০৬. ট্যালন এবং চা পাতা
পরদিন সকালে নাস্তার জন্যে গ্রেট হলে গিয়ে হ্যারি, রন এবং হারমিওন দেখল ড্র্যাকো ম্যালফয় এক দল স্লিথারিনকে যেন কি একটা গল্প বলে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করছে। ওরা যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, ম্যালফয় তখন অদ্ভুতভাবে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অভিনয় করল, একসঙ্গে হেসে উঠল স্লিথারিনের দল।
পাত্তা দিও না, বলল হারমিওন, একেবারে হ্যারির ঠিক পেছনে রয়েছে সে। একেবারেই পাত্তা দেবে না, ও এর যোগ্য নয়
এই যে পটার! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিলের মতো চিৎকার করে উঠল প্যানসি পারকিনসন, সিথারিনদের এই মেয়েটার চেহারাটাই ঝগড়াটে। পটার! ডিমেন্টররা আসছে, পটার! উউউউউউউউ!
গ্রিফিন্ডর টেবিলে জর্জ উইজলির পাশে একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল হ্যারি।
নতুন থার্ড–ইয়ারের রুটিন, বলল জর্জ, ওগুলো বাড়িয়ে ধরে। হ্যারি, তোমার আবার কি হলো?
ম্যালফয়, বলল রন, জর্জের অন্য পাশে বসতে বসতে। কটমট করে তাকিয়ে রয়েছে ও স্লিথারিন টেবিলটার দিকে।
মাথা তুলে জর্জ দেখতে পেলো ম্যালফয় আবার ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করছে।
ওই পুঁচকে পাজিটা, শান্ত স্বরে বলল সে। কাল রাতে ডিমেন্টররা যখন ট্রেনে আমাদের দিকে এলো তখন ওকে এতো বড়বড় করতে দেখা যায়নি। দৌড়ে আমাদের কামরায় এসে লুকিয়েছিল, তাই না ফ্রেড?
প্রায় কাপড় খারাপ করে ফেলেছিল আর কি, বলল ফ্রেড, ম্যালফয়ের দিকে একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি হেনে।
আমি নিজেও খুব খুশি হইনি, বলল জর্জ। এই ডিমেন্টরগুলি ভয়াবহ …
ভেতরটা একেবারে বরফ করে দেয়, তাই না? বলল ফ্রেড।
তুমি তো অজ্ঞান হওনি, হয়েছ? নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।
বাদ দাওতো, ভুলে যাবার চেষ্টা করো, ওকে চাঙ্গা করবার জন্যে বলল জর্জ। ফ্রেড, মনে আছে ড্যাডকে একবার আজকাবানে যেতে হয়েছিল? এসে বললেন এর চেয়ে খারাপ যায়গায় তিনি কখনো যাননি। ফিরে এসেছিলেন তিনি দুর্বল, কাঁপতে কাঁপতে ওই ডিমেন্টররা যে কোন যায়গার সবটুকু আনন্দ শুষে নিতে পারে। ওখানকার সব বন্দী নাকি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যায়।
ঠিক আছে দেখা যাবে আমাদের প্রথম কুইডিচ ম্যাচ-এর পর ম্যালফয়কে কেমন খুশি দেখা যায়, বলল ফ্রেড। মনে আছে তো, এই মওশুমের প্রথম খেলা গ্রিফিন্ডর বনাম স্লিথারিন?
এ পর্যন্ত একবারই মাত্র হ্যারি আর ম্যালফয় কুইডিচ খেলায় মুখোমুখি হয়েছিল, আর সেবার ভালোই পর্যন্ত হয়েছিল ম্যালফয়। মনে মনে একটু উৎফুল্ল বোধ করল হ্যারি, সসেজ আর ফ্রাইড টমেটো টেনে নিয়ে খেতে শুরু করল।
নতুন রুটিনটা দেখছে হারমিওন।
বাহ, চমৎকার, আজ থেকে কয়েকটি নতুন বিষয় শুরু হচ্ছে, খুশি হয়ে বলল সে।
হারমিওন, রন বলল, ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে তাকিয়ে, ওরা তোমার রুটিনে গণ্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছে। দেখো–প্রত্যেকদিন প্রায় দশটা বিষয়ের ক্লাশ হবে। কিন্তু অত সময় কোথায়!
ও আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। এরই মধ্যে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর সঙ্গে সব ঠিকও করে নিয়েছি।
কিন্তু দেখো, হাসতে হাসতে বলল রন, আজ সকালের রুটিনটাই দেখো? সকাল নয়টায় ডিভাইনেশন। এর নিচে আবার লেখা রয়েছে, নয়টায় মাগল স্টাডিজ। এবং রুটিনের দিকে আরো ঝুঁকে গেল রন, বিশ্বাস হচ্ছে না তার, দেখো এর নিচে আবার লেখা অ্যারিথম্যানসি, সকাল নটায়। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, এটা ঠিক যে তুমি ভালো ছাত্রী, কিন্তু কেউই তো অত ভালো হতে পারে না। একই সঙ্গে তুমি তিন তিনটি ক্লাসে উপস্থিত থাকবে কীভাবে?
বোকার মতো কথা বলো না, বলল হারমিওন। আমি একই সময়ে তিনটি ক্লাসে নিশ্চয়ই উপস্থিত থাকব না।
বেশ, তাহলে—
মোরব্বাটা এদিকে এগিয়ে দাও, বলল হারমিওন।
কিন্তু–
আহ, রন, আমার রুটিনটা যদি পূর্ণ থাকে তাতে তোমার কি? চট করে বলল হারমিওন। তোমাকে বলেছি না প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের সঙ্গে সব মিলিয়ে নিয়েছি আমি।
ঠিক ওই সময় হ্যাগ্রিড প্রবেশ করল গ্রেট হলে। চামড়ার লম্বা একটা ওভারকোট পরনে, বিশাল একটা হাতে অন্যমনস্ক একটা মৃত খাটাশ দোলাচ্ছে।
স্টাফ টেবিলের দিকে যেতে যেতে সে বলল, সব ঠিক তো? দুপুরের খাবারের ঠিক পরই তোমরা যাচ্ছো আমার প্রথম ক্লাসে! সেই ভোর পাঁচটায় উঠেছি সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছি … আশাকরি সব ঠিকঠাক আছে … আমি শিক্ষক, ছাত্র পড়াব। সত্যি বলতে কি।
ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে, স্টাফ টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল খাটাশটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে।
ভাবছি, ও আবার কী তৈরি করে রাখছিল? রনের কন্ঠে উদ্বেগ।
হলটা খালি হতে শুরু করল। সবাই যার যার প্রথম ক্লাসটা ধরতে বেরিয়ে যাচ্ছে। নিজের রুটিনটা দেখে নিল রন।
আমাদেরও যাওয়া উচিৎ, ডিভাইনেশন ক্লাসটা হবে নর্থ টাওয়ারের একেবারে ওপরে। ওখানে যেতেই লাগবে দশ মিনিট
দ্রুত নাস্তা সেরে, ফ্রেড আর জর্জের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে গেল ওরা। স্লিথারিন টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখল ম্যালফয় আবারো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অভিনয় করছে। পেছনের অট্টহাসিটা হ্যারিকে বাইরের হল পর্যন্ত অনুসরণ করল।
প্রাসাদ থেকে নর্থ টাওয়ার পর্যন্ত যেতে অনেক সময় লাগল। হোগার্টস-এ দুবছর কেটে গেলেও এখনও প্রাসাদের সবকিছু ওদের জানা হয়নি। এবং এর আগে কখনও নর্থ টাওয়ারের ভেতরে যাওয়া হয়নি ওদের।
নিশ্চয়ই-একটা–শর্ট–কাট–পথ–রয়েছে, সাত তলা পর্যন্ত উঠতে উঠতে হাপাতে হাপাতে বলল রন। অচেনা একটা যায়গায় উঠে এসেছে ওরা। পাথরের দেয়ালটায় ঝুলে রয়েছে বিশাল একটা পেইন্টিং, সাবজেক্ট হচ্ছে দেখা যায় কি যায় না ঘাসের আঁটি।
আমার মনে হয় ওই দিকেই যেতে হবে, ডান দিকের শূন্য পথের দিকে উঁকি দিয়ে বলল হারমিওন।
হতেই পারে না, বলল রন। ওটা দক্ষিণ। দেখো, জানালা দিয়ে তাকালে লেকটার একটুখানি দেখা যাচ্ছে…
দেয়ালের পেইন্টিং–টার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। একটা নাদুশনুদুশ বিচিত্র বর্ণের ঘোডা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘাস খেয়ে চলেছে, কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হোগার্টস-এর পেইন্টিং গুলো ছবির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, পরস্পরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে, এটা হ্যারির অতি পরিচিত দৃশ্য। এক মুহূর্ত পরেই পেইন্টিং-এর মধ্যে ঘোড়াটার পিছু পিছু বেটে খাটো সুলকায় এক যোদ্ধা (নাইট) এসে হাজির, পরনে ওর লৌহ–বর্ম, মাথায় লোহার শিরস্ত্রান। ওর ধাতব হাটুতে ঘাসের দাগ দেখে বোঝা যায়, এই মাত্র [ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল সে।
অহো! হ্যারি, রন আর হারমিওনকে দেখে চিৎকার করে উঠল সে। এরা আবার কোন দুর্বৃত্ত, আমার ব্যক্তিগত যায়গায় অনধিকার প্রবেশ করছে? পড়ে যাওয়াতে আমাকে অশ্রদ্ধা জানাতে এসেছে? তলোয়ার বের কর দুর্বৃত্ত, কুকুর!
অবাক হয়ে ওরা দেখল নাইটটি খাপ থেকে নিজের তলোয়ারটা বের করে, সংঘাতিক ভাবে ওটা ঘোরাতে শুরু করল, লাফাতে শুরু করল ক্রোধে। কিন্তু তলোয়ারটা ওর তুলনায় অনেক লম্বা; ঘোরাতে গিয়ে একবার সে ভারসাম্য হারিয়ে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল ঘাসে।
তুমি ঠিক আছে তো? ছবিটার আরো কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।
সরে যাও, নোংরা হামবড়া কোথাকার! সরে দাঁড়া, বদমাশ!
এদিকে পড়ে থাকা তলোয়ারটা সজোরে আঁকড়ে ধরে ওটার উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বীর পুঙ্গব, কিন্তু ওটা ক্রমেই দেবে যাচ্ছে ঘাসের ভেতর। সর্বশক্তি দিয়ে টেনেও ওটা তুলতে পারছে না সে এবার। অবশেষে ঘাসের ওপর একেবারে চিৎপটাং, শিরস্ত্রাণের মুখাবরণটা ওপরে তুলে মুখের ঘাম মুছল ছবির বেটে খাট নাইট।
শোন, নাইটের ক্লান্তির সুযোগ নিয়ে বলল হ্যারি, আমরা নর্থ টাওয়ারে যাওয়ার পথ খুঁজছি। তুমি নিশ্চয়ই জানো না, তাই না?
জিজ্ঞাসা! মনে হলো সঙ্গে সঙ্গে নাইটের সব রাগ পানি হয়ে গেছে। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, এসো, প্রিয় মিত্র সকল, আমাকে অনুসরণ করো, আমরা নিশ্চয়ই আমাদের লক্ষ্য খুঁজে পাব, নতুবা খুঁজতে গিয়ে সাহসের সঙ্গে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব!
আরেকবার নিষ্ফলভাবে ঘোরালো তলোয়ার, ঘোড়ায় চড়বার ব্যর্থ চেষ্টা করল, তারপর চিৎকার করে উঠল, তাহলে পদব্রজেই রওয়ানা হওয়া যাক, চলুন মহোদয়গণ এবং ভদ্রমহিলা! চলুন! চলুন!
তারপর দৌড়াতে শুরু করল সে ঝন ঝন শব্দ তুলে ছবির ফ্রেমের বাঁ দিক লক্ষ্য করে, এবং এক সময় চলে গেল দৃষ্টির বাইরে।
করিডোর ধরে ওর পিছু পিছু ওরাও দৌড়াতে শুরু করল, লৌহ–বর্মের শব্দটাকে অনুসরণ করছে ওরা। কখনো কখনো দেখা যাচ্ছে সামনের কোনো ছবির মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছে ও।
এখন বুকে সাহস ধরতে হবে, আরো খারাপ সময় আসছে, এসো! চিৎকার করে উঠল নাইট, এবার ওরা ওকে দেখতে পেলো এক দল ভীত সতর্ক মহিলার সামনে, সরু ঘোরানো একটা সিঁড়ির দেয়ালের ছবিতে।
জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে হ্যারি, রন আর হারমিওন ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠছে তো উঠছেই, দৃষ্টি ওদের ঝাঁপসা হয়ে আসছে, এক সময় শুনতে পেল মানুষের কণ্ঠস্বর, অবশেষে যেন ক্লাস রুমে পৌঁছতে পারল ওরা।
বিদায়! চিৎকার শোনা গেল নাইটের, অশুভ দেখতে কয়েকজন সাধুর ছবির মধ্যে থেকে মাথা বের করে রয়েছে সে। হে, আমার কমরেডগণ তোমাদের বিদায়! আবার যদি কখনও তোমাদের কোন মহৎ হৃদয় এবং ইস্পাতের মতো পেশির প্রয়োজন হয় তবে অবশ্যই স্যার ক্যাডোগানকে স্মরণ করবে!
হু, তোমাকেই স্মরণ করবো, বিড় বিড় করে বলল রন, নাইট দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে, যদি কোন পাগলের প্রয়োজন হয়।
সিঁড়ির শেষ কয়েকটা ধাপ অতিক্রম করে ওরা সামনের ফাঁকা জায়গাটায় এসে থামল। ওখানে ক্লাশের বেশিরভাগ ছাত্রই এসে জড়ো হয়েছে। এখানে কোন দরজা নেই; কনুইয়ের খোঁচা মেরে রন হ্যারিকে ছাদের দিকে ইশারা করল, ওখানে একটা বৃত্তাকার দরজা রয়েছে পিতলের নামফলক লাগানো।
সিবিল ট্রিলনি, ডিভাইনেশন টিচার, হ্যারি সশব্দে পড়ল। কিন্তু ওখানে উঠব কীভাবে?
যেন ওর জিজ্ঞাসার জবাবে, হঠাৎ করেই ওপরের দরজাটা খুলে গেল। একটা রূপালী মই নামল ঠিক হ্যারির পায়ের কাছে। সবাই চুপ করে গেল।
তোমার পরে, দাঁত বের করে বলল রন, হ্যারিই প্রথমে উঠল মইটায়।
তার দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত–দর্শন ক্লাস রুমে প্রবেশ করল হ্যারি। বস্তুত এটাকে মোটেই ক্লাস রুমের মতো মনে হচ্ছে না; মনে হচ্ছে যেন একটা চিলে কোঠা আর পুরনো আমলের চায়ের দোকানের সংমিশ্রণ। কমপক্ষে বিশটি গোলাকার টেবিল গাদাগাদি করে ঢোকানো হয়েছে, টেবিলগুলোর চারদিকে কাপড় আচ্ছাদিত গদি আঁটা হাতলওয়ালা চেয়ার রয়েছে। জানালা বন্ধ, পর্দাগুলো টানা, টকটকে লাল রঙের নরম আলো ছড়িয়ে রয়েছে ক্লাস রুমে। দম আঁটকানো গরম, ক্লাসরুমের মাঝখানে বড় একটা তামার কেটলির নিচে আগুন জ্বলছে, কেমন ভারী একটা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে কেটলিটা। গোলাকার দেয়াল ঘিরে তাকগুলোতে তাস, ধুলো ভর্তি পালক, পোড়া মোমবাতির শেষাংশ, অসংখ্য রূপালী ক্রিস্টাল বল আর চায়ের অনেকগুলো কাপ রয়েছে অগোছালো অবস্থায়।
হ্যারির কাধ ঘেষে এসে দাঁড়ালো রন, ওদেরকে ঘিরে ধীরে ধীরে পুরো ক্লাসটা জড়ো হলো, সবাই কথা বলছে ফিস ফিস করে।
কোথায় উনি? বলল রন।
কণ্ঠস্বরটা এলো ছায়ার মধ্য থেকে, স্নিগ্ধ রহস্যময় একটা কণ্ঠস্বর।
স্বাগতম, বলল কে যেন, অবশেষে বাস্তব দুনিয়ায় তোমাদেরকে দেখতে পাওয়াটা কতই না চমৎকার।
চিন্তাটা যেন স্বতস্ফূর্তভাবেই এলো হ্যারির মাথায় বিশাল বড়সড় একটা চকচকে পোকার চিন্তা। আগুনের আলোয় এলেন প্রফেসর ট্রিলনি। ওরা দেখল, একজন খুবই ক্ষীণকায়া; বিশালাকৃতির চশমার কাঁচের কয়েক গুণ বর্ধিত এক জোড়া চোখ, গায়ে চুমকি বসানো শাল জড়ানো। গলায় ঝুলছে অসংখ্য চেন আর ছোট ছোট দানার মালা, হাত ভর্তি চুড়ি আর আঙুল ভরা আংটি।
বসো, বললেন তিনি, ওরা সকলে কসরত করেই চেয়ারে উঠে বসল। হ্যারি, রন আর হারমিওন বসল একই টেবিলে।
ডিভাইনেশনে স্বাগতম, বললেন প্রফেসর ট্রিলনি, আগুনের সামনে একটা পাখাওয়ালা চেয়ারে বসে। আমার নাম প্রফেসর ট্রিলনি। তোমরা হয়তো আমাকে আগে দেখোনি। নিচে, স্কুলের ঝকমারির মধ্যে থাকলে আমার দিব্যদৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায়, সেজন্যে বড় একটা নিচে যাওয়া হয় না।
এমন অসাধারণ একটা ঘোষণার জবাবে ক্লাসের কেউই কিছু বলল না। সুন্দরভাবে গায়ে জড়ানো শালটা গুছিয়ে নিয়ে প্রফেসর ট্রিলনি বললেন, তাহলে, তোমরা পড়বার জন্যে ডিভাইনেশন বেছে নিয়েছ, ম্যাজিক শিল্পের সবচেয়ে কঠিন বিষয়। শুরুতেই তোমাদেরকে সাবধান করছি তোমাদের যদি নিজেদের অন্তদৃষ্টি বা দিব্যদৃষ্টি না থাকে, তাহলে আমি কিছুই শেখাতে পারব না। আর বই? বই এই ক্ষেত্রে তোমাদেরকে শুধু
শেষের কথাটা শুনে হ্যারি আর রন পরস্পরের দিকে তাকাল, মুচকি হেসে হারমিওনের দিকে তাকাল, এই বিষয়ে বই খুব একটা কাজে আসবে না শুনে ও বেচারি খুব ভড়কে গেছে।
অনেক যাদুকরই অনেক বিষয়েই প্রতিভাবান, তারা শব্দ, গন্ধের জগতে অনেক কিছু করতে পারে, হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এখনও তারা ভবিষ্যতের রহস্যময় জগত ভেদ করতে পারেনি, বলেই চলেছেন প্রফেসর, ওর বড় বড় চকচকে চোখ দুটো সামনের নার্ভাস চেহারাগুলোর উপর ঘুরছে। এটা যার থাকে তার ঈশ্বর প্রদত্ত] দান হিসেবেই থাকে। এই যে, ছেলে, হঠাৎ নেভিলকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন তিনি, গদি উল্টে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল ও, তোমার দাদী ভালো আছেন?
বোধহয়, বলল নেভিল কম্পিত কণ্ঠে।
আমি যদি তোমার যায়গায় হতাম তাহলে অতটা নিশ্চিত হতাম না কিছুতেই, বললেন প্রফেসর, ওর কানের লম্বা পান্নার দুল দুটো চুল্লীর আগুনে ঝিকমিক করে উঠল। ঢোক গিলল নেভিল। নির্বিকার ভাবে বলেই চলেছেন প্রফেসর ট্রিলনি, এ বছর আমরা ডিভাইনেশনের মৌলিক পদ্ধতিগুলো পড়ব। প্রথম টার্মে পড়তে হবে চায়ের পাতা। পরের টার্মে হাত দেখা। হঠাৎ পার্বতী পাতিলের দিকে ফিরে বললেন, লাল–চুলো মানুষের ব্যাপারে সাবধান থাকবে।
হতচকিত হয়ে পার্বতী রনের দিকে তাকাল, রন বসেছিল ওর ঠিক পেছনে, নিজের চেয়ারটা সরিয়ে নিল পার্বতী।
গ্রীষ্মের সময় আমরা ক্রিস্টাল বল সম্পর্কে জানব, বলে চললেন প্রফেসর, অবশ্য যদি আমরা ফায়ার–ওমেন সম্পর্কে শেষ করতে পারি। দুঃখজনক হলো ফ্লুর কারণে ফেব্রুয়ারিতে কিছুদিনের জন্য ক্লাসের ব্যাঘাত ঘটবে। আমার নিজের গলার স্বর বন্ধ হয়ে যাবে। এবং ইস্টারের সময় আমাদের একজন চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে যাবে।
চাপা একটা নীরবতা নেমে এলো ক্লাস রুমে কিন্তু মনে হলো প্রফেসর ট্রিলনি এ সম্পর্কে সচেতন নন।
আমি ভাবছি, বললেন তিনি সবচেয়ে কাছে বসা ল্যাভেন্ডার ব্রাউনকে লক্ষ্য করে, চেয়ারটার মধ্যে ভয়ে যেন কুঁচকে গেল সে, তুমি যদি আমাকে রূপার সবচেয়ে বড় টি–পটটা এগিয়ে দিতে পারো?
মনে হলো হাপ ছেড়ে বাঁচল ল্যাভেন্ডার, উঠে দাঁড়িয়ে তাক থেকে বিরাট বড় একটা টি–পট এনে প্রফেসর ট্রিলনির সামনে টেবিলের ওপর রাখল।
ধন্যবাদ, মাই ডিয়ার। ঘটনাক্রমে, তুমি যে ব্যাপারটা নিয়ে ভয় পাচ্ছ সেটা ঘটবে, শুক্রবার, মোলই অক্টোবর।
একেবারে কেঁপে উঠল ল্যাভেন্ডার।
এখন তোমরা সবাই জোড়ায় জোড়ায় ভাগ হয়ে যাও। তাক থেকে একটা করে চায়ের কাপ নিয়ে আমার কাছে আসবে, আমি ওগুলো ভরে দেবো চা দিয়ে। তারপর বসে ওটা পান করবে, যে পর্যন্ত না শুধু তলানিটা অবশিষ্ট থাকে। এরপর বাঁ হাতে কাপের মধ্যে তিনবার ঘুরিয়ে নিয়ে কাপটা ধুয়ে নেবে, পিরিচের ওপর কাপটা উপুড় করে রাখবে। চায়ের শেষ ফোঁটাটা ঝরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তোমার পার্টনারের দিকে ওটা বাড়িয়ে দেবে পড়বার জন্যে। আনফগিং দ্য ফিউচার এর পঞ্চম এবং ষষ্ঠ পৃষ্ঠা দেখে তুমি [তোমার পার্টনার যা দেখেছে তার ব্যাখ্যা করবে। আমি তোমাদের মধ্যেই ঘোরাফেরা করব, তোমাদের সাহায্য করবো, নির্দেশ দেবো। ওহ, ডিয়ার– নেভিল উঠতে গেলে প্রফেসর ওর বাহু ধরে ফেললেন, তোমার প্রথম কাপটা ভাঙার পর, নীল রঙ থেকে একটা বেছে নেবে দয়া করে? গোলাপী রঙের গুলো আমার খুব পছন্দ।
যেই না কাপ নেয়ার জন্যে নেভিল তাকের কাছে পৌঁছেছে অমনি কাপ ভাঙার টুং টাং শব্দ হলো। ব্রাশ আর ডাস্ট প্যান নিয়ে দ্রুত ওর কাছে চলে গেলেন প্রফেসর ট্রিলনি। বললেন, নীল রঙের একটা, ডিয়ার, যদি কিছু মনে না করো ধন্যবাদ
কাপ ভরে দেয়া হলে, হ্যারি আর রন তাদের টেবিলে ফিরে গিয়ে দ্রুত ধোয়া ওঠা চাটা পান করবার চেষ্টা করল। প্রফেসরের বলে দেয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে তলানিটুকু বাঁ হাতে তিনবার কাপের মধ্যে ঘোরালো, তারপর উপুড় করে ফেলে দিয়ে মুছে ফেলল।
ঠিক, বলল রন, দুজনই নিজের নিজের বইয়ের পাঁচ এবং ছয়ের পাতা খুলছে। আমার বইয়ে কি দেখতে পাচ্ছো?
ভিজে ভারি হয়ে রয়েছে এমন একটা বাদামী রঙের বোঝা, বলল হ্যারি। পারফিউমের গন্ধে ভুর ভুর করছে ঘরের ভেতরের ধোয়া, হ্যারির কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে আর বোকা বোকা লাগছে।
মনকে প্রসারিত করো, চোখকে মামুলি পার্থিব বিষয়ের উর্ধ্বে দেখতে দাও! আঁধো অন্ধকারের মধ্যে চিক্কার করে উঠলেন প্রফেসর ট্রিলনি।
হ্যারি নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করল।
তাই তো, তুমি একটা নড়বড়ে ক্রস পেয়েছ… আনফগিং দ্য ফিউচার বইখানা দেখতে দেখতে বলল সে। তার মানে হচ্ছে তোমাকে অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং তোমাকে অনেক দুঃখ–কষ্ট সইতে হবে, ওর জন্যে দুঃখিত কিন্তু ওখানে সূর্যের মতো কি যেন একটা দেখা যাচ্ছে। দাঁড়াও দাঁড়াও এর অর্থ হচ্ছে অনেক সুখ তাহলে প্রথমে তোমাকে অনেক দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে কিন্তু পরে তুমি অনেক সুখী হবে
আমাকে যদি বলতে বলো তাহলে বলতেই হয় তোমার ভেতরের চোখের পরীক্ষা করানো দরকার, বলল রন, এরপর তাদের দুজনকেই হাসির টুটি চেপে ধরতে হলো, কারণ প্রফেসর ট্রিলনি ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন।
এবার আমার পালা হ্যারির চায়ের কাপে উঁকি মারল রন। অনেক কসরৎ করে দেখতে হচ্ছে বলে ওর কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। গুজবেরি ফলের মতো কি যেন একটা দেখা যাচ্ছে কিছুটা বোলারদের হ্যাট-এর মতে, বলল সে। হয়তো তুমি ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ে কাজ করবে
চায়ের কপিটাকে অন্য দিক থেকে উঁচু করল সে।
কিন্তু এভাবে ওটাকে ওক গাছের বীজ বা ফলের মতো দেখাচ্ছে। আনফগিং দ্য ফিউচার খানা ঘাটতে ঘাটতে বলল সে। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি সোনা। চমৎকার, আমাকেও কিছু ধার দিতে পার। এবং এখানেও একটি জিনিষ রয়েছে, বলে সে কাপটা আবার ওল্টালো, এখন ওখানে একটা জন্তু দেখা যাচ্ছে। ইস! ওটাই যদি ওর মাথাটা হতো এটা দেখতে জলহস্তীর মতো …না, ভেড়ার মতো
হ্যারি হেসে উঠতেই পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রফেসর ট্রিলনী।
ওটা আমাকে দাও দেখি, রনকে বললেন তিনি তিরস্কারের ভঙ্গিতে। যেন উড়ে গিয়ে রনের হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিলেন হ্যারির কাপটা। সবাই নির্বাক, দেখছে।
ঘড়ির কাটার উল্টো দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে কাপটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি।
বাজপাখী তোমার একটি মারাত্মক শত্রু রয়েছে ডিয়ার।
কিন্তু সবাই তো তার কথা জানে, জোরে ফিস ফিস করে বলল হারমিওন। প্রফেসর ট্রিলনী ওর দিকে কটমট করে চাইলেন।
হ্যাঁ, তারা জানে বৈকি, বলল হারমিওন। সবাই জানে হ্যারি আর ইউ–নো হুর কথা।
বিস্ময় আর প্রশংসায় হ্যারি আর রন তাকিয়ে রইল ওর দিকে। হারমিওনকে এভাবে টিচারের সঙ্গে কথা বলতে তারা আর কখনও শোনেনি। প্রফেসর ট্রিলনী যেন ঠিক করেছেন তিনি হারমিওনের কথার জবাব দেবেন না। বড় বড় চোখ দুটো আবার হ্যারির কাপের দিকে নামিয়ে তিনি আবার ওটা ঘোরাতে লাগলেন।
মুগুড় একটা আক্রমণ। এটা কোন সুখদায়ক কাপ নয়। আমি মনে করেছিলাম ওটা একটা বোউলার্স হ্যাট, ভয়ে ভয়ে বলল রন।
মাথার খুলি তোমার সামনে বিপদ, মাই ডিয়ার
সবাই প্রফেসর ট্রিলনীর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছে, যেন অসাড়, তিনি কাপটাকে শেষবারের মতো একবার ঘোরালেন, হা করে অনেক কষ্টে শ্বাস নিলেন এবং তারপর তীব্র তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো তার গলা চিরে।
কাপ ভাঙ্গার আরেকটি তীক্ষ্ণ শব্দ পাওয়া গেলো; নেভিল তার দ্বিতীয় কাপটাও ভেঙ্গেছে। একটা শূন্য আরাম কেদারায় ধপ করে বসে পড়লেন প্রফেসর ট্রিলনী। চকচকে হাতটা বুকে চেপে আছেন, চোখ দুটো বন্ধ।
মাই ডিয়ার বয় বেচারা … না না বলাটাই ভালো হবে …না… আমাকে জিজ্ঞাসা করো না।
ওটা কি প্রফেসর? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল ডিন থমাস। সকলেই উঠে দাঁড়িয়েছে এবং হ্যারি আর রনের টেবিলের চারপাশে জড়ো হয়েছে। প্রফেসর ট্রিলনীর চেয়ারের কাছে চলে এসেছে হ্যারির কাপটাকে ভালো করে দেখবার জন্যে।
মাই ডিয়ার, নাটকীয়ভাবে খুলে গেলো প্রফেসর ট্রিলনীর চোখ, তোমার পথে ভয়ংকর করালদর্শন দ্য গ্রিম।
দ্য কি? বলল হ্যারি।
ও বুঝতে পারছে একমাত্র সেই যে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না তা নয়; ডিন থমাস ওর দিকে কাঁধ ঝাঁকালো আর ল্যাভেন্ডার ব্রাউনকে বিভ্রান্ত দেখালো, বাদবাকী প্রায় সকলেই ভয়ে মুখে হাত চাপা দিল।
দ্য গ্রিম, মাই ডিয়ার, দ্য গ্রিম! চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর ট্রিলনী এবং হ্যারি যে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না তাতে তিনি মনে মনে আঘাতই পেলেন। দৈত্যাকার ভুতুড়ে কুকুর যেটা গীর্জার আশে পাশে ঘুরে বেড়ায়! মাই ডিয়ার বয় এটা একটা অত্যন্ত অশুভ লক্ষণ–সবচেয়ে খারাপ লক্ষণ–মৃত্যু!
হ্যারির পেট যেন ভেতর দিকে সেঁধিয়ে গেলো। ফ্লারিশ অ্যান্ড ব্লটস-এ ডেথ ওমেনস-এর মলাটে সেই কুকুরটা–ম্যাগনোলিয়া ক্রিসেন্টের ছায়ায় কুকুরটা ল্যাভেন্ডার ব্রাউনও মুখে হাত চেপে ধরল। সকলেই হ্যারির দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সকলেই, একমাত্র হারমিওন ছাড়া, যে উঠে গিয়ে প্রফেসর ট্রিলনীর চেয়ারের পেছনে দাঁড়াল।
আমার মনে হয়না ওটা গ্রিম-এর মতো দেখতে, সোজা সাপটা বলে দিল হারমিওন।
ক্রমবর্ধমান বিতৃষ্ণা নিয়ে ওকে চোখের দৃষ্টিতে মাপছেন প্রফেসর ট্রিলনী।
যা বলছি তার জন্যে ক্ষমা করে দিও, তোমার মধ্যে আমি তো অলৌকিক ক্ষমতার আভা দেখতে পাচ্ছি না। ভবিষ্যতের অনুরণন ধারণ করার ক্ষমতা একেবারেই কম।
মাথা এদিক থেকে ওদিক দোলাচ্ছিল সিমাস ফিনিগান।
প্রায় নিমীলিত চোখে বলল, আপনি যদি এমন করেন তবে ওটাকে ঘিম-এর মতোই লাগে। বাম দিকে হেলে গিয়ে বলল, কিন্তু এখান থেকে ওটাকে গাধার মতোই মনে হচ্ছে।
আমি মরছি কি, মরছি না এটা তোমরা নির্ধারণ করা কখন শেষ করবে। নিজের কথায় হ্যারি নিজেই অবাক হয়ে গেলো। এখন কেউই ওর দিকে তাকাতে চাচ্ছে না।
আমার মনে হয় আজকের মতো এ পর্যন্তই থাক, প্রফেসর ট্রিলনী তার রহস্যময় স্বরে বললেন। হ্যাঁ …তোমাদের জিনিষপত্র গোছগাছ করে নাও
নীরবে গোটা ক্লাসটাই ওদের চায়ের কাপ গুলো প্রফেসরকে ফিরিয়ে দিল। বই গোছালো। যার যার ব্যাগ বন্ধ করল। এমনকি রনও হ্যারির চোখে চোখে তাকাতে পারছে না।
আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত, ক্ষীণ স্বরে বললেন প্রফেসর ট্রিলনী, ভাগ্য তোমাদের ভালো থাকুক। ওহ এবং ডিয়ার– নেভিলকে দেখিয়ে বললেন পরের বার তোমার দেরী হবে, মনে রেখো অন্যদের সঙ্গে তাল মেলাতে তোমাকে অতিরিক্ত কাজ করতে হবে।
প্রফেসর ট্রিলনীর মই বেয়ে হ্যারি, রন আর হারমিওন নেমে সিঁড়ি দিয়ে নিচে এলো নীরবে। তারপর ছুটল প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর ট্রান্সফিগিউরেশন ক্লাসের উদ্দেশ্যে। ক্লাস রুমটা খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে গেলো, আগের ক্লাস থেকে আগে বেরিয়েও একেবারে শুরু হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পৌঁছাতে পারল ওরা।
রুমের একেবারে পেছনের একটা আসন বেছে নিল হ্যারি। তারপরও ওর মনে হতে লাগল একেবারে উজ্জ্বল স্পটলাইটের নিচে বসে রয়েছে সে; আর ক্লাসের অন্যরা ওকে দেখছে চোরা চাহনীতে যেন যে কোন মুহূর্তে ও মরে পড়ে থাকবে। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ওদের অ্যানিম্যাজি (যাদুকর, যারা স্বেচ্ছায় পশুতে রূপান্তরিত হতে পারে) সম্পর্কে পড়াচ্ছিলেন, হ্যারির কানে কিছুই ঢুকছে না এবং প্রফেসর যখন ওদের সামনেই নিজেকে চোখে চশমার দাগওয়ালা বিচিত্র বর্ণের ডোরা কাটা বাদামী রঙের বেড়ালে রূপান্তরিত করলেন তখনও সে ওদিকে তাকিয়ে দেখেনি।
ছোট্ট একটা শব্দ করে আবার নিজের আকৃতিতে ফিরে এসে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বললেন, সত্যিই তোমাদের আজ হয়েছে কী? চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, অবশ্য কিছু এসে যায় না, কিন্তু এবারই প্রথম আমার রূপান্তর কোন ক্লাস থেকে আভিন্দন পেল না।
সবগুলো মাথা আবার হ্যারির দিকে ঘুরে গেলো, কিন্তু কেউই কোন কথা বলল। তারপর, হাত তুলল হারমিওন।
প্লিজ, প্রফেসর, এইমাত্র আমাদের প্রথম ডিভাইনেশন ক্লাশ শেষ করে এলাম, এবং আমরা চা-পাতার মর্মার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করছিলাম, আর
আহ, নিশ্চয়ই, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, হঠাৎ ভ্রুকুটি করে। আর কিছুই বলবার দরকার নেই, মিস গ্রেঞ্জার। এখন বলো তোমাদের মধ্যে কে এ বছর মারা যাচ্ছো?
সবাই স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।
আমি, অবশেষে বলল হ্যারি।
আচ্ছা, বললেন প্রফেসর ক্ষুদে ক্ষুদে উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টিতে হ্যারিকে বিদ্ধ করে। তাহলে, তোমার জানা উচিৎ, পটার, এ স্কুলে আসার পর থেকেই সিবিল ট্রিলনী প্রত্যেক বছরই একজন ছাত্রের মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যত্বাণী করেছে। এখন পর্যন্ত তাদের একজনেরও মৃত্যু হয়নি। অশুভ লক্ষণ বা ওমেন দিয়ে নতুন ছাত্রদের অভ্যর্থনা জানানো তার খুব প্রিয় পন্থা। অবশ্য আমি আমার সহকর্মীদের সম্পর্কে কখনই খারাপ কিছু বলি না– হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। ওরা দেখল প্রফেসরের নাকের পাটা সাদা হয়ে গেছে। আরো শান্ত স্বরে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বলে যেতে লাগলেন, ডিভাইনেশন হচ্ছে ম্যাজিকের সব চেয়ে অপূর্ণ এবং কম নিখুঁত শাখা। তোমাদের কাছে লুকবো না এ বিষয়ে আমার ধৈর্য খুব কম। সত্যিকারের (ভবিষ্যৎ) দ্রষ্টার দেখা পাওয়া একটি বিরল ব্যাপার এবং প্রফেসর ট্রিলনী
আবার থামলেন তিনি। বললেন সাদামাটা স্বরে, আমার তো মনে হচ্ছে, পটার তোমাকে আজ খুবই সুস্থ দেখাচ্ছে, এ অবস্থায় আমি যদি তোমাকে হোম ওয়ার্ক থেকে রেহাই না দিই তবে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না, তবে তোমাকে আশ্বস্ত করছি মরে গেলে আর হোম ওয়ার্ক দিতে হবে না।
হারমিওন হাসল। হ্যারির একটু ভালো বোধ হলো। প্রফেসর ট্রিলনীর মাতাল করা পারফিউমের গন্ধ আর প্রায়ান্ধকার লাল বাতি থেকে দূরে বসে এক মুঠো চা পাতার ভয়ে ভীত হওয়া কঠিন বৈকি। তারপরও অনেকেই প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না। রনকে এরপরও বিচলিত দেখাচ্ছিল, এবং ল্যাভেন্ডার ফিস ফিস করে বলল, কিন্তু নেভিলের চায়ের কাপের ব্যাপারটা কী তাহলে?
ট্রান্সফিগিউরেশন ক্লাস শেষ হওয়ার পর দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যে গ্রেট হল অভিমুখী ভিড়ের সঙ্গে ওরাও যোগ দিল।
রনের দিকে তরকারির একটা ডিশ ঠেলে দিয়ে হারমিওন বলল, চিয়ার আপ, রন, তুমি তো শুনেছ প্রফেসর ম্যাকগোনাগল কি বলেছেন।
চামচ দিয়ে প্লেটে তরকারি তুলে নিল রন, কাটা চামচটাও তুলে নিল, কিন্তু খেতে শুরু করল না।
হ্যারি, বলল সে আস্তে করে, ওর স্বর সিরিয়াস। তুমি কোথাও বড় কোন কালো কুকুর দেখোনি তো, দেখেছ?
হু দেখেছি, বলল হ্যারি। যে রাতে ডার্সলিদের ছেড়ে এসেছি সে রাতেই দেখেছি।
শব্দ করে রনের হাত থেকে কাটা চামচটা পড়ে গেলো।
হবে একটা নেড়ী কুকুর, বলল হারমিওন শান্তভাবে।
রন এমনভাবে হারমিওনের দিকে তাকাল যেন ও (হারমিওন) পাগল হয়ে গেছে।
হারমিওন, যদি হ্যারি গ্রিম দেখে থাকে তাহলে–তাহলে ওটা দুঃসংবাদই, বলল রন। আমার আংকল বিলিয়াস একটা দেখেছিল এবং-এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মরে গিয়েছিলেন।
কাকতালীয় ব্যাপার, নিজের জন্য কদুর জুস ঢালতে ঢালতে হালকাভাবে বলল হারমিওন।
তুমি জান না তুমি কি বলছ! বলল রন, ক্ষেপে উঠতে শুরু করেছে সে। ভয়ে সব জাদুকরেরই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায় গ্রিম দেখে!
এতক্ষণে সঠিক কথাটা বলেছ, আত্মবিশ্বাসের জোরে কথাটা বলল হারমিওন। ওরা গ্রিম দেখে ভয়েই মারা যায়। গ্রিম কোন অশুভ লক্ষণ নয় ওটাই মৃত্যুর কারণ! এবং হ্যারি এখনও আমাদের মধ্যে বেঁচেই রয়েছে এই জন্যে যে কারণ একটা গ্রিম দেখে প্রাণ ত্যাগের মতো বোকা সে নয়!
নিঃশব্দে হারমিওনের উদ্দেশ্যে মুখ ভেংচাল রন। ব্যাগ খুলে অ্যারেথম্যানসি বইটা বের করে জুসের জগের গায়ে হেলান দিয়ে ওটা খুলে রাখল।
আমার মনে হয় ডিভাইনেশনটা একেবারেই অস্পষ্ট একটা বিষয়, বইয়ের নির্দিষ্ট পাতাটা খুঁজতে খুঁজতে বলল সে। আমার মতে অনেকটাই অনুমান নির্ভর।
ওই কাপের মধ্যেকার গ্রিম সম্পর্কে কোন কিছুই অস্পষ্ট নয়! উত্তপ্ত স্বরে বলল রন।
হ্যারিকে যখন বলছিলে ওটা একটা ভেড়া তখন তো তোমাকে খুব আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি, বলল হারমিওন শীতল গলায়।
প্রফেসর ট্রিলনী বলেছেন তোমার মধ্যে (ডিভাইনেশন উপলদ্ধি করার মতো) সঠিক ক্ষমতাটাই নেই!
হারমিওনের আঁতেই ঘা দিল রন। এত জোরে অ্যারিথম্যানসি বইটা বন্ধ করল হারমিওন যে কিছু মাংস আর গাজর এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল।
ডিভাইনেশন-এ ভালো হওয়ার মানে যদি এক দলা চা–পাতার মধ্যে মৃত্যুর লক্ষণ দেখা, তাহলে মনে হয় না আমি খুব বেশিদিন ওটা পড়ব! আমার অ্যারিথম্যানসি ক্লাসের তুলনায় ওটা একেবারে রাবিশ!
ছোঁ মেরে ব্যাগটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে দীর্ঘ দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল হারমিওন।
ওর চলে যাওয়ার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল রন।
কি কথা বলছে ও? হ্যারিকে বলল রন। এখনও তো সে অ্যারিথম্যানিসি ক্লাস যাওয়াই শুরু করেনি।
***
লাঞ্চের পর ক্যাসেল বা দুর্গ–প্রাসাদটা থেকে বেরোতে পেরে হ্যারি যেন স্বস্তি পেল। গতকালের বৃষ্টি আর নেই; আকাশ পরিষ্কার, বিবর্ণ ধূসর। ওরা যখন ম্যাজিকেল প্রাণীর যত্ন নেয়া বিষয়ক ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করল পায়ের নিচে তখন ভেজা আর সতেজ ঘাস।
রন আর হারমিওন পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে না। ওরা নীরবে ঢাল বেয়ে নিষিদ্ধ বনের ধারে হ্যাগ্রিডের কুটিরের দিকে এগোচ্ছে, পাশে পাশে হাটছে হ্যারি নীরবে। সামনে তিনটি অতি পরিচিত পেছন দিক, দেখে হ্যারি বুঝতে পারল এই ক্লাসগুলো ওদের স্লিথারিনদের সঙ্গে একত্রে করতে হবে। ক্র্যাব আর গোয়েল-এর সঙ্গে উদ্দীপ্ত ভাবে কথা বলছে ম্যালফয়, আর ওরা খল খল করছে আনন্দে। হ্যারি নিশ্চিত যে ও জানে ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু।
কুটিরের দরজায় ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছিল হ্যাগ্রিড। ছুঁচোর চামড়ায় তৈরি ওভারকোট পরে অধীরভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে কুকুর ফ্যাংকে পাশে নিয়ে।
এসো এসো জলদি করো! ডাকল হ্যাগ্রিড, ওরা কাছে আসতেই। তোমাদের জন্যে আজ বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে! সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আসছে! সবাই এসে গেছে? ঠিক আছে, আমাকে অনুসরণ করো!
একটা খুব খারাপ মুহূর্তে হ্যারি ভাবল হ্যাগ্রিড ওদেরকে বনের ভেতর নিয়ে যাচ্ছে; ওখানে হ্যারির এমন অনেক দুঃস্বপ্নের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে যা জন্মের জন্যে যথেষ্ট। যাই হোক গাছের ধার থেকে হ্যাগ্রিড দূরে সরে এলো এবং পাঁচ মিনিট পর ওরা নিজেদের একটা ভোলা ছোট মাঠের বাইরে দেখতে পেলো। ওখানে আর কিছুই নেই।
সবাই এখানে এই বেড়ার পাশে এসে দাঁড়াও! সে ডাকল। হ্যাঁ ঠিক আছে তোমরা দেখতে পাচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করে নেবে। এখন, প্রথমেই তোমরা তোমাদের যার যার বই খোলার চেষ্টা করবে।
কীভাবে? বলল ডাকো ম্যালফয় টেনে টেনে ঠাণ্ডা গলায়।
এহ? বলল হ্যাগ্রিড।
কীভাবে খুলব বই আমরা? আবার বলল ম্যালফয়।
সে তার দ্য মনস্টার বুক অফ মনস্টার্স বইখানা বের করল, বইটি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সবাই তাদের বই বের করল। কেউ কেউ, যেমন হ্যারি, বেল্ট দিয়ে বই বেঁধে রেখেছে। অন্যরা ব্যাগের ভেতর শক্ত করে ঠেসে রেখেছে, না হয় তো বড় বড় ক্লিপ দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে।
কেউই কী তার বই খুলতে পারোনি? হতাশ স্বরে জিজ্ঞাসা করল হ্যাগ্রিড।
সবাই মাথা নাড়ল।
আস্তে আস্তে হাত বোলাতে হবে বইয়ের ওপর, বলল হ্যাগ্রিড যেন এটাই বিশ্বের একমাত্র করণীয় কাজ। দেখো
সে হারমিওনের বইটা নিয়ে ওপরের টেপটা ছিঁড়ে ফেলল। বইটা কামড় দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু হ্যাগ্রিড তার দৈত্যাকার একটা আঙুল বইটার মাঝ (মেরুদণ্ড) বরাবর চালিয়ে দিল, কেঁপে উঠল বইটা, তারপর খুলে গিয়ে হাতের উপর শান্ত হয়ে থাকল।
ওহ! আমরা কি বোকা! অবজ্ঞাভরে বলল ম্যালফয়। আমাদের হাত বোলানো উচিৎ ছিল! আমরা কেন ভাবতে পারিনি!
আমি আমি ভেবেছিলাম ওগুলো খুব মজার, দ্বিধাভরে হারমিওনকে বলল হ্যাগ্রিড।
ওহ, সাংঘাতিক রকমের মজার! বলল ম্যালফয়। সত্যিই বুদ্ধি আছে বৈকি, আমাদেরকে এমন সব বই দেয়া হলো যেগুলো কামড়ে হাত ছিঁড়ে ফেলতে চায়!
চুপ করো, ম্যালফয়, বলল হ্যারি শান্ত স্বরে। হ্যাগ্রিডকে মনমরা দেখাচ্ছে এবং হ্যারি চাচ্ছে হ্যাগ্রিডের প্রথম ক্লাশটা যেন সফল হয়।
ঠিক আছে, তাহলে, বলল হ্যাগ্রিড, মনে হচ্ছে ও খেই হারিয়ে ফেলেছে, তাহলে তাহলে তোমরা বই পেয়ে গেছ এবং এবং এখন তোমাদের দরকার হবে ম্যাজিক্যাল প্রাণীগুলো। ইয়েহ। আমি যাই ওগুলোকে নিয়ে আসি। অপেক্ষা করো।
দীর্ঘ পায়ে হেঁটে ও বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলো।
হে ঈশ্বর, এ যায়গাটা একেবারে গোল্লায় গেছে, জোরে বলে উঠল ম্যালফয়। ওই ভূতের বাচ্চাটা ক্লাশ নিচ্ছে, বাবাকে যদি বলি তাহলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে
চুপ করো ম্যালফয়, আবার বলল হ্যারি।
সাবধান পটার, উন্মত্ত ঘাতক কিন্তু তোমার পিছু লেগেছে।
উউউউউউউহ! খোলা মাঠটার উল্টো দিক দেখিয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল ল্যাভেন্ডার ব্রাউন।
ওদের দিকে হেলে দুলে এগিয়ে আসছে হ্যারির জীবনে দেখা সবচেয়ে উদ্ভট প্রাণী। সংখ্যায় ডজনখানেক। ওগুলোর শরীর, পেছনের পা এবং লেজ ঘোড়ার মতো। কিন্তু সামনের পা, পাখা এবং মাথাটা বিশাল দৈত্যাকার ঈগলের। আরো রয়েছে নিষ্ঠুর দেখতে ইস্পাত রঙ্গের ঠোঁট এবং বিশাল কমলা রঙ্গের চোখ। সামনের পা দুটোর বাঁকা নখ প্রায় আধ ফুট লম্বা এবং দেখতে ভয়ংকর। প্রত্যেকটি প্রাণীর গলায় চেন লাগানোমোটা চামড়ার কলার পরানো রয়েছে, সব গুলো চেন এরই অন্য প্রান্ত হ্যাগ্রিডের বিশাল হাতে ধরা। জগিং করতে করতে উদ্ভট প্রাণীগুলোর পেছন পেছন ছুটে আসছে ও খোলা মাঠের ভেতর।
ওই দিকে যাও! গর্জন করে উঠল সে হাতের শেকল গুলো ঝাকড়াতে ঝাকড়াতে, প্রাণীগুলোকে তাড়া দিল বেড়ার দিকে যেতে যেখানে পুরো ক্লাশটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। হ্যাগ্রিড বেড়ার সঙ্গে প্রাণীগুলোকে বাঁধতে গেলে সকলেই একটু পিছিয়ে গেল।
হিপোগ্রিফস! খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল সে ওদের দিকে হাত নেড়ে। খুব সুন্দর, তাই না?
হ্যারি যেন এক রকম বুঝতে পারছে হ্যাগ্রিড কি বোঝাতে চাচ্ছে। এরকম একটা প্রাণী যেটা অর্ধ–অশ্ব অর্ধ–পাখি সেটা দেখবার প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠলে হিপোগ্রিফকে দেখতে ভালো লাগতে থাকে। ওদের গায়ের চকচকে পালকগুলো ক্রমশ পশমে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া। প্রতিটি হিপোগ্রিফ ভিন্ন ভিন্ন রঙের, কড়া ধূসর, তামাটে, গোলাপী ফুটকি ওয়ালা, চকচকে বাদামী অথবা কালির মতো কালো।
তাহলে, হাত দুটো মলতে মলতে চারদিকে উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল হ্যাগ্রিড, তোমরা যদি আরেকটু কাছে আসতে চাও
মনে হলো কাছে যেতে কেউই আগ্রহী নয়। অবশ্য হ্যারি, রন আর হারমিওন অতি সাবধানে বেড়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রথমে যে কথাটা হিপোগ্রিফদের সম্পর্কে তোমাদের জানা দরকার সেটা হচ্ছে ওরা কিন্তু ভীষণ রকমের আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন, বলল হ্যাগ্রিড। খুব সহজেই ওদের মর্যাদায় আঘাত লাগে, হিপোগ্রিফদের। কখনই ওদেরকে অপমান বা অসম্মান করবে না, কারণ তাহলে ওটাই হয়তো হবে তোমার জীবনের সর্বশেষ কাজ।
ম্যালফয়, ক্র্যাব আর গয়ল কিছুই শুনছিল না; ওরা নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলছিল। হ্যারির কেমন যেন একটা জঘন্য ধারণা হতে লাগল যে ওরা হ্যাগ্রিডের ক্লাশটাকে বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্র করছে।
হিপোগ্রিফটাই যেন প্রথম সাড়া দেয় তার জন্যে তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, হ্যাগ্রিড বলে চলল। ওরা খুব বিনয়ী, দেখো? ওর দিকে তুমি অগ্রসর হও, ওকে বো করো এবং অপেক্ষা করো। যদি সে পাল্টা বো করে, তার মানে হচ্ছে ওকে ছোঁয়ার সম্মতি মিলল। যদি ও পাল্টা বো না করে তবে দ্রুত তোমাকে ওর সামনে থেকে সরে যেতে হবে, কারণ পায়ের ওই বড় বড় বাঁকা নখগুলো খুব বিপদজনক, সাংঘাতিকভাবে জখম করতে পারে।
ঠিক আছে-এখন কে প্রথমে আসতে ইচ্ছুক?
জবাবে ক্লাশের বেশিরভাগই আরো পেছনে সরে গেলো। এমনকি হ্যারি, রন আর হারমিওনেরও ভয় অমঙ্গলের। হিপোগ্রিফগুলো তাদের হিংস্র মাথা দোলাচ্ছে এবং শক্তিশালী পাখাগুলো নাড়ছে; এভাবে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখাটা ওরা পছন্দ করছে না বলেই মনে হচ্ছে।
যেন অনুনয় করছে এমনিভাবে বলল হ্যাগ্রিড,কেউই না?
আমি যাব, বলল হ্যারি।
পেছন থেকে কে যেন গভীর একটা শ্বাস নিল। পার্বতী এবং ল্যাভেন্ডার ফিস ফিস করল, উউউউহ, না, হ্যারি না, তোমার চা–পাতা গুলোর কথা মনে কর!
ওদেরকে পাত্তাই দিল না হ্যারি। মাঠের বেড়া টপকালো সে।
লক্ষ্মী ছেলে! সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল হ্যাগ্রিড। ঠিক আছে–দেখা যাক বাকবিক–কে তুমি কি ভাবে সামলাও।
একটা চেইন আলাদা করে ধূসর হিপোগ্রিফটাকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করল সে। গলা থেকে চামড়ার কলারটা খুলে ফেলল। মাঠের বাইরে দাঁড়ানো ক্লাশের সকলে যেন নিঃশ্বাস চেপে রেখেছে। ম্যালফয়ের চোখ জোড়া সরু হয়ে গেছে বিদ্বেষে।
আস্তে ধীরে, হ্যারি, শান্ত স্বরে বলল হ্যাগ্রিড। ওর সঙ্গে তোমার দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে, চেষ্টা কর যেন চোখের পাতা না পড়ে যাদের চোখ বেশি পিট পিট করে হিপোগ্রিফ তাদের বিশ্বাস করে না…।
ততক্ষণে হ্যারির চোখ থেকে পানি বের হতে শুরু করেছে, কিন্তু ও চোখ বন্ধ করল না। বিশাল মাথাটা ঘুরিয়ে বাববিক তাকিয়ে আছে হ্যারির দিকে তার একটি কমলা রঙের ভয়ানক চোখ দিয়ে।
হ্যাঁ, এই ভাবে, বলল হ্যাগ্রিড। এই ভাবেই, হ্যারি এখন বো কর
হিপোগ্রিফের সামনে ঘাড় পেতে দেয়াটা ভালো লাগল না হ্যারির, কিন্তু যা বলা হলো সেটাই করল সে। ছোট্ট একটা বো করেই সোজা হলো সে, তাকাল হিপোগ্রিফের চোখে।
ওটা তখনও উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। নড়ল না ওটা।
আহ, বলে উঠল হ্যাগ্রিড, বিচলিত শোনাল ওর কণ্ঠস্বর। ঠিক আছে-এখন পেছনে আস্তে ধীরে পেছনে আসতে শুরু করো হ্যারি
কিন্তু সেই সময়, ঠিক সেই সময়, অপার বিস্ময়ে হ্যারি দেখল, হঠাৎ হিপেগ্রিফটা ওর সামনের আঁশওয়ালা হাটু দুটো বাঁকিয়ে অভ্রান্তভাবে বো করল।
চমৎকার, খুব ভালো হয়েছে, হ্যারি, বলল উচ্ছ্বসিত হ্যাগ্রিড। ঠিক আছে এখন ওকে ছুতে পারো তুমি! ওর ঠোঁটটাকে আদর করো, যাও!
হ্যারি ধীরে ধীরে হিপোগ্রিফের দিকে এগিয়ে গেলো, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু মনে মনে ভাবছে পিছু হটে যাওয়াই বোধহয় ভালো ছিল। কয়েকবার ওর ঠোঁটটাকে আস্তে আস্তে করে চাপড় মারল। এবং যেন আরামে চোখ বুজে ফেলল হিপোগ্রিফটা।
হাততালিতে ফেটে পড়ল পুরো ক্লাশ। ব্যতিক্রম শুধু ম্যালফয়, ক্র্যাব আর গয়ল, ওদেরকে খুবই হতাশ দেখাচ্ছিল।
ঠিক আছে হ্যারি, বলল হ্যাগ্রিড, আমার মনে হচ্ছে ও তোমাকে ওর পিঠেও চড়তে দেবে!
এটা হ্যারির প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। সে একটা ব্রুমস্টিক চড়তে অভ্যস্ত, কিন্তু হিপোগ্ৰিফে চড়াও যে একই রকম হবে সে ব্যাপারে সে অতটা নিশ্চিত নয়।
তুমি ওদিক দিয়ে উঠে পড়, ডানার–জয়েন্টের ঠিক পেছন দিয়ে, বলল হ্যাগ্রিড, এবং মনে রেখো ওর কোন পাখা টেনে বার করে নিও না, ওটা ও পছন্দ করবে না
বাকবকের ডানার ওপরে পা রেখে হ্যারি ওর পিঠে উঠে পড়ল। উঠে দাঁড়ালো হিপোগ্রিফটা। কিন্তু ধরবে কোথায়, বুঝতে পারছে না হ্যারি, ওর সামনে যা কিছু দেখা যাছে সবই পাখায় মোড়া।
যাও তাহলে, চিৎকার করে উঠল হ্যাগ্রিড, হিপোগ্রিফের পেছনে মারল এক চাপড়।
কোন রকম সতর্ক না করেই হ্যারির দুদিকে বারো–ফুট পাখা মেলে দিল জটা; হিপোগ্রিফটা আকাশে ওঠার আগে কোন মতে ওর গলা জড়িয়ে ধরবার সময় পেলো হ্যারি। ব্যাপারটা একেবারেই ব্রুমস্টিকের মতো নয় এবং হ্যারি জানে কোনটা ওর বেশি পছন্দ; ওর দুই দিকে পাখা দুটো বেকায়দাভাবে বাড়ি মারছে, পায়ে লাগছে আঘাতটা এবং ওর মনে হলো পড়ে যাচ্ছে যেন; মসৃণ পালকগুলো ওর মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু জোরেও ঠেসে ধরার সাহস পাচ্ছে না সে; হিপোগ্রাফের পেছনটা পাখার তালে তালে ওঠা নামা করছে আর হ্যারি ওর নিম্বাস দুই হাজারে সহজ ওড়ার তুলনায় সামনে পেছনে করছে বার বার।
খোলা মাঠটার চারদিকে একবার উড়ে এলো বাকবিক ওকে নিয়ে, তারপর মাটিতে নামতে শুরু করল; এবং এই সময়টাকেই হ্যারি সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিল; হিপোগ্রিফের মসৃণ গলাটা নিচের দিকে বাক নিতেই ও পেছন দিকে হেলে পড়ল, ভয় হচ্ছিল ওটার ঠোঁটের ওপর দিয়ে পিছলে পড়ে যাবে ও; চারটি সামঞ্জস্যহীন পা যখন মাটিতে পড়ল একটা ধাক্কা খেল হ্যারি, পড়তে পড়তে কোন রকমে সামলে নিয়ে আবার সোজা হতে পারল।
চমৎকার হ্যারি, সোল্লাসে গর্জন করল হ্যাগ্রিড। ম্যালফয়, ক্র্যাব আর গয়ল ছাড়া ক্লাশের বাকি সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। এবার কে যেতে চাইছ?
হ্যারির সাফল্যে সাহস পেয়ে এবার ক্লাশের বাকি সবাই সাবধানে বেড়া টপকে মাঠে চলে এলো। হ্যাগ্রিড একটার পর একটা হিপোগ্রিফের বাঁধন খুলে দিল, এবং তারপর পুরো মাঠ জুড়ে দেখা গেল নার্ভাস কতগুলো লোক কুর্ণিশ করছে।
নেভিল ওর হিপোথিফের কাছ থেকে বার বার দূরে সরে আসছে, মনে হচ্ছে ওটা কিছুতেই হাটু বাঁকা করতে চাচ্ছে না। রন আর হারমিওন চেষ্টা করছে বাদামী রঙেরটাকে নিয়ে, দেখছে ওদের।
ম্যালফয়, ক্র্যাব আর গয়ল নিল বাকবিককে। ও ম্যালফয়ের প্রতি বো করেছে ঠিকই এবং ম্যালফয়ও ওটার ঠোঁটে হাত বোলাচ্ছে কিন্তু কাজটা করছে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে।
খুবই সহজ ব্যাপার একটা, হ্যারি যেন শুনতে পায় এমন জোরে টেনে টেনে বলল ম্যালফয়। আমি জানতাম এটা সহজ হতেই হবে, যদি পটার এটা করতে পারে আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি নিশ্চয়ই অত বিপদজনক নও, তাই? বলল ও হিপোগ্রিফটাকে উদ্দেশ্য করে। তুমি কী তাই, কুৎসিৎ জানোয়ার?
ইস্পাতের মতো বাঁকা নখগুলোর মুহূর্তের টানে ব্যাপারটা ঘটে গেল; ম্যালফয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার এবং পর মুহূর্তেই দেখা গেলো হ্যাগ্রিড বাকবিকের গলায় কলারটা পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, ওটা ম্যালফয়ের দিকে ধেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর ম্যালফয় বাঁকা হয়ে পড়ে রয়েছে ঘাসের ওপর ওর কাপড়ের ওপর দিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে রক্তের ধারা।
আমি মারা যাচ্ছি! আর্ত চিৎকার করে উঠল ম্যালফয়, পুরো ক্লাশটাই ভয় পেয়ে গেলো। আমি মরে যাচ্ছি, দেখো জানোয়ারটা আমাকে মেরে ফেলেছে!
তুমি মরে যাচ্ছো না! বলল হ্যাগ্রিড যে নিজেই ভিয়ে] ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কেউ একজন আমাকে সাহায্য করো–ওকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে হবে–
হারমিওন দৌড়ে গিয়ে গেটটা খুলে দিল, সহজেই ম্যালফয়কে পাজাকোলে করে তুলে নিয়ে রওয়ানা হলো হ্যাগ্রিড। যেতে যেতে হ্যারি দেখল ম্যালফয়ের বাহুতে লম্বা একটা গভীর ক্ষত; রক্ত ঝরছে ঘাসের ওপর, ওকে নিয়ে ঢাল বেয়ে ওপরে ক্যাসেলের দিকে ছুটছে হ্যাগ্রিড।
ভয়ে সকলের ভেতরটা নাড়া খেয়ে গেছে, পুরো ক্লাশটা ধীরে ধীরে হাটছে। স্লিথারিনের সকলেই হ্যাগ্রিডের উদ্দেশ্যে চিৎকার করছে।
ওকে এই মুহূর্তেই বরখাস্ত করা উচিৎ, কাঁদতে কাঁদতে বলল প্যানসি পারকিনসন।
দোষটা ম্যালফয়েরই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে বলল ডিন থমাস। জবাবে মুঠো পাকিয়ে মার দেয়ার ভঙ্গি করল ক্র্যাব আর গয়ল।
সিঁড়ির পাথরের ধাপগুলো বেয়ে ওরা সবাই জনশূন্য সামনের হলরুমটায় ঢুকল।
আমি দেখে আসছি ও ঠিক আছে কি না! বলল প্যানসি, ওরা দেখল মার্বেল সিঁড়ির ধাপগুলো দৌড়ে উঠে গেলো ও। স্লিথারিনরা তখনও হ্যাগ্রিডের উদ্দেশ্যে বিড় বিড় করছে, ধীরে ধীরে ওদের ভূগর্ভস্থ কক্ষের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলো ওরা; হ্যারি, রন আর হারমিওন ওপর তলায় উঠে গেলো গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে।
নার্ভাস হারমিওন জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কি মনে হয় ও সেরে যাবে?
অবশ্যই, ম্যাডাম পমফ্রে মুহূর্তের মধ্যেই কাটাছেঁড়া সারাতে পারেন, বলল হ্যারি, আরো অনেক অনেক বেশি খারাপ ক্ষত ম্যাজিকের মতো সারিয়ে দিয়েছেন তিনি।
হ্যাগ্রিডের প্রথম ক্লাশেই অমন একটা দুর্ঘটনা হওয়াটা খারাপই হয়েছে, তাই? বলল রন, বিচলিত দেখাচ্ছে ওকে। ম্যালফয়ই পুরো ব্যাপারটা গুবলেট করে দিয়েছে …
ডিনারের সময় হলে ওরাই প্রথমে গ্রেট হলে গিয়ে পৌঁছাল, হ্যাগ্রিডকে দেখতে পাবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু নেই সে ওখানে।
ওরা তো ওকে বরখাস্ত করবে না, করবে? উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল হারমিওন, সামনে পড়ে থাকা স্টেক আর কিডনি–পুডিং ছুঁয়েও দেখেনি সে।
না করাই ভালো হবে, বলল রন, খাচ্ছে না সেও।
হ্যারি তাকিয়ে রয়েছে স্লিথারিন টেবিলটার দিকে। ক্র্যাব আর গয়ল সহ একটা বিরাট গ্রুপ একত্র হয়ে গভীরভাবে কথা বলছে। হ্যারি নিশ্চিত যে, ম্যালফয়ের আহত হওয়ার নিজস্ব একটা গপ্পো ওরা তৈরি করছে।
বেশ, তোমরা নিশ্চয়ই বলতে পারবে না প্রথম দিনটা ইন্টারেস্টিং ছিল না, গোমড়া মুখে বলল রন।
ডিনারের পর গ্রিফিন্ডর কমন রুমে এলো ওরা। এখানে বেশ লোকজন রয়েছে। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর দেয়া হোমওয়ার্ক করার চেষ্টা করল ওরা। কিন্তু তিনজনের কেউই মনোযোগ দিতে পারল না, বার বার টাওয়ারের জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেলো ওদের দৃষ্টি।
হ্যাগ্রিডের জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ বলে উঠল হ্যারি।
ঘড়ি দেখল রন।
যদি দ্রুত যেতে পারি তাহলে ওর সঙ্গে দেখা করে আসতে পারি, এখনো বেশ বেলা রয়েছে ..
আমি বুঝতে পারছি না, ধীরে ধীরে কথাটা বলে হ্যারির দিকে তাকাল হারমিওন।
মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে আমার, বলল সে সুনির্দিষ্টভাবে। সিরিয়াস ব্ল্যাক এখানকার ডিমেন্টারসদের পেরিয়ে আসতে পারেনি এখনো, তাই না?
জিনিষপত্র রেখে ছবির ফুটোটা দিয়ে বের হয়ে রওয়ানা হলো ওরা। সামনের দরজায় কেউ না থাকাতে খুশি, কারণ এ সময় বের হওয়া উচিৎ কি না এ নিয়ে তারাও দ্বিধায় রয়েছে।
ঘাস এখনো ভেজা এবং গোধুলী বেলায় প্রায় কালো দেখাচ্ছে। হ্যাগ্রিডের কুটিরের দরজায় গিয়ে নক করলে ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ভেতরে এসো।
টেবিলেই বসে রয়েছে হ্যাগ্রিড শুধু সার্ট পড়ে, গায়ে কোট নেই; ওর হাউন্ড কুকুর ফ্যাং ওর কোলে মাথা দিয়ে রয়েছে। এক নজর দেখেই বোঝা গেল প্রচুর মদ্যপান করেছে সে; ওর সামনে বালতির সমান একটা পানপাত্র রয়েছে, এবং মনে হচ্ছে ওদেরকে দৃষ্টি সীমায় ধরতেই ওর অসুবিধা হচ্ছিল।
আশাকরি এটা একটা রেকর্ড হয়ে গেলো, ভারি গলায় বলল সে ওদেরকে চিনতে পেরে। মনে হয় না ওদের কখনও এমন শিক্ষক ছিল যে কি না মাত্র একদিনই টিকেছিল।
তোমাকে বরখাস্ত তো করা হয়নি, হ্যাগ্রিড! দম নিয়ে বলল হারমিওন।
এখনও করেনি, বলল হ্যাগ্রিড কাতরভাবে, পানপাত্রে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে। মাত্র তো সময়ের ব্যাপার, তাই না, ম্যালফয় বলার পর।
কেমন আছে ও? জিজ্ঞাসা করল রন, বসে পড়ল ওরা সবাই। আঘাতটা সিরিয়াস নয় নিশ্চয়ই, তাই না?
ম্যাডাম পমফ্রে যতটা সম্ভব করেছেন, বলল হ্যাগ্রিড, কিন্তু ও বলছে এখনো তীব্র ব্যথা পাচ্ছে … ব্যান্ডেজে মোড়া গোঙাচ্ছে।
ও ভান করছে, সঙ্গে সঙ্গে বলল হ্যারি। ম্যাডাম পমফ্রে যে কোন কিছুই সারাতে পারেন। গত বছর আমার নিজের অর্ধেক হাড় গজিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বাস করো ম্যালফয় এই অবস্থাটার পুরো সুযোগ নিচ্ছে।
নিশ্চয়ই স্কুল গভর্নরদেরও বলা হয়ে গেছে, কাতর কণ্ঠে বলল হ্যাগ্রিড। ওরা নিশ্চয়ই মনে করবেন আমি বিপদজনক একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলাম। হিপোগ্রিফদের ক্লাশটা আরো পরে শুরু করা উচিৎ ছিল ফ্লোবারওয়ার্মস বা ওই রকম কিছু দিয়ে শুরু করা আমি শুধু ভেবেছিলাম ওটাই প্রথম ক্লাশ হিসেবে ভালো হবে সবই আমার দোষ
সবটাই ম্যালফয়ের দোষ হ্যাগ্রিড! বলল হারমিওন আন্তরিকভাবে।
আমরা তো দেখেছি, বলল হ্যারি। তুমিই তো বলেছ হিপোগ্রিকদের অপমান করলে ওরা আক্রমণ করে। সমস্যাটা ম্যালফয়ের, কারণ ও তোমার কথা শোনেনি। আমরা ডাম্বলডোরকে বলবো আসল ঘটনা।
ঘাবড়ে যেও না হ্যাগ্রিড, আমরা তোমার পক্ষে থাকব। বলল রন।
হ্যাগ্রিডের গুবড়ে পোকার মতো কালো চোখের ভাঁজ পড়া কোণ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আবেগে হ্যারি আর রনকে জাপটে ধরে ওদের হাড় ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করলো সে।
আমার মনে হচ্ছে তোমার যথেষ্ট পান করা হয়ে গেছে, দৃঢ় স্বরে বলল হারমিওন। পানপাত্রটা তুলে নিয়ে বাইরে গিয়ে ওটা খালি করতে গেলো সে।
মানে, হয়তো সে ঠিকই বলছে, বলল হ্যাগ্রিড হ্যারি আর রনকে ছেড়ে দিয়ে। ওরা দুজন টলতে টলতে দূরে সরে গেলো, পাঁজর ঘষছে দুজনই।
চেয়ার থেকে নিজের ভারি দেহটাকে তুলল হ্যাগ্রিড এবং খলিত পদক্ষেপে হারমিওনকে অনুসরণ করল। ঘরের ভেতর থেকে ওরা পানি ছুঁড়ে ফেলার শব্দ শুনতে পেলো।
কি করল ও, জিজ্ঞাসা করল হ্যারি শূন্য পানপাত্রটা হাতে করে হারমিওন ফিরে আসতেই।
পানির পিপার মধ্যে ওর মাথাটা ডুবিয়ে নিল, পানপাত্রটা টেবিলে রাখতে রাখতে জবাব দিল হারমিওন।
হ্যাগ্রিড ফিরে এলো চোখ থেকে পানি মুছতে মুছতে, ওর দীর্ঘ চুল আর দাড়ি ভেজা।
এটাই ভালো, বলল সে কুকুরের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে, ভিজে গেলো ওরা সবাই। দেখো তোমরা যে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ এটা খুবই ভালো হয়েছে, সত্যিই আমি–
হঠাৎ থেমে গেল হ্যাগ্রিড একেবারে পাথরের মতো নিশ্চল, হ্যারির দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এই মাত্র সে খেয়াল করেছে যে হ্যারিও এখানে এসেছে।
তুমি কি করছ বলে ভেবেছ, এহ? সে রীতিমত গর্জন করে উঠল, এতই আকস্মিক যে ফুটখানেক শূন্যে লাফিয়ে উঠল সবাই। তোমার তো অন্ধকারের পর এভাবে ঘুরে বেড়াবার কথা নয়, হ্যারি! আর তোমরা দুজন ওকে এটা করতে দিচ্ছ।
দীর্ঘ পদক্ষেপে হ্যারির কাছে হেঁটে গেল হ্যাগ্রিড, ওর হাতটা ঠেসে ধরে টেনে নিয়ে গেল দরজার দিকে।
এসো! রীতিমত ক্ষেপে গেছে হ্যাগ্রিড। আমি তোমাদের সবাইকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আর যেন না দেখি এরপর তোমরা আমাকে অন্ধকারের পর দেখতে এসেছ। আমি এর উপযুক্ত নই!