০৬. টুকুর খোঁজ নেই

দেখতে দেখতে ছ’দিন হয়ে গেল— টুকুর খোঁজ নেই। মিনু প্রায় দুপুরবেলা নিজেই ছেলেকে খুঁজতে বের হন। কাউকে তা বলেন না। টুকুর প্রসঙ্গে কোনো রকম কথাবার্তায় তিনি অংশগ্রহণ করেন না। যেন টুকু নামে তার কেউ ছিল না।

এই ক’দিন তিথি টুকুর প্রসঙ্গ তুলেনি। আজ তুলল। হীরুকে বলল, থানায় খবর দিয়েছিস?

হীরু অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বলল, না।

না কেন?

আরে থানায় খবর দিয়ে হবেটা কি? কিছুই হবে না। উল্টা শালদের টাকা খাওয়াতে হবে।

টাকা খাওয়াতে হবে কেন?

পুলিশের কাছে যাবি আর টাকা খাওয়াবি না। এটা একটা কথা হল নাকি। পুলিশ সম্পর্কে তুই কিছুই জানিস না। থানায় খবর দেওয়ার ব্যাপারটা তুই ফরগেট করে ফেল।

আমরা কিছুই করব না? হাত গুটিয়ে বসে থাকব?

তোকে এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ব্যবস্থা নেযা হয়েছে।

কি ব্যবস্থা?

ঐসব জেনে তুই কী করবি? আমার ওপর ছেড়ে দে।

তোর ওপর ছেড়ে দিয়ে তো এই অবস্থা…

হীরু কোনো উত্তর না দিয়ে খাওয়া শেষ কবে উঠে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে তাকে এখন সিগারেট কিনতে যেতে হবে। টুকু না থাকায় এই একটা সমস্যা হয়েছে ছোট ছোট কাজে নিজেকেই যেতে হচ্ছে। ভরা পেটে হাঁটতে ভাল লাগে না।

টুকুকে নিয়ে যে তিথি চিন্তা করছে এতেও সে বেশ মজা পাচ্ছে। পীর সাহেবের কথামত দশ দিনের দিন টুকুর ফিরে আসার কথা। আসবে সেটা তো প্ৰায নিশ্চিত। কাজেই ছোটাছুটি হৈচৈ এর কোনো দরকার নেই। সিগারেট কিনতে কিনতে হীরুর মনে হল আজ কী একবার যাবে পীর সাহেবের কাছে? এমনি গিযে একটু কদমবুসি করে আসা আর কি?

 

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পরপরই মিনু বের হয়ে গেলেন। একটা ভবঘুরে কেন্দ্রের খোঁজ পেয়েছেন। পুলিশ ট্রাক ভর্তি ভিখিরি নিয়ে ঐখানে আটকে রাখে বলে শুনেছেন। কে জানে টুকুকেও বেখেছে কি-না!

তিনি ফিরলেন সন্ধ্যা মেলাবার পর। ঘর অন্ধকার। বারান্দায় তার বড় মেয়ে অরুর বর আব্দুল মতিন বসে আছে। রাগে মিনুর গা জ্বলে গেল। এ ছেলেকে দেখলেই তার এ রকম হয়।

আব্দুল মতিনের হাতে সিগারেট। শাশুড়িকে দেখে সিগারেট লুকাবার একটা ভঙ্গি করে উঠে এল। সিগারেট হাতেই পা ছুঁয়ে সালাম করল।

কেমন আছেন আম্মা?

মিনু শুকনো গলায় বললেন তুমি কখন এলে?

চারটার সময়। দেখি কেউ নাই। তখন থেকে একলা বসে আছি। বাসার আর লোকজন কোথায়?

জানি না কোথায়।

আব্দুল মতিন বিস্মিত হয়ে বলল, ঘর খালি রেখে সব চলে গেছে কি আশ্চর্য ব্যাপার। যে তালা দিয়েছেন এটা তো আম্মা বাতাস লাগলে খুলে যাবে।

খুলে গেলে কি আর করা। ঘরে আছেই বা কি যে সিন্দুকের তালা লাগাতে হবে। অরু আছে কেমন?

আছে মোটামুটি।

মোটামুটি কেন?

আরেকটা সন্তান হবে এই জন্যেই শরীরটা একটু ইয়ে। ডাক্তার বলেছে। রক্তের অভাব। আয়রন ট্যাবলেট দিয়েছে। ঐ খাচ্ছে দিনে তিনটা করে।

তুমি ঢাকায় এসেছ কী জন্যে, কোনো কাজে না এমনি…

বিনা কাজে কী আর আম্মা আমার মত মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারে? ঢাকা-কুমিল্লা যেতে আসতেই পঞ্চাশ টাকা খরচা। কাজে এসেছি।

কাজটা কী?

জি বলব। একটু চা দিতে পারবেন? গত রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয় নাই, শরীরটা একেবারে ইয়ে হয়ে গেছে। গোসল করব ভেবেছিলাম। বাথরুমে দেখি সাবান নাই…

কি আর করবে। সাবান ছাড়াই গোসল কর।

মিনু রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন।

ঘরে কিছু নেই। শুধু চা দিতে হল। তার জন্যে মিনু কোনো রকম সংকোচ বোধ করলেন না।

মতিন চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে বলল, টাকাটার জন্যে আসলাম আম্মা। বিপদে পড়েছি। যার টাকা তাকে দিতে হয়। রোজ তাগাদা দিচ্ছে। মিনু বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের টাকা?

ঐ যে গত মাসে হীরু গিয়ে নিয়ে আসল।

হীরু টাকা নিয়ে এল? কিসের টাকা?

আকবার চোখ অপারেশনের টাকা। আমার হাতে তখন একেবারে খালি। তা অরু, এমন কান্নাকাটি শুরু করল। আমি কি আর করব ধার করে জোগাড় করলাম। এমনিতে তো কেউ টাকা দেয় না। সুন্দ কবুল করে ধার। তা ভাবলাম কী আর করা চোখ বলে কথা।

কত টাকা?

মতিন অবাক হয়ে বলল, কত টাকা। আপনি জানেন না? মিনু বিরক্ত গলায় বললেন, জানলে তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম? জানি না বলেই জিজ্ঞেস করছি। কত টাকা এনেছে?

দুই হাজার।

কী সর্বনাশ বল কী তুমি!

আপনি কিছুই জানেন না? এ তো দেখি আরেক মুসিবিত হয়ে গেল। হীরু মনে হচ্ছে ফাটকি মেরে টাকা নিয়ে এসেছে। এখন কী করি আমি?

হীরু আসুক হীরুকে বল। যাকে টাকা দিয়েছে তার ঘাড় ধরে টাকা আদায় কর। আমার কাছে কী?

আপনার কাছে কী মানে? এইসব আপনি কী বলছেন আম্মা?

সত্যি কথাই বলছি। হীরুর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

এ তো বিরাট সমস্যায় পড়লাম। হীরুকে কী আমি টাকা দিয়েছি নাকি? টাকা দিলাম আপনাদের। রাত দশটার ট্রেনে ফিরব–এর মধ্যে যা হোক একটা ব্যবস্থা করেন। পুরোটা না হলেও অন্তত হাজার খানিক। নয়ত বিরাট বেইজ্জত হব।

বললেই তো হবে না। টাকা পাব কোথায়? টাকা গাছ তো বাবা পুতা নাই। সংসারের হাল অবস্থা তো জান। জেনেশুনে এ রকম অবুঝের মত কথা বললে হবে নাকি?

আমি কী অবুঝের মত কথা বললাম? পুরো বেইজ্জত হব লোকের সামনে…

না হয় শ্বশুর বাড়ির জন্যে খানিকটা বেইজত হলেই।

আম্মা। আপনি ব্যাপারটাই বুঝতে পারছেন না।

মিনু ক্লান্ত গলায় বললেন, এ টাকার আশা তুমি ছেড়ে দাও বাবা।

আব্দুল মতিন চোখ কপালে তুলে ফেলল।

ছেড়ে দেব? কী বলছেন?

যা সত্যি তা বললাম।

আব্দুল মতিন খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থেকে উঠে চলে গেল। কোথায় যাচ্ছে মিনু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। যাক যেখানে ইচ্ছা। পুরোপুরি চলে গেলেই ভাল। তবে পরোপুরি চলে যায়নি। হ্যান্ড ব্যাগ ফেলে গেছে। হ্যান্ড ব্যাগের জন্য আসবে। সম্ভবত হীরুর খোঁজে গিয়েছে।

 

তিথি সন্ধ্যার একটু পরই বাড়ি ফিরে দেখে হুঁলস্থূল কাণ্ড। দুলাভাই এবং মা দুজনেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। কি নিয়ে কথা হচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই। তিথি বলল, এসব কী হচ্ছে দুলাভাই?

মতিন চোখ লাল করে বলল, কী হচ্ছে তুমি জানো না?

জি না।

বাজে কথা বলবে না। কি হচ্ছে তোমরা সবাই জান। এখন ভাল মানুষ সেজেছ। ভাইকে পাঠিয়ে টাকা আনবার সময মনে ছিল না। এখন অস্বীকার যাচ্ছ।

কিছুই অস্বীকার যাচ্ছি না। আগে আপনি আমাকে ব্যাপারটা গুছিয়ে বলুন। এরকম রাগ করছেন কেন?

মতিন পুরোপুরি গুছিয়েও বলতে পারল না। কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। তবু মূল ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে। তিথি ক্লান্ত পলায় বলল, আপনার টাকা দিয়ে দেব। এক সঙ্গে সবটা না পারলেও ভাগে ভাগে দেব। প্লিজ চিৎকার করবেন না। আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে দুলাভাই?

মতিন কি-একটা বলতে সীল, বলতে পােবল না। রাগে তার মুখে কথা আটকে যাচ্ছে। সে হ্যান্ড ব্যাগ হাতে নিয়ে নিয়েছে। তিথি বলল, যাচ্ছেন কোথায় দুলাভাই?

মিনু বললেন, যেখানে ইচ্ছা যাক। তুই কথা বলিস না। ফজিলের ফাজিল।

মতিন বাড়ি থেকে বের হবার আগে তীব্র গলায় বলল এর ফল ভাল হবে না। এর ফল। কিন্তু ভাল হবে না। তখন কিন্তু আমাকে দূষবেন না।

তিথি বলল, কাজটা কী ভাল কবলে মা? দুলাভাই গিযে আপার ওপর শোধ তুলবে।

তুললে তুলুক। মুখে অ্যাসিড মারুক! গালামা দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিক যা ইচ্ছা করুক।

হয়েছে কী তোমার?

কিছু হয়নি।

বাবা কোথায় মা?

জানি না কোথায়। যাক যেখানে ইচ্ছা।

তিথি এক দৃষ্টিতে মাকে দেখছে। বোঝার চেষ্টা করছে। যতই দিন যাচ্ছে মা বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন অতি দ্রুত হচ্ছে বলে খুব চোখে লাগছে।

তিথি লক্ষ্য করল মা শান্ত ভঙ্গিতে নিজের জন্য চা বানিয়ে জলচৌকিতে বসে খাচ্ছে। তব চেহারায় কোনো রকম বিকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *