গোষ্ঠ দাওয়ায় বসিয়া ধারকরা তামাকটুকু টানিতেছিল আর ভাবিতেছিল, লোকটা কে? সুবল? কিন্তু সুবলের দুয়ার তো বন্ধ, শিকল পর্যন্ত নড়ে না। সে হইলে দুয়ার বন্ধ করার শব্দ তো হইত, অন্তত শিকলটাও নড়িত। তবে কে?
দামিনী সাতুর বাড়ি হইতে ছুটিতে ছুটিতে আসিয়াই গোষ্ঠকে দেখিয়া সানন্দে কৌতুকে থমকিয়া মাথায় কাপড় টানিয়া দিয়া কহিল, দ্যুৎ সাড়া দেয় না, এমন লোক!
গোষ্ঠ উঠিয়া দুয়ারে ঊকি মারিয়া দেখে, দামিনীর পিছনে কে।
দামিনী কিন্তু ওদিকে খেয়াল করে না। মনে তাহার তখন রসের মাতামাতি।
রূপের উপচারে দেবতাকে অঞ্জলি দিতে সাধ হয়, শাখা-পরা হাত দুইখানি মেলিয়া দিয়া কহিল, দেখ দেখি, কেমন হয়েছে।
বীণার আ-বাধা তার ঘা খাইলে বেসুরা ঝঙ্কারই তুলিয়া থাকে, গোষ্ঠর সন্ধান-ব্যগ্ৰ সন্দিগ্ধ মন শাখা দেখিয়া শোভায় মুগ্ধ হইল না, বকা চোখে তীব্র দৃষ্টিতেই চাহিল। পাইল কোথা? সম্বল। তো সবই জানা। চট করিয়া মনে পড়িল, আবছা-দেখা লোকটাকে সুবল বলিয়াই মনে হইয়াছিল; তবে শাখার গায়ে এখনও অস্পষ্ট হাতের ছাপও সুবলের ছাপ বলিয়াই গোষ্ঠর প্রত্যয় জন্মিয়া গেল।
সে দামিনীর হাতখানা ঠেলিয়া দিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল।
দামিনীর লাজ-রক্তিম আনন্দোজ্জ্বল মুখখানি মুহুর্তে শবের মত বিবর্ণ হইয়া গেল।
ভিতরে রুণ ছেলেটা একটা গভীর যন্ত্ৰণাকাতর শব্দ করিয়া উঠিল, উঃ, মা গো!
দামিনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ঘরের দিকে চলিল।
উদ্ভ্রান্ত পদক্ষেপে চলিতে দুয়ারের চৌকাঠে হোঁচট খাইল, কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য করিবার। তাহার অবসর ছিল না; সে আর্তকণ্ঠে কহিল, কি হল ধন, আজ যে ভাল ছিলে বাবা।
ছেলেটা ওই যে মা গো বলিয়া ডাকিল, ওই শেষ ডাক, তারপর আর ডাকিল।
এমন একটা প্রবল জ্বর আসিল যে, কঙ্কালসার দেহখানা থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল, নাভি হইতে বুক পর্যন্ত দুপিয়া পুঁপিয়া ওঠে; শীর্ণ হাতখানায় বুঝি অবশিষ্ট সব শক্তি সঞ্চারিত করিয়া দেহের সকল আবরণ ঘূচাইতে চাহিল; যেন ওই তুলার আবরণ পাষাণের ভারে বুকে চাপিয়া বসিয়াছে।
বসিয়াছিল সে মরণ।
তিলে তিলে বিন্দুর পর বিন্দু ভার বাড়াইয়া রাত্রি দেড় প্রহরের সময় দেহখানার সকল স্পন্দন নীরব করিয়া দিল।
দামিনী বুক চাপড়াইয়া মেঝের পরে আছাড় খাইয়া পড়িল, আর্ত মাতৃকণ্ঠে মরণের বিজয়বার্তা ঘোষিত হইয়া গেল; নিশীথে নিস্তব্ধ পল্লীটার আকাশ বাতাস শিহরিয়া উঠিল।
গোষ্ঠ উন্মাদের মত চিৎকার করিয়া উঠিল, রাক্ষুসী সর্বনাশী, তুই আমার ছেলে খেলি; তোর পাপেই আমার ছেলে গেল। সর্বনাশী, ছেলের চেয়ে তোর সুবল বড় হল, একজোড়া শাখা বেশি হল? ওই একটা কথায় নারীর সন্তানের শোক পর্যন্ত মূক হইয়া গেল, কে যেন বুকের পরে পাহাড় চাপাইয়া দিল।
অসাড় নিস্পন্দ পাষাণপিষ্টের মত যেখানে পড়িয়া ছিল, সেইখানেই সে পড়িয়া রহিল, মৃত সন্তানটাকে বুকে টানিয়া লইতে পর্যন্ত পারিল না।
রাঙা শাখা জোড়াটা অন্ধকারের মাঝেও আগুনের মত জ্বলিতেছিল, না দামিনীর মনের মাঝে জ্বলিতেছিল, কে জানে! সহসা শাখা জোড়াটা আপন কপালে সজোরে ঠুকিয়া সে ভাঙিয়া দিল।
তারপর আবার অসাড় নিস্পন্দ।
শুধু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস-মাখানো একটি মৃদু কথা বুঝি জোর করিয়াই বাহিরে আসিতেছিল মা, উঃ মাঃ!
বাহিরে ঝরিতেছিল জল। বর্ষণমুখর শ্রাবণ-রজনীর ওই মৃদু কণ্ঠ ঘরের দাওয়ায় গোষ্ঠর কান পর্যন্তই পৌঁছিতেছিল না, তা পাড়া-প্রতিবেশীর নিদ্রাভঙ্গ হয় কি করিয়া!
আসিল শুধু সাতু। দামিনীর প্রথম বুকভাঙা আৰ্তস্বর তাহার কানে গিয়াছিল, সে যখন আসিল তখন দামিনীর কান্না থামিয়া গিয়াছে, সে পাথরের মত পড়িয়া আছে।
আরও একজন আসিল, সে সুবল।
সে সাতুরও আগে আসিয়াছিল, কিন্তু প্রবেশমুখেই উন্মত্ত গোষ্ঠর কথা কয়টা শুনিয়া আর ঘরে ঢুকিতে সাহস করে নাই, ঘরের পিছনে উঁচতলায় দাঁড়াইয়া ছিল।
সাতু কহিল, বউ, একটু কা কেনে ভাই।
দামিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, না ঠাকুরঝি, আমিই থোকাকে মেরে ফেলেছি।–বলিয়াই হু-হু করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, নীরব রোদন, অশ্রুরই ধারা শুধু।
সাতু সান্ত্বনা দিল না, দিবার প্রয়াসও করিল না।
কতক্ষণ পরে আবার দামিনী কহিল, ঠাকুরঝি, জল হচ্ছে বুঝি?
সাতু কহিল, আড়া-বিষ্টি জল, মাঠ-ঘাট ভেসে গেল। পুকুর গড়ে সব ভরে উঠেছে।
দামিনী ব্যগ্ৰ কণ্ঠে কহিল, আমাদের গড়েও তবে ভরেছে?
শঙ্কিত কণ্ঠে সাতু তিরস্কার করিল, পোড়ারমুখী, দাদার হাতে শেষে কি দড়ি পরাবি নাকি? ছি!
তারপর সব চুপ, কথা যেন সব হারাইয়া গেল।
শুধু কয়টি প্রাণীর দুঃখদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস, সে যেন শ্মশানের বুকে কঙ্কালের মালার মাঝ দিয়া বায়ু প্রবাহ।
জীর্ণ কথার পরে ছেলেটার শব।
শ্মশানখানা যেন ঘরের বুকেই প্রকট হইয়া উঠিল।
জীবন তাহা সহিতে পারে না, দূরে সরাইয়া দিতেই হইবে।
আগে কহিল সাতু, দাদা, ছেলেটার তো একটা গতি করতে হবে।
গোষ্ঠ কহে, হ্যাঁ, কিন্তু যে জল–
দামিনী কথা কহে না, মা—হয়ত সন্তানের শব সবার শেষ পর্যন্ত বুকে ধরিয়া রাখিতে চাহিবে, কিন্তু অবশেষে তাহাকেও উহা ত্যাগ করিতে হইবেই।
জীবন মরণের ভয়েই অস্থির, তাহার সান্নিধ্য সহিবে কেমন করিয়া?
সাতু কহে, পাড়ায় ডাক।
বর্ষণের পানে আঙুল দেখাইয়া গোষ্ঠ বলে, বাইরে ও কি হচ্ছে দেখছিস?
তা বলে তো বাসি করে ফেলে রাখে না। দাঁড়াও, আমি ডাকি।
সাতু উচ্চ কণ্ঠে হাকিল, মহান্ত!
দামিনী ধীরে দৃঢ় কণ্ঠে কহিল, না।
গোষ্ঠ কহিল, দাঁড়া, আমি পাড়ায় ডাকি।
সাতু কহিল, ডাকলেই আসবে?
দামিনী কহিল, আর কেউ আসবে না। সাতু কহিল, এলে ও-ই আসবে; এ জলে আর কেউ আসবে না।
ততক্ষণে লোকটি আসিয়া পড়িয়াছে; ভিজিতে ভিজিতে সুবল আসিয়া কহিল, আমাকে ডাকছিলে?
ছেলেটা নষ্ট হয়েছে, তার গতিটা করে দাও ভাই।
আর কে যাবে?
দাদাই যাবে, আর কে যাবে বল? এস, নাও, তুলে নাও, আর দেরি কোরো না।
সুবল বিব্রত হইয়া কহিল, তুমি এনে দাও মায়ের কোল থেকে।
সাতু কহিল, এস তুমি। বউ মড়ার মত পড়ে আছে এক পাশে।
সুবল ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, সত্য সত্যই দামিনী মড়ার মত পড়িয়া।
তাহার চোখে জল আসিল; তাড়াতাড়ি মুখ ফিরাইয়া বিছানাসুদ্ধ ছেলেটিকে তুলিতেই চোখে পড়িল কয়টা শাখাভাঙা টুকরা, রাঙা টকটকে, আগুনের মত ধকধক করিয়া জ্বলিতেছে যেন।
ধকধকে টুকরা কয়টা অঙ্গারের মত দাহে বিছানাটা ভেদ করিয়া তাহার অঙ্গ যেন পোড়াইয়া দিল।
ইচ্ছা করিল, ওই মরা ছেলেটাকে দামিনীর বুকে আছড়াইয়া ফেলিয়া দেয়, বলে, উপেক্ষার বিনিময়ে কি উপকার পাওয়া যায়?
সাতু পিছন হইতে বলে, নিয়ে যাও মহন্ত, নিয়ে যাও, মা কি ওই দেখতে পারে! বউ কেমন করছে।
সুবলের আর চিন্তার অবসর থাকে না, অন্ধকার বর্ষণমুখর শাঙন-রাতির সেই তাণ্ডবের মাঝে শব বুকে সে ঝাঁপাইয়া পড়িল।
সাতু কহিল, দাদা!
গোষ্ঠ সুবলের পিছন ধরিয়া কহিল, চল মহান্ত।
সাতু দামিনীকে ঠেলা দিয়া কহিল, বউ, বউ, বউ।
উত্তর নাই।
মুখে চোখে জলের ছাট দিতে দিতে অশ্ৰুরুদ্ধ কণ্ঠে সাতু কহিল, জাগিস নে হতভাগী, আর জাগিস নে।
ভাগ্য নিষ্ঠুর, দামিনীর জুড়ানো হয় না; সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জাগে।
গোষ্ঠ ও সুবল রাস্তায় জল ভাঙিয়া অতি কষ্টে শ্মশানের দিকে চলিয়াছিল।
মাথার উপর অবিরাম বর্ষণ আর দুরন্ত বাতাস; হাড়ের ভিতর অবধি কনকন করিতেছিল।
খান বিশেক মাঠ পার হইয়াই আর পথ নাই, মাঠ নাই, জল—শুধু জল, আর জলপ্রবাহের একটা কল-কল্লোল।
সুবল কহিল, বান।
পায়ে কাঠকুটার মত কি সব ঠেকিতেছিল, বিদ্যুণ্ডমকে সেগুলা চেনা যায়—পোড়া কাঠ, আঙার রাশি, ওই যে একটা কঙ্কালও।
গোষ্ঠ কহিল, শ্মশানে এসেছি নাকি মহান্ত?
না, বানের ঠেলে শ্মশানটা এগিয়ে এসেছে। কথাটা শেষ হয় না, ওইটুকু বলিয়া বক্তাও। শিহরে, শ্রোতাও শিহরে।
সুবল আবার বলে, তা–হলে–
স্বর বুঝিয়া গোষ্ঠ উত্তর দিল, হ্যাঁ, দাও তা হলে এইখানেই—
সুবল নামিয়া গিয়া বন্যার প্রবাহের মুখে শবটা ছাড়িয়া দেয়।
গোষ্ঠ গম্ভীর কণ্ঠে কহে, যা, চলে যা, তুই তো জুড়লি। আমার বুকে জ্বলে চিতে জ্বলুক।
ভাবুক বাউল উদাস সুরে গান ধরিল, শ্মশান ভালবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি।
গোষ্ঠ ধীরে প্রশান্ত কণ্ঠে কহে, শ্মশান তো বুকে বুকে, ঘরে ঘরে, কিন্তু মা আসে কই, নাচে কই মহান্ত? ফাঁকি, ওসব ফাঁকি, ওসব মানুষের মনগড়া কথা।
দুঃখের দিনে চরম নগ্ন বাস্তবতার মাঝে, মানুষের আশা-প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা, সর্বরিক্ত মন, পরম প্রত্যক্ষ সত্যের সন্ধান চায়।
যুগে যুগে পিষ্ট দারিদ্র্য দেবতার সন্ধান পায় না, সে কয়, সব ফাঁকি, মানুষের রচা কথা ওসব।
গোষ্ঠ আবার বলে, এইবার সবাই বুঝেছে, সবাই বলবে, দেখো।
ওই উপলব্ধি হয়ত সত্য, ওই বাণী বলিবার জন্যই যেন বিশ্বমানবের অন্তর প্রলুব্ধ হইয়া উঠিতেছে।