যষ্ঠ পরিচ্ছেদ
জনার্দন গাঙ্গুলী শহরে একটি অতি পরিচিত মুখ। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সে সাব-পোস্টাপিস হইতে চিঠির ঝুলি কাঁধে লইয়া একটি পুরাতন ব্যালে সাইকেলে চাপিয়া চিঠি বিলি করিতে বাহির হয়, এবং বিকাল তিনটা সাড়ে তিনটার সময় পত্ৰবিতরণ শেষ করিয়া দিনের কর্তব্য সাঙ্গ করে। অন্যান্য পিওনেরা বেলা দেড়টা কি দুইটার ভিতর কাজ শেষ করে, কিন্তু জনার্দন গাঙ্গুলী সবার আত্মীয়-কেহ তাহাকে দাদা, কেহ মামা, কেহ অন্য কিছু বলিয়া ডাকে। প্রত্যেকের বাড়িতে কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া, একগ্লাস জল খাইয়া, মেয়ের বিবাহের কতদূর কি ঠিক হইল, কর্তার গেঁটেবাত কেমন আছে সে সম্বন্ধে সংবাদ লইয়া চিঠি বিলি করিতে তাহার কিছু বিলম্ব হয়। তাহার বিশ্বস্ত। বাহনটি বিগত পঁচিশ বৎসর ধরিয়া অক্লান্তভাবে তাহাকে পিঠে করিয়া কর্তব্য পালনে সাহায্য করে। সহকর্মী কিংবা চিঠির গ্রাহকদের কাছে বাহনটি বিখ্যাত। প্পি মারা চাকা, জং ধরা নড়বড়ে মাডগার্ড, ছিড়িয়া স্পঞ্জ বাহির হওয়া সিট, সামনের রডের সহিত নারিকেলের দড়ি দিয়া বাঁধা, রবারের বলহন—সমস্তটা মিলাইয়া অত্যন্ত করুণ দৃশ্য। নেহাত প্রকৃত বিলাতী র্যালে বলিয়া ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপিতে কাঁপিতে এখনও পথ অতিক্রম করে।
জনার্দন গাঙ্গুলীর মুখের আকৃতি কিছুটা চতুষ্কোণ, ছোট ছোট করিয়া চুল ছাঁটা—যথেষ্ট তৈলদান সত্ত্বেও সেগুলি সটান দাঁড়াইয়া থাকে। চোখদুটি বর্তুলাকার এবং সামান্য রক্তবর্ণ। মাঝারি দৈর্ঘ্য, গায়ে মোটা খাকির জামাতাহাতে পিতলের বোম বসানো। পরনে খাকির প্যান্ট এবং পায়ে শক্ত চামড়ার কালো রঙের কাবুলি চপ্পল। বয়েস বছর বাহান্ন হইবে। এই বর্ণনা হইতে চোখের সামনে অবশ্যই একটি নয়নাভিরাম দেবমূর্তি ভাসিয়া ওঠে না, কিন্তু চেহারা যেমনই হোক, গাঙ্গুলী পিওন মানুষটি ভালো।
পরের দিন কী একটা অজুহাতে কলেজ কামাই করিয়া কাজল তাহাদের গলির উলটাদিকে যে বটগাছটা আছে তাহার তলায় বেলা এগারোটা নাগাদ গিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। গাছের শিকড়ের উপর বসিয়া খোঁড়া অযোধ্যা নাপিত সামনে ইটের আসনে উপবিষ্ট খরিদ্দারের দাড়ি কামাইয়া দিতেছে। কাজলকে দেখিয়া বলিল–কী খোকা, দাড়ি বানাবে? কাজল হাসিয়া বলিল—না। ইহা তাহাদের পুরাতন রসিকতা। কাজল বাড়িতে নিজেই দাড়ি কামায় সে কথা অযোধ্যা জানে, তবু দেখা হইলেই সে রোজ এই কথা বলিবে। অযোধ্যা কাজলকে বালক দেখিয়াছে, তখনও দেখা হইলেই হাতে ক্ষুর লইয়া হাসিয়া বলিত—এসো থোকা, হজামৎ করে দিই। সে অভ্যাসটা রহিয়া গিয়াছে।
সাড়ে এগারোটার সময় দূরে নড়বড়ে সাইকেলের উপর গাঙ্গুলী পিওনের খাকি পোশাক পরা পরিচিত চেহারার উদয় হইল। কাজল তাহাকে গলির মুখে ধরিয়া ফেলিয়া বলিল—গাঙ্গুলীমামা, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল
জনার্দন গাঙ্গুলী সাইকেল হইতে নামিয়া কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল–কী রে? এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী বলবি?
কাজল জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলে নাই এমন নহে, কিন্তু মুখে সারল্য এবং নিষ্পাপ ভাব ফুটাইয়া এ ধরনের ডাহা মিথ্যা বলিতে সে অভ্যস্ত নয়। সে আমতা আমতা করিয়া বলিল—যা, ইয়ে হয়েছে কী—আমার চিঠি সম্বন্ধে আপনাকে—মানে, বিলি না করে যদি–
—কী বলছিস ঠিক করে বল দেখি! বিলি না করে কী করবো?
কাজল ঘামিয়া উঠিয়াছে। অসংলগ্নভাবে সে বলিল—চিঠিগুলো, মানে আমার নামে যেগুলো আসবে, আপনি যদি–বুঝতে পারলেন তো?
গাঙ্গুলী পিওনের চোখ দুটি আরও ছোট ছোট এবং অধিকতর বর্তুলাকার হইয়া গেল। সে বলিল—না, আমি ঠিক বুঝলাম না।
কাজল মরীয়া হইয়া বলিল—সেগুলো যদি আপনি বিলি না করে আপনার কাছে রেখে দেন তাহলে খুব ভালো হয়। বাড়িতে গোলমালকে কোথায় রেখে দেয়, পরে আর পাই না। শনিবার আমার কলেজ থাকে না, বাড়িতেই থাকি। সেদিন আমি চিঠি আপনার কাছ থেকে চেয়ে নেবো
জনার্দন গাঙ্গুলী কয়েক মুহূর্ত নিশূপ। তাহার খাড়া খাড়া চুল বাতাসে নড়িতেছে। কান পাতিয়া শুনিলে বুঝিবা মাথার ভিতর চিন্তার যন্ত্র চলিবার খুটখাট শব্দ শোনা যাইবে।
তারপর সে হাসিয়া বলিল—বেশ, তাই ভালো। শনিবার শনিবার তুই আমার কাছ থেকে চিঠি চেয়ে নিস। তা তোর কী এখন থেকে খুব ঘনঘন চিঠি আসবে মনে হচ্ছে নাকি?
উত্তর হিসাবে কাজলের গলা দিয়া যে শব্দ বাহির হইল তাহার স্পষ্ট অর্থ করা কঠিন। গাঙ্গুলী আবার জিজ্ঞাসা করিল—সব চিঠিই কী আমার কাছে রেখে দেব, না যেগুলো নীল খামে
আসবে কেবল সেগুলো? কালকে যেমন একটা এসেছিল
কাজল যেন এখানে উপস্থিত নাই। গাঙ্গুলী পিওন অন্য কাহাকেও কিছু বলিতেছে। হাসিয়া সাইকেলে উঠিতে উঠিতে জনার্দন গাঙ্গুলী বলিল–ঠিক আছে। চিঠি আমার কাছেই থাকবে।
তারপর আপাদমস্তক কাজলকে একবার ভালো করিয়া দেখিয়া লইয়া বলিল—তুই বড়ো হয়ে গেলি, আঁ? কতটুকু দেখেছি তোকে–
এক-একজন মানুষ আছে যাহাদের কাছে লোকের গোপন কথা নিরাপদে থাকে। গাঙ্গুলী পিওন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিল। কেমন করিয়া সে নির্ভুলভাবে কেবলমাত্র অপালার চিঠিগুলিই বাছিয়া নিজের কাছে রাখিত, বাকিগুলি বাড়িতে বিলি করিয়া দিত–তা সে অপালা যে রঙের খামেই চিঠি লিখুক না কেন। প্রতিমাসে হাজার হাজাব চিঠি লইয়া যাহাব কারবার, মানুষের হাতের লেখা চিনিতে তাহার সময় লাগে না। জনার্দন গাঙ্গুলী সম্ভবত সেই অভিজ্ঞতাই প্রয়োগ করিয়াছিল।
কোনো একজায়গায় বেশিদিন বাস করিলে সেখানকার মাটিতে মানুষের শিকড় গজাইয়া যায়। কাজলের জীবনেও তাহাই ঘটিয়াছিল। অপুর মৃত্যুর পর মামাবাড়িতে বাস করিতে আসা, নিজেদের বাড়ি করিয়া লওয়া, কলিকাতার কলেজে পড়া—এইসব কারণে মালতীপুরে তাহার স্থায়ী ঠিকানা গড়িয়া উঠিয়াছে। ছোটবেলা হইতে বাস করিবার জন্য জায়গাটার উপর তাহার কিছুটা মায়াও আছে। মালতীপুর কলিকাতা হইতে কাছে বলিয়া আরহাওয়ায় শহরের ছোঁয়াচ পুরাদস্তুর, গাছপালা এবং ফাঁকা জায়গা কম, বাড়িঘর বেশি। প্রতিবৎসরই নতুন নতুন আরও বাড়ি উঠিতেছে, জমির দাম আগুন। মূল রাস্তাগুলির দুইধারে ফাঁকা জমি আর নাই বলিলেই চলে। গ্রাম সুন্দর, বিশাল শহরেরও একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে—কিন্তু এই ধরনের আধা গ্রাম আধা শহর কাজল দেখিতে পারে না। শহরের চমকপ্রদ অভিনবত্ব নাই, আবার গ্রামের সরল স্বাভাবিকত্বও নাই, পরিকল্পনাহীনভাবে কিছু বাড়িঘর দোকানবাজার আর চালা গড়িয়া উঠিয়াছে—এই মাত্র। নিশ্চিন্দিপুরে তাহার বাবার যে মায়াময় শৈশব প্রকৃতির অকৃপণ দানে স্বর্ণমণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছিল, তেমন ঈশ্বরের আশীর্বাদপুত শৈশব সে মালতীপুরে যাপন করে নাই। প্রবাসী ইংরেজ যেন অকিঞ্চিকর ঘটনা সম্বন্ধে রসিকতা করে-nothing to write home about, কাজলের শৈশবও প্রায় তাহাই। তবু নিজের কৈশোর ও শৈশব প্রত্যেকেরই প্রিয়। বড়ো হইয়া উঠিতে উঠিতে মনের মধ্যে কত ভাঙচুর হয়, কত সরল বিশ্বাস সন্দেহে পরিণত হয়, আবার কত অস্পষ্ট ধারণা গভীর বিশ্বাসের রূপ নেয়। ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, কতদিনের কত মেঘ-ঘনাইয়া-আসা কালবৈশাখীর অপরাহু, রাত্রিতে হ্যারিকেনের আলো কমাইয়া দিয়া মায়ের কাছে শুইয়া গল্প শোনা। নাঃ, বাবার মতো না হইলেও তাহার ছোটবেলাও নিতান্ত খারাপ কাটে নাই।
তবু নিশ্চিন্দিপুরের জন্য মাঝে মাঝে ভারি মন কেমন করে।
শহরের সহিত তাহার কোনো আত্মীয়তা নাই। গ্রামে সে বেশিদিন বাস করে নাই সত্য, কিন্তু সেখানেই তাহার অস্তিত্বের মূল প্রোথিত রহিয়াছে। কয়েকদিন ধরিয়া সে ভাবিতেছে—একবার নিশ্চিন্দিপুরে গেলে বেশ হত। কে কেমন আছে দেখে আসতাম। এই ইচ্ছার সহিত সমাপতনের মতো আর একটি ঘটনা পরের সপ্তাহেই কাজলের নিশ্চিন্দিপুর যাওয়াকে নিশ্চিত করিয়া তুলিল।
কলিকাতা হইতে অপুর ভক্ত সেই জগদীশবাবু একদিন আসিয়া বলিলেন–সামনের মাসে আমরা অপূর্ববাবুকে নিয়ে সভা করবো। তার আগে একবার তার গ্রামটা ঘুরে আসতে চাই। যে গ্রামকে তিনি তার সাহিত্যে অমর করে রেখেছেন সেটা না দেখলে তাকে পুরো চেনা যাবে না। কী করে যেতে হয় একটু বলে দেবে?
কাজল বলিল—তার চেয়ে ভালো হয়, আমি আপনাদের নিয়ে যাই চলুন। আমিও কিছুদিন ধরে যাবো যাবো করছি, বরং এই সুযোগে—
-বাঃ, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। যেদিন যাবে সেদিনই ফেরা যাবে তো?
–তা চেষ্টা করলে ফেরা যায়, আজকাল তো মোটববাসও হয়েছে ও-পথে। তবে ভালো করে বেড়াতে হলে আমার সঙ্গে একটা দিন না হয় থেকে যাবেন।
—তা অবশ্য হতে পাবে যদি অসুবিধে না হয়—
—অসুবিধে আর কী? আমার সঙ্গেই তো থাকবেন।
যাইবার দিন ঠিক হইয়া যাইবার পর কাজলের মনে অদ্ভুত একটা আনন্দের ঢেউ বহিতে লাগিল। অপুর মৃত্যুর পর বার দুই সে নিশ্চিন্দিপুর গিয়াছিল। থাকা হয় নাই, বাড়িতে জরুরি কাজ থাকায় আবার রাত্রে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছিল। রানুপিসির সঙ্গেও দেখা হয় নাই-রানাঘাটে কে একজন আত্মীয় অসুস্থ থাকায় রানুপিসি সেখানে গিয়াছিল। এবার গেলে হয়তো দেখা হইবে।
নির্দিষ্ট দিনে নিশ্চিন্দিপুরের পথে পা দিয়া সে অবাক হইয়া গেল। কী আশ্চর্য পরিবর্তন হইয়াছে তাহাদের গ্রামের! ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক হইতে যে রাস্তা গ্রামে ঢুকিতেছে সেটা বরাবরই সে কঁাচা দেখিয়া আসিয়াছে। এবার সে অবাক হইয়া দেখিল রাস্তাটায় পিচ দেওয়া হইয়াছে। হইতেই পারে দিন কাটিবার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্রই উন্নতির স্পর্শ লাগিয়াছে, তাহাদের গ্রামেব পথে যে পিচ পড়িবে উহা এমন আশ্চর্য কী? কিন্তু কাজলের মন খারাপ হইয়া গেল। এখানে ওখানে বেশ কয়েকখানা পাকা বাড়ি দেখা যাইতেছে। কবে এসব বাড়ি উঠিল? সারি সারি খুঁটির উপর দিয়া বিদ্যুতের তার গ্রামে প্রবেশ করিয়াছে। রাত্রিবেলা গ্রামে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বলে তো? নদীর ধার দিয়া আসিবার পথে যে বড়ো আমকাঠালের বাগানটা পড়ে সেখানে খুটির উপব বিদ্যুতের আলো জ্বলে না তো? পাখির দল কী আজও এ গ্রামের গাছের পাতার ফাঁকে গান গাহিতে আসে?
নিশ্চিন্দিপুর তাহার একটা বড়ো আশ্রয়। আর হয়তো কোনদিন পাকাপাকি ভাবে এখানে আসিয়া বাস করা হইবে না, তবুও জীবনের শত দুঃখ এবং আঘাতের মুহূর্তে সেদৃঢ় বিশ্বসে স্থির থাকিতে পারিবে—কোথাও এই পৃথিবীতে সবুজ ঘাস আছে, পাখির ডাক আছে, শান্তির আশ্রয় আছে, সেখানে নির্জন বাঁশবনে উদাস হাওয়ায় নিঃশব্দে শুকনো পাতা খসিয়া মাটি ঢাকিয়া দেয়, পূর্বপুরুষদের নিবিড় স্নেহ যুগান্তের বাধা পার হইয়া শীতল ছায়ার রূপ ধরিয়া বনে-বনান্তে ঘনাইয়া আসে। এই গ্রাম হইতে জীবনের প্রবাহ তাহাকে যত দূরেই লইয়া যাক না কেন, একটা অদৃশ্য সংযোগসূত্র তাহাকে চিরদিন নিশ্চিন্দিপুরের সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিবে।
নিশ্চিন্দিপুর বদলাইয়া গেলে তাহা সে সহ্য করিতে পারিবে না। জগদীশ একান্তই শহরের মানুষ, কলিকাতার বাহিরে কমই পা দিয়াছে। তুলনামূলকভাবে গ্রামের যে পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাহা জগদীশের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সে সবকিছু দেখিয়াই ভয়ানক উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। কাজলের প্রথমটা মজা লাগিলেও পরে সে ভাবিয়া দেখিল-জগদীশের দোষ নাই। He has long been in a city pent, শহরের কুশ্রী ইটের স্তূপ দেখিয়া আর কর্কশ শব্দ শুনিয়া তাহার চোখ ও কান ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। এখন প্রতিটি ঘাসের ডগা দেখিয়া তাহার উল্লসিত হইয়া ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
–আহা কী চমৎকার! কী শান্তি! এমন জায়গায় মানুষ হয়েছেন বলেই না অপূর্ববাবু অমন বই লিখতে পেরেছিলেন! আচ্ছা, কুঠির মাঠ কোনদিকে? সেটাও দেখবো কিন্তু
জগদীশ মানুষ ভালো, কিন্তু আবেগের প্রাবল্যে অনর্গল কথা বলিয়া মুশকিল করিতে লাগিল। কাজলের পক্ষে নিশ্চিন্দিপুরে আসা একটা তীর্থযাত্রার মতো। সারাটা দিন সে নিজের ভিতর মগ্ন হইয়া থাকিতে চায়। এমন চলিলে তাহা কী করিয়া সম্ভব হইবে?
আজ রানুপিসি বাড়িতেই ছিল। কাজলের ডাক শুনিয়া রান্নাঘর হইতে ছুটিয়া আসিয়া অবাক হইয়া বলিল—ওমা, তুই! আমি ঠিক গলা শুনে চিনতে পেরেছি। ভাবলাম—ভুল শুনছি নাকি? কাজল এখন কোখেকে আসবে? খবর নেই, কিছু নেই—আর একবার এসেছিলি শুনলাম, আমি ছিলাম না—মামার অসুখ হয়েছিল, তাকে দেখতে গিয়েছিলাম রানাঘাট–
তারপর পেছনে জগদীশকে দেখিযা সংকুচিত হইয়া বলিল—ইনি কে?
—ইনি, মানে-ধরো আমার দাদা হন। বাবার বই পড়ে আমাদের গ্রাম দেখতে এসেছেন। ভালো কথা পিসি, আমরা কিন্তু আজ এখানে থাকবো–
রানী হাসিয়া বলিল—থাকবি তাই কী? সেকথা কী আবার বলতে হবে? আয়, ঘবে এসে বোস–
বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। রানী জলখাবারের ব্যবস্থা না করিয়া একেবারে দুপুরবেলাব খাওয়ার আয়োজন করিতে লাগিল। কাজল বলিল—বানুপিসি, তুমি বরং রান্নাবান্না শেষ করে বাখো, আমি ততক্ষণ এঁকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। দুটো নাগাদ ফিবে খেতে বসবো–
—অত বেলায়? চান করবি কখন?
—সকালে চান করে বেরিয়েছি, শুধু হাতমুখ ধুয়ে নেবো এখন–
উত্তরের মাঠে যাইবার পথে একটি চাষিব ছেলে দাঁড়াইয়া খেতে নিড়ান দেওয়া দেখিতেছে। কাজল তাহাকে ডাকিয়া বলিল–এই শোন, তোর নাম কী?
বালক মুখ হইতে আঙুল বাহির করিয়া বলিল–হারাণ।
-একটা কাজ করবি হারাণ? আমার এই দাদাকে একটু কুঠির মাঠ দেখিয়ে আনবি? তোকে চারআনা পয়সা দেবো–
বালক ঘাড় হেলাইয়া জানাইল–পারিবে।
—তবে নিয়ে যা। জগদীশদা, আপনি রানুপিসির বাড়ি চিনে ফিরতে পারবেন তো? আমার একটু কাজ আছে, সেটা সেরে নিই–
জগদীশ হাসিয়া বলিল–খুব পারবো। তুমি যাও, কাজ সেরে নাও–
কাজল পকেট হইতে একটা সিকি বাহির করিয়া হারাণের হাতে দিতে গেল—এই নে তোর চারআনা–
হারাণ বলিল–নাঃ।
কাজল বিস্মিত হইয়া বলিল–সে কি রে? এই যে বললি যাবি?
—যাবো, পয়সা নেবো না।
কাজল নতুন করিয়া ছেলেটির দিকে তাকাইল। শ্যামবর্ণ, নিতান্ত সাধারণ চেহারা—অনেকদিন চুল কাটা হয় নাই, জুলফি লতাইয়া পড়িয়াছে। পরনে ছেঁড়া ইজের, গা খালি। সর্বাঙ্গে খড়ি উড়িতেছে। মূর্তিমান দারিদ্র। অথচ কত সহজে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করিল।
এই সারল্য চিরস্থায়ী হইবে তো? দিনকাল বড়ো খারাপ পড়িয়াছে। জগদীশ চৌধুরী ছেলেটির সঙ্গে চলিয়া গেলে কাজল একা নিজেদের পুরানো ভিটার দিকে গেল। এখানেও জগদীশ নিশ্চয় আসিতে চাহিবে, তবে সেটা বিকালের দিকে হইলেও ক্ষতি নাই। প্রথমে সে একা কিছুক্ষণ সেখানে কাটাইতে চায়। জগদীশ অপুর যত বড়ো ভক্তই হোক না কেন, পুরানো ভিটার প্রতিটি ইটে প্রতি ধূলিকণায় তাহার বাবার যাপিত শৈশবের যে আনন্দময় ইতিহাস লেখা আছে, সে ইতিহাস পড়িবার ক্ষমতা তাহার নাই। কাজলের শৈশবও এখানে কাটে নাই বটে, কিন্তু সে এই গ্রামেরই সন্তান—এই ভিটার সহিত তাহার বত্রিশ নাড়ির সম্বন্ধ। অন্যে তাহা অনুভব করিতে পারিবে না।
ভিটায় যে জঙ্গল হইয়া গিয়াছে তাহা সে ছোটবেলাতেই দেখিয়া গিয়াছিল। কেহ পরিষ্কার না করায় জঙ্গল যেন আরও বাড়িয়া উঠিয়াছে। কাঁটাওয়ালা দুষ্প্রবেশ্য ওকড়া ফলের ঝোপ ঠেলিয়া ভেতরে ঢোকাই কঠিন। নিশ্চিন্দিপুরে তাহার বাবা সম্প্রতি যে বাড়ি কিনিয়াছিল, কেহ বাস না করায় সেটির অবস্থাও ভালো নহে, অবিলম্বে মেরামত প্রয়োজন। বর্তমানে সে রানুপিসির বাড়িতেই থাকিবে।
তাহাদের বাড়িটার বলিতে গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। দু-একটা দেয়াল কোনোমতে দাঁড়াইয়া আছে, চারিদিকে ভাঙা ইট আর উইধরা কাঠের খুঁটির স্তূপ। ফ্যাকাসে সবুজ পাতাওয়ালা শেয়ালকাটার গাছ সর্বত্র। তাহার পায়েব শব্দে একটা গিবগিটি দ্রুত ছুটিয়া ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে কোথায় লুকাইল।
কাজলের পরিচিত একজন প্রৌঢ় ইতিহাসের অধ্যাপক সবকাবের অনুমতি লইয়া কিছুদিন এখানে-ওখানে শখের খননকার্য চালাইযাছিলেন। প্রত্নতত্ত্বে উৎসাহী কাজল মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে তাহার কাছে গিয়া গল্প শুনিত। অধ্যাপক ভদ্রলোক বলিয়াছিলেন—যেখানে-সেখানে খুঁড়তে আরম্ভ করলেই তো হল না, তোমাকে নিশ্চিত হতে হবে সেখানে আগে মানুষের বাস ছিল। নইলে খোঁড়াখুড়ি কবলে, অঢেল পয়সা খরচ হল, পরিশ্রমও হল—তারপর সেখানে মাটির নিচে কিছুই পাওয়া গেল না—
-কী করে নিশ্চিত হওয়া যায়? কোনো উপায় আছে?
—আছে, অন্তত আমি পারি। ধবো, কোথাও একটা টিবি দেখে বা অন্য কোনো লক্ষণ দেখে মনে হল এখানে এসক্যাভেশন চালানো যেতে পারে। আমি তখন সেখানকার মাটি একমুঠো হাতে তুলে নিয়ে এঁকে দেখি–
-কেন? মাটি খুঁকে কী বোঝেন?
-মানুষ কোথাও একবার বাস করলে সেখানকার মাটিতে মানুষের গন্ধ মিশে যায়—সে গন্ধ আর নষ্ট হয় না। আমি মাটি খুঁকে বলে দিতে পারি—এখানে একহাজার বছর আগে বসতি ছিল। অবশ্য এ ক্ষমতা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয় কিছুটা সহজাতও বটে। যার থাকে তার থাকে
কাজল নিচু হইয়া এক মুঠা মাটি হাতে লইল।
এই মৃত্তিকা বিগত তিনপুরুষ ধরিয়া তাহাদের বংশকে লালন করিয়া আসিয়াছে, আশ্রয় দিয়াছে। তাহার ঠাকুরদা এই ভিটার দাওয়ায় বসিয়া পুথি লিখিয়াছে, ঠাকুমা রান্না করিয়াছে—
দুর্গাপিসি পুতুলের বাক্স সাজাইয়াছে এই উঠানে বসিয়া। তাহার বাবার শৈশবক্রীড়ার সাক্ষী এই ভিটা। এই মাটিতে কী সত্যই তাহাদের স্মৃতির ঘ্রাণ মিশিয়া রহিয়াছে?
বদ্ধমুষ্টি মুখের কাছে আনিয়া কাজল চোখ বুঁজিয়া ঘ্রাণ লইল।
প্রথমে শুধুই সোঁদা সোঁদা সাধারণ মাটির গন্ধ। তারপর যেন তাহারই সঙ্গে মিশিয়া কোন সুদুর অতীত হইতে হারানো দিনের ছবি আর রঙ ভাসিয়া আসিল। কত না-দেখা প্রিয়জন, ভুলিয়া যাওয়া উৎসবের আনন্দ-জন্মান্তরের তটভূমি হইতে প্রবাহিত অলৌকিক বায়ুস্রোতে ভর করিয়া দেবধূপের সৌরভ বহন করিয়া আনিল।
তাহার জন্মের বহু পূর্বেই এই মঞ্চের নাটক সমাপ্ত হইয়া গিয়াছে। কোথায় ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, কোথায়ই বা দুর্গাপিসি আর বাবার হারানো শৈশব! বাবার কাছে সেইসব দিনের গল্প শুনিয়াছে শুধু, তাহার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ নাই সে যুগটার। অন্যের মুখে শোনা রূপকথার কাহিনীর মতো।
তবু চোখে জল আসে কেন?
জায়গাটায় বেশ ছায়া-ছায়া ভাব, তীব্র সূর্যের আলো প্রবেশ করিয়া পরিবেশের স্বপ্নিল মোহাচ্ছন্নতাকে খর্ব করে নাই। কাজল দুইখানি ইট পাশাপাশি পাতিয়া তাহার উপর অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
এই বাড়িটাকে আবার সারাইয়া তুলিতে হইবে। আধুনিক নকশা অনুযায়ী নতুন বাড়ি নয়, পূর্বে যেমন ছিল ঠিক তাহাই। সে দেখে নাই, কিন্তু রানুপিসি বলিতে পারিবে বাড়িটা দেখিতে কেমন ছিল। আজ জগদীশের আগমন দিয়া শুরু, তাহার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে আগামী কয়েক বছরে তাহার বাবার খ্যাতি আরও বাড়িবে। দেশের দূর দূর প্রান্ত হইতে ভক্তের দল এই বাড়ি দেখিতে আসিবে একদিন। আসিয়া কী দেখিবে? এই শ্রীহীন ভগ্নস্তূপ? নাঃ, বাড়িটার সংস্কারের ব্যবস্থা লইতে হইতেছে। কিংবা থাক। বিগত যুগকে এভাবে কালের গর্ভ হইতে উদ্ধার করিয়া লাভ নাই। শেষ জীবনে তাহার বাবা যে বাড়িতে বাস করিত, তাহাই বরং লোকে দেখুক। পুরোনো ভিটার বেদনাকরুণ স্মৃতি বাবার উপন্যাসে অক্ষয় হইয়া থাকিবে।
ঘণ্টাখানেক পরে উঠিয়া আসিবার সময় কাজল ভিটা হইতে কিছুটা মাটি তুলিয়া লইল। পকেটে একটা কিসের হ্যান্ডবিল রহিয়াছে আজ দিন দুই-তিন, শেয়ালদার মোড়ে কে যেন বিলি করিতেছিল। সেই কাগজখানা বাহির করিয়া মাটিটুকু তাহাতে মুড়িয়া পকেটে রাখিল।
সে রানুপিসির বাড়ি পৌঁছাইবার একটু পরেই জগদীশও ফিরিয়া আসিল। কুঠির মাঠ দেখিয়া সে খুব খুশি। বলিল–নীলকুঠির ভাঙা চৌবাচ্চাগুলো এখনও পড়ে আছে দেখে এলাম, বুঝলে? অপূর্ববাবুর শেষ উপন্যাসখানা তো নীলবিদ্রোহের পটভূমিতে বাংলার গ্রাম নিয়ে লেখা। মহাকাব্য, বুঝলে, মহাকাব্য। সেই উপন্যাসের জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে আছি ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল—
দুপুরে রানী যত্ন করিয়া তাহাদের খাওয়াইল। কাজল ছোটবেলায় কী কী খাইতে ভালোবাসিত তাহা সে ঠিক মনে করিয়া রাখিয়াছে। থালায় চূড়া করিয়া ভাত বাড়িয়াছে—শহরের পালিশ করা চালের সাদা ভাত নয়, ঈষৎ লালচে মোটা চাল। কিন্তু ভারি মিষ্টি স্বাদ। পাতের একপাশে মোচার তরকারি, তাহার উপর বড়িভাজার গুঁড়া আর নারকোলকোরা ছড়ানো। ছোটবেলায় খাইতে বসিয়া মোচার ঘণ্ট দেখিলেই সে বলিতও পিসি, বড়ি দাওনি কেন? আমি এমনি এমনি মোচা খাবো না—
অনুরোধ-উপরোধে ফল হইত না, রানীকে আবার বড়ি ভাজিয়া আনিতে হইত। রানুপিসি সেই কথা এখনও মনে রাখিয়াছে দেখিয়া আবেগে তাহার বুকের মধ্যেটা কেমন করিয়া উঠিল। পিসি তাহাকে এত ভালোবাসে, অথচ সে কতবছর আসিয়া একবার খোঁজ করে নাই। কাজটা খুব অন্যায় হইয়া গিয়াছে। এখন হইতে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখিবে।
মধ্যাহ্নভোজনের পর জগদীশ বাহিরের তক্তাপোশের উপর মাদুর পাতিয়া সামান্য বিশ্রাম করিবার জন্য শুইয়া পড়িল। কাজল ভিতরে গিয়া দেখিল খাওয়া সারিয়া রানী শোওয়ার ঘরে মেঝেতে বসিয়া জাতি দিয়া সুপারি কাটিতেছে। কাজলকে দেখিয়া রানী বলিল–আয়, বোস এখানে। ও লোকটা ঘুমিয়েছে?
-হ্যাঁ পিসি, ওকে শুতে দিয়েই তো এলাম।
—কে রে লোকটা? তোর মামাবাড়ির দিকের কেউ নাকি?
-না, আমার কেউ হয় না। বাবার এখন খুব নাম হয়েছে তা জানো তো? অনেক বই বেরিয়েছে বাবার, সেসব বই পড়ে লোকেরা বলহে বাংলা সাহিত্যে অনেক যুগের মধ্যে এতবড় সাহিত্যিক আর আসেনি। এর নাম জগদীশ চৌধুরী, কলকাতায় থাকে, বাবার লেখার খুব ভক্ত। এরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বাবার স্মৃতিতে সভা করবে কলকাতায়, তার আগে একবার আমাদের গ্রাম দেখতে এসেছে।
জাঁতির কুচকুচ শব্দ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। আগ্রহপূর্ণ স্বরে রানী জিজ্ঞাসা করিল—কেন রে? অপু বইতে আমাদের গাঁয়ের কথা লিখেছে বুঝি?
কাজল অবাক হইয়া গেল। যে বই লইয়া এখন সারাদেশে এত আলোচনা, রানুপিসি সে সম্বন্ধে কিছুই জানে না? সে বলিল—বাবার প্রথম উপন্যাসখানা তো আমাদের এই গ্রামের কথা নিয়েই লেখা। সব সত্যি ঘটনা, চরিত্রগুলোও সব সত্যি। ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কথা আছে, প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের কথা আছে, চিনিবাস কাকার কথা আছে।
তারপর একটু থামিয়া আস্তে আস্তে বলিল—তোমার কথাও অনেক আছে পিসি। তুমি নাকি বাবাকে ছোটবেলায় একটা খাতা দিয়েছিলে গল্প লিখে দেবার জন্য, কিছুদূর লেখার পর ঠাকুরদা এ গ্রাম ছেড়ে চলে যান, বাবা আর খাতাটা শেষ করতে পারেনি—সে ঘটনাও লেখা আছে। তুমি বাবার বই একটাও পড়ো নি? কত লোকে পড়ে ফেলল—
রানী ধরা গলায় বলিল—কী করে পড়বো বল? আমাদের গাঁয়ে বই পড়ার রেওয়াজ নেই, কেউ আমাকে বলেও নি অপুর এত নাম হয়েছে। তুইও তো একটা বই আমাকে দিয়ে যেতে পারতিস–আসলে কী জানিস, আমরা সেই গাঁয়েই পড়ে আছি, কাদায় গুণ পুঁতে। তুই শহরে থাকিস, তোর কত বন্ধু, কত কাজ—তোর কী আর মনে পড়বে আমার কথা? তবে তুই ছেলেমানুষ, তোকে দোষ দিই না, তোর বাবা বেঁচে থাকলে
কাজলের সত্য-সত্যই খুব মনখারাপ হইল। রানীর একটা হাত ধরিয়া সে বলিল—পিসি, তুমি রাগ কোরো না, আমার সত্যিই খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। এরপর আমার আসতে আবার কমাস দেরি হবে হয়তো, কিন্তু আমি তার আগেই তোমাকে ডাকে পার্সেল করে বাবার এক সেট বই পাঠিয়ে দেব। অন্য লোকে যতই নাচানাচি করুক, এ পৃথিবীতে বাবার বই পড়বার সবচেয়ে বেশি অধিকার তোমার, কেন জানো?
রানী উত্তর দিল না, মাথা নিচু করিয়া কাটা সুপারির টুকরাগুলি আঙুল দিয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিল।
কাজল বলিল—কারণ এই যে, ছোটবেলায় তোমার প্রেরণাতেই বাবা প্রথম লিখতে শুরু করে। হলই বা ছেলেমানুষি লেখা, জীবনের প্রথম লেখা তো! বাবা নিজের উপন্যাসে তোমার ঋণ স্বীকার করেছে–
রানী মুখ তুলিল না। সুপারিগুলি আঙুল দিয়া নাড়িয়াই যাইতেছে।
কাজল এতক্ষণ আবেগের বশে কথা বলিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল রানুপিসি প্রাণপণে কান্না চাপিবার চেষ্টা করিতেছে। সে অপ্রতিভ হইয়া কথা ঘুরাইয়া গ্রামের বর্তমান পরিবেশ কিরূপ সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করিল। রানী অধমনস্কভাবে দুই-একটা অসংলগ্ন উত্তর দিল। কাজল বুঝিতে পারিল এ আলোচনায় রানুপিসির মনোযোগ নাই। কিছুক্ষণের ভিতরেই দ্বিপাক্ষিক নীরবতার মধ্যে কথাবার্তা থামিয়া গেল।
সারাটা বিকাল ধরিয়া কাজল জগদীশকে লইয়া গ্রাম দেখাইয়া বেড়াইল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিয়া জগদীশ ঝোলার ভিতর হইতে নোটবই বাহির করিয়া হ্যারিকেনের আলোয় কী সব লিখিতে বসিল। কাজল ভিতর-বাড়িতে ঢুকিয়া দেখিল রান্নাঘরের বারান্দায় বসিয়া রানুপিসি তরকারি কুটিতেছে। সে কাছে বসিয়া বলিল—পিসি, বাবা তোমাকে যে খাতাখানা লিখে দিয়েছিল সেটা এখনও তোমার কাছে আছে?
রানী বিষণ্ণ হাসিয়া বলিল–ছোটবেলার জিনিস কী ফেলা যায়? আছে বাক্সের মধ্যে। কেন রে?
—আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার দেখাবে?
বঁটি কাত করিয়া রাখিয়া রানী উঠিয়া ঘরের মধ্যে গেল। খাটের তলায় রাখা পুরাতন বেতের পেঁটরা টানিয়া বাহির করিয়া খুলিতেই অকস্মাৎ চারিদিকের যেন কঠিন বর্তমানটা আর নাই। আবার সেই অতীতের নিশ্চিন্দিপুর। হলুদ জমির উপর খয়েরী ডুরেপাড় শাড়ি, খানকতক পুরানো চিঠি, ভিটোরিয়ার আমলের দুইটি তামার ডবল পয়সা। একটা পুঁতির মালা, মালার সূতা ছিড়িয়া পুতিগুলি বাক্সের ভিতর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সর্বোপরি পেটরার মধ্যেটায় কেমন একটা গন্ধপুরাতন কাপড় বা কাগজপত্র বন্ধ পড়িয়া থাকিলে যেমন পাওয়া যায়। এই ঘ্রাণের সহিত অতীত দিনগুলির কী যেন সম্পর্ক আছে, শুকিলেই মনে হয় মাঝের বসরগুলি সব ফাঁকি। আবার যেন সেই কালের গর্ভে বিলীন বাল্যকালটা সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ লইয়া ফিরিয়া আসে।
উদ্গত চোখের জল চাপিয়া রানী খাতাখানা কাজলকে আনিয়া দিল।
সেকেলে ধরনের হাতে সেলাই করিয়া বাঁধানো খাতা। মোটা পাতাগুলি হলুদ হইয়া আসিয়াছে। প্রথম পাতাতেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-শ্রীঅপূর্বকুমার রায়। চাউলপোড়া আর খয়ের দিয়া তৈয়ারি কালি, এখনও ঝকঝক করিতেছে।
পাতা উলটাইয়া পড়িতে শুরু করিয়া কাজল খুব মজা পাইল। রাজা-রানী, সৈন্যসামন্ত, সেনাপতি আর গূঢ় ষড়যন্ত্র লইয়া একটা সাংঘাতিক কাহিনী! ত্রিশ-বত্রিশ পাতা মোট লেখা হইয়াছিল। তাহার মধ্যেই যুদ্ধ, প্রতিহিংসা, দেশের জন্য আত্মত্যাগ, বাউল ভিখারির ছদ্মবেশে রাজগুরুর রাজমাহাত্ম্য প্রচার, বিশ্বাসঘাতিনী মহিষীর উপযুক্ত দণ্ডবিধান–সব হইয়া গিয়াছে। এই বালকই বড় হইয়া এমন সাহিত্য রচনা করিয়াছে যাহা পাঠ করিয়া লোকে লেখকের ভিটা দেখিতে ছুটিয়া আসিতেছে!
খাতা রানীর হাতে ফেরৎ দিয়া কাজল বলিল–যত্ন করে রেখে দিয়ে রানুপিসি, একদিন এখানা দেখতে তোমার কাছে লোক আসবে, দেখো—
কাজল চলিয়া যাইবার দিন দশেক পর একদিন রানী দক্ষিণের ঘরে জানালার পাশে বসিয়া দুপুরবেলা সেলাইয়ের কাজ করিতেছে। উঠানের গাবগাছে একটা ঘুঘু বহুক্ষণ ধরিয়া ডাকিয়া ডাকিয়া দুপুরবেলার নির্জনতাকে নির্জনতর করিয়া তুলিয়াছে, এমন সময় উঠানে গ্রামের শিশির পিওন আসিয়া দাঁড়াইল।
–একটা পার্সেল রয়েছে দিদিঠাকরুণ-তোমার নামে। সই করে নিতে হবে। রসিদে সই করাইয়া একটা পুলিন্দা রানির হাতে দিয়া শিশির পিওন চলিয়া গেল।
কাজল কথা রাখিয়াছে। পুলিন্দা খুলিতেই আট-দশখানা বাংলা বই বাহির হইল। প্রত্যেকটির মলাটে অপুর নাম। রানী অবাক হইয়া বইগুলি বার বার দেখিতে লাগিল। বাঃ, কী সুন্দর ছবি মলাটে, কেমন সুন্দর বাঁধানো! পিছনের মলাটে বইগুলি সম্বন্ধে বড়ো বড়ো সমালোচকেরা যাহা বলিয়াছেন তাহা ছাপা হইয়াছে। অত কঠিন কথা রানী বোঝে না, তাহার কেবল গর্বে বুকের মধ্যেটা কেমন করিয়া উঠিল এই ভাবিয়া যে, এত সমস্ত বই তাহার হোটবেলার সঙ্গী অপু লিখিয়াছে।
সেলাইয়ের সরঞ্জাম সরাইয়া জানালার পাশে বসিয়া রানী অপুর লেখা প্রথম উপন্যাসখানি পড়িতে শুরু করিল।
বেলা গড়াইয়া নিবিড় অপরাহের ছায়া নামিল বাহিরের উঠানে। ক্ৰম আলো কমিয়া আসিল, চোখের কাছে বই না আনিলে আর পড়া যায় না।
কোথাও মন চলিয়া গিয়াছে রানীর। লোকে বলিতেছে অপু নাকি মস্তবড় লেখক। বড়ো লেখকের লেখা এত সহজ হয় বুঝি? এ তো তাহাদের ঘরের কথা, তাহাদের শৈশবের খেলার গল্প-সংসারের দুঃখকষ্ট হাসিকান্নার কাহিনী।
রানীর চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। সে মনে মনে বলিল—সব ঠিক আছে অপু। সেই মাঠ-বন, আমাদের গাঁ নিশ্চিন্দিপুর-শুধু তুই কেন চলে গেলি?