০৬. গাঁয়ের শেষ মাথার বড় শিমুল গাছ

গাঁয়ের শেষ মাথার বড় শিমুল গাছের নিচে গিয়ে বসে বুড়ি। ওখানে বসে স্কুলঘরের মাঠে ছেলেদের হৈচৈ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। ছেলেগুলোর মধ্যে সেই অকারণ ছেলেমানুষী দুষ্টুমির চপলতা নেই। ওরা যেন কেমন নতুন ঢঙে কথা বলে। ওরা কেবলই উত্তেজিত হতে থাকে। ওরা এ গাঁয়ের বেড়িটা ভেঙে দিতে চাইছে। ওদের গায়ে এখন অসুরের শক্তি। নেংটি পরা টিংটিং-এ ছেলেগুলো যে এমন দামাল হতে পারে তা বুড়ি ভাবতেই পারে না। পেট ভরে ভাত খেতে পায় না যারা ওরা আবার লড়বে কি? কিন্তু ওদের দিকে তাকিয়ে বুড়ির মন ভরে যায়। রইসের মুখটা মনে পড়ে। রইস যদি ওদের মত এমনি করে দামাল হতে পারত? এ চঞ্চল শক্তিমান ছেলেগুলোর পাশে নিজের পঙ্গু অসহায় ছেলেটার কথা মনে করে বুড়ির বুক ভার হয়ে গেল। না, ও কোন কাজেই লাগবে না। ওকে কোথাও লাগানো যায় না। হলদী গাঁয়ের নতুন। সম্ভাবনায় জেগে ওঠা প্রাণের জোয়ারে রইস অপ্রয়োজনীয়। একেবারেই তুচ্ছ। মাথার ওপর শিমুল গাছের ছায়া বড় হতে হতে অনেক বড় হয়ে যায়। তৃষ্ণার্ত মন নিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওরা যদি বলে দিত কেন হলদী গাঁ এমন করে বদলে যাচ্ছে? কেন ওরা ডাঙ্গুলি আর মার্বেল খেলা ছেড়ে দিয়ে বড়দের মত ভাবুক হয়ে গেছে? ওদের প্রাণে এখন কোন বাতাস বইছে? ওরা কেন বন্দুক ছোড়া শিখতে চাইছে? কোন বন্দি দেশের রাজপুত্র হয়ে গেল ওরা? কোন সাম্রাজ্য জয় করবে বলে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে? ওরা কি চায়? কি নেই ওদের? কোন প্রয়োজনে ওরা রক্তের হোলি খেলায় মাতবে? উঠতে গিয়েও বসে পড়ে আবার। উঠতে ভাল লাগছে না। এ জায়গাটা খুব প্রিয় বুড়ির। এখানে বসে হলদী গাকে বড় আপন করে দেখা যায়। যে দেখায় উপরের খোলস ঝরে গিয়ে ভেতরের প্রাণ ঝলমলিয়ে ওঠে। অভাব-অনটন, দুঃখ দারিদ্র্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা হলদী গাঁর সমৃদ্ধ প্রাণকে জীর্ণ মলিন করে রেখেছে। এ মলিনতা বুড়িকে স্পর্শ করে যায়। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে চারদিকে। ফাগুনের গুমোট গরম কখনো হঠাৎ করে উবে যায়। তখন বেশ লাগে। বুড়ির আশপাশে অনেক পাখি। ওড়ে। দূরের গাছে হলুদ বউ কথা কও এক মনে ডাকে। এক ঝাঁক পরাণচমকানি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। বুড়ি পা ছড়িয়ে বসে।

হঠাৎ মনে হয় শিমুলের গোটা আচমকা ফেটে গিয়ে যেমন তুলোগুলো দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে তেমনি হয়েছে হলদী গায়ের অবস্থা। গাঁয়ের মানুষগুলোর বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা শিমুল বীজ ফাগুনের গরম বাতাসে আচমকা ফেটে গেছে। মানুষগুলো ছুটছে। ছুটছে একটা লক্ষ্যের দিকে। সে লক্ষ্য ঐ শিমুল তুলোর মত সাদা ধবধবে। উজ্জ্বল। শিমুলের লাল ফুলের বীজ থেকে যেমন ঐ উজ্জ্বলতার জন্ম হয় এও তেমনি। রক্তলাল ফুলের মত মানুষগুলোর চেহারা এখন রক্তাভ। কেবল ফোটার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। বুড়ির বুক যেন কেমন করে। মানুষগুলোর মুখের আশনাই বুকের মধ্যে তুলোর। মত হালকা ধবধবে সাদা হয়ে যায়। বুড়ি ছটফট করে। ওরা কেন কেউ কিছু বলছে না ওকে? কি যে হচ্ছে সারা গা জুড়ে? বাইরের ডবকা ছেলেগুলো সামনে গেলে ভাগিয়ে দেয়। বলে, তোমাদের মতো বুড়োদের দিয়ে কোন কাজ হবে না। এ এক কঠিন সময়।

–আমি কোন কাজেই লাগব না?

–না, গো, না। কিছু পারবে না।

বড় বেশি সাহসের কথা বলে যুবকরা। বুড়োদের বাদ দিয়ে দিতে চায়। নেংটি পরা ছেলেদের কি এত কিছু মানায়? রমজান আলীকে ধরে বসে ও।

–কি হচ্ছে রমজান ভাই বলতো?

–সে তুমি বুঝবে না। যারা এতকাল আমাদেরটা খেয়েছে এবার আমরা তাদের দেখে নেব। আর চুপ করে থাকব না।

–পারবে? বুড়ি চোখ বড় করে তাকায়।

–কেন পারব না? দেখছ না আমাদের ছেলেরা তৈরি হচ্ছে?

–নেংটি পরা ছেলেদের কি এত কিছু মানায়?

বুড়ির কথায় হো-হো করে হেসে ফেলে রমজান আলী।

–ভালই বলেছ সলীমের মা। মানায় না মনে করেই তো আমরাও এতকাল চুপ ছিলাম। আর তো পারি না। ওরা উঠতে উঠতে আমাদের মাথা ছাড়িয়ে আকাশে উঠে

গেছে।

–কি যে বল বুঝি না?

–বুঝবে না। ঘরে যাও। মাথা ঠাণ্ডা কর। রমজান আলী সোজা রাস্তা ছেড়ে আলপথে নেমে যায়। বুড়ি ঘরে ফেরে।

ওদের কথা বিশ্বাস হয় না বুড়ির। সলীমের কাছে জিজ্ঞেস করে। সলীম গম্ভীর, ভাবনায় মগ্ন। বুড়িকে কিছু বলে না। বুড়ির যেন এ গাঁয়ের সারিতে অপাংক্তেয় হয়ে গেছে। অথচ বুড়ির সেই নিরেট মনটা অনবরত এক লক্ষ্য আবিষ্কারে তৎপর।

বুড়ি কাচারী ঘরের বাঁশের বেড়ার পাশে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের কথা শোনার চেষ্টা করে। সলীমের কণ্ঠ উত্তেজনায় থমথম করে। ওরা কি যেন বলাবলি করে। কিছু বুঝতে পারে না বুড়ি। তবুও মনে হয় ও নিজেও যেন নিজেকে প্রস্তুত। করছে। একটা কিছু ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি। যে ঘটনা বুড়ি কোনদিন দেখেনি এবং আর কোন দিন দেখবেও না। সেই যে বাইশে ফাগুন রেডিওতে একটা বক্তৃতা হয়েছিল সলীম ওকে ডেকে তা শুনিয়েছিল। বলেছিল, তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কি দরাজ গলা! সেই কণ্ঠস্বর এখনো গমগম করে হলদী গা জুড়ে। বুড়ি সকলের সঙ্গে অভিভূতের মত শুনেছিল। শুধু এটুকু বুঝেছিল যে একটি মানুষ ওদের সকলের হয়ে কথা বলছে। একদম ওদের হৃদয়ের কথা। হলদী গার মাঠ, ক্ষেত-ফসল, গাছগাছালি, গরু-ছাগল, পাখ-পাখালি এবং মানুষের কথা। সিরাজ মিয়া কথাগুলো ধরে রেখেছে একটা যন্ত্রে। তারপর থেকে সেই কথাগুলো ওরা প্রায়ই শোনে। শুনতে শুনতে ওদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। সলীম মুখস্থ করে ফেলেছে কথাগুলো। খুব বেশি কিছু না বুঝলেও দুটো লাইন বুড়ির মনে সারাক্ষণ মাতামাতি করে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম–এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বুড়ির এর বেশি কিছু মনে থাকে না। সলীমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে সলীম বলে দেয়। আবার ভুলে যায় ও। কিন্তু কানের পটে রেশ জেগে থাকে সব সময়। তাতে বুড়ি আচ্ছন্ন হয়ে থাকে এবং সে সূত্র ধরে বুড়ি আরো অনেক কিছু বুঝে উঠতে চেষ্টা করে। সেই বজ্রকণ্ঠের মানুষটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে বুড়ির।

একদিন সলীমকে ধরে বসে, বঙ্গবন্ধুকে আমাকে একদিন দেখাবি বাবা?

সলীম হেসে ফেলে।

–কেমন করে? ঢাকা অনেক দূরের পথ। তাছাড়া আমিও তো দেখিনি তাঁকে। কেবল মনে মনে একটা মুখ বানিয়ে নিই।

–আমিও বানাই সলীম।

বুড়ি উৎসাহ ভরে বলে।

–কিন্তু দেখিনি বলে এক একবার এক একরকম হয়ে যায় রে।

–ঠিকই বলেছ। যেবার গঞ্জে এলো বক্তৃতা করতে ওখানে যেতে পারলাম না অসুখ ছিল বলে। আর বুঝি দেখা হবে না?

–হবেরে হবে। বেঁচে থাকলে ঠিকই হবে।

বুড়ির উৎসাহে ভাটা পড়ে না। হলদী গার এখানে সেখানে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে সলীমের বৌ-র পাশে এসে বসে। আজকাল সলীম রমিজাকে আর মারে না। রমিজার বাচ্চা হবে। ও মা হবে। বুড়ি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বুড়ির মত সাধনা করতে হয়নি ওকে, অনায়াসে মা হয়ে যাচ্ছে। রমিজার মেজাজ আজকাল খুব ভাল অনায়াসে মা হয়ে যাচ্ছে। একটা কিছু পেতে যাচ্ছে এ বোধ ওকে সুখ দেয়। বুড়ি ওর পরিতৃপ্ত মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। ওকে এখন ভীষণ ভাল লাগে বুড়ির। রমিজার পাশে এসে বসলে ও সস্নেহে বুড়ির দিকে তাকায়।

–আম্মা আপনার কি হয়েছে? মুখ একদম শুকিয়ে গেছে?

–রোদে ঘুরেছি কিনা তাই অমন দেখায়। সত্যি সারা গায়ে যেন কি হয়েছে রমিজা?

–কি আবার হবে? আপনাকেও ওদের ভূতে পেয়েছে।

রমিজা খুকখুক করে হাসে। ওর হাসির একটা ঢঙ আছে।

হাসতেই থাকে রমিজা। ওর এই হাসি সলীম সহ্য করতে পারে না। রেগে যায়।

–হাসিস না রমিজা। হাসির কথা নয়।

–আমার অতশত ভাবনা নেই আম্মা তাই হাসি। এ বাড়ির সবাই যেমন গম্ভীর হয়ে গেছে তাই আমি একাই হাসি। রইস আমার হাতে দুধ খায়নি। সে কি রাগ কিছুতেই খাবে না। আপনার জন্য বসে রয়েছে।

রইস-রইস-রইস।

বুড়ির ছেলের কথা মনে হয়। এই ছেলের জন্যে বুড়ির কত আকাঙ্ক্ষা ছিল। এক সময় ছেলের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। আজ আর তড়িঘড়ি করে ছেলের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করল না। বেশ কিছু দিন ধরে রইসের দিকে তেমন খেয়াল দিচ্ছে না। ও একা একা ঘুরে বেড়ায়, নয় বারান্দায় বসে থাকে কিংবা উঠোনে বাঘার সঙ্গে খেলা করে। যেহেতু রইস কথা বলতে পারে না তাই ওর কোন অভিযোগ নেই। বুড়ির অবহেলা ও নীরবে মেনে নেয় কিংবা বুড়ির আদর সোহাগও নীরবে উপভোগ করে। রইস একদম একলা। কারো সঙ্গে ওর কোন যোগাযোগ নেই। বুড়ি হাঁটুতে থুতনি রেখে চুপচাপ রমিজার পাশে বসে রইল। বৃষ্টিবাদলা না থাকলে রমিজা উঠোনের চুলোয় রান্নাবাড়ি করে। রান্নাঘরের চাইতে বাইরে রাঁধতেই নাকি ওর ভাল লাগে। রমিজা গগনে আগুনে ভাত ফোটায়। শুকনো পাতা দাউদাউ জ্বলে, বাতাসে সেটা আরো দপদপিয়ে ওঠে। বুড়ি একদৃষ্টে আগুন দেখে। টগবগ করে ফুটে ওঠা ভাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবনা এসে জড়ো হয়। হলদী গাঁও তো এমন টগবগ করে ফুটছে। আগুন দিল কে? এ আগুনে কোন পাতিলের ভাত সেদ্ধ হবে?

ফাগুন শেষে চোত এল। চোত মানেই তো সূর্যের আগুনে খেলা। খা-খা করে গাঁয়ের বুক। মাটি বড় চড়া, রোদের তাপে ফেলা যায় না। বুড়ি এখন বেশি বেরুতে পারে না। বেরুলে গায়ে আগুনে-বাতাসের হলকা লাগে। পায়ের নিচে ঠোসকা পড়ে। কেমন হাঁফ ধরে যায়। খালের পানি চিকচিক করে। ও রমিজার সঙ্গে গল্প করে।

জানিস রমিজা আমার জীবনে হলদী গা-কে এমন গরম কোন দিন দেখিনি। রোদ তো নয় যেন গনগনে আগুনের হাঁপরের মুখটা কে খুলে দিয়ে রেখেছে। বাইরে বেরুনোর জো নেই।

–আপনি এত ঘোরাঘুরি করবেন না আম্মা। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে আপনার শরীর কেমন হয়ে গেছে। শেষে একটা অসুখ না বাধলে বাঁচি। কাল থেকে যেন আপনাকে বাইরে না দেখি।

–তা কি হয়? ঘুরতে আমার মন চায় রে। দেখিস না ওরা কেমন মেতে উঠেছে।

–থাক, ওরা মাতুক। আপনার দরকার নেই।

রমিজা বুড়িকে ছোট মেয়ের মতো শাসন করে।

–না রে রমিজা এমন কথা বলিস না। ওরা যখন জয় বাংলা বলে চেঁচিয়ে ওঠে মনে হয় আমার প্রাণটা ধরে কে যেন নাড়িয়ে দিয়ে গেল। এমন ডাক আর হয় না রমিজা। রমিজারে তুই অনেক কিছু বুঝিস না। আয় আমরা চিৎকার করে বলি, জয় বাংলা।

রমিজা হাঁ করে বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়ির মুখ যেন এক পবিত্র জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

–জানিস রমিজা সবকিছু ভুলে যাই কিন্তু এই ডাকটা আমি ভুলি না। কখনো ভুলি। ভুলতে আমি পারি না। কেন এমন হয় বল তো?

–আমি জানি না আম্মা।

–আমি দেখি রে এই ডাক হলদী গাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমার এত বছরের জীবনে আর কোন ডাকে হলদী গাঁয়ে এমন জোয়ার দেখিনি রমিজা। আহা কি যে ভাল লাগে। মনে হয় মরে যাই। এখন মরে গেলে আর কোন দুঃখ নাই।

–আম্মা আপনি এত ভাবেন কেন?

বুড়ি ওর সঙ্গে আর কোন কথা বলে না। নিজের মধ্যে ডুবে যায়। রমিজা শান্ত চুপচাপ মেয়ে। এতসব হট্টগোল পছন্দ করে না। তাছাড়া ওর শরীরও ভাল নেই। ভেতরের প্রাণের লক্ষণ ছটফটিয়ে বাড়ছে। ও রমিজাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। বুড়ি আকাশ দেখে। রমিজা বলে ভাবেন কেন? এতসব কর্মকাণ্ডের ভেতর থেকে কেউ কি না ভেবে পারে? চৈত্রের আকাশ উজ্জ্বল নীল। বাঁশবনে ছাতার পাখি ডাকে। সেটা থামলে কুটুম পাখি ডেকে ওঠে। বুড়ি কান পেতে শোনে।

–কুটুম পাখি ডাকে রমিজা?

–নির্ঘাৎ আমার বাপের বাড়ির লোক আসবে। উঃ কতদিন যে বাবাকে দেখিনি। ছোট বোন দুটো এলে আরো ভাল হয়। ওরা আমাকে যা ভালবাসতো। আমাকে ছাড়া ওদের এক মুহূর্ত চলতো না। সারাক্ষণ আমার পিছে পিছে ঘুরতো।

রমিজার খুশিভরা মুখ চেয়ে দেখে বুড়ি। বাবার বাড়ির কথা শুনলে রমিজার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ও তখন অন্য এক জগতে চলে যায়। বাবার বাড়ির স্বাদ বুড়ি পায়নি। ওর কাছে শ্বশুর বাড়িও যা বাবার বাড়িও তা ছিল। বুড়ির মনে হয় মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। গফুর কবে মরে গেছে সেই স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে এসেছে। সলীম কলীম কোনদিন ছোট ছিল কি না তাও আজ আর মনে নেই। ঝিমুনি আসে। ঝা-ঝ দুপুর ঘুমের আমেজ ঘনিয়ে আনে। দাওয়ার ওপর রমিজা ঘুমিয়ে গেছে। রইস ঘরে। সলীম কলীম এখনো ফেরেনি। বেলা গড়িয়ে যায়। ওরা ফেরেনি বলে কেউ দুপুরের ভাতও খায়নি। রমিজাকে খেতে বলেছিল বুড়ি। ও খায়নি। সলীমের আগে ও খায় না। ওদের অপেক্ষায় বসে থাকে বুড়ি। বাঁশের খুঁটিটার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে। শুলে ঘুম এসে যেতে পারে। বারেবারে তন্দ্রা ছুটে যায়। মনে হয় কলীম যেন উঠোনের মাথা থেকেই চিৎকার করছে। বলছে, মা ভাত দাও। ওর যেন তর সইছে না। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। কলীম ভীষণ ক্ষুধার্ত। বুড়ি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চোখ খুলে। দেখে কেউ কোথাও নেই।

বুড়ি বিহ্বল হয়ে যায়। কে ডাকে অমন মা মা করে? কার প্রাণ ফেটে যাচ্ছে মা ডাকের জন্যে? কে অমন চিৎকার করে ভাত চায়? বুড়ি কান খাড়া করে চেয়ে থাকে। পুরো হলদী গা যেন চিৎকার করছে ভাতের জন্যে। আকালে, বন্যায়, খরায় এমন চিৎকার ও অনেক শুনেছে। শুধু তাই নয় এমন চিৎকার ও অহরহ শোনে। এই চিৎকারই হলদী গাঁর নিয়তি। চিৎকার করতে করতে হলদী গার লোকগুলোর মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে। বুড়ির অস্থির লাগে। মনে হয় কতগুলো শব্দে ওর চারপাশটা গমগম করছে, মা ভাত দাও–মা ভাত দাও। ভাত দাও-ভাত দাও-ভাত দাও। অন্তর ছটফট করে।

বুড়ি উঠোনে নেমে আসে। কাচারীঘর ফাঁকা। সামনে এসে দাঁড়ায়। রাস্তা বরাবর যতদূর চোখ যায় চেয়ে থাকে। কেউ কোথায়ও নেই। মাঠের ধারে গরু বাঁধা। দুএকটা ছাগল চরে বেড়ায়। বুড়ি আরো একটু এগিয়ে বড় জলপাই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। অনেক দিনের পুরোনো প্রকাণ্ড গাছটা ডালপালা ছড়িয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বিরাট একটা সরাইখানা। যে কেউ এসে দুদও জিরিয়ে নিতে পারে। সেখানে দাঁড়িয়েও বুড়ি আপ্রাণ চেষ্টা করে লোক দেখার। না কেউ কোথাও নেই। হঠাৎ করে হলদী গাঁ যেন জনমানব শূন্য নিঝুমপুরী হয়ে গেছে। সব লোকগুলো কোথায় গেল? বুড়ি বাঁশবাগান থেকে গরুটা খুলে বাড়ির আঙ্গিনায় নিয়ে আসে। কিছুদিনের মধ্যেই গরুটা বিয়োবে। রমিজা ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ বসে থাকে। রইসও বারান্দায় এসে বসেছে।

–কেউ ফিরেনি আম্মা?

–নারে। তোর আর না খেয়ে থাকা ঠিক না। চল আমরা খেয়ে নিই।

রান্নাঘরে বসে তিনজনে ভাত খায়। সাদা ফকফকে ভাতের দলা হঠাৎ করে বুড়ির কাছে কেমন শক্ত মনে হয়। বারবার পানি খায়।

–কি হলো আম্মা?

–খেতে মন লাগে না রে।

বুড়ি ভাত নাড়াচাড়া করে। রইস গপগপিয়ে খায়। ওর পেটে ভীষণ ক্ষিদে। বুড়ি ওর দিকে চেয়ে থাকে।

সন্ধ্যায় সলীম কলীম ফিরে আসে। দুজনের মুখ শুকনো। সারাদিন কিছু খায়নি।

–কোথায় ছিলি তোরা?

–মিটিং শুনতে গিয়েছিলাম।

সলীমের সংক্ষিপ্ত উত্তর। বুড়ি দুজনকে ভাত বেড়ে দেয়। খেয়েদেয়ে বারান্দায় বসে ওরা। সারাদিনের ক্লান্তিতে হঠাৎ করে ঘুম আসে না। রমিজা রান্নাঘরে থালাবাসন গোছগাছ করে। বাঁশবাগানের মাথার ওপরের গোল চাঁদ থেকে আলো চুইয়ে পড়ছে। বুড়ির মনে হয় কি সুন্দর রাত। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। বহুদিন হলদী গাকে এমন মোহনীয় মনে হয়নি ওর। ওর ইচ্ছে করছে এমন চাঁদের আলোয় মাঠঘাট প্রান্তর একবার ঘুরে আসতে। আহা কি সুন্দর এই হলদী গাঁ।

–ইচ্ছে করে ডাক ছেড়ে বুক ফাটিয়ে গান গাই?

গা না কলীম?

বুড়ি উৎসাহ দেখায়।

কিন্তু তেমন করে আসছে না মা?

কলীম উঠোনে পায়চারি করে। বিড়ি ধরায়। বাঘার পিঠ চাপড়ে দেয়। রমিজা এসে ওদের কাছে বসে। সারা দুপুর ঘুমিয়েছে বলে রইসেরও ঘুম নাই। ও বুড়ির পিঠের সঙ্গে মিশে বসে আছে।

–আজকের রাতটা কি যে সুন্দর!

চুপচাপ থাকা সলীমও ওইটুকু না বলে পারে না। নারকেল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কলীম গুনগুনিয়ে গান গায়। কখনো কিছু শব্দ জোরে উঠে আসে। আবার নেমে যায়। কণ্ঠ। সলীম বসেই থাকে। আজ ওর ঘুম পায় না। রমিজা হাই তোলে না। ওরও ঘুম পায়নি। আর বুড়ির চোখ থেকে তো ঘুম পালিয়েছে। এক সময় রইসও উঠোনে নেমে যায়। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে। বাড়ির সামনের জমরুল গাছ পর্যন্ত হেঁটে আসে। বাঘা ওর পিছু পিছু ঘোরে। বুড়ির পরিবারের সবাই। আজ ভরা পূর্ণিমা সাক্ষী করে কিছুটা এলোমেলো, কিছুটা উদভ্রান্ত সময় কাটায়।

চোত মাসের দশ তারিখে ওদের কমদামী ট্রানজিস্টারে করে ঢাকার খবর এলো। মিলিটারি নেমেছে ঢাকার রাজপথে। তখন চৈত্রের আকাশ মুঠো মুঠো রোদ ছড়িয়ে। যাচ্ছে মাঠেঘাটে। রমিজা গরম ভাত নামিয়েছে চুলো থেকে। আর সলীম চেঁচাচ্ছে। একটি অখ্যাত, অবজ্ঞাত ছোট্ট গ্রাম হলদী গাঁয়ের সলীম চিৎকার করছে ক্ষোভে, আক্রোশে। বুড়িকে ধরে ঝাঁকুনি দেয় কয়েকটা। শপথ নেয় অদ্ভুত বলিষ্ঠ কণ্ঠে। বুড়ি কেবল অবাক হয়ে তাকায়। কোন কিছু বোঝার ক্ষমতা ওর নেইও। যে ছেলে মাকে কোনদিন পাত্তা দেয়নি সে ছেলে আজ মা-কে ধরে চেঁচাচ্ছে। বৌ-কে, এমনকি ওর পেটের সন্তানকে সাক্ষী করে কেমন শক্ত শক্ত কথা বলছে এক প্রত্যয়নিষ্ঠ আবেগে। বুড়ির মুখ থেকে কোরানের আয়াতগুলো যেন ভক্তি সহকারে নিঃসৃত হয় সলীমের কণ্ঠ তেমনি ভক্তিতে, আবেগে, শপথে গমগম করছে। সলীমের এ চেহারা বুড়ি কোনদিন দেখেনি। সলীমকে অনেকদিন রাগতে দেখেছে কিন্তু সে রাগের সঙ্গে এ রাগের অনেক তফাৎ। এ বিক্ষোভ যেন অন্য কিছু। অন্যরকম। সলীম যেন সামনে শত্রু রেখে রুদ্র আক্রোশে বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে। একসময় ট্রানজিস্টার বন্ধ করে কোথায় যেন ছুটে বেরিয়ে যায়। কলীমকেও সঙ্গে নেয়। ওদের কাণ্ড দেখে বিরক্ত হয় রমিজা। পেটের। ভেতর শত্রুটা নড়াচড়া করে। বেচারীর ভরা মাস। শরীর ভাল নেই। মেজাজ খিচড়ে থাকে।

যতসব আজগুবী কাজবাজ। কোথায় ঢাকায় কি হলো তার দেখা নেই। ওনারা এখানে চিৎকার শুরু করলেন।

রমিজা গজগজ করে ভাতের হাঁড়ি শিকার ওপর উঠিয়ে রাখে। আড়চোখে বুড়ির দিকে তাকায়।

–ও আম্মা আপনার কি হলো?

বুড়ি উত্তর দেয় না। চুপচাপ বসে থাকে। জয় বাংলা শব্দটা উথাল পাতাল করে। বুড়ির শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সলীম কলীম ঐ ডাক ডাকতে ডাকতেই বেরিয়ে গেছে। এখন সেই শব্দ দুটো বুড়িকে জাপটে ধরে রেখেছে। হাত পা কেমন অবশ লাগে। হাঁ করে রমিজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

–দেখছেন কি আম্মা? ও আম্মা?

–রমিজা আয় আমরা ওদের মত জয় বাংলা বলে হাঁক দিয়ে উঠি।

–তাতে কি হবে?

–আহ্ রমিজা তুই কিছু বুঝিস না। বুঝতেও চাস না।

–সেই ভাল বাপু, অতশত আমার সয় না।

বুড়ি দাওয়া থেকে নেমে আসে। ইচ্ছে করে সবার মত সারা গা মাতিয়ে তুলতে। জলপাই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। গাছের সঙ্গে কথা বলে–জলপাই গাছ সবাই বলে আমি কোন কাজে লাগব না। কেন লাগব না? লাগালেই লাগতে পারি। আমার ইচ্ছে করে কিছু করতে। হলদী গাঁ আমার বড় প্রিয়। ছেলেবেলা থেকেই তো এর ঘাস লতাপাতা, ধুলোমাটি, জলকাদা আর লেংটিপরা মানুষগুলো আমার আপন হয়ে আছে। জলপাই গাছ–আমার বড় সাধ হলদী গার জন্যে আমি মরে যাই। মরে গিয়ে হলদী গাকে বলি, হলদী গাঁ তোর জন্যে, শুধু তোর জন্যে আমার পরাণটুকু দিলাম। এ পরাণ আমি আর কারো জন্যে রাখিনিরে। এটা তোরই।

বুড়ির বিড়বিড়ানি থেমে যায়। দূরের মাঠে ছেলেরা জটলা করছে। এতদূর থেকে কথা শোনা যায় না। বাতাসে কান পেতে রাখে। যদি কিছু ভেসে আসে। বুড়ির গলার কাছটা শুকিয়ে এসেছে। শুকনো বুকের আবেগ নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। মাথার উপর কুটুম পাখি ডাকে। ঝরা পাতা মচমচিয়ে বেজি ছুটে পালায়। কোন কিছুতেই বুড়ির খেয়াল নেই।

দিন সাতেকের মধ্যে পোড় খাওয়া মানুষ হয়ে ফিরে আসে জলিল। সবাই গোল হয়ে ওর কাছ থেকে ঢাকার খবর শোনে। ওর বৌ আর মেয়ে দুটো মারা গেছে। সেই শোকে দিশেহারা। তবু জলিলের পেশিবহুল পেটানো শরীরটা শক্ত হয়ে ওঠে।

–আমাদের এর প্রতিশোধ নিতে হবে সলীম। আমরাও ছেড়ে দেব না।

–হ্যাঁ ঠিকই। প্রতিশোধ চাই। রক্তের বদলে রক্ত।

বুড়ি বেড়ার পাশেদাঁড়িয়ে শশানে। সবাই চলে গেলে জলিল এসে বসে বুড়ির দাওয়ায়। ওকে এখন চেনা যায় না। অনেক বদলে গেছে। মাথার চুল অর্ধেকের বেশি সাদা হয়েছে। বুড়িকে দেখেই জলিলের আবেগ কেঁপে ওঠে। স্খলিত কণ্ঠে এলোমেলো কথা বলে।

সব মানুষ যখন ঘুমিয়ে রাতের আঁধারে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লো। আগুন। গুল। দাউদাউ করে জ্বলে চারদিকে। মানুষ চিল্লায়। আমি বাড়ি ছিলাম না। গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জ। বাবুবাজার বস্তি পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও পুড়ে মরলো। সব আমারে বললো পাশের ঘরের তাহের। ওরও কেউ বাঁচেনি। ও একলা পালিয়েছে।

জলিলের চোখ দিয়ে দরদরিয়ে জল গড়ায়। বুড়িও কাঁদে।

–আমি এমনটা দেখি নি বুড়ি। মানুষ মানুষকে এমন করে মারে কি করে? উঃ আল্লা ওদের প্রাণে কি মায়াদয়া নাই? চোখ বন্ধ করলে আমি আগুন দেখি। গুলির শব্দ শুনি। মানুষের চিল্লানিতে কান ফেটে যেতে চায়। বুড়ি আমার ঘুম আসে না।

জলিলের মুখের শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বুড়ি নিৰ্ণিমেষ তাকিয়ে থাকে। এক সময় থেমে থেমে বলে, যারা আমাদের ওপর গুলি চালালো তারাতো আমাদের দেশেরই মানুষ জলিল ভাই?

–হ্যাঁ আমরা তো একদেশেরই মানুষ। দেশটাতো পাকিস্তান। অন্য নাম তো শুনিনি।

–তাহলে ওরা আমাদের মারে কেন? ওরা কি আমাদের ভালবাসে না?

বুড়ির কণ্ঠ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জলিল চুপ করে থাকে। এর উত্তর ও জানে না। বুড়ির কথা নিজেও ভেবে দেখে।

বুড়ি আবার বলে, আমাদের জন্যে যাদের মায়া নেই তাদের জন্যে আমাদের মায়া কি জলিল ভাই?

–ঠিক বলেছো। এ জন্যেই তো আমরা আলাদা হব। একথাই তো সবাই বলে, আমি কেবল বুঝতে পারি না।

জলিল উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

–ভেবেছিলাম শোধ নেব। দেশের জন্য লড়ব। আমি যাই বুড়ি।

জলিল দ্রুত পায়ে নেমে যায়। সলীমকে খোঁজে। বুড়ি বসেই থাকে। ওর কাছে এখন সব কিছু পরিষ্কার হয়ে আসছে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে সব বুঝে ফেলে। আগুন মানেই কেবল রমিজার ভাত রাধা নয়। আগুণ আরো অন্য কিছু। গুলি শব্দটাও বুড়ির অভিজ্ঞতায় নতুন করে সংযোজিত হয়। গুলি দিয়ে পাখি শিকার করতে দেখেছে বুড়ি। কিন্তু মানুষ মারতে দেখেনি। বুড়ি বিড়বিড় করে, ঐ গুলিটা যখন আমাদের শরীরে ঢুকতে পারে তখন ওদের শরীরে ঢুকবে না কেন? বুড়ি সাহসী হয়ে ওঠে। আমাদের ছেলেরাও তো ওটা পাল্টা ছোড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে। বুড়ি উঠে প্রিয় জলপাই গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে গায়ের অনেক কিছু দেখা যায়। দেখতে পায় মাঠের মধ্য দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে জলিল।

চৈত্রের শেষ রমিজার ছেলে। হয়। ফুটফুটে ছেলে। বেশ বড়সড়। অবিকল গফুরের মত। বুড়ির কাজ বাড়ে। সারাক্ষণ নাতি নিয়ে মেতে থাকে। কাজল পরায়, তেল মাখায়। গা চর্চ করে। ওকে নিয়ে গান গায়। বুড়ির প্রাণের বন্ধ দুয়ার যেন খুলে গেছে। এ ছেলে কি করবে, কোথায় রাখবে বুঝতে পারে না? রমিজা বুড়ির কাণ্ড দেখে হাসে।

–আম্মার খুশি যেন আর ধরে না।

গর্বিত মায়ের স্বর রমিজার কণ্ঠে। বুড়ি রমিজাকে দেখে। খুশিতে ওর মুখটা চচ করে।

–কি দেখেন আম্মা?

–দেখি তোকে। রইস হওয়ার পর আমি তোর মত সুখ পাইনি রমিজা।

–ঐ দেখ কোথা থেকে কি কথা।

রমিজা তাড়াতাড়ি পুকুর ঘাটে চলে যায়। বুড়ি বাঘার গায়ে থাপ্পড় দেয়, ঐ বাঘা তোর খুশি লাগছে না? আমাদের ঘরে একজন নতুন মানুষ এসেছে।

যত দিন যায় নাতিকে কেন্দ্র করে বুড়ির আবেগ তরতরিয়ে বাড়ে। ছেলেকে দোলাতে দোলাতে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। ও রইসের মত নয়। ও হাসে, তাকায়, মুখ। দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে। যখন বুড়ির দিকে তাকিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খেলে তখন বুড়ি বুকের ভেতর জমানো সব দুঃখের কথা ভুলে যায়। ওর সঙ্গে কথা বলে, ও দাদু, দাদুরে তুই আমার সাত রাজার ধন। বুকের মানিক। তুই এমন একটা সময়ে এলি! এটা এখন জয় বাংলার সময়রে। দেখছিস না চারদিকের বাতাসে উথাল-পাথাল ঢেউ। দাদুরে তুই জানতেও পারিস না যে তোর বাপের বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন। হলদী গাঁ এখন গায়ের চামড়ার বদল ঘটাবে বলে তৈরি হয়ে উঠেছে। ও দাদু, দাদুরে তুই যখন বড় হবি দেখবি হলদী গাঁ আর হলদী গাঁ নেই। হলদী গাঁ বদলে গেছে। যারা ভায়ের বুকে গুলি চালায় আমরা তাদের সঙ্গে থাকি না রে।

বুড়ি নাতিকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয়। পরক্ষণে সলীমের ওপর রেগে ওঠে। সারাদিন ওর কাজ আর কাজ। কি যে এত কাজ?

বুড়ি একদিন বলেছিল, হ্যাঁ রে বাপ হয়ে ছেলেটাকে তো একদিন ভাল করে দেখলিও না? এ কেমন কথা?

ধুত ঐ মুরগির বাচ্চা আমি দেখব কি? তুমি দেখ। বড় হোক তখন ও আমার। বুড়ির আবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।

–কি দেখছ কি? আচ্ছা মা তুমি যে ওকে কোলে নিতে বল তা কি আমি পারি? হাতের ফাঁক দিয়ে তো পড়ে যাবে। তাছাড়া আমার সময় কৈ ছেলে সোহাগ করার? আমার কত কাজ।

–ঐ কাজ নিয়েই তুই থাক। বড় হলেও ছেলে তুই পাবি না।

–আচ্ছা দিও না। শোন মা, ও যাতে একটা স্বাধীন দেশের মাটিতে বড় হতে পারে সেই প্রতিজ্ঞাই তো আমি নিয়েছি। বড় হয়ে ও গর্ব করতে পারবে যে ওর বাপ একটা নতুন দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছিল। আমার ছেলের বুকের মধ্যে এই অহংকারের বীজ আমি পুঁতে দিতে চাই মা। এটাই আমার সোহাগ। তুমি ওকে এখন সোহাগ কর ও যাতে বড় হয়। মানুষ হয়।

সলীম হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। কথাগুলো বুড়ির বড় ভাল লাগে। কথাগুলো বুকের কৌটো খুলে তার মধ্যে জমিয়ে রাখে। দুঃসময়ে এসব কথা ভীষণ কাজ দেয়। বুড়ির দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

রইস মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বাচ্চাকে দেখে। কি যেন এক বিস্ময় ওর চোখের সামনে। এত ছোট বাচ্চা এত কাছ থেকে ও আর কখনো দেখেনি। হাত পা নেড়েচেড়ে মাঝে মাঝে বিরূপ হয়ে যায়। মারতে ওঠে। রইসের ভয়ে নাতিকে সারাক্ষণ আগলে রাখে বুড়ি। ও কখন কি অঘটন করে ফেলে বলা যায় না। নাতিকে নিয়ে বুড়ির সময় চমৎকার কাটে। সলীম কলীম বেশির ভাগ সময় বাড়ি থাকে না। কখনো বা রাতেও ফেরে না। রমিজা সাংসারিক ঝামেলায় ছেলের দিকে নজর দিতে পারে না। ফলে নাতির সব দায় দায়িত্ব বুড়ির একলার। ও একটা ছোট্ট দেশ। বুড়ি ঐ দেশের মালিক। ঐ দেশে আর কারো প্রবেশের অধিকার নেই। দুপুরের কড়া রোদে বাইরে যখন ঘুঘু ডাকে তখন বুড়ির অন্তর আর শূন্য হয়ে যায় না। রমিজার ছেলে সরোবরে নীল পদ্ম হয়ে অনবরত গন্ধ ছড়ায়। প্রশান্তির আলো হয়ে জ্বলে বুড়ির মন নামক সমুদ্রের বাতিঘরে। ভাবনার পাখিগুলো সে বাতিঘরের চারপাশে বারবার ভিড় জমায় আশ্রয়ের আশায়। নাতির চিন্তায় ভাল করে ঘুমুতেও পারে না বুড়ি। যন্ত্রণা কখনো মধুর হয়ে ওঠে। বুড়ির এখন সে অবস্থা, দিনগুলো পালে বাতাস লাগা নৌকোর মত।

বৈশাখের শেষ দিকে গান গাইতে গাইতে নীতা বৈরাগিণী আসে। একলা, চরণদাস নেই। হাঁটুর কাছাকাছি শাড়ি ওঠানো। ধুলোয় ধূসরিত পা। ক্লান্ত চেহারা, শুকনো ঘাসের মত রুক্ষ চুল বাতাসে ওড়ে। নীতাকে যেন বয়সে পেয়ে বসেছে। ওকে দেখে ঝকমকিয়ে ওঠে বুড়ির চোখ।

–সই কতদিন আসিসনি। আয় বস।

হাত ধরে নীতাকে বারান্দার ওপর এনে বসায়। ও দোতারাটা নামিয়ে রাখে একপাশে। পিঠের ওপর থেকে কাপড়ের পুটলীটাও নামায়। পা দুখানা জড়ো করে বসে।

–নাতি বুঝি?

–হ্যাঁ।

–চাঁদের মত ছেলে।

নীতা সরল হাসি হাসে। বুকের নিচে দুম করে কিসের যেন একটা শব্দ হয়। ছেলে, স্বামী এসবের কোন বালাই নেই ওর জীবনে। বুড়ির এখানে এলে বুকটা কেন মুচড়ে ওঠে। যত বয়স বাড়ছে ততই এসব বোধ প্রবল হচ্ছে। এখন আর ওর যৌবন নেই। যৌবনের মাদকতা নেই। পথে পথে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে যায় নীতা। বিশ্রাম চায়, আশ্রয় চায়। দুমুঠি ভাত চায়। নীতা হঠাৎ করে সব দুঃখবোধ একপাশে ঠেলে রেখে কোমরে গোঁজা কৌটো থেকে তামাক বের করে।

–কিরে কি ভাবছিস?

–ভাবছি তোর মত একটা সংসার পেলে ঠেলেঠুলে ঢুকে যাই।

–কি যে বলিস সংসার কি তোর ভাল লাগবে? তোর মুখে তো আগে কখনো এমন কথা শুনিনি?

–যত বয়স বাড়ছে ততই তোকে আমার হিংসে হয়।

–সব তোর বাজে কথা।

বুড়ি হেসে গড়িয়ে পড়ে। নাতিকে আদর করে। নীতার বৈরাগী মন ধূ-ধূ করে। ধূসর হয়ে যায় সামনের দিনগুলো। পেছনের দিনগুলো কত মধুময় ছিল। ঘরের চার দেয়াল কল্পনাই করতে পারত না। এখন আখড়ায় বসেও সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।

–তোর মনের মানুষ কই সই।

–মনের মানুষ? মনের মানুষ ছেড়ে এসেছি। এখন এই দেশটাই মনের মানুষ। নীতা দোতরা তুলে নেয়। টুংটাং ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে ও আবার নিজের ভুবনে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা অকারণ যন্ত্রণা পায়।

ও গান ধরে :

সোনার গাঁয়ে বসত করি
সোনা মারেই জানি
বাংলা মায়ের কথা কইয়া
জুড়াইতো পরাণী
মায়ের কোলে দুধের শিশু
আদরের নাই শেষ
আমার সোনার বাংলাদেশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *