তোমাকে আমি বলতে পারব না।

চিঠিটা কি ফেলে দিয়েছিস?

না ফেলি নি রেখে দিয়েছি, কিন্তু তোমাকে চিঠিটা আমি কোনোদিন দেখাব না। দেখতে চেও না। চিঠিটা পড়লে তোমার শরীর অশুচি হয়ে যাবে। আপা এখন তুমি যাও।

তিতলী উঠে দাড়তে দাঁড়াতে বলল, চিঠিতে কি ভালোবাসার কথা লেখা?

নাদিয়া চাপা গলায় বলল, ভালোবাসার কথা লেখা থাকলে আমি রাগ করব কেন? ভালোবাসা টাসা না। আপা অতি কুৎসিত কিছু কথা। আপা শোন মাকে কিছু বলার দরকার নেই।

ফুফুকে কি ঘটনাটা বলব?

না ফুফু, উল্টা আমার ওপর রাগ করবে। কোনো মার কাছেই নিজের ছেলের দোষ ধরা পড়ে না। তাছাড়া এইসব ঘটনায় সবার আগে দোষী ভাবা হয় মেয়েটাকে। ফুফু, কী বলবে জান? ফুফু বলবে বাংলাদেশে তো মেয়ের অভাব ছিল না। এত মেয়ে থাকতে জামান তোকে কেন এই চিঠি লিখলি? এই রহস্যটার মানে কী? তুই নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছিস যে তোকে এ ধরনের চিঠি লেখার সাহস পেয়েছে।

তিতলী বলল, ফুফুন এ রকম বলবে ঠিকই। তুই তো বেশ গুছিয়ে চিন্তা করা শিখে গেছিস।

আমি মোটেও গুছিয়ে চিন্তা করি না। আপা। যা মনে আসে বলে ফেলি। পড়তে পড়তেই সময় পাই না–এত চিন্তা করব কীভাবে।

নাদিয়া হাসল। এত সুন্দর করে হাসল যে তিতলীর তৎক্ষণাৎ ইচ্ছা করল বোনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকতে। সেটা করতে গেলে নাদিয়া বিরক্ত হবে। আচ্ছা! নাদিয়া কি জানে যত দিন যাচ্ছে সে তত সুন্দর হচ্ছে! না, তা সে জানে না। আয়নায় সে। মনে হয় নিজেকে দেখেও না। তার সমস্ত জগৎ পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ। তিতলীর ধারণা সে যদি প্রেমে পড়ে তাহলে কোনো মানুষের প্রেমে পড়বে না, কোনো একটা পাঠ্যবইয়ের প্রেমে পড়বে। তিতলী উঠে পড়ল।

 

মতিন সাহেব গোশত বা সিরকা কোনোটাই আনেন নি। গোশত প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, গোশত শরীরের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। সবচে’ খারাপ ধরনের প্রোটিন হলো এনিমেল প্রোটিন। সপ্তাহে একদিনের বেশি গোশত খাওয়া ঠিক না। এই সপ্তাহে এর মধ্যে দুদিন হয়ে গেছে–আর না। সিরকার প্রসঙ্গে বলেছেন-সিরাকাটা কোন কাজে লাগে? বাড়িটা তো কাবাব হাউস না যে সিরকা লাগবে, সয়াসস লাগবে।

সুরাইয়া স্বামীর সঙ্গে যুক্তিতর্কে যান নি। চুপ করে গেছেন। তাঁর মন একটু খারাপ হয়েছে। মেয়েটা শখ করে একটা জিনিস চেয়েছে।

মতিন সাহেব তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে রাগোরাগিও করেছেন। তিতলীর কলেজ বাদ দেয়া প্রসঙ্গে রাগারগি।

সকাল থেকে তো রিকশা ভাড়া রিকশা ভাড়া করে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল দরজা ভেঙে বাথরুমে ঢুকে পড়বে। যখন ভাড়া দিলাম তখন আর কোথাও যায় না। এর মানে কী? আব্দর দিয়ে দিয়ে সব ক’টা মেয়ের মাথা যে তুমি খেয়েছ সেটা কি তুমি জান? মেয়েরা কিছু বললে তোমার ইশ থাকে না। মেয়েদের কেউ মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করলে ওইটা নিয়েই থাক। মুখ দিয়ে সিরকা’ শব্দটা বের করেছে, তুমিও তসবি জপা শুরু করলে, সিরকা সিরকা।’ আদার এবং প্রশ্ৰয় কম দেবে। এর ফল আখেরে শুভ হবে।

মতিন সাহেব বাজার এনে দিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বসেছেন। তিতলীর কলেজের নোটিশ বোর্ডে ঝোলানোর জন্যে একটা বিজ্ঞাপন। তিনি নিজেই লিখবেন। কাল কলেজে যাবার সময় মেয়ের হাতে ধরিয়ে দেবেন। মেয়ে নিজের আগ্রহে এই কাজ করবে না। তেমন শিক্ষা তারা মার কাছ থেকে পায় নি। তাদের মা তাদের শুধু আদরই দিয়েছেশিক্ষা দেয় নি। মতিন সাহেব অনেক চিন্তা ভাবনা এবং পরিশ্রম করে জিনিসটা দাঁড় করলেন।

সহযাত্রীর জন্যে বিজ্ঞপ্তি
আমার বাসা কলাবাগানের অভ্যন্ততে। দেশের বর্তমান অশান্ত পরিবেশে
রিকশাযোগে একা একা কলেজে অ্যাসবার সময় কিঞ্চিৎ ভীত থাকিএমতাবস্থায় সহপাঠী বন্ধুদের জানাচ্ছি তাহদের কেহ যদি কলাবাগান এলাকায় থাকেন এবং আমার সঙ্গে একত্রে রিকশায় আসা-যাওয়া করতে রাজি থাকেন তাহা হইলে আমার জন্যে অত্যন্ত শুভ হয়রিকশা ভাড়া বাবদ যে অৰ্থ ব্যয় হয় তা সমান সমান ভাগাভাগি করা হইবে ফলশ্রুতিতে অভিভাবকেরও অর্থনৈতিক সাশ্রয় হইবে।
যোগাযোগের ঠিকানা–
তিতলী বেগম
১২/১০ কলাবাগান। হলুদ কাঠের গেটওয়ালা বাড়ি।

দুপুরে খেতে বসে নাদিয়া উৎফুল্ল গলায় বলল, নিশ্চয় আপা রোধেছে। রঙ দেখেই টের পাচ্ছি। আপার রান্না।

তিতলী লজ্জিত গলায় বলল, আহ্লাদী করিস না, খা। তুমি যাই রাধ তাই এমন অপূর্ব কেন হয় বল তো? তুমি একটা রান্নার স্কুল দিও তো। আপা। দেখবে দলে দলে তোমার স্কুলে ছাত্র ভর্তি হবে।

যথেষ্ট হয়েছে।

মোটেই যথেষ্ট হয় নি। আপা তুমি কি জান তুমি খুব অল্প বয়সে বিধবা হবে? সুরাইয়া তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এটা কী ধরনের কথা? নাদিয়া বলল, আপা ভালো ভালো রান্না করবে। সেই রান্না খেয়ে খেয়ে দুলাভাই ফুলে ফেপে একাকার হবে। কোলেক্টরল হবে, হাই ব্লাডপ্রেসার হবে। তারপরেও খাওয়া ছাড়তে পারবে না। তারপর একদিন হার্ট অ্যাটাক।

সুরাইয়া বললেন, রসিকতা ভালো, এ ধরনের রসিকতা ভালো না। তওবা করি। বল তওবা।

নাদিয়া বলল, তওবা।

সুরাইয়া বললেন, তুই কথাবার্তা আরো সাবধানে বলবি। যা ইচ্ছা বলে ফেলিস।

তিতলী বলল, বক্তৃতা বন্ধ করা তো মা। বেচারি আরাম করে খাচ্ছে খাক।

 

সন্ধ্যাবেলা তিতলীর ফুফু নাফিসা খানম এলেন। পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি। কাঁধে গোলাপি চাদর। ছোটখাটো মহিলা, সরল ধরনের গোলগাল মুখ, কথা বলেন নিচু গলায়–কিন্তু তাঁর নিচু গলার প্রতিটি শব্দের গুরুত্ব অসীম।

নাফিসা খানম গাড়ি থেকে নেমেই ভুরু কোঁচকালেন। নষ্ট কলিংবেল এখনো বদলানো হয় নি। গত সপ্তাহে তিনি শক খেয়েছিলেন। মতিনকে বলে গেছেন ঠিক করতে। মতিন সেটা করে নি।

তিনি ড্রাইভারকে তৎক্ষণাৎ দোকানে পাঠালেন। ড্রাইভার ডিংডং শব্দ হয় এমন একটা কলিংবেল কিনবে, একজন ইলেকট্রিশিয়ানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। তিনি থাকতে থাকতেই কলিংবেল ঠিক হবে।

নাফিস খানম কারো বাড়িতেই খালি হাতে যান না। এখানেও এক কেজি জিলাপি নিয়ে এসেছেন। জিলাপি দোকানের কেনা না–তার নিজের বানানো। এক ময়রার কাছ থেকে তিনি মিষ্টি বানানো শিখছেন। জিলাপি ভালো হয়েছে। তবে জিলাপির প্যাঁচ ঠিকমতো হয় নি। আড়াই প্যাঁচ হবার কথা–তার কোনো কোনোটিতে তিন প্যাঁচ হয়েছে কোনোটাতে এক প্যাঁচ।

মতিন এসে বড়বোনকে কদম বুসি করলেন। এটা নতুন না, সব সময় করেন। নাফিসা খানম এত ভক্তিতেও বিচলিত হলেন না। শুকনো গলায় বললেন, কী রে তোকে না বললাম, কলিংবেল ঠিক করাতে। ঠিক করাস নি কেন?

মতিন আমতা আমতা করে বললেন–বেল কিনিয়েছি। বেল, ইলেকট্রিক তার সব কেনা, মিন্ত্রি পাচ্ছি না।

মিস্ত্ৰি পাবি না কেন? মিস্ত্রিরা সব দল বেঁধে গেল। কই?

আমার পরিচিত একজন মিস্ত্ৰি আছে–ও গেছে দেশের বাড়িতে।

পয়সা দিয়ে কাজ করাবি তার আবার পরিচিত-অপরিচিত কী?

কাল-পরশুর মধ্যে লাগিয়ে ফেলব। আপা।

তিতলীকে ওযুর পানি দিতে বল-মাগরেবের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। জিলাপি নিয়ে এসেছি— খা। গরম গরম খা। ঠাণ্ডা হলে ভালো লাগবে না।

নাফিসা খানম ওযু করে নামায পড়তে বসলেন। মতিন সাহেব হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যে কলিংবেল সমস্যা বেশিদূর গড়ায় নি।

সমস্যার এত সহজ সমাধান অবশ্যি হলো না। নামায শেষ করেই নাফিস খানম বললেন, মতিন তুই তোর কলিংবেল আর তারফার কী কিনেছিস আমাকে দেখা। আমি ড্রাইভারকে কিনতে পাঠিয়েছি যেটা ভালো সেটা লাগাব। বাকিটা তুলে রাখব।

মতিন মুখ শুকনো করে কলিংবেল খুঁজতে গেলেন। যে জিনিস কেনাই হয় নি। সে জিনিস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মতিন সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গা খুঁজছেন। আর কিছুক্ষণ পর পর বলছেন, আশ্চর্য পলিথিনের একটা কালো ব্যাগে ছিল–খাটের নিচে রেখেছি গোল কোথায়? তাঁর স্বগতোক্তি নাফিসা খানম শুনেও না শোনার ভাব করছেন। এত কিছু শোনার সময়ও তাঁর নেই। তিনি এসেছেন জরুরি কাজে-তিতলীর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে। ওই পাটি গা এলিয়ে দিয়েছিলো ফাইনাল কথা বলবে বলে ডেট দিয়ে আসে। নি। এখন আবার খানিকটা উৎসাহ দেখাচ্ছে। নতুন পরিস্থিতিতে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে তিনি আলাপ করতে এসেছেন। আলাপ তিনি করছেন সুরাইয়ার সঙ্গে তবে তিনি চাচ্ছেন মেয়েরাও ব্যাপারটা শুনুক। মতামত দেবে না, শুধু শুনে যাবে। বিয়েটিয়ে বিষয়ক গল্প শুনতে নাদিয়ার একেবারেই ভালো লাগে না–তারপরেও তাকে গভীর আগ্রহ নিয়ে জন্ম হচ্ছে। ফু যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ সবাই তাকে ঘিরে থাকবে এটাই অলিখিত নিয়ম।

নাফিস খাটে পা উঠিয়ে বসে আছেন। তার দুপাশে নদিয়া এবং তিতলী। নাতাশা ঠিক তার পেছনে হাঁটু গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাতাশার দায়িত্ব হচ্ছে ফুফুর চুল টেনে দেয়া। এই কাজটা নাকি নাতাশা খুব ভালো পারে।

ঘটনা। কী হলো শোন। রাত আটটা বাজে। তিতলীর ফুফার কাছে গেষ্ট এসেছে। আমি গেস্টদের চা আর নুডুলাস দিয়ে শোবার ঘরে এসেছি। খুবই মাথা ধরেছে। কাজের মেয়েটাকে বললাম চুল টেনে দিতে। সে চুল টানছে তখন টেলিফোন এল। খুবই নরম গলা–আপা কেমন আছেন? শরীর ভালো? এইসব ন্যাকামি টাইপ কথা। আমি গলা শুনেই বুঝেছি–কে। তারপরেও বললাম, চিনতে পারছি না তো কে বলছেন? বলল— আমি বুলা। আমি বললাম, ও আচ্ছা। বুলা হচ্ছে ছেলের মামি। পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে তো চর্বির ভাঁজে ভজে দুষ্টবুদ্ধি। আমাদের মতো সোজা সরল না। আমি বললাম কী ব্যাপার হঠাৎ টেলিফোন? সে বলে কী–আপা আপনার সঙ্গে একটু যে বসতে হয়। সোমবারে কি আপনার সময় হবে? আমি ঘললাম, না। এই সপ্তাহটা খুব ব্যস্ত থাকব। কোনোরকম আগ্ৰহ দেখলাম না। ভাবটা এ রকম করলাম যে আমার কোনো গরজ নেই। গরজ দেখালেই এরা মাথায় উঠে যায়। শুরুতে বেশি গরজ দেখানোর জন্যে। ওরা ঠাণ্ডা মেরে গিয়েছিল। যেই গরজ দেখানো বন্ধ ওমনি খোঁজ পড়েছে।

সুরাইয়া বললেন, ওদের আগ্রহ আছে?

আগ্রহ অবশ্যই আছে। তবে ভালো ছেলে একটা হাতে থাকলে যা হয়–দুনিয়ার মেয়ে বাজিয়ে দেখে। তাই করছে–দুনিয়ার মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছে। কোনো মেয়েরই ভালো কিছু চোখে পড়ছে না। শুধু খুঁতগুলো চোখে পড়ছে।

নাদিয়া বলল, ভালো ছেলে আপনি কাকে বলেন ফুফু?

নাফিসা খানম পানের বাটা থেকে পান মুখে দিতে দিতে বললেন, আমার কাছে ভালো ছেলের হিসেব খুব সোজা। ছেলের ঢাকা শহরে নিজের বাড়ি থাকতে হবে। ভালো একটা চাকরি থাকতে হবে। পরিবারের ছোট বা মেজো ছেলে হতে হবে–বড় ছেলের ওপর সংসারের দায়-দায়িত্ব থাকে। বড় ছেলে চলবে না। গায়ের রঙ ফরসা হতে হবে। রঙ ময়লা হলে তার মেয়েগুলোর রং হবে ময়লা–মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে জান বের হয়ে যাবে। লম্বা হতে হবে। বাপ বাটু হলো–ছেলেমেয়ে সব নাটবলুন্টু হয়। তোর বাবাকে ডাক তো তাকে দুটা কথা বলে বিদেয় হব।

মতিন শুকনো মুখে এসে দাঁড়ালেন। নাফিসা খাতুন চায়ের কাপে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, কলিংবেল পাওয়া গেছে?

না। পলিথিনের ব্যাগে করে খাটের নিচে এনে রেখেছিলাম।

ভালো করে ভেবে দেখ। কিনে হয়তো দোকানেই ফেলে এসেছিস।

সেটাও হতে পারে।

কিনেছিস কোথেকে?

নওয়াবপুর থেকে। কাল গিয়ে খোঁজ নিবি। পয়সা দিয়ে জিনিস কিনে দোকানে ফেলে আসা কোনো কাজের কথা না।

জ্বি বুবু।

আচ্ছা এখন যা।

মতিন হাঁপ ছাড়লেন। মনে হচ্ছে ঘাম দিয়ে তার জ্বর ছেড়েছে। নাফিসা বললেনতিতলী কাগজ আর কলম আন।। জিলাপির রেসিপি তোকে লিখে দিয়ে যাই। আমি মুখে মুখে বলি তুই লিখে নে। না নাদিয়া তুই লেখা। তোর হাতের লেখা ভালো।

নাদিয়া জিলাপির রেসিপি লিখছে। আজ তার অনেক সময় নষ্ট হলো। নষ্ট সময়টা কভার করার জন্যে অনেক রাত জগতে হবে।

সুন্দর করে লিখে রাখ উপকরণ–
ময়দা ১ কাপ
চিনি ১ কাপ
গোলাপজল ১ টেবিল চামচ
সয়াবিন তেল ১ কাপ।
ময়দা আধিকাপ পানিতে ভালো করে গুলে দুদিন ঢেকে রাখতে হবে…

রেসিপি দিয়ে নাফিস উঠলেন। সুরাইয়ার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। সামনের মাসের খরচ চার হাজার টাকা। টাকার খাম সুরাইয়া খুব লজ্জিত মুখে নিলেন। তার লজ অবশ্যি নাফিসা খানমের চোখে পড়ল না। তিনি কলিংবেল লাগানো হয়েছে কিনা দেখতে গেলেন। মিস্ত্ৰি কলিংবেল লাগিয়েছে। নাফিসা খানম দুবার বেল টিপলেন। বেলের আওয়াজে তেমন খুশি হলেন না। ক্যানক্যানে শব্দ। কানে লাগে।

 

নাদিয়া রাত একটা পর্যন্ত পড়ে। বড় ফুফুর জন্যে দেড় ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। সেই সময় পুষিয়ে নেবার জন্যে সে আড়াইটা পর্যন্ত পড়ে ঘুমোতে গেল। দুটা খাটের একটাতে সে একা ঘুমোয় অন্যটাতে তিতলী নাতাশাকে নিয়ে শোয়। কেউ সঙ্গে শুলে নাদিয়ার ঘুম আসে না। এটা তার ছেলেবেলার অভ্যাস। একমাত্র ব্যতিক্রম বড় আপা। বড় আপা তার সঙ্গে ঘুমেলে কোনো সমস্যা হয় না। বরং ঘুমের আগে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করতে পেরে ভালো লাগে।

রাত আড়াইটার সময় কারো জেগে থাকার কথা না। নাদিয়া ঘুমোতে এসে দেখে তিতলী জেগে আছে। নাদিয়া বিস্মিত হয়ে বলল, এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?

তিতলী হাই তুলতে তুলতে বলল, তোর জন্যে জেগে আছি। ঘুমের আগে খানিকক্ষণ গল্প না করলে ভালো লাগে না।

আপা থ্যাংক য়্যু।

আজ কী নিয়ে গল্প করবি?

আমি তো আপা গল্প করতে পারি না। তুমি গল্প করবে। আমি শুনব।

কী গল্প শুনতে চাস?

কলেজে কী মজাটজা কর সেই সব বল।

কলেজে কোনো মজাটজা করি না। মজা মজা ভাব করি।—এই পর্যন্তই।

তোমার মজা মজা ভাবের গল্প কর আমি শুনি। আমার নিজের কোনো মজা করতে ইচ্ছে করে না-অন্যের মজা শুনতে খুব ভালো লাগে। হাসান ভাইয়া হঠাৎ হঠাৎ যখন আসে তুমি মুখটুখ লাল করে তার সঙ্গে গল্প কর। আমার কী যে ভালো লাগে! কিন্তু আপা আমি কোনোদিনও এ রকম করতে পারব না। একটা ছেলের সঙ্গে আমি গল্প করছি।—ভাবতেই পারি না।

গল্প করায় সমস্যাটা কী?

কী গল্প করব৷—আমি তোমাকে ভালোবাসি, এইসব বলব। ভাবতেই তো গা শিরশির করছে।

একটা ছেলে আর মেয়ে যখন গল্প করে তখন কেউ কিন্তু বলে না–আমি তোমাকে ভালোবাসি।

বলে না কেন?

ভালোবাসার কথা বলার দরকার হয় না।

হাসান ভাই তোমার সঙ্গে কী নিয়ে গল্প করে?

ও কী গল্প করবে? ও চুপচাপ থাকে।

তুমি এক বকবক করে যাও?

হুঁ।

কী নিয়ে বকবক কর?

ভালো যন্ত্রণা হলো দেখি! আমি কি মুখস্থ করে রেখেছি নাকি?

হাসান ভাইয়ের কোন জিনিসটা তোমার সবচে’ ভালো লাগে আপা?

জানি না। এই নিয়ে ভাবি নি।

একজন ছেলের প্রেমে তুমি হাবুডুবু খাচ্ছ, আর তাকে কী জন্যে ভালোবাস তা জান না?

তুই হঠাৎ এমন বকবক শুরু করলি কেন?

নাদিয়া বলল, আর করব না।

আয় শুয়ে পড়ি।

নাদিয়া লজ্জিত গলায় বলল, ছাদে যাবে আপা?

তিতলী বিস্মিত গলায় বলল, রাত তিনটার সময় ছাদে যাবি মানে? তোর মাথায় আসলে ছিট টিট আছে।

নাদিয়া মাথা নিচু করে হাসছে।

তিতলী চিন্তিত গলায় বলল, শোন নাদিয়া আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে তুই রাত দুপুরে এ রকম একা একা ছাদে যাস। যাস নাকি?

নাদিয়া হাসছে। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসছে।

এ রকম করে হাসছিস কেন?

আমি সহজভাবেই হাসছি তোমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। চল না। আপা ছাদে যাই। দশ মিনিটের জন্যে।

বৃষ্টিতে ছাদ পিছল হয়ে আছে।

অকারণে অজুহাত তৈরি করবে না তো আপা। তুমি যদি এখন আমার সঙ্গে ছাদে যাও তাহলে তোমাকে মন খুশি হয়ে যাবার মতো একটা কথা বলব।

তিতলী বোনের সঙ্গে ছাদে গেল। নিশিরাতের ছাদ গা কেমন জানি ছমছম করে। তিতলী বলল, তুই একা একা ছাদে এসে কী করিস?

কিছু করি না। আকাশের তারা দেখি।

আমাকে কী কথা বলবি বলেছিলি বলে ফেল। কী সে কথা যা শুনলে আমার মন ভালো হয়ে যাবে?

নাদিয়া হাসতে হাসতে বলল, কোনো কথা না আপা। তোমাকে ছাদে আনার জন্যে এটা হলো আমার একটা ট্রিকস। সরি।

ট্রিকস করার দরকার ছিল কি? আমাকে বললেই আমি আসতাম।

না। আসতে না। আচ্ছা। আপা আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তুমি যদি রাগ না কর তাহলে বলি।

রাগ করব না–বল।

আগে প্ৰতিজ্ঞা করা যে রাগ করবে না।

তোর এইসব প্রতিজ্ঞা ফ্ৰতিজ্ঞা ছেলেমানুষি আমার ভালো লাগে না— বললাম তো রাগ করব না। কথাটা কী?

নাদিয়া মুখ নিচু করে প্রায় ফিসফিস করে বলল, তুমি কি কখনো হাসান ভাইকে চুমু খেয়েছ আপা?

তিতলী স্তম্ভিত হয়ে গেল। নাদিয়ার মতো মেয়ে যে এ রকম অশালীন একটা কথা বলতে পারে তা তার কল্পনাতেও আসে নি। হতভম্ব ভাব সামলিয়ে তিতলী বলল, তুই এসব কী বলছিস! পড়াশোনা করতে করতে তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।

সরি আপা।

আমি খুব রাগ করেছি। অসম্ভব রাগ করেছি।

তুমি কিন্তু বলেছিলে রাগ করবে না।

আমি তো বুঝতে পারিনি তুই এ ধরনের কথা বলতে পারিস।

আর কোনোদিন বলবো না। আপা। তুমি কি খুব বেশি রাগ করেছ?

হ্যাঁ।

তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব দাও নি।

তারপরেও তুই জবাব চাচ্ছিস?

হ্যাঁ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমি তো কল্পনাও করতে পারি না। আপা একটা মেয়ে কী করে একটা ছেলেকে চুমু খাবে।

তিতলীর ইচ্ছে করছে বোনের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে কঠিন গলায় বলল, চল নিচে যাই।

আপা তোমার মনটা তো খুব বেশি খারাপ হয়েছে–এখন তোমার মন ভালো করে দিচ্ছি। তোমাকে আমি বলছিলাম না যে তোমার মন খুশি হবার মতো একটা কথা বলব। এটা কোনো ট্রিকস না–সত্যি। কথাটা হচ্ছে কাল তুমি যখন নিউমার্কেটে গিয়েছিলে তখন হাসান ভাই এসেছিলেন।

কখন, সকালে?

হুঁ।

কাল দিন গেল, আজকের দিন গেল তুই বলিস নি কেন?

তোমাকে চমকে দেবার জন্যে জমা করে রেখেছিলাম। হাসান ভাই যখন এলেন তখন বাবা বাসায় ছিলেন না। কাজেই আমি উনাকে যত্ন করে বসালাম। অনেক গল্প করলাম।

কী গল্প করলি?

উনি তো গল্প করতে পারেন না। আমি একাই গল্প করলাম।

তুই গল্প করতে পারিস নাকি?

মাঝে মাঝে আমি খুব মজা করে গল্প করতে পারি। হাসির কথা বলতে পারি। আমি মানুষের গলার স্বরও নকল করতে পারি।

সে কী!

আমি তোমার গলার স্বর নকল করে হাসান ভাইকে শুনিয়ে দিলাম–উনি হোসেছেন।

তোর যে এমন গোপন প্ৰতিভা আছে তা তো জানতাম না।

হাসান ভাই তোমার জন্যে একটা চিঠি আমার কাছে দিয়ে গেছেন। এই নাও চিঠি। খামে বন্ধ চিঠি–এই চিঠি দিতেও তার কী সংকোচ! আমি শেষ পর্যন্ত বললাম, হাসান ভাই ভয় নেই। আমি চিঠি পড়ব না। আমার ওপর রাগ কি তোমার একটু কমেছে আপা? মনে হচ্ছে কমেছে। চল নিচে যাই। তোমার নিশ্চয়ই চিঠি পড়ার জন্যে প্ৰাণ ছটফট করছে।

তিতলী নিজের ঘরে এসে চিঠি খুলল। একটু দূর থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে নাদিয়া বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুপাতার চিঠি। পুরো পাতাজুড়ে গুণ চিহ্ন আঁকা। তিতলী লজ্জা পেয়ে হাসল। এই গুণ চিহ্নের মানে শুধু তারা দুজনই জানে।

নাদিয়া বলল, এত লম্বা চিঠি এত তাড়াতাড়ি পড়া শেষ হয়ে গেল?

হুঁ।

এখন কী করবে? বাতি নিভিয়ে দেবে? শুয়ে পড়বে?

হুঁ।

বাতি নিভিয়ে নাদিয়া বোনের সঙ্গে ঘুমোতে এল। বোনের বুকে খানিকক্ষণ মাথা ঘষে আদুরে গলায় বলল, আপা গুণ চিহ্নের মানে কী? চুমু? বলেই নাদিয়া খিলখিল করে হাসল। হাসি থামলে চাপা গলায় বলল-সরি আপা, তোমার চিঠি আমি পড়েছি। লোভ সামলাতে পারি নি। তুমি যদি এখন শাস্তি হিসেবে ধাক্কা দিয়ে আমাকে খাট থেকে ফেলে দিতে চাও ফেলে দিতে পাের। আমি কিছু মনে করব না।

তিতলী বোনকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *