দুপুরবেলা হঠাৎ চারদিক অন্ধকার করে ঝড় এল।
জামগাছ থেকে শনশন শব্দ উঠতে লাগল, একতলার কলঘরের টিনের চাল উড়ে চলে গেল। ঝড় একটু কমতেই শুরু হল বর্ষণ। তুমুল বর্ষণ। দরজা-জানালা সব বন্ধ, তবু ফাঁক দিয়ে পানি এসে ঘর ভাসিয়ে দিল। কাদের মহা উৎসাহে ছোটাছুটি করছে। এক বার নিচে যাচ্ছে, আবার উপরে উঠে আসছে। তার ব্যস্ততা সীমাহীন ব্যস্ততা। আমি চা করতে বলেছিলাম, সে তার ধার দিয়েও যাচ্ছে না। এক বার এসে হাসিমুখে বলল, বিলু আফার ঘরের একটা জানালার কাম সাফ। উইড়া গেছে।
উল্লসিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু কাঁদেরের মনস্তত্ত্ব বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, হাসি তামাশার কী আছে। এর মধ্যে?
ঠিক এই সময় একতলা থেকে নেজাম সাহেব ভীত স্বরে ডাকতে লাগলেন, শফিক ভাই শফিক ভাই। আমার উত্তর দেবার আগেই কাদের মিয়া বিদ্যুৎগতিতে নিচে নেমে গেল। সেখান থেকে সেও চেঁচাতে লাগল, ও ছোড মিয়া, ও ছোড মিয়া। আমি গিয়ে দেখি জলিল সাহেব। মাথার চুল কামান। গায়ে একটি গেঞ্জি এবং ফুল প্যান্ট।
আমাকে দেখে বললেন, ভালো আছেন শফিক ভাই?
নেজাম সাহেব বললেন, হাতটার অবস্থা দেখেছেন?
হাতের দিকে তাকিয়ে আমি শিউরে উঠলাম। তাঁর বা হাতটি কনুইয়ের নিচ থেকে শুকিয়ে গেছে। আমি বললাম, আপনার বউ আর মেয়ে ভালো আছে। আপনার ভাই এসে তাদের নিয়ে গেছে। চাঁদপুর।
জলিল সাহেবের কোনো ভাবান্তর হল না। থেমে থেমে বললেন, খিদে লাগছে, ভাত খাব।
ভাত খেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল তাঁর প্রচণ্ড জ্বর। চোখ রক্তবর্ণ। মনে হল কাউকে চিনতে পারছেন না।
নেজাম সাহেব বললেন, জলিল ভাই আমাকে চিনতে পারছেন? আমি নেজাম।
জলিল সাহেব উত্তর দিলেন না।
কি, চিনতে পারছেন না?
জলিল সাহেব বললেন, পানি দেন ভাইসব, তিয়াস লাগে।
কাদের দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার আনল। আর আমাদের সবাইকে স্তম্ভিত করে জলিল সাহেব রাত একটার সময় মারা গেলেন। মারা যাবার আগমুহূর্তে খুব সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মতো কথাবার্তা বললেন। বউ কোথায়? মেয়েটি কেমন আছে জিজ্ঞেস করলেন খুটিয়ে খুঁটিয়ে। নেজাম সাহেব বললেন, হাতটা এ রকম হল কেন?
জলিল সাহেব তার উত্তর দিলেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এত দিন কোথায় ছিলেন?
মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। গুলিস্তানের কাছ থেকে।
কবে ছেড়েছে?
গত পরশু।
বলেন কী! এই দুই দিন তাহলে কোথায় ছিলেন?
জলিল সাহেব তার উত্তর দিলেন না। এর কিছুক্ষণ পরই তাঁর মৃত্যু হল। আমি চলে এলাম উপরে। এসে দেখি মতিনউদ্দিন সাহেব ইজি চেয়ারে বসে হাউমাউ করে কাঁদছেন।
ঝড়-বৃষ্টি কেটে গিয়ে মধ্যরাতে আকাশ কাঁচের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রকাণ্ড একটি চাঁদ ঝকমক করতে লাগল। সেখানে। সেই অসহ্য জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে থেকে শুনলাম, অনেক দিন পর জলিল সাহেবের বউ কাঁদছে। সরু মেয়েলি গলায় গাঢ় বিষাদের কান্না।
কে কাঁদছে?
কাদের মিয়া বলল, বিলু, আফা কানতাছে।
বিলু নীলু দুই বোন সমস্ত রাত জলিল সাহেবের মাথার পাশে বসে রইল।