০৬. জোয়ার গেল

জোয়ার গেল। সমুদ্রের জল নিয়ে এসেছিল, আবার গেল। ঘোলা জলকে ডাক দিয়ে, আবার নেমে গেল ভাটায়। বিলাস বলল, সাংলো ফেলবে নাকি? জলেঙ্গা জলের ভাটা ছাড়বার উপায় নেই।

পাঁচু বলল, এখন না। যা করে, টানাছাঁদি। সাংলোর দিন এখনও অনেক পড়ে আছে।

নৌকা পাড়ি দিল পুবে উত্তরে। জাল ফেলা হবে পুব ঘেসে। উত্তর কোণে পাড়ি না দিলে নৌকা টেনে নিয়ে যাবে দক্ষিণে। বাতাসের তেমন জোর নেই। আকাশ থমকে আছে। চলা-ফেরা নেই মেঘের। বিলাস দাঁড়ে টান দিল। নৌকায় বসে থাকলে বোঝা যায়, টানের জোর কত।

পুব ঘেঁসে নৌকা আড়-পাথালি করল পাঁচু। কিন্তু তরতর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। বিলাস টানাছাঁদি ফেলল ছড়িয়ে। ফেলে গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছে, কলকে সাজাতে বসল। জলেঙ্গা জলের নিশানা ভাল। আবার মাছ পড়ল। টানাছাঁদির দুই গড়ানে, তিনটি মাঝারি। আর একটি বড় ইলিশ। বাকি কিছু খয়রা আর ভোলা। তাও কুল্যে সের দেড়েক।

দুই গড়ান দিতে দিতেই ঘনিয়ে এল অন্ধকার। তা এই শহর বাজারে সন্ধ্যারাত্রে মাছ পড়ে থাকে না। দামিনী পাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল হ্যারিকেন নিয়ে। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই নেমে এল। একলা এসেছে। নাতনি আসেনি। মাছ দেখে দামিনীর মুখে আর হাসি ধরে না। বলল, আহা, বেশ দিয়েছে এই জল। এ জলের পেরমায়ু হোক গো।

পাঁচু মাছ মাপতে মাপতে বলল, সেটি যে হবার জো নেই। এনার পেরমায়ুর বাড়া-কমা নেই। ছকে বাঁধা আছে। তা মাছ কি আজ রাতেই বাজারে নে যাবে?

দামিনী বলল, পাঠিয়ে দিতে হবে বাজারেই। তবে রাতে আর বেচব না। বরফ দিয়ে রাখতে বলব। কাল সকালে, দামটাও ভাল পাব। রাত করে বসলে বেচুনির গরজ ঠাওর হবে, বুইলে না?

পাঁচু মাছ নিয়ে, একটু এগিয়ে এসে বলল, এট্টা কথা বলি। লাতিনের বে দেওনি দামিনীদিদি?

দামিনী বলল, না, বে। সে করেনি। কত গণ্ডা হাত বাড়িয়ে আছে। বলে, রাঁড়ের মেয়ের আবার বে। বেশ আছি, খাচ্ছি। দাচ্ছি, কোনও ঝক্কি-ঝামেলা নেই। এখন দশজনের সামনে বাজারে গিয়ে মাছ নিয়ে বসতে একটু নজা-নজা করে। বছর দু-চার আরও যাক, তা পরে বসব। একটা জীবন, কেটে যাবে।

তা যাবে, তবু, মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ বলে নয়, তুমি মানুষ। জীবনের ধর্ম মানতে হবে তোমাকে। না মানলে তোমাকে অধর্মের পথে যেতে হয়। মনুষ্যজীবন যখন কাটোচ্ছ, তখন তোমার বিপরীত রীতি উচিত নয়। রীতির পথে কাঁটা থাকলে, তাকে নিয়ে চলতে হবে তোমাকে। তবু, তোমাকে মানুষের রীতিতে মতি দিতে হবে।

দামিনী আবার বলল ফিসফিস করে, গত এক বছর তো কাটিয়ে এল চুচড়োয়। কোথায় তা জানি নে বাপু। ভেবেছিলুম, যেখোনে থেকে সুখ পাস, সেখেনেই থাক। আমি মলে দাঁড়িয়ে শুধু কাঠের বন্দোবস্ত করে দিয়ে যাস। তা হলেই হল। সে মিনসেকে কয়েকবার দেখিচি। বয়স বেশি নয়। শুনিচি মিনসের বাড়িঘরও আছে। নাতনির নাকি সে মনের মানুষ। একে মা-মরা মেয়ে, তায় মনের মানুষের টান। আমি কিছু বলতে পারিনি। তোর সুখ, তোর কাছে। কিন্তু কই, থাকতে পারল না, চলে এল। অমন দলমলে শরীরখানি শুকিয়ে নিয়ে ফিরল। কাউকে কিছুটি বললে না। মুখ ফুটে। দেখলুম নাতনির বুক ফাটছে, মুখ ফোটে না। ওই বয়সটা কাটিয়ে এসেছি তো, জানি, কী জ্বালা মেয়েটার। কিন্তু আমার বেঁচে থাকা এখন শুধু ওইসব দেখবার জন্যে।

রাতের অন্ধকারে নেমেছে। দামিনীর এক হাতে হ্যারিকেন, অন্য হাতে মাছের চুপড়ি। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পাঁচুদাদা, সোমসারে মনের মানুষ সবাই খুঁজে মরে। তাকে কি পাওয়া যায়? যায় না। কখন বয়স ঘুচে যায়, মরণ আসে, তাঁর কোলে গিয়ে জুড়োতে হয়। তা বলে সোমসারের পরে রাগ করে তো লাভ নেই। নাতিনের আমার এই সোমসারের পরে বড় বিরাগ।

অর্ধেক কথা আপন মনে বলতে বলতে বুড়ি চলে গেল। খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে এল। পাঁচু যেন কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। মুখখানি নামিয়ে নিয়ে এসে দামিনী বলল ফিসফিস করে, পাঁচুদাদা, মনে বড় সাধ ছিল আমি সাগরের ফড়েনি হব। এখানে আর আমার মন মানে না। কিন্তু কই, যাওয়া হল না তো, মনের সাধ কি কোনওদিন মেটে? মেটে না।

পাঁচুর বুকের মধ্যে চমকে চমকে উঠল। মুখে তার কথা সরল না একটা। কেবল চোখের সামনে সাইদারের মূর্তিখানি ভেসে উঠল।

দামিনী চলে গেল হ্যারিকেন বুলিয়ে। উঁচু পাড় বেয়ে বেয়ে। একটি অদ্ভুত ছায়া যেন বুকে হেঁটে হেঁটে উঠে গেল উপরে। পাঁচু দেখল, বিলাস চেয়ে রয়েছে সেই উঁচু পাড়ের দিকে। চোখের পলক পড়ে না। জাল তুলে, উজান ঠেলে এসে গরম লেগেছে। খালি গায়ে বসে, হাবা ছেলের মতো উপরের দিকে চেয়ে রয়েছে।

পাঁচু মুখ ফেরাল জলের দিকে। নৌকা দুলছে। ভাটা নামছে এখনও তরতর করে। শব্দ করে নামছে। আকাশে মেঘা জমছে, উড়ে উড়ে যাচ্ছে সারাদিন ধরে। এখন এমনি করেই যাবে। তারপর ঘোর ঘনঘটায় নামবে। আজ সপ্তমী। চাঁদ উঠতে দেরি আছে কৃষ্ণপক্ষের, থেকে থেকে তারার মিটমিটে হাসি দেখা যাচ্ছে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু জলের বুকে অষ্টপ্রহর কী যেন চকচক করে। তরঙ্গে তরঙ্গে, স্রোতের টানে। ওই দেখা যায়, সাপের মতো একে-বেঁকে উঁচু-নিচু স্রোতে নেমে চলেছে কলকল করে। একে-বেঁকে পাক দিয়ে ফিরে আসবে সে সুদূর দক্ষিণকে।

উত্তরে আর-একটি কারখানার আলো। এই অসীম অনন্ত অন্ধকারের মাঝে জ্বলছে বিন্দু বিন্দু হয়ে।

বাতাস আসছে দক্ষিণের। পাঁচু ভাবছে, দামিনীর কথাগুলি। ভাবে, মানুষের মনকে এমন বিচিত্ৰ। করেছে কে, সে বিস্ময়ের থই পাওয়া যায় না। নইলে দামিনী কেন সমুদ্রে যেতে চেয়েছিল। মনের মানুষ কাকে বলে, সে খোঁজের কথা কখনও স্মরণ হয়নি বোধ হয় এ জীবনে। মাছমারার জীবনে মনের মতো কোনও দিন কিছু পাওয়া যায়নি। মানুষ হয়ে কে বলতে পারে, মনের মতনটি সব পেয়েছে সে।

উজানে নৌকা ঠেলতে গিয়ে, রক্তের আসল তেজ ঠাহর হয়। দক্ষিণের ডাক পড়েছে। সেখানে। মন অনেক কিছু চেয়েছিল এ জীবনে। তার কিছুই পাওয়া যায়নি। এখন বিলাসের আইবুড়োত্ব ঘুচিয়ে, চারদিক একটু বেঁধেছেদে দিয়ে, চোখ বুজতে পারলে হয়।

জলেঙ্গা জলে যেটুকু উদয় হয়েছে, ঘোলা জলের উজান ঠেলে তার সবটুকু যদি দেখাও, তবে বুঝি অনেক পেলুম এ জীবনে।

পাঁচু ডাকল, বিলেস।

জবাব এল যেন ওপার থেকে, কী বলছ?

—দুটো ফুটোতে হয় এবারে।

ফোটাবার উদযোগ-আয়োজন করল বিলাস। কিন্তু মনটা যেন এখানে নেই। কেমন যেন হতভম্ব ভাব। জাল ফেলেছে, তুলেছে, পুরো উজানটি এসেছে ঠেলে। কথা বলেনি একটিও। বলেও না। অবশ্য। কিন্তু, কথা না বলা আর আনমনা তো এক কথা নয়।

বুকের মধ্যে বড় ধুকধুক করে পাঁচুর। বিলাসের মন বোঝে না সে। ওর জীবনের ডাক বড় দূর দূরান্তে, সমুদ্র থেকে শহরে। বিলাসের মনের অন্ধিসন্ধি খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে পরিষ্কার মন। যা করবে, তা তোমার সামনেই করবে।

 

রাত পোহাবার আগেই ভাটা পড়ল আবার। আজ আর একটু আগে। পুব পারে এসে টের পেল, অনেক নৌকা এসে পড়েছে রাত্রের জোয়ারে। চেনা মানুষের মধ্যে পাওয়া গেল সয়ারাম আর তার দাদা ঠাণ্ডারামকে। চেনা অবশ্য সবাই। তবে গাঁয়ের লোক আরও আপন।

কথাবাতা হল কিছু সকলের সঙ্গেই। তবে, কাজ করতে করতে। দু-দণ্ড হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করতে আসেনি কেউ এখানে।

আজ অষ্টমী। কিন্তু আষাঢ়ের পূর্ণিমা-কোটালের কাল কেটে গেছে আগেই। এখন মরাকোটাল যাচ্ছে বলা যায়। অমাবস্যাঁতে আবার ভারী কোটাল আসছে। তবে সে পূর্ণিমার কোটালের মতো তেজি নয়। অমাবস্যা তার তেজ দেখাবে টানের দিনে। এখন চাঁদের কাল। দিনে দিনে সে বাড়বে, উচাটন হবে। ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে, চাঁদ হেসে হেসে সারা সংসারের চোখে নেশা ধরাবে। রসাবতী গঙ্গা হারাবে কুল। মানুষ তার নিজের দিকে চেয়ে দেখুক, পূর্ণিমার কোটালে তার প্রাণও অকুল। তবে যে কোটালেই আসুক, এখনও আসল জল বাকি।

পাঁচু জিজ্ঞেস করল। সয়ারামকে, কতকগুলান লৌকা এল তোমাদের সঙ্গে।

সয়ারাম বললে, তা পেরায় খানদশেক হবে। আজ রাতের দিকে আরও অনেক আসবে।

আসবে। এই সারা তল্লাটের গঙ্গার বুক ভরে উঠবে মাছমারাদের নৌকায়। সয়ারামের দাদা ঠাণ্ডারামের মুখখানি ভার। পাঁচু শুনে এসেছিল, পাল মশাই এবার নৌকা ছাড়তে চায়নি ঠাণ্ডারামের। দেনা নাকি বড় বেশি করে ফেলেছে।

না জিজ্ঞেস করে পারল না পাঁচু, মহাজনে কী বললে গো ঠাণ্ডারাম।

ঠাণ্ডারাম বলল, লৌকো ভাড়া নে এলুম পাঁচুদা।

–নিজের লৌকো?

—হ্যাঁ। ওদিকে বন্দকি সুদ বাড়াবে, এদিকে ভাড়া।

হুঁ! তবু আসতে হবে। না এসে উপায় নেই। পাঁচু আর কিছু বলল না। বললে শুধু ছাইচাপা। দুঃখকে উসকে দেওয়া হয়।

সয়ারাম নৌক ঘুরিয়ে নিয়ে এল বিলাসের কাছে। বলল, এয়েছিস তো মাত্র আমার এটা রাত আগে। সয়ারামকে যে চিনতেই পারছিস না বিলাস।

বিলাস বলল জালের দিকে নজর রেখে, চিনতে পারব না কেন?

সয়ারাম বলল, তাককে তো দেখছিস নে একবার। খুড়োর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে নাকি।

–না।

হুঁ, সয়ারামের মনটা খারাপ গেয়ে উঠল। সেই হাওয়া নিয়েই এসেছে। দূরে এলে মন যে বড় আকুপাকু করে কিনা। বলে। ঘরের বউয়ের জন্যেই, সয়ারামের এক রাতের মধ্যে মনটা ফসফস করেছে। আর এ তো পরের বউয়ের টান। ওই টান আসলের চেয়ে একটু বেশি হয়। বিলাসের যেন একটু বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে। বলল, তবে? মুখখানা অমন ব্যাজার করে রয়েছিস যে? কিছু হয়েছে নাকি?

বিলাস এতক্ষণে চোখ তুলে একবার যেন ক্যাঁচার ঘা মোরল সয়ারামের মুখের উপর। মুখ ফিরিয়ে বলল, হতে পারে।

সয়ারাম গলুই থেকে একবার দেখল তার দাদা ঠাণ্ডারামের দিকে। ঠাণ্ডারামের নজর এদিকে নেই, জালের দিকে। এসেই জাল ফেলেছে। মনটাও ভাল নেই।

সয়ারাম বলল, কী হয়েছে, বল তো।

বিলাস বলল, জানলে তো বলব।

—সেই কাজটার কথা মনে পড়ছে বুঝিন?

—কোন কাজটা?

ওই দেখো, আবার জিজ্ঞেস করে বিপদে ফেলা কেন? ঢোঁক গিলে বলল, অমর্তের বউয়ের কথা বলছি।

বিলাস তাকাল একবার কাঁটমট করে। বলল, না।

–তবে।

বিলাস ভ্রূ কুঁচকে, খেঁকিয়ে উঠল, তবে? তবে আমার ইয়ে। কাটারি থাকলে আমার বুকের মধ্যে কুপিয়ে দ্যাখ, তবে কী হয়েছে।

না, কথা বলা যাবে না। সয়ারাম তাড়াতাড়ি আশেপাশে দেখল। শত হলেও আশেপাশে এখন দু-এক গণ্ডা নৌকা রয়েছে। শুনলে ভাববে কী না জানি ঘটেছে এদের মধ্যে।

সয়ারামের চোখাচোখি হল পাঁচুর সঙ্গে। ওর মধ্যেই একটু ভাব বিনিময় হল দুজনের। কী জানি, কী হয়েছে বিলাসটার।

গড়কে চলে আড় নৌকা। অথাৎ টানে চলে, চলে ওই আওড়ের মুখে। খেয়াল আছে তো বিলাসের। আর কত দূর যাবে? জালে টান দিল বিলাস। মাছ পড়েছে।

সয়ারাম দেখল, বিলাস হাসছে। ও! ওই জন্য মন খারাপ হয়েছে বন্ধুর। সয়ারামও জালে টান দিল। রাশি রাশি মেকো। দেখতে দেখতে জাল, নৌকা, সবঙ্গি ছেয়ে ফেলেছে। আবার কামড়ায় কুটকুট করে। কাঁকড়ার বাচ্চা তো, স্বভাব যাবে কোথায়। দাড়া না গজাতেই দাড়া ফোটায়।

বিলাস দুটি ইলিশ পেয়েছে। জালের কোলে মাছের ছাপ পড়েছে। সেই আনন্দে গায়ে মেকো পড়ার কথাও মনে নেই।

সয়ারাম বলল, এ তো অস্থির করে খেল। জাল তুলতে দেবে না। জাল ঝেড়ে ঝেড়ে তুলে, একটি মাঝারি শিলং, আর একটি ইলিশ মাছ পেল। এখন শিলং মাছ দেখে পেয়েও মন ভরে না।

সুদিনের গঙ্গা, সে দেবে আসল জিনিস। অথাৎ ইলিশ। বিলাস গুনগুন করে গান ধরে দিয়েছে।

আমার ভরা জোয়ার গেল,
ভাটার বেলা এল হে
আর আমি রইতে নারি বসে।

ততক্ষণে পাঁচু নৌকার মুখ উত্তরে ঘুরিয়ে দিয়েছে। সরে গেছে পাড়ের দিকে। বিলাস লগি ঠেলছে গলুই থেকে।

সয়ারাম চেঁচিয়ে উঠল, এটুস আস্তে রে বিলেস, তোর কাছে যাব।

দেখতে দেখতে, উজান ঠেলে কাছে এল সয়ারামের নৌকা।

পাঁচুর নজর জেটির দিকে। নৌকা বড় টালমাটাল করে। ভাটার টানের জোর বাড়ছে ক্ৰমাগত। জেটির লোহার জটায় বাধা পেয়ে, জল নীচের দিকে চাপ দিচ্ছে। আবার ফেপে ফুলে উঠছে হাত কয়েক দূরে গিয়ে।

হঠাৎ কী খেয়াল হল, বিলাস আর সয়ারাম বাচ লাগিয়ে দিলে পরস্পরে। দুজনের হাতেই লাগি। লগি মেরেই কে কার আগে যাবে, সেই চেষ্টা। বিলাসের বাচ খেলার সাথি সয়ারাম। দুজনেই বেশ দড়ো। কিন্তু ভয় হল পাঁচুর। আবার ভালও লাগল। টনটন করে উঠল। বুকের মধ্যে। বিলাস যে থেকে থেকে আচমকা গুম হয়ে যায়, তার কারণ ওর প্রাণে বিষ রয়েছে। ওটা আর কিছু নয়। বৃথা ভাবনা ভাবে পাঁচু। এই মরশুমটা গেলেই সব দিক ঠিক করবে। সে। বিষঝাড়ানির মন্তর দেবে। একখানি জীবন্ত সোনার প্রতিমা এনে বিলাসের বিষ ঝাড়বে। সেই প্ৰতিমার খোঁজ করে যে ওর মনের অন্ধকার।

ধমকে বলল, করিস কী তোরা দুটোতে। গুঁতোগুতি করবি নাকি?

ঠাণ্ডারামও পাঁচুর মতো কাঁড়ারে হাল ধরে বসে আছে। ভাটার জলে তিন হাত উলটো লাগি মারছে দু-জনে কুপকুপ করে।

তবু পাঁচু দেখছিল বিলাসের হাতের দিকে। হাত নয়, লোহা। ভেবেও কী অস্বস্তি। আ ছি ছি! আজ কী বার। রবিবার। যাক, অ-ফলা বার। তা মিছে নয়, হাতখানি লোহারই। আর একজনের হাতের কথা মনে পড়ে যায়। লগি ফেলেছে, কিন্তু জল ছিটুচ্ছে না। ব্যাটা সুন্দরবনের ডাকাত হতে পারত। কোথায় সয়ারাম। একেবারে হাঁপিয়ে পড়েছে। পেছিয়ে পড়েছে অনেকখানি।

তারপর হেসে উঠে। চিৎকার করে বলল সয়ারাম, দাঁড়ারে দাঁড়া, জানি তুই ধলতিতের বাছাড়ি বীর। ডাকলুম দুটো কথা বলব বলে। উনি পাল্লা দে চললেন।

কাছাকাছি হল আবার দুই নৌকা। গলুয়ে গলুয়ে সমান হল, তবে ফারাক রেখে। দুজনকেই লাগি ঠেলতে হবে তো।

বিলাসের সেই থমথমানি নেই মুখের। বলল, কেন বল দি নি?

—থেকে থেকে তোর কী হয়, বল তো। এসে তোকে দুটো কথা বনানু, তুই গেলি খেপে। মন করছিল, গাঁয়ে ফিরে যাই।

জবাব না পেয়ে বিলাসের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হল সয়ারাম। দেখল বিলাসের ঘামঝরা, মুখখানিতে চাপা চাপা হাসি। সয়ারাম বলল, মশকরা করছিলি আমার সঙ্গে, না?

-হ্যাঁ।

— বাবা, কী মশকরা ভাই তোর। ওতে কিন্তু তা বলে আমার বড় কষ্ট হয়।

বিলাস বলল, তোর কষ্ট আবার বেশি।

সয়ারাম অভিমানহত মুখখানি অন্য দিকে ফিরিয়ে চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপরে ফিরে আবার বলল, দু-দিনই ভাল পাচ্ছিাস, না?

ভাল পাওয়া অর্থে মাছ।

বিলাস বলল, ওই মোটামুটি এক রকম।

—গতিক এবার ভাল মনে হচ্ছে তা হলে?

—এখন আর কী করে গতিক বোঝা যাবে। শাওন মাসটা না দেখে কিছু বলা যায় না।

ঠিক, যথার্থ বলেছে। মনে মনে বলে উঠল। পাঁচু। জাত মাছমারার কথা বলেছে। গঙ্গায় এসেছ তুমি, সুদিনের আশায়। তোমার ভাগ্য নিয়ে বসে আছে শ্রাবণ মাস। জলেঙ্গা জল তোমাকে ইশারা দিয়েছে ভাল। কিন্তু জলেঙ্গা জল সব টেনে আনবে না। কুলে গিয়ে ভরাড়ুবি হতে পারে। শ্রাবণ না দেখে তুমি কিছুই বলতে পারো না।

কৃষ্ণচুড়া গাছের পর, কারখানার পাঁচিল পার হয়ে, পাঁচু নৌকার মুখ ঘোরাল। সয়ারামেরা যাবে সোজা। এই পুব পারেই ওই দেখা যায় পো মাইল উত্তরে জেলেপাড়া, ওইখানে নোঙর করবে। সয়ারাম জিজ্ঞেস করল, পরের ভাটিতে আসবি নাকি বিলেস।

—হ্যাঁ, আসব। পুবের জেলেপাড়ার দিকে দেখা গেল অনেকগুলি নৌকা। চব্বিশ পরগনার পুবের অনেকে স্থায়ী বসত করেছে ওখানে। জানাশোনা লোক অনেক আছে।

নজর পড়তে পাঁচুর মনে পড়ল সকলের কথা। যাবে এক সময়, দিন তো পড়ে আছে। এক ফাঁকে গেলেই হবে। উত্তর-পশ্চিমে পাড়ি দিয়ে বলল পাঁচু, মনে হচ্ছে, পুবের ওই ওড়ের মুখে যেন শাবর রয়েছে।

অর্থাৎ জেলেপাড়াটার যেখানে ভিড়েছে কিছু নৌকা। ওড় হল ইটখোলার গর্ত। গর্ত মানে, ছোটখাট কিছু নয়। ইটখোলার জমিতে জল যাওয়ার জন্যে সারা বিষা কেটে রাখে নয়ানজুলি।

নয়ানজুলিতে বাঁধ দিয়ে, পলিমাটি কেটে ইট হয়। আবার বিষাকালে জল আসে। ওই কাটা জায়গাটির নাম ওড়। জোয়ারের টানে গিয়ে ঢেকে মাছমারারা, বেরিয়ে আসে। ভাটার টানে। জেলেপাড়াটা ইটখোলার ওপরেই।

বিলেস তাকিয়ে ঠোঁট উলটে বলল, ওই কী শাবর। হাতে গোনা যায় কখানি লৌকো রয়েছে।

—না, বলে এট্টা কথার কথা বলছি।

—কথার কথায় শাবর হয় না। সমুদ্রের ট্যাকে থাকে দশ-বিশ গণ্ডা লৌকো, তাকে বলি শাবর।

পাঁচু ধমকে উঠে বলল, সেটা কি তোর কাছে আমাকে শিখতে হবে। বলছি বলে, মনে হচ্ছে যেন শাবর। তা নয়, এড়ে তককো।

বিলাস ছাঁইয়ের উপরে আড়াআড়ি বাঁশের উপরে জাল চেলে দিতে লাগল।

মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে। এ রোদ দেখতে বড় মিষ্টি। কিন্তু কেমন যেন একটু হলুদের ছোঁয়া লেগে থাকে। সোনার মতো। বৃষ্টিভেজা গাছের পাতায়, মাটিতে, সবখানে চোখ-জুড়ানো সোনার ঝিকিমিকি। দেখতে বড় ভাল, কিন্তু গায়ে লাগাও, জ্বলে যাবে। মনে হবে যেন, ধানি লঙ্কা ঘষে দিয়েছে তোমার সারা গায়ে। খানিকক্ষণ রোদটি লাগলেই ভিন্ন মূর্তি হবে। নেশা-ভাং না করেও চোখ দুটি কোকিলের চোখের মতো লাল হয়ে উঠবে। মাথায় চাপবে গরম। খেকতুড়ি হয়ে উঠবে। মেজাজটি।

বিলাসের নজর উপরের পাড়ে। দামিনী আসেনি তখনও। নাবির একটা গাছের গোড়ায় বসে আছে আতরবালা। হাঁটু অবধি শাড়ি তুলেছে। চুল এলিয়ে দিয়েছে ঘাড়ে পিঠে। নজর নৌকার দিকে। মেয়েমানুষের বয়স বোঝা দায়। দামিনীর নাতনির চেয়ে আতর বড়, এইটি মনে হয়। কত বড় আন্দাজ পাওয়া যায় না।

দুলাল চুপড়ি নিয়ে গাঙের পাড়ে ঘুরছে। নৌকা দেখে উঠে এল আতরবালা। মাথার সিঁথেখানি বাঁকা, গায়ে এক চিলতে জামা। কপালে আছে পেতলের টিপ। চোখে বড় লাগে, মনটা ছাঁত ছাঁত করে। কেন কে জানে। শরীরটি ঢলঢল, অঙ্গ একটু বেশি দোলে। এক-বেড়-দেওয়া শাড়ির কোমরের নীচে, রুপোর মোটা বিছে দিয়ে বাঁধা। বাঁধন একটু আট। বাঁধন না থাকলে যেন অঙ্গখানি ছড়িয়ে পড়বে।

ভাটার পলি, বড় পিছল। দুলালের কোমর জড়িয়ে এল আন্তর। বিলাসের সঙ্গে চোখাচোখি হল দুলালের। দুলাল হাসল ঠোঁট টিপে সে হাসি দেখে বিলাসেরও হাসি পেল। কেন কে জানে।

দুলাল বলল আন্তরকে, এ লৌকো নয় গো। এদের মাছ আমাদের ছোটমাসির জন্যে।

আতর বলল, অ।

দুলাল আবার বলল, কাল আমার ছোটমাসি আর হেসে বাঁচে না, ওই খুড়োর কথা শুনে।

আতর বিলাসের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন?

পাঁচু বলে উঠল, বড় গোঁয়ার যে!

আতর চেনা মানুষ। বিলাসেরও। আন্তর দাদন দেয় না কোনও মাছমারাকে। ঘুরে ঘুরে মাছ কেনে দশজনের কাছ থেকে। বিলাসও বলে উঠল, আর ফড়েনিরা যেন সব মহারানি। কথাবাত্তার গতিক দেখে মনে হয়, মাছমারারা তার কেনা গোলাম।

দ্যাখ, দ্যাখ, হারামজাদা কত বড় মুখফোড়। কিন্তু আতর আর দুলাল হেসে উঠল।

দুলাল বলল, ঠিক ধরেছে আমার খুড়ো।

আতর কপট কুটিল চোখে তাকিয়ে হেসে বলল, নেও, তুমি আর ফোড়ন কেটো না বাপু। বেলা অনেক হল। কাজ আছে আরও।

এগিয়ে গেল তারা কেদমে পাঁচুর নৌকার দিকে। কেদমে দেওয়ার জন্যেই ব্যস্ত। যা পেয়েছিল निव्न।

পাঁচু বলল আন্তরকে, ভাল আছ গো মা?

আতরের হাসি-হাসি ভাব, কথা যেন কেমন ঠ্যাকারে ঠ্যাকারে।

বলল, ওই এক রকম। লৌকো। এত কম কেন?

পাঁচু বলল, এ জলটা গেল। সামনে অমাবস্যে। পুন্নিমের কোটাল ধরে আসচে। সব। কত আসবে। তা আমাদের দামিনীদিদি এল না যে এখনও?

বলতে বলতেই, একটি নৌকা এসে লাগল পাঁচুর নৌকার গায়ে। রসিক ছিল কাঁড়ারে। সঙ্গে আর-একটি লোক। চুপড়ি নিয়ে বসে আছে। বলল, পাঁচু, মাছ আছে নাকি হে?

বিলাস বলে উঠল, আছে, লাতিনের জন্যে।

–লাতিন? লাতিন কে?

 

পাঁচু আগে খেঁকিয়ে উঠল বিলাসকে, তুইচুপো।

রসিককে বলল, দামিনীদিদির মাছ ভাই, দেবার উপায় নাই।

রসিক বলল, দাম বেশি দেব, ছেড়ে দ্যাও।

পাঁচু বলল, একবার না জিজ্ঞেস করে দিতে পারব না।

রসিকের গলায় তেমনি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। বলল, আরো লাও লাও, অত ভালমানষিতে কাজ না। মাছ থাকতে আবার গাহকের পিত্যেশ। লাও বার করো কী আছে।

যেন হুকুমের সুর রসিকের গলায়। পাঁচু বলল, তা হয় না গো দাদা। দামিনীদিদির কাছে আমি ধারি। তুমি না হয় একবারটি পাড়ে উঠে বলে এইস, আমি দে দি।

রসিক একটা বিশ্ৰী কটুক্তি করল। অষ্ট-প্রহরই করে এখানকার মাছ-বেচা, মাছমারারা। ওটা চল এখানে, কথার ধরতাই। বলল, আরে ধুর তোর নিকুচি করেছে। দামিনীর। দ্যাও দাও, টাকা দেব, মাল নেব। বলতে বলতে রসিক উঠে এল পাঁচুর নৌকায়।

বিলাস উঠে দাঁড়াল ছাঁইয়ের মুখছাটের কাছে। বলল, আরো বাধু, ইসরে, অ্যাঁ, মনে নেয়। কি য্যানো, হুকুমের লৌকো ডাঙায় চলে? লাতিনের মাছ জোর করে নেবে?

-এই, এই বিলেস।

পাঁচু উঠে এল সামনে। রসিকের গোল হলদে চোখে রক্ত দপদপিয়ে উঠল। কয়েক মুহূর্ত চোখাচোখি হল বিলাসের সঙ্গে।

রসিক ক্রূর গলায় বলল, বড় যে লাতিনের ওপর টান দেখছি।

বিলাস বলল, দেখলে আর থামাচ্ছে কে।

রসিক লাফ দিয়ে নিজের নৌকায় উঠে গেল। হালে একটা ক্রুদ্ধ হ্যাঁচকা দিয়ে, নৌকার মুখ ঘুরিয়ে, ভেসে গেল দূর জলে। চেঁচিয়ে বলল, কোন তল্লাটে এসেছ, সেটা একটু মনে রেখো, বুঝলে।

মিষ্টি করে জবাব দিতে যাচ্ছিল পাঁচু। বিলাস বলে উঠল, তোমার হুকুমে গো।

পাঁচুর মনটা ভরে উঠল। অস্বস্তিতে। ভয়ও লাগে বড়। শহরের মানুষ, বলা তো যায় না, কখন কী অঘটন ঘটায়। কিন্তু রাগ হয় বিলাসের উপর। এই হারামজাদা যে আকোচ বাড়ায়। সর্বনেশে যে মাথা নোয়াতে জানে না।

দুলাল বলল, ওদের পাড়ার লোকগুলানই এমনি। তেরিয়ান হয়েই আছে।

তারপরে এল দামিনী। থপথপ করে ছুটে এল, ও মা, এসে পড়েছ?

পাঁচুর মুখে সব কথা শুনে, চেঁচিয়ে উঠল দামিনী, কোথায় সেই মুখপোড়া আসুক, মাছ নেয়াচ্ছি। খেংরে। বিষ ঝাড়ব না।

মাছ নিয়ে গেল দামিনী। পাঁচুর মনটা ভার হয়ে রইল। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। কিন্তু বিলাস সেটা বোঝে না।

পরের ভাটিতেও মাছ পাওয়া গেল। সবাই পাচ্ছে কিছু কিছু। খবরও রটেছে। এদিক ওদিক। পাইকেরদের ভিড়ও মন্দ না। দুপুরের জোয়ারেই দেখা গেছে, আর-এক ঝাঁক নৌকা এসেছে। কিছু রয়ে গেছে। কিছু চলে গেছে আরও উত্তরে। গঙ্গার এ আর-এক শ্ৰী। ওইটুকুনি দেখে শান্তি মাছমারাদের। আকাশ বাতাস, সবই বদলাচ্ছে। সকলেরই কিছু তাড়া পড়েছে। জলের তাড়া লেগেছে, সে ফুলছে। বাতাসের তাড়া, ঝোড়ো ঝোড়ো ভাব তার। আকাশেরও তাড়া, তাই মেঘের বড় জড়াজাপটি। রোদ উঠছে, কালো হচ্ছে, কখনও গুমসোচ্ছে। প্ৰস্তাবনাটি জমেছে ভাল কথায় বলে, যার শুরু ভাল, তার শেষ ভাল।

 

পরের ভাটা থেকে একটু বেলাবেলি ফিরে নোঙর করল পাঁচু। দামিনী এল ছুটে। এক নৌকা নয়, তিন নৌকার মাছ সবই কিনল। বাদবাকি পাইকের যারা ছিল, তাদের বড় একটা মুখ চলে না। দামিনীর উপর।

মাছ নিয়ে দামিনী বলল পাঁচুকে, আর তোমাকে এখন নগদ দেব না দাদা। এই ফাঁকে তোমারও ঋণ কিছু শোধ হোক। আমার নয়, আমার নাতিনের দেন। বড় মেজাজি রায়বাঘিনি মেয়ে কিনা। কখন কী বলে বসবে কিছু বলা তো যায় না। তোমারও আবার সুদিন দুর্দিন আছে, অ্যাঁ? কী বলো?

পাঁচু বলল, তা বেশ তো গো। তোমার লাতিনের কপাল নে যেন এবার জোয়ান কোটালের ভরা-ভিত্তি হয়। আমি যেন সব ঋণই শোধ করতে পারি।

ফোগলা দাঁতে হাসল দামিনী বুড়ি দূর সন্ধ্যাকাশের দিকে তাকিয়ে। বলল, আমার লাতিনের কপাল নে? ভাই পাঁচুদাদা, তবে তোমাকে এটা কথা বলে যাই চুপিচুপি। কাকে বা বলি, বুড়ো বয়সে যেন মানষের ভয় দু-গুণ বাড়ে। বলছিলুম, আমার লাতিনের কপালের কথা বলছি। লাখ ট্যাকার মালিক, হাত পেতে চেয়েছিল আমার লাতিনকে। গঞ্জে তার বড় কারবার। মোটর বাস, লরির ব্যাওসা। তা মেয়ে জবাব করেছে, ট্যাকায় বিকোতে পারব না, যা-ই বল আর তা-ই বল। মিছিমিছি কোন পাপের দেনা শুধব। কারুর ট্যাকায় আমার লোভ নেই। বোঝা তালে।

বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। আবার বলল, কপাল যে কাকে বলে, তা জানিনে। এতখানি জীবন কাটল আমার! কত কী এল, কত কী গেল, কিছুই তো ধরে রাখতে পারিনি দাদা। কপাল কাকে বলে, বুঝলুম না। খালি বুঝলুম, জীবনটা ফুটো কলসি, সে কখনও ভরে না। যাই ভাই, দেরি করব না। আর, সাঁঝবেলার বাজারটা হাতছাড়া করব না।

চলে গেল দামিনী। পাঁচু দেখল, বিলাস তাকিয়ে আছে সেই উঁচু পাড়ের দিকে। পাড়াটা অন্ধকার হয়ে আসছে আস্তে আস্তে।

হঠাৎ বিলাস উঠে দাঁড়াল। এদিক ওদিক দেখে, মেটে ঘড়াটি নিয়ে এগিয়ে গেল গলুয়ের দিকে।

ছাঁইয়ের গা থেকে টিকটিকি উঠল টিকটিক করে। পাঁচু বলল, কমনে যাস?

বিলাস বলল, এট্টু খাবার জল নে আসি।

খাবার জল পাঁচু নিজেই নিয়ে আসে। বিলাসকে ওপরের পাড়ায় পাঠাতে ভয় করে। আর কিছুর জন্যে নয়। পথ ভুল হতে পারে। ঝগড়া-বিবাদ বাধিয়ে বসতে পারে কারুর সঙ্গে।

পাঁচু বলল, থাক, তোকে যেতে হবে না। বাধা পড়ে গেল, আমিই যাচ্ছি।

বিলাস টিকটিকির ডাক শুনতে পায়নি। বলল, কীসের বাধা পড়ল?

—ওই যে, টিকটিকির বাধা পল। ও সব মানতে হয়, বুইলি? ওঁয়াকে শুধু একখানি জীব ভাবলে হবে না। শাস্তরে বলেছেন, খনার জিভখানি কেটে নে মিহির রেখে দিয়েছিলেন গর্তে। সেই জিভটি খেয়ে ফেলেছিল টিকটিকিতে। খনার বচন হলেন বেদবাক্যি। জিভ খেয়ে ফেলে, টিকটিকিরও গুণ হয়েছে ডাকের। সবাই মানে, তুমো মানো।

বলে পাঁচু নামছিল নৌকা থেকে। বিলাস বলে উঠল, মানষের মরবার সময় যদি টিকটিকিতে ডেকে ওঠে, তবে বোধহয় যমও ফিরে যায়!

পাঁচু রেগে বলল, প্যাঁচা, সেটা যমকে পেলে জিজ্ঞেস করিস। কত তো মুরোদ। যাস, কাল থেকে রোজ জল আনতে যাস, দেখব কেমন লাগে। টেপা-কলে লোকের ভিড়। ঝগড়া করে আসবি তো তোর পিঠে সাংলোর সলি ভাঙব।

ঢালু জমিতে অন্ধকার নেমেছে। পাঁচু মিশে গেল সেই অন্ধকারে।

বিলাস তাকিয়ে রইল, অন্ধকারের বুকে কালো কিম্ভূত পাড়াটার দিকে। কলসি আর হ্যারিকেনটি নিয়ে গেছে পাঁচু। নৌকার ছাঁইয়ের অন্ধকারে দেখা যায় না বিলাসকে। অন্ধকারের মধ্যে চকচক করে শুধু চোখ। অন্ধকার জলের ঝিকিমিকি স্রোতের কোটালের মতো।

সেই অন্ধকার যুগের মানুষের মতো। মনের ভাবকে ভাষা দিতে পারে না। কেবল মনটা ফসফস করে। রক্তের মধ্যে কে যেন পাক দিয়ে ওঠে।

পাঁচু ভাবে, রাগ, বড় রাগ ছেলেটার। নিজের মনের মতো কিছু না হল তো আমনি খেপে যাবে। জানিস, তোকে আমি পাঠাতে চাইনে কোথাও। শহরের পারে, দোকানে বাজারে কোথাও পাঠিয়ে আমার শান্তি নেই। কেন? না, তোকে নিয়ে আমার বড় ভয়। সব জায়গায় বাতাস তোর কানে আন কথার মন্ত্র নিয়ে ঘোরে। সে মস্ত্রের ঘোরে যদি তুই হারিয়ে যাস।

আমি তো জানিনে, কেন তুই এমন করে তাকিয়ে থাকিস পাড়ের দিকে। যেন সদ্য আঁতুড়ঘর থেকে বেরিয়ে আসা ছেলে তুই। যা দেখিস, সবই অবাক হয়ে দেখিস, মোহমুগ্ধ হয়ে দেখিস। তুই যখন দক্ষিণে তাকিয়ে দেখিস স্বপ্ন, দেখিস গঙ্গার ঘোলা মিঠে জল, সবখানেই তোর এক ভাব। দেখে মনে হয়, কে যেন তোকে টানছে দিবানিশি।

পাড়ের দিকে কী দেখিস তুই ও চোখে। দেখে মনে হয়, যেন তোর মন আর মানছে না। না, তোকে আমি কোথাও যেতে দিতে চাইনে।

টেপা-কলের পাশেই দামিনীর ছিটে বেড়ার বাড়ি। এ পাড়াটাও একটু কেমন কেমন লাগে পাঁচুর। পাড়ায় মেয়েমানুষ বেশি। রাতের দিকে মাতাল মিনসে দেখা যায় দু-একটা। দাজ্জাল মেয়েদের খাণ্ডার গলায় আ-কথা কু-কথা শোনা যায়। যা শোনা যায়, তা ঘর-গেরস্থির বউ-বিদের বলা উচিত নয়। পাড়ার মধ্যে দু-চার ঘর আবার মাছমারাও আছে। বড় গরিব, পরের নৌকায় কাজ করে। সব ঘরেই ছেলেমেয়ে আছে, সংসার আছে। মিল-কলে কাজ করে অনেক মেয়েমানুষ।

কিন্তু কেমন যেন। মনটা কু গায়। দামিনীদের মতো মেয়েমানুষেরই পাড়া বলা যায়।

টেপা-কালের হাতল চালাতে চালাতে শুনতে পেল পাঁচু মেয়েমানুষের গলা। বাড়ির ভিতরে কাকে বলছে, ব্যাটাছেলে বলে তো ছেড়ে কথা কইব না! তোমাকে খেতে দি আমার কাজকর্ম করার জন্যে, বসে বসে আমার মুখ দেখার জন্যে নয়। বুড়ি একলা গেল বাজারে, ভাল চোখে দেখতে পায় না। রাতের বেলা মাছ কাটতে কুটিতে হতে পারে। তুমি গাঁজায় দম দে বসে রইলে এখেনে। বেরও বেরও, দূর হয়ে যাও, দূর হয়ে যাও এখান থেকে।

বুঝল পাঁচু। দামিনীর নাতিন কথা বলছে। হ্যাঁ, খারাপ জায়গার মেয়ে, তবে বড় ডাকসাইটে। শাসন করে পুরুষকে।

জল নিয়ে নেমে এল পাঁচু। দেখল, বিলাস বসে আছে।

—বসে আছিস যে? তিবড়ি জ্বালিসনি?

—এই জ্বালি।

ছাঁইয়ের ভিতর থেকে শুকনো কাঠ এনে তিবড়ি জ্বালল বিলাস। আগুন জ্বলে উঠল। দাউ দাউ করে। ভাতের হাড়ি চাপিয়ে বিলাস গান গেয়ে উঠল,

আমার পরান বড়ো উদাস হে
আমি যাব সাগরে।
ঘরে নাই ভাত-পানি
পরনে নাই কানি
পানসা সাই নে আমি যাব সাগরে।

পাঁচুর মুখে থমকে যায় হরির নাম। ভয়ে বুক কাঁপে থরথরিয়ে। বিলাসকে দেখে, আগুনের শিখা সাপের মতো খেলা করে ওর গায়ে। ভাটার জল বড় হাসে খিলখিল করে।

 

পরদিন, জলেঙ্গা জলের স্রোতের বাঁকে, ঘোলা জলের আগমন দেখা গেল। কিন্তু নবমী পড়ে গেছে। সাঁঝের ভাটার জোর তেমন নেই।

তবু মাছ পাওয়া গেল। বাচা শিলং খানকয়েক। জালের প্রথম মুখ দেখে পাঁচুর মনটা। সাঁঝবেলার মতো অন্ধকার হতে লাগল। পুরো টানাছদি জলে তুলে দেখা গেল, ছোট একটি ইলিশ, আধ সের আড়াইপো।

হে খোকাঠাকুর। যা দিয়েছ, আজ এই ভাল। জলেঙ্গা জল শেষ হচ্ছে। এও আমার ভাল নিশানা।

মাছমারা মালো, সে জানে মাছের দেবতা খোকাঠাকুর। কেমন তোমার মূর্তি, তা জানিনে। নিজের হাতে মাছ মেরে, সেই মাছের গোল আপলক চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তুমি তাকিয়ে আছ আমার দিকে। দেবতা, তুমি আমার শিকার। তোমার আমার জীবনের এই বিধান।

কেদমে পাঁচু একটি বড় ইলিশ পেয়েছে।

দুপুরের দিকে আকাশ পরিষ্কার হয়েছিল। আবার জমছে মেঘ। নৌকা নোঙর করল বটতলায়। বটের মাথায় মেঘ নামছে গড়িয়ে গড়িয়ে। বাতাসের জোর কম। কোনখানে যেন বিদ্যুৎ চিকচিক করে।

চুপড়ি কাঁখে নিয়ে, নেমে এল হিমি। সাদা শাড়ির গায়ে, লাল রঙের গোল ছাপ। যেন মাছের চোখ ছড়ানো সারা গায়ে। পান খেয়েছিল। কখন। তার লাল দাগ এখনও দুই ঠোঁটে। জামা বোধ হয়। কখনওই গায়ে দেয় না। চল নেই। বিকালে বাঁধা আট খোঁপায়, সেদিনের চওড়া, বড় মুখখানি আজ একটু লম্বা লাগছে।

এখন নৌকা বেড়ে হয়েছে ছখানি এই বটের তলায়। আরও দু-জন ফড়ে ছিল দাঁড়িয়ে।

হিমি আসছিল পাঁচুর নৌকার কাছেই। হঠাৎ নজরে পড়ল কেদমে পাঁচুর বড় মাছটির দিকে। জিজ্ঞেস করল, দেবে নাকি দাদা?

কেদমে একবার উপরের পাড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, নেও। ঠাকুরের লোক এল না। সাঁঝবেলায় আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়?

মাছ নিয়ে আচল খুলে পয়সা দিতে গিয়ে হঠাৎ নজর পড়ে গেল বিলাসের দিকে। পাশের নৌকাই বিলাসদের। ছাঁইয়ের মুখছাটের কাছে দাঁড়িয়েছিল সে।

চোখে চোখ পড়তেই ভু দুটি কুঁচকে উঠল একবার হিমির। পাঁচু দেখল ভাইপোের দিকে। দেখো ছোঁড়ার কাণ্ড। তোর রাগ যায়নি। নাকি এখনও। অমন করে তাকিয়ে রয়েছিস। শত হলেও মেয়েমানুষ। ভাল হোক, মন্দ হোক, অল্প বয়সের জোয়ান মেয়েছেলে। মাকড়া, সহবত শিখিসনি।

পান-খাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে সাদা দাঁতের সারি দেখা গেল হিমির। পাঁচুর দিকে ফিরে, হেসে বলল, খুড়ো, যাচ্ছি। তোমার কাছে। দেখি, এদের কাছে আর কিছু পাই কি না।

—আচ্ছা গো মেয়ে, আচ্ছা, ঘুরে এসো। তোমার দিদিমার কী হল।

–শরীরটা খারাপ। আজ আর বেরুতে দিইনি।

বলতে গিয়ে আবার নজর পড়ল বিলাসের দিকে। ভাবলেশহীন কালো কুচকুচে নাগের চোখ বিলাসের। হঠাৎ একবার বুঝি বা হিমির চোখ জ্বলে উঠল দপ করে। স্ফীত হল নাসারন্ধ।

কিন্তু মুখ ফিরিয়ে চলে গেল অন্য নৌকার কাছে। কাপড় একটু তুলতে হচ্ছে উপরে। জল নামছে এখনও ভাটার। কাদা হয়েছে। বড় পিছল। আর আটালো। এদিকে হড়কে দেয়, আবার টেনে রাখে। মাঝে মাঝে পা ঝাড়া দিতে হচ্ছে। রাশি রাশি মেকো উঠছে গা বেয়ে বেয়ে। সুড়সুড়ি লাগে, কুটকুটও করে। বলে উঠল হিমি, আ কী মরণ গো মেকোর।

পাঁচুর মুখ দিলা পাকিয়ে উঠল। রাগে বিলাসের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল চাপা গলায়, এই, আরে এই শোরের লাতি, কী দেখছিস তুই তাক্কে তাক্কে, অ্যাঁ? গাড়লের লাতি, ক্যাঁচা গিঁথে চোখ ওড়াব তোর। মালো গোঁয়ার, তোর ঘাড়ের ওই ব্যাঁকা রগটা আমি আজ কাটিব কাটারি দোঁ।

বিলাস তাকাল খুড়োর দিকে। আমার আৗতুড়ের ঘুমভাঙা ছেলে তাকাল অবাক চোখে। ভাটার ঢেউয়ে নৌকা দুলছে, দুলছে বিলাসও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বলল, চোখ ওড়াবে? কেন?

—কেন? কেন দেখবি তুই আমন করে? রাগ থাক যা থাক, মাছমারা তুই, মাথা নামমে রাখ।

বিলাস একমুহূর্ত খুড়োর দিকে চেয়ে থেকে, চোখ নামিয়ে নিল।

ওদিকে, চারটি নৌকার মাছ সব খরিদ করেছে হিমি। কুল্যে হবে প্রায় সের সাতেক। বাকি দুই ফড়ের চেয়ে দু-আনা দর বেশি দিয়ে নিয়েছে।

একজন ফড়ে বলে উঠল, বাজার চড়াচ্ছ কেন? আমরা কি নিতুম না?

হিমি বলল নির্বিকার গলায়, নিলে না তো। দীর চড়িয়ে থাকি, চড়িয়েছি। সাঁজের মাছ, দু-আনা পয়সার জন্য দশ ঘণ্টা দরদরি করার সময় নেই। আমার।

-আমাদের যে সময় ছেল।

—তার আমার কী? সময় ছেল, দাঁড়িয়ে থাকো, বারণ করছে। কে। শুধু শুধু ঝগড়া পাকাচ্ছ দাদা।

—ঝগড়া কেন। বলে, ঘাটের ইজারাখনি তো তোমার লয়।

–তোমারও নয়।

ফিরে তাকাল হিমি ফড়েদের দিকে। বলল, এখানে পয়সা বেশি দি আর যা-ই করি, বাজারে গিয়ে তো তোমার চেয়ে বেশি লাভ খাব না।

ফড়ে দুটি চুপ হয়ে গেল।

পাঁচুর নৌকার কাছে এল হিমি। বলল, দেখো দিকিনি, পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া। দেও খুড়ো, মাছ দেও।

আবার চোখাচোখি হল বিলাসের সঙ্গে। ভুলে গেলি হারামজাদা, খুড়োর কথা ভুলে গেলি।

ভুরু কুঁচকে চোখ ফেরাতে গিয়ে হিমি আবার তাকাল। হঠাৎ কুঁচকে উঠল তার ঠোঁটের কোণ দুটি। চোখে ফুটল একটু হাসির ধার। কাঁখ থেকে চুপড়ি নামাল নৌকার গলুয়ে।

পাঁচু বলল, ওজন করি মেয়ে?

-হ্যাঁ করো। ওকী, সব একসঙ্গে কেন? ইলিশটা আলাদা করো।

পাঁচুর ফোগলা মুখে হাসি আর ধরে না। বলল, থাক না। এট্টা তো মাছ। ছোটগুলানের সঙ্গে এক দর-ই দিওখনি।

–সে তোমার যা প্রাণ চায়।

মুখখানি যেন লাল দেখা যায় দামিনীর নাতিনের। আবার চোখাচোখি হল। কী দেখছে বিলাস এমন অবাক হয়ে। সমুদ্র নাকি! নজর যে ক্ৰমে মোহমুগ্ধ হচ্ছে। সর্বনাশ। দামিনীর নাতিনের দিকে হারামজাদার মন টেনেছে নাকি? দুশ্চরিত্র! গাড়ল! অপঘাতে মারে যে মাছমারাকে, সেই ডাকিনী চেপেছে শোরের ঘাড়ে। রাগে ও ভয়ে হাতের দাঁড়িপাল্লা কাঁপে পাঁচুর।

দামিনীর নাতিনের চোখে যেন বিদ্যুৎ চিকচিক করে। কেন? ভাইপো আমার মাছমারার ছেলে। ও তো লাখপতি নয়।

তোমাদের ঝগড়া হয়েছে?

পাঁচু বলল, ঝগড়া করিনি গো মেয়ে, দিতে চাইনি। ভয় আমার ভাইপোকে নে। এর যে জায়গা অজায়গার ধেয়ান নেই।

হিমির চোখে আবার বিদ্যুৎ চিকচিক করল। আড়চোখে দেখল বিলাসকে।

—এই নেও মেয়ে, মাছ নেও।

—দেও। হিসেব রাখছি। তো, কত শোধ দিলে।

–রাখছি। দামিনীদিদিও রাখছে।

কী হল বিলাসের। শরীরের পেশি শক্ত করে কাট মেরে তাকিয়ে দেখছে পাথরের মূর্তির মতো। শহরের ফড়েনির চোখ-মুখের ভাবেও যেন সাপ-খেলানো মন্ত্রের উত্তেজনা। নাকের নাকছবি কাঁপছে থেকে থেকে।

হিমি বলল, দি-মা আর কদিন রাখবে। আমাকেই রাখতে হবে খুড়ো। যাই, বাজারের সময়

—নিজে যাবে?

—না, বাজারে গিয়ে বসতে এখনও বড় লজ্জা করে খুড়ো। একটা বুড়ো মিনসে রেখেছি, তা সেও গ্যাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। কী যে জ্বালা!

তা বটে। কিন্তু আড়চোখে চেয়ে অত হেসে যায় কেন দামিনীর নাতনি।

মেঘ নামছে বাসুকির মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে। ভাটার ছলছলানি যেন কমছে একটু। জোয়ার এসেছে তলে তলে।

যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল হিমি। ঠোঁট টিপে হেসে বিলাসকে চকিতে দেখল আর-একবার। বলল, খুড়ো, তোমার ভাইপো যেন এক ঢপ বাপু।

–তা বটে ঢাপ-ই।

বিলাস বলে উঠল, কেন, ঢপ হতে গেলুম কেন?

হিমি বলল ঠোঁট উলটে, আমার তো সে রকমই মনে হয়। আ মা গো, কী কাদা! জল দেখছি অনেক দূর উঠেছেল।

চলতে গিয়ে হিমির পা পিছলে পড়ছে। পা হাড়কায় তবু হাসে। লজ্জায় আর সঙ্কোচে হাসে। পশ্চিম আকাশের কালো মেঘের তলা দিয়ে একটু সিঁদুরে মেঘের আলো এসে পড়েছে হিমির এক ভাঁজ শাড়িতে। খোঁপাটি চকচক করছে।

বিলাস আবার বলে উঠল, কাদায় বোধকরি ঢপ আছে।

শোনো, শোনো হারামজাদার কথা। ওর অত বড় বাপ যা কোনও দিন বলেনি দামিনীকে, ও তাই বলছে। ও যে মাছমারা সে কথা ভুলে যাচ্ছে। ডাকিনীর মায়া লেগেছে। ওর।

হিমি তাকাল ভ্রূ কুঁচকে। বলল, তাই নাকি?

—মনে তো নেয় তাই।

হঠাৎ দাঁড়াল আবার হিমি। বিলাসকে বলল, কাঁখালে ভার, উঠতে পারছিনে। চুপড়িটা একটু দিয়ে আসবে ওপরে? ·

বুকের মধ্যে দুরদুর করে উঠল। পাঁচুর। বিলাস বললে, তা দিতে পারি।

দেখো, দেখো, হারামজাদা সত্যি নেমে গেল নৌকা থেকে। ডাকতে পারল না পাঁচু। সে যে জানে, এ যাওয়ায় ওর মরণ থাকলেও ডাকলে পিছু ফিরবে না। থ্যাবড়া পা ফেলে ফেলে গিয়ে বলল, দেও।

হিমি চুপড়ি দিল। বিলাস আগে আগে উঠে গেল সেই আমগাছের গোড়ায়। হিমি উঠল। ঠেলতে ঠেলতে। দেখো, হারামজাদা চোখ ফেরায় না শহরের পাইকেরানির ওপর থেকে।

কাছে গিয়ে, বিলাসের পায়ের থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল হিমি। বলল, দেও, চুপড়ি দেও।

চুপড়ি নিয়েও আবার দাঁড়াল হিমি। কালো পাথরের মূর্তি বিলাস। প্রস্থে বুক যেন এক হাত উঁচু! সলুই কোঁকড়ানো চুল। বনমানুষের মতো। কাপড় পরেছে নেংটির মতো, উরুতের ওপর তুলে।

হঠাৎ যেন একটু লজ্জা করে উঠল হিমির। বেশ গভীরও দেখাল। বলল, যাও এবারে।

বিলাস বলল, তুমি যাও আগে, তা পরে যাই।

হেসে ফেলল। আবার হিমি। চুপড়ি ঝাঁকানি দিতে, সোনার চুড়ি বেজে উঠল। বিলাসের চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটু চাপা গলায় আবার বলল হিমি, ঢপো!

বলে চলে গেল চুপড়ি কাঁখালে।

কী কথা বলিস তুই এতক্ষণ ধরে। কী কথা! ভাব-বিভ্রম মন নিয়ে, উথালি-পাথালি বুক নিয়ে, এইখানে এসে তোর মরণ ধরেছে। হারামজাদা। অ-জাতের মেয়ে, কুহকীর হাতে তুই প্ৰাণ সঁপে দিতে চাস। তুই তাকিয়ে দেখিস না, ও মেয়ের সারা গায়ে আপলক মীনচক্ষু, তাকিয়ে আছে তোর দিকে। ও মেয়ে মাছ বিক্রি করে আর পুবের মাছমারার ব্যাটা তুই, পিঁপড়ের মতো মরতে চাস এখানে। তার আগে তোকে জলে ড়ুবিয়ে মারব আমি জালে জড়িয়ে।

বিলাস নৌকায় আসতেই বুড়ো শরীর শক্ত করে দাঁড়াল পাঁচু সামনে। হাত-পা নিশপিশ করছে। কিন্তু গায়ে হাত তুলতে সাহস হয় না। ও যে ড্যাকরা হয়েছে। তবু সামলাতে পারছে না পাঁচু। বললে, কী হয়েছে তোর?

–কেন? কী দেখলে কী?

—বড় যে চাড় দেখছি। আবার দেখলুম কী?

বিলাসের গায়ে গা ঠেকে পাঁচুর। কাঁপছে রাগে। —শহরের ফড়েনির সঙ্গে তুই পিরিত করতে এসেছিস, শোরের লাতি। শুনি, মনে তোমার সুখ নেই, বড় জ্বালা। আমি তোমার জ্বালা জুড়োবার কাল গুনছি, আর তুমি গাড়লের ভাইপো এখানে মন বসাচ্ছ, জুড়াবে বলে? মেয়ে মাগছিস রাঁড়ের?

বিলাস তো পিছুল না খুড়োর গায়ের কাছ থেকে। মাথা নিচু করে চলে যা সামনে থেকে। তা নয়, বলল, হয়েছে, সর দিনি এখন, তিবড়িটা জ্বলি।

কেদমে পাঁচু বলে উঠল, হুঁ রোগ হয়েছে।

বিলাস ফিরে তাকাল। কেদমে পাঁচু কোনও দিন দেখতে পারে না তাকে। চোখ দুটি জ্বলে উঠল। বলল, হতে পারে। কারুর বাপের কাছে তো ওষুধ মাগতে যায়নি।

শোনো, কত বড় কথা। কেদমেও বড় শক্তিশালী মানুষ। বয়সকালে একদিন তো বাছাড় হয়েছিল। তার উপরে সঙ্গে দুই দুই জোয়ান ছেলে। দাঁড়িয়ে উঠল কেদমে— কী বললি?

অন্ধকার নামছে। আর একপৌঁছ। কালো অন্ধকারের মতো বিলাস এক জায়গাতে দাঁড়িয়েই বলল, যেমন বললে, তেমনি বনানু। বড় যে তড়পাচ্ছি?

আগে বাড়তে পারল না কেদমে পাঁচু। ছেলে দুটোও বসে রইল হাঁ করে। কেদমে বলল চিবিয়ে চিবিয়ে, বিদেশ বিভূয়ে না হলে একবার দেখতুম।

বিলাস বলল, ফিরে গে। দেখোখনি।

হুঙ্কার দিল পাঁচু, চুপ, দে রাড়-মোগো।

বিলাস চুপ করল।

জোয়ার এসেছে পুরোপুরি। মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। গাঢ় অন্ধকার নেমেছে ত্রিসংসার জুড়ে। শেয়াল ডাকছে কাছাকাছি। তার ফাঁকে ফাঁকে একটু দক্ষিণে গঙ্গার পাড় থেকে শোনা যাচ্ছে ডাকিনীর খিলখিল হাসি। ভাগাড়ের পরে, পুবে পশ্চিমে লম্বা পাহাড়টার মেয়েরা, রাতের অন্ধকারে পুরুষদের সঙ্গে এসে ওখানে হাসি-মশকরা করে মাঝে মাঝে।

জোয়ারের মতো ফুলতে লাগল পাঁচু গলুয়ে বসে। দেখছে বিলাসকে, কালো মূর্তি দপদপ করছে তিবাড়ির আগুনে। কোথায় গেল এত কথার পোড়ানি। দেখো, গুনগুন করছে বসে।

আমার ডাক পড়েছে সাগরে,
ঠাকুর, আমার যেতে মন করে।

পাঁচুর বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। তুমি ফিরলে না। আর সমুদ্র থেকে। আজ বিলাস বারবার সমুদ্রে যেতে চায়। তোমার প্রাণে ছিল আগুন, তার চেয়ে আমি বেশি দেখি বিলাসের। বংশে যাদের সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ, সেই কাজে বিলাসের জেদ। মাছমারা থাকে বউ নিয়ে ঘরের কোণে। ও ছোটে ফড়েনির পিছনে। মরণ ওর চারপাশে ফিরছে। রংমশালের ঝাড় নিয়ে। শক্তি দাও, ওকে আমি সামলাই।

সু আর কু আছে সব জায়গায়। মাছমারাদের মধ্যেও আছে। যার কু আছে, তার সেটুকু সমুদ্রেও যায় সঙ্গে সঙ্গে। মাছ নিয়ে গোটা সাইয়ের শাবর হল হয়তো ক্যানিংয়ে। বড় বড় আড়ত। দোকান পশার। চারিদিকে মেলাই আলো। একটু দেখেশুনে বেড়াতে ভাল লাগে মাছমারার। নোনা জলের অকুল থেকে মাছ মেরে, এক আধ রাত কাটাতে হয়। এখানে। জলে জলে ঘুরে, একটু হাত-পা ছড়িয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে। আড়ত এখানে, মাছ মেরে এখানে আসতেই হবে। রক্তে যার বড় বেশি জ্বালা সে যায় শহরের খারাপ জায়গায়। তারাও ডাকে, ফোঁসলায়, টানাটানি করে হাত ধরে।

বড় ভীষণ পাপ, যে যায়, সে তো বলে যায় না। ঘর ছেড়ে এসেছে সে। তার সোহাগের মানুষ ফেলে এসেছে ঘরে। নকল সোহাগের কোলে এক দণ্ড প্ৰাণ শান্ত করতে চায়। যেখানে দাড়ি-গোঁপ। কামানো নিষেধ, সেখানে অপবিত্র হয়ে ফিরছ তুমি। তার জন্যে কত গুনোগাথ দিতে হয়, তোমার তখন মনে থাকে না। পাপ ঢোকাচ্ছ সাইয়ে! রক্তের মধ্যে বিষ নিয়ে আসছে। সারা গায়ে নিয়ে ফিরছি। ছাপকা ছপকা ঘা।

তারপরে সুঁদুরী বনের অন্ধকারে, হেঁতালের ঝোপে, মেতে ওঠে। একজন মদমত্ত হয়ে। তোমার পাপ। ভুগবে। সবাই। পাপ এমনি করেই আসে।

কেমন করে আসে? না, দেখছিলে বসে, শীতের কুয়াশা-ঢাকা আকাশ, মিটমিট করছে তারা। হঠাৎ সূদুরবিন উঠল মেতে প্রচণ্ড বাতাসে। গোলপাতা আর হোগলা মাথা কুটতে লাগল। সারা বনজঙ্গল কাঁপিয়ে কে যেন আসছে। হা হা করে। কিন্তু শাবর স্থির। তোমার প্রাণও স্থির। ওই শোনো, মটাস মাটাস করে কে বড় বড় সুদুরীর ডাল ভেঙে আসছে। কী খরা। কান ফটছে দানোর খরায়। অথাৎ দানোর চিৎকারে।

টনক নড়ল গুণিনের। যে আসছে। সেও গুণিনেরই আত্মা যে! দানো আসছে। পৌঁতো, পোঁতো শিগগির মন্ত্র খুটি। গোটা শাবর ঘিরে পাড়াবন্দ করল গুধীিন। মন্ত্র দিয়ে দানোর সামনে সীমাবদ্ধ করল পাড়াবিন্দ করে। এর মধ্যে আর পারবে না সে ঝাঁপিয়ে পড়তে। একটি বেগুন ফেলে দেখো পাড়াবিন্দের জলে। গোটা বেগুন সেদ্ধ হয়ে যাবে। এত তেজ গুণের। দানো আসে খরা মেরে মেরে, শাবরে ঝাঁপ দেয় দেয়, পারে না। রাত পোহালে দেখো, আক্ৰোশে শুধু গাছ ভেঙে গেছে। কয়েক গণ্ডা।

সকালবেলা এলেন সরকারি বন-বাবু। এত গাছ ভাঙলে কে? অমনি শাবরে এসে নৌকা তল্লাশি শুরু করলেন। দানের কথা শুনবেন না। উনি দানো দেখেননি, ও সব চেনেনও না। কিন্তু মাছমারা কাঠ চুরি করতে আসেনি। সে টিকিট কেটে সমুদ্রে ঢোকে। হাপ্তায় হগুপ্তায় টিকিটের পয়সা তাকে জমা দিতে হয়। তার জন্যেই অনুমতি আছে, প্রয়োজন মতো মাছমারা কাঠ কাটতে পারে। কাঠ চুরির আলাদা লোক আছে। মাছমারাদের চোখের সামনে দিয়েই তারা নৌকা বোঝাই কাঠ নিয়ে পাড়ি দেয় দূরদূরান্তে। বন-বাবুরা তাদের ধরতে পারেন না। নৌকা তল্লাশি করেন নিরীহ মাছমারার, প্ৰাণ যার পড়ে আছে অগাধ জলের তলায়।

তারপরে বন-বাবুর চমক ভাঙে। ভাঙা গাছগাছালি দেখেন। বলেন, হুঁ, সমুদ্রের সেই ঝড় এসেছিল। কেন না, গাছ ভেঙে পড়েছে, কাঠ যায়নি কোথাও এক টুকরো। সে ঝড় কীসের, মাছমারা জানে না। সে দেখে, শান্ত সমুদ্র। হঠাৎ কোথেকে আধ মাইল জুড়ে একটি ভীষণ ঝড় ওলট-পালট করে, দলে মুচড়ে দিয়ে গেল বনের মধ্যে। আর কী তার হাঁক। কাঁপ ধরে যায় বুকের মধ্যে!

এখানে, সমুদ্রের এই জলে স্থলে, পায়ে পায়ে নানান বেশে আছে সে। বাবু বলেন ঝড়, তুমি বলো দানো। কাজ তার দানের মতোই।

তবে সব সময় দানো বাগ মানে না। দু-একটি প্রাণ নিয়ে ফেরে সুযোগ পেলে। কেমন করে? না, শাবরীসুদ্ধ দুমড়ে দিতে চায় সে ঝাঁপ দিয়ে। ওই সময়ে ছাঁইয়ের বাইরে থাকলে, তাকে লোপাট করে নিয়ে যায়। নৌকাসুদ্ধ নোঙর ছিড়ে, টেনে নিয়ে যায় অকুলে। —

গুণ জানে না পাঁচু, জানলে আজ গুণ দিয়ে বশীভুত করত বিলাসকে। কিন্তু যদি পাপ করে ঘরে ফেরে ছোঁড়া। সে পাপের চেয়েও বড় ভয়, দামিনীর নাতনি ভেড়া করে রাখবে বিলাসকে। বড় যে দাপট মেয়ের। পুরুষ পোষে সে। বউঠান, ঘরে বসে তুমি খোকাঠাকুরের স্মরণ নাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *