০৬. ঝুনুর ছেলে হবে

ঝুনুর ছেলে হবে। যাতে কেউ গিয়ে তাকে নিয়ে আসে, সে-জন্যে সে সবার কাছে চিঠি লিখেছে। তারা আসতে দেবে কিনা কে জানে! মোটেই ভালো ব্যবহার করছে না তারা। রুনু মারা যাবার পরও আসতে দেয় নি। তবু বাবা যাচ্ছেন আনতে। সঙ্গে রাবেয়াও যাবে। যদি ঝুনু আসে, তবে বেশ হয়। অনেক দিন দেখি না। ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।

রাবেয়া কলেজে ভর্তি হয়েছে। উৎসাহ নিয়ে রাত জেগে পড়ে। ছুটির দিনগুলি ছাড়া তাকে পাওয়াই যায় না। রোববারে ফুর্তি হয় এই কারণেই। সবাই রোববারের জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করি।

 

মন্টু এক দৈনিক পত্রিকা-অফিসের সহ-সম্পাদক হয়েছে। বেশ ভালো বেতন। বি. এ. টাও পাশ করে নি, কিন্তু বেশ গুছিয়ে ফেলেছে। অবাক হওয়ারই কথা। তার দ্বিতীয় বই শুধু ভালোবাসা সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছে। মন্টু এখন নামী ব্যক্তি। অনেকেই তার কাছে আসে। মন্টু তো বাসাতে থাকে কমই, বাবা গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করেন। এ ব্যাপারে বাবার উৎসাহ প্ৰায় সীমাহীন। কোন পত্রিকায় কী লিখল, তা তিনি অসীম ধৈর্য নিয়ে খোঁজ রাখেন। সযত্নে পেপার-কাটিং জমিয়ে রাখেন। মন্টুর কাছেই শুনেছি, এক দিন বাবা নাকি কোন বই-এর দোকানে ঢুকে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনার এখানে কিছু কিংশুক কবিতার বইটি আছে?

দোকানী জবাব দিয়েছে, না নেই।

তাহলে শুধু ভালোবাসা বইটি আছে?

না, সেটাও নেই।

বাবা রেগে গিয়ে বলেছেন, ভালো ভালো বই-ই নেই, আপনারা কেমন দোকানদার?

মন্টুর সঙ্গে কবিতা নিয়ে আলাপ করতেও তাঁর খুব উৎসাহ। মন্টু এ ব্যাপারে অত্যন্ত লাজুক বলেই তিনি সুযোগ পান না।

সত্য-মিথ্যা জানি না, শুনেছি বাবা ওভারশীয়ার কাকুর বড়ো ছেলের বউকে প্রায়ই মন্টুর কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। এই মেয়েটিকে বাবা খুব পছন্দ করেন। মেয়েটির চেহারা অনেকটা রুনুর মতো। পেছন থেকে দেখলে রুনু বলে ভ্রম হয়।

 

নিনুও অনেক বড়ো হয়েছে। সেদিন তাকে নিয়ে রাস্তায় বেরোতেই দুটি ছেলে শিস দিল। নিনুকে বললাম, নিনু কোনো বদ ছেলে তোমাকে চিঠি—ফিঠি লিখলে না পড়ে আমাকে দিয়ে দেবে, আচ্ছা? নিনু লজ্জায় লাল হয়ে ঘাড় নেড়েছে।

সেদিন রবিবার। সবার বাসায় থাকার কথা, কিন্তু বাসায় নেই। কেউ। বাবা। আর রাবেয়া গেছে ঝুনুকে আনতে, মন্টু তার পত্রিকা-অফিসে। পত্রিকা-অফিসের কাজ নাকি পুলিশের কাজের মতো। ছুটির কোনো হাঙ্গামাই নেই। বাসায় আমি আর নিনু। আমি ভেতরে বসে কাগজ পড়ছি, নিনু বলল, দাদা, এক জন ভদ্রলোক এসেছেন।

কী রকম ভদ্রলোক?

বুড়ো। চোখে চশমা।

বেরিয়ে এসে দেখি বড়মামা। অনেক দিন পর দেখা, কিন্তু চিনতে অসুবিধা হল না। বড়মামা বললেন, আমাকে চিনতে পারছি?

জ্বি, আপনি তো বড়মামা।

অনেক দিন পর দেখা, চেনার কথা নয়। তুমিও বড়ো হয়েছ, আমিও বুড়ো। কী কর এখন?

এখানকার এক কলেজে প্রফেসরি করি।

বেশ, বেশ। বাসায় আর কেউ নেই? খালি খালি লাগছে।

জ্বি না। বাবা এবং রাবেয়া গেছেন চিটাগাং আমার এক বোনের সেখানে বিয়ে হয়েছে।

মামা চুপ করে শুনলেন। তাঁকে দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছি। হঠাৎ করে কেনই-বা এলেন। মা বেঁচে নেই যে আসবার একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। তা ছাড়া মামাকে কেমন যেন লজ্জিত এবং অপ্রস্তুত মনে হচ্ছিল। মামা বললেন, আমার আব্বা–মানে তোমাদের নানা মারা গিয়েছেন দিন সাতেক হল।

কী হয়েছিল? তেমন কিছু নয়! বয়স তো কম হয় নি তাঁর, নব্বুইয়ের কাছাকাছি। আজকালকার দিনে এত বাঁচে না কেউ।

মামা বলতে বলতে অল্প হাসলেন কি ভেবে। বললেন, আমাকে আসতে দেখে অবাক হয়েছ, না?

না-না, অবাক হব কেন? আপনি চা খাবেন?

চা ছেড়ে দিযেছি, ডায়াবেটিসে ভুগছি। আচ্ছা, দাও এক কাপ চিনি ছাড়া।

নিনুকে চায়ের কথা বলে এসে বসতেই মামা বললেন, বাবা শেষের দিকে তোমাদের কথা কেন জানি খুব বলতেন। তিনি সিলেটে আমার ছোটভাইয়ের কাছে ছিলেন। অসুখের খবর শুনে আমি গিয়েছিলাম। বাবা প্রায়ই বলতেন, ঢাকা গিয়েই তোমাদের এখানে আসতে পান। আগে কখনো এমন বলেন নি।

মামা চশমার কাঁচ ঘষতে ঘষতে বললেন, বয়স হলে অনেক values বদলে যায়, তাই না?

 

জ্বি।

শিরিন খুব আদরের ছিল সবার। তবে বড়ো গোঁয়ার ছিল। জান তো মেয়েদের দুটি জিনিস খুব খারাপ, একটি হচ্ছে সাহস, অন্যটি গোয়ার্তুমি।

আমি কোনো কথা বললাম না। মামা বললেন, শিরিনের অনেক গুণ ছিল। সাধারণত মেয়েদের থাকে না। যখন সে এখানে চলে আসল, তখন সবাই দুঃখিত হয়েছিলাম। গুণ বিকাশে পরিবেশের প্রয়োজন হয় তো।

নিনু চা নিয়ে ঢুকল। মামা চায়ে চুমুক দিয়ে চমকালেন, একি খুকি, চিনি দিয়ে এনেছ যে!

নিনু আধহাত জিভ বের করে ফেলল। মামা বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এক দিন একটু অনিযম হোক না হয়। তোমার এক ভাই শুনেছি খুব নাম করেছে। আমি ঠিক চিনতাম না। কিটকি আমাকে বলল। কিটকি আমার ভাগ্নী, চিনেছ?

জ্বি।

তোমার বাবা আসলে সবাইকে নিয়ে যাবে আমাদের বাসায়। আমিই নিয়ে যাব। তোমার মার অনেক গয়না ছিল। সব ফেলে এসেছিল, সেগুলিও নিয়ে আসবে।

মামা নিনুকে কাছে ডেকে আদর করতে লাগলেন, ফুলের মতো মেয়ে। তুমি যাবে আমার বাসায়? তোমাকে একটা জিনিস দেব।

কী জিনিস? একটা ময়ূর। হিলট্রাক্টে থাকে–এক বন্ধু—আমাকে দিয়েছিল।

পেখম হয়?

হয় বোধকরি। আমি অবশ্যি পেখম হতে দেখি নি।

আমি বললাম, মামা, মার একটা পুরনো রেকর্ড ছিল নাকি?

হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে এখনো। তুমি চাও সেটি?

শুনতে ইচ্ছে হয় খুব।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। মারা গান শুনতে ইচ্ছে তো হবেই। পাঠিয়ে দেব আমি, আমার মনে থাকবে।

 

ঝুনুকে শেষ পর্যন্ত আসতে দিল তারা।

তিন বৎসর পর দেখছি। মা হতে যাবার আগের শারীরিক অস্বাভাবিকতায় একটু যেন লজ্জিত। ছেলেবেলার উচ্ছ্বলতা ঢাকা পড়েছে অপরূপ কমনীয়তায়। মোটা হওয়াতে একটু যেন ফর্সা দেখাচ্ছে।

দুপুরবেলা সে যখন এসেছে, তখন আমি কলেজে। মন্টু পাশের বাড়ি থেকে ফোন করল আসতে। পরীক্ষণ-সংক্রান্ত জরুরী মীটিং ছিল, আসতে পারলাম না। সারাক্ষণই ভাবছিলাম, কেমন না জানি হয়েছে বুঝুনুটা। সেদিনও একটা চিঠি পেয়েছি, তুমি তো মনে কর বিয়ে করে ঝুনু বদলে গেছে। বাসার কারো সঙ্গে কোনো যোগ নেই। তাই বাসার কোনো খবরই আমাকে দাও না। রাবেযা আপার যে জ্বর হয়েছিল, সে তো তুমি কিছু লেখি নি। বাবার চিঠিতে জানলাম। আর আমি এত কেঁদেছি, তোমরা সবাই আমাকে পায় মনে করছ, এই জন্যে। মন্টুর কবিতার বই বেরিয়েছে, মন্টু আমায় পাঠায় নি। আমি নিজে যখন একটা কিনেছি, তার দশ দিন পর সে বই পাঠিয়েছে। কেন, আগে পাঠালে কী এমন ক্ষতি হত? মন্টু তার বইয়ে পেন্সিল দিয়ে লিখেছে, সুক্রন্দসী বন্ধু ঝুনুকে। আমি বুঝি সুক্রন্দসী? মন্টুকে হাতের কাছে পেলে কাঁদিয়ে ছাড়ব… ।

 

সন্ধ্যাবেলা বাসায় এসে শুনি ঋনুপাশের বাড়ি বেড়াতে গেছে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় একা একা বসে পেপার দেখছি, এমন সময় সে এল। কি একটা ব্যাপারে ভীষণ খুশি হয়ে হাসতে হাসতে আসছে। আমায় লক্ষ করে নি দেখে নিজেই ডাকলাম, ঝনু, আয় এদিকে।

ঝনু প্রথমে থতমত খেল। তারপর কিছু বোঝবার আগেই তার হাতের ধাক্কায় আমার হাত থেকে চায়ের পেয়ালা ছিটকে পড়ল। এবং প্রথমেই যা বুঝতে পারলাম, তা হচ্ছে ঝুনুটা আমায় জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। প্রথম উচ্ছ্বাসটা কাটল অল্পক্ষণেই, কান্না থামল না। অনেক দিন পর প্রিয় জায়গায় ফিরে আসা, রুনুর মৃত্যু, নিজের জীবনের অশান্তি–সব মিলিয়ে যে কান্না, তা একটু দীর্ঘস্থায়ী তো হবেই। আমি বললাম, ঝুনু, চা খা, তারপর আবার কান্না শুরু কর। মন্টু তোকে সুক্রন্দসী কি আর শুধু শুধু লিখেছে?

কাঁদুক, ঝুনু কাঁদুক। অনেক দিন এ বাড়িতে কেউ কাঁদে না। সেই কবে রুনু মারা গেল। খুব কাঁদল সবাই। বাবা গলা ছেড়ে কাঁদলেন, মন্টু আর রাবেয়া ছেলেমানুষের মতো কাঁদল। নিনু চুপি চুপি আমার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর আর এ বাড়িতে কান্না কই? নিনু পর্যন্ত ভুলেও কাঁদে না! রাবেয়া হয়তো কাঁদে, আমার তো কখনো চোখে পড়ে না : কাঁদুক ঝুনু। আমি দেখি তাকিয়ে তাকিয়ে সুক্রন্দসী ঝুনুকে।

ঝনুর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল পুরনো দিনগুলি যেন ফিরে এসেছে। আগের মতো হৈ-হল্লা হতে লাগল। নিনুর চুল ঘন হয়ে উঠবে বলে এক দিন ঝুনু মহা-উৎসাহে নিনুর মাথা মুড়িয়ে দিল। নিনু তার কাটা চুল লুকিয়ে রাখল তার পুতুলের বাক্সে। এই নিয়ে ফুর্তি হল খুব। মন্টু ছড়া লিখল একটা–নিনুর চুল। নিজের পত্রিকায় ছবি দিয়ে ছাপিয়ে ফেলল। সেটি। নিনুও মন্টুর খাতায় গোপনে লিখে রাখল মন্টু ভাই একটা বোকা রোজ খায় তেলাপোকা। ঝুনু সবাইকে এক দিন সিনেমা দেখাল। রোববারে পিকনিক হল আমগাছের তলায়। সময় কাটতে লাগল বড় সুখে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা মাথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে শুয়ে আছি। ঝুনু এসে বলল, মাখায় হাত বুলিয়ে দেব দাদা?

না, এমনি সারবে।

আহা, দিই না একটু।

ঝুনু বসল। মাথার কাছে। মনে হল কিছু বলবে। চুপ করে অপেক্ষা করছি। ঝুনু ইতস্তত করে বলল, আচ্ছা দাদা, হাসপাতালে নাকি ছেলে বদল হয়ে যায়?

ছেলে বদল! কী রকম?

অবাক হয়ে তাকাই আমি।

ওভারশীয়ার চাচার ছেলের বউ বলছিল, হাসপাতালে নাকি ছেলেমেয়েদের নম্বর দিয়ে সব এক জায়গায় রাখে। নম্বরের গণ্ডগোল হলেই এক জনের ছেলে আরেক জনের কাছে যায়।

হেসে ফেললাম। আমি। বললাম, এই দুশ্চিন্তাতেই মরছিস? পাগল আর কি!

না দাদা, সত্যি। ওর এক বন্ধুর নাকি টুকটুকে ফর্সা এক ছেলে হয়েছিল।

রিলিজের সময় যে-ছেলে এনে দিল, সেটি নিগ্রোর চেয়েও কালো।

হাসপাতালে যেতে না চাস, বাসায় ব্যবস্থা করা যাবে। তবে এগুলো খুব বাজে কথা ঝনু।

দুজনেই চুপচাপ থাকি। বুঝতে পারছি, ঝুনুর ছেলের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজেই জিজ্ঞেস করি, ছেলে হলে কী নাম রাখবি, ঝুনু?

যাও।

বল শুনি, একটা তো ভেবেছিস মনে মনে।

আমি যেটা ভেবেছি, সেটা খুব বাজে–পুরনো।

কী সেটি?

উঁহু।

বল না, শুনি কেমন নাম।

কিংশুক।

এই বুঝি তোর পুরনো নাম?

যাও দাদা, শুধু ঠাট্টা।

মেয়ে হলে কী রাখবি?

মেয়ে হলে রাখব রাখী।

চমৎকার!

রাখী নামে আমার এক বন্ধু ছিল। এত ভালো মেয়ে! এখন ডাক্তার। আমিও আমার মেয়েকে ডাক্তগরি পড়াব দাদা।

আমার অসুখবিসুখ হলে আর চিন্তাই নেই। ভাগ্নীকে খবর দিলেই হল।

আচ্ছা দাদা, ইরিত্রা নামটা তোমার কেমন লাগে?

নতুন ধরনের নাম। আধুনিক।

মন্টু বলছে ইরিত্রা রাখতে, দুটি নামই আমার ভালো লাগে। কী করব বল তো দাদা।

দু নম্বর মেয়ের নাম ইরিত্রা রাখ।

না, দু নম্বর মেয়ের নাম রাখব রুনু।

রুনু?

হ্যাঁ। তাহলে রুনুর মতো লক্ষ্মী মেয়ে হবে। একটুক্ষণ থেমে ঝুনু কাতর গলায় বলল, রুনুর কথা বড়ো মনে হয় দাদা। ওকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে।

রুনুকে আমারো বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে রুনুর ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকি। পাতলা ঠোঁট চেপে হাসির ভঙ্গিমায় তোলা ছবি। বড়ো বড়ো চোখ। বাচ্চা ছেলেদের চোখের মতো দৃষ্টি। সব মিলিয়ে কেন যেন ভারি করুণ মনে হয়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুকের ভিতর ব্যথা বোধ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *