০৬. টুনুর লেখা গল্প

দৈনিক ভোরের কাগজের সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত টুনুর লেখা গল্প।

মূল উপন্যাসের সঙ্গে এই গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা মূল উপন্যাসে থাকতে চান, তারা এই অধ্যায়টা বাদ দিতে পারেন।

মাহিনের মৃত্যু
তৃপ্ত সেন

রাত দশটা থেকে দশটা পীচ এই সময়ের মধ্যে মাহিনের মৃত্যু হবে। এই তথ্য সে জানত। তাকে সন্ধ্যা ছাঁটায় মোবাইল ফোনে জানানো হয়েছে। টেলিফোন পাওয়ার পর তার সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সে হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল। মাহিনের স্ত্রী শেফালী বলল, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?

মাহিন মুখে কিছু বলল না, হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

শেফালী বলল, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?

হুঁ।

বেশি?

না বেশি না।

কতবার বলেছি। একজন ডাক্তার দেখাও। আমার কোনো কথা তুমি শোনো না। বুকে তেল মালিশ করে দিব?

না। ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাব। খুব ঠান্ডা।

শেফালী বলল, ফ্রিজের মনে হয় গ্যাস চলে গেছে। ঠান্ডা হয় না। পাশের ফ্ল্যাট থেকে এনে দেই?

লাগবে না।

কেন লাগবে না! ঠান্ড পানি নিয়ে আসছি।

শেফালী পানির বোতল নিয়ে এসেছে। মাহিনের হাতে পানির গ্ৰাস। এমনিতেই পানি ঠান্ডা, তারপরেও গ্লাসে দুটা বরফের টুকরা ভাসছে। মাহিন বরফের টুকরা দুটার দিকে তাকিয়ে আছে।

শেফালী বলল, গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছ, চুমুক দিচ্ছ না কেন?

মাহিন পানির গ্লাসে চুমুক দিল। পানি তিতা লাগছে। মৃত্যুর আগে পানি তিতা লাগে–এই কথা সে শুনেছে। বাস্তবেও যে লাগে তা জানা ছিল না। পানি শুধু যে তিতা লাগছে তা-না, রসুন রসুন গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।

শেফালী বলল, শ্বাসকষ্টটা কি কমেছে?

মাহিন বলল, হুঁ।

শেফালী বলল, ভিডিওর দোকান থেকে একটা ছবি এনেছি। দেখবো? অনেকদিন আমরা একসঙ্গে ছবি দেখি না।

মাহিন বলল, ছবি দেখব। কী ছবি?

গজনি। খুব না-কি ভালো ছবি।

হিন্দি?

হুঁ হিন্দি।

আমি তো হিন্দি বুঝি না।

শেফালী বলল, আমি বুঝিয়ে দেব।

মাহিন বলল, আচ্ছা। বাবু কখন আসবে?

শেফালী বলল, এগারোটার দিকে বড় ভাইজান বাবুকে নামিয়ে দিবেন। সে খুব মজা করছে। সবাইকে ছড়া শোনাচ্ছে।

বাবুছড়া জানে না-কি?

শেফালী বলল, তুমি তো ঘরেই থাকো না। বাইরে বাইরে ঘোরো। বাবু কত কী যে শিখেছে! বানিয়ে বানিয়ে গানও গায়।

কী গান?

শেফালী তার আড়াই বছরের ছেলের গান ছেলের মতো করে গেয়ে শোনাল–

মামণি ভালো
বেশি ভালো
অনেক ভুলো
বনেক ভালো।

মাহিন বলল, বনেক ভালোটা কী? শেফালী বলল, বানিয়ে বানিয়ে বলছে। তোমার ছেলে যে বানিয়ে বানিয়ে কত কথা বলে। মনে হয় বড় হয়ে কবি হবে।

মাহিন হঠাৎ বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে।

শেফালী লজ্জা পেয়ে গেল। মাহিন এই ধরনের কথা কখনো বলে না; বাসাতেই থাকে না, কথা কখন বলবে!

মাহিন ঘড়ি দেখল। সাতটা বাজে। এখনো হাতে তিনঘণ্টা সময় আছে। এর মধ্যে ছবি দেখে ফেলা যায়। তার মাথায় পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা আসছে না। তার বস এমন জিনিস যে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসে থাকলে সেখান থেকেও ধরে নিয়ে আসবে। বিসের সঙ্গে যে দুনম্বরিটা সে করেছে তা কারোরই ধরতে পারার কথা না। বাস ঠিকই ধরেছে এবং শাস্তির ব্যবস্থা করেছে।

শেফালী বলল, সব রেডি করেছি। এসো ছবি দেখি।

মাহিন বলল, কাছে আসো, তোমার সঙ্গে জরুরি। আলাপ আছে।

শেফালী চিন্তিত মুখে এগিয়ে এল। মাহিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার নামে একটা ব্যাংক একাউন্ট আছে। ব্র্যাক ব্যাংক। মিরপুর শাখা। একাউন্ট নাম্বার টেলিফোন বুকে লেখা আছে।

শেফালী অবাক হয়ে বলল, আমার নামে ব্যাংক একাউন্ট?

হ্যাঁ। সেখানে অনেক টাকা জমা আছে। আমার ভালোমন্দ কিছু হলে সেই টাকা ব্যবহার করবে।

তোমার ভালোমন্দ কিছু হবে কেন?

মানুষের ভালোমন্দ যে-কোনো সময় হয়। বিছানায় শুয়ে হার্টফেল করে মানুষ মরে যায় না? চলো ছবি দেখি।

ছবি চলছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে শেফালী। স্বামীকে হিন্দি ডায়ালগ তার বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। সে এতটাই মুগ্ধ যে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেও না। মাহিন তাকিয়ে আছে স্ত্রীর দিকে। তার স্ত্রী এত সুন্দর তা সে আগে কখনো লক্ষ করে নি। শেফালী হাসলে গালে টোল পড়ে তাও লক্ষ করে নি। তার ইচ্ছা করছে। স্ত্রীর গা ঘেঁসে বসতে। কিন্তু কেন জানি লজ্জা লাগছে।

ছবি শেষ হবার পরপরই গেট থেকে দারোয়ান ইন্টারকমে জানাল–ইসকান্দর নামে একজন তার বন্ধু নিয়ে এসেছে। এদের ঢুকতে দিবে কি না?

মাহিন বলল, ঢুকতে দাও।

শেফালী বলল, কে এসেছে?

মাহিন বলল, তুমি শোবার ঘরে যাও।

শেফালী আবার বলল, কে এসেছে?

মাহিন বলল, কে এসেছে তোমার জানার দরকার নাই। তুমি তোমার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে।

ইসকান্দর এবং তার সঙ্গী হামিদ বসার ঘরে ঢুকেছে। হামিদ সদর দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মাহিনের পাশে এসে দাঁড়াল। ইসকান্দর বলল, খবর কিছু পেয়েছেন?

মাহিন বলল, কী খবর?

বস-কে তো শেষ করে দিয়েছে।

কখন?

ইসকান্দর গলা নামিয়ে বলল, কখন সেটা জানি না। বস আমাকে বিকাল পাঁচটায় টেলিফোন করে বলল, অস্ত্র নিয়ে রাত নটায় তার কাছে যেতে। তিনি অপারেশনে পাঠাবেন। একজনকে শেষ করতে হবে। নটার সময় বসের কাছে গিয়ে দেখি–তিনি মরে পড়ে আছেন। কপালে গুলি, পেটে গুলি, বুকে গুলি।

মাহিন সিগারেট ধরাল। হামিদ বলল, ওস্তাদ এখন আপনিই আমাদের বস। কী করব বলেন।

মাহিন সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাও। সাতদিন ঝিম ধরে থাকো।

ইসকান্দর বলল, বস তাহলে চলে যাই?

মাহিন বলল, যাও।

তারা চলে গেল। মাহিন শোবার ঘরে ঢুকে শেফালীকে বলল, ছবিটা আমি বুঝতে পারি নাই। তোমার বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তুমি বুঝাও নাই। ছবিটা আবার ছাড়ো।

ছবি শুরু থেকে চলছে। মাহিন স্ত্রীর হাত ধরে বসে আছে। মাথার ওপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। শেফালীর চুল এসে মহিনের চোখে-মুখে লাগছে। কী মিষ্টি গন্ধ সেই চুলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *