০৬. টুকটুক করে টোকা পড়ছে

টুকটুক করে টোকা পড়ছে দরজায়। তার মানে যে এসেছে সে পরিচিত কেউ নয়। পরিচিতরা ডোরবেল বাজায়। ডোরবেলটি এমন জায়গায় যে অচেনা কারোর চোখে পড়ে না।

আনিসের মনে হল যে এসেছে সে এক জন মহিলা। শুধুমাত্র মেয়েরাই দরজায় দু বার টোকা দিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তৃতীয় বার টোকা দেয়। ছেলেদের এত ধৈৰ্য নেই।

আনিস দরজা খুলে দিল। একটি মেয়েই দাঁড়িয়ে আছে, মালিশা। দিনের আলোয় তাকে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। তার উপর সে বেশ সাজগোজ করেছে। কাঁধে লাল টকটকে ভেলভেটের ব্যাগ। সোনালি চুলগুলিকে লম্বা বেণী করে কাঁধের দু পাশে ঝুলিয়ে দিয়েছে। রাতের আলোয় যতটা অল্পবয়েসী মনে হয়েছিল, এখন অবশ্যি সে-রকম লাগছে না।

তুমি কি আমাকে চিনতে পারছি?

তা পারছি। তুমি মালিশ। মালিশা গিলবার্ড।

আমি কি তেতিরে এসে বসতে পারি?

হ্যাঁ, পার!

মেয়েটি ঘরে ঢুকেই বলল, তুমি সন্ধ্যাবেলা ফ্ৰী আছ?

কেন বল তো?

আমি তোমাকে কোনো একটি ভালো রেস্টুরেন্ট নিয়ে যেতে চাই। আজ আমার জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন মালিশা।

ধন্যবাদ। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?

আনিস ইতস্তত করতে লাগল।

তোমার ইচ্ছা না হলে যেতে হবে না।

আনিস বলল, কোথায় যেতে চাও?

আমার পকেটে চল্লিশ ডলার আছে। এর মধ্যে হয়, এরকম কোনো রেস্টুরেন্ট। মেক্সিকান খাবার তোমার পছন্দ হয়? সেগুলি বেশ সস্তা।

মেক্সিকান খাবার আমার খুব পছন্দ।

তোমাকে খুব একটা ভালো রেস্টুরেন্টে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু কী করব বল? রোজগারপাতি নেই। হাইস্কুল পাস করি নি। কাজেই রেস্টুরেন্টের ওয়েটেস আর বেবিসিটিং-এর বেশি কিছু পাই না। চল্লিশ ডলার জমাতে হলে আমাকে দু মাস রোজ আট ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়।

আনিস বলল, তুমি যদি কিছু মনে না কর, তাহলে আমি বরং ডিনারটা কিনি।

মালিশা হেসে ফেলল।

এখন আমার অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু শিগগিরই আমি মাল্টিমিলিওনিয়ার হচ্ছি। কাজেই টাকা খরচ করতে মায়া লাগে না আমার।

আনিস বলল, মিলিওনিয়ার সত্যি সত্যি হচ্ছে তুমি?

ইউ বেট। আমার মা ডলারের বস্তার উপর শুয়ে আছে। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, যদি বিষটিষ খাইয়ে দিই। আমিও বুড়িকে ভজিয়ে রাখছি। প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিই–মা, তোমার শরীর কেমন আছে? ঠিকমতো ওষুধপত্র খাচ্ছ তো? গরমের সময় অবশ্যই হাওয়াই থেকে ঘুরে আসবে। হা হা হা।

আনিস হেসে ফেলল। মালিশ বলল, বুড়ো—বুড়ি হলেই মানুষ এরকম হয়ে যায়। ডলারই তখন প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। জীবন দিয়ে ডলার আগলে রাখে। আমার মতে পঞ্চাশের ওপর বয়স হলেই তাকে ঘাড় ধরে একটা নির্জন দ্বীপে ফেলে দিয়ে আসা উচিত। না-না, আমি খুব সিরিয়াস। জান তুমি, আমার মারা কত টাকা আছে? আন্দাজ করতে পারে?

না।

মা দু নম্বর বিয়ে করে এক জন পোল ব্যবসায়ীকে। তার হচ্ছে সী কার্গোর ব্যবসা। আমার স্টেপফাদার মারা যাবার পর সবকিছু আমার মা পেয়েছে। তার মধ্যে আছে রাজপ্রসাদের মতো দুটি বাড়ি। একটি ফ্লোরিডাতে, অন্যটি বোহেমিয়া আইল্যাণ্ডে। মা সবকিছু বিক্রি করে ডলার বানিয়ে ব্যাঙ্কে জমা করেছে। নিজে গিয়ে উঠেছে ওল্ড হোমে। সস্তায় থাকা-খাওয়া যায়। বিশ্বাস করতে পার?

বিশ্বাস করা কঠিন।

আমি তারই মেয়ে। আর দেখ, চল্লিশটি ডলার খরচ করতে আমার গায়ে লাগছে।

আনিস দেখল, মেয়েটির চোখ ছলছল করছে। আমেরিকান মেয়ে কাঁদবে না ঠিকই। এরা মাচকাতে জানে না।

আনিস বলল, ছটার আগে নিশ্চয়ই তুমি খেতে যাবে না? কফি খাও একটু!

কফিতে দুধ চিনি নাও তুমি?

দু চামচ চিনি। দুধ চাই না।

আনিস কফি বানাতে বানাতে বলল, মিলিওনিয়ার যখন হবে, তখন এত টাকা খরচ করবে কীভাবে?

প্রথমেই প্লাস্টিক সার্জারি করব। আমার বুক দুটি বড়োই ছোট। সিলিকোন রাগ দিয়ে বড়ো করব। আমাকে দেখে অবশ্যি বোঝা যায় না, আমার বুক এত ছোট। আমি অন্য ধরনের ব্রা ব্যবহার করি। ফোম ব্ৰা।

ও আচ্ছা।

এই ব্রাতে ছোট বুকও খুব এটাকটিভ মনে হয়। ব্রা খুললেই তুমি হতাশ হবে। দেখতে চাও?

না, না ঠিক আছে, বিশ্বাস হচ্ছে তোমার কথা।

তাছাড়া আমার নাকটাও বেশি ভালো না। মনে হয় অনেকখানি ঝুলো আছে। তাই না?

আমার তো মনে হয় না।

তোমার সৌন্দর্যবোধ নেই, তাই বুঝতে পারছি না।–নাকটা অল্প একটু তুলে দিলেই সব বদলে যাবে।

কেমন বদলাবে?

যেমন ধর, তখন যদি তোমাকে বলি–ব্রা খুললেই দেখবে আমার বুক দুটি টাইনি, তুমি দেখতে চাও? তুমি বলবে–তাই নাকি? কই দেখি তো?

আনিস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মালিশা, তুমি বেশ বুদ্ধিমতী!

আমার মায়েরও তাই ধারণা। মা বলেন–বুড়ো বয়সে কোনো ধনী মহিলার উচিত নয় তার মেয়েকে কাছে রাখা, বিশেষ করে সে মেয়ে যদি আমার মতো ইন্টেলিজেন্ট হয়।

কফি কেমন হয়েছে মালিশা?

ভালো।

আরেক কাপ নেবে?

দাও। তোমার নাম কিন্তু আমি জানি না।

আনিস।

তুমি কি ইণ্ডিয়ান?

না, বাংলাদেশ হচ্ছে আমার দেশ।

সেটা আবার কোথায়?

ইণ্ডিয়ার পাশে ছোট একটা দেশ।

সেখানেও কি ইণ্ডিয়ার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ থালা হাতে খাবারের জন্যে ঘুরে বেড়ায়?

কোথায় শুনেছ এসব?

আগে বল সত্যি কিনা। ডাস্টবিনের পাশে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা বসে। থাকে।–কখন কেউ এসে খাবার ফেলবে সেই আশায়। বল, সত্যি নয়? নাকি তোমার স্বীকার করতে লজ্জা লাগছে?

আনিস ইতস্তত করে বলল, সত্যি নয়। বড়ো বড়ো অভাব হয়েছে। সে তো পৃথিবীর সব দেশেই হয়েছে। ইউরোপে হয় নি? আমেরিকাতেও তো ডিপ্রেসন হয়েছে।

আনিস, তুমি রেগে যাও কেন? তোমাকে রাগাবার জন্যে আমি বলি নি।

তোমরা যা ভাব, দেশটি মোটেই সে-রকম নয়।

মালিশা ঠোঁট চেপে হাসল। পরমুহুর্তে ভালোমানুষের মতো বলল, ইলেকট্রিসিটি আছে?

এসব জিজ্ঞেস করছ কেন?

কারণ, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছা না হলে বলবে না।

আনিস গম্ভীর মুখে বলল, না মালিশা, ইলেকট্রিসিটি-ফিটি নেই। গাড়ি ফাড়িও নেই। শহরে বাস সার্ভিসের বদলে আছে এলিফ্যান্ট সার্ভিস। হাতির পিঠে চড়ে যাওয়া-আসা।

ঠাট্টা করছ?

তা করছি।

কেউ আমার সঙ্গে ঠাট্টা করলে আমার ভালো লাগে না। প্লীজ, আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবে না এবং আমি সরি।

সরি কী জন্যে?

তোমাদের দেশের কথা বলে হার্ট করেছি, সেই জন্যে। আমার যখন টাকা হবে, তখন আমি তোমার দেশ দেখতে যাব।

বেশ তো।

দেশে তোমার কি বউ আছে?

না।

কোনো সুইটহার্ট?

না, তাও নেই।

আমি মনে মনে আশা করছিলাম, তুমি বলবে না। বিবাহিত লোকদের আমার ভালো লাগে না।

টুনটুন করে ঘণ্টা বাজছে। যে এসেছে, সে যদিও ডোরবেল বাজাচ্ছে, তবু লোকটি অপরিচিত। এরকম করে ঘণ্টা কেউ বাজায় না। ছোট বাচ্চাদের মতো অনবরত টিপেই যাচ্ছে! আনিস দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। নিশানাথ বাবু।

নিশানাথ বাবু ঢুকেই মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, এই মেয়েটি বড়ো সুন্দর তো! দূৰ্গা প্রতিমার মতো চোখ।

মালিশা বলল, আপনি কি আমাকে নিয়ে কিছু বলছেন? আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, তাই জিজ্ঞেস করছি।

নিশানাথ বাবু হাসিমুখে বললেন, আমি বলছি এই মেয়েটি কে? আমাদের এক গডেস-এর চোখের মতো অপূর্ব চোখ!

মালিশা হাসিমুখে বলল, আমার নাম মালিশা। আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে আপনি কি আমার সঙ্গে দয়া করে ডিনার খাবেন?

খাব না কেন?

নিশানাথ বাবুর ভাব দেখে মনে হল, তিনি খুব অবাক হয়েছেন প্রশ্ন শুনে।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে কিন্তু মাত্র চল্লিশ ডলার আছে। মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে গেলে মনে হয়। এতেই তিন জনের হয়ে যাবে, কি বলেন?

টেকো খেতে আর কয় পয়সা লাগবে? হয়েও থাকবে, দেখবে।

নিশানাথ বাবু ঠিকানা যোগাড় করে কী জন্যে হঠাৎ এসেছেন, আনিস বুঝতে পারল না। নিশানাথ বাবু ফার্গোতে এসেছিলেন বাংলাদেশের স্টল দেখতে। সেখান থেকে আনিসের কাছে এসেছেন। কারণ রেহানা বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন আনিসের ঘর হয়ে আসতে। হঠাৎ করে আনিসের সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে কেন, নিশানাথ বাবু বুঝতে পারেন নি। অনেক কিছুই তিনি বুঝতে পারেন না। আসতে বলা হয়েছে, তিনি এসেছেন। ব্যস।

আনিস বলল, বাংলাদেশের স্টল কেমন দেখলেন?

চমৎকার। ঐ টম ছোকরা কী সব কায়দাকানুন করে দিয়েছে, আমি স্তম্ভিত। টেবিলটাতে হার্ডবোর্ড-ফোর্ড লাগিয়ে রং-টাং দিয়ে এমন করেছে, দেখে মনে হয় একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ছোকরার গুণ আছে।

মালিশা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, আপনার নামটা কি দয়া করে বলবেন?

আমার নাম নিশানাথ।

এই নামের মানে কি?

এর মানে হল গড অব দ্য ডার্কনেস।

বাহ্‌, মজার নাম তো!

নিশানাথ বাবু সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ঐ টম ছোকরার গুণ আছে। হুলস্থূল করছে, বুঝলেন নাকি আনিস সাহেব। পেছনে হার্ডবোর্ডের উপর বৃষ্টির ছবি এঁকেছে। ছবির দিকে তাকালেই বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যায়। মনে হয় ব্যাঙ ডাকছে চারদিকে।

মলিশা বলল, ব্যাঙ ডাকছে মানে?

আমাদের দেশে বৃষ্টি হলেই ব্যাঙ ডাকে। সেই শব্দ জগতের মধুরতম ধ্বনির একটি। তুমি না শুনলে বুঝতে পারবে না।

ব্যাঙের ডাক তো আমি শুনেছি। ওর মধ্যে মধুরতর কী আছে? এই সব আপনি কী বলছেন?

মালিশা, তোমাকে বোঝান যাবে না।

নিশানাথ বাবু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। মালিশা অবাক হয়ে বলল, আপনি অদ্ভুত লোক! সত্যি অদ্ভুত!

 

মালিশার বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল।

মেটোপলিটন বাসে উঠতে গিয়ে দেখে একটার উপর বাজে। ফাঁকা বাস। সে ছাড়া অন্য কেউ নেই। একটি নব্বুই বছরের বুড়ি ছিল, সে টুয়েলভ স্ট্রীটে নেমে গেল। নামবার সময় বুড়িটি বলল, আমাকে একটু হাত ধরে নামিয়ে দেবো?

মালিশা এমন ভাব করল, যেন সে শুনতে পায় নি! বুড়ি দ্বিতীয় বার কিছু না বলে নিজে নিজেই নামল। এই বয়সেও রাতদুপুরে একা-একা বাসে চড়া চাই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে পাসবই-ভর্তি ডলার। তবু পাঁচ ডলার খরচ করে ক্যাব ডাকবে না। দেশে একটা ফেডারেল আইন থাকা দরকার, যে-আইনে সত্তুরের উপর বয়স হলে সব টাকা-পয়সা সরকারের কাছে সারেণ্ডার করে নির্বাসনে যেতে হয়।

বাস ডাউনটাউনে আসতেই মালিশা নেমে গেল। এখানে বাস বদল করতে হবে। বাস থেকেই মালিশ লক্ষ করল তার হাত-পা শিরশির করছে। নিৰ্ঘাত আবার জ্বর আসছে। এ রকম হচ্ছে কেন? বারবার শরীর খারাপ হচ্ছে। মালিশ মাথা নিচু করে দ্রুত হাঁটতে লাগল। শরীর বেশি খারাপ হবার আগেই এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাওয়া দরকার।

বাস-স্ট্যাগুটি ফার্স্ট এ্যাভিন্যুতে। মালিশার ইচ্ছে হল, বাসের জন্যে না হেঁটে একটি ক্যাব ডাকে। সে খোলা একটি ট্যাভাৰ্ণে ঢুকে পড়ল। ক্যাব কোম্পানিকে টেলিফোন করতে হবে।

জন টিভিলটার রেকর্ড বাজছে উচ্চ স্বরে। কোমর জড়াজড়ি করে ডায়াসের কাছে দু-তিনটে ছেলেমেয়ে নাচছে। সেদিকে তাকিয়ে মালিশার কেমন যেন মাথা ঘুরতে লাগল।

হ্যালো মালিশা, গা গরম করবে নাকি? নাচবে এক পাক?

মালিশ তাকাল, কিন্তু ছেলেটিকে চিনতে পারল না।

মালিশা, এস।

নাহ।

না কেন?

আমার শরীর ভালো লাগছে না।

মলিশ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল। চিনতে পারছে না কেন? ছেলেটি এসে পরিচিত ভঙ্গিতে হাত ধরল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, যাবে না কি আমার সঙ্গে?

কোথায়?

আমার এ্যাপার্টমেন্ট। দু জনের ছোটখাটো একটা পার্টি হয়ে যাবে, কী বল?

না।

না কেন? আসি। আমি তো অপরিচিত কেউ নই। আগেও তো আমাক সঙ্গে ডেটে গিয়েছ। এস এস, খুব ফান হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *