০৬. গ্রাম্য জীবনে শশীর বিতৃষ্ণা

গ্রাম্য জীবনে আবার শশীর বিতৃষ্ণা আসিয়াছে। মাঝখানে কিছুদিন সে যেন এখানে বাস করিয়াছিল অন্যমনস্কের মতো। আধখানা মন দিয়া সবসময় সে তাহার কাম্য জীবনের কথা ভাবিত,-শিক্ষা সভ্যতা ও আভিজাত্যের আবেষ্টনীতে উজ্জ্বল কোলাহলমুখর উপভোগ্য জীবন। এখানকার মশকদষ্ট মৃত্তিকালীন জীবন এই সাম্ভনার জন্য শশীর সহ্য হইয়া আসিয়াছিল যে, যখন খুশি গ্রাম ছাড়িয়া যেখানে খুশি গিয়া মনের মতন করিয়া জীবনটা সে আরম্ভ করিতে পারে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিপুলতা অবশ্য কমিয়া যায় নাই। শশীর স্বাধীনতাও হরণ করে নাই কেহ। তবু শশীর মনে হয় চিরকালের জন্য সে মাকামারা গ্রাম্য ডাক্তার হইয়া গিয়াছে-এই গ্রাম ছাড়িয়া কোথাও যাইবার শক্তি নাই। নিঃসন্দেহে এজন্য দায়ী কুসুম। শশীর কল্পনার উৎস সে যেন চিরতরে রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে। বিদ্যুতের আলের মতো উজ্জ্বল যে জীবন শশী কল্পনা করিত সে যাযাবরের জীবন নয়,-শশীর নীড়-প্রেম সীমাহীন। কল্পনার তাই একটি কেন্দ্র ছিল শশীর, এক অত্যাশ্চর্য অস্তিত্বহীনা মানবী, কিন্তু অবাস্তব নয়; শশীর ভাবুকতা উদভ্ৰান্ত হইতে জানে না। কুসুম যেন তাহাকে মিথ্যা করিয়া দিয়াছে- সেই মহা-মানবীকে।

ছোট বোন সিন্ধু আর মতি ছাড়া কারো সঙ্গে শশীর ভালো লাগে না। এতবড় গ্রামে শুধু এই দুটি প্রিয়তমা বান্ধবী। নিচে সিন্ধু পুতুলখেলা করে, খাটে বসিয়া শশী অস্বাভাবিক মনোযোগের সঙ্গে সে খেলা চাহিয়া দ্যাখে।

খুকী, বড় হইয়া তুই কী করবি?

পুতুল খেলব।

এই একটিমাত্র জবাবে ক্ষণেকের জন্য শশীর মন যেন একেভাবে হালকা হইয়া যায়। জানালা দিয়া সে বাহিরের দিকে তাকায়। জানালার নিচে সেদিন কুসুম যে গোলাপের চারটি মাড়াইয়া দিয়াছিল, শশীর যত্নে সেটি আবার মাথা তুলিয়াছে।

মতি স্পষ্টই জিজ্ঞাসা করে, আপনার সেই বন্ধুটি পত্ৰ দিয়াছে?

কে রে মতি, কুমুদ? না দেয়নি—কেন?

এমনি শুধোচ্ছি।

সুন্দর যাত্রা করে যে!

তা বটে। সুন্দর যাত্রা করে বলিয়া কুমুদ পত্ৰ দিয়াছে কি না মতির তা জিজ্ঞাসা করা চলে বটে। শশী হাসিয়া বলে, ওর পার্ট তোর খুব ভালো লাগত, না রে মতি?

আমার একার কেন, সবার লাগত। একটা যাত্রাগান দিন না ছোটোবাবু, দেবেন? কত টাকা নেয়? গম্ভীরমুখে শশীর হাসিকে মতি অগ্রাহ্য করে, বলে, আমার টাকা থাকলে দলটা ভাড়া করে আনতাম ছোটোবাবু, আমাদের বাড়ির সামনে শামিয়ানা খেঁচে আসর করে দিতাম, পালা হত সাত দিন।

মতি একটু গম্ভীর হইয়াছে আজকাল। কথা বলিতে বলিতে দুচোখে তাহার একটু ভীরু ঔৎসুক্য দেখা দেয়। কথা শেষ করিয়া কী যেন ভাবে মতি। শশী ভাবে , কে জানে, হয়তো ধীরে ধরে অবশ্যম্ভাবী আত্মচিন্তাই এবার আসিতেছে মতির। গ্রামের মেয়ে তো, নিশ্চিন্ত থাকিবার বয়সটা ইতিমধ্যে পার হইয়া যাইতে আরম্ভ করিবে আশ্চর্য নাই।

একদিন বাসুদেব বাঁড়ুজ্যে সপরিবারে গ্রামত্যাগের আয়োজন করিলেন। কলিকাতায় মেজছেলে চাকরি করিত, সম্প্রতি সেজছেলেরও কোনো আফিসে চাকুরি হইয়াছে। জমিজমা নাই। গোপালের শক্রতার জন্য কেহ টাকা ধার করিতে আসে না। আসিলেও গোপালের পরামর্শে সুদে-আসলে গাপ করিতে চায়। ম্যালেরিয়ায় ভুগিতে আর কেন গ্রামে থাকা? এমন অনেক গিয়াছে। গ্রাম জুড়িয়া এখানে-ওখানে পোড়ো ভিটা খাঁ-খাঁ করে। খবর পাইয়া শশী দেখা করিতে গেল; জিনিসপত্র বাধাছাদা হইতেছে দেখিয়া হঠাৎ কেমন রাগ হইয়া গেল শশীর। সে নিজে যখন গ্রামের পাঁকে আত্মসমর্পণ করিয়াছে চিরকালের জন্য, আর কারো যেন গ্রাম ত্যাগ করা অন্যায়।

আপনার কাছে কতগুলো টাকা পেতাম বাঁড়ুয্যেকাকা।

কলকাতায় গিয়া পাঠিয়ে দেব বাবা। কটা টাকা তো–ছেলেরা মাসকাবারের মাইনে পেলে একটা দিনও দেরি করব না।

শশী মাথা নাড়িল, না, অনেকদিন পড়ে আছে টাকাটা, দিয়েই যান!

শশীর এত টাকার প্রয়োজন কিসের কে জানে বিশ্রী একটা কলহ বাঁধিয়া গেল বাসুদেবের সঙ্গে। তার দুই ছেলে রুখিয়া আসিল। কোনো পক্ষেরই মানঅপমানের পার্থক্য রহিল না। তবু শশী ছাড়িল না-ছোট নোটবুকটিতে ভিজিট আর ওষুধের জন্য যত টাকার অঙ্কপাত করা ছিল, সমস্ত টাকা আদায় করিয়া ক্ষান্ত হইল। টাকাটা পকেটে পুরিয়া বলিল, দু দুটো চাকরে ছেলে আপনার,–ডাক্তারের ফি দিতে মরেন কেন বাঁড়ুয্যেকাকা? কলকাতায় ডাক্তার দেখে তার সঙ্গে যে এ রকম করবেন না কখনও, জুতো মেরে যাবে।

ফিরতে ইচ্ছা হয় না শশীর,-অনেকক্ষণ ধরিয়া আরও তীব্র ভাষায় সকলকে গালাগালি দিতে ইচ্ছা হয়, সে একটা কটু আনন্দের নিবিড় স্বাদ পায়। বাসুদেবের বিধবা বউটি, মৃত ভুতোকে বাঁচানোর জন্য একদিন যে শশীর পথ আটকাইয়াছিল, হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়ায় শশী যেন চমকাইয়া গেল। ভূতোর মৃত্যুর তিন মাস পরেও এ-বাড়ির কাছাকাছি পথ দিয়া যাওয়ার সময় শশী এর বিনানো কান্না শুনিয়াছে। আজও সে কাঁদিতেছিল, নিঃশব্দে। আশ্চর্য নয়, যার চিকিৎসায় ভুতো বাঁচে নাই, সেই ডাক্তার আসিয়া ভিজিটের টাকার জন্য এমন কান্ড করিলে মন যার স্নেহকোমল সে তো কাঁদিবেই। পাংশুমুখে শশী পলাইয়া আসিল।

ভূতোর চিকিৎসার হিসাব যে সে ধরে নাই,-যে টাকা সে আদায় করিয়াছে তার প্রত্যেকটি পয়সা যে এ-বাড়ির জন্য লোকের অসুখের চিকিৎসা করার দরুন,–যারা আজও সুস্থ শরীরে বাঁচিয়া আছে, বউটি একবারও তাহা ভাবিবে না। ভূতোর জন্য মন কেমন করিলে গাওদিয়ার শশী ডাক্তারকে স্মরণ করিয়া সে শিহরিয়া উঠিবে। হয়তো কোনোদিন শহরের প্রতিবেশিনীদের কাছে গ্রামের গল্প বলিবার সময় আজিকার ঘটনার উল্লেখ করিয়া বলিবে, গাঁয়ের ডাক্তারগুলো পর্যন্ত এমনি মানুষ দিদি, আমরা গাঁ ছেড়ে এসেছি কি সাধে?

 

কয়েক দিন পরে শশীর একবার কলিকাতা যাওয়ার প্রয়োজন ছিল,— কয়েকখানা বই ও কতগুলি ওষুধ কিনিবে। একদিন পরাণ লজ্জিত মুখে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, কলকাতা যাবার বায়না নিয়ে মতি বড়ো কাঁদা-কাটা জুড়েছে ছোটোবাবু।

শশী অবাক হইয়া বলিল, কলকাতা যাবে? কার সঙ্গে?

বলছে আপনার সঙ্গে যাবে।

শশী হাসিয়া বলিল, তুমি বুঝি তাই আমাকে বলতে এসেছ, যদি নিয়ে যাই? তোমার বুদ্ধি নেই পরাণ। আমি যেতে পারি নিয়ে,–গাঁয়ের লোক বলবে কী?

শশী একা মতিকে লইয়া কলিকাতা যাইবে, পরাণ সেকথা বলিতে আসে নাই। পরাণও সঙ্গে যাইবে বইকী। মোক্ষদা বারকয়েক গঙ্গায়ানের ইঙ্গিত করিয়াছে,-এ সুযোগ বুড়ি ছাড়িবে মনে হয় না। সুতরাং কুসুমও যাইবে সন্দেহ নাই। মতির জন্য এবার ফতুর হইতে হইবে পরাণকে,-এতগুলি মানুষের কলিকাতা যাওয়া-আসার খরচ কি সহজ। কিন্তু না-গেলেও চলিবে না,-মতি দুদিন নাওয়া-খাওয়া ছাড়িয়া কাঁদিয়াছে।

হঠাৎ ওর এত কলকাতা যাওয়ার শখ হল কেন? শশী জিজ্ঞাসা করিল।

পরাণ তা জানে না। মাথা নাড়িয়া জ্ঞানীর মতো সে শুধু বলিল, জানেন ছোটোবাবু, নাই দিয়ে দিয়ে কর্তা ওর মাথাটা খেয়ে গেছে।

নাই তুমিও ওকে কম দাও না পরাণ!

শশী মতিকে বুঝানোর চেষ্টা করিল। বলিল, কী চাস তুই আমাকে বল, কিনে আনব তোর জন্যে–কী করবি মিছামিছি কলকাতা গিয়ে? মতি ভীরু ও শান্ত, শশীর কথা সে চিরকাল মানিয়া আসিয়াছে,–আজ কিন্তু সে কোনো কথা কানে তুলিল না।

শেষে শশী রাগিয়া বলিল, চল তবে চল। তোকে কলকাতায় ফেলে রেখে আমরা চলে আসব। তখন টের পাবি।

নৌকা, স্টিমার, রেল, তবে কলকাতা। সমস্ত পথ মতি অস্থির, উত্তেজিত হইয়া রহিল! কুসুম চারদিক দেখিতে দেখিতে বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করিতে করিতে চলিল, কিন্তু মতির যেন নদীর বুকে, রেলপথের দুধারে দেখিবার কিছু মিলিল না। অতটুকু মেয়ে, জীবনে এই প্রথম দূরদেশে বেড়াইতে চলিয়াছে, চোখের পলকে পথ ফুরাইয়া গন্তব্যস্থানে পৌঁছাইয়া যাওয়ার ভয়টাই ছিল তার পক্ষে স্বাভাবিক, কিন্তু তার একান্ত আগ্রহ দেখা গেল তাড়াতাড়ি কলিকাতায় উপস্থিত হইতে। হয়তো সে ভাবিয়াছিল কলিকাতায় পা দেওয়া মাত্র কুমুদের দেখা মিলিবে,–তাকে শহরে অভ্যররথনা করিয়া লইবে রাজপুত্র প্রবীর!

পথে একবার সে জিজ্ঞাসা করিল, কলকাতায় আমরা কোথায় থাকব ছোটোবাবু? আপনার সেই বন্ধুর বাড়িতে?

শশী বলিল, খুব তাহলে যাত্রা শুনতে পারিস, না? যাত্রা শুনবার লোভে তুই কলকাতায় চলেছিল নাকি মতি? থিয়েটার দেখিস একদিন, দেখাব তোদের–যাত্রার চেয়ে সে ঢের ভালো।

পাঁচ দিন তাহারা কলিকাতায় রহিল। যা-কিছু দেখার ছিল শহরে দেখিয়া বেড়াইল। স্নান করিল গঙ্গায়, পূজা দিল কালীঘাটে, ট্রামে চাপিয়া অকারণে ঘোরাফেরা করিল। কিন্তু কোথায় মতির রাজপুত্র প্রবীর? শশীর সে বন্ধু, এই শহরের কোথাও সে বাস করে। কিন্তু শশী একবার না করিল তার নাম, না আনিল তাকে ডাকিয়া। শহরের অফুরন্ত বিস্ময় অভিভূত করিয়া না রাখিলে মতির দুচোখ ভরিয়া হয়তো জল আসিত। শিয়ালদহের কাছে একটা হোটেলে তাহারা দু-খানা ঘর ভাড়া করিয়াছে-একটা ঘর শশীর একার। একদিন শশী এক ডাক্তার বন্ধুর বাড়ি রাত কাটাইয়া আসিল। রাত্রে উকি দিয়া তার ঘর খালি দেখিয়া মতি ভাবিল শশী তবে নিশ্চয় কুমুদের কাছে গিয়াছে – সকালে দুজনে একসঙ্গে আসিবে। কুমুদ ছাড়া জগতে শশীর আর কোনো বন্ধু আছে বলিয়া মতি জানে না। পরদিন বেলা দশটা বাজিয়া গেল, সকাল হইতে মতি সিড়ি দিয়া হোটেলের সমস্ত লোকের ওঠানামা চাহিয়া দেখিল, কিন্তু শশী অথবা কুমুদ কেহই আসিল না। পরাণের সঙ্গে সেদিন তাহার জাদুঘরে যাওয়ার কথা,-সকাল সকাল খাওয়াদাওয়া সারিয়া বাহির হওয়া দরকার,-মতি নড়িতে চায় না।

ছোটোবাবু আসুক?

ছোটোবাবু এবেলা আসবে না মতি, এলে এতক্ষণ আসত।

ওবেলা জাদুঘর যাব দাদা, অ্যাঁ? এবেলা বড্ড শীত।

পরাণের চাদরটা গায়ে জড়াইয়া মতি ঠিরঠির করিয়া শীতে কাঁপে।

কুসুম বলে, মর তুই আহ্লাদী মেয়ে ছোটোবাবু আজ মটরগাড়ি চাপাবে না লো, পিত্যেশ করে থেকে করবি কী? দেরি হল বলে মটর এল সেদিন, মটরে ঢের পয়সা লাগে। নাইবি তো নেয়ে ফ্যাল মতি, নয়তো ভাত দিয়েছি খাবি আয়।

যাইতে হইল মতিকে। জন্তু-জানোয়ার দেখিয়া সন্ধ্যার সময় হোটেলে ফিরিয়া সে দেখিল, ঘরে বসিয়া শশী চা খাইতেছে-একা। কুমুদ নিশ্চয় আসিয়াছিল, বসিয়া বসিয়া বিরক্ত হইয়া চলিয়া গিয়াছে।

মতি সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কখন এলেন ছোটোবাবু?

শশী বলিল, এই তো এলাম খনিক আগে। কোথায় গিয়েছিলি-জাদুঘর? কাল কিন্তু শেষ দিন মতি, পরশু আমরা ফিরে যাব।

মতির তাতে কোনো আপত্তি নাই। আর কলিকাতায় থাকিয়া কী হইবে?

পরদিন সন্ধ্যার সময় শশী বিন্দুর খবর আনিতে গেল। নন্দ থাকিলে রাগ করিবে, হয়তো অপমানও করিবে। করুক। সেজন্য বোনটা বাঁচিয়া আছে কি না এইটুকু না জানিয়া বাড়ি ফেরা যায় না। গোপালের খেয়ালে জীবনে যারা দুঃখ পাইয়াছে তাদের জন্য শশীর মনে একটা অতিরিক্ত মমতা আছে। গোপালের কীর্তিতে নিজেকেও সে কেমন অপরাধী মনে করে। মনে হয়, তারও যেন দায়িত্ব ছিল।

পাড়াটা ভালো নয়। সে পথের শেষাশেষি বিন্দুর বাড়ি-সন্ধ্যার পর মানুষকে সে পথে হাঁটিতে দেখিলে চেনা লোক নিন্দা রটায়। তবে বিন্দুর বাড়িটা একটু তফাতে,– ভদ্রপাড়ার গাঁ ঘেষিয়া! বাড়ির পুবদিকে খানিকটা জমি খালে পড়িয়া আছে। ইট-সুরকির তলে সমাধি পাওয়া বিন্দু বোধহয় ওইদিকে চাহিয়া মাঝে মাঝে অবরুদ্ধ নিশ্বাস ত্যাগ করে।

বিন্দু বাড়ি ছিল না। বিন্দুকে শশী প্রায় আড়াই বছর পরে দেখিল। প্রায় তেমনি আছে বিন্দু। বিন্দুর ঘরের চেহারাও বিশেষ বদলায় নাই।

কেমন আছিস বিন্দু?

ভালো আছি দাদা, কবে এলে? সবাই ভালো আছে তো?

শশী হাসিয়া বলিল, কেন? চিঠি লিখে খবর নিতে পারিস না?

বিন্দু বলিল, চিঠি লিখতে বড় আলসেমি লাগে দাদা!

শশী জানে এটা ফাঁকির কথা। নন্দ চিঠি লিখতে দেয় না। শশীকে খাবার দিয়া নানাকথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। গাওদিয়া গ্রামটি সম্বন্ধে আজও বিন্দুর কৌতুহল আছে। কে বাঁচিয়া আছে, কে স্বর্গে গিয়াছে, চেনা ছেলেমেয়েদের মধ্যে কার কার বিবাহ হইয়াছে, কার কটি ছেলেমেয়ে–শশীর মুখে এসব খবর শুনিতে শুনিতে বিন্দুর চোখ ছলছল করিতে লাগিল।

শশী বলিল, এর মধ্যে তোর খোকা-খুকি কিছু হয়নি বিন্দু?

বিন্দু ঘাড় নাড়িল। কিন্তু মুখে বলিল উলটা কথা।

মরে গেল যে!

মরে গেল? কবে মরে গেল?

আর বছর।

শেষবার দেখিতে আসিয়া শশীর মনে হইয়াছিল বিন্দুর বোধ হয় ছেলে হইবে। সে ছেলে হইয়া তবে মরিয়া গিয়াছে? বিন্দু দেওয়ালের গাঁয়ে রাধাকৃষ্ণের ছবিটার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। হঠাৎ শশীর মনে হইল শরীরটা বিন্দুর ঠিক আছে, কিন্তু মুখটা তাহার কেমন এক অদ্ভুত রকমের রোগাহইয়া গিয়াছে। মুখের চামড়ার নিচেই যেন শুষ্কতা,–ত্বকের লাবণ্য শুষিয়া লইতেছে।

তোর অসুখবিসুখ করেছে নাকি বিন্দু?

কিসের অসুখ? বেশ আছি আমি।

বাহিরে গিয়া বিন্দু কোথা হইতে একপাক ঘুরিয়া আসিল।

ভালোই আছিস বিন্দু, অ্যাঁ?

আছি বইকী!

সমস্ত ব্যাপারটা এমন বিস্ময়কর লাগে! এমন রহস্যময় মনে হয় বিন্দুর মুখের গোপন-করা বুড়োটে ভাব, বিন্দুর অবসারক্লিষ্ট, নিরুত্তেজ কথা। বিন্দু তার বোন, পাতানো সম্পর্ক নয়। ছুরি দিয়া আঙুল কাটিয়া দিলে দুজনের যে রক্ত বাহির হইবে তাহা এক, কোনো পার্থক্য নেই। অথচ বিন্দুকে সে একরকম চেনে না, বোঝে না।

শশী মমতার সঙ্গে বলিল, অত দূর বসলি যে এদিকে আয়, এখানে বোস।

বিন্দু উদ্ধতভাবে বলিল, কেন?

শশী বলিল, আয়, সরে আয়, কটা কথা শুধোই তোকে।

ইতস্তত করিয়া বিন্দু কাছে আসিল। তার দুচোখ দিয়া জল পড়িতেছে।

কাঁদিস কেন?

এ প্রশ্নে বিন্দু ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

কোনোদিন তুমি আমাকে কাছে ডেকেছ! কেউ ডেকেছে!

শশী অবাক হইয়া যায়। কিন্তু বলিতে পারে না। এ বাড়িতে আসিয়া পরের মতো আধঘণ্টা বলিয়া সে চিরদিন বিদায় লইয়াছে, তা সত্য। কিন্তু কী করিতে পারিত শশী? কদাচিৎ অতটুকু সময়ের জন্য সে যে আসিত, তাতেই নন্দ পাছে রাগ করিয়া বিন্দুকে কষ্ট দেয় শশীর সেজন্য ভয় করিত। বিন্দুর মনে তাতে এত ব্যথা লাগিত সেই নিরুপায় অনাদরে? বিন্দু তো কোনোদিন কিছু বলে নাই মুখ ফুটিয়া।

অনেক দিনের অভিমানে বিন্দু অনেকক্ষণ কাঁদিল। শেষে সে শান্ত হইল, শশী বলিল, তোর ব্যাপারটা খুলে বল তো বিন্দু?

কিছু না দাদা।

শশী বুঝাইয়া বলিল, আজ না বললে আর কোনোদিন বলতে পারবি না বিন্দুঅন্যদিন লজ্জা করবে। নন্দ খারাপ ব্যবহার করে?

হুঁ। আমাকে ভীষণ শাস্তি দিচ্ছে।

ভীষণ শাস্তি? নন্দ ভীষণ শাস্তি দিতেছে বিন্দুকে? বিন্দুর এমন বাড়ি, এত কাপড়গয়না, এত বিলাসিতার ব্যবস্থা!

হু। তোকে ভালোবাসে না, বিন্দু? বাসে–স্ত্রীর মতো নয়–রক্ষিতার মতো।

অ্যাঁ? কিসের মতো?–শশী যেন বুঝিতে পারে। গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাসকরা কলিকাতার অনামী-রহস্য শশীর কাছে স্বচ্ছ হইয়া আসে।

বিন্দু বলিল, দেখবে? উনি এলে কোনো ঘরে বসেন দেখবে দাদা? চলো দেখাই।

কী সে তীব্র আলো! গোটা-তিনেক বালব ঘিরিয়া কাচের ঝাড় ঝলমল করে-শশীর চোখ যেন ঝলসিয়া গেল। দেওয়ালে আট-দশটা অশ্লীল ছবি। মেঝে জুড়িয়া ফরাশ পাতা। তাতে কয়েকটা বড় বড় তাকিয়া। হারমোনিয়াম, বাঁয়া তবলা এসবও আছে।

বিন্দু বলিল, গান শিখিয়েছেন। উনি তবলা বাজান, আমি গান করি।

শশীর আর কিছু দেখিবার অথবা শুনিবার ইচ্ছা ছিল না। সে মড়ার মতো বলিল, ওঘরে চল বিন্দু।

বিন্দু শক্ত করিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, না, আসল জিনিস দেখে যাও।

ঘরে ছোটো একটি আলমারি ছিল। টানিয়া দরজা খুলিয়া বিন্দু বলিল, দ্যাখো।

শশী না-দেখিয়াই অনুমান করিয়াছিল। আলমারির তাকগুলি নানা আকারের নানা লেবেলের বোতলে বোঝাই হইয়া আছে।

নিজেকে শশীর অসুস্থ মনে হইতেছিল। এমন কান্ডও ঘটে সংসারে? কত শক্ত মেয়ে বিন্দু! এতকাল একথা সে চাপিয়া রাখিয়াছিল? ছেলে হইয়া মরিয়া না গেলে, স্নেহ করিয়া কাছে না ডাকিলে, আজও হয়তো সে কিছু বলিত না।

তুই খাস?

না খেলে ছাড়ছে কে দাদা? দ্যাখো, আমার একটা দাঁত বাঁধানো–প্রথম দিন সাড়াশি দিয়ে দাঁত ফাঁক করে গলায় ঢেলে দিয়েছিল। তার পর থেকে নিজেই খাই।

এদিকের ঘরে আসিয়া শশী বলিল, জোর করে বিয়ে দেবার জন্যে, না?

বিন্দু বলিল, না। আমি হাবভাব দেখিয়ে ভুলিয়েছিলাম বলে।

কিন্তু তা তো তুই করিসনি? তুই তখন কতটুকু!

ও তাই মনে করে দাদা।

বিন্দুর শুষ্ক চোখ এতক্ষণ জ্বলজ্বল করিতেছিল, আবার স্তিমিত সজল হইয়া আসিল। চোখ মুছিয়া বলিল, কেন মিথ্যে তোমায় বললাম।

শশী ভাবিতেছিল, বিন্দুর কথায় চমকাইয়া গেল। এমন হতাশ হইয়া গিয়াছে বিন্দু? ভাবিতে ভাবিতে শশীর মুখ কালো আর কঠিন হইয়া ওঠে। অন্যদিকে চাহিয়া সে জিজ্ঞসা করিল, নন্দ আর কাউকে আনে,–বন্ধুবান্ধব?

বিন্দু বলিল, না না ছি, ও সব বুদ্ধি নেই। যা শাস্তি দেবার নিজেই দেয়। তারপর মৃদুস্বরে আবার বলিল, অসুখ-বিসুখ হলে খুব ভাবে দাদা, সেবাও করে।

শশী অনেকক্ষণ ভাবিল।

আমার সঙ্গে যাবি বিন্দু? বিন্দু উৎসুক হইয়া বলিল, কোথায় যাব তোমার সঙ্গে?

শশী বলিল, কাল আমরা দেশে বলে যাব,–যাবি?

বিন্দু ব্যগ্র হইয়া বলিল, যাব। চলো এখনি বেরিয়ে পড়ি দাদা, হঠাৎ যদি এসে পড়ে?

বিন্দুর যেন এক মিনিটও সবুর সইবে না। এতকাল এখানে সে কেমন করিয়া ছিল কে জানে। গাড়িতে শশী তাহাকে এই কথাই জিজ্ঞাসা করিল।

পথের পাশে সাজানো দোকানের দিকে চোখ রাখিয়া বিন্দু বলিল, ভেবেছিলাম ক্ষমা করবে।

 

এতকাল পরে এ কী প্রত্যাবর্তন বিন্দুর? গহনা কই, কাপড় কই, মোটবহর কই? গ্রামের লোক অবাক মানিল বিন্দুকে জ্বালাতনও কম করিল না। ব্যাপারটা বুঝিবার জন্য সকলেই উৎসুক। জেরায় জেরায় বাহিরে পুরুষদের এবং ভিতরে মেয়েদের জীবন অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। শশী আর বিন্দু নিজে ছাড়া কেহ কিছু জানিত না, কেহ কিছু জানিতেও পারিল না। তাই মুখে মুখে নানা কথা প্রচারিত হইয়া গেল।

সেনদিদিই বিন্দুকে যন্ত্রণা দিল সবচেয়ে বেশি। শশীকে অবাক করিয়া কিছুদিন হইতে সেনদিদি হামেশা এ বাড়িতে আসিতেছিল। গোপালের সঙ্গে তার যেন একটা সন্ধি হইয়াছে। কুর্তায় ভুড়ি ঢাকিয়া গোপাল তামাক টান, অদূরে সিড়ি পাতিয়া বসিয়া সেনদিদি তার সঙ্গে করে আলাপ। সেনদিদির দাগী মুখ আর কানা চোখ দেখিয়া গোপালেরও যেন একটা রোগ আরাম হইয়া গিয়াছে। আজকাল সে প্রসন্ন প্রশান্ত। গ্রাম্য রমণীর আবেগপূর্ণ মমতায় সেনদিদি শশীকে আকর্ষণ করিত বটে এবং লাবণ্যবতীর স্নেহ স্বভাবতই মানুষ একটু বেশি পছন্দ করে বলিয়া সে মমতা দামিও ছিল শশীর কাছে। কিন্তু একথা শশী কখনও বিশ্বাস করে নাই যে পড়ন্ত সূর্যের মতো শেষ যৌবনের অত্যাশ্চর্য রূপের অস্ত্রে ছেলেকে বশ করিয়া গোপালের উপর একটা উপযুক্ত প্রতিরোধ গ্রহণের এতটুকু ইচ্ছাও সেনদিদির ছিল। গোপালের বাঁকা মন বাঁকা মানে খুঁজিত। তাই সেনদিদির বর্তমান শ্রীহীনতায় গোপালের প্রসন্নভাব শক্ৰ বুঝিতে পারে। বুঝিতে পারে না সেনদিদির আসা-যাওয়া। চিরকাল যে গল্প করিতে পারে, শশীকে তা যেন অপমান করে। মাঝে মাঝে হাসির কথাও বুঝি বলে গোপাল, কারণ সেনদিদির কুশ্রী মুখখানা অনিন্দ্য হাসিতে ভরিয়া যাইতেও দেখা যায়। শশী জানে, খুব অল্পবয়সে সেনদিদির ভার গোপালের ঘাড়ে পড়িয়াছিল। তারপর কত টাকার বিনিময়ে সেনদিদিকে গোপাল যামিনীর কাছে বিসর্জন দিয়াছিল তাও শশী জানেদেড়শো টাকা! গোপালের গ্রাম্য রসিকতায় সেই সেনদিদি আজ এমন অকুণ্ঠ হাসি হাসিতে পারে ভাবিলে গ্রামের উপরেই শশীর বিতৃষ্ণা যেন বাড়িয়া যায়।

বিন্দুকে সেনদিদি একদিন একাই প্রায় তিনঘণ্টা কোণঠাসা করিয়া রাখিল। বাক্যহারা মেয়েটাকে কত কথাই সে যে বলিল তার ঠিকঠকানা নাই। বিন্দু বেশির ভাগ কথার জবাব পর্যন্ত দিল না। তাতে দমিবার পাত্রী সেনদিদি নয়। নিজের প্রশ্ন করিয়া নিজেই একটা পছন্দসই জবাব আবিষ্কার করিয়া বিন্দুর সম্বন্ধে নিজের কাল্পনিক জ্ঞানকে সে অবাধে আগাইয়া লইয়া গেল। মোট কথাটা দাঁড়াইল এই : নন্দ আর একটা বিবাহ করিয়া বিন্দুকে দেখাইয়া দিয়াছে। নন্দর তাহলে তিনটে বিয়ে হল—না দিদি? কী মানুষ নন্দ, অ্যাঁ? শশী বুকি খবর পেয়ে আনতে গিয়েছিল? তাই তো বলি, হঠাৎ কেন শশী কলকাতা গেল। আমি জানি দিদি তোর এমন অদেষ্ট হয়েছে!

এমনি আবেগপূর্ণ মমতা সেনদিদির কানা চোখ ভরিয়া তাহার অশ্রু টলমল করিতে লাগিল!

কুসুম যেদিন শশীর ঘর দেখিয়া গিয়াছিল তারপরে নির্জনে কুসুমের সঙ্গে শশীর আর দেখা হয় নাই। একদিন ভোরবেলা সেই জানালা দিয়ে কুসুম তাহাকে ডাকিয়া তুলিল। শশী উঠিয়া দ্যাখে গোলাপের সেই চারটিকে আজও কুসুম পায়ের তলে চাপিয়া দাঁড়াইয়াছে। কাটা ফুটিবার ভয়ও কি নাই কুসুমের মনে?

আজও চারাটা মাড়িয়ে দিলে বউ! কত কষ্টে বাঁচিয়েছি সে বার।

ইচ্ছে করেই দিয়েছি ছোটোবাবু, চারার জন্যে এত মায়া কেন? দরকার আছে, তবু ডাকতে আসতে হবে,-রাগ হয় না মানুষের?

শশী বলিল, কী দরকার বউ?

কুসুম বলিল, তালপুকুরে আসুন একবার, বলছি।

শশী তালপুকুরে গেল। কনকনে শীতে তালগাছগুলি পর্যন্ত যেন অসাড় হইয়া গিয়াছে। পুকুরের অনেকখানি উত্তরে একটা তালগাছ মাটিতে পড়িয়াছিল, শশীকে কুসুম সেইখানে লইয়া গেল। নিজে তালগাছের গুড়িটাতে জাকিয়া বসিয়া হুকুম দিয়া বলিল, বসুন ছোটোবাবু, অনেক কথা, সময় নেবে বলতে।

শশী কিছু বলিল না। কুসুমের অনেকখানি তফাতে বসিল। কুসুম যেন একটু অবাক হইয়া গেল প্রথমে, তারপর হঠাৎ লজ্জায় মুখখানা তাহার লাল হইয়া উঠিল; বিন্দুর ব্যাপারটা শুনিবার জন্য কুসুম শশীকে এখানে ডাকিয়া আনিয়াছে। কৌতুহলের বশে এতক্ষণ তাহার খেয়ালও হয় নাই যে চুপিচুপি শশীকে এখানে ডাকিয়া আনিলে কতখানি উপযাচিকা অভিসারিকার মতো কাজ করা হয়।

তারপর বিন্দুর কথা জিজ্ঞাসা করিয়া কুসুম শশীকে একটু অবাক করিয়া দিল। খেয়ালি কম নয় কুসুম। বিন্দুর কাহিনী শুনিবার জন্য এত কাণ্ড! ও-কথা সে তো যেখানে খুশি বলিতে পারিত কুসুমকে!

ওর কথা শুনে কী করবে বউ?

কুসুম সবিস্ময়ে বলিল, আমাকে বলবেন না?

শশীর গোপন কথা কুসুমকে না-বলার মতো সৃষ্টিছাড়া ঘটনা যেন আর নেই। জীবনে আজ প্রথম শশী কুসুমের প্রকৃতির একটা আশ্চর্য দিক আবিষ্কার করিয়া অভিভূত হইয়া গেল। একটি বালিকা আছে কুসুমের মধ্যে, মতির চেয়েও যে সরল, মতির চেয়েও নির্বোধ। সংসারকে দেখিয়া শুনিয়া কুসুমের যে-অংশটা বড় হইয়াছে, এই বালিকা কুসুমটি তার আড়ালে বাস করে। সংসারকে যখন সে ভুলিয়া যায়, জীবনের যত দায়িত্ব, যত জটিলতা আছে, কিছুই যখন তাহার নাগাল পায় না, তখন তাহার এই বিস্ময়কর দিকটা চোখে পড়ে। শশী বুঝিতে পারে, এতকাল কুসুমের যেসব পাগলামি সে লক্ষ্য করিয়াছে,-ওর শান্ত সহিষ্ণু ও গম্ভীর প্রকৃতির সঙ্গে যা কোনোদিন খাপ খাওয়ানো যায় নাই –সেসব বহু দূর-অতীতের ছেলেমানুষ কুসুমের কীর্তি-কুসুমের এখনকার পরিণত দেহমনে যার অস্তিত্ব কল্পনা করাও কঠিন।

বিন্দুর কথা ধীরে ধীরে শশী সব বলিয়া গেল। বলিতে বলিতে সে অন্যমনস্কও হইয়া গেল মাঝে মাঝে। কী রহস্যময়ী আজ তাহার মনে হইতেছে কুসুমকে। কুসুম যখন সেদিন দুপুরে তার ঘর দেখিতে গিয়াছিল, সেদিন প্রথম সে লক্ষ করিয়াছে, সব তাহার মন ভুলানোর জন্য বয়স্কা রমণীর প্রণয়-ব্যবহার। বড় দুঃখ হইয়াছিল সেদিন শশীর নিজের মনকে সে মহার্ঘ মনে করে, সে মন যেন বিকাইয়া গিয়াছিল কানাকড়ির দামে। শশী এখন তৃপ্তি বোধ করিল। তাই যদি হইত, কুসুমের সংস্পর্শে সে বছরের পর বছর কাটাইয়া দিয়াছিল, একদিনও সে কি টের পাইত না কুসুম কী চায়? একটি নারী মন জুলাইতে চাহিতেছে এটুকু বুঝিতে কি সাতবছর সময় লাগে মানুষের? এই কুসুমের মধ্যে যে কুসুম কিশোর-বয়সী, সে শুধু খেলা করিত শশীর সঙ্গে। শশী তো চিনিত না, তাই ভাবিত, এত বয়সে পাগলামি গেল না কুসুমের।

তালবন হইতে শশী সেদিন হালকা মনে বাড়ি ফিরিল।

কুসুমকে বিন্দুরও ভালো লাগিল। কুসুমের কৌতুহল মিটিয়াছিল। বিন্দুর কলিকাতার জীবন সম্বন্ধে সে কোনো কথা তুলিল না। সাধারণ নিয়মে বিন্দু বাপের বাড়ি আসিয়াছে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই, এমনি ভাব দেখাইল কুসুম। বিন্দুর কাছে সে অনেক সময় আসিয়া বসে, নানা কথা বলিয়া বিন্দুকে ভুলাইয়া রাখতে চেষ্টা করে। ওসব পারে সে। সত্যমিথ্যা জড়াইয়া জমজমাট উপভোগ কাহিনী রচনা করিতে কুসুম অদ্বিতীয়া। অপরূপ ভ্রান্তি সৃষ্টি করিবার কৌশল সে জানে চমৎকার। বলে, শহর থেকে শখ করে গাঁয়ে তো এলে ঠাকুরঝি, মরবে ভুগে ম্যালেরিয়ায়। দুবার কাপুনি দিয়ে জ্বর এলে বাপের বাড়িতে পেন্নাম করে কর্তার কাছে ছুটবে তখন।

গোপাল রাগারগি করিল,–শশীর সঙ্গে তার কলহ হইয়া গেল। চেঁচামেচি করিয়া সে বলিতে লাগিল যে এমন কাণ্ড জীবনে সে কখনও দ্যাখে নাই। স্ত্রীকে মানুষ নিজের খুশিমতো অবস্থায় রাখিবে এই তো সংসারের নিয়ম। মারধোর করিলে বরং কথা ছিল। কিছুই তো নন্দ করে নাই। যা সে করিয়াছে বিন্দুর তাতে বরং খুশি হওয়াই উচিত ছিল। যদি নিজের একটা খাপছাড়া খেয়াল মিটাইতে চায়, স্ত্রীর সেটা ভাগ্যই বলিতে হইবে। স্বামীর সে অধিকার থাকিবে বইকী! মদ খায় নন্দ? সংসারে কোন বড়লোকটা নেশা করে না শুনি? তখন বলিলেই হইত, অত অষ্টে বড়লোক জামাই যোগাড় না করিয়া একটা হা-ঘরের হাতে মেয়েকে সঁপিয়া দিত গোপাল,—টের পাইত মজাটা!

কেন ওকে তুই নিয়ে এলি শশী! তোর কর্তালি করা কেন। ছেলেখেলা নাকি এসব, অ্যাঁ? রেখে আয় গে,–আজকেই চলে যা।

তা হয় না বাবা। আপনি সব জানেন না,–জানলে বুঝতেন ওখানে বিন্দু থাকতে পারে না।

এতকাল ছিল কী করে?

সেকথা ভাবিলে শশীও কি কম আশ্চর্য হইয়া যায়!

গোপাল মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে, গয়নাগাটি জিনিসপত্র কী করে এলি?

আনিনি বাবা।

কেন, আনোনি কেন?

আমার কী ছিল যে আনব? আনলে চোর বলে জেলে দিত।

শুনিয়া গোপাল রাগিয়া ওঠে।–জেলে দিত! গোপাল দাসের মেয়েকে অত সহজে কেউ জেলে দিতে পারে না। তোরা সবকটা ছেলেমানুষ, কাঁচা বুদ্ধি তোদের। তোরা ঢের কষ্ট পাবি, এই আমি বলে রাখলাম।

গোলমাল করার ফল হইল এই, শশীর সঙ্গে গোপালের আবার কথা বন্ধ হইয়া গেল। ছেলের সঙ্গে এরকম মনান্তর গোপালের বাৎসল্যেরও জগতে মস্বত্তরের সমান, বড় কষ্ট হয়। দিন যায়, কলহ মেটে না। গোপাল উশখুশ করে। ছেলে যেন আকাশের দেবতা হইয়া উঠিয়াছে,-নাগাল পাওয়া কঠিন। শেষে গোপাল নিজেই একদিন মরিয়া হইয়া শশীর ঘরে যায়। শশী মোটা ডাক্তারি বইটা নামাইয়া রাখিলে সেটা সে টানিয়া লয়, পাতা উলটায়, আর ছেলের এত মোটা বই পড়িবার অমানুষি প্রতিভায় সুস্পষ্ট গর্ববোধ করে। বলে, যতক্ষণ বাড়িতে থাকো বই পড়ে সময় কাটাও, শরীর তোমার খারাপ হয়ে যাচ্ছে শশী। এত পড়ো কেন, পরীক্ষা তো নেই? আগে তো এরকম পড়তে না দিনরাত?

ডাক্তারের সর্বদা নতুন বিষয় জানতে হয়।–শশী বলে।

যা তুমি জানো শশী, গাঁয়ে ডাক্তারি করার পক্ষে তাই ঢের।

শহরে গিয়ে যদি বসি কখনও—

কী বিচিত্র চক্র কথোপকথনের বিন্দুর কথা আলোচনা করিতে আসিয়া কী কথা উঠিয়া পড়িল দ্যাখো। শহর? শহরে গিয়া ডাক্তারি করার মতলব আছে নাকি শশীর? তাই এত পড়াশোনা? গোপাল বিবর্ণ হইয়া যায়। এই গ্রামে একদিন কুঁড়েঘরে গোপালের জন্ম হইয়ছিল এইখানে একদিন সে ছিল পরের দুয়ারে অন্নের কাঙাল। আজ সে এখানে দালান দিয়াছে; একবেলায় তার দাওয়ায় পাত পড়ে ত্রিশখানা। চারিদিকে ছড়ানো টাকা, ছড়ানো জমি-জায়গা। ঘরে-বাইরে এখানে তাহার আদর্শ বাঙালি জীবনের বিস্তার। এইখানে মরিতে হইবে তাহাকে। শশী এখানে থাকিবে না, অনুসরণ করবে না তার পদাঙ্ক? গোপল ব্যাকুল হইয়া বলে, ওসব সর্বনেশে কথা মনে এনো না শশী।

শশী বলে, সময় সময় মনে হয় শহরে বসলে পয়সা বেশি হত—

ছাই হত! শহরে ঢের বড় বড় ডাক্তার আছে,-তুমি সেখানে পাত্তাও পাবে না শশী। এখানে মন্দ কী হচ্ছে তোমার? তা ছাড়া, ডাক্তারিতে পয়সা না এলেও তোমার চলবে। জমিজমা দেখবে, সুদ গুনে নেবে। ডাক্তারিতে কিছু হয় ভালো, নাহয় না-ই হবে। গায়ে আর ডাক্তার নেই, অচিকিচ্ছেয় মরে গায়ের লোক, সেটাও তো দেখতে হবে?–বড় তুই স্বার্থপর শশী।

গোপাল পালায়। কী বলিতে কী বলিয়া ফেলিবে, আবার হয়তো পনেরো দিন কথা বন্ধ থাকিবে ছেলের সঙ্গে। খানিক পরে গোপাল আবার শশীর ঘরে ফিরিয়া যায়। বলে, চাবিটা ফেলে গেলাম নাকি রে?

শশী বলে, চাবি? ওই যে আপনার পকেটে চাবি?

চাবির ভারে কর্তার পকেটটা বুলিয়াই আছে বটে। গোপাল অপ্রতিভ হইয়া যায়। পদে পদে জব্দ করে, কী ছেলে। খানিক সে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। তারপর করে কি, হঠাৎ অন্তরঙ্গভাবে জিজ্ঞাসা করে, হ্যা রে শশী, গাঁয়ে তোর মন টিকছে না কেন বল তো, গাঁয়ের ছেলে তুই?

মন টিকবে না কেন?

তবে যে শহরে যাবার কথা বলছিস?

ঠিক করিনি কিছু। কথাটা মনে হয় এই মাত্র।

শশীর শান্ত ভাব দেখিয়া নিজের উত্তেজনায় আর এক দফা অপ্রতিভ হয় গোপাল। ছেলে বড় হইয়া কী কঠিন হইয়া দাঁড়ায় তার সঙ্গে মেশা। সে বন্ধু নয়, খাতক নয়, উপরওয়ালা নয়, কী যে সম্পর্ক দাঁড়ায় বয়স্ক ছেলের সঙ্গে মানুষের, ভগবান জানেন।

 

একদিন নন্দর একখানা পত্র আসিল বিন্দুর নামে। লিখিয়াছে চিঠি পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে ফিরিয়া গেলে এবারের মতো ক্ষমা করিবে। শশী আগুন হইয়া বলিল, ক্ষমাঃ তাকে কে ক্ষমা করে ঠিক নেই, কোন সাহসে ক্ষমার কথা লেখে? তুই যেন ভদ্রতা করে চিঠির জবাব দিতে বসিস না বিন্দু।

জবাব দেব না?

শশী অবাক হইয়া বলিল, জবাব দেয়ার ইচ্ছে আছে নাকি তোর? সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এলি, চিঠির জবাব দিবি কীরকম?

বিন্দু বলিল, দেব না দাদা।–দেব কি না জিজ্ঞেস করলাম।

এও জিজ্ঞেস করতে হয়?

বিন্দু ম্লানভাবে হাসিল, মনটা বড় নরম হয়ে গেছে দাদা—একেবারে সাহস নেই। নিজে নিজে কিছু ঠিক করতে পারি না। নইলে দাখো না, আগে কি পালিয়ে আসতে পারতাম না আমি?

একখানা চিঠি লিখিয়া নন্দ আর সাড়াশব্দ দিল না। শীতের দিনগুলি তাড়াতাড়ি কাটিয়া যাইতে লাগিল। কুসুমের সঙ্গে শশীর কদাচিৎ দেখা হয়। দেখা করিবার জন্য কোনো পক্ষেই যেন তাড়া নাই। তা ছাড়া শশী বড় ব্যস্ত। শীতকালে গ্রামে অসুখবিসুখ কিছু কম থাকে বটে, সে শুধু অন্য সময়ের তুলনায় কিছুদিন আগে বাজিতপুরের হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে মুখচেনা ছিল শশীর। তাকে সে বলিয়া আসিয়াছিল, হাসপাতালে কোনো অসাধারণ রোগী আসিলে শশীকে তিনি যেন একটা খবর দেন,— শুধু বই পড়িয়া শেখা যায় না। মাঝে মাঝে শশী বাজিতপুরে যায়। বড় রকমের অপারেশন দেখিবার সুযোগ থাকিলে নিজের রোগীদের কথা ভুলিয়া দু-একদিন সেখানে থাকিয়া আসে।

কুসুম নালিশ করে না। কী যেন হইয়াছে কুসুমের। বোধ হয় ভুলিয়া গিয়াছে নালিশ করিতে। এমন অন্যমনস্কতা মাঝে মাঝে আসে বইকী মানুষের, অভ্যস্ত কাজের যাতে ভুল হইয়া যায়।

ফাল্গুনের গোড়ায় হঠাৎ একদিন কুমুদ আসিয়া হাজির।

কদিন থাকতে দিবি শশী?

যদ্দিন থাকবি,–শশী খুশি হয়, সত্যি থাকবি?

থাকব বলেই এলাম। ভালো লাগলে থাকব।

শশী হাসিল, ভালো লাগার মতো কীই-বা আছে গায়ে? ডোবা জঙ্গল আর মুখ্য মানুষ। ভালো না-লাগলেও থাকিস কুমুদ কিছুদিন। সঙ্গীর অভাবে বড় চিন্তাশীল হয়ে উঠেছি।

কুমুদ বলিল, সঙ্গীর অভাব? বিয়ে কর না?

শশীর হাসি দেখিয়া কুমুদ গম্ভীর হইয়া বলিল, ঠাট্টা করছি না শশী, সত্যি তোর বিয়ে দরকার। শান্ত হিসেবি সাধারণ সংসারী মানুষ তুই। সাধারণ মানুষের জীবন যেমন হয় তোরও তেমনি হওয়া দরকার। অন্যরকম করে বাঁচতে গেলে তুই সুখী হতে পারবি না।

শশী বলিল, তুই তো এরকম ছিলি না কুমুদ, এসব কী পরামর্শ দিচ্ছিস?—আমার ঘরে থাকবি, না, একটা ভিন্ন ঘরের ব্যবস্থা করে দেব তোকে? কুমুদ বলিল, ভিন্ন ঘরে হলে মন্দ নয় না শশী–দু-চার ঘণ্টা একা না থাকতে পারলে কি চলে?

কবিতা লিখিস, অ্যাঁ?

না ঠিক মতো বাঁচতেই জানি না, কবিতা লিখব। লিখতে লজ্জা করে।

কুমুদ লজ্জায় কবিতা লেখে না, এটা আশ্চর্য মনে হয়। জীবনে সে কী চায়, আজও কি কুমুদ তাহা বুঝিতে পারে নাই? জীবনকে লইয়া আজও সে পরীক্ষা করিয়া চলিতেছে? কোন সাগরে মুক্তা আহরণ করিবে তারই আম্বেষণে সাতসাগরে বাসিয়া বেড়াইতেছে? এর চেয়ে বিস্ময়কর কিছু নাই যে শান্ত আর বন্য কোনো মানুষই জীবনের রহস্য ভেদ করিয়া সেই চিরন্তন স্থিতির খোঁজ পায় না, যা অপরিবর্তনীয় হইলেও চলে, যেখানে অভিনবত্ব কাম্য নয় মানুষের। শশীর মতো জীবনকে কুমুদ আজ মন্থর করিতে চায়; আর শশী প্রার্থনা করে কুমুদের অতীত দিনের উত্তপ্ত উচ্ছল জীবনের আবর্ত সুখ যে তাতে বিশেষ হইবে না তা জানে শশী। তবু মনে কেমন করে!

কুমুদ যে কেন গাওদিয়ায় আসিয়াছে শশী ঠিক তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। কতদিন থাকিবে তাই বা কে জানে। জিজ্ঞাসা করিলে কুমুদ সেই একই জবাব দেয়। যত দিন থাকতে দিবি। একথার কোনো মানে হয় না। সে যদি ছ মাস একবছরও এখানে থাকিয়া যায়, শশী কি তাহাকে বলিবে যে এবার তুমি বিদেয় হও?

কুমুদের মধ্যে একটা নূতন পরিবর্তন এবার শশীর চোখে ধরা পড়িতেছিল। সেবার তাহার মুখে চোখে কথায় ব্যবহারে যাত্রার দলে অধঃপতনের পরিচয় ছিল স্পষ্ট, এবার সে যেন বহুদিন আগেকার মতো কবি ও ভাবুক হইয়া উঠিয়াছে। কেবল পুরানো দিনের মতো এবার আর তাহার বিদ্রোহী উদ্ধত ভাব নাই। কী যেন সে ভাবে, কী এক রসালো ভাবনা, চোখের দৃষ্টি তাহার হইয়া আসে উৎসুক এবং একান্ত বেমানানভাবে সেইসঙ্গে মুখে ফুটিয়া থাকে গভীর সন্তোষ। তা ছাড়া, গাওদিয়ার মাঠে ঘুরিয়া বেড়ানোর মধ্যে কী রস সে আবিষ্কার করিয়াছে সে-ই জানে—সময় নাই অসময় নাই, কোথায় যেন চলিয়া যায়।

একদিন শশী জিজ্ঞাসা করিল, বিনোদিনী অপেরার কী হল রে কুমুদ?

কুমুদ বলিল, ও দলটা ছেড়ে দিয়েছি। বৈশাখ মাসে সরস্বতী অপেরা বলে আর একটা দলে ঢুকব,–কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে আছে। এরা মাইনে অনেক বেশি দেবে। এখনি যোগ দেবার জন্য ঝুলোবুলি করছিল, কিন্তু পার্ট বলে বলে কেমন বিরক্তি জন্মে গেছে ভাই, তাই ভাবলাম কটা মাস একটু বিশ্রাম করে নিই।

কে জানে একথা সত্য কি মিথ্যা। শশীর মনে একটা সন্দেহ উকি দিয়া যায়। সে ভাবে যে হয়তো বিনোদিনী অপেরা হইতে কুমুদকে বিদায় করিয়া দিয়াছে, কোথাও কিছু সুবিধা করিতে না পারিয়া সে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে এখানে-সরস্বতী অপেরার কথাটার বানানো। টাকাকড়ি কিছুই হয়তো কুমুদের নাই।

একদিন শশী বলল, আমায় গোটা পনেরো টাকা দিবি কুমুদ? হাতে নগদ টাকা নেই, একজনকে দিতে হবে।

কুমুদ তাহার সুটকেস খুলিল, একোণ ওকোণ হাতড়াইয়া বলিল, আমার মানিব্যাগ?

কুমুদ ভাবিল, হুঁ, এবার মানিব্যাগ তোমার চুরি যাবে! ছি কুমুদ, আমার সঙ্গেও শেষে তুই ছলনা আরম্ভ করলি!

কিন্তু না ব্যাগ আছে। আমাকাপড় নামাইয়া খুঁজিতেই ব্যাগটা বহির হইয়া পড়িল। কুমুদ বলিল, তোর কাছে রাখতে দেব ভেবে একেবারে ভুলে গিয়েছি ভাই, চুরি গেলেই হয়েছিল আর কি! যা দরকার নিয়ে রেখে দে ব্যাগটা তোর কাছে।

ব্যাগটা হাতে করিতে শশী লজ্জা বোধ করিল।

কত আছে?

কে জানে কত আছে। গুনে দ্যাখ।

 

তারপর একদিন পুকুর-ডোবা-জঙ্গলভরা গাওদিয়া গ্রামে কুমুদের আত্মনির্বাসনের কারণটা জানা গেল।

শশী বিবর্ণ হইয়া বলিল, তুই কী বলছিস কুমুদ, মতিকে বিয়ে করবি? ওইটুকু মেয়ে।

কুমুদ বলিল, বিশেষ ছোট নয়। তা ছাড়া, ছোটই ভালো। বিয়েই যদি করব, ধাড়ি মেয়ে বিয়ে করব কোন দুঃখে?

শশীর রাগ হইতেছিল। কেমন একটা জ্বালাও সে বোধ করিতেছিল, বলিল, তুই তবে এইজন্য এসেছিলি কুমুদ, বন্ধুর বাড়ি, বিশ্রামের ছল করে?

কুমুদ বিস্মিত হইয়া বলিল, বিচলিত হইয়া পড়লি যে শশী? খুব কী একটা অন্যায় কাজ করতে বসেছি আমি? ছন্নছাড়ার মত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম,-বিয়ে করে সংসারী হব, এতে তোর খুশি হওয়াই তো উচিত।

বাংলাদেশে তাই আর মেয়ে পেলি না?

কেন, মতি কী দোষ করেছে?

ওইটুকু একটা মুখ্য গেঁয়ো মেয়ে।

কুমুদ একটু হাসিল, তুই যে কার দিকে টানছিস বুঝে উঠতে পারছি না শশী। মতি মুখ্য গেঁয়ো মেয়ে বটে, আমিও তো যাত্ৰাদলের সঙ!

কুমুদের হাসি দেখিয়া শশী আরও রাগিয়া গেল। এ জগতে কিছুই যেন কুমুদের কাছে গুরুতর নয়, যখন যা খেয়াল জাগে খেলার ছলেই যেন তা করিয়া ফেলা যায়, জীবনে যেন মানুষের নিয়ম নাই, বাঁচিবার রীতি নাই। মনের রাগ চাপিয়া বিচারকদের রায় দেওয়ার ভঙ্গিতে শশী বলিল, এসব দুৰ্বদ্ধি ছেড়ে দে কুমুদ, যাত্ৰাদলের সং সেজে থাকতে তোকে কে বলেছে? সরস্বতী অপেরায় ঢুকে আর কাজ নেই, ফিরে যা তোর কাকার কাছে। কাকার তোর অত বড় মাইকার কারবার, একটা ভালোরকম কাজ তোকে তিনি দিতে পারবেন না? তখন সমান ঘরের কতো ভালো ভালো মেয়ে পাবি, তোর উপযুক্ত সঙ্গিনী হতে পারবে। খেয়ালের বশে একটা গেঁয়ো মেয়েকে বিয়ে করে কেন জ্বলে মরবি আজীবন?

কুমুদ বলিল, কাকার দুটো গ্রেট ডেন কুকুর আছে জানিস?

শশী অবাক হইয়া বলিল, না।

কাকার বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকলে কুকুর দুটো তিনি লেলিয়ে দেবেন।

কথাটা হইতেছিল শশীর ঘরে,–সন্ধ্যার পর। ঘরে সাত টাকা দামের একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলিতেছিল। এত আলোতে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিতে তাদের যেন কষ্ট হইতে লাগিল। রাগ শশীর মনে বেশিক্ষণ টেকে না। খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল, মতিকে তোর ভালো লাগল কুমুদ বিশ্বাস হতে চায় না।

প্রথমে আমারও হয়নি। সেবার যখন চলে গেলাম, কে জানত ওর জন্যে আবার ফিরে আসতে হবে!

তারপর কুমুদ তালপুকুরের পাড়ে অবোধ গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে তার ভালোবাসার জন্ম-ইতিহাস ধীরে ধীরে শশীকে শুনাইয়া দিল। এতটুকু মেয়ে মতি, তার যে এমন একটা মন থাকিতে পারে যাহাতে অতল মেহের সঞ্চার সম্ভব তা কি কুমুদ জানিত? সরল মনের স্নেহ ছাড়া আর সবই যে ফাকি মানুষের জীবনে, মতি কুমুদকে এ শিক্ষা দিয়াছে। সত্য কথা বলিতে কি, এ অপূর্ব অভিজ্ঞতা কুমুদ তো কোনোদিন কল্পনাও করে নাই। শুনিতে শুনিতে শশীর বিস্ময়ের সীমা থাকে না। মতি? ওই একরত্তি নোংরা মেয়েটা গোপনে গোপনে এত ভালোবাসিয়াছে কুমুদকে? শশীর মনে হয় সব কুমুদের বানানো,-দিবাস্বপ্ন, কল্পনা মুখে মুখে গীতগোবিন্দের মতো যে মহাকাব্য কুমুদ রচনা করিয়া চলিয়াছে, মতি কি কখনও তার নায়িকা হইতে পারে?

সেদিন অনেক রাত্রি অবধি শশী ঘুমাইতে পারিল না। কুমুদের সঙ্গে মতির বিবাহ? কেমন করিয়া ইহা ঘটিতে দেওয়া যায়। চিরদিন কুমুদ ছন্নছাড়া যাযাবরের জীবন যাপন করিয়াছে, সাময়িক একটা নীড় প্রেম তার মধ্যে দেখা দিলেও এটা যে স্থায়ী হইবে বিশ্বাস করা কঠিন। তা ছাড়া মতির মূর্খতা এবং গ্রাম্যতা অসহ্য হইয়া উঠিতে কুমুদের বোধ হয় ছমাস সময়ও লাগিবে না। কী উপায় হইবে মতির তখন? কুমুদ কষ্ট দিলে, ত্যাগ করিলে, নিরীহ বোকা মেয়েটার জীবন যে দুঃখে ভরিয়া উঠিবে কে তার দায়িত্ব গ্রহণ করিবে? একদা-প্রিয় বস্তুগুলি জীবন হইতে ছাঁটিয়া ফেলাই যে স্বভাব কুমুদের।

পরদিন কুমুদকে সে এ-বিষয়ে প্রশ্ন করিল। বলিল, মতিকে তোর বেশিদিন ভালো লাগবে কেন কুমুদ?

মতিকে আমার চিরদিন ভালো লাগবে।

কী করে লাগবে তাই ভাবছি।

কুমুদ বলিল, শশী, তুই কি ভাবিস বিয়ের পরেও মতি এমনি থাকবে? ওকে আমি মনের মতো করে গড়ে তুলব না? খনি থেকে তোলা হীরের মতো ওকে আমি গ্রহণ করছি,-নিজে কটিব, ঘষব, মাজব, উজ্জ্বল করে তুলব। ওর মনের কোনো গড়ন নেই, তাই ওকে বিয়ে করতে আমার এত আগ্রহ। ওর মনকে আমি গড়ে নেব। আমার সঙ্গিনী হতে পারে, এমন মেয়ে জগতে নেই ভাই-সঙ্গিনী আমার সৃষ্টি করে নিতে হবে আমাকেই।

শশীর অর্ধেক মন সংসারী, হিসাবী, সতর্ক-এসব বড় বড় কথা শুনিলে তার বিরক্তি জন্মে। মনের মতো গড়িয়া তুলিতে গেলে মানুষ যে মনের মতো হয় না, এটুকু জ্ঞান কি কুমুদের নাই? পরের চেষ্টায় মনের যে বিকাশ তাহা অস্বাভাবিক, অপ্রীতিকর। মতিকে ছাঁচে ঢালিয়া একটা সৃষ্টিছাড়া অদ্ভুত জীবে পরিণত করিবার ধৈর্য কুমুদের থাকিবে কিনা সন্দেহ-থাকিলেও, সেই পরিবর্তিত মতিকে কি তাহার ভালো লাগিবে? কীভাবেই বা মতিকে সে গড়িয়া তুলিবে? লেখাপড়া গানবাজনা ছবি-আকা-শুধু এইসব শিক্ষা তাকে দেওয়া সম্ভব। তার অতিরিক্ত আর কী করিতে পারবে কুমুদ? মতির নিজস্ব সত্তাটুকু পর্যন্ত কুমুদ যদি তাকে দান করে, স্বতন্ত্র সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে কী মূল্য থাকিবে মতির? কুমুদ এত জানে, এটুকু জানে না যে প্রিয়াকে মানুষ গড়িয়া লইতে পারে না। মেয়ের মতো যাকে শিখাইয়া পড়াইয়া মানুষ করা যায় তাকে বসানো চলে না প্রিয়ার আসনে?

ভাবিয়া শশী কিছু ঠিক করিতে পারে না। একসময় সে খেয়াল করিয়া অবাক হয় যে মতির সঙ্গে কুমুদের ভালোবাসার খেলাটা তাহার বিশেষ খাপছাড়া মনে হইতেছে নাওদের বিবাহের কথাটাই তার কাছে সৃষ্টিছাড়া কাণ্ডের মতো ঠেকিতেছে। মতিকে নষ্ট করিয়া কুমুদ যদি চলিয়া যাইত, শশীর দুঃখের সীমা থাকিত না, তবু যেন মনে হইত অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নাই, দুইজনের মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য তাহদের তাহাতে দুদিনের নিন্দনীয় ঘনিষ্ঠতা ছাড়া আর কী সম্পর্ক তাহাদের মধ্যে হওয়া সম্ভব? ওদের বিবাহ অবাস্তব, অর্থহীন।

এ চিন্তায় শশী লজ্জা পায়। মতির জন্য তার মনে বাৎসল্য-মেশানো একপ্রকার আশ্চর্য মমতা আছে, মতিকে কুমুদের বউ হওয়ার অনুপযুক্ত মনে করিতে তাহার কষ্ট হয়। সেদিন বিকালে মতির সঙ্গে শশীর দেখা হইল। মতি একডালা কুমড়াফুল লইয়া তাহাদেরই বাড়ি আসিয়াছিল। শশীকে যে কথাটা জানানো হইয়াছে, কুমুদ হয়তো মতিকে এ সংবাদ দিয়াছিল। শশীকে দেখিয়া মুখখানা তার রাঙা হইয়া উঠিল। তারপর একটু হাসিল মতি,–হঠাৎ লজ্জা পাইলে এ বয়সে ঠোঁটে একটু হাসির ঝিলিক দিয়া যায়। মতির মুখখানা আজ শশীর অসাধারণ সুন্দর মনে হল। সে ভাবিল, হয়তো কুমুদ ভুল করে নাই। হয়তো সত্যই একদিন সে মতিকে রূপে-গুণে অতুলনীয়া করিয়া তুলিবে।

মতি চলিয়া গেলে কুমুদের এই শক্তিতে কিন্তু শশীর আর বিশ্বাস রহিল না। খনিগর্তেও হীরার মতোই বটে মতি, তাকে একদিন অনুপমা ও জ্যোতির্ময়ী করিয়া তোলাও সম্ভব, কিন্তু কুমুদ তাহা পরিবে না। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিবার প্রতিভা আছে কুমুদের, স্বপ্নকে সফল করিবার তপস্যা নাই। মতির মুখের পেলব ত্বকে দুদিনে সে দুঃখের রেখা আনিয়া দিবে।

মনটা শশীর খারাপ হইয়া থাকে। কুমুদের প্রতি সে বিতৃষ্ণা বোধ করে সীমাহীন। এ কি বন্ধুর কাজ বন্ধুর বাড়ি আসিয়া তাহার মেহের পাত্রীর সঙ্গে গোপনে ভালোবাসার খেলা করা? উপায় থাকিলে কুমুদকে সে তাড়াইয়া দিত। কিন্তু কুমুদের কথা শুনিয়া আর তো মনে হয় না মতির কোনোদিকে আশা-ভরসা আছে। কুমুদের সম্বন্ধে মতির উৎসুক প্রশ্ন, কুমুদকে দেখিবার আশায় মতির কলিকাতা যাওয়ার আগ্রহ, সব এখন শশীর মনে পড়িতে থাকে। প্রেম? কুমুদের জন্য এতখানি প্রেম জাগিয়াছে মতির বুকে? তা ছাড়া, হয়তো মতির বুকভরা প্রেমই শুধু নয়-কুমুদকে বিশ্বাস নাই, জীবনটা কুমুদের আগাগোড়া অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ।

কী করিবে শশী ভাবিয়া পায় না। এ ব্যাপারেও তার সিদ্ধান্তই চরম। সে যদি বলে হোক, তবেই এ বিবাহ হইবে-পরাণের কাছে কথাও পাড়িতে হইবে তাহাকেই। শশীর ইচ্ছা হয়, যাই ঘটিয়া থাক-কুমুদকে সে এইদণ্ডে দূর করিয়া দেয়। চিরদিনের জন্য বন্ধুত্বের অবসান হোক, কুমুদ চলিয়া যাক তাহার যাযাবর জীবন যাপনে— গায়ের মেয়ে মতি থাকে গাঁয়ে। চিরকাল মতি দুঃখ পাইবে জানিয়াও এ বিবাহ সে ঘটিতে দিবে কেমন করিয়া।

সন্ধ্যার পর কুসুমের সঙ্গে শশী এ বিষয়ে পরমাশ করার সুযোগ পাইল। আকাশে তখন চাঁদউঠিয়াছিল। ঘরের চালা যে জ্যোৎস্নার ছায়া ফেলিয়াছিল সে ছায়ায় দাঁড়াইয়া অনেক কথা বলিবার পর শশী বলিল, একটা উপায় আছে বউ।

কী উপায়? কুসুম জিজ্ঞাসা করিল।

আমি মতিকে বিয়ে করতে পারি।

এই উপায়! কুসুম হাসিয়া ফেলিল।

শশী কিন্তু হাসিল না, বলিল, হাসির কথা নয় বউ। কুমুদের হাতে ওকে সপে দিতে সত্যি আমার ভাবনা হচ্ছে।

কুসুম গম্ভীর হইয়া বলিল, সে আপনি ওকে ছোটবোনটির মতো ভালোবাসেন বলে। মেয়ে, বোন—এদের বিয়ে দেবার সময় মানুষের এরকম ভাবনা হয়।

শশী তবু বলিল, আমি যদি মতিকে বিয়ে করি—

যদি করেন! যদি! তীব্র চাপা গলায় এই কথা বলিয়া কুসুম পরক্ষণেই আবার হাসিয়া ফেলিল, সংসারে অত যদি চলে না ছোটোবাবু। আপনি করবেন মতিকে বিয়ে! জীবনটা আপনার নষ্ট হয়ে যাবে না?

তখন শশী বলিল, কুমুদ অবশ্য একেবারে অমানুষ নয়, রোজগার-পাতিও মন্দ করে না–

কুসুম বলিল, মতির ভাগ্যি ওকে কুমুদবাবুর পছন্দ হয়েছে। পড়ত গিয়ে কোনো চাষার ঘরে,—দুবেলা চেলাকাঠের মার খেয়ে প্রাণটা ছুঁড়ির বেরিয়ে যেত। অনেক পুণ্যতে এমন বর জুটেছে ওর।

হোক হবে, তাই হোক মতি কী বলে বউ?

কী বলবে? দিন গুনছে।

দিন গুনিতেছে মতি? গুনুক!

কুসুমের উপর রাগে শশীর মন জ্বালা করিতে থাকে। সেদিন প্রত্যুষে তালবনে কুসুমের মধ্যে যে সরলা বালিকাকে আবিষ্কার করিয়া সে পুলকিত হইয়াছিল, আজ সে কোথায় গেল? কী পাকা বুদ্ধি কুসুমের কী নিখুঁত কৌশলে মতির বিবাহ সম্বন্ধে সে তার মনের মোড় ঘুরাইয়া দিল। দুদিন ভাবিয়া সে যা স্থির করিতে পারে নাই, আধঘণ্টার মধ্যে দুটো আচল যুক্তি দেখাইয়া কুসুম কত সহজে সব সমস্যার মীমাংসা করিয়া দিল। কুসুমের কাছে দাঁড়াইয়া মতির ভালোমন্দ সম্বন্ধে এমন সে নির্বিকার হইয়া উঠিল কিসে যে অনায়াসে বলিয়া বসিল, হোক তবে, তাই হোক? তাছাড়া, এসব আজ কী বলিতেছে কুসুম?

এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটোবাবু।

গভীর দুঃখের সঙ্গে শশীর মনে হয়, একথা কুসুমের বানানো। মতিকে পাছে সে আবার নিজে বিবাহ করিয়া কুমুদের হাত হইতে বাঁচাইতে চায়, তাই কুসুম এই মনরাখা বলিয়াছে। বলুক। সে তো কুমুদ নয়, তার জীবনে সবই অভিনয়। তবু, চাঁদের আলোয় চারিদিক আজ কেমন স্বপ্ন দেখিতেছে দ্যাখো। এ যেন বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় ন কুসুমের কুটিলতার বিষে এমনি সময় এত কষ্ট পাওয়া তাহার ভাগে ছিল। কিন্তু কেন সে দাঁড়াইয়া আছে, কেন সে চলিয়া যাইতে পারে না? কে জানে, হয়তো জীবনের বিতৃষ্ণা ও আত্মপ্লানি-ভরা মুহূর্তগুলির আকর্ষণ তার কাছেই এত তীব্র? কুমুদ হয়তো ছুটিয়া পলাইত, বলিয়া যাইত, তুমি গোল্লায় যাও কুসুম। অথবা হয়তো নিজের আনন্দ দিয়া, এই জ্যোৎস্নার কবিতাটুকু ছাঁকিয়া লইয়া এমনি স্থূল মুহূর্তগুলিকে অপূর্ব করিয়া তুলিত?

কুসুম নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটোবাবু?

শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *