৬
বাড়ি ফিরে মিসির আলি দেখলেন খাঁচায় দুটি চড়ুই পাখি। বদু পাখির খাঁচার সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে পাখি দেখছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এর আগে সে চড়ুই পাখি দেখে নি। এই প্রথম দেখছে। এবং পাখির সৌন্দর্যে সে অভিভূত। মিসির আলি গায়ের কোট খুলতে খুলতে বললেন, কেউ এসেছিল?
‘জে না।’
মিসির আলি আশাহত হলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মুশফেকুর রহমান হয়তো এসেছিল। চড়ুই পাখি দুটিকে সে-ই খাঁচায় ঢোকার ব্যবস্থা করেছে। এখন বুঝা যাচ্ছে এই জটিল কাণ্ডটি করেছে বদু। খাঁচা এবং চড়ুই পাখির প্রতি বদুর এই অতি আগ্রহের কারণ এখন পরিষ্কার হল।
‘পাখি দুইটা আপনে আপনে হান্দাইছে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ। আমি ঘর ঝাঁট দিতেছিলাম দেখি ভিতরে বইয়া কুটুর কুটুর চায়। আমি দৌড় দিয়া ঝপাং কইরা খাঁচার দরজা বন্ধ করলাম।’
‘গুড।’
‘বাটিত কইরা পানি দিলাম। পানি খাইছে। চুমুক দিয়া খাইছে।’
‘আচ্ছা।’
মিসির আলি পাখি দুটির প্রতি তেমন আগ্রহ বোধ করছেন না। তিনি হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় গেলেন। কয়েকটা জরুরি বিষয় লিখে ফেলা দরকার। বদু বলল, ভাত দিমু স্যার?
‘দাও।’
বদু ভাত বাড়তে গেল না। উবু হয়ে খাঁচার সামনে বসে রইল। মিসির আলি নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, পাখি দুটি যদি বদু নিজে খাঁচায় না ঢোকাত তা হলে কি সে এতটা আগ্রহ বোধ করত? মুরগি ডিম পেড়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। যেসব মুরগি ডিম পাড়ার দৃশ্য দেখে তারা চুপ করে থাকে। সম্ভবত বিরক্তই হয়।
মিসির আলি খাতায় বড় বড় করে লিখলেন—মুশফেকুর রহমান। এটি হচ্ছে শিরোনাম। শিরোনাম বড় করেই লিখতে হয়। মূল অংশ থাকে ছোট হরফে লেখা। তিনি দ্রুত লিখতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পরে অবাক হয়ে দেখলেন তিনি যা লিখেছেন তা হচ্ছে-
মুশফেকুর রহমান
মুশফেকুর রহমান। মুশফেকুর রহমান। মুশফেকুর রহমান মুশফেকুর রহমান মুশফেকুর রহমান। মুশফেকুর রহমান। মুশফেকুর রহমান মুশফেকুর রহমান…
মিসির আলি নিজের লেখার দিকে খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ব্যাপার বুঝতে পারছেন না। তাঁর নিজের চিন্তাভাবনা কি এলোমেলো হয়ে গেছে? এরকম কাণ্ড তো আগে কখনো ঘটে নি। তিনি বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। তবে এ জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি তো তিনি আগেও হয়েছেন, কখনো এমন বিচলিত বোধ করেন নি। এবার করছেন কেন?
মুশফেকুর রহমান নামের মানুষটি তাঁকে কি ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে? মানুষটি কি একজন মানসিক রোগী? নাকি সে ভান করছে? সে মানসিক রোগী হলে সমস্যা সহজ, সে যদি ভান করে তা হলে সমস্যা মোটেই সহজ নয়।
লোকটি তার কাছে কী চাচ্ছে তাও স্পষ্ট নয়। শুরুতে সে বলেছে—সে একটি প্রেমের গল্প শোনাতে চায়। এখনো প্রেমের গল্পের অংশে আসা হয় নি। প্রেমের গল্পটি ভালোভাবে শোনা দরকার।
আগের ম্যানেজার সাহেবের মেয়ে ব্যাপারটিকে জটিল করে তুলেছে। তৃতীয় যে খুনটির কথা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে কি এই মেয়েটি যুক্ত? হবার সম্ভাবনাই বেশি। মুশফেকুর রহমানের পরিচিত লোকের সংখ্যা সীমাবদ্ধ। এই মেয়ে তার পরিচিতদের একজন। তবে যাকে হত্যা করা হবে তাকে কি কেউ চিঠি দিয়ে ডেকে আনবে? তাও অফিসে? এত বড় ভুল কি মুশফেকুর রহমান করবে? করার কথা নয়।
তবে ভয়ংকর বুদ্ধিমান কিছু মানুষও মাঝে মাঝে হাস্যকর বোকামি করে বসে। নিউ ইংল্যান্ডে জনি ম্যান নামের এক সাইকোপ্যাথের গল্প—ক্রিমিনোলজির বিখ্যাত গল্পের একটি। সে অসম্ভব ধূর্ততার সঙ্গে এগারটি খুন করল। নিখুঁত পরিকল্পনা, নিখুঁত কাজ পুলিশের মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। কিন্তু বারো নম্বর খুনটি সে করল নিতান্ত বোকার মতো। যে মেয়েটিকে খুন করবে তাকে এক পার্টি থেকে বের করে আনল। বের করে আনার আগে মেয়েটির সঙ্গে নাচল। ছবি তুলল। রাস্তায় এসে আইসক্রিমের দোকানে আইসক্রিম খেল। খুনের আধঘণ্টার মধ্যে সে ধরা পড়ল। পুলিশ যখন তাকে জিজ্ঞেস করল, এত বড় বোকামি তুমি কী করে করলে? সে হাই তুলতে তুলতে বলল, আমার ধারণা ছিল শেষ খুনটি আমি খুব বুদ্ধি খাটিয়ে করেছি। আগের কাজগুলো ছিল বোকার মতো।
এরকম কোনো ব্যাপার তো মুশফেকুর রহমানের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
আচ্ছা, তিনি নিজেও কি খুব বোকার মতো একটা কাজ করেন নি? তাঁর কি উচিত ছিল না ম্যানেজারের কাছ থেকে রানুর ঠিকানা নিয়ে আসা? ম্যানেজার নিশ্চয়ই জানে। রানুর ঠিকানা ছাড়াও মুশফেকুর রহমানের টেলিফোন নাম্বার আনা দরকার ছিল। এখন চলে গেলে কেমন হয়? রশিদ মোল্লাকে হকচকিয়ে দেওয়ার জন্যেও গভীর রাতে তার বাসায় উপস্থিত হওয়া দরকার।
‘স্যার ভাত দিছি।’
মিসির আলি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, ভাত পরে খাব রে বদু। আমি একটা কাজ সেরে আসি।
‘কই যাইবেন?’
‘একটা কাজ সেরে আসি। খুব জরুরি।’
‘ভাত খাইয়া যান। ভাত খাইতে কয় মিনিট লাগব।’
‘এসে খাব।’
মিসির আলি রশিদ মোল্লার বাসায় রাত সাড়ে এগারোটায় উপস্থিত হলেন। এত দেরি হবার কারণ তিনি বাসা ভুলে গেছেন। দু ঘণ্টা আগে যে বাড়িতে এসেছেন সেই বাড়ির ঠিকানা ভুলে যাওয়া একটা বিস্ময়কর ঘটনা। এই বিস্ময়কর ঘটনাই তাঁর জীবনে ঘটল।
.
রশিদ মোল্লা বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। কলিংবেল শুনে দরজা খুললেন। আঁতকে উঠে শুকনো গলায় বললেন, কী ব্যাপার স্যার?
মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, ভালো আছেন?
রশিদ মোল্লা এই সামাজিক সৌজন্যমূলক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, আপনার বাসায় কি টেলিফোন আছে?
‘জি আছে।’
‘একটা টেলিফোন করব।’
‘আসুন, ভেতরে আসুন। বসুন আপনি। টেলিফোন সেটটা শোবার ঘরে। আমি নিয়ে আসছি।’
রশিদ মোল্লার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের অন্য সবাইও জেগে উঠেছে। অল্পবয়সী একটি মেয়ে পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে গেল। মনে হচ্ছে—এই মেয়েটিই গোলাপের চাষ করে। তিনি রশিদ মোল্লাকে হকচকিয়ে দিতে এসে পরিবারের সবাইকে হকচকিয়ে দিয়েছেন।
‘নিন স্যার, টেলিফোন করুন। কত নাম্বারে করবেন?’
মিসির আলি বললেন, আপনি নাম্বারটা বলুন?
রশিদ মোল্লা বললেন, কী নাম্বারের কথা বলছেন?
‘মুশফেকুর রহমানের টেলিফোন নাম্বারটা বলুন। নিশ্চয়ই তাঁর বাড়িতে টেলিফোন আছে। আপনি তার নাম্বারও জানেন।’
‘এখন টেলিফোন করে লাভ হবে না স্যার। উনি এখন টেলিফোন ধরবেন না। সন্ধ্যার পর উনি টেলিফোন ধরেন না।’
‘তবু চেষ্টা করে দেখি। নাম্বারটা বলুন।’
‘উনি যদি জানেন আমি নাম্বার দিয়েছি তা হলে খুব রাগ করবেন।’
‘উনি জানবেন না।’
রশিদ মোল্লা শুকনো গলায় নাম্বার বললেন, দু বার রিং হতেই ওপাশ থেকে টেলিফোন উঠানো হল। কেউ কোনো কথা বলছে না। মিসির আলি কুকুরের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে পাচ্ছেন। কেউ একজন খুব হালকাভাবে টেলিফোন সেটের উপর নিশ্বাস ফেলল। মিসির আলি বললেন, হ্যালো!
ওপাশ থেকে ভারী গম্ভীর গলায় বলল, মিসির আলি সাহেব?
‘জি।’
‘আপনার টেলিফোন কলের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।’
গলার স্বর সম্পূর্ণ অচেনা। শুদ্ধ ভাষায় কেউ কথা বলছে—কিন্তু এর মধ্যেই গ্ৰাম্য টান আছে। পুরুষকণ্ঠ, তবে এই কণ্ঠের সঙ্গে মুশফেকুর রহমানের কণ্ঠস্বরের কোনো মিল নেই। গলার স্বর মানুষ বদলাতে পারে, কিন্তু এতটা পারে না। মিসির আলি বললেন, আপনি কে বলছেন?
‘আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয় নি। আমি তন্ময়ের টিচার ছিলাম। ওকে অঙ্ক শেখাতাম। তন্ময় সম্ভবত আমার কথা বলেছে আপনাকে?’
‘হ্যাঁ বলেছে।’
‘শুনুন মিসির আলি সাহেব, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। কবে আসবেন?’
‘বুঝতে পারছি না কবে আসব। প্রেতাত্মাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ভালোও লাগে না।’
‘ভালো লাগে না কী করে বললেন? আগে কি কখনো প্রেতাত্মার সঙ্গে কথা বলেছেন?’
‘আপনার সঙ্গে বলছি।
‘বাহ্, আপনি মানুষ হিসেবেও তো রসিক। একবার আসুন। আসবেন?’
‘আসতেও পারি।’
‘দেরি না করে চলে আসুন। আজ রাতেই চলে আসুন।’
‘আপনার বাড়ির ঠিকানা কী?’
‘রশিদ মোল্লাকে জিজ্ঞেস করুন। ও আপনাকে ঠিকানা বলে দেবে। আপনি ওর বাসা থেকেই তো টেলিফোন করছেন। তাই না?’
‘জি।’
‘কিংবা এক কাজ করতে পারেন। ওকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসতে পারেন। ও দারুণ ভীতু। ওকে একটা ধমক দিলেই ও আপনার সঙ্গে আসবে এবং দূর থেকে বাসা দেখিয়ে দেবে। কাছে আসবে না। সন্ধ্যার পর বাসার কাছে আসতে সে ভয় পায়?’
‘আজ আসতে পারছি না। তবে হয়তো শিগগিরই আসব।’
‘শুনুন মিসির আলি সাহেব, আজ আসাই ভালো। জোছনা রাত আছে। জোছনা আপনার ভালো লাগে নিশ্চয়ই।
‘ভালো লাগে না। জোছনা অনেক রহস্য তৈরি করে। রহস্য আমি পছন্দ করি না বলেই দিনের আলো জোছনার চেয়ে বেশি ভালো লাগে।’
‘রহস্য আপনি পছন্দ করেন না?’
‘জি না।’
‘এই জন্যেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। চলে আসুন।’
‘আসব আসব, এত ব্যস্ত হবেন না।’
‘আমি মোটেই ব্যস্ত নই। আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এই জন্যেই বলছি। ও আরেকটা কথা—আগের ম্যানেজারের মেয়েটির ঠিকানা রশিদ মোল্লা জানে না। বের করার চেষ্টা করেছে। পারে নি। তবে আমি আপনাকে ঠিকানা দিতে পারি। ওরা নারায়ণগঞ্জে থাকে। আপনার কাছে কি কাগজ-কলম আছে? থাকলে লিখে নিন… ‘
মিসির আলি বললেন, থাক, ঠিকানার প্রয়োজন নেই।
‘আমি যে এতকিছু জানি আপনি কি এতে অবাক হচ্ছেন না।’
‘আমি এত সহজে অবাক হই না। আপনার নাম তো জানা হল না।’
‘দেখা হলেই নাম বলব। এত তাড়া কিসের?’
মিসির আলি টেলিফোন নামিয়ে রেখে রশিদ মোল্লাকে বললেন, চলি রশিদ সাহেব। অনেক রাতে আপনাকে বিরক্ত করেছি। কিছু মনে করবেন না।
রশিদ মোল্লা কিছু বলল না। জবুথবু হয়ে বসে রইল। এই শীতের রাতেও তার কপালে ঘাম। সে খুব ভয় পেয়েছে।
আগের বার রশিদ মোল্লা গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল। এবার এল না। দরজা বন্ধ করতেও উঠল না। রশিদ মোল্লার মেয়েটি দরজা বন্ধ করার জন্যে উঠে এসেছে। সে খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। তার বাবার মতো মেয়েটিও ভয় পেয়েছে।
.
অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছে। বুদ্ধি করে মাফলার এনেছেন বলে রক্ষা। মাফলার ভেদ করে শীতল হাওয়া ঢুকছে। নাক জ্বালা করা শুরু হয়েছে। ঠাণ্ডা মনে হয় লেগে যাবে। নিউমোনিয়ায় না ধরলে হয়। শরীর দুর্বল। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি গেছে। ছোট অসুখই দেখতে দেখতে ভয়াবহ হয়ে যায়।
আজকের রাতের ঘটনায় তিনি তেমন বিস্মিত বোধ করছেন না। বড় ধরনের রহস্যময় ঘটনায় তিনি তেমন বিস্মিত হন না। ছোটখাটো ঘটনাগুলো বরং তাঁকে অনেক বেশি অভিভূত করে। একবার এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে ছ’টাকা ভাড়া ঠিক করে রিকশায় উঠলেন। নামার সময় তাকে একটা পাঁচ টাকা এবং একটা দু টাকার নোট দিলেন। দু টাকার নোটটা ছিল পাঁচ টাকার নোটের ভেতর। রিকশাওয়ালার তা দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। সে টাকাটা নিয়ে পকেটে রেখে দিল এবং লুঙ্গির খুঁট থেকে একটা এক টাকার নোট ফেরত দিল। মিসির আলি বিস্ময়ে অভিভূত হলেন। একবার ভাবলেন, রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কী করে বুঝল পাঁচ টাকার নোটের ভাঁজে একটা দু টাকার নোট আছে? তিনি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেন নি। থাক না কিছু রহস্য। সব রহস্য ভেঙে দেওয়ার দরকার কি?
পৃথিবীতে কিছু কিছু রহস্য আছে যা ভাঙতে ইচ্ছে করে, আবার কিছু রহস্য আছে ভাঙতে ইচ্ছা করে না। তন্ময় নামের ছেলেটির রহস্য ভেদ করার ইচ্ছা তাঁর আছে। ব্যাপারটা খুব সহজ হবে কিনা তা তিনি এখনো জানেন না।
রশিদ মোল্লার বাসা থেকে তিনি টেলিফোন করলেন। অন্য একজন ধরল। তা ধরতেই পারে। হয়তো তন্ময়ের বাড়িতে আরো একজন থাকে। যে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে মাস্টার সাহেব হিসেবে। সে চট করে বলে দিল, আপনি রশিদ মোল্লার বাড়ি থেকে টেলিফোন করছেন? আপাতদৃষ্টিতে খুব আশ্চর্যজনক ঘটনা মনে হলেও হয়তো তেমন আশ্চর্যজনক নয়। রশিদ মোল্লাই আগেভাগে জানিয়েছে। মিসির আলি অপেক্ষা করছিলেন—রশিদ মোল্লা টেলিফোন সেট আনতে গেল। চট করে আনল না। দেরি হল। এই ফাঁকে রশিদ মোল্লা হয়তো জানিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া ঐ লোকটি প্রাণপণ চেষ্টা করছিল মিসির আলিকে বিস্মিত করতে। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল, ‘আমি যে এতকিছু জানি আপনি এতে অবাক হচ্ছেন না?’ একজন প্রেতাত্মা মানুষকে বিস্মিত করার এত চেষ্টা করবে না। মানুষই করবে। তন্ময়ের মৃত শিক্ষক টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলবে এই হাস্যকর ধারণা নিয়ে মাথা ঘামাবার মানুষ মিসির আলি নন। তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। তবে চিন্তিত বোধ করছেন। কেন চিন্তিত বোধ করছেন তাও তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়।
তিনি বিপদ আঁচ করছেন। তাঁর মনের একটি অংশ ভয় পাচ্ছে। ভয় পাবার পেছনের কারণটি তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। শুধু যে ভয় পাচ্ছেন তা না—পুরো ব্যাপারটা তাঁর মনের ওপর এক ধরনের চাপও সৃষ্টি করছে। কে যেন খুব অস্পষ্টভাবে তাঁকে বলছে—তুমি সরে এস। তুমি দূরে সরে এস।
টুং টুং ঘণ্টা বাজিয়ে রিকশা আসছে। ভিড়ের সময় রিকশাওয়ালারা কখনো ঘণ্টা বাজায় না। ফাঁকা রাস্তা বলেই হয়তো ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে আসছে। এই রিকশা ভাড়া যাবে বলে মনে হয় না। যাচ্ছে উল্টো দিকে। তবু মিসির আলি বললেন, ভাড়া যাবে?
মিসির আলিকে বিস্মিত করে দিয়ে রিকশাওয়ালা বলল, যামু। এই শীতের রাইতে খামাখা রিকশা বাইর করছি? টাইট হইয়া বহেন। পঙ্ক্ষীরাজের মতো লইয়া যামু।
মিসির আলি টাইট হয়ে বসলেন। এই রিকশায় বসাই তাঁর কাল হল। রিকশাওয়ালা ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু ক্ষতি যা করার করে ফেলল। ভয়াবহ ঠাণ্ডা লেগে গেল। মিসির আলি ঘরে ঢুকেই বিছানায় পড়লেন। প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। বুক পাথরের মতো ভারী, শ্বাস নিতে পারেন না। আচ্ছন্নের মতো মাঝে মাঝে তাকান, তখন মনে হয় মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা তাঁর কাছে নেমে আসছে। একসময় মনে হল, ফ্যানের ব্লেড ঘুরতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগছে। হেলুসিনেশন। তাঁর হেলুসিনেশন হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন বদু তাঁর মাথায় পানি ঢালছে। সেই পানি তাঁর কাছে উষ্ণ মনে হয়। বদু কি তাঁর মাথায় ফুটন্ত পানি ঢালছে? বিছানার এক পাশে চড়ুই পাখির খাঁচা। খাঁচার ভেতর পাখি দুটিকে ঘুঘু পাখির মতো বড় দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারাও এক দৃষ্টিতে মিসির আলিকে দেখছে। শেষ রাতের দিকে তিনি অচেতনের মতো হয়ে গেলেন। জ্বরের প্রচণ্ড ঘোর, আধো-চেতন-আধো-জাগ্রত অবস্থায় তিনি নীলুকে দেখলেন।
নীলু যেন এসেছে তাঁর কাছে। বসেছে বিছানার পাশে। কি স্পষ্টই না তাকে দেখাচ্ছে। কানের দু পাশের চুল যে বাতাসে কাঁপছে তাও দেখা যাচ্ছে। নীলু বলল, আবার অসুখ বাঁধিয়েছেন? মিসির আলি হাসার চেষ্টা করলেন।
‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘হুঁ।’
‘বলুন আমি কে?’
‘নীলু।’
‘কতদিন পর আপনাকে দেখতে এলাম বলুন তো?’
‘তুমি আমাকে দেখতে আস নি। সবই আমার কল্পনা। প্রচণ্ড জ্বরের জন্যে আমি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছি। ঘোরের কারণে মস্তিষ্কের নিউরনে সঞ্চিত স্মৃতি উলটপালট হয়েছে। সে তোমাকে তৈরি করেছে। বাস্তবে তোমার অস্তিত্ব নেই। আমি হাত বাড়ালে তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারব না।’
‘এখনো লজিক?’
‘হ্যাঁ, এখনো লজিক।
‘দেখুন না একটু হাত বাড়িয়ে আমাকে ছুঁতে পারেন কিনা।’
‘পারছি না, নীলু। আমার হাত-পা পাথরের মতো ভারী হয়ে এসেছে।’
‘আমি কেন এসেছি বলুন তো?’
‘আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে এসেছ। কেউ যখন ভয়ংকর অসুস্থ হয় তখন তার চারপাশের জগত্ত শূন্য হয়ে পড়ে। তার মস্তিষ্ক তখন তার জন্যে একজন সঙ্গী তৈরি করে।’
‘আপনার লজিক ঠিক আছে। আপনি অসুস্থ নন।’
‘তুমি চলে যাও, নীলু। আমি কথা বলতে পারছি না। আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।’
‘আমি চলে যেতে পারছি না। আমি তো নিজ থেকে আসি নি—আপনি আমাকে এনেছেন।’
ঘোরের মধ্যে মিসির আলি ছটফট করতে লাগলেন। নীলু তাঁর দিকে ঝুঁকে এল। মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। মেয়েটা এত কাছে এগিয়ে আসছে কেন? এটা ঠিক হচ্ছে না। নীলু এখন ফিসফিস করে বলল, আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি। আপনি ভয়াবহ বিপদের দিকে যাচ্ছেন। পুরোনো ঢাকার ঐ বাড়িতে আপনি কখনো যাবেন না। মাস্টার সাহেবের সঙ্গে আপনার দেখা না করলেও চলবে। প্লিজ, আপনি আমার কথা শুনুন।
মিসির আলির জ্বর আরো বাড়ল। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে একটা রেলগাড়ি চলছে। চাকার ঘর্ঘর শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দ বারবার বলছে—আপনি আমার কথা শুনুন। আপনি আমার কথা শুনুন।