৬ জেনারেল উদ্দিন মোহাম্মদ
বড়ো ভাঁড়টি বেশ নায়ক হয়ে উঠছে, দিন দিন ঘটছে তার নানা রঙের বিকাশ, এভাবে চালাতে পারলে, পারবে বলেই মনে হচ্ছে, সে মহানায়ক হয়ে উঠবে কোনো এক। ভোরবেলা। দশকে দশকে এখানে একেকটা উৎকট পরিহাস নায়ক হয়ে দেখা দেয়, এর আগেও একটিকে দেখেছে রাশেদ, তার আগেও দেখেছে একটিকে, তারও আগে। একটিকে দেখেছে, বেঁচে থাকলে পরেও একটিকে দেখবে, তার পরেও একটিকে দেখবে। প্রথম একটা খুব জরুরি কাজ সে করেছে, ঠিকঠাক করে নিয়েছে নিজের নামটা; মোহাম্মদ ছলিমউদ্দিন নাম মানায় না প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে, যে একটার পর একটা রাষ্ট্রপতি রাখতে পারে, যেগুলোর নাক ঘষতে পারে বুটের গোড়ালি দিয়ে, যে একটার পর একটা উপদেষ্টা রাখছে, যেগুলো করছে তার চাকরের কাজ, কোনোটিকে দিয়ে রাস্তা ঝাড় দেয়াচ্ছে কোনোটিকে দিয়ে মুজো ঘোয়াচ্ছে কোনোটিকে দিয়ে পা টেপাচ্ছে; নিজের নামটা ভেঙে পেছনের দিকটা আগে এনে, আর ছলিমের বানান আধুনিক রীতিতে সংস্কার করে সে হয়েছে জেনারেল উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম। ভাঁড়টার প্রতিভায় রাশেদ মজা পাচ্ছে যেমন পাচ্ছে অনেকে, রাশেদ ভাবছে ওকে একটা পিএইচডি বা পিউবিক হেয়ার ড্রেসার উপাধি দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, হয়তো এ সম্পর্কে কোনো উপাশ্বার্য চিন্তাভাবনাও করছেন। উপাশ্চার্য শব্দটি চমৎকার, জিন্ধুদের বেশ মানায়। পত্রিকায় তার নতুন নাম ছাপা হচ্ছে বড়ো বড়ো অক্ষরে, আরো বড়ো অক্ষরে ছাপা হতো যদি কম্পিউটারগুলো আরো বড়ো অক্ষর প্রসব করতে পারতো; টেলিভিশনের বালিকাগুলো ওই নাম চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে ফেলছে, আধ বছরের মধ্যে তারা আর ওই ঠোঁট দিয়ে প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনো কাজকামই করতে পারবে না। ক্ষমতায় এসেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকেরা নিজেদের একটা পদোন্নতি দেয়, তাতে দেশের ও জনগণের মর্যাদা বাড়ে; উদ্দিন। মোহাম্মদও নিজেকে দিয়েছে আরেকটি পদোন্নতি, আরেকটি তারা ঝুলিয়েছে উর্দিতে; বিশপঁচিশটি পদোন্নতি দিলেও কেউ আপত্তি করতো না, অতোগুলো পদোন্নতি দেয়ার সুযোগ নেই বলেই দেয় নি, আর একবারেই ফিল্ড মার্শাল হওয়া হাস্যকর হবে, তা সে নিজেও বুঝতে পারে। যত্নের সাথে সে গোঁফ ছাঁটছে, নতুন নাপিত রেখেছে গোঁফের। জন্যে, ক’টি রেখেছে সে-ই জানে; আগে গোঁফে এতো ঝিলিমিলি ছিলো না, এখন খুব ঝিলিক দিচ্ছে, টেলিভিশন তা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশ জুড়ে; মুখের এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে হাসার কৌশলও সে আয়ত্ত করছে। কখনো হাসছে প্রতিভাবানের মতো, কখনো মেধাবী ফার্স্ট বয়ের মতো, কখনো লাহোরি সিনেমার নায়কের মতো, শেষে বিধাতার মতো সে লৌহমানব হতে চায় না, হতে চায় সম্ভবত হৃৎকম্প; তার উপদেষ্টা-দাসেরা গবেষণা করে তাকে শিখিয়েছে লৌহমানবদের আর আবেদন নেই জনগণের কাছে, জনগণ। অনেক লৌহমানব দেখেছে, বাঙলা ভাষায় লৌহমানব কথাটি ভালোও শোনায় না, জংধরা লোহ লোহা মনে হয়। শ্রেষ্ঠ আবেদন এখন যৌনাবেদনের, ওই আবেদন ছাড়া এখন কিছু কাটে না, ভিখিরি ভাতের থালা দেখে সাড়া না দিতে পারে, পিপাসার্ত জল দেখে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু যৌনাবেদনে সাড়া দেবে না এমন হতে পারে না; তাই হতে হবে তাকে মদনমোহন, মোহনমানব, হৃদয়বল্লভ, যাকে দেখে কাঁপবে ভিখিরি থেকে যুবতী। তার উপদেষ্টারা তাকে শিখিয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালির দুটি রোগ বাঙলা। ভাষা ও কবিতা, সে যদি ও-দুটি দখল করতে পারে, তাহলে মধ্যবিত্তের মন সে সহজে দখল করতে পারবে। গুছিয়ে বাঙলা বলছে সে, যা দেশের নেতাগুলো কখনো পারে নি, পারবে বলেও মনে হয় না; কবিতাও লিখতে শুরু করেছে, তার কবিতা ছাপা হচ্ছে দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায়;-কবিতা মুদ্রণে সে সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। নানা উপলক্ষে সে কবিতা লিখে চলেছে, ঝড় হলে লিখছে ঝড়ের কবিতা, বন্যা হলে বন্যার, উমরা করতে গেলে উমরার কবিতা। এমন গুজবও রটছে যে তার কবিতাগুলো লিখে দেয়ার জন্যে সে পুষছে একদল দাসকবি, সংখ্যায় যারা নগণ্য নয়, যাদের সে বকশিশ দিচ্ছে নানা রকম। তার কবিতা সাড়া জাগিয়েছে, সমালোচকেরা সে-সব সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখছেন; এক ছান্দসিক তার কবিতার ছন্দোবিশ্লেষ করে দেখিয়েছেন ওই কবিতায় ছন্দের অভাবিত বিকাশ ঘটেছে, যা গত ষাট বছরে ঘটে নি। প্রবন্ধটির জন্যে ছান্দসিক বনানী গোরস্থানে বিনামূল্যে কবরের জমি পেয়েছেন।
একটি পুত্রও সে জন্ম দিয়েছে কয়েক মাসের মধ্যে, তার যন্ত্রটি শেষ পর্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। পুত্রটির জন্মদিনের ছবি পত্রিকাগুলো পাঁচস্তম্ভ জুড়ে ছেপেছে, তাতে যুবরাজকে চারপাঁচ মাসের মতো দেখাচ্ছে, একদিনের কিছুতেই মনে হচ্ছে না। এতে অস্বাভাবিক কী আছে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যদি জন্ম দেয়, তাহলে এমনই দেয়া উচিত; তবে লোকজন খুবই সন্দেহ করছে। জনগণের বিশ্বাস সে নপুংসক, আঁটকুড়ো, জন্ম দেয়ার শক্তি তার নেই, থাকলে অনেক আগেই জন্ম দিতো; এমন একটা জনশ্রুতিও রয়েছে যে তার স্ত্রীটির জরায়ু বিয়ের আগেই কেটে ফেলতে হয়েছিলো, যেহেতু তারা বিয়ের আগেই একটা দুর্ঘটনা বাধিয়েছিলো। সে অবশ্য দাবি করছে বাগদাদের এক পিরের দরগার গিলাফ জড়িয়ে কাজ করার ফলেই সে পিতা। হ’তে পেরেছে। গিলাফটি টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, গিলাফটি গলায় জড়িয়ে সে এক মহফিলে ভাষণও দিয়েছে; ভবিষ্যতে সে ওই গিলাফ জড়িয়ে আবার কাজ করবে কিনা, তা জানায় নি; বাগদাদের পিরের দরগা থেকে যে-পাণ্ডা গিলাফ এনে দিয়েছে, যে দেখতে দোজখের প্রহরীর মতো, তাকে সে উপদেষ্টা রেখেছে। কেউ খলনায়ক মনে। করছে না তাকে, নায়কই মনে করছে; কয়েক বছর আগে তার সানগ্লাসপরা পূর্বসূরীটি খুন হয়ে যাওয়ার পর জনগণ একটা নায়কের অভাবে খুব শূন্য শূন্য বোধ করাছিলো, মনে মজা পাচ্ছিলো না, সিনেমার হোদলগুলোও জনগণকে যথেষ্ট পরিতৃপ্ত করতে পারছিলো, এ-ভড় তাদের সে-অভাব মিটিয়েছে; যেখানেই যাচ্ছে, যাচ্ছে সে সবখানেই, তাকে দেখার জন্যে পোকার মতো ভিড় হচ্ছে মানুষের, সে পোকাঁদের জড়িয়ে ধরছে, পোকারা ধন্য হচ্ছে, সে জয় করে ফেলেছে পোকাঁদের মন। শুধু পোকাঁদের মন নয়, এমন চাঞ্চল্যকর সংবাদও ছড়িয়ে পড়ছে যে সে দেহও জয় করে ফেলেছে কয়েকটি নারীর, যাদের মধ্যে কুমারী, সধবা ও বিধবা সব স্বাদের নারীই রয়েছে; তবে সে যে সধবাদের শরীরই বিশেষ পছন্দ করে, তাও রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে। পুরুষগুলো বাঙলায় অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হতে হতে সেগুলোর আর কিছু বাকি নেই; নারীগুলোকেও নষ্ট করা দরকার, ভাঁড়টি সে-কাজ শুরু করেছে, নারীরাও আনন্দের। সাথেই নষ্ট হচ্ছে। তারা এতোদিন নষ্ট হওয়ার মতো সুযোগ পাচ্ছিলো না। একটা। কালোবাজারিকে সে এসেই ধরেছে, বা লোকটিকে ধরবে বলেই তাকে কালোবাজারি নাম দিয়েছে, তার দোষ তার একটা রূপসী স্ত্রী রয়েছে। রূপসী স্ত্রীটি স্বামীকে ছাড়াতে গিয়ে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিমের সাথে দেখা করেছে, দেখা করতে করতে সালিমের। সাথে ঘুমোতে শুরু করেছে, ঘুমোতে ঘুমোতে স্বামীর কথা ভুলে গেছে; সে আর ছাড়া পাবে না। একটা আমলাকে সালিম তিনটি পদোন্নতি দিয়েছে যেহেতু তার একটা উপভোগ্য স্ত্রী রয়েছে; সালিম মাঝেমাঝে তার স্ত্রীকে নিয়ে শয্যাকক্ষে রাত্রি যাপন করছে, আমলাটি পরিচারিকাকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে বাইরের ঘরে। এক অনুষ্ঠানে লিলির দেখা হয়েছে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিমের সাথে,-লিলি এখন টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান। উপস্থাপন করছে, যে-অনুষ্ঠানের আগে একবার আজান বাজে, মাঝে সংবাদের নামে ওই দিন সালিম কী কী মহৎ কাজ করেছে, তা দেখানো হয়, শেষ হওয়ার আগে আরেকবার আজান বাজে, তাই কেউ তার অনুষ্ঠান দেখে না, তবু লিলি ঘন ঘন শাড়ি বদলিয়ে হিতোপদেশ দেয় জনগণকে; উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম লিলিকে বলেছে লিলির অনুষ্ঠান। দেখে সে মুগ্ধ, লিলির অনুষ্ঠান সে মিস করে না, নামাজ পড়ার আগে তার অনুষ্ঠান। দেখে। লিলি সালিমকে আরো মুগ্ধ করার জন্যে ওই সন্ধ্যায়ই প্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো, কিন্তু সালিম তাকে আর কোনো সংকেত দেয় নি বলে কয়েক রাত ধরে লিলি ঘুমোতে পারছে না, ঘুমোনোর জন্যে সে নিজেকে নিজেই তৃপ্ত করে চলছে। লিলি রাশেদকে বলেছে, উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম মারাত্মক সুপুরুষ, টেলিভিশনে ঠিক বোঝা যায় না, কাছে গেলে বোঝা যায়। লিলি আরো একটু কাছে যেতে চেয়েছিলো, যেতে পারে নি; তবে সালিম যে সুপুরুষ সে-কথা বলার সময় লিলি থরথর করে পুলক বোধ। করছিলো। নিজে জিপ চালিয়ে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম শহর ভরে ঘুরছে, জিপ থামিয়ে চৌরাস্তায় বুক মেলাচ্ছে জনগণের সাথে, পোকারা পাগল হয়ে তার হাত ছুঁচ্ছে, তার সামনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। জনগণকে সে খুলাফায়ে রাশেদিনের কালের স্বাদ দিচ্ছে। সপ্তাহে দু-তিন দিন; জিপ চালিয়ে সরাসরি গিয়ে ঢুকেছে কোনো রিকশাঅলার বাড়িতে, তার কিডনি-নষ্ট শিশুটিকে এনে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে হাসপাতালে, টেলিভিশন সে-দৃশ্য দেখাচ্ছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে; হেলিকপ্টারে করে গ্রাম থেকে নিয়ে আসছে কোনো অন্ধ। বালিকাকে, হাসপাতালে ভর্তি করে দিচ্ছে, তার অপারেশন হচ্ছে, চোখ মেলে সে প্রথম দেখছে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিমের মুখ, সালিম তাকে জড়িয়ে ধরছে, টেলিভিশন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে ওই দৃশ্য। জনগণ কাতর হয়ে উঠছে, তাদের চোখে জল টলমল করছে। সাইকেল চালিয়ে সে অফিসে যাচ্ছে, মুগ্ধ হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। পোকারা, টেলিভিশনে ওই সব অভিনব দৃশ্য দেখছে সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। পত্রিকাগুলো তার সামনের পেছনের ডানের বায়ের ছবি ছাপছে, প্রথম পাতায়, পাঁচ। কলাম জুড়ে; বৃহস্পতি, শুক্র, শনিবারের গুজব পত্রিকাগুলোর প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে ছাপা হচ্ছে সে। বাঙলাদেশে নতুন নায়কের আবির্ভাব ঘটেছে।
সালিম শীততাপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে, পাজেরোতে, হেলিকপ্টারে ছুটে চলছে দেশের দিকে দিকে। সে বিশেষ করে যাচ্ছে মসজিদগুলোতে। তার এক পূর্বসূরী বাঙালি। মুসলমানকে আবার মুসলমান করে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলো, খুন হয়ে যাওয়ায় ওই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে যেতে পারে নি, উদ্দিন মোহাম্মদ সে-ভার তুলে নিয়েছে; সে একেক। শুক্রবার হানা দিচ্ছে একেক মসজিদে। মসজিদগুলোতে লোকজন উপচে পড়ছে, দেশ জুড়ে নতুন নতুন মসজিদ উঠছে, হেলে-পড়া টিনের মসজিদগুলো হঠাৎ লাল ইটের। মসজিদ হয়ে উঠছে; শুধু গরিবের নয়, টয়োটা পাজেরো ভরে শিল্পপতিরা, আমলারা, চোরাকারবারিরা আসছে মসজিদে। উদ্দিন মোহাম্মদ আগে থেকেই ঠিক করে সে কোন শুক্রবার যাবে কোন সমজিদে, তার গোয়েন্দারা সাত দিন আগে থেকে ঘিরে ফেলে মসজিদটি, চারপাশের ছাদের ওপর উঠে পাহারা দিতে থাকে; কিন্তু শুক্রবারে সে। এমনভাবে গিয়ে উপস্থিত হয় যেনো সে হঠাৎ এসেছে। নামাজের পর সে বক্তৃতা দেয়, তার দামি সিল্কের পাঞ্জাবি আর টুপি ঝলঝল করতে থাকে টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে, বক্তৃতা দেয়ার সময় সে পুণ্যবানের মতো গলে পড়তে থাকে, সে আল্লা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। বক্তৃতার শুরুতেই সে বলে গতরাতে সে স্বপ্ন দেখেছে এক আওলিয়া দরবেশ তাকে বলেছেন তুমি এই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ো। তাই সে ছুটে এসেছে এই মসজিদে। কেঁদে কেঁদে সে জানায় এই মসজিদে নামাজ পড়ে তার বুক শান্তিতে ভরে গেছে, সে কিছু চায় না, ক্ষমতা চায় না, চায় মুসলমান আর ইসলামের ভালো। সে শুধু একটু খাঁটি মুসলমান হতে চায়। আরেক শুক্রবার সে যায় আরেক মসজিদে, সাতদিন আগে থেকে যেটিকে ঘিরে ফেলে তার গোয়েন্দারা। নামাজের পর সে বক্তৃতায় বলে যে দশ বছর আগে সে স্বপ্ন দেখেছে এই সমজিদটিতে সে নামাজ পড়ছে, এতোদিনে তার মনের বাসনা পূর্ণ হলো; দশ বছর ধরে সে মনে মনে এই মসজিদটিতে নামাজ পড়ছে, আজ এখানে নামাজ পড়তে পেরে তার বুক শান্তিতে ভরে গেছে। সে কিছু চায় না, ক্ষমতা চায় না, চায় মুসলমান আর ইসলামের ভালো। সে শুধু একটু খাঁটি মুসলমান হতে চায়। টেলিভিশন তার আকুল বক্তৃতা প্রচার করছে দিনের পর দিন।
উদ্দিন মোহাম্মদ সেনাবাহিনীতে না গিয়ে যদি বায়োস্কোপে ঢুকতো, যদি নিজের নাম রাখতো সালিমকুমার বা ডালিমকুমার, তাহলে আরো সফল হতে পারতো। নামাজকেও সে অভিনয়ে পরিণত করেছে, সে ক্যামেরার মুখোমুখিই নামাজ পড়তে পছন্দ করে, কোনো পির হয়তো তাকে শিখিয়েছে যে ক্যামেরার মুখোমুখি নামাজ পড়লে আশিগুণ সোয়াব কামেল হয়। মসজিদে নামাজের অভিনয়ের পর সে। হেলিকপ্টারে উড়ে যায় পিরের দরগায়। সময়টা হয়ে উঠেছে পিরদের দশক, দেশ ভণ্ডপিরে ছেয়ে যাচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় পিরদের দরগা উঠছে, খুনি আসামী ডাকাতরা পির হয়ে ব্যবসা খুলে বসছে, খুব লাভ হচ্ছে, কালোবাজারিতেও এতোটা লাভ হয় না। অনেক পির অবশ্য পিরব্যবসায়েই সন্তুষ্ট থাকছে না, কালোবাজারিও করছে, শিল্পপতিও হচ্ছে। উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম পিরদের বড়ো ভক্ত, সে উড়ে যাচ্ছে ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল পিরদের বাড়িতে। এক টাকা মূল্যে পিরদের লিখে দিচ্ছে শহরের বিঘে বিঘে জমি, পিররা তাকে দোয়া করছে, আর লাখে লাখে বাড়ছে পিরদের ভক্ত। প্রতিটি অফিসের বড়ো, মাঝারি, ছোটোকর্তারা পিরের মুরিদ, পিরের নাম না নিয়ে তারা কথা বলে না, এবং কথা বলতে বলতে পিরের নাম বলে। ঢাকা শহরের কোণে কোণে পিরের দরগা উঠছে; অফিসের কর্তাদের কেউ পুবকোণের মুরিদ, কেউ পশ্চিমকোণের মুরিদ, কেউ দক্ষিণ কোণের মুরিদ, কেউ উত্তর কোণের মুরিদ। উদ্দিন মোহাম্মদ যে-পিরের দরগায়ই একবার যাচ্ছে, সে-পিরেরই ব্যবসা জমে হয়ে উঠছে, সেনাপতিরা জিপ নিয়ে ভিড় করছে, আমলারা তার আস্তানা টয়োটায় ভরে ফেলছে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাশ্চার্যরা, দারোগা পুলিশ কেরানিরা তার দরগায় গিয়ে লুটিয়ে পড়ে পিরের পায়ের ধুলো চাটছে। সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করছে ফরিদপুরের পিরটা, উদ্দিন। মোহাম্মদ তার দরগায় প্রত্যেক শুক্রবারেই যায়, টেলিভিশনে তার আস্তানা দেখানো হয় প্রতি শুক্রবার। ওই পির ঠিক করে দিচ্ছে কে কোন পদ পাবে, পদোন্নতিগুলো স্থির হচ্ছে তারই আস্তানায়, তাই তার আস্তানার দিকে গাড়ি ছুটে চলছে দিনরাত। উদ্দিন মোহাম্মদ বুর্জোয়াগুলোর কোমর আর মেরুদণ্ড এমনভাবে ভেঙে দিচ্ছে যে তারা আর মাথা তুলতে পারছে না, পা দেখলেই তারা মাথা ঠেকাচ্ছে, মাথা তুলতে পারছে না; ওগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছিলো, কেউ কেউ প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলো, আমলা প্রকৌশলী চিকিৎসক আরো অনেক কিছু হয়েছিলো, বিলেত আমেরিকা গিয়েছিলো, স্যুটটাই পরেছিলো এবং এখনো পরছে, বড়ো বড়ো পদও দখল করেছিলো, এখনো। দখল করে আছে, আরো বড়ো পদ দখল করতে চায়, উদ্দিন মোহাম্মদ দেখিয়ে দিয়েছে ওগুলো ভেতরে ভেতরে নিরক্ষরই রয়ে গেছে, একটুও বুর্জোয়া হয় নি, অশিক্ষিত পিরের পায়ে ওগুলো চাষী আর মুদির থেকেও বেশি ভক্তিতে মাথা ঠেকাচ্ছে। পিরগুলোও বেশ ঝানু, ওদের বেশ শিক্ষা দিচ্ছে। উত্তরকোণের পিরটার মুরিদ হতে হলে তার থুতু খেতে হয় একগ্লাশ। পিরটা তার গদিতে বসে বাণী দিতে থাকে, যার সবটাই ছাইপাঁশ, তার পাশেই থাকে পানিভরা একটা বড়ো গামলা, ওই গামলায় সে অনবরত ফেলতে থাকে থুতু ও কফ, তার পানের পিকের লাল ও থুতুকফের শাদাটে রঙ মিলে গামলার পানি। ঘিনঘিনে থিকথিকে হয়ে ওঠে। যারা তার মুরিদ হতে চায় প্রথমে তাদের খেতে হয় ওই গামলার একগ্লাশ পানি। স্যুটটাইপরা মুরিদরা সারি বেঁধে ওই পানি খেয়ে মুরিদ হচ্ছে; তাদের চোখেমুখে কোনো ঘেন্নার ভাব নেই, ভক্তিতে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। পুবকোণের পিরটা তার পা দুটি ভিজিয়ে রাখে একটি গামলায়, মাঝেমাঝে উঠে গিয়ে খালি পায়ে সে ঘুরে আসে বাইরের নোংরা পায়খানা থেকে, গোয়ালে গিয়ে পা দিয়ে গোবর পরিস্কার করে আসে, আবার পা ভিজিয়ে রাখে গামলায়। তার মুরিদ হতে হলে প্রথমে খেতে হয় ওই গামলার একগ্লাশ পানি। স্যুটটাইপরা আমলারা। ব্যবস্থাপকেরা ওই পানি প্রাণভরে খাচ্ছে, তার মুরিদ হচ্ছে, পিরের পা দুটি তারা গামছা তোয়ালে দিয়ে মুছতে দিচ্ছে না, পিরের পা চেটে চেটে, তারা মুছে ফেলছে। রাশেদ। যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই দু-চারটি পিরের মুরিদ পাচ্ছে, পিরের বাড়ি আর মসজিদ ছাড়া যারা আর কোথাও যাচ্ছে না বছরখানেক ধরে।
উদ্দিন মোহাম্মদ আর শুধু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নয়, সে এখন রাষ্ট্রপতি, অবসরপ্রাপ্ত যে-বিচারপতিটিকে সে রাষ্ট্রপতি রেখেছিলো, যেটা প্রাণপণে তার জুতো। পরিষ্কার করছিলো, আরো অনেক দিন করার স্বপ্ন দেখছিলো, সেটিকে সে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, সেটা স্বপ্নভঙ্গের দুঃখে রাতের পর রাত আত্মহত্যার কথা ভেবেছে, আত্মহত্যা করতে গিয়ে ভয় পেয়ে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা গেছে। উদ্দিন মোহাম্মদ সেটাকে জাতীয় কবরস্থানে কবর দিয়েছে, বাঙলার মাটি তার আরেক মহৎ সন্তানকে নিজের বুকের মধ্যে পেয়ে সুখী হয়েছে। উদ্দিন মোহাম্মদ সব কিছু গুছিয়ে আনছে; মসজিদ, পির, আর পোকাঁদের গুছিয়ে এনেছে, কিন্তু তাদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারছে না, সে জানে ওগুলো কাজ দেবে, তবে বেশি কাজ দেবে না; টিকে থাকতে হলে শক্ত রাখতে হবে তার ভিত্তিটাকে, যা তার শক্তির উৎস, অনেক জেনারেল তৈরি করতে হবে, তাদের তৃপ্ত রাখতে হবে, তাদের সব কিছু দিতে হবে, এবং তাদের সব কিছু দিচ্ছেও, কিন্তু তাতেই চলবে না; সে টিকে থাকতে চায়, দেড়-দু-দশক ভোগ করতে চায়। দেশটাকে, তার জন্যে কাজে লাগাতে হবে সেই শাশ্বত শয়তানগুলোকে, যেগুলো রাজনীতির নামে দালালি করে, যেগুলো নেতা নামে পরিচিত। উদ্দিন মোহাম্মদ শুরু। থেকেই সেগুলোকে তার বুটের ভেতরে আনার চেষ্টা করে আসছে, অনেকগুলোই তার বুটের ভেতরে এসে গেছে; তার আরো শয়তান দরকার, আরো শয়তান দরকার, আরো শয়তান দরকার, বাঙলাদেশের সমস্ত শয়তান তার দরকার। সুখের কথা বাঙলাদেশ অঢেল শয়তান জন্ম দিয়েছে, সে জানে শয়তান সে পাবে দলে দলে। দেশ দখল করার পরই সে কয়েকটি শয়তানকে ধরেছিলো,–এসেই শয়তান ধরা সামরিক রীতি, তাদের মধ্যে বড়ো শয়তানগুলোকে সে ছেড়ে দিয়েছে, সেগুলো উদ্দিন মোহাম্মদের বন্দনা। গাইছে দেশ জুড়ে, যেমন তারা গাইতো আগের প্রভুদের বন্দনা। তারা সভা করছে, সভায় বলে বেড়াচ্ছে উদ্দিন মোহাম্মদ দেশকে উদ্ধার করেছে, মহামান্য উদ্দিন মোহাম্মদ এলে এতোদিনে দেশ ধ্বংস হয়ে যেত, দেশের জন্যে উদ্দিন মোহাম্মদকে আরো বহু বছর দরকার। তারা উদ্দিন মোহাম্মদের নামের আগেপাছে লাগাচ্ছে বিশেষণের পর। বিশেষণ, তাকে মহামানব আখ্যা দিচ্ছে, বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসে এমন মহামানব আর দেখা যায় নি বলে চিৎকার করে চলছে, মহামান্য না বলে তার নাম উচ্চারণ করছে না। ভিড় বাড়ছে উদ্দিন মোহাম্মদের সচিবালয়ে, শয়তানরা তাকে ঘিরে ফেলছে; সে আরো দালাল চায়, আরো শয়তান চায়, সে যতো শয়তান চাইছে দালাল চাইছে ভিড় হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। তার পূর্বসূরীটি, যে খুন হয়ে গেছে, যার খুনের সাথে উদ্দিন মোহাম্মদ জড়িত ছিলো, হয়তো সে-ই ছিলো প্রধান পরিকল্পনাকারী, সে একটি রাজনীতিক দল তৈরি করেছিলো, গণতন্ত্রবাদী নাম রেখেছিলো, যা সে ভরে ফেলেছিলো অবসরপ্রাপ্ত সেনাপতিতে, এবং দলে সে জড়ো করেছিলো কুখ্যাত রাজাকারদের, ও নকল সমাজতন্ত্রীদের। সে রাজনীতিবিদদের জন্যে রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিলো, আর সহজ করে তুলেছিলো সুবিধাবাদীদের জন্যে। উদ্দিন মোহাম্মদ আসে ওই গণতন্ত্রবাদীদের উত্থাত ক’রে, ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে প্রথম নষ্ট। করতে হবে ওই দলটিকেই।
গণতন্ত্রবাদীদের নষ্ট করছে উদ্দিন মোহাম্মদ, বা ওই দলের নষ্টরাই বেশি ব্যগ্র হয়ে পড়েছে আরো নষ্ট হওয়ার জন্যে, তারাই দলে দলে ঢুকে পড়ছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে। একপাল অবসরপ্রাপ্ত রয়েছে ওই দলে, রাজনীতিতে ঢোকার কথা ছিলো না তাদের, উদ্দিন মোহাম্মদের পূর্বসূরীটি তাদের নিয়ে এসে মন্ত্রী করেছিলো, সে। রাজনীতি কঠিন করে তুলতে চেয়েছিলো রাজনীতিকদের জন্যে, তারা আবার মন্ত্রী হতে চায়, মন্ত্রী হওয়া সুখকর; গাধা হলেও তারা বুঝতে পারছে গণতন্ত্রবাদী থেকে। আর মন্ত্রী, এমনকি বাহরাইন বা কাতারে রাষ্ট্রদূতও হওয়া যাবে না। গণতন্ত্রবাদীতে আর থাকা চলে না, থাকতে হবে উদ্দিন মোহাম্মদে, এবং তারা উদ্দিন মোহাম্মদের হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার একটি অবঃ উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে ঢুকলে শনিবার ঢুকছে। তিনটা অবঃ। গণতন্ত্রবাদীদের জনক একপাল ব্যারিষ্টার বা ছাগল ঢুকিয়েছিলো নিজের গোয়ালে ছাগল সব কিছু খায় জেনে; ছাগলরা বুঝতে পারছে গণতন্ত্রবাদী থেকে আর। ঘাস মিলবে না কাঁঠালপাতা মিলবে না,-তারা পালে পালে উদ্দিন মোহাম্মদের গোয়ালে ঢুকছে। নকল সমাজতন্ত্রীতে দেশ ভরে উঠেছিলো, রাশিয়া আর চিনের কাছ থেকে যা পাচ্ছিলো তাতে পেট ভরছিলো না তাদের, বুঝতে পারছিলো জীবনে তারা কিছুই পাবে না, তাই দলে দলে যোগ দিয়েছিলো গণতন্ত্রবাদীতে। ঢুকে বুঝতে পেরেছিলো। শ্রেণীসংগ্রামের থেকে শোষণ অনেক সুখকর, ক্ষমতা অত্যন্ত মনোহর; গণতন্ত্রবাদী থেকে আর ক্ষমতা সম্ভব নয় শোষণ সম্ভব নয়, তাই তারা দলে দলে এখন উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে ঢুকছে। বড়ো শয়তানগুলো তো ঢুকবেই, ছোঁকরাগুলোও ঝানু শয়তান। হয়ে উঠেছে, তারাও যাচ্ছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে। রাশেদ একটা ছোঁকরাকে স্নেহ করতো, চমৎকার ছোঁকরা, বিদ্যালয়ের বারান্দা সে শ্লোগানে মাতিয়ে রাখতো, মূর্তির নিচে দাঁড়িয়ে মার্ক্স মার্ক্স লেনিন করে শ্রোতাদের ক্ষেপিয়ে তুলতো, সেটাও। উদ্দিন মোহাম্মদের বুটে ঢুকে গেছে। ছোঁকরাকে রাশেদ চিনতো না, চেনে এক ভয়ঙ্কর ঘটনার মধ্য দিয়ে। রাশেদ বিদ্যালয়ের চা খাওয়ার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলো, এমন সময় পাঁচ ছটি ছোঁকরা দৌড়ে আশ্রয় নিতে আসে সেখানে, তাদের তাড়া করে আসে আরো দশবারোটা, ছোঁকরাটা রাশেদের চেয়ারের নিচেই আশ্রয় খুঁজছিলো। তিন চারটি। হকিস্টিক এসে পিটিয়ে তার মাথা ভেঙে দেয়, সে পড়ে থাকে রাশেদের চেয়ারের পাশে, রক্তে মেঝে কালো হয়ে ওঠে। রাশেদ চিনতো না ছোঁকরাকে, ছোঁকরাকে টেনে তোলার মতো কেউ ছিলো না তখন চারপাশে। রাশেদ তাকে টেনে তোলে, মাথার রক্ত মুছে দেয়, ধরাধরি করে হাসপাতালে পাঠায়। ছোঁকরা এখন উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের। ভেতরে। গণতন্ত্রবাদীতে ঢুকেছিলো দলে দলে রাজাকার, তারা রাজার সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করে, তাই এখন তারা উদ্দিন মোহাম্মদের পায়ে। আওয়ামির অবস্থা খারাপ বহু বছর ধরেই স্বাধীনতার পর তারা খুব স্বাধীনতা পেয়েছিলো, বাঙালির হাজার বছরের পরাধীনতার ক্ষতি তারা পূরণ নিতে চেয়েছিলো দু-এক বছরেই, সাড়ে তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার বছরের স্বাধীনতা ভোগ করার পর দেখতে পায় তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমান অন্ধকার, ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকার। আওয়ামি থেকে একদল ঢোকে গণতন্ত্রবাদীতে, তারা এক সময় বাঙালিতে বিশ্বাস করতো, গণতন্ত্রবাদীতে ঢুকে বাঙলাদেশিতে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তারা গণতন্ত্রবাদী ছেড়ে ঢোকে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটে, এবং এতোদিন যারা মাটি কামড়ে পড়ে ছিলো আওয়ামিতে, গণতন্ত্রবাদীতে ঢুকতে লজ্জা পাচ্ছিলো, তাদের অনেকে আর নীরস মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চায় না, তাদের লজ্জাও কেটে গেছে, তারা ঢোকে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে। উদ্দিন মোহাম্মদের বুটই বাঙলাদেশ।
উদ্দিন মোহাম্মদের স্ত্রীটিকে দেখলে ছেলেবেলার ডাইনিদের মনে পড়ে, মনে হয়। রূপকথায় যে-ডাইনিদের কথা শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেছি, কিন্তু চোখের সামনে যাদের কখনো দেখি নি, তাদের প্রধানটিকে দেখছি। সেও বেরিয়ে পড়েছে। রাশেদ প্রথম তাকে দেখতে পায় শুক্রবারের একটি গুজবকাগজের প্রচ্ছদে, দেখেই ডাইনি দেখার ভয়ে তার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চায়। সেও, উদ্দিন মোহাম্মদের মতো, ভর করছে দেশের ওপর, দেশটা যেমন উদ্দিন মোহাম্মদের দেশটা তারও; সেও দিকে দিকে যাচ্ছে, উদ্দিন। মোহাম্মদের মতো তাকেও তিন ঘণ্টা ধরে দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে, নতুন নতুন জামদানি পরে সে সকাল দুপুর সন্ধ্যায় ফিতে কাটছে, তার জন্যে একটা জামদানির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে, সে ভিত্তিপ্রস্তর বসাচ্ছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, তার ডাইনিস্বরে কান ছিঁড়েফেড়ে যাচ্ছে শ্রোতাদের, তবে তার পেছনেও পোকার অভাব হচ্ছে না, . মেয়েমানুষ তাকে ঘিরে ফেলছে পুরুষমানুষ তাকে ঘিরে ফেলছে। সে দেশের প্রথম। মহিলা, এমন মহিয়সী আগে দেখা যায় নি; পত্রিকায় উদ্দিন মোহাম্মদের সমান জায়গা জুড়ে থাকছে সে, অনেক সময় বেশি জায়গাই জুড়ছে, তিনস্তম্ভের নিচে তার ছবি ছাপা হচ্ছে না, কোনোদিন ছাপা হলে পরের দিন চারস্তম্ভে ছাপতে বাধ্য হচ্ছে পত্রিকাগুলো। আমলারা তাকে আম্মা বলছে, তার পা ছুঁয়ে দোয়া চাইছে, তার দোয়ায় পদোন্নতি পাচ্ছে। দেশের কল্যাণের জন্যে সে অতিবাহিত করছে ব্যস্ত সময়; সে নারীদের কল্যাণ দেখছে, শিশুদের কল্যাণ দেখছে, গরিবদের কল্যাণ দেখছে, মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে। আন্দোলন করছে, পত্রিকার প্রথম পাতা ও টেলিভিশন জুড়ে থাকছে। যা কিছু বাইরের, তাই দেখাচ্ছে আর ছাপছে টেলিভিশন আর পত্রিকাগুলো, ভেতরের কিছু তারা দেখাচ্ছে না ছাপছে না, কিন্তু ভেতরের সত্যও বেরিয়ে পড়ছে। কোনো কিছুই চাপা থাকছে না, সবাই জেনে ফেলছে যে উদ্দিন মোহাম্মদ কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছে, বিদেশে পাচার করছে, তাকে টাকা না দিয়ে দেশে কোনো কাজ হচ্ছে না, একটা রাস্তাও খোঁড়া হচ্ছে না; আর সে নারী ভোগ করছে, তার এক নারীকে সে রাখছে শহরের উত্তরে, আরেকটিকে পুবে, আরেকটিকে দক্ষিণে, কোনোটিকে রাখছে বিদেশে। উদ্দিন মোহাম্মদের স্ত্রীটিও তাই করছে, সেও টাকা বানাচ্ছে, তাকেও টাকা না দিয়ে বহু কাজ হচ্ছে না। আর সে যুবক পছন্দ করে, সে যুবক উপভোগ করছে, কয়েকটি যুবক তার সেবা করছে, বারবার সে যুবক বদল করছে। কয়েকটি যুবক তার সেবা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে নাকি একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে উদ্দিন মোহাম্মদের বিরুদ্ধে, তার অভ্যুত্থানের কাহিনীটি খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। উদ্দিন মোহাম্মদ একদিন যখন জরিনা নামের এক উপস্ত্রীর সাথে লিপ্ত ছিলো, তখন সে সচিবালয়ে গিয়ে উদ্দিন মোহাম্মদকে নগ্ন অবস্থায় হাতেনাতে ধরে ফেলে, উদ্দিন মোহাম্মদের দিকে সে একটা ছাইদানি ছুঁড়ে মারে। উদ্দিন মোহাম্মদের নাকটি তাতে ভেঙে যায়, ফলে কয়েক দিনের জন্যে উদ্দিন মোহাম্মদ টেলিভিশনে নিজেকে দেখানো থেকে বিরত থাকে; ওই সময় তার স্ত্রীটি টেলিভিশনে প্রথম মহিলারূপে আবির্ভূত হয়। উদ্দিন মোহাম্মদ তার সাথে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়, তাকে নিজের ক্ষমতার এক অংশ আর যুবকসংসর্গের। অধিকার দেয়।
দুটি পার্টিতে যাওয়ার ভাগ্য হয়েছে রাশেদের এর মাঝে; একই লোকের পার্টি, লোকটি ঘন ঘন পার্টি দিচ্ছে, মারাত্মক প্রগতিশীল বলে সে বিখ্যাত, রাশেদ গিয়ে দেখে বাড়িটা একটা ছোটোখাটো বাঙলাদেশ। সেখানে সব আছে, সিনেমার ৭টা অভিনেত্রী আছে, ১ পাল আমলা আছে, ৫টা অবসরপ্রাপ্ত আছে, ২টি নেত্রী আছে, তাদের ঘিরে আছে তাদের গোটাদশেক গণতান্ত্রিক প্রহরী, এমনভাবে ঘিরে আছে নেত্রীদের যেনো তারা গণতন্ত্রের দেবীদের ঘিরে আছে, আছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরের অধিবাসীরা। উত্তর দিকে এক নেত্রী, তাকে ঘিরে তার প্রহরীরা; দক্ষিণ দিকে আরেক নেত্রী, তাকে ঘিরে তার প্রহরীরা; সবচেয়ে উজ্জ্বল পশ্চিম দিকটা, যেখানে উদ্দিন। মোহাম্মদের মন্ত্রীরা পান করছে, অন্যরা তাদের পান করার দৃশ্য দেখে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে, শুধু স্যার, স্যার শোনা যাচ্ছে। ঝকঝক করছে উদ্দিন মোহাম্মদের মন্ত্রীরা। রাশেদ একপাশে বসে পান করছিলো ১টি কবি, ২টি ঔপন্যাসিক, ৩টি সাংবাদিক-প্রাবন্ধিকের সাথে, খুব বিখ্যাত তারা, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের জন্যে যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছে। দেশে গণতন্ত্র নেই বলে তারা তৃপ্তির সাথে পান করতে পারছিলো না, চুমুকে চুমুকে গণতন্ত্র গণতন্ত্র শব্দ করছিলো, একজনের গণতন্ত্রের হিক্কা ওঠার ক্রম হচ্ছিলো; এমন সময় উদ্দিন মোহাম্মদের একটা মন্ত্রীকে নিয়ে পার্টিদাতা তাদের দিকে এগিয়ে আসে, সে তাদের মন্ত্রীটির সাথে পরিচয় করিয়ে ধন্য করতে চায়। রাশেদ দেখে একটা পাড়ার। মাস্তান, কয়েক দিন আগেও যে প্রকাশ্যে ছিনতাই করতো, যার নাম সে কিছুতেই মনে করতে পারছিলো না। ওই মাস্তানটা, যে উদ্দিন মোহাম্মদের মন্ত্রী, তাদের দিকে এগিয়ে আসতেই বিনয়ে গলে দাঁড়িয়ে পড়ে কবি আর ঔপন্যাসিক আর সাংবাদিক প্রাবন্ধিকগুলো, একের পর এক হাত বাড়াতে থাকে, পারলে চার-পাঁচটি করে হাত বাড়িয়ে দিতো তারা, নিজ নিজ নাম বলতে থাকে অষ্টম শ্রেণীর বালকদের মতে, দুজন উত্তেজনায় নিজেদের নাম বলতেও ভুল করে। মাস্তানটি মহাপুরুষের মতো মৃদু হাসে। রাশেদ বসেই ছিলো, ওই মাস্তানের দিকে হাত বাড়ানোর আর নিজের নাম বলার কোনো ইচ্ছে তার নেই। মাস্তানটি মহাপুরুষের মতো তারও দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, আশা করতে থাকে রাশেদ দাঁড়াবে; রাশেদ বসেই থাকে, তার হাতের দিকে অন্যরা। তাকিয়ে আছে বলে এক সময় ব’সেই হাত বাড়ায়, এবং জিজ্ঞেস করে, এর কী নাম? পার্টিদাতা ও কবি ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিকগুলো বিচলিত হয়ে পড়ে, তারা চিৎকার করে। বলতে থাকে, উনি মাননীয় মন্ত্রী, উনি মাননীয় মন্ত্রী, উনি মাননীয় মন্ত্রী, এবং কী একটা নামও বলে। মাস্তানটি তখনো রাশেদের হাত ধরে রেখেছে, রাশেদ তাকে জিজ্ঞেস। করে, বুটের ভেতর থাকতে কেমন লাগে? মাস্তানটা কেঁপে ওঠে, একবার হোঁচট খায়, এবং রাশেদের হাত ছেড়ে অভিনেত্রীদের দিকে এগিয়ে যায়।
রাশেদ ভেবেছিলো একটি নেত্রীর সাথে কথা বলবে, কী গণতন্ত্র সে একদিন আনবে সে-সম্পর্কে একটু জানবে, বাসায় গিয়ে একটু গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখবে, গণতন্ত্রের গালে একটু গাল ঘষবে; কিন্তু তাকে ঘিরে চক্রটা বেশ শক্ত, সেটা ভেঙে তার দিকে যাওয়া অসম্ভব। গণতন্ত্রের চক্রও বেশ শক্ত বঙ্গে। রাশেদ দূর থেকে বলে, আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই। পাঁচটা প্রহরী রাশেদকে ঘিরে ধরে, পারলে তারা রাশেদের মুখ চেপে ধরতো; তাদের নেত্রীর সাথে এভাবে কথা বলতে নেই, খুব বিনয়ে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে তার সাথে কথা বলতে হয়। রাশেদ ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবে না। রাশেদ গণতন্ত্রের মুখের দিকে তাকাতে চেষ্টা করে, প্রহরীদের ভিড়ে সে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের মুখ দেখতে পায় না, হয়তো গণতন্ত্রের মুখ নেই শুধু পা আচে। হাঁ হাঁ করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে রাশেদের, কিন্তু সে হাসে না, তাকে মাতাল ভাবতে পারে সবাই, পার্টিতে প্রত্যেকে অন্যকে মাতাল ভাবে, বা ভাবতে পারে সে। গণতন্ত্রের অনুপযুক্ত, ভবিষ্যতে দেশ ভরে যে-গণতন্ত্র আসবে রাশেদ তার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে না। রাশেদকে প্রস্তুত হতে হবে গণতন্ত্রের জন্যে, এখন থেকেই শুধু পায়ের দিকে তাকানোর অভ্যাস করতে হবে। কয়েক মাস পর আরেক পার্টিতে রাশেদ ওই নেত্রীকে দেখতে পায়, কিন্তু তখনো রাশেদের পায়ের দিকে তাকানোর অভ্যাস আয়ত্ত হয় নি, সে দূর থেকে নেত্রীর মুখের দিকেই তাকায়; সে আগের মতোই দাঁড়ায়ে আছে উত্তরকোণে, বেশ মলিন দেখাচ্ছে তাকে, তার গণতান্ত্রিক প্রহরীর সংখ্যা কমে গেছে, দু-তিনটিতে ঠেকেছে। যে-প্রহরীগুলো রাশেদকে সেবার কথা বলতে দেয় নি তার সাথে, তারা এবার নেত্রীর সাথে নেই, তবে পার্টিতে আছে; তারা এখন আছে অন্য কোণে, একটা নতুন কোণ উজ্জ্বল করে তারা পান করছে। তাদের তিনটা উদ্দিন মোহাম্মদের মন্ত্রী হয়েছে, উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের মতোই ঝকঝক করছে তাদের মুখমণ্ডল।
রাশেদ একটা স্বপ্ন দেখেছে; এক রাতে ঘুমিয়েই স্বপ্নটি সে দেখেছিলো, তার পর থেকে জেগে জেগেই সে স্বপ্নটি দেখতে থাকে, মাঝেমাঝেই স্বপ্নটি তার মগজ ফেড়ে। ঝিলিক দিয়ে ওঠে। একটা উৎসবে গেছে রাশেদ, উৎসবটা হচ্ছে প্রাসাদের ভেতরে। যেখানে তার যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু সে যায় যেমন স্বপ্নে মানুষ যায়, প্রাসাদে ঢোকার আগে সে দেখতে পায় চারপাশে স্থূপ স্থূপ হাড় পড়ে আছে। অতো হাড় কোথা থেকে এলো সে বুঝতে পারে না, প্রাসাদের বাইরে হাড় পড়ে থাকাও তার কাছে অদ্ভুত লাগে। উৎসবে যারা এসেছে, তারা পরে এসেছে তাদের শ্রেষ্ঠ স্যুট, পাজামা, শেরোয়ানি, সাফারি, উর্দি, শাড়ি; কিন্তু রাশেদ যার সাথেই হাত মেলাতে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে সে-ই তার দিকে একটা থাবা বাড়িয়ে দিচ্ছে, থাবার নখে রক্ত ঝলমল করছে; তাদের কারো মুখ সিংহের কারো মুখ বাঘের কারো মুখ শেয়াল কুকুর শুয়োরের। রাশেদ কোনো মানুষের মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু মানুষের মুখ দেখার জন্যে তার খুব। পিপাসা জেগে উঠছে, যেনো হাজার বছর ধরে সে মানুষের মুখ দেখে নি। সে কি হাজার বছর ধরে প্রাসাদের ভেতরে উৎসবের ভেতরে রয়েছে? সিংহগুলো গম্ভীরভাবে হাঁটছে, বাঘগুলোও গম্ভীর; তারা মুখোশ পরে আছে বলে মনে হচ্ছে, গম্ভীর না হলে মুখোশ খসে পড়ে যেতে পারে। কুকুরগুলো তাদের ঘিরে ঘিরে ঘুরছে, শেয়াল। শুয়োরগুলো তাদের ঘিরে ঘিরে ঘুরছে; আরেক পাশে কারা যেনো খুঁজছে বাঘের মুখোশ সিংহের মুখোশ, কিন্তু সবগুলো মুখোশ পরা হয়ে গেছে, তারা মুখোশ পাচ্ছে না। হাড়। জমে উঠছে প্রাসাদের দেয়ালের বাইরে, নখে রক্ত ঝলমল করছে। রাশেদ স্বপ্নটি মগজে বয়ে বয়ে জীর্ণ হয়ে পড়ছে, কাউকে বলতে পারছে না।