০৬. ঘরে ঝলমলে রোদ

নবনীর ঘুম ভাঙ্গল অনেক বেলায়।

ঘরে ঝলমলে রোদ। জানালা ভেঙে পায়ের পাতায় রোদ পড়েছে। পা চিড়বিড় করছে। শরীরে আরামদায়ক আলস্য। রোদ থেকে পা সরিয়ে নিতেও আলসেমি লাগছে। রাতে রেললাইন ঘটিত দুঃস্বপ্নের পরেও ঘুম যে শুধু ভালো হয়েছে তা-না, খুব ভালো হয়েছে। ঘুমের ট্যাবলেট চমৎকার কাজ করেছে। ট্যাবলেটের নাম ধাম জেনে নিতে হবে।

সকালে জেগে ওঠার পরের দশ মিনিটের আলসেমির আনন্দের সীমা নেই। নবনীর খাটে উঠে বসতেও ইচ্ছা করছে না। কেউ যদি টেনে বিছানায় বসিয়ে দিত! কাজের ছেলেটার নাম মনে পড়ছে না। তাকে ডেকে ফুটন্ত পানির কথা বলতে হবে। এই ছেলে চা কেমন বানায় এখনো জানা হয় নি। দিনের প্রথম চা-টা খারাপ হলে পুরো দিনটাই নষ্ট হবে। দিনের প্রথমটা এবং রাতে ঘুমুতে যাবার আগে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি–নবনীর জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে যে ক’দিন এখানে থাকবে–ঠাণ্ডা পানির সমস্যা হবে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে ঠাণ্ডা পানি পাওয়া যাবে না, এটা ভেবে নবনীর এখনি খারাপ লাগছে।

আনিস যে বাড়িতে নেই এটা বুঝা যাচ্ছে। সিক্সথ সেন্স কি-না কে জানে! কে বাড়িতে আছে কে নেই এটা নবনী চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে। কেউ যখন বাড়িতে থাকে তখন তার শরীরের জীবন্ত গন্ধ বাড়িতে ভাসতে থাকে। সে চলে গেলে গন্ধটা চলে যায়–ছোটবেলায় এই পরীক্ষা সে অনেকবার দিয়ে অনেক লোকজনকে চমৎকৃত করেছে। এখনো এই পরীক্ষা দিলে ভালো নম্বর পাবে।

নবনী উঠে বসল। এমিতেই ঘুম ভাঙার পর তার মন প্ৰফুল্প ছিল–উঠে বসার পর মন প্ৰফুল্লতম হয়ে গেল। খাটের মাথার পাশে রাখা টেবিলে ফ্লাস্ক। ফ্লাস্কের পাশে টি ব্যাগ, চিনি, দুধ। কাজটা আনিস করে গেছে। ফ্লাস্কে গরম পানি যে আছে এটা নিশ্চিত। নবনী টেবিলের দিকে হাত বাড়াল। ফ্লাস্কের পাশে খাম। আনিস চিঠি লিখে গেছে। আনিসের হাতের লেখা ডাক্তারদের হাতের লেখার মতো জড়ানো না, স্পষ্ট সুন্দর অক্ষর। নবনী খাম খুলে চিঠি বের করল।

নবনী,

খুব আরাম করে ঘুমাচ্ছ বলে ঘুম ভাঙালাম না। সকাল আটটায় আমাকে ক্লিনিকে যেতে হয়। ভেবেছিলাম। আজ ছুটি নিয়ে তোমার ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করব। সম্ভব হলো না। ফ্লাস্ক ভর্তি গরম পানি রেখে গেলাম। আরো কিছু যদি লাগে– সুজাত মিয়াকে বলবে। সে ব্যবস্থা করবে। সে কথা বলে না, কিন্তু কাজে খুব দক্ষ। নাশতা খেয়ে নিও। আমার ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে। দুপুরে কী খেতে চাও সুজাত মিয়াকে বলবে। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে বললেই সুজাত রোধে দেবে। ও সব রান্না জানে।

–আনিস

নবনী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গম্ভীর গলায় ডাকল–সুজাত মিয়া।

সুজাত দরজা ধরে দাঁড়াল। তার চোখ মেঝেতে। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে সে মেঝেতে অদৃশ্য নকশা করছে। দৃষ্টি সেই নকশায় নিবন্ধ। সুজাত মিয়া যে শুধু কথাই কম বলে তা-না, চোখের দিকেও তাকায় না।

তোমার ভাইজান চিঠিতে লিখেছে। আমি দুপুরে যা খেতে চাই তাই রোধে খাওয়াবে। পারবে?

সুজাত চোখের দিকে না তাকিয়েই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। নবনী গম্ভীর গলায় বলল, দুপুরে আমি পিজা খেতে চাই। পিজা বানাবে, ঠিক আছে?

সুজাত এবার চোখের দিকে তাকাল। এবং চট করে চোখ নামিয়ে নিল না, তাকিয়েই রইল। নবনী বলল–আমি এ বাড়িতে আসার পর থেকে লক্ষ করেছি তুমি কারোর চোখের দিকে তাকাও না। ক্রমাগত মেঝের দিকে তাকিয়ে থাক বলে তোমার ঘাড়াও বকের মতো বেঁকে গেছে। তুমি যাতে আমার চোখের দিকে তাকাও এজন্যেই পিজা খেতে চেয়েছি। আমি নিশ্চিত ছিলাম পিজা খেতে চাই শুনলেই তুমি চমকে আমার চোখের দিকে তাকাবে। বুঝতে পারছ কি বলছি? নবনী হাসিমুখে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছে।

সুজাত মিয়া উত্তর দিল। না। চুপ করে রইল। নবনী বলল, এখন তোমাকে চা বানানো শেখাব। মন দিয়ে শিখবে। এরপর থেকে যেভাবে শেখালাম ঠিক সেইভাবে চা বানিয়ে দেবে। পারবে না?

সুজাত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। নবনী বলল, চা বানানো শেখাবার পর আমি তোমাকে নিয়ে গ্রাম দেখতে বের হব। তোমাদের এখানে শ্মশান ঘাট আছে। তোমার ভাইজানের চিঠি পড়ে জেনেছি সেখানে শ্মশান বন্ধুদের একটা বসার ঘর আছে যার মেঝে, শ্বেত পাথরে বাঁধানো–আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে?

জ্বি, আইচ্ছা।

এইতো কথা বলেছ! এখন থেকে আমার সঙ্গে কথা বলবে–এসো এখন চা বানানো শেখাই–ওয়ার্কশপ অন টি মেকিং।

সুজত ফিস ফিস করে বলল, চা বানাইতে জানি।

নবনী কড়া গলায় বলল, বাজে কথা বলবে না–চা বানানো রন্ধনশিল্পের অতি কঠিন অংশ। খুব কম মানুষই এটা জানে। আমি কী করছি মন দিয়ে দেখ। প্রথমে কাপে দুটা টি ব্যাগ নিলাম। এক চামচ গরম পানি ঢেলে দিলাম টি ব্যাগে। ক্যাগের ভেতরের শুকনা। চা-পাতা এই পানিতে নরম হতে থাকবে। এই ফাঁকে চায়ের কাপ, চামচ ধুয়ে ফেলতে হবে গরম পানিতে… গরম পানিতে চায়ের চামচ, ধোয়া অতি জরুরি। এতে চামচটা গরম হয়। তা না করলে ঠাণ্ডা চামচ চা থেকে অনেকটা তাপ নিয়ে নেবে। চা হয়ে যাবে ঠাণ্ডা।

সুজাত কাছে এগিয়ে এসেছে। খুবই আগ্রহ নিয়ে চা বানানো দেখছে। সে নবনীর চোখের দিকে কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়াই তাকাচ্ছে।

নবনী বলল, তোমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন গিয়েছে না?

সুজাত মাথা নাড়ল। নবনী বলল, মাথা নাড়ানাড়ি করবে না, মুখে কথা বল। গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন গিয়েছে?

দূর আছে। জংলা পার হইয়া যাইতে হয়।

তোমাদের এদিকে জঙ্গল আছে না-কি?

হুঁ।

কত দূর?

মেলা দূর।

হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যাবে?

ফিরতে দিরং হইব। দুপুর পার হইব।

হোক দুপুর পার–চল রেললাইন দেখতে যাব। তোমার ভাইজান দুপুরে ভাত খেতে এসে দেখবে–ঘর তালাবন্ধ, কেউ নেই। সে আমাদের কোথাও খুঁজে পাবে না। মজা ভালোই হবে। রেললাইন দেখার পর যদি দেখি হাতে সময় আছে তাহলে মন্দির দেখতে যাব।

নবনী মিটিমিটি হাসছে। সুজাত মিয়ার মনে হলো–ভাইজানের স্ত্রী মানুষটা অন্য রকম। ভাইজান ভালো, তার স্ত্রীও ভালো। দুইজন দুই রকম ভালো। একটা ব্যাপার শুধু মিলছে না। ডাক্তার সাবের পরিবার অতিরিক্ত সুন্দর। যারা অতিরিক্ত সুন্দর তারা ভালো হয় না। তাদের মধ্যে বড় কোনো দোষ থাকে। এটা পরীক্ষিত।

 

নবনীর মাথায় বাহারী লাল রঙের ছাতা। সুজাত মিয়ার কাধে ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি চায়ের সরঞ্জাম। নবনী এগুচ্ছে দ্রুত পায়ে। ঝাঁঝাঁ রোদ। কিন্তু তার হাঁটতে ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে গরম বাতাসের ঝাপ্টা চোখে মুখে লাগছে। শরীর চিড়বিড় করে উঠছে। এই চিড়বিড়ানিও ভালো লাগছে। গ্রামের মানুষজন কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে। তাদের কৌতূহলী চোখের দিকে তাকাতেও মজা লাগছে। তারা কী ভাবছে জানতে পারলে ভালো হতো। এটা সম্ভব না। সুজাত মিয়া এখন বেশ সহজভাবেই নবনীর সঙ্গে গল্প করছে। তার গল্প বলার ভঙ্গি খুবই সংক্ষিপ্ত। গল্প শুরু করে সে চুপ করে যায়। বাকি অংশ প্রশ্ন করে করে বের করতে হয়। যেমন সুজাত মিয়া বলল–মেয়ে আসছে। হইলদা বোরকা।

নবনী বলল, কোন মেয়ে এসেছে বোরকা পরে?

ইমাম সাবের।

যিনি মারা গিয়েছেন সেই ইমাম সাহেব?

হুঁ। সকিনা।

সকিনা কি মেয়ের নাম?

হুঁ।

কবে এসেছে?

আইজ সকালে। খুব কানতেছিল।

কাঁদারই তো কথা। বাবা মারা গেছে। বাবার কবর দেখতে এসেছে। কাঁদবে না তো কী করবে? খিলখিল করে হাসবে?

দুই হাত দিয়া তেতুলগাছ ধইরা কানতেছিল। যে তেতুলগাছে তার বাবা ফাঁসি দিয়েছিল সেই তেতুলগাছ!

আহারে বেচারি।

তেতুলগাছ কাটাইয়া ফেলব। চেয়ারম্যান সাব হুকুম দিছে।

তেতুলগাছ কাটাবে কেন?

তেতুল গাছে দোষ লাগছে। মানুষ যে গাছে ফাঁস নেয়। হেই গাছে দোষ লাগে।

নবনী সুজাত মিয়ার দিকে তাকাল। গল্প শেষ হয়েছে না-কি আরো কিছু বাকি আছে সেটা জানার চেষ্টা। সুজাত নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তেতুল গাছটার তেতুল ছিল খুবই মিষ্টি।

নবনী ধমক দিয়ে বলল, বাজে কথা বলবে না সুজাত মিয়া। তেতুল কখনো মিষ্টি হয় না। তেতুলি একটা টক ফল।

আরবের তেতুল মিষ্টি হয়।

এটা তো আরব না, বাংলাদেশ। তাছাড়া ঐ তেতুল গাছের তেতুল আমি খেয়েছি। ভয়ঙ্কর টক। আমার সঙ্গে কখনো বানিয়ে কথা বলবে না। আমি নিজে কখনো বানিয়ে কথা বলি না। অন্যরা বললে রাগ করি। বুঝতে পারছ?

জ্বে।

সুজাত মিয়া তোমার ক্ষিধে লেগেছে?

না।

ক্ষিধে লাগলে বলবে। ব্যাগে বিসকিট আছে। আপেল আছে। রেল লাইন আর কতদূর?

দূর নাই।

অনেকক্ষণ থেকেই তো বলছি দূর নাই। তারপরেও তো দেখা পাচ্ছি না।

সুজাত মিয়া দাঁত বের করে হাসল। কারণ অনেকক্ষণ থেকে সে যদিও দূর নেই বলছিল–এখন সত্যিই আর দূর নেই–বাঁকটা পার হলেই রেল সড়ক।

 

নবনী রেল সড়কে উঠে এসেছে। সে খুবই বিস্মিত বোধ করছে। অবিকল এ রকম রেললাইন সে স্বপ্ন দেখেছে। কোথাও দৃষ্টি আটকাচ্ছে না। যতদূর চোখ যাচ্ছে ফাঁকা মাঠ। রেললাইনের দু’পাশে কাশবন। বাতাসে কাশফুল কাঁপছে। ঢেউয়ের মতো হচ্ছে। স্বপ্নের কাশফুলগুলো এভাবেই কাঁপছিল।

রেললাইনের শ্ৰীপারে পা রেখে রেখে নবনী এগুচ্ছে। তার শরীর কেমন ঝিম ঝিম করছে। স্বপ্নে সে এভাবেই হাঁটছিল। স্বপ্নে সে ছিল একা। এখানে তার পাশে আছে সুজাত মিয়া। পা ছোট বড় হলেও সুজাত দ্রুত হাঁটতে পারে।

নবনী বলল–আশেপাশে কোনো বীজ আছে? নদীর ওপর পুল?

সুজাত মিয়া বলল–আছে।

কোথায়? সামনে না পেছনে?

সামনে। তালবন্দির পুল। যাইবেন?

নবনীর খুবই যেতে ইচ্ছা করছে। বীজটাও স্বপ্নের ব্রীজের মতো কি-না, দেখা দরকার। কিন্তু আজ না। অন্য আরেক দিন যাবে। একা একা যাবে। হয়তো কালই যাবে।

সুজাত মিয়া।

জ্বি।

যেভাবে শিখিয়েছি ঠিক সেভাবে চা বানাও তো। রেললাইনের ওপর পা ছড়িয়ে বসে চা খাব।

ট্ৰেইন আসব। ট্ৰেইন আসনের সময় হইছে। দুপুরের ট্রেইন।

আসুক না ট্রেইন। ট্রেইন ট্রেইনের মতো আসবে। আমরা আমাদের মতো চা খাব।

নবনী ট্রেনের লাইনের ওপর বসেছে। কী মনে করে যেন মাথার ওপর ধরে রাখা ছাতাটা ছুড়ে ফেলল। বাতাস লেগে সেই ছাতা ভাসতে ভাসতে কাশফুলের দিকে যাচ্ছে।

সুজাত মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে বেশ চিন্তিত বোধ করছে। জিনের আছর হয় নি তো? মেয়ে রূপবতী হলে জিনের নজর হবেই। সেই মেয়ে যদি ভর দুপুরে খোলা চুলে জঙলার ভেতর দিয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই।

 

আনিসের ক্লিনিকে আজ রোগীর খুব ভিড়। এর মধ্যে একজন এসেছে সাপেকাটা রোগী। এই সময় সাপেকাটা রোগী আসে না। শীত আসতে শুরু করেছে, সাপদের এখন দীর্ঘ দিনের জন্যে গর্তে ঢোকার প্রস্তুতি নেবার সময়। মানুষের গায়ে ছোবল দেওয়ার চেয়েও তারা ব্যস্ত থাকে ঘুমোবার আয়োজনে।

সাপেকাটা রোগীকে ঘিরে বেশ ভিড়। রোগীর বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ। অন্ত বলশালী ব্যক্তি। সে ঝিম মেরে গেছে। রোগীর ছেলেমেয়ে এবং দুই স্ত্রী চলে এসেছে। দু’জন স্ত্রীই পাল্লা দিয়ে কাঁদছে। আনিস রোগীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আগে সাপেকাটা রোগীকে কেউ ক্লিনিকে আনত না। ওঝা ডাকিয়ে ঝাড় ফুক করত। আজকাল ক্লিনিকে আনছে। আনিস এন্টি ভেনম ইনজেকশন কিছু আনিয়ে রেখেছে। ইনজেকশনগুলো দামি। ঠাণ্ডায় রাখতে হয়। ক্লিনিকে ফ্রিজ নেই। গরমে ইনজেকশনগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবার কথা। তাছাড়া একেক ধরনের সাপের জন্যে একেক রকম এন্টি ভেনম। কোন সাপে কামড়েছে তা জানা দরকার। আনিসের ধারণা গ্রামের মানুষরা সাপের সঙ্গে বাস করলেও সাপ চেনে না। সাপে কাটা রোগী, যে নিজের চোখে সাপকে ছোবল দিতে দেখেছে সেও সাপটা কী রকম বলতে পারে না। কী সাপ? প্রশ্ন করলে একটাই উত্তর–কাল সাপ।

আনিসকে দেখে রোগী হাউমাউ করে উঠল–ডাক্তার সাব আমারে বাঁচান। কাল সাপ দংশন করছে। রোগীর কান্না শুনে তার দুই স্ত্রী আরো উঁচু গলায় কান্না শুরু করল। এই দু’জনের মধ্যে পাল্লা-পাল্লি ব্যাপার আছে। দু’জনই চেষ্টা করছে কে কার চেয়ে বেশি শব্দ করে কাঁদতে পারে। রোগী ওদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল–চুপ। দু’জনই সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল।

কোথায় কামড় দিয়েছে?

বুড়া আঙ্গুলের চিপাত।

সাপটা দেখেছেন?

আবছা আবছা দেখছি–কাল সৰ্প।

দুই আঙ্গুলের ফাঁকে গভীর ক্ষত। সাপ দাঁত ফুটিয়ে এমন গভীর ক্ষত কখনোই করবে না। পুরা পা নীল হয়ে ফুলে উঠেছে। এটা হয়েছে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বঁধার জন্যে। মাংস কেটে দড়ি ডেবে আছে।

পাও জ্বইল্যা যাইতেছে ডাকতার সাব।

কতক্ষণ আগে কামড়েছে?

সইন্ধ্যা রাইতে ছোবল দিছে। পিসাব করতে জঙ্গলাতে গেছিলাম তখন ঘটনা ঘটছে। গত বচ্ছরও এই জঙ্গলাত সাপের ছোবলে মানুষ মরছে। এই বছর মরব আমি।

পায়ে বাঁধন কখন দিয়েছেন?

রাইতেই বান দিছি। খবর পাইয়া আমার বড় বউ-এর বাপের বাড়ি থাইক্যা ছোট শ্যালক আসছে। হে শক্ত বান দিছে।

আনিস বলল, আপনাকে সাপে কামড়ায় নি। কাটার খোঁচা লেগেছে। পায়ের বাঁধন খুলে দিলেই জ্বলুনি কমবে।

আমি নিজের চউক্ষে সাপ দেখছি ডাকতার সাব।

আপনার হাতে টর্চ হারিকেন এইসব কিছু ছিল?

