ডাঃ নন্দি বোঝে যে, ছেলেটা রেড-গ্রিন কালার ব্লাইন্ড, সে একটা কাগজের মধ্যে কলম দিয়া খসখস করে লেখে, প্রোটানোপিয়া/ডিউটারানোপিয়া; কিন্তু তখন ডা: নন্দির ফোন আসে, অন্য একটা ঘরে গরুর শিঙ্গার মত কাল রঙের টেলিফোন ঝনঝনায়া বাজে, এবং সে উঠে যায়া, হ্যালো হ্যালো হ্যালোরে করে ফিরা এসে দেখে যে, টেবিদ্রে উপরে কাগজটা নাই-হয়তো সে ফিলোসফার টাইপের ডাক্তার ছিল, ফলে দেখা যায় যে, কাগজটার কথাও সে ভুলে যায়-এবং চানমিঞা এবং তার টিচারও তখন চলে গেছে। ডাক্তার নন্দি যখন সকলের সঙ্গে চানমিল্লার মেডিকেল শিট তৈরি করে, তখন সে লেখে, চুলের রঙ কালো, চোখ বাদামি, চোখের দৃষ্টি ৬/৬ (চশমা ছাড়া), কোনো বিশেষ স্বাস্থ্যগত সমস্যা নাই; বর্ণকানা পোলাটা এইভাবে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে অনবহিত হয়া থাকে। ফলে মেরি নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় যায়া এইসব গল্প ববকে বলে, তখন হয়তো জুলি খুবই ছোট, কিন্তু সে হয়তো তার জীবনের প্রথম থেকেই মায়ের স্কুলের গল্প শোনায় অভ্যস্ত হয় ওঠে, প্রতি বছর তালিকায় নতুন নাম যোগ হয়, লুঙ্কুল, মাসুদ, দেলোয়ার, তারপর আসে চানমি; তখন প্রাইজ গিভিং ডে-তে চানমিঞাকে সে দেখে এবং তার মাকে যখন বলে, হু ইজ হি? মেরি বলে, হি ইজ মাঙ্কি বয়! জুলি ফ্লোরেন্স হয়তো চানমিঞার কথা তার মার কাছে আগেই শুনেছিল-ক্লাসে একটা পোলা আছে, এই ছোট্ট পিচ্চি, সকলে তাকে মাঙ্কি বয় বলে-সেই কারণে মেরি যখন জুলিকে বলে যে, এইটা মাঙ্কি বয়, তখন জুলি তাকে চিনতে পারে, তাহইলে এইটা সে, এবং বালিকা জুলি তার মাকে বলে, ওকে আমাদের বাসায় আসতে বলো না, আমি ওর সাথে খেলব; কিন্তু সেটাতো আর সম্ভব না, কোন কারণ ছাড়া শুধু জুলির সঙ্গে খেলার জন্যভো চানমিঞাকে বাসায় নিয়া যাওয়া যায় না, তবে মামুন এবং লেদুর সঙ্গে চানমিঞা জুলির পরবর্তী জন্মদিনে যোগ দেয়। ছেলে মেম সাহেবের বাসায় দাওয়াত খেতে যাবে এই খবর পায়া খৈমন অস্থির হয়া পড়ে, রথখোলার মোড়ে যায়া চানমিঞার লাল নটিবয় জুতা কালি করায়া আনে, চানমিঞার হতি/পাওয়ে সরিষার তেল মাখায়া মুখে তিব্বত স্নো লাগায়া দিয়া বলে, যা এ্যালা, এবং পোলা তার মেম সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায়। মেরি তাদেরকে স্কুল থেকে নিয়া যায় এবং তখন চানমিঞার সঙ্গে জুলির দেখা হয়, মেরি তার মেয়েকে ডেকে আনে, জুলি, এই যে ছানমিঞা, হ্যালো বলো, বলল হ্যালো চানমিঞা? তখন জুলির হয়তো মনে পড়ে যে, চানমিঞা হচ্ছে মাঙ্কিয়! কারণ এইসব বিটলা পোলাপান কিছুই ভোলে না, সে তাকে হ্যালো বলে এবং জিগাস করে, তুমি কি মাঙ্কি বয়? এবং মেরি তাকে থামায়া সারতে পারে না, ছিঃ জুলি এইসব বলে না; ফলে জুলি তখন তাদের নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় বসে বিকাল বেলা মামুন এবং ফখরুল আলম লেদুর সঙ্গে গল্প করে, এবং চানমিঞার কথা মনে হলে সে জিগাস করে, কোথায় সে এখন? এই প্রশ্ন শুনে মামুন যতই পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করুক, লেদুর মনে হয় যে, জুলি এত চানমিঞার কথা জিগাস করে কেন! তখন সে একদিন “চানমিঞার খোঁজে বের হয়, তার মনে হয় যে, চানমিঞার সঙ্গে তারও বহুদিন দেখা হয় না, কি করে সে এখন? কি করে এই পোলাটা? চানমিঞা? এই খবর তার মা খৈমন হয়তো সবচাইতে ভাল জানে, পোলার পিছনে যে যৌবন খোয়ায় বসে থাকে, পোলা তার বড় হবে, জোবেদা বেগমের পোলা মামুনের মত সে তাকে সিলভারডেল স্কুলে নিয়া যায়া ভর্তি করে, ঠোঙ্গা বানায়া বেইচা পোলার স্কুলের বেতন দিতে পাছা দিয়া ধুমা, ছুটে যায় তার, তবে প্রথম দিকে চানমিঞা এই ধুমা ছোটার দাম দেয়, কেজি ওয়ান থেকে পাশ দিয়া কেজি টুতে ওঠে, সেকেন্ড থার্ড কিছু একটা হয়-অভিজিৎ হয় ফাস্ট-সে তার স্কুল থেকে নতুন বইয়ের তালিকা নিয়া আসে, খৈমন তখন নুরানি বিলকিস উপমাকে যায়া ধরে, আফা আমারে কয়টা ট্যাকা দেন, নাইলে আমার পোলাআর পড়ালিখি আমি কেমনে চালাই!
খৈমনের এই কথায় নুরানি বিলকি অবাক হয়, এই বেটি বলে কি, আশ্চর্য, তর পোলারে ইংরেজি স্কুলে কি আমরা দিবার কইচি নিহি, অখনে আয়া কচ পোলার লেখাপড়ির লাইগা টাকা দেন, আরে, এই মারিতে মহা চালুরে বাবা! নুরানি বিলকিস এমন একটা ভাব করে যেন সে বুঝতেই পারে নাই খৈমন কি বলে, তারপর সে বলে, তর রেশন কাট কয়টা? এবং খৈমন যখন বলে যে, তার তিনটা রেশন কার্ড, দুইটা সাদা রঙের ফুল কার্ড-তার একটার মালিক জরিমন ইতিমধ্যে মরে ভূত হয়া গেছে—অন্য আর একটা নীল রঙের হাফ কার্ড, চানমিঞার; তখন উপমা বেগম একটুখানি ভেবে বলে, তুই দুই সেট রেশন কাট বানায়া ল, এবং খৈমন তাই করে, সে বিশটা করে মোট চল্লিশটা অতিরিক্ত সাদা কার্ডের মালিক হয়, নুরানি বিলকিসের স্বামী ফজলুর রহমান এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে, খৈমনের কোন ঝামেলা হয় না, সে প্রত্যেক সপ্তাহে দুইটা রেশন দোকান থেকে দুই সেট কার্ড দিয়া প্রতি সাদা কার্ডে দেড় সের করে চাইল উঠায়, চিনি এবং গম উঠায়, এবং ঠাটারি বাজারে নিয়া যায় মুদি কিংবা চাইলের দোকানদারদের কাছে বেচে। ঠোঙ্গা বনানো এবং রেশনের মাল বেচা পয়সা দিয়া সে চানমিঞাকে সিলভারডেলের চাইর ক্লাস পর্যন্ত টেনে নিয়া যায়, চানমিঞা যখন স্কুল থেকে পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড নিয়া আসে সে সেটা নিয়া যায় পূর্ণলক্ষ্মীর কাছে, পূর্ণলক্ষ্মী তখনো ঘরে শুয়ে বসে ঘুমায়া : মোটা হয় এবং বছরে চাইর বার খৈমনকে চানমিঞার প্রোগ্রেস রিপোর্ট পড়ে শোনায়-খৈমন তাকে এক ভালই কাজ দেয়-প্রোগ্রেস রিপোর্ট কার্ড পড়ে সে বলে, তুমার পোলাতো ছাত্র ভালই, থার্ড হইছে, দুই বিষয়ে একশর মইদ্দে একশ, তারপর পূর্ণলক্ষ্মী অবিভাবকের স্বাক্ষরের ঘরে সই করে দেয়, খৈমন বেগম। তবুও খৈমনের হয়তো আশা ছিল তার ছেলেটা মানুষ হবে, ময়না–মিঞার সঙ্গে বিয়া হওয়ায় সে কিছুই পায় নাই, এই পোলাটা ছাড়া; মেরি জয়েসের হয়তো মনে হয়েছিল যে, চানমিঞা অনেকদূর যাবে, কিন্তু খৈমনের পোলার জীবনের পথ হারানো খুব অসম্ভব ছিল না। মেরি জয়েস ক্লার্ক হয়তো ভেবেছিল যে, ছেলেটাকে সে সিলভারডেলের চৌকাঠ পার করে দেবে, বেচারা গরিবের পোলা; কিন্তু সে হয়তো বোঝে নাই যে, ভালবাসাই চানমিঞাকে বাঁচানের জন্য যথেষ্ট ছিল না, শুধু চোখের পানি আঙ্গুল দিয়া মুছে দিয়া চানমিঞার জীবনের বিচিত্ররকমের সঙ্কট দূর করা যায় নাই, ফলে মেরি ভুলের ফান্দে পড়ে, সে একদিন ক্লাসে মামুন কিংবা অভিজিৎ কিংবা লেদুর মত চানমিঞাকে আদর করে চান্দু বলে ডেকে ঝামেলা তৈরি করে, চানমিঞা বিষয়টা একদম পছন্দ করে না, সে এরপর তিনদিন স্কুলে আসে না, তখন মেরি চিন্তিত হয়া পড়ে, কি হইলো পোলাটার? এবং তখন খৈমন এসে তাকে স্কুলে দিয়া যায়, খৈমন তার দাঁতের ফাঁকে শাড়ির আঁচল কামড় দিয়া ধরে হাসে, পান-দোক্তা খাওয়া তার কালা দাঁত ভেটকায়া রাখে, মেরি জয়েসের দিকে তাকায়া সে বলে, আফা আপনে অরে চান্দু বলছেন সেইজন্য ও লজ্জা পাইছে, আমাকে বলে, টিচার আমারে চান্দু বলছে!
মেরির মনে তখন খুব কষ্ট হয়, কারণ কষ্ট পাওয়ার জন্যই মেরি জয়েসের জন্ম, সে ভাবে এই পোলাটাকে সে কত না ভালবাসে, তার জন্য কত কি না সে করে, ফলে সে একদিনদুইদিন গম্ভীর হয়া থাকে, চানমিঞা এটা করে, সেটা করে, খাতায় একটা সাম করে নিয়া যায়া দেখায়, কি মেরি তার দিকে তাকায় না, তখন চানমিঞাঁ কেন্দে ফেলে, মেরি দেখে, সে কাছে এসে বলে, কান্দ কেন, কেন কান্দ তুমি? আশ্চর্য!
চানমিঞা তখন কি বলবে? সে হাত দিয়া মুখ ঢেকে আরো কান্দে, কেন্দে ভাসায়, এবং তখন মেরি জয়েস তার মাথায় হাত বুলায়া দেয়, ওকে ওকে, ডোন্ট ক্রাই, ওকে!
চানমিঞা তার জীবনে দ্বিতীয়বার মেরি জয়েসের হাত চোখের পানিতে ভিজায়া দিয়া সুস্থির হয়, হয়তো মামুন তার মা মিসেস জোবেদাকে সব বলে, এবং জোবেদা বেগম এইসব কথা শুনে বলে, আল্লাদ, নাটকের দেখি শ্যাষ নাইকা; কি চানমিঞা ছিল কেমন যে তেরাবাকা পেলা, সিদাই হতে পারে না, ফলে জুলি ফ্লোরেন্স তার জন্মদিনের পার্টিতে যখন তাকে জিগাস করে সে মাঙ্কি বয় কিনা তখন তার এত রাগ হয় যে, রামকৃষ্ণ মিশন রোডের মোড় থেকে বারি স্টুডিওর ফটোগ্রাফার এসে যখন তার গলায় ঝোলানো ক্যামেরার উপরের ঢাকনি টেনে তুলে ডাইন হাতে ফ্লাশ গান উঁচা করে ধরে, তখন চানমিঞা সেখান থেকে সরে যায় বেলকোনিতে খাড়ায়া থাকে। মামুন এবং ফখরুল আলম লেদুর সঙ্গে পরে জুলি যখন তাদের ফ্যামিলি এলবাম দেখে, তখন এই ছবিটা তাদের সংযুক্ত শৈশবের স্মৃতি হয়, ছবির মাঝখানে রবার্ট একটা বো-টাই পরে খাড়ায়া আছে, এই ছবির মধ্যে কত লোক, শুধু চানমিঞা নাই-কেন নাই? নাই ক্যালা?
: হোয়্যার ওয়াজ হি?
মামুনুল হাই বলে যে, সেইদিন হয়তো চানমিঞা এই অনুষ্ঠানে ছিলই না; কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের জানা ছিল-কিভাবে জানা ছিল বালা মুশকিল-যে, চানমিঞা অবশ্যই এসেছিল এবং সে মনে করতে পারে যে, সে চানমিঞার দেওয়া একটা লেবেথুসও খেয়েছিল; জুলি তখন তাদের ড্রয়িংরুমে বসে মামুন এবং লেদুকে বলে, বাট হি ওয়াজ দেয়ার, সে আমাকে চকলেট না কি যেন দিয়েছিল একটা!
মোটা লেদুরও বিষয়টা মনে পড়ে, সে জুলিকে বলে যে, চানমিঞা তাকে একটা কলাও দিয়েছিল খেতে; জুলির তখন তার মার কলা খাওয়া সম্পর্কিত সাবধান বাণীর কথা স্মরণ হয় এবং সে বলে, কলা খাব কেন, কলা খাওয়ার প্রশ্নই আসে না!
: খাইছ, আমার মনে আছে আমিতো বানায়া বলতেছি না, কলী খাইতে অসুবিধা কি?
জুলি তখন হতাশ হয়া পড়ে, তার মনে হয় যে, তার মা হয়তো তাকে অনেক দেরি করে সবধান করেছিল, কলা এবং পুরুষ মানুষ সম্পর্কে অবশ্য চানমিঞা তখন পুরুষ মানুষ ছিল না, তবুও—এবং সে পুনরায় জিগাস করে, লেদুভাই আপনেদের মাঙ্কিবয় এখন কোথায়?
লেদুর তখন মনে হয় যে, চানমিঞাকে জুলি ফ্লোরেন্স ভোলে নাই কেন? একটা চকলেট খাইছিল কত বছর আগে, সেইটা মনে করে রেখেছে, হোয়াই, কেন? এত কিছু কেন মনে রাখে এই মেয়েটা? হয়তো এমনি রাখে, মামুন তাকে এ ব্যাপারে সবচাইতে ভাল ব্যাখ্যা দেয়, সে বলে যে, কেউ যদি মাক্কিবয় হয় তাকে লোকে মনে রাখবে, এইটাই স্বাভাবিক, মামুনুল হাই, ফখরুল আলম এদেরকে কেউ মনে রাখবে না, এইটাও স্বাভাবিক-ফলে মাঙ্কিবয় হওয়ার কারণে চানমিঞা সুবিধা পায়-জুলি হয়তো বলে, চানমিঞাকে মাঝিবয় বলে কেন?
: হি ওয়াজ ব্ৰটআপ বাই এ শি মাঙ্কি।
: ইট ইজ ভেরি মাচ পসিবল, দুই ভাই রোমুলাস এবং রেমাস নেকড়ে বাঘের দুধ খায়া বড় হয়েছিল, পরে তারা রোম নগরের প্রতিষ্ঠা করেছিল।
: তাই নাকি? ইজ ইট সো!
: অফকোর্স ইট ইজ, হোয়াই?
হয়তো মামুন বলে, ওকে লেটস ফরগেট ইট, এবং ফখরুল আলম লেদুর মনে হয় যে, চানমিঞাটা এখন কোথায়? হয়তো খৈম জানে, কারণ জন্ম দেওয়ার পর রাজাকারের ভয়ে খৈমল তাকে পোটলার মধ্যে জড়ায়া রাখে এবং বলে যে, তার পোলার জন্ম ১৬ই ডিসেম্বর; মেরি জয়েস হয়তো বিষয়টা কেজি ওয়ানের প্রথম কোয়ার্টারের প্রোগ্রেস রিপোর্ট লিখতে যায় খেয়াল করে, সে লেখে, ফাদার্স নেম, লেট ময়না মিঞা, ডেট অব বার্থ…, তখন মেরি জয়েস চমকৃত হয়, কি সুন্দর একটা পোলা তুমি ছানমিঞা, বিজয় দিবসে তোমার জন্ম, কি চমঙ্কার একটা বিজয়, তখন টিচার্স কমেন্টসের ঘরে যায়া মেরি লেখে, হি ইজ এক্সসেপশনালি গুড়, হি ইজ আওয়ার হোপ! কিন্তু চানমিঞাকে হয়তো মামুন কিংবা লেদু কিংবা অন্য কেউ পোটলার পোলা বলে গাল দেয়, হয়তো একদিন স্কুলে চানমিঞার সঙ্গে কেউ একজন মাঞ্জা দেওয়া সুতা দিয়া ধিরি কাটাকাটি খেলে, হয়তো চানমিঞার সুতার টানে মামুন কিংবা লেদু কিংবা অভিজিৎ-এর ধিরি কেটে যায় এবং তখন ঝগড়াটা লাগে এবং চানমিঞাকে সে পোটলারপোলা বলে। সেইদিন বাসায় ফিরা সে দেখে যে, খৈমন ঘরে নাই, বান্দরেরা দেওয়ালের উপরে লাইন দিয়া বসে আছে, দাদা বান্দর, বাপ বান্দর, পোলা বান্দর, নাতি বান্দর, এবং অনেক বান্দরনিও, তাকে দেখে এই বান্দরের লাফঝাপ দেয়, কান্ধের উপরে এসে বসে, কিন্তু চানমিঞার মন খারাপ হয়া থাকে, মাঙ্কিবয় একরকম জিনিস, পোটলার পোলা অনারকম, এর মানে কি? তার জীবনে কি এইসব শেষ হবে না? হায় আল্লা! তখন হয়তো ঠাটারি বাজারে ঠোঙ্গা বেচা শেষ করে খৈমন পড়ন্ত বিকালে বাড়ি ফিরা দেখে যে, ঘর অন্ধকার, বান্দর বাহিনী দেওয়ালের উপরে গালে হাত দিয়া চুপ মাইরা আছে, তার মনে হয় যে, এত ভাল হয়া গেল এই বান্দরের বাচ্চা বান্দরগুলা, আশ্চর্য! তখন সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে, চানমিঞা অসময়ে চৌকির উপরে শোয়া, তারতো ভয় লেগে যায়, পরাণে পানি থাকে না, কিরে কি হইলো? সে কাছে যায়া পোলাকে উঠায়, কাপালের মাঝখানে চোপস করে একটা চুমা খায়া জিগাস করে, কি হইলো তর বাপ, আব্বা, শৈল ভালা লাগতাছে না? এবং তখন চানমিঞা যা বলে, তা শুনে, খৈমনের আক্কেলগুড়ুম হয়, ইচ্ছা হয় একটা চটকা লাগায়, লাঠি দিয়া মারে; চানমিঞা বলে, আমারে পোলাপান পোটলার পোলা কয় ক্যালা? এই কথা শুনে মোছা: খৈমন আর কি করবে, সে হয়তো নিজের কপালে নিজেই থাপ্পড় মারে, বেকুব হয়া বসে থাকে, কি বলবে সে? এই পোলা এক পাতা না গজাইতেই তার জন্মের বিষয়ে মাকে জেরা করে, কৈফিয়ত চায়, হায় খোদা; রাগে দুঃখে অপমানে তার চোখ ফেটে পানি আসে এবং সে বলে, যারা তরে পোটলার পোলা কয় হাগো থোতা ফাড়ায়া দে না কালা? আয়া ঘরের ভিতরে শুয়া থাকচ!
চানমিঞার সামনে তার মা মোছা: খৈমন একটা চ্যালেঞ্জ খাড়া করে দেয়, হয়তো স্কুলে তার ক্লাসের লিয়াকত হোসেনের সঙ্গে সে একদিন মারামারি করে-পোলাপানের মত বড় বান্দরবো আর হয় না-হয়তো কোন খেলা খেলতে যায়, কিংবা সি-সতে চড়া নিয়া ঝগড়ার পর লিয়াকত বলে, পোর্ট…, এবং চানমিঞা ভাবে যে, লিয়াকত হয়তো পোটলা বলে নাই, সে তার সঙ্গির সঙ্গে সি-স নিয়া ধপধাপর চালায়া যায়, পাশে খাড়ায়া থেকে লিয়াকত হয়তো তার দিকে তাকায়া বলে, পোটলা, এবং তখন, তারপরেও হয়তো চানমিঞা ভাবে যে, ঠিক আছে, এইটা কিছু না; কিন্তু লিয়াকত পোলাটাও বদ ছিল, সে তখন বলে, পোটলার পোলা, ফলে চানমিঞাকে কিছু করতেই হয়, তার মা বলেছিল হোতা ফাটায়া দিতে, এবং সে সি-স এর ভেঁকি থেকে নেমে লিয়াকতকে জাপটায়া ধরে, ধাক্কায় মাঠের এক কিনারায় নিয়া যায় মাটিতে ধূলার মধ্যে ফালায়া দেয়। সেইদিন স্কুলে চানমিঞা শাস্তি ভোগ করে, দারোয়ান রামদাস তাকে ধরে নিয়া যায় প্রিন্সিপালের সামনে হাজির করে এবং রোকেয়া আনোয়ার উঁচা টেবিলের পিছনে বসে তাকে জিগাস করে, লিয়াকতকে তুমি কেন মেরেছ?
চানমিঞা কি বলবে? সে মাথা নিচা করে খাড়ায়া থাকে এবং রোকেয়া আনোয়ার এই সহিংসতার জন্য তাকে শাস্তি দেয়, স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত অফিস ঘরের এক কোনায় চানমিঞা খাড়া হয়া থাকে। এই খবর হয়তো মেরি ক্লার্কের কাছে যায়, তার হয়তো মন চায় গরিব পোলাটার জন্য কিছু করে, অফিস ঘরে যায়া হাত ধরে বের করে নিয়া আসে, কিন্তু তার ভয় হয়, রোকেয়া আনোয়ার যে জাদরেল মহিলা, সে তাকে বকাবকি করবে, মেরি তুমি এই রকম কর কেন, তুমি পোলাপান নষ্ট করতেছ; ফলে সে একে জিগাস করে, তাকে জিগাস করে, শেষে চানমিঞার স্ট্যান্ডার্ড টু এর টিচার রোজালিন ডি কস্তা তাকে ব্যাপারটা বুঝায়া বলে এবং মিসেস ক্লার্ক যারপর নাই বিভ্রাম্ভ হয়া পড়ে, হোয়াট ডাজ ইট মিন, পোটলার পোলা?
: সান অফ এ ব্যাগেজ, দ্যাটস হোয়াট ইট মিনস!
: বাট হোয়াই গুড় হি বি সান অফ এ ব্যাগেজ, ও মাই গড!
তখন, পরদিন কিংবা তারপর দিন, কিংবা তারও পর দিন মেরি হয়তো চানমিঞাকে খুঁজে বের করে বলে, লিয়াকতের সঙ্গে মারামারি করছ কেন, তুমি কি ছোট আছ? ছুটু সে নাই, ছুটুকাল হলে মেরির এই কথায় সে নির্ঘাত কানতো, কিন্তু এখন সে আসলেই বড় হয়া গেছে, কান্দার সুযোগ কম, ফলে মেরি জয়েন্স তার ডাইন হাতটা চানমিঞার কান্ধের উপরে যখন রাখে তখন চানমিঞার মনে হয় যে, দরজার কপাটের ফাঁক দিয়া আসা তেরছা আলোর মত, একটা আলোর শুম্ভ তার শীর্ণ কান্ধের উপরে এসে পড়ে, এবং সে তার মুখটা এই আলোর দিকে ফেরায়, সামনে খাড়ায়া থাকা মেরির মুখের দিকে দেখে; মেরি জয়েস বলে, কেন এইরকম করো, এ্যা, হোয়াই?
: আমাকে পোটলার পোলা বলছে!
: সেই জন্য মারবা ওকে?
খৈমন হয়তো ভেবেছিল, এত সইহ্য করা ভাল না, কেউ ইটা মারলে কখনো পাটকেলটা মারা ভাল, কিন্তু সব হিসাব আউলায়া যায়, স্কুলে লিয়াকতের সঙ্গে মারামারি করে শাস্তি ভোগের পর একসময় চানমিঞা স্কুল কামাই দিতে থাকে, ভূতের গল্লিতে মামুনের ছুটু ভাই মাহমুদকেও দুর্বল পায়া কি কারণে একদিন সে মারে, দুই চাইরটা কিল থাপ্পড় লাগায়, কিন্তু এর ফলে মাহমুদ এমন চিৎকার শুরু করে যে, মিসেস জোবেদা রহমানের পুরা পরিবার একজোট হয়া চানমিঞাকে ধরে, এবং পিটায় তার নাকলা ফাটায়া দেয়-খৈমন লাঠি নিয়া যায়া পোলাকে উদ্ধার করে আনে। তখন চানমিঞা আর স্কুলে যেতে চায় না, খৈমন রাগ করে, বকাবকি করে, কান্দে, কিন্তু চানমিঞার শরীরেতো ছিল ময়না মিঞার রক্ত, তাতে ছিল অলসতা, ফলে চানমিঞা লেখাপড়া নিয়া ক্লান্ত হয় যেতে থাকে, স্কুলের পোলাপানও তার পিছনে কাউয়ার মত লাগে, তার জীবন অতীষ্ঠ করে তোলে, সে খৈমনকে বলে যে, সে তার সঙ্গে ঠোঙ্গা বানাতে চায়, তোমার লগে আমি ঠোঙ্গা বানায়া বেচুম, পোলাপান আমারে মাকিবয় কয়, পোটলার পোলা কয়, স্কুলে যামু না আমি; এবং তখন শৈমন বোঝে যে, পোটলার ভিতর থেকে ছেলের এই জন্মের বিষয়টা ভাল হয় নাই, তার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়া যায়। তখন জোবেদা বেগম এবং তার পরিবারের দুষ্কর্মের কথা হয়তো বন্দরে শোনে, তারা হয়তো ভাবে, কি এত বড় কথা, একটা বাপ মরা এতিম পোলারে ব্যাকতে মিল্লা মাইরা ফাটাইলো? এবং এটা বান্দর-চানমিঞার প্রথম খেলার সাথি ছিল যে শিশু-বান্দরটা, হয়তো সেইটা-একদিন মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমানকে তাদের বাসার কুয়াতলায় দাঁত বের করে এমন একটা ভেটকি দেয় যে, জোবেদা বেগম। শ্যাওলা জমে পিছলা হয়া থাকা শানের উপরে হাড়িপাতিল থালাবাসুন নিয়া পড়ে যায়, তার মোটা কোমরের হাড্ডি ভাঙ্গে না, কিন্তু সে ভাল ব্যাথা পায়, আমার মাজা গেল, আমি শ্যাষ হয়া গেলাম, বান্দরেরা আমারে মাইরা ফালাইলো, বলে সে কান্দে, ফলে কোমরে আয়োডেক্সের মালিশ লাগায়, গরম সেক দিয়া, বিছানায় পড়ে থাকা লাগে অনেক দিন; তখন তার কিছু করার থাকে না, কারণ বান্দরের বিরুদ্ধে এই দেশে কিছু করার নাই, তাদের ধরতে পারার উপায় নাই-যদিও হয়তো বন্দুক দিয়া গুলি করা যায়—এতগুলা বান্দরকে গুলি করে মারাও মুশকিল। কিন্তু বান্দরের বিরুদ্ধে কি থানায় যায় নালিশ করা যায় না? পুলিশ কি এই বিষয়ে কিছু করতে পারে না? তখন জোবেদা বেগমের স্বামী গোলাম রহমান সূত্রাপুর থানায় গেলে দারোগা অভিযোগের বিবরণ শুনে বলে, খুব কঠিন কেস, এইগুলা জংলি বান্দর, কোন মালিক নাই, বেওয়ারিশ, পেনাল কোড অনুযায়ী পাবলিক নুইসেন্সের আওতায় ফেলানো খুব মুশকিল, তার থেইকা হাতের কাছে একটা লাঠি রাখতে বইলেন, তখন চানমিতো আর স্কুলে যায় না, মেরি জয়েস হয়তো অনেক কিছু ভাবে, এইরকমের একটা পোলার কত কিছু হতে পারে; পরে জুলি যখন মামুন এবং লেদুকে জিগাস করে যে, সে কোথায়? লেদুর মনে হয়, খৈমনতো জানবেই সে কোথায়, কারণ খৈমন হয়তো চানমিঞার মতিগতি দেখে হতাশ হয়া পড়ে, কিন্তু তার হয়তো এটাও মনে হয় যে, উপায় কি? মাইরা পিটায়া লাভ কি হবে, তার বাপ মরা এতিম পোলা, ঠিক আছে, তার রেশন কার্ড আছে দুই সেট, দিন চলে যাবে, ফলে সে হয়তো নুরানি বিলকিস উপমার বাড়িতে আসে এবং বানায়া বানায়া ফের আবোলতাবোল বলে, চানমিতে পড়তেই চায়, কিন্তু ভাইবা দেখলাম পড়ায় লাভ কি, আমরা গরিব মানুষ আফা, আমার লগে ঠোঙ্গা বানাইলে দুইজনে মিল্লা এই কাম করতে পারি।
নুরানি বিলকিস বলে, কর! আইজ কিছু লবি না?
: কি লম!
: তাল, তরকারি।
: না আফা, মনটা ভালা নাইকা, পোলাটা লেখাপড়া করলো না!
খৈমনের মন খুবই খারাপ হওয়ার কথা, কত চানমির অবস্থা তার বাপ ময়না মিঞার মতই খাড়ায়া যায়, সে শুয়ে বসে থেকে বান্দর নিয়া খেলা করে বড় হয়া ওঠে, তখন হয়তো বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে ঢাকা শহরের রেশন ব্যবস্থা এবং রেশনের দোকান সরকার একদিন উঠায়া দিলে খৈমনের দুই সেট রেশন কার্ড একদম বেকার হয়া যায়, বিছানার ভোশকের তলা থেকে মৈন তার মোট তেতাল্লিশটা কার্ড বের করে ছিঁড়া ফালায়া দিলে বাতাস সেগুলা উড়ায়া নিয়া যায়, খৈমন দেখে তার জীবনের শেষ ভরসা এলোমেলো হাওয়ায় ধূলার ভিতরে কেমন গড়ায়, এবং তখন সে বারান্দার কোনার খুপরি ঘরের ভিতর থেকে বহুদিনের পুরানো একটা বাঁশের টুকরি বের করে চানমিঞাকে বলে, ল পড়বি না যখুন, বাপের মত ঠাটারি বাজারে যায়া তরকারি বেচ গা, রাস্তায় রাস্তায় এই তরকারি এই তরকারি কয়া চিক্কার পাড় গা। চানমিঞার তখন হয়তো হুঁশ হয়, সে হবে তরকারিঅলা? অসম্ভব, কোনদিন না, তখন সে নায়াপল্টন যায়া শ্যাকাডেম ড্রাইভিং এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট-এ ভর্তি হয়, হয়তো সে কোন আদম ব্যাপারির খপ্পরে পরে, আদম ব্যাপারি তাকে হয়তো বলে, ডেইরিটা শিখা ফালাও, তুমারে সৌদি আরবে সাপেকো কম্পানিতে চাকরি দিয়া পাঠায়া দিমুনে, জেদ্দা-মদিনা রুটে বাস চালাইবা; এবং চানমিঞা তার মাকে বলে, আম্মা আমার লাইগা টাকা যোগাড় কর, আমি ড্রাইভিং শিখা সৌদি আরব যামু।
খৈমন তখন অবশ্যই নুরানি বিলকিস উপমাকে বলে, চনিমিঞয়িতো আফা ডেরাইরি হিকা মিডিলইস্ট যাইতে চায়, এবং তার কথা শুন নুরানি বিলকিস বলে, টাকা লাগবো অনেক, পাবি কৈ?
: কইতে পারি না কৈ পামু!
চনিমিঞা যখন ম্যাকাডেম ড্রাইভিং এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট-এ ভর্তি হয়, সে যে রঙ কানা তা জানার আরেকটা সুযোগ আসে তার, কিন্তু মানুষের আবিবেচনা, দুনীতি এবং দ্বায়িত্বহীনতার জন্য এইটাও হাতছাড়া হয়; ট্রেনিং ইনস্টিটিটিউটের মালিক কাম ইন্সট্রাক্টার, রহমান/দত্ত কিংবা গোমেজ, ষাইট দশকের মডেলের একটা নিসান ডাটসান গাড়িতে এল-প্লেট লাগায়া মতিঝিল কলোনির ভিতরের রাস্তায় এবং মাঠে চানমিঞাকে গাড়ি চালান শেখায়, পিছনের সিটে সৌদি আরব কিংবা দুবাই কিংবা কুয়েত গমন প্রত্যাশী আরো তিনজন বসে অপেক্ষা করে, তখন রহমান অথবা দত্ত অথবা গোমেজ-হয়তো রহমানই—ফেকচার দেয়, এইটা বাম্পার, এইটা বনেট, এইটা বুট; দেখেন পায়ের সামনে তিনটা পেডেল, পাও দিয়া চাপ দেন, ডাইনেরটা এসকালেটর, বামেরটা কেলচি, মইদ্দেরটা বেরেক, যখন গাড়ি চালাইবেন দূরে রাস্তার দিকে তাকাইবেন, বনেটের উপরে তাকায়া থাকবেন না। সে তখন তার অফিস ঘরে বসে থিওরিটিক্যাল জিনিস শেখায়, দেওয়ালের গায়ে লোহার পেরেকের সঙ্গে ঝুলান চার্টের দিকে তাকায়া বলে, দেখেন খেয়াল করেন, ডাইন দিকে মুখ করা একটা কা রঙ্গের এ্যারো, তার উপরে লাল রঙ্গের প্যাট কাটা একটা সার্কেল, মানে কি? মানে হইলো ডাইনে মোড় নিতে পারবেন না; তারপর সে তিন রঙের সিগনাল বাত্তির ছবিসহ একটা প্লাকার্ড ঝুলিয়া দিয়া টুলের উপরে চানমিঞাকে বসায়া যখন বলে, কয়টা বাত্তি দেখেন? চানমিঞা বলে, তিনটা।
: উপরেরটা জ্বললে কি করবেন? এইটা কি?
: ছাই রঙ, গাড়ি থামুমু।
রহমান বিভ্রাপ্ত বোধ করে, সে বলে, মইন্দেরটা জ্বললে? এইটা কি রঙ?
: সোলো করুম, এইটা হইলদা।
: নিচেরটা?
: এইটা ছাই রঙ, নিচেরটা জ্বললে চালামু।
: যুদি বাত্তি কাইত করা থাকে?
: এইগুলা আমি জানি, বামেরটা জ্বললে খমামু, ডাইনেরটা জ্বললে চালামু।
চানমিঞা উপর-নিচ, ডাইন-বাম করে তার বিদ্যার্জন শেষ করে, রহমান বোঝে যে, ভোদাইটা রঙকানা, কিন্তু সে তা চেপে যায়; কারণ এর কোন সমাধান নাই এবং রঙচেনে না বললে, বিআরটিএ-এর কাছ থেকে লাইসেন্স পাওয়ার উপায় নাই। তখন চানমিঞাকে ধৈমন তার কষ্টে গড়া সঞ্চয় ভাঙ্গায় আড়াই হাজার টাকা যোগাড় করে দেয়, এবং রহমান ঘুষ দিয়া এনে দেয় লাইসেন্স; ফলে চানমিঞার আর জানাই হয় না যে, সে দুইটালিক রঙই দেখে না। খৈমন হয়তো নুরানি বিলকি উপমার বাড়িতে মায়া কান্দাকাটি করে, অখনে কি করি কনতো আফা, আমি অখনে পঞ্চাইশষাইট হাজার টাকা কৈ পাই, কেমনে পাঠাই সৌদি আরব?
নুরানি বিলকিস চুপ করেই থাকে, খৈমনের এই সব নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যার সমাধান তার জানা নাই, সে কোন টাকা পয়সা দিতে পারবে না, সে খৈমনের দিকে তাকায়া আনমনা হয়া থাকার ভান করে, যেন সে বাংলা ভাষাই বোঝে না, কিন্তু খৈমন যখন আর কথা বাড়ায় না, তখন সে বলে, দিনকাল যা পড়ছে তরে কি কমু!
: কি যে করুম বুজি না কিছু বাপ মরা পোলাটা!
কামে লাগায়াদে, ক পরে টাকা যোগাড় কইরা দিবি।
: পরে দিমু কইখন?
নুরানি রিলকিসের উদ্দেশ্যই ছিল খৈমনকে বিভ্রান্ত করা, অন্য আলোচনার ভিতরে নিয়া যাওয়া, যাতে করে সে না বলে, আমারে কিছু টাকা দেন আফা, এবং আশ্চর্য খৈমন টাকা চায় না, কি হইলো, তার, সে কি বদলায়া গেল? উপমা বেগম বলে যে, কাজে লাগায়া দিলে চানমিঞা হয়তো সৌদি আরব যাওয়ার কথা ভুলেই যাবে, অথবা নিজে কামাই করে নিজের টাকাতেই যেতে পারবে, কে বলতে পারে; ফলে, চানমিঞাকে বাস্ত বতা মেনে নিতে হয়, রেশনের চাল বেচা সঞ্চয় থেকে পঞ্চাইশ/মাইট হাজার টাকা দেওয়া খৈমনের পক্ষে সম্ভব হয় না, হয়তো সে দিতেও চায় না-একমাত্র পোলা তার, সে গেলে গা খৈমন বাঁচবে কি নিয়া–এবং সে তাকে কলতাবাজার ফুড ডিপার্টমেন্টের সাইলোর পিছনে একটা মোটর গেরেজে নিয়া যায় কাজে লাগায়া দেয়, গেরেজের নাম দি কারোম মোটর গেরেজ লিঃ, এবং দেখা যায় যে, কামে আগ্রহ না জন্মালেও মোটর গাড়ির ব্যাপারে তার ঝোক বাড়ে, সে মৃত না ভাঙ্গা গাড়ি রিপিয়ার করে, তার চাইতে বেশি গাড়ি চালায়া ট্রায়াল দেয়, তখন একদিন একটা অচল গাড়ি-হয়তো একটা হোন্ডা সিভিক-কেউ ঠেইলা এনে গেরেজে ঢুকায়, গাড়ির হয়তো বিরাট কিছুই হয় নাই, তার ওস্তাদ তাকে বলে, পেলাগে কালি জমছে নিহি দেখ, তখন চানমিঞা বনেট উঠায়া কাপড় দিয়া মুছে প্লগের কার্বন পরিষ্কার করে, তারপর গাড়ির দরজা খুলে স্টার্ট দেয় এবং ব্যাক গিয়ারে গেরেজের গেট দিয়া বের হয়া যায়। তারপরে তার আর দেখা নাই, ওস্তাদ বলে, ইকটু ট্রায়াল দেয়; কিন্তু কতক্ষণ, একটা প্লাগের কালি পরিষ্কার করে কত ট্রায়াল দেওয়া লাগে? গাড়ির মালিক চেহারা গম্ভীর করে ফালায়, গেরেজের মালিকের কানাপট্টি রাগে লাল হয়া আসে–চানমিঞার পাত্তা নাই! তখন আধঘন্টা কিংবা এক ঘন্টা পর সে একটা পঙ্খিরাজের মত গাড়িটা চালায়া এনে ঘ্যাচ করে থামায়, এবং গেরেজের মালিক তাকে জুতা দিয়া মারে—শুয়ারের বাচ্চা তুই গাড়ি লয়া হাওয়া হয়া গেলি-জুতার বাড়ি খাওয়ার পর সে তার ওস্তাদকে বলে যে, গাড়িটা এমন উইড়া গেল বুঝতেই পারে নাই কোনখান দিয়া কোনখানে চলে গেল সে! তখন গেরেজের এইসব কাজকারবারের কথা ভূতের গল্লিতে খৈমন শোনে, তার মুখ কালা হয়া থাকে, কি করবে সে এই পোলা নিয়া? সৌদি আরব যেতে দিল না, কিন্তু এইখানে গেরেজের মালিক তাকে জুতা দিয়া মারে, তার আদরের পোলা, এতিম বাচ্চা, তার গায়ে হাত উড়ায়; সে বলে, তরে লয়া আমি অখনে কি করি তুই ক! কিন্তু চানমিঞার জীবন বসে থাকে না, সে একদিন বলে যে, সে পার্টনারের সঙ্গে পরান গাড়ির ব্যবসা করবে এবং দুখন তার মার মাথায়। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, কয় কি পোলা? টাকা পাইব কৈ? ফলে নুরানি বিলকিস উপমা বেগুন কিংবা বিলাতি কুমড়ার এক বাটি সালুন দিয়া খৈমনকে বিদায় করে, কিন্তু চানমিঞার পাত্তাই পাওয়া যায় না, নুরানি বিলকিসের দেওয়া সালুন এখন বন্দরেরা খায়; ভূতের গল্লির ৩৬নম্বর বাড়িতে বান্দরের তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, তারা তাক থেকে হাড়ি নামায়া খৈমনের রান্দা ভাত খায়া যায়, খৈমন উপমা বেগমের দেওয়া তরকারি এনে রাখে, ঘরের ভিতরে বন্দিরের পাল ঢুকে ফ্লোরের উপরে তরকারি ফালায়া নষ্ট করে। মৈন যখন নুরানি বিলকিসকে বলে, আফা ঘরে ভাত তরকারি কিছুই রাখতে পারি না বান্দরের জ্বালায়, তখন ভূতের গল্লির বান্দর তার ভাত তরকারি খায়া এইভাবে মোটাতাজা হয়, এবং মামুনুল হাইয়ের মা/বাপ যখন সূত্রাপুর থানার দারোগার কাছে মহল্লায় বান্দরবাহিনী গঠনের অভিযোগ করে, তখন তারা কি খুব বেশি বাড়ায়া বলে? তেল, নুন কিংবা চিনি ধার করার অবসরে খৈমনই কি এইসব কথা নুরানি বিলকিস উপমাকে বারে বারে বলে নাই-চানমিঞা বড় হয়া গেলে কি হবে, বান্দরভো চানমির পাছ ছাড়ে না, হয় খোদা এই জঙ্গুলী এই পালাটার ভিতরে কি দেখলো চানমিঞা বড় হয়া যাওয়ার পর যদিও খৈমন ঘরের দরজায় ডবল তালা লাগায়, শিকল তুলে দিয়া একটা তিন লিভারের দেশি তালা, লোহার কড়ার সঙ্গে কালা রঙের একটা গ্লোব মার্কা চিনা প্যাডলক, কিন্তু বান্দরদের আটকাইতে পারার কি কোন উপায় আছে? মনে হয় না, কারণ চানমিঞা জানালার একটা শিক বান্দরদের জন্য ভেঙ্গে রেখে দেয়, বন্দিরেরা সেইখান দিয়া আসা যাওয়া করে, ভিতরে ঢুকে বসে থাকে, খৈমন আর কি বলবে?-বাপ মরা পোল তারা এখন অতিবুড়া বান্দর, বুড়া বান্দর, অল্পবুড়া বান্দর, প্রৌঢ় বান্দর, ইত্যাদি থেকে পিচ্চি কোলে ঝোলা সব বান্দর মহল্লায় তাদের দিনের কাজকাম শেষ করে খৈমনের ঘরের মধ্যে এসে বিকাল বেলা আড় জমায়, বসে থাকে চানমিঞা কখন আসে এই আশায়, এবং খৈমন নুরানি বিলকিসকে বলে, ঘরে ঢুইকা দেখি বান্দরের দল কাউমাউ করে, আমারে দেইখা দাঁত বাইর কইরা ভেটকি দেয়, চিন্তা করেন; ফলে বান্দরের ভয়ে কুয়তিলায় জোবেদা বেগম পড়ে যাওয়ার পর, যখন সূত্রাপুর থানার দারোগা বলে, জঙ্গলের জানোয়ারের বিরুদ্ধে কি ব্যাবস্থা নেব, বলেন? তখন জোবেদা বেগমের স্বামী গোলাম রহমান কথা খুঁজে পায় না, তার মনে হয় যে, বলে কি লোকটা? আশ্চর্য, কারণ এই বান্দরতো শুধু বান্দর থাকে নাই, এইগুলা লাই পায় নষ্ট হয়া যাওয়া মহল্লার বন্দর, এইগুলা জংলি বন্দির না, এবং এই বান্দরদের লাই দেয় কে তা দেশের সকলেই কি জানে না? তখন একদিন গোলাম রহমান সিড়ি দিয়া ছাদে যায় দেখে যে, তাদের ছাদ বান্দরের ও দিয়া ভরা, সে যখন জোবেদা বেগকে বলে, মহল্লার সব বান্দর দেখি আমাগো ছাদের উপরে আয়া হাগে, তখন জোবেদা বেগম ধুম মেরে থাকে, খৈমন সারাটা জীবন তার সঙ্গে দুশমনি করলো, ফকিন্নির মাইয়া ফকিন্নি, এবং গোলাম রহমান আবার নারিন্দা ফঁাড়ি কিংবা সূত্রাপুর থানায় যায়, এবং দারোগা সবকিছু শুনে বলে, বান্দরেরতো পায়খানা করা লাগবে তাই না? গোলাম রহমান আর কি বলবে? বান্দরের হাগা লাগবে বলে কি কেবল তাদের বাসার ছাদের উপরে এসে এই কাজ করবে, হেগে গুয়ের পাহাড় বানাবে! এই সবকিছুর কি সমাধান নাই? বান্দরকে কিছু বলতে না পারেন বান্দরের গডফাদারকে কিংবা গডমাদারকে বলেন, সকলে জানে ভূতের গল্লিতে বান্দরের গডফাদার হচ্ছে চানমিঞা, তাকে ধরেন, মারেন, কাটেন; কিন্তু দারোগা হাসে, সে বলে, বন্দির পুরান ঢাকার একটা ঐতিহ্য, বান্দরের আবার গড ফাদার কি, ওরে ধরলে হয়তো বান্দরেরা ম্যাজিস্ট্রেট কোটে যায়া ধরনা দেবে, তাতে মহামান্য আদালত এম্ৰাসড হবে, পত্রিকায় ছবি উঠবে এবং আমি খামাখা ক্লোজ হয়া যাব! ফলে মিসেস জোবেদা রহমানের জীবনে নতুন উৎপাত শুরু হয়, একদিন সকালে কিংবা বিকালে এক লোক এসে বলে যে, তার নাম মামুন, সে চট্টগ্রাম থেকে এসেছে; আমি চট্টগ্রাম তেকে আইসি, সে বলে, আমি এই বাসার চেলে, আমার নাম মামুন, আমি হারাই গেইলাম দেরি, এবং তখন জোবেদা বেগমের পুরান ভয় ফিরা আসে, তার মনে হয় যে, এসব খৈমনেরই কাজ। কিন্তু খৈমনতো তখন চানমিঞাকে নিয়াই ব্যস্ত হয়া থাকে, তার আফসোস হয়, চানমিঞাকে কেন যে সে ড্রাইভারি শিখতে দিল, যখন তার বিদেশ যাওয়ার টাকাই নাই; ফলে চানমিঞা বান্দরের পরে চিনলো অন্য মানুষের গাড়ি। দি কার হোম মোটর গেরেজ লিঃ-এর মালিক তাকে একদিন জুতা দিয়া পিটালেও তার লজ্জা হয় না, সে গাড়ি চালানোর লোভে গেরেজের চাকরিতে লেগে থাকে, কালিঝুলি মেখে গাড়ি রিপিয়ার করে আর ট্রায়াল দেয়, তখন হয়তো লক্ষ্মীবাজারেই, হয়তো বাহাদুরশাহ পার্কের গোল চক্করের পাশেই সে দেখে যে, আর একটা হোন্ডা সিভিক পার্ক করা আছে-হয়তো এইটা সেই গাড়িটাই যেটার জন্য তার মালিক তাকে জুতা মেরেছিল-তখন চানমিঞা একটা লোহার গুনা ঢুকায় দরজার লক খুলে গাড়ি নিয়া হাওয়া হয়া যায়। ত্রিশ/চল্লিশ মিনিট কিংবা একঘন্টা পর ফিরা সে গাড়িটা পার্কের গোল চক্করের কাছেই রেখে ভাগোয়াট হয়, তখন গাড়ির মালিক হয়তো ফিরা এসে দেখে যে, সে গাড়িটা যেখানে রেখেছিল এখন হয়তো সেটী সেখানে নাই, তবু তার কিছু সন্দেহ হয় না, তার মনে হয় যে, ঠিকই আছে, মানুষের কি সব সময় সব কিছু মনে থাকে? তখন চানমিঞার আর গেরেজ্জের কাজ ভাল লাগে না, কারণ ট্রায়াল দেওয়ার জন্য গাড়ির অভাব তার আর থাকে না, এবং সে গেরেজের মালিককে একদিন যায় বলে, আপনে আমারে জুতা দিয়া মারছেন, আমার বাপ নাই, আমি একটা এতিম পোলা, আমি আর আপনের কাম করুম না, এবং হয়তো বাহাদুরশাহ পার্ক, লক্ষ্মীবাজার কিংবা পুলিশ ক্লাবের সামনে নবাবপুর রোডের উপরে পার্ক করা একটা সাদা রঙের টয়োটা মার্ক টু গাড়ি তার নজরে পড়ে, সে গাড়িটা নিয়া উধাও হয়, আমিনবাজার দিয়া যায়, সাভার পর হয়া জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখে আসে, হয়তো স্মৃতিসৌধে সে ফুলও দেয়, তার মনে হয় যে, খুবই চমৎকার জিনিসটা, কিন্তু ৩/৪ ঘন্টা পর ফিরা এসে রায়সা বাজারের কাছাকাছি গাড়ি ফালায়া দিতে গেলে সে দোলাইখালের মোড়ের পুলিশের নজরে পড়ে; গাড়ির লক পুশ করে দিয়া ঘটাং করে দরজা লাগায়া ঘুরতেই সে দেখে এক পুলিশ তার সামনে খাড়ায়া, লোকটা বলে, আমার নাম সার্জেন্ট রফিক, কার গাড়ি এইটা?
চানমিঞার কিছু বলার থাকে না, কিন্তু সার্জেন্ট ধুরন্ধর প্রাণী, চানমিঞার সঙ্গে কথা বলে সে অবাক হয়, এইটা কোনখানকার চিড়িয়া, সে ভাবে এবং বলে, এই কমি যখন কই গাড়ি ফালায়া দিয়া যাও কেন? ধরা খাইলেতো বাবা না তুমিতো ধরা পড়ছো, এখনতো জেলে যাই-অফেন্স এগেনস্ট প্রপাটি, থেফট, পেনাল কোডের ধারা ৩৭৮; শাস্তির ধারা ৩৭৯, তিন বছরের জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়, তোমারতো উভয়ই হবে!
তখন সার্জেন্ট রফিকের এই পোলাটার জন্য মায়া হয়, সে তার কান্ধের উপরে একটা হাত রাখে এবং সেদিন চানমিক্স টয়োটা মার্ক টু গাড়িটার দরজা পুনরায় লোহার তার ঢুকায়া খুলে লম্বা ট্রিপ মেরে টঙ্গি যায়, গাজিপুর চৌরাস্তার পিছনে বসুমতি মোটর গেরেজ-এর মালিক আরফান আলির কাছে গাড়ি এবং রফিক সার্জেন্টের লেখা একটা চিরকুট পৌছায়া দিলে, আরফান আলি তাকে বলে, বিক্রি হইলে তুমি পঞ্চাইশ পাইব।
: পঞ্চাইশ কি?
: হাজার।
চানমিক্সা গাড়ি চোরে পরিণত হয় এবং সে তার মাকে যখন বলে যে, সে পুরান গাড়ির কারবার করবে, খৈমনেরতো ঘুম ছুটে যায়, সে নুরানি বিলকিন্স উপমাকে ইনিয়াবিয়া সব বলে, তার পোলা চানমিঞার যোগ্যতা কিন্তু ছিল, চাইলে সে জীবনে ভাল করতেই পারতো, সেকি ভাল ছাত্র ছিল না? পূর্ণলক্ষ্মী কি তার সাক্ষী নাই? গেরেজের কামেও সে ভাল ছিল, রোকনপুর যায়া জিগান, দেখেন কেমুন ভাল মেকেনিক সে হয়া গেছিল গা, এবং তখনই তার মাথায় পুরান গাড়ির ব্যবসা করার বুদ্ধিটা আসে! তখন উপমা বেগমের মুখের দিকে তাকায়া খৈমন বলে, চানমিঞায় পুরান গাড়ির ব্যাবসা করবার চায়।
নুরানি বিলকিস বোঝোই না ব্যাপারটা কি, তার স্বামী ফজলুর রহমান রেশন দোকান উঠে যাওয়ার পর এখন শ্যাম বাজারে চালের আড়তদারি করে, সে বলে, এইটা কি বাবসা?
খৈমনও হয়তো বোঝে না, সে বলে, গাড়ি কিনব, বেচব!
: ট্যাকা পাইবো কৈ?
: গেরেজের মালিকের লগে পাটনারি ব্যবসা করব।
নুরানি বিলকিসের হয়তো পুনরায় অস্বস্তি হয়, ফলে তখন মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদু নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় দেখে, রবার্ট খুব অসুস্থ, তার বুকে ব্যথা আর কাশি, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য মিসেস ক্লার্ক এবং জুলির কান্ধে ভর দিয়া সে সিঁড়ি বায়া নিচে নামে, তখন বিষয়টা একটা সুযোগ হয়া দেখা দেয় এবং মামুন এবং লেদু হাত লাগায়-জুলিতে মন গলে না, টলে না, যদি তার বাপের সেবা করে মামুনের কিছু হয়। তখন জুলি মামুনের দিকে তেরছা করে তাকায়া থাকে, মামুন ভাবে, কেন তাকাও খামাখা? হয়তো তারপর আবার তাদের দেখা হয়, রবার্টের অসুখটা হয়তো কঠিন কিছু না, হয়তো ঠাণ্ডার কারণে তার এই সমস্যা, হয়তো পুরুসির ভাব, তখন মামুন জুলিকে বলে, বাপের যত্ন নেও না কেন?
: আর কত যত্ন নিব, বিয়া হলেতো চলেই যাব।
: কবে বিয়া করতাছ?
জুলির বিয়া নিয়া হয়তো তার মা/বাপ ভাবে, মেয়ে তাদের বড় হয়া গেছে, মেয়ে বড় হয়া গেলে বিয়া দেওয়াই নিয়ম, হয়তো বিষয়টা নিয়া জুলিও চিন্তা করে, কিংবা জুলি হয়তো ভাবে না, জুলির বিয়া দেবে এইদেশে ছেলে কোথায়? তখন মামুনুল হাই তাকে একদিন বলে, তুমি কি বাংলা বই পড়, নাকি শুধু মাউন্ট্রাপ?
: কালের যাত্রার ধ্বনি.. পড়ছো?
: মনে হয়।
: তোমার জন্মদিনে কি তোমাকে একটা বই দিতে পারি।
: দিয়েন, কিন্তু ভিতরে কিছু লিখেন না।
মামুন বোঝে কি ভয়ানক সেয়ানা এই মাইয়া এবং ২১শে সেপ্টেম্বরে তারা দুইজন-মামুন এবং লেদু-জুলির জন্য দুইটা বই কিনা নিয়া আসে, মামুনের ভীষণ সাধ হয় বইয়ের প্রথম পাতায় সে লেখে, প্রিয়তমা জুলিকে, অথবা, আমার স্বপ্নের জুলিকে; অথবা, প্রিয় জুলিকে ভালবাসাসহ, কিন্তু তার সব আকাক্ষা অপূর্ণ থাকে; সে বলে, তোমার জন্মদিনে কোন অনুষ্ঠান নাই?
: ড্যাডের শরীর ভাল না, এল্ড আই এম অলরেডি এনি ওল্ড ওম্যান, আর কত!
: তুমি কি জান লেদু কি করতাছে?
তখন জুলি কৌতুহলি হয়, না জানি না, কি করতেছে?
: লেদু প্রেম করতাছে, শেলি আপার সঙ্গে।
: গ্রেট, অপনে করতেছেন না?
মামুন খুবই বিষণ্ণ হয়া পড়ে, এ কেমুন মাতারি, নিমজ্জমান এক অসহায় মানুষকে নিয়া খেলে! তার কি দরকার এইরকম একটা প্রশ্ন করার? যাহোক, মামুন বলে যে, তার ইচ্ছা আছে!
জুলি বলে, আমার মাঙ্কিবয়কে দেখতে খুব মন চায়।
ফলে ফখ আলম লেদু যখন চানমিঞার সঙ্গে দেখা করে, তখন সে মহল্লায় গাড়ি নিয়া আসতে শুরু করেছে, তার কারবার দেখে ভূতের গন্নির লোকেরা হা হয়া থাকে, তাজ্জব বনে যায়, এবং জোবেদা বেগম ভাবে এইটা কি সম্ভব? এইটা কি তরকারি বেচইনা ময়না মিঞার পোলা না? এইটা কি ঠোঙ্গা বানায়া জীবন চালানো খৈমনের পোল না? তারতোবৈল গাড়ি চালানোর কথা, সে কিনা মহল্লায় মোটর গাড়ি নিয়া আসে! তখন একদিন মন্দিরের সামনে সাদা, নীল কিংবা কালা রঙ্গের একটা প্রোটন সাগা কিংবা বিরা সিডান কাঁরের ছাদের উপরে তিনটা বান্দর নিয়া গাড়ির দরজা খুলে রেখে চানমিঞা খাড়ায়া খাড়ায়া বন্দরের সঙ্গে কলা খায় এবং তখন লেদু এসে তাকে বলে, কি ব্যবসা করছ তুই?
: গাড়ির ব্যবসা!
: গাড়ির কি ব্যবসা?
: গাড়ি কিনি, বেচি।
: কি কচ!
: হঁ, কলা খা।