০৬. ডা. ভ্যানার মেসেজ

০৬.

ডা. ভ্যানা কোনো মেসেজ দিয়ে গেছে কিনা সেটা দেখতে হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে খোঁজ নিল স্যাম ও রেমি। ক্লার্ক ওদেরকে একটা মেসেজ স্লিপ ধরিয়ে দিল।

কাজ হয়েছে দেখা যায়, নোটটা পড়তে পড়তে বলল স্যাম। লিও আগামীকাল সকাল ছ’টায় আমাদেরকে নিতে আসবে।’

‘কুমীর ভর্তি জলাভূমিতে ডাইভ দিতে আমার কেমন যেন লাগছে,’ রেমি বলল।

ভুল বললে ওটা জলাভূমি নয় আর কুমীর তো মাত্র একটা ছিল।’

‘আচ্ছা, পানির নিচে যদি কুমীর আক্রমণ করে তাহলে ঠিক কী উপায়ে আত্মরক্ষা করতে হয়? হাঙ্গর থেকে বাঁচার জন্য যে-রকম কায়দা ব্যবহার করা হয় সেরকম নাকি?

“চিন্তার কিছু নেই! কুমীর থেকে বাঁচার কায়দা আমার জানা আছে।’

‘ভাল। তো তোমাকে যখন একটা কুমীর আক্রমণ করবে তখন কী করবে শুনি?

এটা কোনো ব্যাপার হলো!’ স্যাম বলল। আমি দ্রুতগতিতে সাঁতার কাটতে পারি।

কুমীরের চেয়ে দ্রুত সাঁতার কাটাতে পার না নিণ্ডয়ই?’

 ‘তা ঠিক। কিন্তু যা পারি তাতেই যথেষ্ট। হাসল স্যাম। গতিতে তোমাকে হারাতে পারলেই চলবে।

পাল্টা হাসি দিল রেমি। ফাজিল।

‘নোনাপানির কুমীররা কম নড়াচড়া করে। সে-হিসেবে আমরা যেখানে ডাইভ দিতে যাচ্ছি সেখানে ওদের হানা দেয়ার সম্ভাবনা নেই। নিরাপদ থাকব আমরা। তারপরও চোখ-কান খোলা রাখব। সাবধানের মার নেই।’

 ‘প্রার্থনা করি, কেউ কুমীরদেরকে গিয়ে বলে আসুক, ওরা যেন আমাদের ডাইভিং এরিয়ায় হাজির না হয়।’

কাদায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া একটা সিলভার মিতসুবিশি নিয়ে হাজির হলো ডাক্তার ভ্যানা। স্যাম আর রেমি পেছনের সিটে গিয়ে বসে সিটবেল্ট বেধে নিল। সন্ধ্যা নামছে। বৃষ্টি থেমে গেলেও রাস্তার অনেক জায়গায় পানি জমে আছে এখনও। খানা-খন্দ দেখে খুব সাবধানে ডা. ভ্যান গাড়ি চালাচ্ছে।

‘আশা করি, আপনারা সামুদ্রিক খাবার পছন্দ করেন। এই দ্বীপে খুব ভাল পাওয়া যায় ওগুলো! একদম তরতাজা টাটকা, যদিও সৌন্দর্যের বিচারে একটু ঘাটতে আছে। তবে বিশ বছর ধরে এখানে সামুদ্রিক খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। ভাল তো হবেই।’

‘একদম, রেমি বলল। সামুদ্রিক খাবার আমার পছন্দ।

 ‘আমারও। একমত হলো স্যাম।

রেস্টুরেন্টের বাইরের কাঠের দেয়ালের রং নীল। তবে সময়ের বিবর্তনে সেটা ঝাপসা নীল হয়ে গেছে। দরজার উপরে সাদামাটা হস্তাক্ষরে রেস্টুরেন্টের নাম লেখা: Eleanor’s.

‘এটার মালিক একজন মহিলা। তাঁর হাতে জাদু আছে! দারুণ সব রেসিপি করে। যা তৈরি করে সবই ভাল। কোনোটাতেই আপনাদের অরুচি হবে না। ভ্যানা ওদেরকে নিশ্চিত করল।

বাইরের মতো ভেতরেও একই দশা। একদম সাদামাটা। তবে রান্নাঘর থেকে দারুণ সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। স্থানীয় লোকজন খাবার খাচ্ছে ডাইনিং এরিয়ায়। পেছনের দিকে থাকা এক টেবিলের দিকে এগোল ভ্যানা। কয়লার মতো কালো দেখতে একজন হৃষ্টপুষ্ট লোক স্যুট-টাই পরে বসে রয়েছে। ভ্যানাদেরকে দেখে হাসল সে। ওরা এগিয়ে আসতেই উঠে দাঁড়াল স্যুট পরা ব্যক্তিটি। সে এতই লম্বা যে আর একটু হলেই রেস্টুরেন্টের ছাদে গিয়ে তার মাথা ঠেকতো। ভ্যানা পরিচয় করিয়ে দিল।

‘স্যাম ফারগো ও রেমি ফারগো… ও হচ্ছে অরউন ম্যানচেস্টার। অরউন। এখানকার একজন খাঁটি সেলিব্রেটি। আমাদের সংসদে টিকে যাওয়া কয়েকজন সদস্যের মাঝে ও একজন।

 ‘ধন্যবাদ, ভ্যানা। খুব ভাল বলতে পারো তুমি। তোমার তো সরকারের হয়ে কাজ করা উচিত। ভাল করতে পারবে।’ বলল ম্যানচেস্টার। তার কণ্ঠস্বর বেশ ভরাট। তবে রসিক বলে মনে হলো। “Halo olkata,” স্থানীয় ভাষায় অভিবাদন জানাল সে। তার সাথে রেমি হাত মিলালো। ম্যানচেস্টারের হাত রেমির হাতের চেয়ে সাইজে দ্বিগুণ বড়। স্যামও হাত মিলালো। খেয়াল করল অরউন তার হাতের ব্যাপারে বেশ সচেতন। অতিথিদের হাতে যাতে বাড়তি চাপ না পড়ে সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন করছে।

 ‘হয়েছে। এত বিনয় তোমাকে মানায় না, অরউন। তুমি সলোমন আইল্যান্ডের আইকন ব্যক্তিত্ব। বলল ভ্যানা।

‘আমার ভাগ্যটা ভাল। ম্যানচেস্টার মাপা হাসিতে জবাব দিল। ভাল ডাক্তাররা সবকিছু বাড়িয়ে বলে। আমি এমন একটা পেশায় জড়িত যেটায় কেউ আসতে চায় না। তাই আমার কাজে তেমন প্রতিযোগী নেই, প্রতিযোগিতাও নেই।’

ভ্যানার মতো ম্যানচেস্টারের ইংরেজি উচ্চারণও সুন্দর। বোঝা গেল সে ও অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে পড়ালেখা করেছে। টেবিলের চারপাশে বসল সবাই। ওয়েটার হাজির, হাতে কোনো মেনু নেই। পটপট করে মেনু বলে গেল সে। কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল স্যাম ও রেমি।

বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে ভ্যানা এগিয়ে এলো। যদি আপনারা বিয়ার নিতে চান তাহলে এখানকার সলব্রিউ ভাল হবে। এক বন্ধুর কাছে শুনেছি ড্রিঙ্কসকে ঠাণ্ডা রাখার বিশেষ ব্যবস্থা আছে এদের। আর এখানে কিন্তু ভাল সোডাও পাওয়া যায়।

একটা কোলা চাইল রেমি! ম্যানচেস্টার আর স্যাম বিয়ার অর্ডার করল। স্রেফ এক বোতল পানি নিল ভ্যানা, বলল সোডার সাথে ক্যাফেইন আর চিনি খেলে ওর সারারাত ঘুম হবে না। এই দ্বীপের প্রায় কোনো মেয়েই অ্যালকোহল পান করে না। আমাকে এখন যদি কেউ দেখে এখানে বসে অ্যালকোহল খেয়েছি তাহলে পুরো দ্বীপে কানাঘুষা শুরু হয়ে যাবে।’ ভ্যানা বলল। অস্ট্রেলিয়ায় এসব খেতাম। এখানে মিস করি। ঠাণ্ডা বিয়ার আর ভাল ওয়াইন।

 ‘আপনাকে হিংসা করতে পারছি না, ওয়েটার ড্রিঙ্কসের বোতল আর চারটা এক পৃষ্ঠার মেনু দিয়ে যাওয়ার পর বলল স্যাম।

 ‘কপাল ভাল, এই নিয়ম পুরুষদের উপর প্রযোজ্য নয়। চিয়ার্স! ম্যানচেস্টার বোতল তুলে টোস্ট করল। বোতলে বোতলে ঠুকে চুমুক দিল স্যাম। বলল, “ভাল তো। এটা নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে।

‘কোনো বিয়ারই স্যামের খারাপ লাগে না।’ রেমি মেনু পড়তে পড়তে বলল। মেনু আপনিই ঠিক করুন, নাকি?

‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ বলল ভ্যানা। মাথা নেড়ে ম্যানচেস্টার সম্মতি দিল।

পাশের টেবিলের দিকে তাকাল স্যাম। স্থানীয় লোকজন হাত দিয়ে মাছ খাচ্ছে। ম্যানচেস্টার বিষয়টা খেয়াল করে হাসল। হাত দিয়ে খাওয়া এখানকার প্রচলিত রীতি। চিন্তার কিছু নেই। আমাদের টেবিলের সবাই কাঁটা চামচ আর ছুরি ব্যবহার করেই খাবে।

৪ টা টাটকা মাহি মাহি ডিস অর্ডার করল ওরা। ওয়েটার মেনুগুলো নিয়ে ফিরে গেল।

‘আপনারা এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে কাজ করতে এসেছেন, তাই?’ ওয়েটার যাওয়ার পর বলল ভ্যানা।

রেমি মাথা নাড়ল। এক বন্ধুকে সাহায্য করছি।

‘গোয়ালক্যানেলে এসেছেন কবে?’ ম্যানচেস্টার প্রশ্ন করল।

আজ সকালে।

‘প্রথম দিনেই কাহিনি হয়েছে, অরউন। কুমীরের কামড় খাওয়া এক লোককে নিয়ে হাসাপাতালে এসেছিলেন ওরা। সেখানেই পরিচয় হয় আমাদের।’

‘ও খোদা! সত্যি? নাকি মজা করছ?’ বলল ম্যানচেস্টার। সত্যি সত্যি অবাক হয়েছে।

মজা হলে তো ভালই হত। কিন্তু এটাই সত্য।’ স্যাম জানাল। কুমীরকে মেরে ফেলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু অনেক রক্ত ঝরেছে লোকটার।

‘মর্মান্তিক। আমি দুঃখিত, দ্বীপে এসেই আপনাদেরকে এরকম একটা পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। আমরা সাধারণত চেষ্টা করি কুমীর আর অ্যাটনীরা যেন পর্যটকদের কাছ থেকে দূরে থাকে। অন্তত শুরুতে সেরকমটাই করা হতো। এরকম আক্রমণ হলে তো পর্যটন ব্যবসা লাটে উঠবে।’ থামল সে। অ্যাটনী আর কুমীরের মধ্যে পার্থক্য নেই। তবে ভাল অ্যাটনীরা বন্ধুর মতো আচরণ করে।

হেসে উঠল সবাই। ম্যানচেস্টার বলে চলেছে, তাহলে আজকের দিনে দুটো খারাপ ঘটনা ঘটল। এক, কুমীরের আক্রমণ। দুই, রাজনীতিবিদের সাথে ডিনার।

ভ্যানা হাসল। “হোক রাজনীতিবিদ। কিন্তু তুমি তো ভাল রাজনীতিবিদ, তাই না?’ স্যামের দিকে তাকাল ও। অরউন নিজেও একজন অ্যাটনী। তাহলে আপনারা পাচ্ছেন একের ভেতর তিন! হাত বাড়িয়ে ম্যানচেস্টারের হাত চাপড়ে দিল ভ্যানা।

বিয়ারের বোতল শেষ করে ফেলেছে ম্যানচেস্টার। সেজন্য আরেক বোতল খাব। স্যামের দিকে তাকাল সে। মাত্র অর্ধেক বোতল শেষ হয়েছে ওর। ওয়েটারকে ২ আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করল অরউন। স্থানীয় হওয়ায় পিপাসা বেশি, আরকী। স্যামকে দেখে নিল সে। সামনে ঝুঁকে বলল, আক্রমণটা খুব বেশি ভয়াবহ ছিল?

 নাক গলালো ভ্যানা। বেঁচে যাবে, তবে একটা পা কাটা পড়েছে। লোকটির ভাতিজা বলল কুমীরটা নাকি ২০ ফুট লম্বা ছিল। সে হিসেবে ভিকটিম কিন্তু ভাগ্যবান। কুমীর যে তাকে দু’টুকরো করে ফেলেনি এটাই অনেক।

আরেক রাউণ্ড বিয়ার চলে এলো। স্যামের দিকে তাকিয়ে হাসল ম্যানচেস্টার। এই গরমের মধ্যে আপনাকে দ্রুত ড্রিঙ্কস করা শিখতে হবে নইলে ড্রিঙ্কস-ই গরম হয়ে যাবে।

হাসল স্যাম। একটা বালতিতে কিছু বরফের ব্যবস্থা করা গেলে ভাল হত। এমনিতেই আমার ওজন কম তার ওপর কালকে ডাইভ করতে নামৰ। কড়া ড্রিঙ্কস করলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

‘ডাইভ করবেন? পানি নিচে? দারুণ তো। কাহিনি কী? ভ্যানা আর্কিওলজি নিয়ে কী যেন বলল? জানতে চাইল ম্যানচেস্টার। টাটকা বিয়ারের বোতল থেকে বড় করে একটা চুমুক দিল। হাত নেড়ে ওয়েটারকে ডাকল সে। কানে কানে কিছু একটা বলে দিয়ে আবার স্যামের দিকে ফিরল। বুঝলাম না আর্কিওলজির সাথে পানির নিচে ডুব দেয়ার কী সম্পর্ক? অবশ্য কোনোকিছু ডুবে গিয়ে থাকলে ভিন্ন কথা…’।

‘আমাদের বন্ধু ব্যতিক্রমধর্মী কিছু একটা খুঁজে পেয়ে সেটা কী দেখার জন্য আমাদেরকে ডেকে এনেছে।

‘তাই? তাহলে আপনারা প্রত্নতত্ত্ববিদ? আর্কিওলজিস্ট?

 ‘আমরা আর্কিওলজি ভালবাসি।

 ‘বেশ বেশ। আমার কখনও এরকম পেশায় জড়িত হওয়ার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। রেমির প্রশংসা করল ম্যানচেস্টার।

‘পৃথিবী বদলাচ্ছে। চমকের শেষ নেই, ওর হাতে থাকা বিয়ারের বোতলটা টোস্ট করার জন্য তুলল। রাজনীতিবিদকে ভিন্ন প্রসঙ্গে আনার চেষ্টা আরকী।

‘আচ্ছা, সেই ব্যতিক্রমধর্মী” জিনিসটা কী?’ ভ্যানা জানতে চাইল।

‘সেটা জানি না। আমরা এখানে এসেই তো কুমীরের কাহিনিতে জড়িয়ে পড়লাম। জানাল রেমি।

‘যুদ্ধের সময়কার বাতিল কিছু হতে পারে কি? এখানে তো ওসবের অভাব হওয়ার কথা নয়। ম্যানচেস্টার বলল।

হতে পারে।’ বলল স্যাম।

বরফ বোঝাই বালতি নিয়ে ওয়েটার হাজির হলো। ওতে একটা বিয়ারের বোতল রাখল স্যাম। ম্যানচেস্টার ইতিমধ্যে তার প্রথম বোতল শেষ করেছে। দ্বিতীয় বোতলের জন্য ইশারা করল সে।

 ‘আমাদের ব্যাপারে তো অনেক কথা হলো, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য বলল স্যাম। এবার ক্লিনিক সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই।’

ভ্যানা ওর দিকে ঘুরল। পরিকল্পনাটা অনেক পুরানো। প্রথমদিকে ক্লিনিক করার বিষয়টা আমি সরকারের উপর ছেড়ে দিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু সরকার জনগণের টাকা চুষে খেতেই ব্যস্ত। তাই বাধ্য হয়ে নিজেকে নামতে হলো। এখানকার বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ত অথচ কোনো সেবা পেত না। চিকিৎসা করলে বাঁচানো যেত এরকম অনেক মানুষ মারা গেছে। খুব বেশি কিছু যে প্রয়োজন তা-ও নয়। স্রেফ হালকা কিছু সেবা। তাতেই প্রাণ বেঁচে যেত অনেকের। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে এরকম পরিস্থিতি মেনে নেয়া যায় না। কোনোভাবেই নয়। আমাদের জ্ঞান আছে, শুধু অর্থ প্রয়োজন। আর সেই অর্থ দিয়ে আমাদের সম্মানিত দাতাগণ তাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।’

 বাহ্ বেশ। আপনারা কী ইতিমধ্যে অনেক দাতা পেয়েছেন?’ রেমি জানতে চাইল।

বিয়ারের তৃতীয় বোতল সাবাড় করে হেসে উঠল ম্যানচেস্টার। প্রত্যেকটা ওষুধ প্রস্তুককারক কোম্পানীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছিল ও। বিনিময়ে লজ্জা পেয়েছে।’

‘ওখানেই শেষ নয়, ওরউইন। আসল বিষয় হলো, আমাদের এখানকার লোকজনের ব্যাপারে কেউ কোনো তোয়াক্কা করে না। বড় বড় কোম্পানীগুলো চাইলেই কলমের একটা খোঁচায় আমাদের এখানকার অনেক সমস্যার সমাধান করে দিতে পারতো কিন্তু দেয়নি। কারণ আমাদের এই দ্বীপ সেভাবে জনপ্রিয় নয়। পৃথিবীর এক কোণায় পড়ে রয়েছি আমরা। কেউ আমাদের কথা জানে না। তারপরও যা পেয়েছি ওতেই শুকরিয়া। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।

‘আপনাদের এখনও আরও কত অর্থ প্রয়োজন?

‘প্রথম বছরের জন্য আমার টার্গেট ৫ লাখ মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় বছরে ২০ লাখ। তারপর থেকে প্রতি বছর ২০ লাখ মার্কিন ডলার করে চাই। প্রথম বছরের টাকা কিছু ভবন আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করব। মাথা নাড়ল ভ্যানা। কোম্পানীগুলো দাঁত সাদা করার পেস্টের বিজ্ঞাপন দিতে এরচেয়েও বেশি খরচ করে। কিন্তু আমাদেরকে টাকা দিতে চায় না। দ্বীপটা আকর্ষণীয় হলে ঠিকই দিত। তারপরও আমি এপর্যন্ত প্রথম বছরের জন্য দেড় লাখ আর দ্বিতীয় বছরের জন্য ৫০ হাজার ম্যানেজ করতে পেরেছি।’

স্যামের দিকে তাকাল রেমি। স্যামের ঠোঁটে হালকা হাসি দেখা যাচ্ছে। ‘আমরা বিষয়টা বিবেচনায় রাখলাম। আপনাদের কোনো রূপরেখা আছে?  বাজেট লেখা আছে কোনো?’

“অবশ্যই। পুরোটাই প্রেজেন্টেশন আকারে রেডি আছে।

 ‘আমরা কি একটা কপি পেতে পারি? রেমি প্রশ্ন করল।

অবশ্যই। আপনাদেরকে একটা কপি দিতে পারলে আমিও খুশি হব। আপনারা তাহলে সত্যিই এখানকার ক্লিনিকের জন্য দান করতে আগ্রহী? জানতে চাইল ভ্যানা। ওর কণ্ঠস্বরে চাপা উত্তেজনা।

স্যাম বিয়ার খাওয়া শেষ করেছে। কথা দিচ্ছি না। আগে দেখি, তারপর বলব।

মাছের ডিশ হাজির। খাবারের উপর প্রথম হামলা করল ম্যানচেস্টার। ওর হামলে পড়া দেখে যে-কেউই বুঝতে পারবে এই লোক বেজায় ভোজন রসিক। কোনো খাবারে এর অরুচি নেই। মাছ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই চুপ। খাওয়া শেষে পেছনে হেলান দিল স্যাম। ‘দারুণ তো। মাছগুলোকে বোধহয় মাত্র ধরে এনেছে। একদম টাটকা।

মাথা নেড়ে সায় দিল ভ্যানা। কয়েক ঘণ্টা আগে হয়তো এনেছে। সৌভাগ্যবশত এখানে প্রচুর সামুদ্রিক খাবার পাওয়া যায়। কোনো কমতি নেই। এই একটা দিকে আমরা ভাগ্যবান।

 এখানে অনেক খনিজ পদার্থও আছে। কিন্তু উপযুক্ত প্রযুক্তি ও লোকবলের অভাবে আমরা ওগুলোকে মাটির নিচ থেকে তুলতে পারছি না। তিক্ত কণ্ঠে বলল ম্যানচেস্টার।

‘তাই?’ স্যাম প্রশ্ন করল। কীরকম খনিজ পদার্থ আছে?’

‘তেল, ভাই। তেল। কত তেল চাই আপনার? তাছাড়া সোনা, পান্না, রুবিসহ আরও অনেক কিছুই আছে। সৌদির চুতিয়া বাদশাগুলোর চেয়েও আমরা ধনী হতে পারতাম। কিন্তু কপাল দোষে আমরা নিজেরাই নিজেদের পেছনে বাঁশ দেয়ার জন্য ছুটে মরছি।’

‘এই তো ভাষণ শুরু হলো।’ মন্তব্য করল ভ্যানা। ওয়েটার এসে ইতিমধ্যে টেবিল থেকে প্লেটগুলো সরিয়ে ফেলেছে।

ইতিহাস বলে, আমাদের এখানে বিদেশিরা এসে ইচ্ছেমতো লুটপাট করে গেছে। আচ্ছা, আপনি আমাদের ইতিহাস কতখানি জানেন?’ ম্যানচেস্টার বলল।

‘বেশি কিছু না।’ জবাব দিল স্যাম।

‘অনেক বছর আমরা ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম। তারপর জাপানীরা দ্বীপের দখল নিয়ে নিয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আবার ব্রিটিশদের হাতে গিয়ে পড়েছিলাম আমরা। ফুটবলের মতো একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক… এভাবে আমাদেরকে লাখানো হয়েছিল। কোনো স্বকীয়তা, সার্বভৌমত্ব ছিল না। সবসময় কারও না কারও অধীনে ছিলাম।’ ফাটা হাসি দিল ম্যানচেস্টার। ভাগ্যের ফের দেখুন… কাড়ি কাড়ি প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বসে থেকেও আমরা সবাই গরীব। এরকম করুণ কাহিনি আপনি দুনিয়ার আর কোথাও পাবেন না।’

হাঁপ ছাড়ল ভ্যানা। এই একই ভাষণ ও এরআগে বহুবার শুনেছে। এরপর ও সোনার খনি নিয়ে কথা বলবে, আমি জানি।

‘আচ্ছা, তাহলে এখানে এখনও সোনা আছে? জানতে চাইল রেমি।

 ‘অবশ্যই আছে। কিন্তু এখানকার লোকদের হাবভাবে সেটা মনেই হচ্ছে না, তাই তো? আর ভ্যানা তো ইতিমধ্যে আমাদের সরকার ব্যবস্থার বেহাল দশা সম্পর্কে বলেই দিয়েছে। জনগণ সন্তষ্ট না হওয়ায় নিয়মিত সরকার পরিবর্তন হয়। তাই রাজনীতিবিদদের মূল লক্ষ্য থাকে কীভাবে মেরে কেটে নিজের পকেট বোঝাই করবে। এটাকে একধরনের দুষ্ট চক্র বলতে পারেন। তবে একমাত্র আমিই টানা ২০ বছর যাবত টিকে আছি।’

ম্যানচেস্টারের দিকে তাকাল ভ্যানা। এখানে যদি একজন ভাল মানুষ থেকে থাকে তাহলে সেটা অরউন। আমাদের গোয়াডালক্যানেলে অনেক রকম সমস্যা আছে ঠিকই, কিন্তু এখানকার জনগণের মনটা বড়।

বিয়ারের বোতল খালি করল ম্যানচেস্টার। কুমীরও বড়। ওদের একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’

আলোচনার গতি কমে গেছে। একদম মোক্ষম সময়ে ভ্যানা উপযুক্ত প্রসঙ্গ টানল। কিছু বিষয় স্বীকার করে নেয়া দরকার। আমি আপনাদের দুজনের কাছে পুরোপুরি সৎ থাকতে চাই।’ নিচু স্বরে বলল সে।

 ‘তাই?’ ভ্রূ উঁচু করে রেমি প্রশ্ন করল।

 ‘হ্যাঁ। ঘাটাঘাটি করার অভ্যাস আছে আমার। পোশাক বদলাতে বাসায় গিয়ে স্যাম আর রেমি ফারগো লিখে গুগলে সার্চ করেছিলাম। বুঝতেই তো পারছেন আপনাদের ব্যাপারে কী কী জেনেছি।

স্যামকে অপ্রস্তুত দেখাল। ইন্টারনেটে যা পড়া হয় তার সবকিছু বিশ্বাস করা যায় না।

হয়তো।’ ম্যানচেস্টারের দিকে তাকাল ভ্যানা। অরউন, তুমি কিন্তু এখন সেলিব্রিটিদের সাথে বসে আছ! স্যাম আর রেমি হলেন স্বনামধন্য ট্রেজার হান্টার। গুপ্তধন খুঁজে বের করার কাজে ওনাদের অনেক সুনাম আছে।’

ম্যানচেস্টারের মুখ দেখে মনে হলো কেউ বোধহয় ওর মুখে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। ট্রেজার হান্টার?

মিডিয়ার কাজই এই। সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি। বিনয় দেখাল রেমি। ‘আমরা সৌভাগ্যবান বেশকিছু উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের সন্ধান বের করতে সক্ষম হয়েছি। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক অনেক প্রজেক্ট পরবর্তীতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শনের হদিস পাইয়ে দিয়েছে। তবে ট্রেজার হান্টার মানে এই না যে, আমরা গুপ্তধন উদ্ধার করে নিজেরা নিয়ে নিই। যা কিছু উদ্ধার করা হয় সব বুঝিয়ে দেয়া হয় উপযুক্ত মালিককে, যাতে সেগুলো বিভিন্ন দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করা যায় ও তাদের অবস্থান পরিবর্তন হয়।

 ‘একদম ঠিক। কিন্তু পত্রিকায় অনেক কিছু বানিয়ে বানিয়ে লেখে। ওদেরও তো পেট চালাতে হবে নাকি!’ স্যাম বলল।

‘বুঝেছি, ফারগো দম্পতি গুপ্তধন উদ্ধারের পাশাপাশি অনেক বিনয়ী। বলল ভ্যানা। অরউন, ইনারা স্বামী-স্ত্রী মিলে যত গুপ্তধন উদ্ধার করেছেন পৃথিবীর আর কেউ অতটুকু, করতে পারেনি। অথচ এদের সরল কথাবার্তা শুনে কিছু বোঝার উপায় নেই।

স্যাম হাত নাড়ল। দুনিয়ার লোকজন এসব গুপ্তধনের পেছনে ছোটার চেয়ে আরও ভাল কাজ করছে। এসব করা খুব একটা কাজের কাজ নয়।’

 ‘আচ্ছা, আপনারা যেন কোথায় ডাইভ করতে যাচ্ছেন বললেন?’ প্রশ্ন করল ম্যানচেস্টার। তার বলার ধরন পুরোপুরি ভদ্র ও সভ্য কিন্তু তারপরও একটু শীতলভাব টের পাওয়া গেল।

সুন্দর করে হাসি দিল রেমি। আমরা এখনও জায়গায় নাম বলিনি। আসলে এটা আমাদের বন্ধুর প্রজেক্ট। তাই বেশিকিছু বলা সম্ভব নয়। তবে আমি আপনাকে এতটুকু নিশ্চিত করতে পারি এই প্রজেক্টের সাথে গুপ্তধনের কোনো সম্পর্ক নেই।

 ম্যানচেস্টারের চোখ সরু হয়ে গেল। দ্বীপটা অনেক ছোট, বুঝলেন। আমি নিশ্চিত ইতিমধ্যে সবাই কুমীরের ঘটনাটা জেনে গেছে। এখানে গোপন বিষয় বেশিক্ষণ গোপন থাকে না।

তা হতে পারে। কিন্তু বন্ধুর ইচ্ছের প্রতি সম্মান দেখানোটাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের বন্ধু একজন প্রফেসর, এই বিষয়গুলো ওর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বুঝিয়ে বলল রেমি।

 ম্যানচেস্টার মাথা নাড়ল। বুঝতে পেরেছি। ভাবলাম, প্রজেক্টের ব্যাপারে আমি আপনাদের হয়তো কোনো কাজে আসব। অনুমতি-টনুমতির ব্যাপারে কিংবা অন্য কোনো কিছুতে…’।

হাই তুলল রেমি। ভ্যানা রেমির ইশারা বুঝতে পেরে ওয়েটারকে বিল আনতে ইশারা করল। ওয়েটার বিল আনতেই সেটাকে চট করে হাতে তুলে নিল স্যাম। ভ্যানা চেকটা নিতে যাচ্ছিল কিন্তু স্যাম ওর আগেই নিয়ে ফেলেছে। প্লিজ, আজকে ডিনারের বিলটা আমাদেরকে দিতে দিন। শেষ কবে এত সুস্বাদু মাছ খেয়েছি মনে করতে পারছি না। বিল দিয়ে তৃপ্তির ষোলকলা পূর্ণ করতে চাই।’

ভ্যানার চোখ দুটো চকচক করে উঠল, হাসল সে। বাহ্। খুব ভাল। আশা করা যায়, এভাবে আপনি আমাদের এখানকার মানুষদের জন্যও কিছু করবেন।’

 ‘ধুর! যদি জানতাম বিলটা অন্য কেউ দেবে তাহলে আরও কয়েক বোতল বিয়ার খেতাম!’ অট্টহাসি দিল ম্যানচেস্টার।

 ডিনার শেষে স্যাম ও রেমিকে হোটেলে নামিয়ে দিল ভ্যানা। ক্লিনিকের প্ল্যান ই-মেইল করে পাঠাবে বলে কথা দিল। ফারগো দম্পতির কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে রওনা হলো হাসপাতালের দিকে। ওখানে ওর অসুস্থ রোগীরা সেবার অপেক্ষায় রয়েছে।

ম্যানচেস্টার একটা চিজ, কি বলো?’ বলল স্যাম।

তা আর বলতে। আচ্ছা, তাকে রাগী দেখাচ্ছিল, তাই না? ঠাণ্ডা রাগ।

হু, তবে আমি তাকে দোষ দিতে পারছি না। লোকটা অনেক চাপে থাকে। এক পা এগোয় তো পরিস্থিতি তাকে দুই পা পিছিয়ে দেয়।

 ‘যদি সে সবকিছু সত্য বলে থাকে তাহলে তোমার সহানুভূতি ঠিক আছে। তবে আমার সাথে সে যেভাবে কথা বলছিল তাতে কিন্তু ওরকমটা মনে হয়নি।

.

০৭.

স্যাম ও রেমিকে গাড়িতে তুলে নিল লিও। গাড়ির পেছনের অংশে দুটো ডাইভিং সট আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে। লিও-কে দেখে মনে হচ্ছে গতরাতে খুব ধকল গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। দুই দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে লবণ, ময়লায় মাখামাখি আর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে।

‘গুড মর্নিং, বন্ধু,’ লিওর উপর নজর বুলিয়ে বলল স্যাম! কী অবস্থা?

লিও ফাটা হাসি দিল। আর বোলো না।’

‘ক্রু যোগাড় করতে পেরেছ?

সাগরের পাড়ে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। গতকালের চেয়ে আজ দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিতে হবে ওদের। আশা করা যায়, আসবে।

হাতঘড়ি দেখল স্যাম। ব্যাকপ্যাক থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করল। দু’বার রিং হওয়ার পর ফোন ধরল সেলমা।

‘গুড মর্নিং, সেলমা।

‘আফটারনুন। এখানে বিকেল। ৬ ঘন্টার পার্থক্য আছে। অবশ্য আরও সঠিক করে বলতে গেলে তোমরা এগিয়ে আছে। তাহলে পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ১৮ ঘন্টার।

‘একদম ঠিক বলেছ। আচ্ছা, কোনো জাহাজের খোঁজ পেলে?

‘আমাদের ভাগ্য ভাল। অস্ট্রেলিয়া থেকে একটা জাহাজ আসছে। অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে ওটা আর ওখানে থাকতে পারবে না। আবহাওয়া সুবিধের নয়। আর হ্যাঁ, সত্যি কথা বলতে ওটা জাহাজ নয়। ১০০ ফুট দীর্ঘ অভিযানমূলক ইয়ট। গতি সর্বসাকুল্যে ১২ নট।

‘দারুণ খবর।

‘ওটা গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে রিসার্চ করছিল। যে ইন্সটিটিউট ইয়টটার মালিক তাদেরকে বলে তোমাদের কাজের জন্য একটা সাইড ট্রিপের ব্যবস্থা করেছি।

‘হু, সাইড ট্রিপ বটে।

‘আচ্ছা, গোয়াডালক্যানেলে তোমাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে? আমি তো শুনেছি জায়গাটা নাকি খুবই সুন্দর।

স্যাম ওকে কুমীরের আক্রমণের ঘটনা বলল। সব শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ রইল সেলমা।

 ‘ভয়াবহ ঘটনা। তোমরা এখনও ওখানে কী করছ? নিরাপদ কোথাও চলে যাচ্ছ না কেন?

‘আমি রেমিকে প্রতিনিয়ত বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি, আমাকে এসব থেকে রেহাই দাও। এবার অবসর নিই। কিন্তু সে কী আর আমার কথা শোনে!’ বলতে বলতে রিয়ারভিউ আয়না দিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল স্যাম। দেখল, রেমি আপত্তিসূচক মাথা নাড়ছে।

‘ইয়ট তোমাদের ওখানে পৌঁছতে আরও তিন-চারদিন লাগতে পারে। ততদিন পর্যন্ত নিজেদেরকে নিরাপদে রাখো আর অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকো। ভুলেও কুমীরদের ধারে কাছে যেয়ো না। কুমীর তো আছেই, আমি জেনেছি গ্রেট হোয়াইট শার্কও আছে ওখানে।

‘জেনে খুশি হলাম। আমাদের জন্য দেয়া কোরো।’

ফোন রাখল স্যাম। রেমি ওর দিকে ঝুঁকল। কী বলল, সেলমা?’

বলল, রেমি যেন শার্ক পানচিং (ঘুষি) চর্চা করে।

 রেমির চোখ বড় বড় হয়ে গেল। না!’

‘হা! সেলমা এই এরিয়া নিয়ে গবেষনা করেছে। কুমীরের পাশাপাশি হাঙরও আছে এখানে।

‘তারপরও আমরা আজ পানিতে নামব?”

 শ্রাগ করল স্যাম। কেউ তো আর চিরদিন বাঁচে না।’

লিও’র দিকে তাকাল রেমি। আবার বলো তো শুনি, কেন আমরা এত পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে রাজি হয়েছিলাম?’

বন্ধুর হয়ে স্যাম জবাব দেয়ার চেষ্টা করল। বৈজ্ঞানিক বিষয়ে আগ্রহ, বন্ধুত্ব, নতুন কিছু আবিষ্কার করার রোমাঞ্চ, জ্ঞান আহোরণ ইত্যাদি।

‘ক্লান্তি ও বিরক্তি। এটা বলতে ভুলে গেছ।’ বলল লিও। হেসে উঠল সবাই।

তুমি জানো, ওয়েট স্যুট পরে পানিতে নামলে হাঙরের চোখে আমাদেরকে সীল (একধরনের সামুদ্রিক প্রাণী)-এর মতো দেখাবে? রেমি বলল।

দাঁত বের করে হাসল স্যাম। আমি তো শুনেছি ওয়েট স্যুট খেতে খুব একটা সুস্বাদু নয়। হাঙররা ওয়েট স্যুট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।’

হাঙর নয়। তুমি ভোদরের কথা বলছ।’ সংশোধন করে দিল রেমি।

‘ওহ, আমি বারবার গুলিয়ে ফেলি। তাহলে পানিতে নেমে ভোদরের মতো অভিনয় করতে হবে। তাহলে হয়তো হাঙর এড়িয়ে যাবে আমাদের।

‘পানিতে কুমীর খুব একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না। সমুদ্র কিংবা নদীর পাড়ে কুমীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে।’

‘যেমনটা বেনজির ক্ষেত্রে হয়েছে। বেচারা।’

সাগর পাড়ে ওরা পৌঁছে দেখল নতুন একটা ট্রাক পার্ক করে রাখা আছে। পাম গাছের ছায়ায় অপেক্ষা করছে তিনজন। ওদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। কাছেই একটা নৌকো অলসভঙ্গিতে ভাসছে পানিতে। রোদ পোহাচ্ছে।

চারদিকে ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিল স্যাম ও রেমি। দেখে নিল আশেপাশে কোনো কুমীর ঘাপটি মেরে আছে কিনা। কুমীরের দেখা না পেয়ে ওয়েট স্যুট পরে নিল ওরা দু’জন। নৌকোয় উঠল। নৌকোর ইঞ্জিনের অনেক বয়স হয়েছে। একবার কেশে নিয়ে চালু হল ইঞ্জিন। ক্যাপ্টেনকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে লিও, ওর হাতে একটা জিপিএস রয়েছে।

জায়গামতো পৌঁছুনোর পর ক্যাপ্টেন গতি বন্ধ করে স্রেফ ইঞ্জিন চালু করে রাখল। ওদিকে স্যাম ও রেমি ওদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। লিও হাসিমুখে মাস্ক, রেগুলেটর ইত্যাদি এগিয়ে দিয়ে ওদেরকে সাহায্য করল।

‘পানির তলা এখান থেকে প্রায় ৮০ ফুট নিচে। সবকিছু বেশ পরিষ্কার দেখতে পাবার কথা, ডাইভাররা তো সেরকমটাই জানিয়েছে। তাছাড়া সমুদ্রের পানি এমনিতেও বেশ টলটলে।’

রেগুলেটর বের করল স্যাম। কিন্তু গতকাল ঝড় হয়েছে। বিষয়টা মনে রাখতে হবে। দেখা যাক… কী আছে কপালে।

পিঠ পেছনে দিয়ে নৌকো থেকে ডাইভ দিল রেমি। স্যাম একটা ধাতব ডাইভ মই বেয়ে পানিতে নামল। পানিতে নেমে শুকরিয়া জ্ঞাপন করল স্যাম। পানির তাপমাত্রা বেশ আরামদায়ক। পানির গভীরে ডুব দিল ও। রেমিকে দেখতে পেল, দশ ফুট দূরে রয়েছে, অপেক্ষা করছে ওর জন্য। ওরা দুজন একে অপরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থাম্বস আপ জানাল। ধীরে ধীরে আরও গভীরে যাত্রা করল ওরা। একদম তলায় কী আছে সেটা ওদের বর্তমান অবস্থান থেকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে।

৫০ ফুট নিচে নেমে রেমির কাঁধে টোকা দিল স্যাম। সমুদ্রের তলায় বিশালাকার কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ওদিকে এগোেনোর পর ওরা নিশ্চিত হলো জিনিসটা মানুষের তৈরি। ধ্বংসাবশেষের গায়ে বিভিন্ন সামুদ্রিক শৈবাল জড়িয়ে রয়েছে, তবে আকার-আকৃতি খুব একটা বিকৃত হয়ে যায়নি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এটা কোনো একটা ইমারতের অংশ।

 ইমারতের একদম কাছে পৌঁছুনোর পর পায়ের সাথে লাগানো ডাইভিং নাইফ বের করল স্যাম। রেমি দেখল স্যাম ধীরে ধীরে সব জলজ লতাপাতা আর শৈবালের জঞ্জাল কেটে পরিষ্কার করছে। কাজ সেরে কিছুক্ষণ পর স্যাম পিছিয়ে এলো যাতে রেমি দেখতে পারে।

দুই ব্লকের জোড়মুখ এটা।

হঠাৎ সমুদ্রের তলদেশের কাছ দিয়ে কিছু একটা সাঁতরে গেল। চুপ হয়ে গেল ফারগো দম্পতি। স্যাম তাকিয়ে দেখল ওটা একটা বড় হাঙর। গ্রেট হোয়াইট শার্কের মতো দৈত্যাকার না হলেও যথেষ্ট বড়। প্রায় নয় ফুট দীর্ঘ।

 ওদের দুজনকে মাঝখানে রেখে কয়েক পাক ঘুরল হাঙরটা। কিন্তু আগ্রহী হওয়ার মতে কিছু না পেয়ে অন্যদিকে চলে গেল। মাস্কের ভেতরে রেমির চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। হাঙরকে চলে যেতে দেখে স্যাম নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ও হৃদপিণ্ডে স্পন্দন দু’টোকেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারল। এখানে ওরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে সেটা প্রমাণ হিসেবে এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাই যথেষ্ট। ধ্বংসাবশেষের ভেতর দিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল ওরা। সাঁতরে উপরে ওঠার সময় নির্দিষ্ট স্থানে এসে থামল, দ্রুত উপরে উঠলে ডিকমপ্রেশনে আক্রান্ত হতে হবে। অনাহুত কোনো অতিথি উদয় হয় কিনা সেটা দেখতে চোখ খোলা রেখে সজাগ থাকল ওরা।

ওয়েট স্যুটসহ যাবতীয় সরঞ্জাম খুলে ফেলল নৌকোয় উঠে।

“কী অবস্থা?’ প্রশ্ন করল লিও।

‘নিশ্চিত করে বলা যায়, দালান-কোঠা টাইপের কিছু একটা হবে। তবে বেশ পুরানো।’

মাত্র একবার দেখেই কীভাবে এতটা জোর দিয়ে বলছ?

ব্লকের গঠনশৈলী ব্যাখ্যা করল রেমি। সব শুনে লিও মাথা নাড়ল। তাহলে তোমরা একদম নিশ্চিত?

‘আমরা কিন্তু এরকমটাই সন্দেহ করেছিলাম।

 ‘তুমি ডাইভ দেবে না?’ স্যাম লিওকে প্রশ্ন করল।

মাথা নাড়ল রাশিয়ান। কখনও শিখিনি।’

‘ডাইভিঙের উপর শর্ট কোর্স সেরে নেয়া উচিত তোমার। পানির নিচে চলা এরকম অভিযানে যদি তুমি স্বশরীরে পানিতে না নামো তাহলে তো তোমার অভিযান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’

‘আমার যা বয়স হয়েছে… নতুন কি আর শিখতে পারব?

‘বোকারাম! আমরা একজন ট্রে খুঁজে বের করব। তারপর দেখবে শিখতে পার কি না। তাছাড়া সামনের কয়েকদিন কী নিয়ে ব্যস্ত তুমি?

লিও ঠিক ভরসা পাচ্ছে না। তুমি নিশ্চিত? আমি তো এটাকে, নিজের শরীরে দেখাল লিও, ফিট রাখিনি।’

‘এটা তেমন কঠিন কিছু না। স্রেফ ভেসে ভেসে সঁতরে যাওয়া। জ্যাকুস কসটিউ তোমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সে এসেও এসব করেছেন। এত আমতা আমতা করলে চলে! একটু সাহসী হও।’ বন্ধুকে খোঁচা মারল স্যাম।

নৌকো ওদেরকে পাড়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বেনজিকে যেখানে কুমীরটা আক্রমণ করেছিল সেদিকে তাকাল রেমি। স্যামকে বলল

কুমীরের কী খবর?’ রেমির কণ্ঠস্বর বেশ নিচু।

স্থানীয়রা বোধহয় ভয়কে জয় করে এখান থেকে কুমীরগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ভয়ে লুকিয়ে থেকে আর কতদিন চলা যায়। বলল লিও। এবার ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরল। কালকে আসতে পারবেন?

ক্যাপ্টেন আর ক্রুরা নিজেদের মধ্যে দুশ্চিন্তামাখা দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর বলল, না। এই জায়গায় ভালা না।

‘আরে, কী যে বলেন! কিছুই হবে না। কত সহজে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন ভেবে দেখেছেন?!

ভ্রু কুঁচকাল ক্যাপ্টেন। ট্যাকা দিয়া আপনেরা এইহানে কুনো সুবিদা করবার পারবেন না। আমি আর কক্ষনও আমু না এইহানে। এই জায়গাড়া অভিশপ্ত। যদি নিজেগো ভালা চান তো এইহান থিক্কা চইল্যা যান। আর কক্ষনও ফিরা আইয়েন না। আর যদি থাকবার চান তত থাকেন। খোদা আপেগো দেইখ্যা রাখুক।’

কর্কশ হাসি দিল লিও। কী যে বলেন! অভিশপ্ত? এসব বলে কী আর আমাদেরকে ভয় দেখানো যায়!

শীতল দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন লিও’র দিকে তাকাল। আপনে যা করতে কইছিলেন করছি, কিন্তু আর করমু না। আমাগো মজুরী দিয়া দেন। বাড়িত চইল্যা যাই। আপনেরা নিজেগো জীবন নিয়ে জুয়া খেলবেন, ভালা কথা। কিন্তু আমি খেলম না।’

নাটকীয় কথাবার্তা। মন্তব্য করল লিও। কয়েকটা বিল বের করে ক্যাপ্টেন হাতে দিল। আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল মনে রাখবেন। কাউকে এই ব্যাপারে কিছুই বলবেন না। আরেকটা অতিরিক্ত বিল দিল সে।

 আমি কাউরেই কইতাম না। আর কইলেও কেউ নিজের কপাল ফাটাইতে এইখানে আইব না। বেনজির কী অবস্থা হইছে আমি শুনছি। অভিশাপের লাইগ্যা ওর এক পাও কাড়া পড়ছে। একটু থামল ক্যাপ্টেন। এইডা তো ক্যাবল শুরু। সামনে আরও হইব।’

ক্যাপ্টেন ও তার ক্রু’রা তাদের ট্রাক নিয়ে বিদেয় হলো।

স্যামের দিকে তাকাল রেমি। লোকটার চেহারা খেয়াল করেছ? খুব ভয় পেয়েছে বেচারা।

স্থানীয় কুসংস্কার। মাম্বো জাম্বো। যতসব ফালতু। স্যাম তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিল।

‘সে এই জায়গা সম্পর্কে আগে থেকেই জানে। হয়তো তার মাধ্যমে আমরা চলমান গুজব সম্পর্কে জানতে পারব।’ বলল রেমি।

‘ওসব শুনে কি খুব একটা লাভ আছে? পাড় থেকে একটু দূরেই প্রাচীন কোনো ভবনের ধ্বংসাবশেষ ডুবে রয়েছে। কেউ এটা সম্পর্কে জানতো না পর্যন্ত। অথচ আমরা ঠিকই আবিষ্কার করেছি। তাদের ওসব বাচ্চা ভোলানো ভূতের গল্পে কে বিশ্বাস করে? লিও বেশ ক্ষিপ্ত।

তবে লিও, এসব লোককাহিনিতে কিন্তু কিছু সত্য উপকরণও থাকে। মন্তব্য করল স্যাম। আশেপাশে একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে ক্ষতি কী?

‘বেশ, তোমরা যদি তোমাদের সময় নষ্ট করতে চাও, করো। আমি বরং আগামী তিনদিনের মধ্যে স্কুবা ডাইভিং শিখব।

.

০৮.

লা জল্ল্যা, ক্যালিফোর্নিয়া

সামনের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চোখ সরাল সেলমা। ওর দুই সহকারী এসেছে হয়তো। পিট ও ওয়েন্ডি। লাঞ্চ করতে বাইরে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু রুমে ভিন্ন একজনকে ঢুকতে দেখে জোলটান গরগর আওয়াজ করল। সেলমা হাত দিয়ে শান্ত করল জোলটানকে। আগন্তুকের নাম; ল্যাজলো।

পেশায় শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ায়। নিয়মিত আসে এখানে। সেলমা সন্দেহ করল এই ব্যক্তির হাতে এখন কোনো কাজ নেই তাই গল্প করে সময় কাটাতে আসছে। এরআগে লাওস অভিযানে গিয়েছিল ল্যাজলো। কিন্তু সেখান থেকে কোনো গুপ্তধন উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গুপ্তধন না পেয়ে ল্যাজলো খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল কিন্তু কুখ্যাত জলদস্য ক্যাপ্টেন কিডের হাতে লেখা একটা কাগজ পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে। ক্যাপ্টেন কিডের কাগজে সবকিছু কোডে লেখা।

‘সেলমা, কী আর বলব। আজকের এই সুন্দর দিনে তোমাকে যা অসাধারণ লাগছে। আর জোলটান, তুমি তো মোটাসোটা হ্যান্ডসাম। একদম ঠিকঠাক। বলল ল্যাজলো।

 ‘জোলটান মোটেও মোটা নয়,’ সেলমা আপত্তি করল। মাথা ঘুরিয়ে ল্যাজলোকে পর্যবেক্ষন করল জোলটান। তারপর বসে পড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ল্যাজলোর প্রতি তার এখন কোনো আগ্রহ নেই।

 ‘এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে? আমি তো আদর করে বলেছি। সেলমার কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকাল সে। কী নিয়ে কাজ করছ?

সেলমা মনিটরের পাওয়ার বাটনে চাপ দিল। তোমার ভাল লাগতে পারে এরকম কিছু করছি না, নিশ্চিত।

‘তা কী আর বলা যায়! যদি তুমি পাশে থাকো তাহলে যে-কোন বিষয়ই আমার অনেক ভাল লাগে।’

অভিযান থেকে ফেরার পর ল্যাজলো দিনের পর দিন মাত্রা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ফ্লার্ট করেই যাচ্ছে।

 ‘তোমার যে বয়স তাতে কোনো বিষয়ের প্রতি আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক।’ বলল সেলমা। তা এখানে এলে কী মনে করে?’

 ভাবলাম আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারব। বলো, কোনো কাজ আছে? যেটাতে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি? কোনো জটিল সাইফার, কোড? কোনো ধাঁধা?’

 ‘ক্যাপ্টেন কিডের কাজ কতদূর এগোল? কোডের অর্থ উদ্ধার হয়েছে? জেনে-শুনে খোঁচা মারল সেলমা।

কাজ করছি। কাগজটা যার কাছে ছিল তার ধারণা জলদস্যুদের কোনো হারানো গুপ্তধন সম্পর্কে বলা আছে ওতে। কিন্তু সেরকম মনে হয় না।

এরকম বাড়িয়ে বলেই তো অনেকে সাধারণ একটা জিনিসকে অনেক উচ্চমূল্যে বিক্রি করে থাকে।

‘রাইট। সেজন্য আমি এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিতে চাই। যদি ওই লোকের কথা সত্য হয় তাহলে তো কেল্লাফতে। অনেক লাভ হবে।

সেলমা মাথা নাড়ল। এসব করতে গিয়ে আসল চাকরি হারিয়ে না আবার।

হুঁ। এটা আমার আসল চাকরির চেয়েও বেশি মজার। অন্য দিকে তাকাল ল্যাজলো। আচ্ছা, আমাদের ফারগো দম্পতির কী খবর? কোথায় তারা?

সলোমন আইল্যান্ডের বিভিন্ন ডকুমেন্ট দেখাল সেলমা। আমি ওদের জন্য এই এরিয়া নিয়ে রিসার্চ করছি। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস… সবই আছে ওখানকার ইতিহাসে। ফারগোরা ওখানে যাওয়ার আগে আমি নামটাও পর্যন্ত জানতাম না।’

হুম। ইন্টারেস্টিং। পৃথিবীতে এরকম অনেক জায়গা আছে যেগুলো এখনও সেভাবে পরিভ্রমণ করা হয়নি। এটাও সেরকম একটা জায়গা হবে।

“হ্যা…’

‘ফারগোরা তো গুপ্তধন উদ্ধারে পটু। সবার চোখের সামনে দিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারাটা কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর।’

 ‘কিন্তু এই জায়গাটা কিন্তু তারা আবিষ্কার করেনি। ওদের বন্ধু লিওনিডের আবিষ্কার এটা। ওরা স্রেফ সাহায্য করতে গেছে।

“লিওনিড, এহ? আইরিশ নাম।’

ল্যাজ-লো, ওর নাম ভেঙে উচ্চারণ করল সেলমা। শুনেই কোনোকিছু সম্পর্কে মন্তব্য করা উচিত নয়। ফারগোদের প্রথম নিয়ম এটা। নিয়মটা খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ। সেলমা ল্যাজলোকে ইশারায় সাবধান করল।

তারমানে ওই লোক রাশিয়ান নয়?

ছোট্ট করে হাসল সেলমা। আমি কি তোমাকে অন্য কোনকিছুতে সাহায্য করতে পারি?

ল্যাজলো উঠে দাঁড়াল। সেলমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছে। না, না। আমি তো তোমাকে সাহায্য করার জন্য এসেছিলাম। যা-ই হোক, ভাল থাকো, সেলমা। আর হ্যাঁ, যে-কোন কাজে আমার দক্ষতার প্রয়োজন হলে জাস্ট আমাকে ফোন দিলেই হবে। আমি হাজির হয়ে যাব।’

‘অনেক ধন্যবাদ। তবে আজকে হয়তো আর লাগবে না।’

 ‘সমস্যা নেই।

বিদেয় হলো ল্যাজলো। সেলমা এই ব্যক্তিকে মোটেও পছন্দ করে না। তাই কোন কাজে সাহায্য চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। মনিটরের পাওয়ার বাটন অন করল সেলমা। ওকে নড়তে দেখে জোলটান ওর পায়ের কাছে এগিয়ে এলো। প্রাণীটার বিশালাকার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল ও।

.

০৯.

গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যান্ড

লিও’র সাথে হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে নিল স্যাম ও রেমি। বেচারা আগামীকালের জন্য আরেকটা নৌকো খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছে। কুমীরের ঘটনা এখন দ্বীপের সবার মুখে মুখে। তাই কেউ আর লিও’র সাথে কাজ করার সাহস পাচ্ছে না। লিও অনেক বাড়তি অর্থ প্রস্তাব করেছিল, তাতেও কাজ হয়নি।

‘দেখো, লিও, স্যাম বলল। তাড়াহুড়ো করে ডাইভ দিয়ে আমরা কিন্তু খুব বেশিকিছু উদ্ধার করতে পারব না। তারচে’ বরং রিসার্চ শিপের জন্য অপেক্ষা করি। ওতে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি থাকবে, লোকবলও পাব। পানির নিচের জিনিসটা মানুষ-নির্মিত। প্রথম ডাইভে যা দেখে এসেছি, ওতেই যথেষ্ট।

 তুমি এই সুযোগে ডাইভিং শিখে ফেলল,’ বলল রেমি। হয়তো ডাইভিঙে আনন্দ খুঁজে পাবে।’

‘তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’ কফিতে চুমুক দিল লিও।

‘এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই, বন্ধু। পানিতে নামতে পারছি না তো কী হয়েছে? আমরা এখানকার লোককাহিনি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া শহর নিয়ে কোনো গল্প না থেকে পারেই না।’

 ‘গুড লাক। আমি তো স্থানীয়দের সাথে কথাই বলতে পারি না। সব ব্যাটা মুখ সেলাই করে বসে থাকে।’

‘আমার সুন্দরী বউকে দিয়ে করার কাজটা।

 ‘ভাল। আমি আসলে মানুষদের সাথে খুব একটা মানিয়ে নিতে পারি না।

তাই আমরা এখন আলাদা হয়ে যাব। তুমি স্কুবা ডাইভিং শিখবে আর আমরা এখানকার বিভিন্ন লোকদের কাছ থেকে কথা আদায় করার চেষ্টা করব।’ বলল রেমি। “ঠিক আছে?

‘আমাকে পানিতে নামতে হবে…এই অংশটুকু ছাড়া বাকিসব ঠিক আছে।

হাসপাতালের দিকে পায়ে হেঁটে রওনা হলো স্যাম ও রেমি। ওরা যখন পৌঁছুল, সকালের সূর্য তখন কেবল হাসপাতাল ভবনের গায়ে লাগতে শুরু করেছে। ভ্যানার খোঁজ করল ওরা। ইমার্জেন্সি দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো ভ্যানা। তাকে দেখে খুব খুশি মনে হচ্ছে।

‘বাহ, কি দারুণ সারপ্রাইজ। আপনারা এত তাড়াতাড়ি আসবেন ভাবিনি।

কাছ দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম…’ বলল স্যাম।

‘খাবার প্লেট সাইজের শহরে আপনি যেখানেই যাবেন সেখান থেকেই। সবকিছু কাছে বলে মনে হবে।

‘রোগীর কী অবস্থা?’ রেমি প্রশ্ন করল।

‘অবস্থা স্বাভাবিক তবে এখুনি কারও সাথে দেখা করতে দেয়া সম্ভব নয়। সিডেটিভ দিয়ে রাখা হয়েছে। দুঃখিত। তবে আমি তাকে বলব, আপনারা এসেছিলেন।

‘ধন্যবাদ। আসলে আমরা তো তাকে চিনিও না। সে হয়তো বুঝতেও পারবে না আমরা কারা?’ বলল রেমি।

 “ঠিক আছে, আমি বলব, যারা আপনার জীবন বাঁচিয়েছিল তারা দেখতে এসেছিল আপনাকে।

 “থ্যাঙ্ক ইউ।

আপনাদের কাছ থেকে অনুদান পাওয়ার আশায় আছি। এতটুকু খে করতেই পারি।’ মজা করল ভ্যানা।

‘আপনি গতরাতে বলেছিলেন, সাহায্য করবেন আমাদের। আমি যদি এখন সাহায্য চাই কিছু মনে করবেন? স্যাম বলল।

“অবশ্যই নয়। বলুন, কী করতে পারি?

‘প্রথমত, কথা এ-কান ও-কান হতে দেয়া যাবে না। চারিদিকে তাকিয়ে বলল রেমি।

‘আমার ঠোঁটে তালা-চাবি মারা থাকবে।

‘আমরা এখানে যেটা নিয়ে রিসার্চ করছি… দেখা যাচ্ছে ওটা কোনো তলিয়ে যাওয়া শহরের অংশবিশেষ।’

দু’বার চোখের পলক ফেলল ভ্যানা। কী?

সমুদ্রের পাড়ে থাকা কোনো প্রাচীন শহর।’

 ‘গোয়াডালক্যানেলে? আপনারা মজা করছেন।

স্যাম মাথা নাড়ল। না, করছি না। আমরা জানতে চাই এরকম জিনিস নিয়ে কোনো লোককাহিনি আছে কিনা। আমার বিশ্বাস, আছে। এক বয়স্ক ক্যাপ্টেন “অভিশাপ” নিয়ে কী যেন বলল। আমরা এর পেছনের কাহিনি জানতে চাই।’

রোগীদের বসার জায়গা এখন ফাঁকা। ভ্যানা ওখানে বসে ওদের দুজনের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন ওরা ভিন্ন কোনো গ্রহের বাসিন্দা। আমি এখানে জন্মেছি। কিন্তু কখনও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া অভিশপ্ত শহরের ব্যাপারে কিছু শুনিনি। সাইন্স ফিকশনের মতো শোনল বিষয়টা। দুঃখিত, মাইন্ড করবেন না।’

না, করিনি। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও কিছু করার নেই। আমরা কিন্তু এবারই প্রথম এরকম লোককাহিনি নিয়ে কাজ করছি না। এরআগেও আমরা এসবের মুখোমুখি হয়েছি এবং দেখেছি এসব লোককাহিনি অনেকসময় একদম সত্য কাহিনিতে পরিণত হয়। রেমি বুঝিয়ে বলল।

‘আসলে আমি আপনাদের কথাকে অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার… এখানে পানির নিচে ভবনের ধ্বংসাবশেষ। সলোমনদের ইতিহাসের কোথাও উল্লেখ নেই যে তারা ভাল নির্মাতা ছিল। দ্বীপের চারিদিকে দেখুন। কী মনে হয়? প্রাচীনকালে এদের পূর্বপুরুষরা ভাল নির্মাতা হওয়ার কোনো নজির দেখতে পাচ্ছেন? অথচ পানির নিচে আস্ত শহর ডুবে রয়েছে…’।

‘আসলে “শহর” বললে বেশি বলা হয়। তবে কমপ্লেক্স ভবন” বলা যেতে পারে।’ বলল স্যাম। আচ্ছা, আপনি এমন কাউকে জানেন যিনি আমাদের প্রশ্নের দিতে পারবে? বয়স্ক কেউ? যিনি এখানকার প্রাচীন রীতিনীতি ও লোককাহিনি সম্পর্কে জানে?

 ডা. ভ্যানা মাথা নাড়ল। হয়তো অরউন জানে। এই এলাকার লোকদের সাথে ওর বেশি ওঠাবসা আছে। রাজনীতিবিদ বলে কথা! তবে আমার পরিচিত এরকম কেউ আছে বলে মনে পড়ছে না।

 ভ্রু কুঁচকাল স্যাম। দ্বীপে আগত বিদেশিদের উনি খুব একটা পছন্দ করেন বলে মনে হলো না। বিশেষ করে যেসব বিদেশি লোক এসে এখান থেকে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে তাদেরকে তো উনার পছন্দই হয় না বোধহয়।

না, অরউনকে ভুল বুঝবেন না। আপনারা সাহায্য চাইলে ও সাহায্য করবে, দেখবেন।

‘আমরা চাচ্ছি, বিষয়টা যাতে অনেক লোকের কানে না যায়। রেমি সতর্ক করে দিল।

 ‘আপনারা যদি সত্যি সত্যি সিরিয়াস অভিযান পরিচালনা করতে চান তাহলে কিন্তু সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর সেই অনুমতির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে অরউন। আপনারা যদি সরকারকে নিশ্চিত করে তথ্য না দেন তাহলে কীসের ভিত্তিকে সরকার আপনাদেরকে অনুমতি দেবে? সরকারের সাথে যাবতীয় লেনদেনের ব্যাপারে অরউন-ই আপনাদের শ্রেষ্ঠ খুঁটি। ওকে দরকার হবে আপনাদের।

 ‘আসলে আমরা বিস্তারিত কিছু এখনও জেনে উঠতে পারিনি। এখুনি সরকারকে অফিসিয়ালি কিছু জানানোটা কেমন হয়।’

 ‘আচ্ছা, বলুন, অনুমতি নিয়ে কাজ করা ভাল নাকি পরে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে “দুঃখিত” বলা ভাল? ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন দ্বীপের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু হলে দ্বীপের বাসিন্দারা স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে। আপনাদের জায়গায় আমি হলে শুরু থেকে সকল অনুমতি নিয়ে রাখতাম।’

স্যাম মাথা নাড়ল। ভাল পরামর্শ দিয়েছেন। অরউন সাহেবের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন?

‘আমি এখুনি ফোন দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।

হাসাপাতালের পেছনের অংশে চলে গেল ভ্যানা। স্যাম রেমির দিকে ঝুঁকল। আমাদের আবিষ্কারের ব্যাপারে কোনোকিছু শেয়ার না করতে পারলে ভাল হতো।’

 ‘হুম। কিন্তু না জানিয়েও উপায় নেই। এই দ্বীপে যেসব ইকুইপমেন্ট পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে কিন্তু বেশি কিছু করা সম্ভব না। ওরা হয়তো ডাইভ দিয়ে এতটুকু নিশ্চিত হতে পারবে পানির নিচে থাকা ইমারতটা মানুষ নির্মিত, এ-পর্যন্তই। এতে তো কোনো ক্ষতি দেখি না।’

তারপরও…’

 ‘পানির নিচে যা আছে সেটাকে তো আর কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারছে না। আর এরমধ্যে আমাদের রিসার্চ শিপও চলে আসবে। তাছাড়া স্থানীয় লোকজন কুসংস্কারের ভয়ে আধামরা। ওরা কোনো উঁকি-ঝুঁকি মারবে বলে মনে হয় না।’

হাসিমুখ নিয়ে ফিরল ভ্যানা। যদি আপনারা ওর অফিসে যান তাহলে অরউন আজ দেখা করতে পারবে। এই হলো অফিসের ঠিকানা, ভ্যানা একটা বিজনেস কার্ডের পেছনে হাতে লিখে ঠিকানাটা স্যামকে দিল।

‘অসংখ্য ধন্যবাদ।’ বলল রেমি।

‘মাই প্লেজার। আপনাদের রহস্যের জন্য শুভ কামনা রইল। কী বৈচিত্রময় আপনাদের জীবন!

‘অনেক তাড়াহুড়ো আর অপেক্ষাও আছে আমাদের জীবনে!’ স্যাম বলল।

মূল সড়কের পাশে থাকা সুন্দর ভবনগুলোর একটা হচ্ছে ম্যানচেস্টারের অফিস। দোতলা ভবনের গায়ে যে রং করা আছে সেটার হাল দেখে মনে হচ্ছে সর্বশেষ ১০ বছর আগে রং করা হয়েছে ভবনটা। এক সুন্দরী নারী এসে ওদের দুজনকে ভবনের পেছনের অংশে নিয়ে গেল। সেখানে ম্যানচেস্টার স্যুট পরে বড়সড় একটা গাড়ি সাইজের টেবিলের পেছনে বসে অপেক্ষা করছে।

বসুন, আপনারা। ভ্যানা তো ফোনে পরিষ্কার করে কিছু বললই না। শুধু বলল, আপনারা নাকি কোন অ্যাডভেঞ্চারে আছেন… একটু সাহায্য লাগবে?

‘সাহায্য লাগবে ঠিক আছে কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।’ বলল রেমি।

পানির নিচে থাকা ইমারতের ব্যাপারে স্যাম সব বলল। সবগুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ম্যানচেস্টারের। কথা শুনে ম্যানচেস্টার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। জানালার পাশে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাল সে।

‘গল্প তো ভালই। এ থেকে আসলে কী পাওয়া যাবে সে-ব্যাপারে আমি কিছু ঠাওর করে উঠতে পারছি না।’ ইতস্তত করল ম্যানচেস্টার। আপনারা আমাকে কী করতে বলছেন?

‘কিছু সাহায্য লাগবে? এই ইমারতের কোনো প্রমাণাদি আছে নিশ্চয়ই। কোনো ঐতিহাসিক দলিল? কিংবা কম করে হলেও কোনো লোককাহিনি।

হয়তো আছে। কিন্তু আমাদের এখানে কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তাই খুব বেশি কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আমি নিজেও সেরকম কিছু শুনিনি।

হয়তো বয়স্ক কেউ পুরানো গল্প কিংবা লোককাহিনি সম্পর্কে ভাল বলতে পারবে?’

চিন্তিত হয়ে পড়ল ম্যানচেস্টার। কয়েকজন বুড়ো আছে যারা হয়তো সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু ওদের কোনো থাকার ঠিক নেই। শহরে ওরা থাকতে চায় না। গ্রামের কোথাও গিয়ে আছে হয়তো।

‘আপনি কোনো ঠিকানা দিতে পারবেন?’

ম্যানচেস্টার হাসল। ওদেরকে একটা ই-মেইল করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। আমি বরং আপনাদেরকে দিক-নির্দেশনা দিতে পারি। সাথে একটা নোট দিয়ে দেব। ওরা হয়তো লেখা পড়তে জানে না কিন্তু কাগজের মুল্য ঠিকই বুঝবে।

‘তাহলে তো দারুণ হয়। স্যাম বলল। আরেকটা বিষয়। অভিযান চালানোর জন্য সরকারের অনুমতির বিষয়টা…’।

 ‘ওটা নিয়ে ভাবতে হবে। এমপি হওয়ার পর থেকে আমি আজপর্যন্ত কখনও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। তাই বুঝতে পারছি না কোন পদ্ধতি কিংবা আইন অনুসরণ করলে ভাল হবে। এ-ব্যাপারে আদৌ কোনো আইন আছে কিনা সে-ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই।’

 ‘আইন না থাকাতে ভাল দিকও আছে তেমনি খারাপ দিকও আছে।’ বলল রেমি।

হ্যাঁ। আমি বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। আজকে অন্যান্য এমপিদের সাথে লাঞ্চে বসে এই বিষয়ে আলোচনা করব। দেখি, তারা কী বলে। আচ্ছা, আপনারা তো কোনো খনিজ পদার্থ তুলবেন না? জাস্ট পানির নিচে ডুব দিয়ে অনুসন্ধান চালাবেন, তাই তো?’

‘একদম। আমরা যদি অনুসন্ধানে কোনোকিছু পাই সেটার মালিক সলোমন আইল্যাণ্ডের বাসিন্দারা। আমরা স্রেফ আগ্রহী হয়ে ডাইভ দিচ্ছি। কোনো লোভের বিষয় নেই এখানে।

“ঠিক আছে। তাহলে আপনারা বিনা মজুরীতে কাজ করছেন। আমাদের ইতিহাসের ব্যাপারে ক্যাটালগ তৈরিতে সাহায্য করছেন, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, এভাবে বললেই ভাল হয়। স্যাম সায় দিল।

হাসল ম্যানচেস্টার। বেশ। অনুমতির ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। ওর কণ্ঠে দ্বিধা।

‘আমরাও অতটুকুই চেয়েছি আপনার কাছ থেকে।

‘বয়স্ক লোকদের মধ্যে দুজনের কথা মনে পড়ছে এখন। একজন মিনু তে থাকে… দ্বীপের পূর্ব অংশে। আরেকজন থাকে অনেক দূরে… আওলা গ্রামের পুবে… নদীর পাশে। কোন গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা?’

স্যাম ও রেমি পরস্পরের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। একটা গাড়ি ভাড়া করে নেব।’

 ‘একটা এসইউভি নেবেন। ভাল টায়ার, ফোর-হুঁইল ড্রাইভ যেন থাকে। দরকার পড়বে।’

‘কোথায় পাওয়া যাবে?

নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল ম্যানচেস্টার। সলোমন আইল্যান্ডের সরকারি কাগজে প্রয়োজনীয় নোট আর অন্য একটা সাধারণ কাগজে কয়েকটা নাম আর ঠিকানা লিখল। লেখা শেষে কাগজ দুটো রেমিকে দিল সে।

 রুবোর বয়স প্রায় ১০০। তিনি আওলা গ্রামের দিকে থাকেন। কুসংস্কার আছে, তিনি নাকি একজন শ্যামান… কবিরাজ। আর টম এই দ্বীপের সবার খোঁজ রাখে। হয়তো সে ইতিমধ্যে জেনে গেছে আপনারা তার মতো কারও খোঁজ করছেন।’ হাসতে হাসতে বলল ম্যানচেস্টার। এদের দুজনই একটু-আধটু ইংরেজি জানে। তাই আপনাদের কোনো দোভাষী প্রয়োজন পড়বে না। আর গাড়ির জন্য ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি। যার ঠিকানা দিয়েছি সে বেশ সং… ওর গাড়িগুলোও মন্দ না। ওকে গিয়ে বলবেন আমি পাঠিয়েছি। তাহলে আপনাদের ভাল খাতির করবে।

কথা শেষে ওরা তিনজন উঠে দাঁড়াল। বাইরে বেরিয়ে এসে কাগজে চোখ বুলাল স্যাম।

‘অ্যাডভেঞ্চার আর কাকে বলে! একদম অঁজপাড়া গাঁয়ে যেতে হবে এবার!

 রেমি শ্রাগ করল। আপাতত এরচেয়ে ভাল কোনো রাস্তা আমাদের সামনে খোলা নেই।

‘রাইট। কিন্তু যদি কিছু গড়বড় হয়…?”

 রেমি থামল। কতবার বলেছি তোমাকে…’

 ‘ওই… সরি… মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। আর হবে না।

বলেই তো ফেলেছ। এখন আর সরি বলে লাভ আছে?”

.

১০.

কার রেন্ট কোম্পানির মালিক দেখতে নাদুসনুদুশ বুদ্ধের মতো। প্রতিটা বাক্য বলা শেষে হেসে ওঠা তার মুদ্রাদোষ। একটা রূপোলি নিশান এক্সটেরা দেখাল সে। তবে গাড়ির তুলনা ভাড়াটা বেশি চাইল।

প্রচণ্ড বৃষ্টি নামতে শুরু করল স্যাম ও রেমি গাড়িতে ওঠার পর। ড্রাইভিং সিটে স্যাম বসে আছে। ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে এগোচ্ছে ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা শহর ছাড়িয়ে গ্রাম্য অঞ্চলে প্রবেশ করল। হেন্ডারসন ফিল্ড ও যুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী কর্তৃক নির্মিত আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে এগোল ওদের গাড়ি। এরপর রাস্তার দু’পাশে গভীর বন দেখা দিল। আকাশ থেকে অঝরো বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির পরিমাণ এতই বেশি যে নিশানের ওয়াইপার গাড়ির সামনের কাঁচ থেকে পানি মুছে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

 এভাবে কয়েক মাইল যাওয়ার পর বৃষ্টি থেমে গেল। হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল, হঠাৎ করেই থেমে গেল। মেঘ সরে গিয়ে সূর্য দেখা দিল আকাশে।

এই এলাকার একটা দিক ভাল,’ বলল স্যাম। ওদিকে রেমি গাড়ির এসি চালু করার জন্য নব হাতড়াচ্ছে।

কী সেটা?

যদি আবহাওয়া সুবিধের না হয় তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এখানকার আবহাওয়া একটু পর পর বদলে যায়।

‘ঠিক বলেছ! যখন গরম পড়ে তো পড়েই আর যখন বৃষ্টি নামে তখন একেবারে ভাসিয়ে দেয়। এরকম আবহাওয়ায় আমার চুলের বারোটা বাজবে।’

‘এখানকার কাজ শেষ হয়ে যাক। তারপর তুমি যেখানে যেতে চাইবে আমি সেখানেই নিয়ে যাব। রিও, মিলান, স্পা, স্যালুন, শপিং…. যেখানে তুমি চাইবে।’

‘আচ্ছা, এখানকার কাজে ফাঁকি দিয়ে সরাসরি ঘুরতে যাওয়ার কোনো উপায় আছে?

 ‘না। আমরা তো এখানেও ঘুরছি, তাই না?’ স্যাম হাসল।

রাস্তার পাশে থাকা একটা ছোট্ট চিহ্ন জানান দিল ওরা ব্রিজ দিয়ে অ্যালিগেটর রিভার পার হচ্ছে। স্যামের দিকে তাকাল রেমি। এখানে ইন্টারেস্টিং জিনিসের অভাব নেই।

হুম, তবে অ্যালিগেটর কিন্তু কুমীর থেকে আলাদা। অ্যাটিগেটরের মুখ তুলনামূলক কম লম্বা ও কিছুটা ভোতা হয়।

‘আলাদা হোক কিন্তু দুটোর স্বভাব একই। মানুষ খায়।’

 ‘তা ঠিক।

চলতে চলতে আরেকটা ব্রিজের কাছে চলে এসেছে ওরা। এই ব্রিজটা অনেক সরু। ওদের নিশান গাড়ির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা হওয়াই কঠিন। ব্রিজের পাশে লেখা রয়েছে “গোল্ড রিজ।” লেখাটার পর দক্ষিণ দিকে তীর চিহ্ন আঁকা।

‘কোনো খনি হবে হয়তো। বলল রেমি।

‘যদি তুমি চাও তাহলে ফেরার পথে একবার দেখে যাব। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে।’

 ‘ঠিক আছে। আগে আজকে যে কাজের জন্য এসেছি সেটার কতদূর কী হয় দেখি। তারপর দেখা যাবে।

‘ওকে। ম্যাডামের যা মর্জি।

ম্বিনু-তে পৌঁছে ওরা যে গ্রামটাকে দেখল সেখানে হাতেগোনা কয়েকটা ঘর ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। ছোট্ট একটা বাজারের পাশে থামল ওরা। গাড়ি থেকে নামতেই পোকামাকড় আর তীব্র গরম ওদের উপর হামলে পড়ল। কয়েকজন গ্রামবাসী রাস্তার পাশে থাকা গাছের ছায়ার নিচে বসে আছে, আগ্রহ নিয়ে দেখছে ওদেরকে। ম্যানচেস্টারের দেয়া নাম-ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে এগোল স্যাম।

 ‘টম নামের একজনের কাছে এসেছি আমরা। এখানেই থাকে। একটু সাহায্য করবেন?’ মুখে হাসি নিয়ে স্যাম জিজ্ঞাস করল।

গ্রামবাসীরা ভাল করে স্যামকে দেখে নিয়ে বিজাতীয় ভাষায় বলল কী যেন। স্যাম ও রেমি দু’জনের কেউ-ই এই ভাষা বোঝে না। ওরা কিছু বুঝতে পারছে না টের পেয়ে হেসে উঠল গ্রামবাসীরা।

রেমি সামনে এগোল। আপনারা কেউ টমকে চেনেন?

আবার গুঞ্জন শুরু হল গ্রামবাসীদের মধ্যে। এবার আরও জোরে হাসল তারা। স্যামের দিকে রেমি ফিরল। অবস্থা দেখেছ?

 যতদূর মনে পড়ে এই দ্বীপের অফিসিয়াল ভাষা হলো ইংরেজি। কিন্তু খুব কম লোকই ইংরেজি জানে।

‘আমাদের সামনে এখন যারা আছে তারা সেই “কম লোকের মধ্যে নেই।

গ্রামবাসীদের দিকে হাত নেড়ে সরে গেল ওরা। গ্রামবাসীরা পাল্টা হাত নাড়ল। বাজারের ভেতরে ঢুকল ফারগো দম্পতি। ওদের কপাল ভাল বলতে হবে। প্রাচীন এক ক্যাশ রেজিস্টারে বসা দশাসই সাইজের এক মহিলাকে পাওয়া গেল, সে একটু-আধটু ইংরেজি বলতে পারে।

‘টম? হি বাই দ্য চার্চ। ডাউন দ্য রোড। অশুদ্ধ ইংরেজি বলল মহিলা।

 ‘চার্চ? স্যাম প্রশ্ন করল।

 ‘হ, পিছন দিকে।

‘আচ্ছা, টমের বাসাটা ঠিক কোথায়?

 ‘চিহ্ন খোঁজেন… পাইবেন।

 ‘চিহ্নটা কী?

 ‘Skink

 ‘সরি, বুঝতে পারিনি।’

Skink,’ হামাগুড়ি দেয়ার অভিনয় করে দেখাল মহিলা।

‘ওহ।

ওরা গাড়িতে গিয়ে বসল। গাড়ি নিয়ে দুই-তিনবার চক্কর দেয়ার পর কাদায় মেখে যাওয়া একটা চিহ্ন চোখে পড়ল ওদের। টিকটিকি।

মহিলা কী বলছিল? কিঙ্ক?’ স্যাম প্রশ্ন করল।

‘স্কিঙ্ক। একটা s ছিল। অন্তত উচ্চারণ শুনে তো তা-ই মনে হলো।’ স্বামীকে শুধরে দিল রেমি।

চিহ্ন পার হয়ে ৩০০ ফুট এগোল ওরা। গাছের ছায়ার নিচে একটা জীর্ণ বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ৬০ শতকের জং ধরা টয়োটা সেডান পার্ক করা আছে। বাড়ির পাশে। ওদের গাড়ি দেখতে পেয়ে এক বয়স্ক লোক গাঢ় রঙের টি-শার্ট পরতে শুরু করল। গাড়ি থেকে নামল ফারগো দম্পতি। বয়স্ক লোকটার পরনে এখন টি-শার্ট আর শর্টস রয়েছে। তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

টম?

‘আমি।’ হাসল লোকটা। লোকটার গায়ের রং কালো, দাঁতগুলো হলুদ। হাসার সময় হলুদ দাঁতগুলো গাড়ির হেডলাইটের মতো জ্বলে উঠল যেন।

‘আমরা অরউন ম্যানচেস্টারের বন্ধু।’

‘ওই চোরের বন্ধু? ওরে দিয়া কোনো ভালা কাজ হয় না।’ হাসতে হাসতে বলল টম। কন, আমি আপনাগো লাইগ্যা কী করবার পারি? Skink লইবেন? কোলে থাকা একটা সবুজ টিকটিকি উঁচু করে ধরে দেখাল সে।

রেমি আর একটু হলেই কয়েক হাত পিছিয়ে আসতো কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল। স্কিঙ্ক প্রায় দুই ফুট লম্বা। মাথাটা ত্রিভুজাকৃতির, চোখ কালো।

না। আমরা কিছু পুরানো গল্প জানতে চাই। অরউন বললেন, আপনি হয়তো আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন। মিষ্টি হাসি হেসে বলল রেমি।

‘ও আইচ্ছা। আপনেরা কিছু খাইবেন? পানি? সোডা? আমার স্টকে খুব বেশি কিছু নাই। তারপরও মোটামুটি খাতির-যত্ন করবার পারমু।’

মাথা নাড়ল স্যাম। না, ঠিক আছে। আমাদের কিছু লাগবে না।

 ‘আইচ্ছা, আহেন, বহেন। তারপর কন, কীসের গল্প শুনবার চান?

বাড়ির সামনে থাকা কাঠের বেঞ্চে বসল ওরা। স্যাম গলা পরিষ্কার করল। সাগরের অভিশপ্ত পাড় নিয়ে কিছু জানেন?

টমের চোখ সরু হয়ে গেল। অভিশপ্ত পাড়?

 ‘জি। এক নৌকার ক্যাপ্টেনের মুখে তো সে-রকমই শুনলাম।

এরাম পুরান ফাউল জিনিস লইয়্যা আপনারা মাথা ঘামাইতাছেন ক্যান?

‘আমরা আসলে এই দ্বীপের লোকদের লোককাহিনি ও প্রচলিত গল্প সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।

দূরে দৃষ্টি মেলল টম। মাফ কইরেন। আমি আপনাগো কোনো সাহায্য করবার পারতাছি না।’

 ‘আপনি সৈকতের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনো গল্প জানেন না?’ প্রশ্ন করল রেমি।

টম মাথা নাড়ল। আপনেরা হুদাই আপনাগো সময় নষ্ট করছেন।

 ‘খুবই লজ্জাজনক হালো বিষয়টা। আমরা কিন্তু ওখানে একলোকের জীবন বাঁচিয়েছি। কুমীর আক্রমণ করেছিল তাকে। বলল স্যাম। ভাবল, এতে হয়তো লোকটা মুখ খুলবে।

কিন্তু টম কোনো আগ্রহই দেখাল না। হ, হুঁশ কম হইলে কুমীরের কামড় খাইতে হয়। এইহানকার কুমীরগুলান খুব ভয়ঙ্কর। আরও মেলা কিছু আছে। সাবধান না হইলে ওইগুলা থেইক্যা বিপদ হইবার পারে।’

‘তাই নাকি? রেমি বলল।

 ‘হু, তাই। হেইডা ছাড়াও যেইখানে সেইখানে আজাইরা নাক গলাইলেও বিপদ হইবার পারে।’

‘যেমন?

‘ধরেন, অভিশপ্ত সাগর। তারপর ধরেন গিয়া… গুহা। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নরম করল টম। জায়ান্ট (রূপকথায় বর্ণিত বিশালাকার দানব বা বিরাকাটার মানুষ)-এর কাছ থেইক্যা দূরে থাকাই ভালা।’

‘দুঃখিত। কী বললেন? জায়ান্ট স্যাম প্রশ্ন করল।

মাথা নাড়ল টম। হ। পাহাড়ে অনেক আছে ওইগুলা। শুনেন, নিজের চড়কায় ত্যাল দেন, ওইডাই ভালা হইব। এইখানে আইছেন, ঘুরে-ফিরেন, মস্তি করেন। ভালা থাকেন।

‘আপনি বললেন, এখানে জায়ান্ট আছে?’ স্যাম আবার প্রশ্ন করল।

হ, আছে। তয় এখন একটু কমছে।

 ‘আপনি কি বড় সাইজের মানুষ বোঝাচ্ছেন?’ কথা পরিষ্কার করতে চাইল। রেমি। কথার মোড় ঘুরে যাওয়ায় অবাক হয়েছে।

না। মানুষ না। জায়ান্ট। বিশাল সাইজের। অরা গুহায় থাকে আর ধইরা ধইরা মানুষ খায়। এইখানকার মোটামুটি সবাই অগো কথা জানে। দেহাও যায়।’

‘এগুলো তো সব লোককাহিনি, তাই না?

‘যা খুশি নাম দেন, সমস্যা নাই। আমি আপনাগো সাবধান কইরা দিলাম, যাতে বিপদে না পড়েন। আপনারা অরউনের বন্ধু। আমি চাই না আপনাগো জায়ান্ট খায়া ফালাক।

স্যাম হাসল। আপনি সত্যি সত্যি জায়ান্টে বিশ্বাসী?

‘আবার জিগায়। আমি নিজের চোখে দেখছিও। আপনার চাইতে আরও দুইগুণ বড়। সারা শরীরে লোমে ভরা। আপনের বন্ধুরে যে কুমীর কামড়াইছে। ওইটার চেয়েও এরা ভয়ঙ্কর। এটুকু বলে টম থামল। ওর আর এ-নিয়ে কথা বলার আগ্রহ নেই মনে হচ্ছে। স্যাম ও রেমি আরও কিছু জানার জন্য চাপাচাপি করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। টম যেসব জবাব দিল সবই কোনো না কোনো ধাঁধা কিংবা হেঁয়ালীমূলক।

জায়ান্ট ছাড়া আর কী সম্পর্কে আমাদের জানা থাকা উচিত, বলুন তো শুনি। সুন্দর হাসি হেসে স্যাম প্রশ্ন করল।

‘হাসেন। যত খুশি মশকরা করেন এইসব নিয়া। এইখানে অনেক আজিব আজিব জিনিস হয়, বুঝছেন? মানুষ উধাও হয়া যায়। কোনো কারণ ছাড়াই ব্যারাম হয়। পাহাড়ের উপরে কেউ যায় না, বিষাক্ত সব। এই দ্বীপ বদলাইয়া যাইতাছে। জায়ান্ট হইল অনেকগুলা বিপদের মইদ্যে একটা। ওইরম জিনিস আমি জীবনেও দেখি নাই। খুব ভয়ঙ্কর।

 ‘লোকজন কি সাগরের পাড় নিয়েও এরকম ভাবে? বিষাক্ত? অভিশপ্ত? নরমভাবে রেমি প্রশ্ন করল।

‘আমি কোনো সাগরের পাড় চিনি নাহ।

 ‘পুরানো দিনের কোনো গল্প আছে? কোনো শহর তলিয়ে গেছে… এরকম কিছু?

কোলে থাকা স্কিঙ্কের মাথায় হাত বুলাল টম। আপনেরা এইবার ফাউ জিনিস নিয়া কথা বলছেন।

‘না। আমি হারানো শহর নিয়ে কিছু একটা শুনেছি।

‘আমি শুনি নাই। আইজকা প্রথম শুনলাম। বলল টম। তার কণ্ঠে সতর্কতা।

আরও কয়েক মিনিট প্রশ্ন-উত্তরের পর টম জানাল সে ক্লান্ত। ফারগো দম্পতি বিষয়টা বুঝতে পারল। গাড়ির দিকে এগোল ওরা।

ইঞ্জিন চালু করে রেমির দিকে তাকাল স্যাম। তার কথাগুলো বিশ্বাস হয়েছে তোমার?

‘কোনটা? জায়ান্ট? নাকি সাগর সম্পর্কে কিছু জানে না, সেটা?

‘দুটোই। আমি তার চোখ দেখেছি। সে যা জানে আমাদেরকে ততটা জানায়নি। আমার তো মনে হয়, জায়ান্টের কথা বলে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে।’

 ‘বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। এরকম উদ্ভট জিনিস আমি এই প্রথম শুনলাম। কিন্তু সে কিন্তু অবলীলায় বলেছে সব।

‘আমার ধারণা, এসবই টুরিস্ট ভুলানোর ধান্দা। জায়ান্ট-টায়ান্ট কিছু। নেই।’

 ‘তার বলার ধরণ কিন্তু ভাল ছিল। প্রতি পদে পদে বিপদ আর লোকজন গায়েব হওয়ার বিষয়টার উপস্থাপনাভঙ্গিটা দারুণ। কী মনে হয় তোমার?

‘সত্যি বলতে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি, এসব থেকে আমরা অভিশপ্ত সাগরের কোনো তথ্য পাচ্ছি না। টম আসলে আমাদেরকে ভয় দেখিয়েছে যাতে আমরা আর প্রশ্ন না করি।’

পশ্চিম আকাশে মেঘ গুড়গুড় শব্দে ডেকে উঠল। “প্লিজ, আর না।’ বলল রেমি।

‘আরেক বুড়োর কাছে যাব? হয়তো টমের চেয়ে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করবে।’

 ‘আবার যদি বৃষ্টি নামে তাহলে কিন্তু কাদায় রাস্তার অবস্থা জঘন্য হবে।

‘তা তো হবেই। আমি বলি কি, যা আছে কপালে। চলো।’

‘আমি জানতাম, তুমি এটাই বলবে।’ বলল রেমি। ঠিক আছে। চলো। তবে পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না। আমি কিন্তু সতর্ক করেছি, হুঁ।

১৫ মিনিটের মধ্যে নীল আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে রাস্তার বেহাল দশা। মাইলখানেক যাওয়ার পর দেখা গেল রাস্তা আর চেনাই যাচ্ছে না। পুরো রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। হার স্বীকার করল স্যাম। গাড়ি ঘুরিয়ে হোটেলের দিকে রওনা হলো। অনেক কষ্টে হোটেলে এসে পৌঁছুল ওরা।

 বৃষ্টি এখনও থামেনি। হোটেলে ঢুকে দেখল ডেস্ক ক্লার্ক ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রেমি গেল ক্লার্কের কাছে। দুটো মেসেজ দিল ক্লার্ক। একটা লিও’র আরেকটা ম্যানচেস্টারের। লিও জানিয়েছে, ডাইভিঙের প্রথম ক্লাস ছিল আজ। বিকেলে হাতেকলমে ডাইভিং শিখতে পানিতে নামছে। আরেকটা মেসেজে ওদের দুজনকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে ম্যানচেস্টার।

যাবে? রুমে যেতে যেতে স্যাম ওর স্ত্রীকে প্রশ্ন করল।

‘অবশ্যই। কেন যাব না? দেখি রাজনীতিবিদ সাহেব জায়ান্ট সম্পর্কে কী বলেন।

‘আমার তো মনে হয় সবই বাচ্চা ভোলানো কাহিনি।’

হতে পারে। তবে যত যা-ই বলল। টমের সাথে কথাবার্তা পুরোপুরি শেষ হয়নি আমাদের। তার কথা শুনে মনে হলো সে আসলেই এসবে বিশ্বাস করে।

 তার যে বয়স। এই বয়সে কোনটা হ্যালুসিনেশন আর কোনটা বাস্তব সেটা আলাদা করা কঠিন। কত বয়স হবে তার? আশি?

বলা মুশকিল। আমার কাছে অবশ্য অতটা বয়স্ক মনে হয়নি।

সমুদ্রের পাশে অন্য একটা রেস্টুরেন্টে ম্যানচেস্টারের সাথে দেখা করল ওরা। আগের রেস্টুরেন্টের চেয়ে এটা তুলনামূলক উন্নতমানের। টেবিলের উপরে একটা খালি বোতল দেখে বোঝা গেল স্যাম ও রেমি এখানে আসার আগেই ম্যানচেস্টার ইতিমধ্যে এক রাউন্ড বিয়ার সাবাড় করেছে।

 ‘দুঃখিত। আজকের আবহাওয়াটা সুবিধের নয়। আশা করা যায়, কালকের আবহাওয়া ভাল হবে। ম্যানচেস্টার এমনভাবে কথাটা বলল যেন এরকম আবহাওয়ার জন্য সে নিজেই দায়ী।

না, ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আপনি যে দু’জনের কথা বলেছিলেন আমরা তাদের একজনের সাথে দেখা করেছি।’ বলল রেমি।

ভাল তো? কার সাথে দেখা করলেন?

 ‘টম।

‘সে একখান চিজ, তাই না? ওর কাছ থেকে কোনো কাজের কথা বের করতে পেরেছেন?

“তিনি স্রেফ জায়ান্টের গল্প শুনিয়েছেন।

‘ওহ, হ্যাঁ। জায়ান্ট। এখানকার বহুল প্রচলিত গল্প! কেউ না কেউ এমন কাউকে চেনে যে জায়ান্ট দেখেছে কিন্তু যখন একটু গভীরে গিয়ে সত্যতা খতিয়ে দেখতে যাবেন, তখন দেখবেন সবাই বাইন মাছের মতো পিছলাতে শুরু করবে।’

টম বললেন, তিনি নাকি জায়ান্ট নিজের চোখে দেখেছেন।

‘অবশ্যই দেখেছে। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, সে অবশ্যই কিছু একটা দেখে সেটাকে জায়ান্ট ভেবে বসে আছে। রেইন ফরেস্টের ভেতরের কোনো ছায়া কিংবা কোনো ঝাপসা কিছু… দেখলে দেখুক। ক্ষতি তো নেই। কিন্তু সে কি আপনাদের পানির নিচে পাওয়া ধ্বংসাবশেষের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পেরেছে?

মাথা নাড়ল স্যাম। দূভার্গ্যবশত, না। তিনি মানুষের গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। তার ভাষ্য, মানুষখেকো জায়ান্টের কারণেই মানুষ গায়েব হচ্ছে।’

ওয়েটারকে আরও দুই বোতল বিয়ার আনার জন্য ইশারা করল ম্যানচেস্টার, তারপর রেমির দিকে তাকাল। আপনি কী নেবেন?

‘আমি পানি নেব। গরমে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে।

ম্যানচেস্টার রেমির জন্য ওয়েটারকে এক বোতল পানির অর্ডার দিল। ‘তাহলে পাহাড় জুড়ে মানুষখেকো জায়ান্টদের বসবাস, তাই তো? আমি সেই ছোটবেলা থেকে এসব গল্প শুনে আসছি। মজাই লাগে শুনতে। অবাক হয়ে ভাবি, এসব গল্পের শুরুটা হয়েছিল কীভাবে। আশেপাশের অন্যান্য দ্বীপগুলোর গল্পের চেয়ে আমাদের দ্বীপের গল্পগুলো কিন্তু বেশ আলাদা।

ওয়েটার বিয়ার ও পানির বোতল নিয়ে আসার পর ম্যানচেস্টার ওদের তিনজনের জন্য সামুদ্রিক খাবার অর্ডার করল। কিন্তু ম্যানচেস্টার যে পরিমাণ খাবার অর্ডার করেছে তা দিয়ে দশজন মানুষের পেট ভরে যাবে। খাওয়ার পুরো সময়টা চুপচাপ রইল ওরা। ম্যানচেস্টার গপাগপ খাবার সাবাড় করে ফেলল। খাওয়া শেষে সোনার খনির কথা তুলল স্যাম।

‘গতরাতে আপনি খনির কথা বলেছিলেন। কতদিন আগে চালু ছিল ওটা?

বিগত ১২ বছর ধরে বিভিন্ন সময় চালু হয়েছে… বন্ধ হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খনিতে কোনো কাজকর্ম চলেনি।’

‘গোয়াডালক্যানেলের সাথে সোনার কোনো সম্পর্ক আছে বলে শুনিনি কখনও।

‘অনেক আমেরিকানই বিষয়টা জানে না। তারা শুধু এই দ্বীপের কথা জানে, কারণ ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের বিরুদ্ধে এই দ্বীপকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু সোনা হলো আমাদের মূল সম্পদ। সোনার কারণেই কিন্তু এই দ্বীপের নাম সলোমন আইল্যান্ড রাখা হয়েছিল।’

তাই?’ প্রশ্ন করল রেমি।

‘হ্যাঁ। স্প্যানিশরা যখন ষোড়শ শতাব্দীতে এখানে আসে তখন তারা মাটানিকো নদীর মুখে সোনা পেয়েছিল। তাদের নেতার নাম ছিল অ্যালভারো ডি ম্যানডেনা ডি নেই। সেই নেতা তখন ঘোষণা করলেন এই এলাকা থেকেই হয়তো বাইবেলে বর্ণিত রাজা সলোমন তার বিখ্যাত সোনা পেয়েছিলেন। সেই ধারণার উপর ভিত্তি করে নেইরা এই দ্বীপের নাম দিলেন সলোমন আইল্যান্ড। তিনি একজন সাধারণ ভ্রমণকারী ছিলেন। ভূগোল সম্পর্কে তার ধারণা কম থাকতেই পারে।

মজা তো।’ বলল রেমি। আসলে কখনও কখনও কাল্পনিক কাহিনির চেয়েও বাস্তব সত্য অনেক বেশি আশ্চর্যজনক হয়।’

স্যাম সামনে ঝুঁকল। আচ্ছা, মূল প্রসঙ্গে আসি। টমের গল্পের ব্যাপারে আপনার কী মত?’

 ‘মানুষ গায়েব হয়, এটা সত্য। আর দিনকে দিন গায়েব হওয়ার পরিমাণ বাড়ছে মনে হয়। কিন্তু আমি সেটার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত নই। কোনো দুর্ঘটনা, ডুবে যাওয়া, কুমীর… এগুলোর মধ্যে যে-কোন কারণেই মানুষ গায়েব হতে পারে। আমরা নিয়মিত রিপোটিং করছি যাতে মানুষ উধাও হওয়ার যথাযথ কারণটা খুঁজে বের করতে পারি। বিষয়টা অনেকটা মহামারীর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ জন করে গায়েব হয়। তবে সে-হিসেবে এত কম মানুষ খেয়ে জায়ান্টরা কত-ই-বা ক্যালরি পায়? মাঝে মাঝে ভাবি, এত কম ক্যালরিতে ওদের চলে?’

‘আপনি নিশ্চয়ই জায়ান্টের গল্পে বিশ্বাস করেন না?’ রেমি প্রশ্ন করল।

‘টম মানুষ হিসেবে ভাল। তবে আমি বাস্তব দুনিয়ার থাকতে পছন্দ করি… যতটুকু সম্ভব আরকী। রূপকথার যাবতীয় বিষয় আমি অন্যদের উপর ছেড়ে দিয়েছি। ওসব নিয়ে আমার আগ্রহ নেই।’

দ্বীপের কিছু অংশকে তিনি অভিশপ্ত” বলেছেন। কারণ কী?

কী হতে পারে? হয়তো ওখানে কুমীরের আনাগোনা বেশি, তাই। আসলে প্রত্যেকটা অভিশাপঅলা কাহিনির পেছনে যুক্তিযুক্ত বাস্তব কারণ থাকে। সেটা বোঝার জন্য রকেট সাইন্স জানার প্রয়োজন পড়ে না।

আচ্ছা। আমরা আগামীকাল রুবো’র সাথে দেখা করার পর সোনার খনি দেখতে পাব বলে ঠিক করেছি।’

 ‘আশা করি, রুবো এখনও পরলোক গমন করেনি। আর সোনার খনিতে আসলে দেখার মতো কিছু নেই। বন্যার কারণে খনি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপরে আর ভোলা হয়নি।’

 ‘আমাদের হাতে অনেক অবসর সময় আছে। তাই এটা-সেটা দেখব। আচ্ছা, জায়ান্টরা যে গুহাগুলোতে থাকে… সেগুলো কোথায়?’

 ‘পাহাড়ের উপরে,’ অস্পষ্টভাবে বলল ম্যানচেস্টার। কিন্তু ওখানে যাওয়ার জন্য কোনো ভাল রাস্তা নেই। খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয় ওদিকটা। আপনারা কোন দুঃখে ওদিকে যেতে চাচ্ছেন, আমার মাথায় ধরছে না। সময় কাটানোর কত উপায় আছে। ডাইভিং, মাছ ধরা,…’।

ম্যানচেস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের দিকে ফিরল ফারগো দম্পতি।

‘টমের গল্প শুনে ম্যানচেস্টার খুশি হয়নি বলে মনে হলো, তাই না? স্ত্রীকে বলল স্যাম।

হুম। হয়নি। তবে ম্যানচেস্টারের মধ্যে অন্য একটা ব্যাপার আছে। সেটা কী, আমাকে প্রশ্ন কোরো না কিন্তু। ‘ও আচ্ছা, তুমিও টের পেয়েছ? আমি ভাবলাম, শুধু আমার চোখেই পড়েছে বিষয়টা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *