ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য
উপরে আলোচিত ও বিশ্লেষিত নামগুলির মধ্যে আর কোন কোন বর্ণ বা উপবর্ণ আত্মগোপন করিয়া আছে তাহা বলিবার উপায় নাই; অন্তত বিশেষ ভাবে কোন ও বর্ণ বা উপবর্ণ উল্লিখিত হইতেছে না। বর্মণ অন্ত্যনাম কোন ও কোন ও ক্ষেত্রে পাওয়া যাইতেছে, যেমন বেত্রবর্মণ সিংহবৰ্মণ, চন্দ্রবর্মণ ইত্যাদি। এই যুগে বর্মণান্ত নাম উত্তর-ভারতের অন্যত্র ক্ষত্রিয়ত্ব জ্ঞাপক; কিন্তু বেত্রবর্মণ, চন্দ্রবর্মণ ক্ষত্রিয় কিনা বলা কঠিন, অন্তত তেমন দাবি কেহ করিতেছেন না। রাজ-রাজন্যরা ত সাধারণত ক্ষত্রিয়ত্বের দাবি করিয়া থাকেন, কিন্তু সমসাময়িক বাংলার রাজরাজন্যদের পক্ষ হইতে ও তেমন দাবি কেহই জানায় নাই। পরবর্তী পাল রাজাদের ক্ষত্রিয়ত্বের দাবিও নিঃসংশয় নয়, কেবল বিদেশাগত কোনও কোন ও বাজবংশ এই দাবি করিয়াছেন। বস্তুত বাংলার স্মৃতি-পুরাণে ঐতিহ্যে ক্ষত্রিয় বর্ণের সবিশেষ দাবি কাহারও যেন নাই! নগরশ্রেষ্ঠ, সার্থবাহ, ব্যাপারী-ব্যবসায়ীর উল্লেখ এযুগে প্রচুর; কিন্তু তাহাদের পক্ষ হইতেও বৈশ্যত্বের দাবি কেহ করিতেছেন—সমসাময়িক কালে তো নয়ই, পরবর্তী কালেও নয়। বাংলার স্মৃতি-পুরাণ-ঐতিহ্যে বিশিষ্ট পৃথক বর্ণ হিসাবে বৈশ্যবর্ণের স্বীকৃতি নাই। বল্লালচরিতে বণিক-সুবর্ণবণিকদের বৈশ্যত্বের দাবি করা হইয়াছে; কিন্তু এ সাক্ষ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। অন্যত্র কোথাও কাহারও সে দাবি নাই, স্মৃতি গ্রন্থাদিতে নাই, বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পর্যন্ত নাই। বস্তুত বাংলাদেশে কোনও কালেই ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সুনির্দিষ্ট বর্ণহিসাবে গঠিত ও স্বীকৃত হইয়াছিল বলিয়াই মনে হয় না; অন্তত তাহার সপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোনও প্রমাণ নাই। ইহার কারণ কি বলা কঠিন। বহুদিন আগে রামপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বলিয়ছিলেন, (১) বাংলার আর্যীকরণ ঋগ্বেদীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী হয় নাই, সেই জন্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য-শূদ্র লইয়া যে চাতুবৰ্ণ-সমাজ, বাংলাদেশে তাহার প্রচলন নাই। বাংলার বর্ণসমাজ অ্যাল্পীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী গঠিত, এবং অ্যালপীয় আর্য ভাষীরা ঋগ্বেদীয় আর্যভাষী হইতে পৃথক। চন্দ মহাশয়ের এই মত যদি সত্য হয় তাহা হইলে ইহার মধ্যে বাংলার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের প্রায়ানুপস্থিতির কারণ নিহিত থাকা অসম্ভব নয়। বাংলার বর্ণবিন্যাস ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রবর্ণ ও অন্তজ-ম্লেচ্ছদের লইয়া গঠিত; করণ-কায়স্থ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য এবং অন্যান্য সংকর বর্ণ সমস্তই শূদ্র-পর্যায়ে; সর্বনিম্নে অন্ত্যজ বর্ণের লোকেরা। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকের এই বর্ণবিন্যাস পঞ্চম-অষ্টম শতকে খুব সুস্পষ্টভাবে দেখা না দিলেও তাহার মোটামুটি কাঠামো এই যুগেই গড়িয়া উঠিয়াছিল, এই অনুমান করা চলে। কারণ, এই যুগের লিপিগুলিতে তিনটি দ্বিজবর্ণের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণদেরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ধরা পড়িতেছে; আর যাঁহারা, তাঁহারা এবং অন্যান্যে বিচিত্র জীবন-বৃত্তি অবলম্বন করিয়া শূদ্রান্তর্গত বিভিন্ন উপবর্ণ গড়িয়া উঠিতেছে মাত্র; ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণের কোন ইঙ্গিত-আভাস কিছুই নাই।
—————–
(১) Chanda, Indo-Aryan Races