৬
চিঠি লিখলাম আমার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে যে-মেয়েটির বিয়ের কথা হয়েছিল, সেই মেয়ের বড়চাচাকে। আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোক জবাব দেবেন না। যে-পরিচয়ের সূত্র ধরে চিঠি লিখেছি, সেই সূত্রে চিঠির জবাব দেওয়ার কথা নয়। ভদ্রলোক কিন্তু জবাব দিলেন। এবং বেশ গুছিয়েই জবাব দিলেন।
‘আপনার পত্র পাইয়াছি।
এক নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় আপনাদের সহিত পরিচয় হইয়াছিল। আপনি যে সেই পরিচয় মনে রাখিয়া পত্র দিয়াছেন তাহাতে কৃতজ্ঞ হইলাম। আপনি আমার ভাইস্তি প্রসঙ্গে জানিতে চাহিয়াছেন। দুই বৎসর আগে তাহার বিবাহ হইয়াছে। এই খবর তো আপনার জানা। সে এখন তাহার স্বামীর সহিত ইরাকে আছে। তাহার স্বামী একজন ডাক্তার। আপনাদের দোয়ায় তাহারা ভালোই আছে।
দ্বিতীয় যে-বিষয়টি আপনি জানিতে চাহিয়াছেন, তাহার সবই সত্য। কুকুরের কামড়ে ছিন্নভিন্ন বালিকাটির দেহ আমরা সবাই দেখিয়াছি। তাহার মৃতদেহ সৎকারের কোনো ব্যবস্থা হয় নাই, কারণ বালিকাটি হিন্দু কি মুসলিম তাহা জানা সম্ভব হয় নাই।
ঘটনাটি সেই সময় জনমনে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার মফস্বল পাতায় খবরও ছাপা হইয়াছিল।
অধিক আর কি? আমরা ভালো আছি। আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করি।’
.
আমি চিঠিটি ডাকযোগে মিসির আলির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। মনে-মনে হাসলাম। অভ্রান্ত যুক্তিও মাঝে-মাঝে অচল হয়ে যায়। এই চিঠিটি হচ্ছে তার প্রমাণ।
চিঠি পাঠাবার তৃতীয় দিনের মাথায় মিসির আলি এসে উপস্থিত। আমি হেসে বললাম, ‘কি, গল্পটা এখন বিশ্বাস করলেন?’
মিসির আলি শুকনো গলায় বললেন, ‘হুঁ।’
তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হল।
আমি বললাম, ‘আপনাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?’
মিসির আলি বললেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকে গল্পটা আবার শুনতে চাই।’
‘কেন?’
‘প্লীজ, আরেক বার বলুন।‘
‘আবার কেন?’
‘বলুন শুনি।’
আমি দ্বিতীয় বার গল্পটা শুরু করলাম। এক জায়গায় মিসির আলি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কত তারিখ বললেন?’
‘বারই কার্তিক। এই তারিখে ঘটনাটা ঘটল।’
‘বারই কার্তিক তারিখটা আপনার মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে। প্রথম বার যখন আপনাকে গল্পটা বলি, তখনও তো বারই কার্তিক বলেছিলাম বলে আমার মনে হয়।’
‘হ্যাঁ, বলেছিলেন। আজও সেই একই তারিখ বলেন কি না তাই দেখতে চেয়েছি। এই তারিখটা বেশ জরুরি।’
‘জরুরি কেন?’
‘বলছি কেন। তার আগে আপনি বলুন বার তারিখটা আপনার মনে রইল কেন? এ-সব দিন-তারিখ তো আমাদের মনে থাকে না।’
‘বার তারিখ আমার বড়মেয়ের জন্মদিন। কাজেই সুধাকান্তবাবু বার তারিখ বলামাত্র আমার মনে গেঁথে গেল। তা ছাড়া আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।’
‘তাই তো দেখছি।’
‘এখন বলুন তারিখটা এত জরুরি কেন?’
‘যে-বছরে ঘটনাটা ঘটল, আমি সেই বছরের পঞ্জিকা দেখেছি। বার তারিখ হচ্ছে ২৪শে অক্টোবর। স্কুল ছুটি থাকে। ঐদিন লক্ষ্মীপূজার বন্ধ। কাজেই আপনার সুধাকান্তবাবু আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ঐদিন স্কুল করেছেন।’
‘হয়তো উনিই তারিখটা ভুল বলেছেন।’
‘হ্যাঁ, তা হতে পারে। তবে আমি তাঁর নিজের মুখে ঘটনাটা শুনতে চাই।’
‘আবার শুনতে চান?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘বিশ্বাস করতে না চাইলে করবেন না। আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?’
মিসির আলি বললেন, ‘আপনি কি একটু যাবেন আমার সঙ্গে?’
‘কোথায়?’
‘ঐ জায়গায়।’
‘কেন?’
‘তাহলে জেনে আসতাম তারিখটা বার কিনা।’
‘আপনি কি পাগল নাকি ভাই?’
মিসির আলি বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব জরুরি। আমাকে জানতেই হবে।’
‘জানতে হলে আপনি যান। আমি আপনাকে ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।’
‘আপনি যাবেন না?’
‘জ্বি-না। আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানর সময় আমার নেই।’
‘এটা আজেবাজে ব্যাপার না।’
‘আমার কাছে আজেবাজে। আমার যাবার প্রশ্নই ওঠে না।’
মিসির আলি মুখ কালো করে উঠে গেলেন। আমি মনে মনে বললাম, ভালো পাগলের পাল্লায় পড়েছি। লোকটা মনে হল অ্যাবনর্মাল। অ্যাবনর্মাল সাইকোলজি করতে-করতে নিজেও ঐ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরা দেখি বিপজ্জনক ব্যক্তি!
মিসির আলি যে কী পরিমাণ বিপজ্জনক ব্যক্তি তা টের পেলাম দিন দশেক পর। আমার ঠিকানায় মিসির আলির এক চিঠি এসে উপস্থিত।
‘ভাই,
আপনি কেমন আছেন?
আমি সুধাকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখা হয় নি। উনি তাঁর দূর সম্পর্কের এক বোনের বাড়ি চলে গিয়েছেন বলে দেখা হয় নি। শুনলাম, তিনি সেখানে পুরো গরমের ছুটিটা কাটাবেন। যাই হোক, ওঁর অনুপস্থিতিতে আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। থানায় গিয়ে থানার রেকর্ডপত্র দেখেছি। ঐখানে ঘটনার তারিখ ২৩শে অক্টোবর দিবাগত রাত। অর্থাৎ ১১ই কার্তিক। কাজেই সুধাকান্তবাবু তারিখ বলায় একটু ভুল করেছেন বলে মনে হয়। আমি স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ঐদিন সুধাকান্তবাবু ঠিকই সারা দিন ক্লাস করেছেন। কাজেই সুধাকান্তবাবু মিথ্যা বলেন নি। তারিখে ভুল করেছেন।
তারিখ ভুল করা খুব অস্বাভাবিক নয়। ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তি তেমন ভালো না। কারণ আপনার মুখেই শুনেছি দ্বিতীয় বার যখন তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়, তখন তিনি আপনাকে চিনতে পারেন নি।
থানার ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম—পোস্টমর্টেম করা হয়েছিল কি?
উনি বললেন—পোস্টমর্টেমের মতো অবস্থা ছিল না। কুকুর সব ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। ছিন্নভিন্ন কিছু অংশ ছড়িয়ে ছিল। গ্রামের অন্যরাও তাই বলল।
মেয়েটি কোথাকার তাও জানা যায় নি। আমি এত দিন পর এ-সব খোঁজ করছি দেখে তারা প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে আমাকে আগ্রহ করে সাহায্য করেছে, কারণ তাদের বলেছি আমার কাজই হচ্ছে রহস্যময় ঘটনা সংগ্রহ করা। গ্রামবাসীদের ধারণা, মেয়েটির অশরীরী আত্মা এখনো ঐ বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। নানান রকম শব্দ শোনা যায়। মেয়েলি কান্না, দরজা-জানালা আপনা-আপনি বন্ধ হওয়া—এইসব। আমি ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে দু’ রাত এই বাড়ির উঠোনে বসে ছিলাম। তেমন কিছু দেখি নি বা শুনি নি। তবে এক বার বাড়ির পিছনে মানুষ দৌড়ে যাবার শব্দ শুনেছি। এটা শেয়ালের দৌড়ে যাবার শব্দও হতে পারে। সারা জীবন শহরে মানুষ হয়েছি বলে এই জাতীয় শব্দের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই।
আপনাকে চিঠিতে সব জানাচ্ছি, কারণ আমার শরীরটা খুবই খারাপ। ওখান থেকে এসেই প্রবল জ্বরে পড়ে যাই। এক বার রক্তবমি হয় বলে ভয় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখন আছি মিডফোর্ড হাসপাতালে। ওয়ার্ড দু’ শ তেত্রিশ। বেড নাম্বার সতের। আপনি যদি আসেন তাহলে খুব খুশি হব। সুধাকান্তবাবু প্রসঙ্গে একটা জরুরি আলাপ ছিল। আশা করি আপনি ভালো আছেন।’
আমি এই চিঠি ফেলে দিলাম। একটা পাগল লোককে শুরুতে খানিকটা প্রশ্রয় দিয়েছি বলে আফসোস হতে লাগল। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এই লোক আমার পিছনে জোঁকের মতো লেগে থাকবে এবং জীবনটা অস্থির করে তুলবে।
তাকে হাসপাতালে দেখতে যাবার পিছনেও কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। দেখতে যাওয়া মানে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া। দূরে-দূরে থাকাই ভালো। দেখা হলে বলা যাবে—চিঠি পাই নি। বাংলাদেশে চিঠি না-পাওয়া এমন কিছু অবিশ্বাস্য ব্যাপার না। খুবই স্বাভাবিক।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাসপাতালেই নিতান্ত কাকতালীয়ভাবে মিসির আলির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। টেম্পোর সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করে আমার এক কলিগ পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁকে দেখে ফিরে আসছি, হঠাৎ শুনি পিছন থেকে চিকন গলায় কে যেন আমাকে ডাকছে, ‘হুমায়ূন সাহেব। এই যে হুমায়ূন সাহেব।’
তাকিয়ে দেখি আমাদের মিসির আলি।
বিছানার সঙ্গে মিশে আছেন। গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। চিঁচিঁ আওয়াজ হচ্ছে। আমি বললাম, ‘আপনার এ কী অবস্থা!’
‘অসুখটা কাহিল করে ফেলেছে। গত কাল পর্যন্ত ধারণা ছিল মারা যাচ্ছি। আজ একটু ভালো।’
‘ভালোর বুঝি এই নমুনা?’
‘রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়েছে। তবে ব্যথা সারে নি। ভাই, বসুন। আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন, বড়ই আনন্দ হচ্ছে। আসছেন না দেখে ভাবছিলাম হয়তো চিঠি পান নি।’
আমি খানিকটা লজ্জিত বোধ করতে লাগলাম। একবার ইচ্ছা হল সত্যি কথাটা বলি। বলি যে, তাঁকে দেখতে আসি নি, ভাগ্যচক্রে দেখা হয়ে গেল। পরক্ষণেই মনে হল, সব সত্যি কথা বলতে নেই!
‘হুমায়ূন সাহেব।’
‘জ্বি?’
‘বসুন ভাই, একটু বসুন।’
আমি বসলাম। মিসির আলি বললেন, ‘আপনাকে দেখে ভালো লাগছে। একটা বিশেষ কারণে মনটা খুব খারাপ ছিল।’
‘বিশেষ কারণটা কী?’
‘এগার নম্বর বেডটার দিকে তাকিয়ে দেখুন। আলসারের পেশেন্ট। কিছু খেতে পারে না। হাসপাতাল থেকে যে-খাবার দেয়, সবটাই রেখে দেয়। তখন কী হয় জানেন, তার ছোটভাই সেটা খায়। খুব তৃপ্তি করে খায়। দিন-রাত বড় ভাইয়ের কাছে সে যে বসে থাকে, ঐ খাবারের আশাতেই বসে থাকে। আজ কী হয়েছে জানেন? বড়ভাইয়ের শরীর বোধহয় একটু ভালো হয়েছে, সে তার খাবার সব খেয়ে ফেলেছে। ছোট ভাইটা অভুক্ত অবস্থায় সারা দিন বসে আছে। অসম্ভব কষ্ট হয়েছে আমার, বুঝলেন। চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আমাদের দেশের মানুষগুলো এত গরিব কেন বলুন তো ভাই?’
আমি মিসির আলির প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। এগার নম্বর বেডের দিকে তাকালাম। ষোল-সতের বছরের এক জন যুবক অসুস্থ ভাইয়ের পাশে বসে আছে। আমি বললাম, ‘ছেলেটি কি এখনো না-খেয়ে আছে?’
‘হ্যাঁ। আমি নার্সের হাতে তার জন্যে পঞ্চাশটা টাকা পাঠিয়েছিলাম। সে রাখে নি। বড়ই কষ্ট হচ্ছে হুমায়ূন সাহেব।’
আমি মিসির আলির হাত ধরলাম। এই প্রথম বুঝলাম—এই মানুষটি আমাদের আর দশটি মানুষের মতো নয়। এই রোগা আধপাগলা মানুষটির হৃদয়ে সমুদ্রের ভালবাসা সঞ্চিত আছে। এদের স্পর্শ করলেও পুণ্য হয়।
‘হুমায়ূন সাহেব।’
‘জ্বি?’
‘এই খাতাটা আপনি মনে করে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।’
‘কী খাতা?’
‘সুধাকান্তবাবুর বিষয়ে এই খাতায় অনেক কিছু লিখে রেখেছি। বাসায় নিয়ে মন দিয়ে পড়বেন।’
‘শরীরের এই অবস্থায়ও আপনি সুধাকান্তবাবুকে ভুলতে পারেন নি?’
‘হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে এইটা নিয়েই শুধু ভাবতাম। কিছু করার ছিল না তো। অনেক নতুন-নতুন পয়েন্ট ভেবে বের করেছি। সব লিখে ফেলেছি।‘
‘ভালো করেছেন। এখন বিশ্রাম করুন। আমি খাতা নিয়ে যাচ্ছি। কাল আবার আসব।‘
মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, ‘এক বার কি চেষ্টা করে দেখবেন ঐ ছেলেটিকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়ান যায় কি না?’
‘আমি দেখব। আপনি এই নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।’
‘আমি ব্যস্ত হচ্ছি না।’
চলে আসার আগে-আগে মিসির আলি বললেন, ‘আপনি কষ্ট করে আমাকে দেখতে এসেছেন, আমি খুবই আনন্দিত।’
আমি আবার লজ্জা পেলাম।