॥ ৬ ॥
রাত্রে ডিনার সেরে ঘরে বসে আড্ডা মারছি, ফেলুদা সবে একটা চারমিনার ধরিয়েছে, এমন সময় লালমোহনবাবু হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন।
‘এত তাড়া কিসের?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
‘আরে মশাই, শতদল একটা বই পড়তে দিয়েছে না— সেটা ছাড়তে পারছি না। টম ম্যাক্সওয়েল যে পাংখা-পুলারকে জুতিয়ে মারার গল্প বলল, সেই ঘটনা এই বইতে রয়েছে।’
‘বটে?’
‘বইটার নাম লাইফ অ্যান্ড ওয়র্ক ইন বীরভূম; লিখেছেন এক পাদ্রী, নাম রেভারেন্ড প্রিচার্ড। গত সেঞ্চুরির শেষের দিকের ঘটনা। রেজিন্যাল্ড ম্যাক্সওয়েল তার চাকরকে খুন করে কিন্তু সেই খুনের জন্য কোনো শাস্তি তাকে কোনোদিন ভোগ করতে হয়নি। এই চাকরের নাম ছিল হীরালাল।
মারা যাওয়াতে তার ছেলে অনাথ হয়ে পড়ে। এই পাদ্রী তখন ছিলেন শিউড়িতে। তিনি খুনের খবরটা পেয়ে ম্যাক্সওয়েলের নীলকুঠিতে যান। সেখানে এগার বছরের অনাথ অনন্ত নারায়ণকে দেখে ভারী দুঃখ পান। তখনই ছেলেটির ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করেন। তারপর ছেলেটিকে ক্রিশ্চান করে একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করেন। এই পর্যন্ত পড়েছি মশাই। সেই ছেলেটির কী হল জানার জন্য প্রাণটা আঁকুপাঁকু করছে, সো প্লীজ এক্সকিউজ—’
দরজায় টোকা। খুলে দেখি পিটার রবার্টসন।
‘মে আই কাম ইন?’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’
ফেলুদা উঠে দাঁড়াল। লালমোহনবাবু আবার বসে পড়লেন। পিটারকে গম্ভীর দেখাচ্ছে; কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়ই।
‘কী ব্যাপার পিটার?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু সেল দ্য রুবি।’
‘সে কি! বসো, বসো বসো— কথা বল।’
পিটার বসল। তারপর বলল, ‘এই দূর দেশে এসে বন্ধু-বিচ্ছেদের কথা ভেবে মনটা বড় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। টম বদ্ধপরিকর যে পাথরটা বেচে যা টাকা আসবে তাই দিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বেরোবে। এই ধারণাটা ওকে একেবারে নেশার মতো পেয়ে বসেছে। আর আমিও ভেবে দেখলাম— মিউজিয়ামে দিলে ক’জনে আর পাথরটার কথা জানতে পারবে? তাই অনেক ভেবে-চিন্তে⋯অবশেষে⋯’
ফেলুদা গম্ভীর। বলল, ‘তোমাদের সিদ্ধান্ত আমি নাকচ করার কে? তবে অনেক আশা করেছিলাম যে তোমার সিদ্ধান্তই কায়েমি থাকবে। এখন দেখছি তা নয়।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘কবে বিক্রি করার কথা ভাবছ তুমি?’
‘প্রথম অফার যখন ঢানঢানিয়ার তখন ওকেই দেব ভাবছি। ওর সঙ্গে টেলিফোনেও কথা হয়ে গেছে। পরশু সকাল দশটায় টাইম দিয়েছে।’
‘একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটবে বলেছিলে, এখন সেটা একটা মামুলি ঘটনায় পর্যবসিত হল,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ফেলুদা।
‘আই অ্যাম ভেরি সরি।’
পিটার চলে গেল। রবার্টসনের রুবির সঙ্গে ব্যবসার ব্যাপারটা জড়িয়ে জিনিসটা কেমন জানি জোলো হয়ে গেল।
আমরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে পরদিন সকালে গিয়ে বক্রেশ্বরটা দেখে আসব। ব্রেকফাস্ট খাবার দশ মিনিটের মধ্যে মিঃ নস্কর তাঁর গাড়িতে এসে টুরিস্ট লজের রিসেপশন বিল্ডিংটার সামনে হাজির হলেন।
‘গুড মর্নিং।’
আমরা লাউঞ্জে দাঁড়িয়েছিলাম, সকলেই গুড মর্নিং বললাম।
‘আজ ফুলবেড়ে গ্রামে চাঁদনি রাতে জবর সাঁওতাল নাচের বন্দোবস্ত হয়েছে।’
‘হঠাৎ?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘একদল জাপানী ট্যুরিস্ট এসেছে। তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি এসেছি আপনাদের আমার ওখানে ইনভাইট করতে। রাত্রে ডিনার। তারপর দশটা নাগাদ দু’ মাইল দূরে সাঁওতাল গ্রামে গিয়ে নাচ দেখা। কেমন?’
ফেলুদা বলল, ‘ইনভাইট করছেন মানে সবাইকে?’
‘এভরিওয়ান। আপনারা তিনজন এবং সাহেব দুজন।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ,’ বলল ফেলুদা। ‘ক’টায় আসব?’
‘এই আটটা নাগাদ। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব কি?’
‘না না,’ বলল ফেলুদা। আমরা ত ড্রাইভার নিয়ে সবশুদ্ধ ছ’জন—কোনো অসুবিধা হবে না।’
‘ভেরি ওয়েল। গুড ডে।’
বক্রেশ্বর গিয়ে মনে হল সেই কোন আদ্যিকালে এসে পড়েছি। সামনে সারি সারি মন্দির, পিছনে জঙ্গল। তার মধ্যে বটগাছই বেশি। কোনো কোনো বটগাছ থেকে ঝুরি নেমে এসে মন্দিরকে আঁকড়ে ধরেছে। এতগুলো মন্দির আর এতগুলো কুণ্ড, জগন্নাথবাবু দেখলাম সবগুলোর নাম জানেন। লালমোহনবাবু পুজো দিলেন। কারণ বললেন, ‘না দিলে নিজেকে বড় বে-ধার্মিক মনে হচ্ছে।’ দুজন সাহেবের একজন—পিটার রবার্টসন—সুইমিং ট্রাকস্ পরে সৌভাগ্য কুণ্ডে সাঁতার কাটল। কুণ্ডের নামের মানেটা আগেই জেনে নিয়েছিল। তাই বলল, ‘দিস উইল ব্রিং মি গুড লাক্।’ মন্দিরের আগেই ভিখিরির দল। তাই টম ম্যাক্সওয়েলের ফোটোজেনিক বিষয়ের অভাব ঘটেনি।
লজে ফিরে আসার আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফেলুদার একটা ফোন এল। ইন্সপেক্টর চৌবে। জিজ্ঞেস করলো আমরা সাঁওতাল নাচের খবরটা পেয়েছি কিনা। ফেলুদা অবিশ্যি নস্করের বাড়িতে ডিনারের খবরটাও দিয়ে দিল। বলল, সেখান থেকে আমরা নাচ দেখতে যাবো। চৌবে বললেন তিনিও সাড়ে দশটা নাগাদ যাবেন, কাজেই ওখানেই আমাদের সঙ্গে দেখা হবে।
মিঃ নস্কর ভালোরকম ডিরেকশন দিয়ে দিয়েছিলেন। তাই ওঁর বাড়ি পেতে দেরি হল না। বেশ বড় দোতলা বাড়ি, সামনে ফুলের বাগান, গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকে পোর্টিকোর নিচে থামল।
নস্কর আমাদের জন্যে অপেক্ষাই করছিলেন, আমরা গাড়ি থেকে নামতে আমাদের আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। একটা সুসজ্জিত বৈঠকখানায় গিয়ে আমরা ক’জন বসলাম। সাহেবদের জন্য ইংরিজিতেই কথাবার্তা হল।
‘একা মানুষের পক্ষে ত আপনার বিরাট বাড়ি দেখছি’, বলল ফেলুদা।
‘একা বটেই, তবে আমার বন্ধু-বান্ধব অনেক। তাদের চার-পাঁচজনকে ধরে নিয়ে প্রায়ই এখানে ছুটি কাটিয়ে যাই।’
নস্কর আর দুই সাহেবের জন্য হুইস্কি এল, আর আমরা ও রসে বঞ্চিত জেনে আমাদের জন্য লিমকা।
লালমোহনবাবুর দিকে দৃষ্টি দিয়ে হঠাৎ নস্কর বললেন, ‘আপনার বন্ধু যে গোয়েন্দা সে আমি নাম শুনেই বুঝেছি। কিন্তু আপনার সঠিক পরিচয়টা পাওয়া যায়নি। এখন জিজ্ঞেস করতে পারি কি?’
উত্তর দিল ফেলুদা।
‘ওর আসল নামটা অনেকেই জানে না। উনি ছদ্মনামে থ্রিলার লেখেন। সেই নামটা হল জটায়ু। জনপ্রিয়তায় উনি নাম্বার ওয়ান বললে বেশি বলা হবে না।’
‘ঠিক, ঠিক—আমি পড়েছি আপনার লেখা। “সাংঘাইয়ে সংঘাত”—কেমন, ঠিক বলিনি?’
লালমোহনবাবু একটা বিনয়ী হাসি হাসলেন।
‘আমি সিরিয়াস বই একদম পড়তে পারি না,’ বললেন নস্কর। ‘বিলিতি ক্রাইম ফিকশন পড়ি আর মাঝে মাঝে দু-একটা দিশিও চেখে দেখি। এখন কী লিখছেন?’
‘আপাতত রেস্ট। গত পুজোয় একটা বেরিয়েছে। নাম শুনে থাকতে পারেন—লন্ডনে লণ্ডভণ্ড।’
‘এটাও কি হিট?’
‘সাড়ে চার হাজার কপি নিঃশেষ—হেঃ হেঃ!’
মিঃ নস্কর আসল প্রসঙ্গে যেতে বেশি সময় নিলেন না। পিটারের দিকে ফিরে বললেন, ‘আমার প্রস্তাবটা নিয়ে কি আপনি কিছু ভেবেছেন?’
‘আমি পাথরটা বিক্রি করে দিচ্ছি?’ বলল পিটার।
‘দ্যাট্স এক্সেলেন্ট।’
‘কিন্তু আপনাকে না।’
‘ঢানঢানিয়া?’
‘হ্যাঁ। উনিই প্রথম অফার দিয়েছিলেন তাই⋯’
‘নো, মিঃ রবার্টসন, আপনি ওটা আমাকেই বিক্রি করবেন।’
‘সে কি করে হয়? আই হ্যাভ সেট-আপ মাই মাইন্ড।’
‘কী করে হয় আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। কারণটা আমি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির মুখ দিয়ে শুনিয়ে দিচ্ছি। —মিঃ গাঙ্গুলি!’
‘আগ্-গেঁ?’
ডাকটা এত অপ্রত্যাশিত যে লালমোহনবাবুর গলা চিরে দু-ভাগ হয়ে গেল।
‘আপনি কাইন্ডলি যদি এই কার্পেটের সামনেটায় এসে দাঁড়ান!’
‘আ-আমি?’
‘আপনিই সবচেয়ে নিরপেক্ষ এবং সবচেয়ে অমায়িক। আপনি ভয় পাবেন না। আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। আমার একটা বিশেষ ক্ষমতার কথা আপনাদের বলা হয়নি। আমি সকলকে হিপনোটাইজ করতে পারি। সেই অবস্থায় তাদের নানারকম প্রশ্ন করে সঠিক জবাব পেতে পারি। হিপ্নোটাইজড্ ব্যক্তি কখনো মিথ্যা বলে না। কারণ সেই ক্ষমতাটা তাদের সাময়িকভাবে লোপ পেয়ে যায়। সেই জায়গায় নতুন ক্ষমতা আসে। সেটার পরিচয় আপনারা এখনই পাবেন।’
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে লালমোহনবাবু আপত্তি করার কোনো সুযোগই পেলেন না। ফেলুদাও দেখলাম নির্বিকার। আসলে লালমোহনবাবুকে নিয়ে কেউ রগড় করলে ও সেটা বেশ উপভোগ করে।
নস্কর উঠে গিয়ে লালমোহনবাবুর কাঁধ ধরে তাঁকে একরকম টেনে এনেই ঘরের মাঝখানে দাঁড় করালেন। তারপর নিজেই গিয়ে ঘরের বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট্ট লাল টর্চ বার করে সেটা জ্বালিয়ে জটায়ুর চোখের উপর ফেলে আলোটাকে ঘোরাতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে তার কথাও শুরু হল।
‘আপনি সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভর করুন, আমার উপর নির্ভর করুন। আপনার নিজের সত্তা লোপ পেতে বসেছে, সেই জায়গায় আসছে একটি অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞ মানুষ। ⋯ইয়েস⋯ইয়েস⋯ইয়েস⋯ইয়েস⋯’
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লালমোহনবাবুর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে, তাঁর মুখ হাঁ হয়ে আসছে। তিনি সটান চেয়ে আছেন নস্করের দিকে।
এবার টর্চ ঘোরানো থামল, কিন্তু নস্কর সেটা লালমোহনবাবুর মুখের উপর ফেলে রাখলেন। তারপর এল প্রথম প্রশ্ন।
‘আপনার নাম কী?’
‘শ্রী সর্বজ্ঞ গঙ্গোপাধ্যায়, ওরফে লালমোহন, ওরফে জটায়ু।’
লালমোহনবাবুর এ নাম আমি কখনো শুনিনি।
‘এ ঘরে ক’জন উপস্থিত আছে?’
‘ছয় জন।’
‘তাদের সবাই কি বাঙালি?’
‘দুজন সাহেব।’
‘তাদের নাম কী?’
‘পিটার রবার্টসন আর টম ম্যাক্সওয়েল।’
‘তাঁরা কোত্থেকে আসছেন?’
‘ল্যাঙ্কেশিয়ার, ইংল্যান্ড।’
‘এঁদের বয়স কত?’
‘পিটার চৌত্রিশ বছর তিন মাস, টম তেত্রিশ বছর নয় মাস।’
এঁদের ভারতবর্ষে আসার উদ্দেশ্য কী?’
‘পিটারের উদ্দেশ্য রবার্টসনের রুবি ফেরত দেওয়া।’
‘সে রুবি কার কাছে আছে?’
‘টম ম্যাক্সওয়েল।’
‘এই রুবির ভবিষ্যৎ কী?’
‘ওটা বিক্রি হবে।’
‘সেটা কি গণেশ ঢানঢানিয়া কিনবে?’
‘না।’
‘কিন্তু উনি ত দর দিয়েছেন?’
‘এবার দশ লাখ নেমে হবে সাড়ে সাত।’
‘তার মানে পিটার বিক্রি করবে না?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘ওটা অন্য একজন কিনবেন?’
‘কে?’
‘অর্ধেন্দু নস্কর।’
‘কত দাম?’
‘বারো লাখ।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।’
এবার নস্কর লালমোহনবাবুর কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিতেই তিনি ধড়মড়িয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন।
‘ওয়েল মিস্টার রবার্টসন?’
নস্কর পিটারের দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করলেন।
‘দ্যাট ওয়জ মোস্ট ইমপ্রেসিভ।’
‘এখন বিশ্বাস হল?’
‘আই ডোন্ট নো হোয়াট টু থিঙ্ক।’
‘তোমাকে ভাবতে হবে না। তাড়া নেই। তুমি ঢনঢানিয়ার সঙ্গে কাল দেখা কর। সাড়ে সাত লাখে তোমার রুবি বিক্রি করতে চাও ত পার। তা না হলে আমার বারো লাখের অফার ত রয়েইছে।’
চাকর এসে খবর দিল ডিনার রেডি।
আমরা সকলে উঠে ডাইনিং রুমের উদ্দেশে রওনা দিলাম।