তপতীর জীবন যেরূপভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাতে আধুনিক সমাজের কোন ছেলের পক্ষে তাহার মন জয় করা সহজ নয়, আবার প্রাচীন সমাজের পক্ষপাতী কাহারো পক্ষে তপতীকে মুগ্ধ করা অত্যন্ত কঠিন। প্রাচীন এবং আধুনিক সংস্কারের সঞ্চয়ন হইয়াছে তাহার জীবনে কিন্তু সমন্বয় হয় নাই। তাহার ঠাকুরদার শিক্ষা পদ্ধতি ছিল একদেশদর্শী, প্রাচীন—আবার তাহার পিতার শিক্ষাপদ্ধতি একান্তভাবে আধুনিক। দুইটি শিক্ষাকে একত্র মিলাইবার ক্ষীণ চেষ্টা করিতেছেন তপতীর মাতা কিন্তু প্রগতিবাদের উদ্ধৃঙ্খল স্রোতে তাহার বাঁধ বাঁধাইবার দুর্বল প্রচেষ্টা ভাসিয়া গিয়াছে। যেটুকু তিনি করিয়াছেন, তাহার ফল হইয়াছে বাধাপ্রাপ্ত জলস্রোতের মতো আরো উদ্দাম। চিন্তার সমুদ্রে তপতী আছাড় খাইয়াছে এ কয়দিন। তপনকে নানাভাবে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দিবার কল্পনা করিয়াছে, আবার ভাবিয়াছে; তাড়াইয়া কাজ নাই তপন তো তপতীর কোন ক্ষতি করে না।
কিন্তু সেদিন সিনেমায় একজন সুন্দরী নারীর সহিত তপনকে দেখার পর হইতে তপতীর মনে আগুনের জ্বালা ধরিয়া গিয়াছে। ঐ মেয়েটা উহার আপন বোন নয়, হয়তো কেহই নয়, মিথ্যা করিয়া বোন বলিয়া পরিচয় দিয়াছে। না হোক, তপতী তার জন্য ঈষা করিবে না, ঈর্ষা করিবার কারণও নাই। তপন যে-চুলোয় খুশী যাইতে পারে কিন্তু তপতী তাহার নিজের বাড়িতে বসিয়া তাহার পিতার জনৈক অন্নদাসের নিকট এ অপমান সহ্য করিবে না। ইহার প্রতিকার করিবার জন্য সে তপনকে সাংঘাতিক অপমান করিবার সঙ্কল্প করিল।
কি মতলবে যে সে এখন এখানে বাস করিতেছে তাহা বোঝ তপতীর বুদ্ধির বাহিরে, কিন্তু মতলব তাহার যে একটা কিছু রহিয়াছে তাহা তপতী বুঝিতে পারিতেছে। টাকা সে লইয়াছে, এবার তো অনায়াসে সরিয়া পড়িতে পারে। কিন্তু আরো টাকা আদায় করিবার জন্যই সে আছে নিশ্চয় অথবা ধীরে ধীরে তপতীর মনকে জয় করিতে চায় সে। সে মতলব যদি উহার থাকে তবে তপতী যেমন করিয়াই হোক উহার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করিয়া দিবে। তপতীর সঙ্কল্প স্থির হইয়া গেল। সে আসিয়া ফোন করিল মিঃ বোসকে। তাহার সহিত তপতী বেড়াইতে যাইবে আজ। মিঃ বোস কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসিলেন; সুসজ্জিত তপতী তাঁহাকে নীচের তলায় অভ্যর্থনা করিল, ইচ্ছাটা, তপন এখনি জলযোগের জন্য বাড়ি ফিরিয়া তপতীকে মিঃ বোসের সহিত একাসনে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আর একবার অপমানিত হইবে। কিন্তু অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিবার পরও তপন আসিল না দেখিয়া তপতী ও মিঃ বোস বাহিরে চলিয়া গেল মিঃ বোসেরই গাড়ীতে।
রাত্রি প্রায় দশটায় তপতী স্বয়ং মিঃ বোসের গাড়ী চালাইয়া বাড়ি ফিরিতেছে, মিঃ বোসও পাশে বসিয়া আছেন–তপতী দেখিল গেটের নিকট দারোয়ানগুলোর সঙ্গে তপন কি কথা বলিতেছে। গাড়ীর হর্ণ না দিয়াই তপতী চলিয়া যাইবে কিন্তু তপন ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল, দেখিতে পাইল না। মিঃ বোস তপনকে উদ্দেশ্য করিয়া ধমক দিলেন, রাস্তায় দাঁড়ান কেন? ইডিয়ট।
তপন বিস্ময়-বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিল এবং তৎক্ষণাৎ পাশে সরিয়া দাঁড়াইল। তাহাকে এভাবে অপমানিত হইতে দেখিয়া দারোয়ানগুলো পৰ্য্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিল, কিন্তু তপতী গাড়ীটা চালাইয়া যাইতে যাইতে বলিয়া গেল,–ইডিয়ট মানেই ও জানে না মিঃ বোস—অনর্থক গলা ফাটাচ্ছেন।
তপন নীরবে,নতমুখে প্রায় সাত মিনিট দাঁড়াইয়া রহিল সেইখানেই স্থাণুবৎ। চলৎশক্তি তাহার যেন থামিয়া গিয়াছে। তপতী মিঃ বোসকে এক কাপ কোকো পান করিয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিয়া ভিতরে লইয়া গেল, তপন তাহাও দেখিল, তারপর ধীরে ধীরে আসিয়া উপরে উঠিল, ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহভার বহন করিয়া।
তপতী মিঃ বোসকে কোকো খাওয়াইয়া বিদায় করিল। মার কাছে যাইতেই তিনি বলিলেন,–তপন এখনো এলো না কেন রে, জানিস?
এসেছে তো।—বলিয়া তপতী মার পানে চাহিল হাসিমুখে। মা ভাবিলেন, হয়তো উহারা একসঙ্গেই বেড়াইতে গিয়াছিল। তিনি তপনের দরজায় আসিয়া ডাকিলেন,—এসো বাবা, খাবে এসো!
–আজ কিছু খাব না মা-লক্ষ্মী মা, আপনি জেদ করবেন না, বড্ড ক্লান্তি লাগছে—শুয়ে পড়েছি!—তপন উত্তর দিল।
-সে কি বাবা! একটু দুধ মিষ্টি?-মা অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে কহিলেন।
-না মা, না—আজ কিছু না—আমায় শুতে দিন একটু! তপনের স্বর এত করুণ যে মা আশ্চর্যান্বিত হইয়া তপতীকে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ঝগড়া টগড়া কিছু করেছিস খুকী?
—আমার অত দায় পড়েনি! আমি খেয়ে এসেছি ফারপোতে। আজ আর খাব না কিছু বলিয়া তপতী চলিয়া গেল।
মা কিছুই বুঝিতে না পারিয়া নানা সন্দেহ দোলায় দুলিতে লাগিলেন। শেষে তিনি নিজের মনকে বুঝাইলেন, হয়তো তপন কিছু খাইয়া থাকিবে। আজ তাহার সাবিত্রী ব্রত বলিয়া সারাদিন তপন উপবাসী আছে, রাত্রে ফল মিষ্টি খাইবে ভাবিয়া মা সব ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন, কিন্তু খুকী হয়তো দোকানেই কিছু ফল মিষ্টি খাওয়াইয়াছেনা হইলে খুকী আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিত!
তপতী এতক্ষণ ভাবিতেছিল—আজ সে তপনকে চরম অপমান করাইয়াছে। ইহার পরও যদি সে এ বাড়ি না ছাড়ে তবে তপতী আর কি করিতে পারে! মিঃ বোস অবশ্য জানেন না তপনের সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্ক কি। তিনি উহাকে একজন পোষ্য মনে করিয়া এবং তপতী উহাকে দুই চক্ষে দেখিতে পারে না জানিয়া তপতীর প্রীত্যর্থেই উহাকে ইডিয়ট, বলিয়াছেন। তপতী বেশ কৌশলেই মিঃ বোসকে দিয়া তপনকে অপমানটা করাইয়া লইল। অন্য কেহ, যাহারা তপনের সহিত এ বাড়ির সম্বন্ধে অবগত আছে, তাহারা সাহস করিত না। তপন নিশ্চয়ই ইহার পর চলিয়া যাইবে।
কিন্তু তপনের সহিত মার কথাগুলি তপতী শুনিয়াছে। লোকটা খাইল না কেন। তপতীর এবং মি বোসের কৃত অপমানের প্রতিকারের জন্য সে অনশন আরম্ভ করিল নাকি! আশ্চয্য নয়! তপন যে আজ সমস্ত দিনই খায় নাই, তপতী সে সংবাদ অবগত নয়! তপন অনশন আরম্ভ করিয়াছে, অন্ততঃ আজ রাত্রে কিছু না খাইয়া তপতীকে বুঝাইয়া দিতে চায় যে, সে অপমানিত হইয়াছে। ঐ ভণ্ড প্রবঞ্চক মনে করিয়াছে, তপতী ইহাতে ভয় পাইয়া যাইবে। না, তপতী ভয় পাইবে না। কাল সকালে যদি সে মা-বাবার নিকট সব কথা প্রকাশ করে তাহাতেও তপতীর ভয় পাইবার কোন কারণ নাই। বরং সে ভালই হইবে! মা ও বাবাকে তপতী উহার স্বরূপ চিনাইয়া দিবে।
অনেকক্ষণ ভাবিয়া তপতীর মনে হইল,—মিঃ বোস যখন জানিবেন, তপতীর সহিত ঐ লোকটির সম্বন্ধ কি, তখন তপতীকে তিনি কি মনে করিবেন? ভালই মনে করিবেন। একান্ত অনুপযুক্ত ভাবিয়া তপতী উহাকে অপমান করিয়াছে। কিন্তু মা-বাবা যদি খুব বেশী চটিয়া যান। মা তো নিশ্চয়ই চটিয়া যাইবেন। আজই যদি তপন বলিয়া দিত, কি কারণে সে খাইল না, তাহা হইলে মা হয়ত এখনি একটা অনর্থ ঘটাইতেন। কিন্তু কেন সে কিছুই বলিল না? এখনো কি এই বাড়িতে থাকিবার ইচ্ছা পোষণ করে! নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে তপতীর ভাল নিদ্রা হইল না।
সমস্ত রাত্রি আপনার দুর্ভাগ্যের কথা ভাবিয়া তপন সকালে স্নান করিয়া পূজায় বসিল। দারুণ অপমানে মনটা তাহার বিকল হইয়া গিয়াছে, ধ্যানে মনঃসংযোগ হইতেছিল না। অনেক-অনেকক্ষণ পরে পূজা শেষ করিয়া সে উঠিল এবং বাহিরে যাইবার বেশ না পরিয়াই দরজা খুলিয়া বিস্ময়ের সহিত দেখিল, তপতী বারান্দায় দাঁড়াইয়া আছে স্নানসিক্ত চুলগুলি পিঠে ছড়াইয়া। তপনের ঘরের এত কাছে তপতী কোনদিন আসে নাই। তপন অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল, যদি তপতী কিছু বলে। আশা এবং উদ্বেগে তাহার অন্তর আন্দোলিত হইতেছে।
–দেখুন মশাই—তপতী সরোষে কহিল,—এ বাড়িতে থেকে ওসব হাঙ্গার স্ট্রাইক ফাইক করা চলবে না। ওসব করতে হলে যেখানকার মানুষ সেখানে যান–
তপন দুই মুহূর্ত বিমূঢ় হইয়া রহিল, তারপর কিছু না বলিয়াই খাইবার জন্য মার কাছে চলিয়া গেল। তাহার কথাটাকে এভাবে অগ্রাহ্য করার জন্য তপতীর মন উত্তপ্ত লৌহের মতো অগ্নিময় হইয়া উঠিতেছিল, কিন্তু তপনকে খাইবার ঘরের দিকে যাইতে দেখিয়া সে ভাবিল, হয় সে সেখানে গিয়া মাকে সব কথা বলিবে, না হয় নির্বিবাদে খাইবে। কি করে দেখিবার জন্য তপতীও তৎক্ষণাৎ খাইবার ঘরে আসিল। তপন মুখ নামাইয়া একটা চেয়ারে বসিতেই মা বলিলেন,–এসো বাবা, কাল সারা দিনরাত উপোস আছ।
—দিন মা, এবার খেতে দিন কিছু ফল মিষ্টি-নির্লিপ্তের মতো জবাব দিল!
মা তাহাকে ফল মিষ্টি আগাইয়া দিয়ে সহাস্যে প্রশ্ন করিলেন,–সাবিত্রী ব্রত তো মেয়েরা করে বাবা, তুমি কেন করেছ?
ব্ৰতটা আমার মা করতেন, উদযাপনের আগেই তিনি স্বর্গে যান মা, তাই আমি শেষ করে দিচ্ছি। শাস্ত্রে এ রকম বিধান আছে।
–ও! আজো ভাত খাবে না বাবা?
–না মা–ফল জল খাবো-ভাত খাবো কাল।
তপতী বসিয়া চা খাইতেছিল। তপনের কথা শুনিয়া অবাক হইয়া গেল। অপমানিত হইয়া সে তবে অনশন করে নাই, তাহার ব্রত পালনের জন্যই করিয়াছে। কিন্তু গত রাত্রে নিশ্চয়ই কিছু খাইবে বলিয়াছিল, না হইলে মা তাহাকে ডাকিতে যাইবে কেন? রাত্রের না খাওয়াটা নিশ্চয় তপতী ও মিঃ বোসের উপর রাগ করিয়া। কিন্তু মাকে তো কথাটা সে বলিয়া দিতে পারিত না বলার মধ্যে নিহিত রহিয়াছে যে গভীরতম উদ্দেশ্য—টাকা আদায় করিবার মতলব, তাহা হাসিল করিতে হইলে তপতীকে চটানো চলে না, এ বাড়ি ছাড়া চলে না, মা বাবাকে বলা চলে না যে তপতী তাহাকে গ্রহণ করিবে না! ভাল, তপতী নিজেই মা ও বাবাকে জানাইবে—ঐ অর্থ-লোভী মতলববাজ গণ্ডমূর্খটাকে তপতী কোন দিন স্বামী বলিয়া গ্রহণ করিবে না।
এখনি তপতী সেকাজটা করিতে পারি, কিন্তু লোকটা কাল থেকে উপবাসী আছে এখনি একটা হাঙ্গামা করিবার ইচ্ছা সে কষ্টেই মন করিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল।
-আচ্ছা দাদা, তুমি তো এবার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারো।
–না; শিখা, নেতার কাজ অত সোজা নয়। মনে করলেই নেতা হওয়া যায় না।
–তা হলে নেতার লক্ষণ কি দাদা, কি দেখে চিনবো?
–নেতার ডাক হবে দুর্বার—ইরেজিস্টিবিল্। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশী শুনে ব্রজগোপীরা যেমন কুল-মান বিসর্জন দিয়ে ছুটে যেতো, নেতার ডাক হবে তেমনি।
-কোথায় সে নেতা পাবো দাদা?
—সেজন্য চিন্তা নেই বোনটি–যেদিন তোরা মানুষ হবি, সেদিন নেতাও আসবেন। মানুষের নীতিকে আজ যারা পদদলিত করছে, স্বেচ্ছাচারিতায় আজ যারা বনের পশুকে হারিয়ে দিচ্ছে, তাদের জন্য পাশব-শক্তির আবির্ভাব পৃথিবীতে বিরল নয়। কিন্তু বহু যুগ পূর্বে জন্মগ্রহণ করেও পশ্বের প্রাণী এই মানব আজো পশুধর্ম ছাড়তে পারলো না। এই পশুধর্মকে যিনি জয় করতে পারবেন, তিনি হবেন সেই নেতা!
পশুধর্ম একেবারে কি করে ছাড়া যায় দাদা—মানুষ তো পশুও!
–না শিখা, প্রাণীও বলতে পারিস। প্রাণধর্ম তো তাকে বিসর্জন দিতে বলা হচ্ছে। প্রাণকে মহান করতে, বিশাল করতে বলা হচ্ছে। শিখা! আমি কতকগুলো কঠোর নিয়ম পালন করি; দেখে হয়তো তোরা আবিস-দাদা তোদের গোঁড়া। কিন্তু ভেবে দেখেছিস কি—পশুর কোন বাঁধা-ধরা নীতি নেই। উদর পালনের প্রয়োজনই তার নীতি। তাছাড়া অন্যনীতি যদি কেউ পালন করতে পারে তো সে মানুষ। সত্য কথা নিশ্চয় বলবো এই প্রতিজ্ঞা মানুষই করতে পারে। হিংসা করবো না”–এ নীতি মানুষেরই পালনীয়! ঈশ্বর বলে কেউ থাকুন আর নাই থাকুন—প্রকৃতি মানুষের মধ্যে যে ভাল-মন্দ বোঝবার শক্তি দিয়েছেন,–যে কল্যাণকারী বুদ্ধিটুকু দিয়েছেন, মানুষ কেন তাকে ব্যবহার করবে না, বলতে পারিস?
শিখা অনেকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। বিনায়ক আসিয়া বলিল,–তোমাদের ভাইবোনের গল্প তো আর শেষ হবে না, এদিকে রান্নাকরা খাদ্য সব ঠাণ্ডা মেরে যাচ্চে, আর পেটের খিদে গরম হয়ে উঠেছে।
শিখার দুটি চোখ দরদে ভরিয়া উঠিল,–ওঃ! এত খিদে পেয়েছে আপনার? তো ডাকলেই পারতেন আমাদের! চলুন চলুন।
তপন হাসিয়া বলিল,–না কহিতে ব্যাথাটুকু পার না বুঝিতে?
যাও বলিয়া শিখা প্রায় ছুটিয়াই পলাইতেছে, তপন তাহার বেণীটা ধরিয়া আটকাইয়া ফেলিল, তারপর বলিল,–মিতা পাতিয়েছিস যে,—কি রকম মিতা তাহলে। খিদের সময় বুঝতে পারিস নে?
-আমি দাদারই খিদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, তা মিল।
–তা হলে ওকে আর এক ডিগ্রি প্রমোশন দে ভাই শিখা। ও খিদে মোটেই সইতে পারে না।
–মানে? কোন ক্লাসে প্রমোশন।
—মিতার উপরের ক্লাসে?
শিখা হাসিতে গিয়া লজ্জায় লাল হইয়া উঠিল, বিনায়ক হাসি চাপিতে গিয়া অত্যধিক গম্ভীর হইয়া গেল এবং তপন ভাতের হাঁড়িটা লইয়া পাতায় ভাত পরিবেশন করিতে লাগিল।
খাওয়া শেষ হইলে শিখা বলিল—তুমি দিল্লী কি জন্যে যাবে দাদা। কদিন দেরী করবে সেখানে?
–দিন দশ মাত্র। কি জন্য যাবো সেটা এখন নাই শুনলি ভাই?
—তুমি বড় কথা লুকিয়ে রাখ দাদা। শুনলাম তো কি হলো ক্ষতিটা!
—প্রকাশ করে ফেলতে পারিস সেটা আমি চাইনে। কাজে সিদ্ধিলাভ করে অন্যের মুখে সুযশ শোনা আমার শিক্ষা বোনটি! তবে মনে রাখ—মিঃ আর মিসেস চ্যাটার্জির স্নেহঋণ শোধ করবার জন্যই যাচ্ছি।
শিখা আর অনুরোধ করিল না, কিন্তু মনটি তাহার অত্যন্ত বিষণ্ণ হইয়া রহিল দেখিয়া তপন তাহাকে কাছে ডাকিয়া সস্নেহে কহিল,—আমি নাইবা বইলাম রে, যার হাতে তোকে দিচ্ছি সে তোর অযোগ্য হবে না।
-কিন্তু সেদিনটিতে আমি তোমার আশীর্বাদ পাবো না দাদা। আর কারো আশীর্বাদে তৃপ্তি হবে না আমার।
আশীর্বাদ আজও করছি আবার ফিরে এসেও করব। আর যতকাল বাঁচবো করবো। তোদের কল্যাণ কামনাই যে আমার জীবনের ব্রত শিখা। এই বিশাল পৃথিবীতে তুই, মীরা আর বিনায়ক ছাড়া আত্মীয় বলতে তো আমার আর কেউ…।
তপন থমিয়া গেল। অসহনীয় ব্যথায় কণ্ঠস্বর কঁপিয়া উঠিতেছিল। সংযমী তপন আত্মসংবরণ করিল কিন্তু শিখার নারীহৃদয় এ বেদনা সহিতে পারিল না, দরদর ধারায় তরল মুক্তবিন্দু তাহার দুই গণ্ডে ঝরিয়া পরিল। বিনায়ক নীরবেই এই শোকাবহ দৃশ্য অন্যদিন দেখিয়াছে, আজো দেখিল নীরবেই।
আত্মসম্বরণ করিয়া শিখা বলিল,–তপতীর আশা কি তুমি তবে ছেড়েই দিয়েছে দাদা?
—প্রায়; কারণ সে অন্য কাউকে ভালবাসে কি না আমি জানিনে, তবে আমায় সে গ্রহণ করবে না, এটা বহু প্রকারে জানিয়ে দিয়েছে।
–কিন্তু দাদা, তুমি সেখানে যে ভাবে থাকো, যে ছদ্মবেশে সে তোমায় দেখেছে, তাতে তার মতো একজন শিক্ষিতা তরুণীর পক্ষে তোমাকে স্বামী স্বীকার করা কঠিন তো?
—আমি তো বলছিনে শিখা, যে সহজ। কঠিন নিশ্চয়ই। তবে সেটাও সম্ভব, যদি সে আজো অনন্যপরায়না থাকে। আছে কি না জানবার জন্য আমি এত ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছি। এত অপমান সহ্য করছি। আমি যদি আজ আত্মপ্রকাশ করি, তাহলে তো নিশ্চয়ই সে আমায় গ্রহণ করবে কিন্তু তাতে সে পূর্বে আর কাউকে ভাল বেসেছে কি না, তা আর আমার জানা হবে না।
—তা যদি বেসেই থাকে দাদা, তাহলে কি তুমি ওকে গ্রহণ করবে না?
–নিশ্চয় না। আমার জীবনে অন্যাসক্তা নারীর ঠাঁই নেই। শিখা, আমি কোনো মানবীকে আমার সহধর্মিণীর আসন দিতে চাই, যে মানবী শুধু দেহধর্মিণী নয়। এর জন্য যদি শত জন্মও আমার একক জীবন কাটাতে হয়, সেও ভালো।
শিখা নীরবে তপনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল,—মিঃ বোসকে দিয়ে তোমায় অপমান করালো এরপর তোমার আর কিসের সন্দেহ দাদা–ছেড়ে দাও ওবাড়ি।
দেরী আছে ভাই। মিঃ বোসকে দিয়ে আমায় অপমান করানোর জন্য কারণও থাকতে পারে, এমন কি, সে আজো নির্মল আছে ঐটাই তার একটা বড় প্রমাণ।
—তা হলে আরও পরীক্ষা তাকে করবে?
—আমি কিছুই করবো না শিখা, যা-কিছু করবার সেই করবে। আমি শুধু জানতে চাইছি, কাকে সে চায়। তা যদি না জানতে পারি তাহলে ওর মাবাবের কাছে পাওয়া স্নেহের যৎকিঞ্চিৎ ঋণ আমি শোধ করে যাবো—তারই জন্য দিল্লী যাচ্ছি।
তপন অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল,—শিখা, এই দেশের মেয়েরাই স্বামীর নিন্দা শুনে মৃত্যু বরণ করেছে, মৃত স্বামীর কঙ্কাল নিয়ে দেশে দেশে ফিরেছে, গলিত কুষ্ঠ স্বামী কাঁধে করে বয়ে বেড়িয়েছে,—আধুনিকতা তোরা; অতটা বাড়াবাড়ি না-হয় নাই করলি! কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কারো ভাগ্যে যদি মুখ স্বামীই জোটে তো, তাকে কি স্নেহের সুরে একটা কথাও বলবি নে? বন্ধু দিয়ে অপমান করে তাড়াবি? তার চেয়ে নিজেই কি বলা উচিত নয়, তুমি চলে যাও, আমি তোমায় চাইনে। তপতী যদি বলতো, সে অন্য কাউকে ভালোবাসে, তাহলে আমি আনন্দে তাকে তার প্রিয়তমের হাতে তুলে দিতাম। আজো তারজন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি আমি, শিখা–কিন্তু তপতীর মনের খবর জানবার সুযোগ আমার খুবই কম। ওর মা-বাবাকে কথাটা জানালে তারা অত্যন্ত আহত হবেন, তাই নিজেই সহ্য করছি। দুঃখ আমি বিস্তর সহ্য করেছি। এটাও সইতে পারবো—তোরা সুখে থাক…
তপন চলিয়া গেল—শিখা নিৰ্ণিমেষ দৃষ্টিতে তার গমন পথের দিকে চাহিয়া রহিল।
তপতী নির্বাক হইয়া চাহিয়াছিল কার্ডখানার দিকে, শিখায় বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র। তপতী এবং তপন দুজনকেই এক পত্রে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে। তপতীর গাত্রদাহ হইতেছিল ঐ ইতর লোকটার সহিত তাহার নাম যুক্ত হইতে দেখিয়া। কিন্তু নিরুপায় নিষ্ফল গর্জন ছাড়া তপতী আর কি করবে। সৌভাগ্য এই যে তপতী সেদিন এখানে থাকিবেনা, দিল্লীতে নিখিল ভারত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় যোগদানের জন্য কালই তারা যাত্রা করিবে।
তপতী নীচে আসিয়া বসিল বন্ধুদের অপেক্ষায়,–অনেক কিছু আয়োজন করিবার আছে তাহাদের। মিঃ ব্যানার্জি, মিঃ অধিকারী, মিঃ সান্যাল, রেবা সিকতা, শৈলজা ইত্যাদি আসিয়া পৌঁছিল।
রেবা বলিল, বন্ধুর বেতে থাকবি নে তুই? কেমন ছেলে রে? তুই জানিস?
তপতী অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সহিত বলিল—জানার দরকার? সে যখন আমায় ছাড়তে পেরেছে তখন আমিই বা না পারবো কেন?
—ঠিক কথা। তবে বিয়েটা কার সঙ্গে হচ্ছে, জানতে ইচ্ছে করে।
–জেনে আয় গিয়ে নাম তো দেখলাম বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তপতী একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজ্ঞাতেই মোচন করিল।
মিঃ ব্যানার্জি তাহার কথাটা ধরিয়া বলিলেন,–বিলেৎফেরত নাকি; করে কি?
–জানিনে বলিয়া তপতী অন্যদিকে চাহিয়া রহিল। তাহার নিজের দুর্ভাগ্য আজ তাহাকে অপরের সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত করিতেছে! তপতী বুঝিতেছে, ইহা অন্যায়; কিন্তু তাহার আয়ত্তের বাহিরে। নিজের মনের এই শশাচনীয় অধোগতি আজ তপতীকে ব্যথা দিল না, বিষাক্ত করিয়া দিল। তাহার যত কিছু জ্বালা তপনের সর্বাঙ্গে ঢালিয়া দিতে পারিলে তপতী যেন কতকটা জুড়াইতে পারে।
মিঃ অধিকারী বলিলেন—লোকটা ব্রাহ্ম, না হিন্দু, না খৃষ্টান? জানেন?—হিন্দুই হবে বোধ ইয়—শিখা কি আর অনা ধর্মের কাউকে বিয়ে করবে! ওর যা হিন্দুয়ানী স্বভাব! ওর বাবা তার উপর যান। আর মা যান বা উপরে।
রেবার কথাকটি শুনিয়া সকলেই হাসিল, হাসিল না শুধু তপতী; গম্ভীর মুখে খানিক বসিয়া থাকিয়া কহিল,ভালই। শিখা হচ্ছে আর্যনারী।
–কেন? আমরাও তো আর্যনারী—আমরাই বা সতীর কম কি? রেবা কহিল।
–বেফাঁস কথা কেন বলিস রেবা—সতীত্বের মানে বুঝিস? তপতীর উষ্ণ কথায় সবাই চুপ হইয়া গেল। মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন–আমরাও জানিনে সতীত্বের মানে; আপনি যদি বলেন দয়া করে? শুনে ধন্য হই।
–জানেন—কোন কালে কেউ সতী ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না।
–কেন? সীতা সাবিত্রী, বেহুলা,রেবা তুরিতে কথাটা বলিয়া তপতীর মুখের দিকে চাহিল।
কলহাস্যে তপতী ঘর ভরাইয়া দিয়া বলিল,–থাম থাম-সীতার মতন বোকা মেয়ে পৃথিবীতে আর জন্মায়নি। আর সাবিত্রী তো এক নম্বর পলিটিসিয়ান, আর নির্লজ্জ বেহুলার কথা বলতে ইচ্ছে করে না, একটা ফাষ্ট ক্লাস ককেট। নাচনী সেজে নিজের কাজ গুছিয়ে নিয়ে ফিরে এল!
সবাই উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। মিঃ ব্যানার্জি প্রশ্ন করিলেন,–সীতা বোকা, কিসে প্রমাণ হয়?
-বরাবর। প্রথম, রাবণের মত একটা পশুপ্রকৃতির লোককে অত রূপগুণ থাকা সত্ত্বেও সীতা খেলাতে পারেনি; অশোক বনে পড়ে পড়ে মার খেলো। তারপর আগুনে পুড়ে পরীক্ষা দিয়ে নিজের আত্মার করলো অপমান। রাণী তুই না-হয় নাই হতিস বাপু, তাবলে পরীক্ষা দিবি কিসের জন্য। তিন নম্বর বোকামী তার পরের কথায় তার নিষ্ঠুর স্বামী তাকে দিল বনবাস, আর সে দিব্যি বনে চলে গেল! কেন? সেও তো একজন প্রজা, বিনা অপরাধে তার শাস্তি সে কেন মেনে নিলো?—কেন বিচার চাইল না? তাতে সে স্বামীকেও স্বধর্মের পথে চালনা করতে পারতো! সতী হবার কাঙালপনায় ঐ মেয়েটা নারীত্বের চরম অপমান ঘটিয়েছে। চতুর্থ দফায় সেকরলো পাতাল প্রবেশ! আত্মহত্যার আর ভালো উপায় তখনকার দিনে ছিল কিনা আমার জানা নেই—পটাসিয়াম সায়নাইড় তখনো বার হয়নি, কিন্তু আত্মহত্যা ও করলো কেন? এই কাপুরুষত্ব আই মিন কা-নারীত্ব—সবাই উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল, তপতী ধমক দিয়া কহিল,—থামুন হাসি কেন অত? এই কানারীত্ব আমি কিছুতেই সমর্থন করিনে। সীতার যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকতো তাহলে রামের গড়া সোনার সীতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে বলতে-পারতো, আমি পরীক্ষাও দেব না আত্মহত্যাও করবো না। তুমি আমায় বিয়ে করেছে বনে যদি যেতে হয়, চল দুজনেই। তোমার বোকামীর জন্য আমার একা কেন শাস্তি হবে? তুমি গিয়েছিলে কেন সোনার হরিণ ধরতে? কেন তুমি রাবণের বাড়ি থাকার সময়েই আমায় আত্মহত্যা করতে বলনি? কেন তুমি অগ্নি পরীক্ষাটা এখানেই এনে করলে না? কেনইবা তুমি বিনাবিচারে আমায় বনে পাঠালে? নিজে যেমন তুমি নির্বুদ্ধিতা করে একটা বুড়ো স্ত্রৈণ লোকের কথা রাখবার জন্য বনে গিয়েছিলে তেমনি কি সবাই বোকা নাকি? কিন্তু সীতা এত বোকা ছিল আর ছিল সতীত্বের নামে কাঙাল যে এ-সব কথা ওর মাথায় একদম ঢোকেনি।
আলোচনাটা অত্যন্ত সরল এবং উপভোগ্য ভাবিয়া মিঃ অধিকারী কহিলেন,–আচ্ছা,–সাবিত্রী সম্বন্ধে কি আপনার বক্তব্য?
—সি ওয়াজ এ গ্রেট পলিটিসিয়া। সাবিত্রী সতী কিনা বলতে পারি না, তবে সীতার চেয়ে সে হাজারগুণ বুদ্ধিমতী। যম রাজার মতো ঘড়িয়াল লোককে সে সাতঘাটের জল খাইয়ে দিল!নারীত্বের সম্মান সে কিছুটা রেখেছে, এই জন্য ওকে আমি শ্রদ্ধা করি। দেখুন না রাজার মেয়ে তো, চেহারা নিশ্চয় ভাল ছিল, যম রাজাও এসে গেছে, আর সাবিত্রী আরম্ভ করেছে নানারকম কথার প্যাচ। পুরুষমানুষের মাথা ঘুলিয়ে দিতে কতক্ষণ! শেষ যখন বললো, তার একশ ছেলে চাই, তখন যম ভাবলো আহা বেচারা, এই বয়সে সেক্সআকাঙক্ষাটা মিটোবার বায়না ধরেছে, অস্বাভাবিক তো কিছু নয়! দিয়ে দিলোবর। সাবিত্রী যে পলিশি করে ওর প্রার্থনার মধ্যে সত্যবানের দ্বারা কথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে, রূপমুগ্ধ যমের তখন আর সেদিকে খেয়াল নেই। কেমন কৌশলে বর নিল বলুন তো? একশ ছেলে, বছরে একটা হলেও স্বামী তার অন্তত একশ বছর বাঁচবে। ছেলের আর কিছু দরকার ছিল বলে তো মনে হয় না, দরকার যা ছিল তার সে ঠিক আদায় করে নিয়েছে। এমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি থাকলে যদি সতী বলা চলে, তাহলে অবশ্য সাবিত্রী সতীই।
মিঃ-সান্যাল পুনরায় প্রশ্ন করিলেন,—বেহুলার কথাটাও বলুন একটু
-ও আর বলে কাজ নেই। ও যখন দেখলে যে দেবতারা তার স্বামীকে বাঁচিয়ে দিতে পারে তখন সেখানে গিয়ে নাচ গান যা কিছু করা দরকার, করে স্বামীর জীবনটাকে ফিরিয়ে নিল, আধুনিক যেসব মেয়েকে চাঁদা আদায় করতে পাঠানো হয়, বেহুলা তাদের চেয়ে অনেক উঁচুদরের ককেট।
তপতীর প্রত্যেক কথা হাস্যোদ্রেক করিলেও তাহার চিন্তাশীলতার গভীরতা অন্যান্য সকলকে অভিভূত করিতেছিল, হাসিতে গিয়াও তাহারা ভাবিতেছিল, তপতীর চিন্তাধারা ভিন্ন খাতে বহিয়া চলে। আর তপতী ভাবিতেছিল, ভারতের চিরবরেণ্যা কয়জন মহামানবীর চরিত্রের যে সমালোচনা সে আজ করিতেছে, তাহা শুনিলে তাহার ঠাকুরদা হয়তো মূচ্ছা যাইতেন। তপতীর মনে বেশ একটা তীব্র সুরার আনন্দ অনুভূত হইতেছে। ঠাকুরদার মৃত আত্মা যদি কোথাও থাকেন তো শুনুন, তাহার নাতনী ঠাকুরদার চিন্তাকে অতিক্রম করিয়া গিয়াছে।
মিঃ সান্যাল এবার বেশ জোরে হাসিয়া কহিলেন,–আপনার অভিধানে তাহলে সতী কথাটা নেই, কেমন?
—থাকবে না কেন? সৎ কথাটার স্ত্রীলিঙ্গ সতী! কিন্তু সৎ কাকে বলে তা বুঝতে হলে অভিধান দরকার। ঠাকুরদা বলতেন সৎ চিরস্থায়ী আর অপরিবর্তনীয়, কিন্তু এরকম কোন কিছু আমি তো খুঁজে পাইনে। ভগবান যদিবা থাকেন তো তিনি দেশকাল-পাত্র হিসেবে পরিবর্তিত হন, অর্থাৎ তিনি নেই, আছে মানুষের কল্পনা যার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
—ভগবান না থাকাই ভালো, অনেক হাঙ্গামা চুকে যায়। আর থেকেই বা উনি কি করছেন আমাদের?কথাটা বলিয়াই মিঃ ব্যানার্জি টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিলেন।
–তাঁর থাকার ভয়ানক দরকার, নইলে মানুষ তার হৃদয়ের শ্রদ্ধাভক্তিগুলো দেবে কাকে? চৈতন্যের মতন খোল বাজিয়ে দিনরাত কান্নাকাটি কেবল ঐ নির্বিকার ভগবান সইতে পারেন। ঐ তাণ্ডব কোন মানুষের উপর চালালে সেও যে নির্বিকার পাথরবনে যাবে। তপতীর কথায় আবার সকলে হাসিয়া উঠল।
অকস্মাৎ তপতীর ঠাকুরদার হাতে-গড়া মন চীকার করিয়া উঠিল : এ সত্য নয়, তপতী আত্মবঞ্চনা করিতেছে। নিজেকে সংশোধন করিবার জন্যই যেন সে বলিয়া উঠিল,—ঐ নির্বিকার ভগবান আছে, ও থাক–ওকে মানুষের বড় দরকার। যেকথা নিজের কাছেও বলতে মানুষ কুষ্ঠিত হয়, সে কথাও ওর কাছে বলে খানিকটা হাল্কা হওয়া যায়। জীবনে এমন দুঃসময় আসে, যখন একটা অচেতন কিছুকে চেতন ভোব নিজের সুখ দুঃখের কথা বলতে ভাল লাগে, ভালো লাগে নিজের আরোপিত মেহকেই তার কাছ থেকে ফিরে পেতে। নিজের ক্ষুদ্রতাকে মানুষ নিজের কল্পনায় বিশালতার মধ্যে অনুভব করতে চায়!—তপতী কথাগুলো বলিয়া যেন দম লইতেছে।
–তা হলে ভগবানকে মেনে নিলেন আপনি?—মিঃ ব্যানার্জি পুনঃ প্রশ্ন করিলেন।
—মানা মা-মানায় ওঁর কিছু এসে যায় না, ওঁকে দরকার হলে ডাকবে, না হলে ডাকবার দরকার নেই, এমন সুবিধার জিনিস না ত্যাগ করাই বুদ্ধির কাজ। চলুন এখন সব গোছগাছ করে নিতে হবে।
তপতী উঠিল এবং বাধ্য হইয়া অন্য সকলেও উঠিল।
পরদিন বিকালের ট্রেনে তপতীদের দল মিঃ ব্যানার্জি ও মিঃ সান্যাল কর্তৃক পরিচালিত হইয়া যথাসময়ে হাওড়ায় পৌঁছিয়া রিজার্ভ ফাক্ট ক্লাসের দুইটি কক্ষে স্থান গ্রহণ করিল। ট্রেন প্রায় ছাড়ে ছাড়ে এমন সময় তপন একজন কুলির মাথায় সুটকেশ ও বেডিং লইয়া তপতীদের কামরার সামনে দিয়া চলিয়া গেল।
মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন,–তপনবাবুও যাচ্ছে নাকি?
তপতী লক্ষ্য করে নাই; মিঃ ব্যানার্জির কথায় চাহিয়া দেখিল, তপন যে গাড়িতে উঠিতেছে, তাহার দরজাটায় একটা বড় অক্ষরের তিন নম্বর।
মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন, কি রকম! থার্ড ক্লাশে যাচ্ছে যে?
তপতী চুপ করিয়া রহিল। বিস্ময় ও লজ্জায় তাহার মাথা নীচু হইয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকিয়া সে মিঃ ব্যানার্জি ও মিঃ সান্যালকে কহিল,—ও যে আমাদের কেউ, একথা যেন এখানে আর কেউ না শশানে, বুঝলেন! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।
মিঃ ব্যানার্জি বলিলেন,—আমরা এত নির্বোধ নই, মিস চ্যাটার্জি? কিন্তু লোকটা কী ধড়িবাজ। আপনার বাবার কাছে নিশ্চয় ফাৰ্ট ক্লাসের ভাড়া ও আদায় করেছে, টাকাটা জমিয়ে নিল।
ইহা ছাড়া আর কি কারণ থাকতে পাবে। বাবা নিশ্চয় জামাইকে থার্ড ক্লাসে পাঠাঁইবেন। কোটিপতি লোকের জামাই তপন-থার্ড ক্লাসে যাইতেছে, শুনিলে লোকে কী ভাবিবে! রাগে দুঃখে তপতীর কান্না পাইতে লাগিল। স্থির করিল ফিরিয়া বাবাকে বলিয়া ইহার প্রতিকার সে করিবেই। তখনকার মতো তপতী বিষয়ান্তরে মনঃসংযোগের চেষ্টা করিল, কিন্তু মনের ভিতর যেন একটা আগ্নেয়গিরি ফাটিয়া গিয়াছে। তাহার ধুমায়িত শিখায় তপতীর চকু অন্ধ হইয়া যাইবে। ঐ লোকটার সীমাহীন অর্থলোলুপতা তপতীর পিতাকে পর্যন্ত অপদস্থ করিতেছে। ধনীর দুলালী আভিজাত্য গৌরবে গরবিণী তপতী ভাবিতেই পারেনা, থার্ড ক্লাসে যাইতেছে তাহার স্বামী—তাহারই পিতার যাবতীয় সম্পত্তির মালিক!
নির্বাক তপতীর মনের ভাব বুঝিয়া মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন,
–আর দেরী করায় লাভ কি মি চ্যাটার্জি? আপনার বাবাকে বলে ওকে তাড়িয়ে দিন বাড়ি থেকে।
–হুঁ–
–আপনার মত মেয়েকে পাওয়া যে-কোন উচ্চ শিক্ষিত যুবকের অহঙ্কারের বিষয়।
—হুঁ—
—অবশ্য বিবাহ বিচ্ছেদের দলিলটা রেজিষ্টারী করিয়ে নিতে হবে তার আগে! তপতী এবারও একটা হুঁ দিয়া অন্য দিকে সরিয়া জানালায় মুখ বাড়াইল।
নিখিল-ভারত-সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় খেয়াল গানে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ লাভ করিতে গিয়া তপতীর মন বিষাদে পূর্ণ লইয়া গেল। এই গান তাহার শুনিবে কে? কার জন্য তপতীর এই সাধনা! সে কি ঐ নিতান্ত অপদার্থ একটা গণ্ডমূখের জন্য? তপতীর বিষবাষ্প তপনকে এই মুহূর্তে দগ্ধ করিয়া দিতে চায়! যেন মিঃ ব্যানার্জি এবং মিঃ সান্যাল তপতীর মনের গতি সর্বদা লক্ষ্য কবিতেছেন।
তাহাদের কাজ হাসিল করিবার ইহাই উৎকৃষ্ট সুযোগ। তপতীর নিকট আসিয়া কহিলেন,
–চলুন একটু বেড়িয়ে আসা যাক—হুমায়ুনের কবর দেখে আসি গে!
তপতী আপত্তি করিল না। একটু বাহিরে গিয়া আপনার চিত্তবেগ প্রশমিত করিতে তাহারও ইচ্ছা জাগিতেছিল। ট্যাক্সি চড়িয়া সকলে যাত্রা করিল। পৃথ্বীরাজ রোডের উপর দিয়া গাড়ি চলিয়াছে। দুইপাশে ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি তাহার উপর বাল্লা বন,—যেন সুদূর অতীতের-পথ ধরিয়া চলিয়াছে তাহার পৃথ্বীরাজরেই রাজত্বে!
তপতী হঠাৎ কহিল,–সংযুক্তার কথা মনে পড়ছে। যোগ্য স্বামীকে পাবার জন্য বাপমাকে ছাড়তে সে দ্বিধা করেনি—অদ্ভুত মেয়ে।
মিঃ ব্যানার্জি তাহাকে উস্কাইবার জন্য কহিলেন, আপনার মনের শক্তিও কিছু কম নয়। আজ দীর্ঘ সাতমাস আপনি মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
তপতী একটা নিঃশ্বাস ছাড়িল তারপর ধীরে ধীরে কহিল,—যুদ্ধ এখনো করিনি মিঃ ব্যানার্জি এ কেবল সমরায়োজন চলছে। কিন্তু সংযুক্তার মতো ভাগ্য তো আমার নয়, আমার পৃথ্বীরাজ এখনো আসেননি।
মিঃ ব্যানার্জি ও মিঃ সান্যাল চকিত হইয়া উঠিতেছেন! তপতীর মনটাকে তাহার। আজো আকর্ষণ করিতে পারেন নাই তবে! কে তবে উহাকে লাভ করিবে। এখনি সেটা জানিয়া লওয়া দরকার, বলিলেন,–আপনার পৃথ্বীরাজ কিভাবে আসবেন, বলতে পারেন মিস্ চ্যাটার্জি?
না! যেদিন আসবেন সেদিন বলতে পারব! আজ শুধু জানি যারা এতদিন আসছেন তারা কেউ-ই পৃথ্বীরাজ নন! তাদের মধ্যে অনেক ঘোরী আছেন, কিন্তু পৃথ্বীরাজ নেই।
তপতীর ইঙ্গিত বঙ্গের কাছে ঘেঁষিয়া মিঃ ব্যানার্জিদের পীড়িত করিতেছে। মিঃ ব্যানার্জি আজ মরিয়া হইয়া উঠিয়াছেন কহিলেন,
-ঘোরীর হাতে পৃথ্বীরাজের পরাজয় ঘটেছিল, বীরত্ব তার কম ছিল না মিস্ চ্যাটার্জি?
দুর্ভাগ্য সংযুক্তারবাবা তার জয়চন্দ্র আর সৌভাগ্য সংযুক্তার স্বামী তার মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘোরীর বীরত্ব দেশজয় করতে সক্ষম, নারী হৃদয় নয়, কারণ নারী নিজে ছলনাময়ী বলে ছলনা কপটতাকে অত্যন্ত ঘৃণা করে। নারী নিশ্চিত নির্ভরতায় তাকে বুকের পদ্মটিতে গন্ধ হয়ে ফোটে যে-পুরুষ আপন পৌরুষ মহিমায় মৃত্যুপথকে উজ্জ্বল করে তুলবে; চালাকিতে নয়, ছলনায় নয়, কপটতায় নয়। নারী নিজে সাংঘাতিক কপট তাই অন্যের কপটতা সহজে বুঝতে পারে।
—আপনি কি বলতে চান যে আমরা আপনার সঙ্গে কপটত করি?
—হাঁ, তাই। তার প্রমাণ আপনার এই প্রশ্নটি। আপনি যদি অকপট হতেন তাহলে এ প্রশ্ন আপনার মনে আসতো না। আমি তো কোন ব্যক্তিগত কথার আলোচনা করিনি। আপনি নিজেই ধরা পড়লেন! তপতী হাসির বিদ্যুৎ হানিল।
মিঃ ব্যানার্জি ও মিঃ সান্যাল মুড়াইয়া পড়িতেছেন। কিন্তু মিঃ সান্যাল কানে কানে মিঃ ব্যানার্জিকে বলেন,—আধুনিক সাইকোলজি বলে : মেয়েরা যাকে ভালোবাসে তাকেই ঐ রকম আক্রমণ করে; অতএব ভাবনার কিছু নাই।”
কথাটা শুনিয়া মিঃ ব্যানার্জি প্রীত হইয়া কহিলেন, কটকে কপটতা দিয়েই তো জয় করা যায়।
তপতী মধুর হাসিল, একটু থামিয়া বলিল,–জয়ীর লক্ষণ হচ্ছে বিজিতেব আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা—পারবেন তো?
–নিশ্চয়। বলুন কি আকাঙক্ষা। মিঃ ব্যানার্জি সাগ্রহে চাহিলেন তপতীর দিকে।
–উপস্থিত যৎসামান্য। ঐ-যে লোকটা বসে আছে, পিছনের চুলগুলো ঠিক তপনবাবুর মতো, দেখে আসুন তো, ও সেই কি না? আপনাকে আশা করি চিনতে পারবে না।
—সম্ভব নয়—বলিয়া মিঃ ব্যানার্জি গাড়ী হইতে নামিয়া গেলেন। হুমায়ুনের কবরের নিকট এক টুকরো ঘাসে-ভরা জমির উপর তপন নিশ্চল-ভাবে বসিয়া ছিল। মিঃ ব্যানার্জি গিয়া দেখিলেন, এবং নমস্কার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি বাঙালী দেখছি—
—হ্যাঁ—বলিয়া তপন তাহার মুখের পানে তাকাইল। মিঃ ব্যানার্জিদের সহিত তাহার পরিচয় নাই। ব্যানার্জি জিজ্ঞাসা করিলেন,–বেড়াতে এসেছেন বুঝি? ক দিন থাকবেন? উত্তবে তপন জানাইল, তাহার কাজ শেষ হইয়াছে, কাল সে আগ্রা যাইবে পরশু বৃন্দাবনধাম দর্শন করিয়া পরদিন কলিকাতা ফিরিবে। মিঃ ব্যানার্জি হয়তো আরো কিছু জিজ্ঞাসা করিতেন, কিন্তু তপন উঠিয়া নমস্কার করিয়া অদূরে দণ্ডায়মান টাঙ্গায় চড়িয়া প্রস্থান করিল। মিঃ ব্যানার্জি ফিরিয়া তপতীকে সব কথা জানাইয়া শেষে কহিলেন,–ভদ্রলোক দেখলেই ও ভয় পায়।
–পায় হয়তো। চলুন; কাল আমরাও আগ্রা যাই।
এভাবে কেন তপনের পিছনে ঘুরিয়া মরিবে, জিজ্ঞাসাব উত্তরে তপতী জানাইল, উহার পিছনে একটু গোয়েন্দাগিরি করা দরকার, নতুবা বাবা-মাকে কি বলিয়া সে বুঝাইবে যে তপনকে বাড়িতে রাখা যায় না। আগ্রায় এবং বৃন্দাবনে সে কি করে জানিতে হইবে। এই সঙ্গে আগ্রা সহরটাও দেখা হইয়া যাইবে আর একবার!
পরদিন নিউ-দিল্লী স্টেশনে একটি প্রথম শ্রেণীর কামরায় আসিয়া উঠিল তপতীদের দল। তপনকে তাহারা অনেক খুঁজিয়াও দেখিতে পাইল না। তপতী সেই দীর্ঘ পথ বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল—হয়তো তপন এ-গাড়ীতে আসে নাই, কিম্বা কোন থার্ডক্লাসের ভিড়ে লুকাইয়া গিয়াছে। যদি না আসে তবে তপতীদের পরিশ্রম বৃথা হইবে। তপতী জানিতে চায়, এতদুরে আসিয়া ঐ অদ্ভুত লোকটা কী করিতেছে।
বেলা বারটায় গাড়ী আসিয়া থামিল। জিনিসপত্র গুছাইয়া সিসিল হোটেলের লোকদের সহিত গাড়ীতে উঠিতে গিয়া মিঃ ব্যানার্জি দেখাইলেন, একটা টাঙ্গায় সুটকেশ ও বেডিং হাতে তপন উঠিয়া চলিয়া গেল। হয়তো কম দামের কোন হোটেলে উঠিবে। এইভাবে পয়সা বাঁচাইতে গিয়া তপন যে তাহার সম্মানিত পিতার কতখানি অপমান করিতেছে তাহা ঐ ইডিয়ট বোঝে না। তপতীর সর্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল।
হোটেলে আসিয়া স্নানাহার সারিয়া সকলেই বলিল,–ফতেপুর সিক্ৰী, আগ্রা ফোর্ট, ইত্মাৎ-উদ্দৌলা ইত্যাদি দেখিতে যাইবে। তপতীর মন অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, সে অসুস্থতার ছুতা করিয়া হোটেলেই পড়িয়া রহিল। আগ্রা সে পূর্বে দুইবার দেখিয়াছে। অন্যান্য সকলে চলিয়া যাইবার পর তপতী ভাবিতে বসিল তাহার জীবনের অপরিসীম ব্যর্থতার ইতিহাস। তপনকে ভালবাসিবার আকাঙ্ক্ষা সে তাহার মনের অলিগলিতে ঘুরিয়াও কুড়াইয়া পাইল না। ঐ লোকটার উপর বিতৃষ্ণাই কেবল জাগিয়া উঠে এবং বিতৃষ্ণার কথা ভাবিতে গিয়া ক্রোধে সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া যায়। উহার হাত হইতে উদ্ধার লাভের কি কোন উপায় নাই। সারাদিন চিন্তার পর ক্লান্ত তপতীর মনে হইল, প্রেমের শ্রেষ্ঠ তীর্থ তাজমহলটা একবার দেখিয়া আসিবে! হোটেলের গাড়ী আনাইয়া তপতী উঠিয়া বসিল।
আশ্চর্য! তাজমহলের সম্মুখে ঝাউবীথি-বেষ্টিত প্রকাণ্ড চত্বরে বসিয়া আছে তপন-দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত। তাজের শুভ্র মর্মরমূর্তিকে যেন সে ধ্যান করিতেছে। তপনের পিছন দিকটা তপতী ভালভাবেই চিনিত ঘাড়ের পাশেই সেই কালো তিলটি, লম্বা গভীর কালো কোঁকড়ানো চুল লতাইয়া পড়িয়াছে যেখানে। সামনে গেলে পাছে তপতীকে দেখিয়া তপন চলিয়া যায়, এই ভয়ে তপতী পাশ্চাতেই অপেক্ষা করিতে লাগিল।…সন্ধ্যা হইতেছে। আষাঢ় পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় বিরহী সম্রাটের প্রেমদ্যুতি যেন ভাষা লাভ করিতেছে!
তপন উঠিয়া তাজমহলের মধ্যে আসিল। তপতী তাহার অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে। জনতার মধ্যে কে কোথায় কি উদ্দেশ্যে চলিতেছে তপন লক্ষ্যমাত্র করিল না। সম্রাট সম্রাজ্ঞীর সমাধিপার্শ্বে আসিয়া সে হাতের ফুলগুলি অঞ্জলিবদ্ধ করিয়া আবৃত্তি করিল :
হে সম্রাট কবি, এই তব জীবনের ছবি–
এই তব নব মেঘদূত, অপূর্ব্ব-অদ্ভুত,
চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া—
ভুলি নাই—ভুলি নাই—ভুলি নাই প্রিয়া…
তপতীর বিস্ময় সীমাতিক্রম করিয়া গিয়াছে। এই তপন! সত্যই তপন তো? কিম্বা তপতী অন্য কাহাকেও তপন ভাবিয়াছে। না, তপতীর ভুল হয় নাই। ও-যে তপন, তাহার পরিচয় রহিয়াছে উহার পোষাকে। ঐ পোষাকে সে দিল্লীতেও পরিয়াছিল—ঐ রং—ঐরকম কোট।
তপন প্রণাম কবিয়া চলিয়া আসিল। তপতী পিছনে পিছনে আসিয়াছে বরাবর। তাজমহলের সুবিস্তৃত আঙ্গিনা পার হইয়া তপন বাহিরের গাড়ী থামিবার জায়গায় আসিল। তাহার টাঙ্গাওয়ালা কহিল,—আইয়ে!
–তপতী ত্বরিতে তপনের নিকট আসিয়া বলিল,
–আমায় একটু পৌঁছে দেবেন?
তপন এক মুহূর্ত ইতস্তত করিয়া বলিল,
–একা এসেছেন? চলুন, কোথায় যাবেন?
—সিসিল হোটেল-বলিয়া তপতী চাহিল জ্যোৎস্নলোক-দীপ্ত তপনের মুখের পানে। ভাল দেখা যায় না, তথাপি তপতীর মনে হইল—এমন সুন্দর সে আর দেখে নাই! টাঙ্গার সামনেকার আসনে তপতী উঠিয়া বসিল, তপন বসিল পিছনে!
—এদিকে আসুন!—তপতী অনুরোধ করিল তপনকে তাহার পাশে বসিতে।
—থাক—আমি বেশ আছি বলিয়া তপন আদেশ করিল গাড়ী চালাইতে।
–কেন? এখানে আসবেন না?—তপতীর কণ্ঠে অজস্র বিস্ময়!
–মাফ করবেন, আমি অনাত্মীয়া মেয়েদের পাশে বসি নে—তপনের কণ্ঠস্বর দৃঢ়।
-অনাত্মীয়া! আমি আপনার অনাত্মীয়া নাকি? এই, রোখো!–তপতী কঠোর আদেশ করিল চালককে।
রাগে তপতীর আপাদমস্তক ঝিমঝিম করিয়া উঠিয়াছে। লাফ দিয়া গাড়ী হইতে নামিয়া পড়িয়া সক্রোধে কহিল,–আমিও অনাত্মীয় পুরুষের গাড়ীতে চড়ি না বলিয়াই অপেক্ষামাত্র না করিয়া তপতী হোটেলের গাড়ীতে চড়িয়া প্রস্থান করিল।
ব্যাপারটা কি ঘটিল, কেন উনি এভাবে চলিয়া গেলেন–তপন কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া বিব্রতভাবে চাহিল। কোন নারীর মুখের পানে সে পারতপক্ষে তাকায় না। ইহাকেও চাহিয়া দেখে নাই। একক কোনো মহিলা পৌঁছাইয়া দিতে বলিতেছেন, তপনের অন্তরের কাছে ইহাই যথেষ্ট আবেদন। সমস্ত ব্যাপারটা তপনের দুৰ্জেয় বোধ হইতেছে।
গাড়ীতে উঠিয়া উত্তেজনার আতিশয্যে তপতী কয়েক মুহূর্ত প্রায় কোন চিন্তাই করিতে পাবিল না। তাহার মনে হইতেছিল, তপন তাহাকে এত বেশী অসম্মান করিয়াছে যাহা পৃথিবীর কোন মেয়েকে কোন পুরুষ কখনও করে নাই। কিন্তু সন্ধ্যার শীতল বায়ুর স্পর্শে এবং তপনের সুন্দর মুখের মোহমদিরার যাদু-মহিমায় তপতী যেন কিছুটা কোমল হইয়া গেল। তাহাব মনে পড়িল—তপতী যে এখানে আসিয়াছে ইহা তপন তত জানে না। অনাত্মীয়া মনে করা তাহার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আজ দীর্ঘ সাত মাস তপন একই বাড়িতে তপতীর সহিত বাস করিতেছে, এতকালেও কি সে তাহাকে চেনে নাই? নিজে তপন মুখ ফিরাইয়া থাকে, চোখে ঠুলি পরে, তথাপি তপতীর তাহাকে চিনিতে ভুল হইল না; আর তপন তাহাকে অত কাছে দেখিয়াও চিনিল না। তপন নিশ্চয়ই তাহাকে ঠকাইয়াছে। এইভাবে তপতীকে অপমানিত করিয়া সে তপতীর অপমানের শোধ লইল। কিন্তু তাহার ব্যবহারে তো সেরূপ মনে হইল না!
এই মুহূর্তে তপতীর মনে প্রশ্ন জাগিল, তপন তাহাকে অনাত্মীয় বলায় সে ক্ষুন্ন হইয়াছে কিম্বা অপমানিত বোধ করিতেছে। তপতীর পিতার অন্নদাস একটা দরিদ্র ভিক্ষুক—তপতীর আত্মীয়তাকে অস্বীকার করিবার শক্তি তপন পাইবে কোথায়? কোন সাহসে? বিবাহের বন্ধনগ্রন্থী আধুনিক কালে এমন কিছুই জটিল নয়, যাহা খুলিতে তপতীর খুব বেশী আটকাইতে পারে। কিন্তু কেন তবে লোকটা তপতীকে অপমান করিল? সে কি সত্যই তবে তপতীকে চেনে নাই? না চেনাই সম্ভব। এমন অস্থিরভাবে গাড়ী হইতে না নামিয়া আসিলেই ভাল হইত। বলিল যে, অনাত্মীয়া মেয়ের পাশে বসেনা। আচ্ছা পরীক্ষা করিতে হইবে। অনাত্মীয় মেয়ে বসিতে আহ্বান করিলেও বসিবে না, এমন সুদুঃসহ গোঁড়ামির মূল কোথায় তপতী তাহা দেখিয়া লইবে।
হোটেলে আসিয়াই তপতী আবদার ধরিল, কাল বৃন্দাবন যাইবে। তপতীর অনুরোধ আদেশেরই নামান্তর। সকলে হোটেলের দুইখানা কার লইয়া সকলে বৃন্দাবন যাত্রা করিল। সেই বৃন্দাবন, যেখানে বংশীরবে যমুনা বহিত উজান; বাঁধনহারা ব্রজগোপিগণ ছুটিয়া আসিত কোন অন্তর প্রেমসাগরে আত্মবিসর্জন করিতে—কালো কৃষ্ণ যেখানে কালাতীত হইয়াছে, প্রেমের আলোয়। সারাদিন, শ্যামকুঞ্জ, রাধাকুঞ্জ দর্শনে কাটিল। গৌরাঙ্গ কোনো পুরুষ দেখলেই তপতীর মনে হয়, ঐ বুঝি তপন! কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙ্গিয়া যায়। তপনকে কোথাও দেখা যাইতেছে না! তবে কি সে আসে নাই! তপতীকে অপমান করিয়া ফিরিয়া গেল নাকি? তপতী চতুর্দিকে অন্বেষণ করে। মিঃ ব্যানার্জি এবং মিঃ সান্যালও তপনকে খুঁজিতেছেন। তাঁহাদের মনে একটা আশা জাগিতেছে, তপনকে কোনো একটা বিশ্রী পরিস্থিতির মধ্যে দেখাইয়া দিতে পারিলেই তপতীর অন্তর হইতে তাহাকে চিরনির্বাসিত করা যাইবে। কোন একটা ব্রজাঙ্গনার সঙ্গে যদি তপনকে দেখা যায় তবে এখনই প্রমাণ হইয়া যায় যে তপন শুধু অর্থলোভীই নয়, অসচ্চরিত্রও। তপনকে না তাড়াইতে পারিলে তাহারা সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিতেছে না।
বহুস্থান ঘুরিয়া সকলেই প্রায় ক্লান্ত হইয়া বাসায় ফিরিতেছে,একটা স্থানে কতকগুলি লোক জটলা করিতেছে দেখিয়া তপতীর দল গাড়ী থামাইল। এক বাঙালী ভদ্রলোক একটি পাখি কিনিতে চান; তিনি কহিলেন,—আমি দুটাকা দেবোতৎক্ষণাৎ অন্যদিকে যে উত্তর দিল সবিস্ময়ে চাহিয়া তপতীর দল দেখিল, সে তপন;-বলিল, আমি চার টাকা দিচ্ছি! তপনের পরিহিত পোশাক ধূলিমলিন, গায়ে এত ধুলা লাগিয়াছে যে প্রায় চেনা যায় না। সারাদিন রোদে ঘুরিয়া মুখকান্তি মলিন এবং অসুন্দর হইয়া উঠিয়াছে, ঐ ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখশ্রীকে তাহার অঞ্চল দিয়া মুছাইয়া দিতে ইচ্ছা করিতেছিল! তপন বলিল,–দাও পাখিটা। সে চারটা টাকা দিয়া পাখিওয়ালার নিকট হইতে পাখিটা লইল। একটু বয়স্ক হইলেও ভারী সুন্দর রং প৭িটার। ধরা পড়িয়া মুক্তির জন্য পাখিটা করুণভাবে কাঁদিতেছে আর ডানা ঝাপটাইতেছে। তপতীর ইচ্ছা করিতেছিল, তপনের হাত হইতে সে এখনি উহা লইয়া আসে, কিন্তু সঙ্গীদের মধ্যে মিঃ ব্যানার্জি ও মিঃ সান্যাল ছাড়া কেহই তপনকে চেনে না। তাহারা কি ভাবিবে। তারপর ঐ নিতান্ত কদর্য্য পোশাক-পরিহিত দরিদ্রমূর্তিকে তপতী স্বামী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে না। সে থামিয়া গেল।
প্রথমে যে ভদ্রলোক পাখিটি কিনিতে চাহিয়াছিলেন, তিনি শুল্কমুখে কহিলেন,অতবড় বুড়ো পাখি, পোষ মানবে না মনে হচ্ছে
–ঠিক মানবে। এই দেখুন না—বলিয়া তপন পাখিটাকে মুক্ত আকাশে উড়াইয়া দিয়া হাসিয়া কহিল, মুক্তির মধ্যেই প্রেমের বন্ধন দৃঢ়তর হয়।
–করলেন কি মশাই! বলিয়া একজন চীকার করিয়া উঠিলেন।
–ওকে ভালবাসি কিনা, তাই মুক্তি দিলাম-বলিয়াই তপন চলিয়া গেল। চোখের জল লুকাইবার জন্য তপতী তখন ঘাড় হেঁট করিয়া বসিয়াছে। মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন,—আমাদের দেখে কি রকম অভিনয়টা করলো।
জলভরা চোখে তপতীর রোষবহ্নি গজিয়া উঠিল,–থামুন! যথাযোগ্য স্থানে যথাযোগ্য কথার ব্যবহারের যোগ্যতা পৃথিবীতে কম অভিনেতারই থাকে। ও যদি অভিনেতা হয় তো, আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি–ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।
গাড়ীস্থ সকলেই একমুহূর্তে স্তব্ধ হইয়া গেল তপতীর কথা শুনিয়া।
তপতীর সারা অন্তরখানি স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে ছাইয়া গেছে। গাড়ীতে সারা পথ সে বিশেষ কিছু কথা বলে নাই, সর্বক্ষণ তপনের কথা ভাবিয়াছে আর বিস্মিত হইয়াছে। যে মানুষ অর্থ বাঁচাইবার জন্য থার্ডক্লাসে দূর পথের যাত্রী হয়, মুটে খরচের ভয়ে স্বয়ং বাক্স-বিছানা বহন করে; পোষাকের কদৰ্য্যতায় পর্যন্ত যাহার কৃপণতা পরিস্ফুট—সেই কিনা দুই টাকার পাখি চার টাকা দিয়া কিনিয়া আকাশে উড়াইয়া দেয়, আবার বলে ওকে ভালবাসি, তাই উড়াইয়া দিলাম। ইহা অপেক্ষা মানবতার প্রকৃষ্টতম পরিচয় আর কি হইতে পারে? মিঃ ব্যানার্জি বলেন, উহা তপনের অভিনয়।হউক উহা অভিনয়, তথাপি আজ প্রেমের শ্রেষ্ঠতম তীর্থ শ্রীবৃন্দাবনে প্রেমের যে নবীনতম বাণী তপনের মুখে শুনিয়াছে, তাহা তপতীর জীবনকে পরিপূর্ণ করিয়া দিতে পারিবে। আর অভিনয়ইবা হইবে কেন? তপন তো জানিত না তাহারা ওখানে দাঁড়াইয়া আছে। তপতী স্থির করিল, তপনকে লইয়া সে একবার অভিনয় করিবে। প্রেমের অভিনয়।
পরদিন বিকালে হাওড়ায় গাড়ী থামিলে তপতী নিজের গাড়ীতে চড়িয়া বাড়ি ফিরিল! মা তাহাকে দেখিয়া প্রশ্ন করিলেন,তপন নামেনি খুকী? ওরও তো নামবার কথা এই ট্রেনে।
–নেমেছে, আমি দেখা না করে চলে এসেছি। ও আসছে ঘোড়ার গাড়ীতে, আমার যাওয়ার কথা ওকে বলোনো মা তুমি বরং ওকে জিজ্ঞাসা করো থার্ডক্লাসে কেন ও যায়?
তপতী স্নান করিতে চলিয়া গেল। স্নানাদি সেরে সে আবার আসিয়া বসিল এমন স্থানে যেখান হইতে মার সহিত পনের কথা শুনা যাইতে পারে।
তপন ফিরিয়া আসিল একটা ফিটনে। মা বলিয়া ডাকিতেই মা ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। তপনের মূর্তি দেখিয়া দুঃখে তাহার অন্তর ফাটিয়া যাইতেছে। আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন,–কী চেহারাই করেছ বাবা। মাথায় এত ধূলো যে ধান চাষ করা চলে–
সুমিষ্ট হাসিতে ঘরখানা পূর্ণ হইয়া গেল। তপনের হাসির আওয়াজ যে এত মিষ্টি তপতী তাহা কোনদিন জানে না। তপন কহিল,—মাথাটা তাহলে ধান চাষের যোগ্য হয়েছে মা! ধানের জমি সব থেকে দামী।
মা আরো ব্যথিত হইয়া কহিলেন, রাখো বাবা, তোমার হাসি দেখে আমার রাগ বাড়ছে। থার্ড ক্লাসে কেন তুমি যাবে, বলো তো?
কোটটা খুলিয়া কামিজের বোতাম খুলিতে খুলিতে তপন জবাব দিল,—কেন মা থার্ডক্লাসে তো মানুষই যায়—গরু ছাগল তো যায় না!
মা এবার হাসিয়া ফেলিলেন; বলিলেন,—কিন্তু ফার্স্ট ক্লাসেও যায় মানুষ–
–সে বড় মানুষ। আপনার ছেলে তো বড়মানুষ নয়, মা! গরীব ছেলে আপনার–
-না বাবা, না। ওরকম করো না তুমি। মার মনে দুঃখ দিতে নাই, জান তো?
-দুঃখ কেন পাবেন, মা? আপনার সক্ষম ছেলে যে-কোনো অবস্থায় নিজেকে চালিয়ে নিতে পারে—এ তো আপনার সুখেরই কারণ হওয়া উচিত?
কিন্তু আমাদের ক্ষমতা যখন আছে, বাবা-তখন ফার্স্ট-ক্লাসেই–
বাধা দিয়া তপন বলিল,–ক্ষমতার সংযত ব্যবহারটাই মানুষের শিক্ষণীয় বিষয় মা।এতেই তার মহিমা বাড়ে! মানুষের অক্ষমতাকে ভেংচিয়ে ক্ষমতার জাহির নাইবা করলাম?
তপন স্নানাগারে ঢুকিল। মা তপনের কথা কয়টি আপনার মনে পুনরাবৃত্তি করিয়া বাহিরে আসিলেন। তপতী বিহ্বল দৃষ্টিতে মাঠের পানে তাকাইয়া আছে। সস্নেহে মা ডাকিলেন,–আয় খুকী, খেয়ে নে কিছু।
—আসছি বলিয়া তপতী আপনার ঘরে চলিয়া গেল। তপনের কথা বলার আশ্চৰ্য্য ভাঙ্গিটি আজ তপতীকে যেন ভাঙ্গিয়া গড়িতেছে। এই সুকুমার দর্শন যুবকটি মুখ, উহাকে তপতী উৎপীড়িত করিয়াছে, অপমানিত করিয়াছে,অতিষ্ঠ করিয়াছে,—তথাপি সে যায় নাই! কিন্তু কেন যায় নাই, সে কথা ভাবিতে গিয়াই তপতী আর একবার শিহরিয়া উঠিল। সত্যই কি তপন অর্থলোভী? সত্যই কি সে তপতীর জন্য এত অত্যাচার সহ্য করে নাই, তুচ্ছ অর্থের জন্যই করিয়াছে? ভাবিতে ভাবিতে তপতীর অন্তর ব্যথায় টন্ করিয়া উঠিল। হে ঈশ্বর! যদি তপতী কখনও তোমায় ডাকিয়া থাকে, তবে বলিয়া দাও তপতীর জন্যই তপন এত অপমান নীরবে সহ্য করিয়াছে। এইটাই যেন সত্য হয় তপতী তাহার জীবনে আর কিছুই তোমার নিকট চাহিবে না।
মায়ের দ্বিতীয় ডাকে ক্লান্ত তপতী যখন খাইতে আসিল, তখনও তাহার চোখের পাতা ভিজিয়া রহিয়াছে। মা ব্যাকুল হইয়া বলিলেন,—কি হল রে, মা! কাদছিস?
অনেক তীর্থ ঘুরে এলাম মা, ঠাকুরদার সঙ্গে সেই গিয়েছিলাম। আজ তিনি নাইবলিতে বলিতে তপতী অজস্র ধারায় কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিল। বি এ. পড়া শিক্ষিত মেয়ের এরূপ অসাধারণ দুর্বলতা দেখিয়া মা বিস্মিত হইলেন, কিন্তু আনন্দিত হইলেন ততোধিক। তপতী আবার তাহার পূর্বের তপতীর মতোই হইয়া উঠিতেছে? চোখের জলে মানুষের মনের ময়লা ধুইয়া যায়—তপতী আবার সুন্দর হইয়া উঠুক, তাহার তপতী নাম সার্থক হোক!
মায়ের কল্যাণাশীষের স্পর্শে তপতীর অন্তর সেদিন জুড়াইয়া গেল।