জ্বি না। তাহলে সাপটা দেখবেন কীভাবে? জঙ্গলে আলো কোথায়? কৃষ্ণপক্ষের রাত।

রোগী চুপ করে গেল! আনিস তার পায়ের বাঁধন কেটে দিয়ে বলল–গরম চা এক কাপ খান। খেয়ে বাড়ি চলে যান।

রোগী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। রোগীকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা খানিকটা হতাশ হলো। সাপে কাটা রোগী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসার মধ্যে কোনো নাটকিয়তা নেই। এই গল্প কাউকে করলে সে মজা পাবে না। সাপে কাটা রোগী মারা গেছে, কলার ভেলায় তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে–এই গল্প মজার। এই গল্প করতেও আনন্দ, শুনতেও আনন্দ।

রোগী বিড়ি ধরিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে টানছে। এক স্ত্রী পাখা দিয়ে তাকে বাতাস করছে। অন্য স্ত্রী স্বামীর সেবা করার কোনো কিছু না পেয়ে মন খারাপ করেছে। রোগী আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার সাব আমি চইল্যা যাইতেছি। আমার নামটা একটু ইয়াদ রাইখেন, আমার নাম হেকিম আলি। ঝিলকান্দার হেকিম আলি। আফনের যে-কোনো প্রয়োজনে আমি জান দিয়া দিব। আফনে আমারে জীবন দিয়েছেন এই জীবন আমি আফনেরে দিয়া দিলাম। ঝিলকান্দার হেকিম আলি দেনা রাখে না।

আনিস বলল, আমি জীবন দিব কী? আপনাকে তো সাপেই কামড়ায় নি।

হেকিম আলি বিড়িতে লম্বাটান দিয়ে নিচু গলায় বলল–আমারে যে সাপে কাটছে এইটা আমি জানি, আপনে জানেন না। সাপের বিষ ক্যামনে আপনে পানি বানাইছেন সেইটা আফনে জানেন। আমি জানি না। আমার জানার দরকারও নাই। তয় ডাকতার সাব একটা কথা আপনেরে বইল্যা যাইতেছি, হেকিম আলি তার জেবন আপনের হাতে দিয়া গেল। নামটা ইয়াদ রাখবেন–ঝিলকান্দার হেকিম।

আনিস বিরক্ত বোধ করছে। অঞ্চলের লোকজন তাকে নিয়ে গল্প গাথা বানানো শুরু করেছে। তার মধ্যে রহস্যময়তা আরোপ করার চেষ্টা করছে। গ্রামের মানুষ রহস্যমানব তৈরি করতে পছন্দ করে। আনিস জানে সে যে মাঝে মাঝে শ্মশানঘাটায় বসে থাকে তা নিয়েও গল্প তৈরি হয়েছে। এইসব গল্পের ফল বেশির ভাগ সময়ই শুভ হয় না।

আজিজ মিয়া সকাল থেকেই আনিসের ক্লিনিকে বসে আছে। ভূতের ভয়ে রাতে তার ঘুম হয় না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় ইমাম সাহেব তার আশেপাশে আছেন। আজিজ মিয়া ডাক্তারের কাছে এসেছে ঘুমের ওষুধ নিতে। সেই ওষুধ তাকে আগেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে যাচ্ছে না। আনিসের ধারণা মানুষটা তাকে গোপন কিছু কথা বলতে চায়। ক্লিনিক ফাঁকা হবার পর আনিস বলল, আজিজ সাহেব। আপনি কি আরো কিছু বলবেন?

আজিজ মিয়া অপ্রস্তুত গলায় বলল, না। কোনো কাজ নাই, এইজন্যেই আপনার সামনে বসে আছি। আপনে রোগী দেখেন–এইটা আমার দেখতে ভালো লাগে।

আনিস বলল, আজকের মতো রোগী দেখা শেষ। আমি এখন উঠব।

আমিও উঠব ডাক্তার সাব। চলেন। আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত আগায়ে দেই।

নিশ্চিত যে আপনি আমাকে কিছু বলতে চান। বলুন শুনি।

আজিজ মিয়া বিব্রত গলায় বলল, মনটা অত্যাধিক খারাপ–এইটা বলতে চাই আর কিছু না।

মন খারাপ কেন?

জহির খাঁ সাব আমারে দেখতে পারেন না। আমি কিছুই করি নাই, তারপরেও আমারে দেখতে পারেন না। এই জন্যে মনটা খারাপ।

আপনাকে দেখতে পারেন না। কীভাবে বুঝলেন?

এইটা না বুঝার কোনো কারণ নাই। শখের জন্যে আড়ং-এর একটা ষাঁড় কিনিছিলাম, উনার ধারণা হয়েছে। আমি পাল্লা পাল্লি খেলায় নামছি। মনটা অত্যাধিক খারাপ ডাক্তার সাব। রাইতে যে আমার ঘুম হয় না। এইটাও একটা কারণ। খুবই মন কষ্টে আছি ডাক্তার সাব। কখন কী হয়!

কখন কী হয় মানে কী?

মানে কিছু না, এমেই বললাম। আমার সামান্য টেকা পয়সা হইছে। এইটা সত্য। তয় উনার সাথে পাল্লা দিব এইটা কেমন কথা?

আনিস বলল, তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মন খারাপ করে থাকবেন না। জহির সাহেবের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ আছে–সম্পর্ক ভালো হবে।

আজিজ সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল–সম্পর্ক ভালো হওনের কোনো আশা নাই। এমন বিপদে পড়েছি। এখন একলা চলাফেরা করি না। লোকে ভাবতেছে ভূতের ভয়ে একলা চলাফেরা বন্ধ করেছি। ভূতের ভয়ে বাজারে লোকজনের মধ্যে থাকি। আসলে ঘটনা অন্য। কাউকে না বইল্যা পারতেছিলাম না বইল্যা আফনেরে বললাম। গ্রামের পলিটিক্স–বড়ই কঠিন পলিটিক্স। আপনে শহরের ছেলে আপনে বুঝবেন না। কোনদিন শুনবেন আমার মরা লাশ পুসকুনিতে ভাসতেছে! গ্রামে রটনা হইব। ভূতে আমারে পুসকুনিতে ফেইল্যা মারছে।

 

আনিস বাসায় ফিরল দুপুর একটায়। বাসা তালাবন্ধ। নবনী নেই, সুজাত মিয়াও নেই। বাড়ির বাইরের উঠানে আনিসের চুরি যাওয়া সাইকেল। কেউ একজন সাইকেলটা রেখে গেছে। আনিসের ভ্রূ কুঁচকে গেল। চুরি যাওয়া সাইকেল ফেরত পাওয়া আনন্দের ঘটনা। সমস্যা হলো–এখন এই সাইকেল নিয়ে নানান গল্প শুরু হবে। ডাক্তারকে সাধারণ মানুষের স্তর থেকে টেনে রহস্যমানবের স্তরে আনার প্রক্রিয়ায় সাইকেল ফেরত পাওয়ার ঘটনাটাও কাজ করবে।

 

জহির উদ্দিন খাঁ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।

বেলা দ্বিপ্রহর। তার ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। গরম পানি আনা হয়েছে। জলচৌকিতে বসে তিনি গোসল সারবেন। গোসলের আগে তাঁকে কিছুক্ষণ দলাই মলাই করা হবে। এতে তার ক্ষুধা বৃদ্ধি হবে। দুপুরের খাবারটা আরাম করে খাবেন। দুপুরে খাবারের পর দুই ঘণ্টা দিবানিদ্রা। তার দীর্ঘদিনের রুটিন। রুটিনে ব্যতিক্রম করলেই শরীর জানান দেয়। গরম পানির বদলে একদিন যদি ঠাণ্ডা পানি গায়ে দেন– সঙ্গে সঙ্গে গা ম্যাজ ম্যাজ। বন্দ হজম।

রুটিনের ব্যতিক্রম তিনি সচরাচর করেন না। আজ মনে হয় করতেই হবে। তার সামনে বেঞ্চে একজন বোরকাওয়ালি বসে আছে। এই বোরকা কঠিন বোরকা। বোরকার পেছনের মুখ দেখা দূরে থােক, চোখও দেখা যাচ্ছে না। বোরকাওয়ালির পরিচয় এবং উদ্দেশ্য জেনেও জহির উদ্দিন খাঁ বিস্মিত। মনে মনে বলেও ফেলেছেন–মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের মতো থাকতে হয়। মেয়েমানুষ পুরুষ হবার চেষ্টা করলে সমূহ বিপদ। একমাত্র কেয়ামতের আগে আগে মেয়েমানুষকে পুরুষের ওপরে স্থান দেয়া হবে। তখন তাদের চোখের ইশারায় সংসার চলবে। পুরুষ হবে ছাগলের মতো। তাদের একমাত্র কাজ হবে স্ত্রীর দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে ভ্যা ভ্যা করা। কিন্তু সেই কেয়ামতের তো এখনো দেরি আছে।

জহির উদ্দিন খাঁ বোরকাওয়ালির নাম আগে একবার শুনেছেন। তারপরেও মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বললেন–তোমার নাম যেন কী বললা?

বোরকাওয়ালি শান্ত কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল, আমার নাম সকিনা।

তুমি ইমাম ইয়াকুব মোল্লার মেয়ে?

জ্বি।

তোমারই বিবাহের কথা চলতে ছিল? পাত্র কলেজের শিক্ষক?

জ্বি।

বিবাহ হয়েছে?

জ্বি, না। বিবাহ ভেঙে গেছে।

আফসোস! বিবাহ ভাঙল কেন?

বোরকাওয়ালি সহজ কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল–পাত্ৰপক্ষ বাপজানের খবরটা পেয়েছিল। তাকে নেংটা করে হাঁটানো হয়েছে, তিনি ফাঁস নিয়ে মরেছেন। এইসব খবর শুনলে আত্মীয়তা হয় না।

জহির খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন–তুমি খবর যা পেয়েছ তার মধ্যে কিছু ভুল আছে। তাকে নেংটা করে হাঁটানো হয় নাই। শাস্তি আমি দিয়েছি, আমি জানি। সে রকম শাস্তিই দেয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত দেয়া হয় নাই। তার পরনের পায়জামা খোলা হয় নাই। তুমি নিজে যখন এসেছি খোঁজ-খবর নাও। রটনা বিশ্বাস করা ঠিক না।

বাবাকে এই শাস্তি কেন দেয়া হলো এটা নিয়েও আমি খোঁজ-খবর করব।

কর। অনুসন্ধান করে দেখ। কন্যা হিসাবে এটা তোমার কর্তব্য।

আমি একটা মামলাও করতে চাই।

জহির খাঁ অবাক হয়ে বললেন, কী! মামলা?

আমার বাবাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ভয়ঙ্কর লজা দেয়া হয়েছে। বাবা আত্মঘাতী হয়েছেন। যারা এই কাজটা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা।

জহির খাঁ খুবই মজা পাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, কর, মামলা করা। থানা এখান থেকে দূরে আছে। প্রথমে নান্দাইল রোড যাও। সেখানে রিকশা পাবে। মামলা ছাড়া আরো কিছু করার ইচ্ছা আছে?

জ্বি।

বল। সব এক সঙ্গে শুনি।

এখানে বাবার কবর হয়েছে। তার লাশ তুলে আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।

এটা করতে পারলে ভালোই হয়। কাঠের বাক্সে করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব না। মুনশি মৌলবিরা কী বলে আগে জানতে হবে। তারা যদি বলেন লাশ নেয়া যাবে তাহলে নিয়া যাবে।

মুনশি মৌলবির কথা দিয়া কী হবে? মুনশি মৌলবিরা তো আমার বাবার জানাজাও করে নাই।

কাজটা যে তারা ইচ্ছা করে করেছেন তা তো না। তাঁরা কাজ করেছেন হাদিস কোরান দেখে। যাই হোক, তুমি খাওয়া-দাওয়া করেছ?

না।

পরিশ্রান্ত হয়ে আসছি। বিশ্ৰাম কর। গোসল কর। তারপর খাওয়া-দাওয়া করা। তোমার থাকার জন্য একটা ঘর দিতে বলে দিব। কোনো অসুবিধা নাই। তোমার পিতা যখন প্রথম এখানে এসেছিলেন তখন প্ৰায় দুই বছর আমার বাড়িতেই ছিলেন। পরে মসজিদের কাছে তারে ঘর ওঠায়ে দেয়া হয়েছে।

আমি আপনার এখানে থাকব না।

কোথায় থাকতে চাও?

মসজিদের কাছে বাপজান যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে থাকব।

তোমার সাথে কে এসেছে?

কেউ আসে নাই।

মামলা মোকদ্দমা, লাশ কবর থেকে তোলা–সময়ের ব্যাপার। তোমাকে কয়েক দিন থাকতে হইতে পারে। একা থাকবা?

হ্যাঁ, একা থাকব।

ভয় পাইতে পার। নানান কথা এখন শোনা যায়। তোমার পিতাকে নিয়েই কথা। তুমি বোধহয় শুনেছ।।

জ্বি আমি শুনেছি। এইজন্যেই আমি আরো বেশি করে থাকতে চাই।

ভূত-প্রেতের কথা বাদ দাও। ভূত-প্রেতের চেয়েও খারাপ জিনিস হলো মানুষ। এই অঞ্চলে খারাপ মানুষের অভাব নাই। তুমি অল্প বয়েসী মেয়ে–একলা থাকব!

আমি ভয় পাই না। আপনি আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে?

আমি চাল-ডাল কিনে নেব। নিজেই রান্না করে খাব।

জহির খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–ভর দুপুরে আমার বাড়িতে আসছি। এই বেলা খাওয়া-দাওয়া কর। তারপর না হয় তুমি যেটা চাইতেছ সেটার ব্যবস্থা করা যাবে।

আমি আপনার এখানে খাব না।

আমি গৃহস্থ মানুষ। দুপুরে গৃহস্থের বাড়িতে না খেলে অকল্যাণ হয়।

আপনি মনে কিছু নিবেন না। আমি আপনার এখানে খাব না।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বোরকাওয়ালি উঠে দাঁড়াল। জহির খাঁ তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা লম্বা। তার বাবা ছোটখাট মানুষ ছিলেন। মেয়ে বাবার মতো হয় নি। আবার ব্যবহারেও অমিল আছে। বাপ ছিল মেদামারা। মেয়ে শক্ত ধরনের। মেয়ের জিদ আছে। তবে মেয়েছেলের জিদ থাকা খারাপ। পুরুষের জিদ ভালো। কথায় আছে–

জিদের পুরুষ হয় বাদশাহ
জিদের মেয়ে হয় বেশ্যা।

জহির খাঁ ভ্রূ কুঞ্চিত অবস্থায় থাকল। তিনি চিন্তিত বোধ করছেন না, তবে তার ক্ষিধা নষ্ট হয়ে গেছে।

তার গোসলের পানি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে–পানি আবার গরম করতে গেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তার খাস লোক–বদি মিয়া শরীরে তেল মাখাতে শুরু করেছে। রসুন দিয়ে জ্বাল দেয়া খাঁটি সরিষার তেল। এর সঙ্গে চায়ের চামচে দুই চামচ মধু মেশানো হয়েছে। এতে শরীরের বাহিরটা ঠাণ্ডা থাকে। গোসলের ঠিক পরে পরে আধা গ্লাস তোকমার সরবত খান। তোকমার সরবত শরীরের ভেতরটা ঠাণ্ডা রাখে। ভেতর বাহির দুই দিক ঠাণ্ডা রাখতে হয়।

বদি মিয়া।

মেয়েটার কথাবার্তা কেমন শুনলা?

ভালো। তেজি আছে।

তেজ কয় প্রকার জান?

জ্বে না।

তেজ দুই প্রকারের। মুখের তেজ আর কাজের তেজ। যাদের মুখের তেজ থাকে তাদের কাজের তেজ থাকে না। যাদের কাজের তেজ থাকে তারার মুখে কোনো তেজ থাকে না।

খুবই সত্য কথা।

যে কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে হেই কুত্তায় কামড়ায় না।

অতি সত্য কথা।

জহির খাঁ অলস গলায় বললেন, দেখি এখন একটা শিলুক ধর। ভাঙাইতে পারি কি-না দেখি।

গা দলাই মলাইয়ের সময় জহির খাঁ খুব হালকা মেজাজে থাকেন। বদিকে তখন শ্লোক ধরতে বলেন। জহির খাঁ শ্লোক ভাঙিয়ে অত্যন্ত আনন্দ পান। শ্লোক ভাঙানোর ব্যাপারে তার দক্ষতা আছে। বদি তাকে আটকাতে পারে না।

বদি পিঠে তেল ডালতে ডিলতে বলল—

মাইয়া লোকের হাতে নাচে
সাত শ’ মুখ কার আছে?

জহির খাঁ চোখ বন্ধ করে বললেন–মেয়ে মানুষের হাতে নাচে? সাত শ’ মুখ–চালুনি। চালুনি চালে মেয়েরা। চালুনির হাজার হাজার ফুটা। হয়েছে?

জ্বে হইছে। কন দেখি–

জলেতে জন্ম তার জলে ঘর বাড়ি
ফকির নহে ওঝা নহে মুখে আছে দাড়ি।

জহির খাঁ বললেন–চিংড়ি মাছ।

বদি আনন্দের সঙ্গে বলল–আপনেরে আটকানি কঠিন। আচ্ছা দেখি এইটা পারেন কি-না!

নৌকা নহে জলে চলে শূন্যতেও চলে
দিনেতে দেখি না তারে দেখি নিশাকালে
কহেন কবি কালিদাস।
এই শিলুক যে ভাঙতে পারে সে আমার দাস।

জহির খাঁর মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে গেল। এই শ্লোকটা তিনি ভাঙ্গাতে পারছেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন–এখন শরীরে পানি ঢালার ব্যবস্থা কর।

বন্দি পানি ঢালতে শুরু করল। জহির খাঁ বিরক্ত মুখে বসে রইলেন। বদিকে জিজ্ঞেস করলেই সে বলবে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কবি কালিদাসের দাস হবার অপমানটা গায়ে বিঁধছে।

বদি।

জ্বে।

ডাক্তার সাব আর তার স্ত্রীরে আইজ রাইতে আমার সাথে খানা খাইতে বলবা।

জ্বে আচ্ছা।

নয়াপাড়া থাইক্যা ছগীররে খবর দিয়া আনিবা। জাদু দেখাইব। শহরের মেয়ে গেরাইম্যা জাদু তো দেখে নাই। দেখলে খুশি হইব।

জ্বে আইচ্ছা।

তোমার শ্লোকটা কী আরেকবার বল দেখি–

নৌকা নহে জলে চলে শূন্যতেও চলে
দিনেতে দেখি না তারে দেখি নিশাকালে।

জহির খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন–জলেও চলে, শূন্যতেও চলে—বল কী?

বদি হাসিমুখে বলল, জিনিসটা হইল…

জিনিস কী তোমার বলার প্রয়োজন নাই। আমি বাইর করতেছি।

জহির খাঁ গভীর চিন্তায় ড়ুবে গেলেন।

 

চৈত্র মাসের রোদে তালু ফাটে। কিন্তু এই রোদ তালু ভেদ করে মগজে ঢুকতে পারে না। আশ্বিন মাসের রোদ আবার অন্য রকম–এই রোদ তালু ভেদ করে মগজে ঢুকে যায়। মগজ ওলট-পালট করে দেয়।

ছাতা থাকা সত্ত্বেও নবনী আশ্বিন মাসের রোদ পুরোটা মাথায় নিয়েছে। রেল সড়ক থেকে ফেরার পথে মাথায় ছাতা দেয় নি। গায়ে রোদ লাগাতে তার নাকি ভালো লাগছে। সেই ভালো লাগা এখন উল্টো গীত গাইতে শুরু করেছে। বাড়িতে ফিরেই নবনী বমি করল। আনিস অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কী?

নবনী বলল, ব্যাপার বুঝতে পারছি না? বমি করছি এই হলো ব্যাপার। তুমি ডাক্তার মানুষ। তুমি কি আমার আগে কাউকে বমি করতে দেখ নি?

জহির বলল, কী হয়েছে?

শরীর যেন কেমন করছে। তোমাকে অস্থির হতে হবে না। লম্বা গোসল দেব। শরীর সেরে যাবে।

আনিস বলল, দেখি তো জ্বর এসেছে কি-না। জ্বর দেখতে হবে না। তুমি দয়া করে সামনে থেকে যাও–কটকটা রঙের কী পাঞ্জাবি পরেছ–চোখে লাগছে।

কোথায় গিয়েছিলে?

রেল সড়ক দেখতে গিয়েছিলাম।

বল কী? অনেক দূর তো! হেঁটে গিয়েছ?

নবনী বলল, না হেঁটে কেন যাব, হেলিকপ্টার চার্টার করে গিয়েছি। তোমার তদন্ত যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে সামনে থেকে যাও। তোমার শার্টের দিকে যতবার তাকাচ্ছি, ততবার শরীর বিমঝিম করে উঠছে।

আনিস বলল, তোমার সামনে থেকে যেতে চাচ্ছি না। শার্টটা বরং বদলে আসি।

নবনী ক্লান্ত গলায় বলল, যাও বদলে আস।। হালকা রঙের কিছু পরবে। সবচে’ ভালো হয় সাদা।

নবনী এক ঘণ্টা সময় লাগিয়ে গোসল করল। গোসল শেষ করে বিছানায় পড়ে গেল। তার গায়ের তাপ এক শ’ তিনের চেয়েও সামান্য বেশি। আনিস বলল, খুব খারাপ লাগছে?

নবনী বলল, খুব খারাপ না। মোটামুটি খারাপ লাগছে।

বমি ভাবটা কি গেছে না এখনো আছে?

এখনো আছে।

তাহলে কিছু খাবার দরকার নেই। শুয়ে থাক। ওষুধ দিচ্ছি, এক্ষনি জ্বর কমে যাবে।

নবনী বলল, ওষুধ দিয়ে এই জ্বর নামাতে পারবে না। এই জ্বর খুব বাড়বে। সারা রাত ছটফট করব। শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ব, তখন জ্বর থেমে যাবে।

কীভাবে বলছে?

আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। ইএসপি পাওয়ার। সেই ক্ষমতা থেকে বলছি।

তোমার ক্ষমতার ব্যাপারটা মানলাম। তারপরেও ওষুধ দিচ্ছি, খাও।

নবনী তরল গলায় বলল, যে ওষুধে কাজ করবে না। সেই ওষুধ খেয়ে লাভ কী? ওষুধ খাব না।

ছেলেমানুষি করো না তো।

আমি ছেলেমানুষিা করছি না। ওষুধ আমি খাব না।

আচ্ছা ঠিক আছে ওষুধ খেতে হবে না। দেখি জ্বরটা আরেকবার দেখি।

নবনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জ্বর আরো খানিকটা বেড়েছে। এখন আমার জ্বর এক শ’ চার।

এটাও কি ইএসপি ক্ষমতা ব্যবহার করে বলছ?

হ্যাঁ।

জ্বর দেখতে পারব না?

না।

পাশে তো বসে থাকতে পারি। না-কি সেটাও পারব না? কটকটে রঙের শাটটা বদলে সাদা পাঞ্জাবি পরেছি। এখন নিশ্চয়ই চোখে লাগছে না।

নবনী বলল, খাটে না বসে চেয়ারটায় বোস। জ্বর যখন বেশি হয় তখন চোখে আপনাআপনি একটা জুম এফেক্ট তৈরি হয়। সব কিছু চোখের কাছাকাছি চলে আসে। তুমি যদি খাটে বস–আমার কাছে মনে হবে তুমি চোখের ওপর বসে আছ।

আনিস চেয়ারে বসল। সে চিন্তিত বোধ করছে। জ্বর যে বাড়ছে এটা বুঝা যাচ্ছে। রোগী ডিলেরিয়ামে চলে যাচ্ছে। তার লক্ষণ স্পষ্ট। চোখের তারা ডাইলেটেড হয়েছে। অর্থহীন কথাবার্তা বলা শুরু হয়েছে।

নবনী আনিসের দিকে ফিরল। ক্লান্ত গলায় বলল, আমি চাচ্ছি জ্বরটা আরেকটু বাড়ুক।

আনিস বলল, কেন?

আমি খুব জরুরি কিছু কথা তোমাকে বলতে চাচ্ছি। ক্লাস বাদ দিয়ে তোমার এখানে এসেছি কথাগুলো বলার জন্যে। মুশকিল হচ্ছে কথাগুলো বলতে পারছি না। জ্বরের ঘোর তৈরি না হলে বলা যাবে না।

চুপ করে শুয়ে থাক। এখন কিছু বলতে হবে না।

জ্বরের এই সুযোগটা আমার গ্রহণ করা উচিত। এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে আর কখনো হয়তো বলতে পারব না।

কথাগুলো কি খুবই জরুরি?

হ্যাঁ জরুরি। খুবই জরুরি।

যদি খুব জরুরি হয়, তাহলে জ্বর লাগবে না। তুমি এম্নিতেই কথাগুলো বলবে। হয়তো একটু বেশি সময় নেবে। তাছাড়া জরুরি কথা খুব গুছিয়ে বলতে হয়। মাথায় জ্বর নিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারবে না।

আমি কি এলোমেলোভাবে কথা বলছি?

না, তা বলছ না।

তাহলে কথাগুলো আমি এখনি বলব। তার আগে এক গ্লাস ঠাণ্ডক্স পানি খাব। ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এখানে বরফ পাওয়া যায় না, তাই না?

সিদ্ধিরগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে বরফকল আছে। আমি সুজাত মিয়াকে বরফ আনতে পাঠিয়েছি।

কখন পাঠিয়েছ?

তুমি যখন গোসল করছিলে তখন।

থ্যাংক য়ু। বরফ আসছে শুনেই ভালো লাগছে। তুমি মানুষটা খুবই গোছানো। তোমার মতো স্বামী পাওয়া যে-কোনো মেয়ের জন্যে ভাগ্যের ব্যাপার। হয়তো আমার জন্যেও।

হয়তো বলছি কেন? সন্দেহ আছে?

হ্যাঁ, সন্দেহ আছে। বাতি নিভিয়ে দাও চোখে আলো লাগছে।

আনিস বাতি নিভিয়ে দিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাচ্ছিলে বল।

নবনী ক্লান্ত গলায় বলল, আমি অন্ধকারে কথা বলতে পারি না। কথা বলতে হলে–আমার মুখ দেখতে হয়। কাজেই আজ বাদ থাক।

আনিস বলল, আচ্ছা বাদ থাক। সঙ্গে সঙ্গে নবনী খাটের ওপর উঠে বসে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বলছি। তুমি শুনে খুবই মনে কষ্ট পাবে, তারপরেও বলছি–তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা ওয়ার্ক আউট করছে না। মানুষ হিসেবে তুমি খুব ভালো, মেয়ে হিসেবে আমিও ভালো। তারপরেও না। আমাদের বিয়েটা ফেল করেছে।

আনিস সহজ গলায় বলল, এখনো তো সময় আছে।

নবনী বলল, সময় তো আছেই। জোড়াতালি দিয়ে আমরা হয়তো এগিয়ে যাব। আমি জোড়াতালি ব্যাপারটা পছন্দ করি না।

আনিস বলল, তোমার শরীর ভালো না। জ্বর অনেক বেড়েছে। জটিল একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করার মতো অবস্থা তোমার না। আমরা পরে আলাপ করি।

নবনী বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, আমার কথা যা বলার বলে ফেলেছি। আমার আর কিছু বলার নেই।

 

জহির খাঁ খেতে বসেছেন। একটু দূরে বসেছে ছগীর। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ভালো। গ্রামের দাওয়াতে পোলাও কোরমা থাকেই–তার পরে আছে ক্লাই মাছ ভাজা। একেকটা টুকরা প্লেটে ধরে না। এত বড়! মাছের মাথাটা ছগীরকে দেওয়া হয়েছে। সে কিছুক্ষণ পর পর তৃপ্তি নিয়ে মাছের মাথাটার দিকে তাকাচ্ছে। জহির খাঁ বললেন, পাক কেমন হয়েছে?

ছগীরের মুখ ভর্তি মাছ। সে অনেক কষ্টে বলল, বেহেশতী খানা হইছে চেয়ারম্যান সাব। দাওয়াতী মেহমান এই খানা খাইতে পারল না, এটা একটা আফসোস।

আফসোস করার কিছু নাই। আইজ আসতে পারে নাই, আরেকদিন আসব। সুবিধা অসুবিধা সবেরই আছে।

শুনেছি ডাক্তার সাবের ইস্ত্রীরে জিনে ধরেছে। সারা দিন আউল চুলে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছে। সুযোগ বুইজ্যা ধরছে জিনে।

শোনা কথায় কান দিও না। কানের ওপরে বিশ্বাস নাই, কান নিমকহারাম। অতি খাঁটি কথা বলেছেন চেয়ারম্যান সাব। তরকারিতে লবণ কি একটু কম হয়েছে?

একদানা লবণ কম হয় নাই, আবার একদানা লবণ বেশিও হয় নাই। জবরদস্ত হইছে।

খাও, আরাম কইরা খাও। মাথাটা ভাইঙ্গা মুখে দেও।

ছগীর আগ্রহের সঙ্গে মাথা ভাঙ্গল।

আনন্দে তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে অতি সাধারণ একজন। রেলে রেলে ম্যাজিক দেখায়। দড়ি কাটার ম্যাজিক, পয়সার ম্যাজিক, তাসের ম্যাজিক। সস্তার জিনিস। তারপরেও চেয়ারম্যান সাহেবের মতো মানী লোকের কাছে তার ডাক পড়ে। এটা ভাগ্য ছাড়া আর কী? তাকে অবহেলাও করা হচ্ছে না। উঠানে কলাপাতায় খাবার দেওয়া হচ্ছে না। চিনামাটির বাসনেই সে খাচ্ছে। চলে যাবার সময় চেয়্যারম্যান সাহেব দশ টাকা বখশিশও তাকে দেবেন।

 

মতি নান্দাইল রোড থেকে অনেক রাতে ফিরছে। তার হাতে হারিকেন। হারিকেনের সবচে’ বড় অসুবিধা হলো–দূরের কিছু দেখা যায় না। গ্রামে পথ চলার জন্যে হারিকেন কাজের কিছু না। অন্ধকারে পথ চলতে লাগে টর্চ। মতির টর্চের ভাগ্য খুব খারাপ। টর্চ কেনার সাতদিনের মাথায় সে হারাবেই।

ডাক্তার সাহেবের সাইকেল বেচা টাকায় টর্চ কিনতে গিয়েও সে কেনে নি। কী হবে কিনো! দুদিন পরে তো হারিয়েই যাবে। এখন মনে হচ্ছে টর্চ না কেনোটা খুবই বোকামি হয়েছে। গ্রামে নানান উপদ্রব শুরু হয়েছে। চোর-ডাকাতের চেয়েও হাজার গুণে ভয়ঙ্কর কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সময় টর্চ ছাড়া গ্রামে আসাই ঠিক না। একটা টর্চ, একটা হারিকেন। টর্চ দরকার দূরের জিনিস দেখার জন্যে। হারিকেন দরকার জ্বলন্ত আগুনের জন্যে। নিশিরাতে মানুষের শরীর ধারণ করে যারা চলাফেরা করে, তারা একটা জিনিশই ভয় পায়। সেই জিনিশের নাম—আগুন।

জুম্মাঘরের কাছাকাছি এসে মতি বিড়ি ধরাল। জিন-ভূত বিড়ির আগুনকেও ভয় পায়। বাতাসের হঠাৎ ঝাপ্টায় হাতের হারিকেন নিভে যেতে পারে। বিড়ির আগুন নিভবে না। সবচে’ ভালো ছিল আয়াতুল কুরাসির তাবিজ। গলায় একটা তাবিজ পরা থাকলে দশ হাতের ভেতর জিন, ভূত, খারাপ বাতাস কিছুই আসতে পারে না। এই তাবিজের বড় সমস্যা হলো—তাবিজ গলায় নিয়ে নাপাক অবস্থায় থাকা যায় না। আজে বাজে জায়গায় যাওয়া যায় না।

মতি থমকে দাঁড়াল। ইমাম সাহেবের বাড়ির উঠানে কে যেন হাঁটাহাঁটি করছে! হারিকেনের আলো উঠানে পর্যন্ত যাচ্ছে না। তারপরেও মতি নিশ্চিতএকজন কেউ হাঁটাইটি করছে। তার গায়ে কালো আচকান। মতির শরীর ঘেমে গেল। তার সমস্ত মন চাচ্ছে–হারিকেন ফেলে উল্টো দিকে দৌড় দিতে–কিন্তু হাত পা জমে গেছে। সে বুঝতেই পারল না, কখন তার হাত থেকে হারিকেন পড়ে গেছে। সে বিকৃত গলায় বলল, কে কে? উঠানে কে?

মতি অবাক হয়ে দেখল উঠানের মানুষটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে আবারো ভাঙা গলায় বলল, কে কে?

মানুষটা থমকে দাঁড়াল। স্পষ্ট গলায় বলল, আপনি ভয় পাবেন না। আমি জিন ভূত না। আমার নাম সকিনা। আমি ইমাম সাহেবের মেয়ে।

পায়ের কাছে পড়ে থাকা হারিকেন নিভে যায় নি। দপদপ করে জ্বলছে। প্রচুর ধোঁয়া বের হচ্ছে। মতি হারিকেন তুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে যে মেয়েটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে–এত রূপবতী মেয়ে সে তার জীবনে কখনো দেখে নি। বেহেশতের পর এই মেয়ের কাছে কিছু না। বেহেশতের যে-কোনো হুরকে এই মেয়ে দাসী হিসাবে বিনা বেতনে তার কাছে রেখে দিতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *