৬
রাত ন’টা।
মিসির আলি গরম চাদর গায়ে দিয়ে বারান্দায় বসেছেন। মাটির হাঁড়িতে তুষের আগুন করে তাঁর পায়ের কাছে রাখা হয়েছে যাতে তিনি পা গরম করতে পারেন। ফ্লাস্কে চা দেয়া হয়েছে। মিসির আলি পান খান না। তারপরেও পানের বাটায় পান দেয়া হয়েছে।
আয়না বসেছে তাঁর সামনে। সে গায়ে চাদর দেয় নি। সম্ভবত তার তেমন শীত লাগে না। আয়না বলল, স্যার, একটা পান বানিয়ে দেই পান খান।
মিসির আলি বললেন, দাও।
আয়না পান বানাতে বানাতে বলল, আমাকে প্রশ্ন করলেই আমি উত্তর দেব। এইটুকু সাহায্য আপনাকে করব। কিন্তু নিজ থেকে কিছু বলব না।
মিসির আলি বললেন, তোমার স্বামী লিখেছে তুমি আয়নার ভেতর ঢুকে যাও এটা কি সত্যি?
জি।
মিসির আলি বললেন, এটা সত্যি হবার কোনো কারণ নেই। আয়না জিনিসটা কী? এক খণ্ড গ্লাস যেখানে পারা লাগানো হয়েছে। যাতে আলো প্রতিফলিত হয়। তুমি সেখানে ঢুকতে পার না।
আয়না বলল, মার্থা মেয়েটা কীভাবে ঢুকত?
মিসির আলি বললেন, মার্থার ব্যাপারটা আমার ছাত্র পুরোপুরি জানে না। কাজেই তুমিও জান না। এর মধ্যে অনেক মিথ্যা আছে। আমেরিকা ডিউক ইউনিভার্সিটির প্যারাসাইকোলজির প্রফেসর এরান সিমসন তাঁকে নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। বইটার নাম Martha deceit. এই নামের সহজ বাংলা হচ্ছে মার্থা বিষয়ক ধাপ্পাবাজি। বইটা আমার কাছে আছে। তুমি পড়ে দেখতে পার।
আয়না বলল, মার্থা মিথ্যা করে বলেছে সে আয়নার ভেতর থাকে?
মিসির আলি বললেন, সে নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। বাচ্চারা কল্পনার জগতে বাস করে। সে কল্পনা করেছে।
স্যার, আমি তো বাচ্চা মেয়ে না।
মিসির আলি বললেন, বড়রাও কল্পনা করে। সিজিওফ্রেনিক রোগীরা শুধু যে কল্পনা করে তা-না। তারা সেই জগতে বাসও করে। এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, মাঝে মাঝেই তুমি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দুই তিন দিন কাটিয়ে দাও। তখন কী কর?
আয়না বলল, আমি কিছু করি না। আয়নার ভেতর ঢুকে পড়ি। ঐ জগতে থাকি।
ধরে নিলাম তুমি আয়নার জগতে থাক। বের হয়ে আস কেন?
স্যার আমি নিজের ইচ্ছায় আয়নায় ঢুকতেও পারি না। বের হতেও পারি না। ঘটনাটা আপনাআপনি ঘটে। আমি যদি নিজের ইচ্ছায় ঢুকতে পারতাম তা হলে কারো সামনে ঢুকতাম না। কাউকে ভয় দেখাতাম না।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। আয়না বলল, স্যার প্রশ্ন করুন।
তুমি যে তরিকুল ইসলাম সাহেবের পালক মেয়ে এটা নিশ্চয় তুমি জান?
জি জানি।
তোমার আসল বাবা-মা’দের বিষয়ে জান না?
জানি না।
তারা এই পৃথিবীর মানুষ নাকি আয়না জগতের মানুষ?
আয়না জগতের মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
মিসির আলি বললেন, আয়না জগৎটা কেমন?
আয়না বলল, কেমন বলতে পারব না, যখন আপনাদের সঙ্গে থাকি তখন আয়না জগতের কথা তেমন মনে থাকে না। সেই জগৎটা ছায়া ছায়া, শান্তির জগৎ। মনে হয় সেখানে ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই। সেখানে সবাই একা থাকে।
একা থাকে?
জি একা থাকে। এটা মনে আছে। স্যার একটা কাজ করুন না। আপনি আমাকে হিপনোটিক সাজেশান দিয়ে আয়না জগতে নিয়ে যেতে পারেন কি না দেখুন। আপনি মনে মনে এই কথা ভাবছেন বলেই বললাম।
মানুষের মনের কথা কখন থেকে তুমি ধরতে পারতে?
প্রথম যখন আয়না জগতে যাই এবং সেখান থেকে বের হয়ে আসি তখন থেকে পারি। আয়না জগতের সবাই তো একা একা থাকে। এইভাবেই একজনের সঙ্গে অন্যজন যোগাযোগ করে। মানুষ একসঙ্গে থাকে বলেই এমন ক্ষমতার তাদের প্রয়োজন হয় নি। তা ছাড়া এই জগতে মোবাইল ফোনও আছে।
মিসির আলি মাটির হাঁড়ির উপর পা রাখলেন। রাত বাড়ার সঙ্গে শীত বাড়ছে। পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আয়না বলল, বোতলে গরম পানি ভরা আছে। একটা বোতল এনে দেব কোলে রাখবেন?
দরকার নাই।
স্যার, আর কোনো প্রশ্ন করবেন?
মিসির আলি বললেন, কোন লাইনে প্রশ্ন করব ধরতে পারছি না। তোমাকে প্ৰশ্ন করার দু’টা লাইন আছে। প্রথম লাইনে তুমি -Delusion-এর শিকার। অসুস্থ একটা মেয়ে। যে নিজের জন্য ভ্রান্তির এক জগৎ তৈরি করেছে। সে তার ভ্রান্তির জগতে বাস করে। পৃথিবীর Realityর সঙ্গে যে যুক্ত না। কিছু ড্রাগস আছে এ ধরনের জগৎ তৈরি করে। যেমন- L S D.
আর দ্বিতীয় লাইন হচ্ছে স্বীকার করে নেয়া তুমি সত্যি সত্যি আয়না জগতের বাসিন্দা। সেখানেই থাক। মাঝে মাঝে সেখান থেকে বের হয়ে আস। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি কোনোটাই গ্রহণ করতে পারছি না। অন্ধকারে ঢিল ছোড়া আমার স্টাইল না। আমি লজিক ব্যবহার করি। লজিক পাশা খেলা না। লজিক অন্ধকারে ঢিল ছোড়ে না। আমি আজ রাতটা চিন্তা করব। কাল আরো কিছু প্রশ্ন করব। আমার ছাত্রও তখন সঙ্গে থাকবে।
হিপনোটাইজ করবেন না?
করব। তোমাকে এবং আমার ছাত্রকে একসঙ্গে করার চেষ্টা করব।
স্যার, আজকের অধিবেশনের কি এখানেই সমাপ্তি?
হুঁ।
আমি কি চলে যাব?
চলে যাও।
আপনি এখানেই থাকবেন?
হ্যাঁ। শীতের মধ্যে বসে থাকতে ভালো লাগছে। তোমাদের বারান্দাটা সুন্দর। ঢাকায় যখন চলে যাব তখন বারান্দাটা মিস করব।
আয়না বলল, স্যার, আরেকটা সিগারেট ধরান। সিগারেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকি। আপনার গল্প শুনি।
কী গল্প শুনবে?
যে কোনো গল্প।
রূপকথা?
বলুন। আপনার রূপকথা সাধারণ রূপকথা হবে না। এর মধ্যেও অন্য কিছু থাকবে।
মিসির আলি বললেন, Delusion-এর জগৎ নিয়ে কথা বলি। মানবজাতির একটা অংশ সব সময়ই ডিলিউসনের জগতে বাস করে। এদের মধ্যে বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট আছেন, সংগীতজ্ঞ আছেন। লেখক, চিত্রকর আছেন। কাজেই তুমি ভেব না যে তুমি একা এবং অদ্বিতীয়।
স্যার, আমি ভাবছি না।
আবার একদল আছে যারা অন্যের ভেতর কঠিনভাবে ভ্রান্তি ঢুকিয়ে দেয়। এর সবচে বড় উদাহরণ হল পারস্যের হাসান সাব্বা। এই হাসান সাব্বা পাহাড়ঘেরা এক সমতল ভূমিতে গোপন বেহেশত তৈরি করেছিল। সেই বেহেশতে অপূর্ব বাগান ছিল। দুধ, মধু এবং শরাবের নহর ছিল। ষোল সতের বছরের অতি রূপবতী নগ্ন যুবতীরা ছিল। হাসান সাব্বা তার কিছু নির্বাচিত শিষ্যদের এই বেহেশতে প্রবেশের অনুমতি দিতেন। তবে বেহেশতে ঢোকার আগে তাদের হেলুসিনেজেটিং ড্রাগ হাশিশ অর্থাৎ ভাংয়ের শরবত খাওয়ানো হতো। শিষ্যরা পুরোপুরি এক ভ্রান্তির জগতে চলে যেত। হাসান সাব্বা পরে এদের দিয়েই গোপন হত্যাকাণ্ড ঘটাতেন। হাশিশ থেকে আরবি হালাশিন। সেখান থেকে ইংরেজি শব্দ এসেছে Assassin. অর্থাৎ গুপ্ত ঘাতক।
এই দলটাকে ধ্বংস করার অনেক চেষ্টা করা হয়। কেউ পারে নি। অনেক পরে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান তাদেরকে পুরোপরি ধ্বংস করেছিলেন।
গল্প শেষ করে মিসির আলি হাসলেন। আয়না বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার, হাসছেন কেন?
মিসির আলি বললেন, তোমাকে ভ্রান্তির জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য একজন হালাকু খাঁ দরকার। আমি হালাকু খাঁ না। আমি বৃদ্ধ মিসির আলি।