অধ্যায় ৬. কোনো ক্ষতি কোরো না
বৌদ্ধধর্মের মতো, জৈনধর্মও সেই প্রশ্নটির একটি উত্তর, হিন্দুধর্ম মানবতাকে যে প্রশ্নটির মুখোমুখি করেছিল। যদি আমাদের বর্তমান অস্তিত্বটি শুধুমাত্র ভবিষ্যতে কাটাতে হবে এমন বহুজীবনের সবচেয়ে সাম্প্রতিকতমটি হয়ে থাকে, কারণ আমাদের কার্মা পুনর্জন্মের সেই চক্রে আমাদের বন্দি করে রেখেছে, তাহলে কীভাবে আমরা এখান থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি এবং পালিয়ে যেতে পারি সেই অবস্থায়, যাকে বলা হয় ‘নির্বাণ’? নির্বাণ হচ্ছে সংস্কৃত একটি শব্দ, যার অর্থ মোমবাতির শিখার মতো নিভে যাওয়া। এটি অর্জিত হয় যখন আত্মা অবশেষে ‘সামসারা’ থেকে মুক্তি পায়। বুদ্ধের উত্তর ছিল দুই চূড়ান্তের মধ্যম পন্থা। জৈনধর্ম এর বিপরীত দিকে গিয়েছিল। এটি কল্পনাযোগ্য সবচেয়ে কঠোর আত্ম-অস্বীকৃতির পথ নির্বাচন করেছিল। আর এর অনুসারীদের জন্য চূড়ান্ত আদর্শ ছিল সাল্লেখানা বা সন্ত্রা আচারটি পালন করা এবং উপোস করার মাধ্যমে নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত করা।
‘জৈন’ শব্দটি যে সংস্কৃত ক্রিয়াপদ (জিন) থেকে এসেছে, তার অর্থ হচ্ছে ‘জয় করা। এটি সেই যুদ্ধটির তথ্যনির্দেশ করছে, যে যুদ্ধটি জৈনধর্মানুসারীদের তাদের নিজেদের প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়তে হয়, বোধিলাভের সেই পর্যায় পৌঁছাতে, যা তাদের মুক্ত করে (জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি)। জৈনধর্মের চব্বিশ জন ‘জিন’ অথবা বিজয়ী ছিলেন, যারা তাদের সব তৃষ্ণার ওপর এমন দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, তারা বোধিলাভ করেছিলেন। তারা তীর্থঙ্কর’ নামে পরিচিত ছিলেন [(জৈনধর্মে একজন তীর্থঙ্কর হলেন এক সর্বজ্ঞ শিক্ষক ঈশ্বর, যিনি ধর্ম (নৈতিক পথ) শিক্ষা দেন।] ‘তীর্থঙ্কর’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘তীর্থের প্রতিষ্ঠাতা’। আর জৈনধর্মে ‘তীর্থ’ বলতে ‘সংসার’ নামক অনন্ত জন্ম ও মৃত্যু সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত একটি সংকীর্ণ পথকে বোঝায়, তীর্থঙ্করদের ‘শিক্ষক ঈশ্বর’, ‘পথ স্রষ্টা, যাত্রাপথ-স্রষ্টা’ ও ‘নদী পারাপারের পথস্রষ্টা; কারণ পুনর্জন্মের সেই নদীর উপর দিয়ে অন্যপ্রান্তে মোক্ষ (মুক্তি)-লাভের দিকে তারা আত্মাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। এইসব তীর্থঙ্করদের মধ্যে যিনি সর্বশেষ, তাকে সাধারণত জৈনধর্মের (জিন সাশন) প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বর্ণনা করা হয়। তার নাম ছিল বর্ধমান, যদিও তিনি মহাবীর (মহান বীর) নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। জৈনধর্মীয় ঐতিহ্য আমাদের জানাচ্ছে তিনি ৫৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, পূর্বভারতের। গাঙ্গেয় অববাহিকায়; এই এলাকায় সিদ্ধার্থ গৌতমও জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি বুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
শুধুমাত্র ভূগোল বা সময় ছাড়াও বুদ্ধ আর মহাবীরের মধ্যে আরো বেশকিছু মিল আছে। তিনিও একজন রাজকুমার ছিলেন। তিনিও দুঃখের সমস্যা, এর কারণ আর প্রতিকার নিয়ে ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলেন। অনন্ত জ্ঞান বা সর্বজ্ঞতা লাভের আশায় তিনিও তার স্বচ্ছল বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত জীবন ত্যাগ করেছিলেন। এবং তিনি বুদ্ধের সাথে একমত হয়েছিলেন যে, তৃষ্ণাই (কামনা/আসক্তি) হচ্ছে সব দুঃখের কারণ। মানুষ অসুখী কারণ, তাদের যা নেই, তারা সেই জিনিসই কামনা করে। কিন্তু যখনই তারা যা তারা কামনা করেছিল সেটি পায়, আবার তারা অন্য কোনোকিছু কামনা করতে শুরু করে। সেকারণে তৃষ্ণাই হচ্ছে সব দুঃখের কারণ, এই তৃষ্ণা নির্বাপন করার মধ্যেই আছে আমাদের পরিত্রাণ। এবং যেভাবে তিনি এই তৃষ্ণা নির্বাপন করার পথ বেছে নিয়েছিলেন সেটি ইঙ্গিত করে মহাবীর আসলে ঠিক কতটা বৈপ্লবিক একটি চরিত্র ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অশুভ সব কাজকে এড়িয়ে চলা এবং ভালো কাজ করার মাধ্যমেই জন্ম-জন্মান্তরের সামসারার চক্র থেকে মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। বুদ্ধের মতোই, তিনিও তালিকা বানাতে ভালোবাসতেন। তিনি তার প্রক্রিয়াটিকে পাঁচটি নির্দেশনায় সূত্রবদ্ধ করেছিলেন। কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা কিংবা ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা। চুরি না করা। মিথ্যাচার না করা। অপবিত্র কিংবা বিশৃঙ্খল জীবন না কাটানো। এবং কোনোকিছুতে আসক্তি বা কামনা না করা। এই পঞ্চব্রতগুলো হচ্ছে : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে এই নির্দেশগুলোর মধ্যে নতুন কিছুই নেই। বিশ্বাসের অন্য অনেক পদ্ধতিই একই ধরনের তালিকা তাদের অনুসারীদের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে এর আগে। কিন্তু জৈনধর্মকে যা স্বতন্ত্র করেছে, সেটি হচ্ছে মহাবীরের প্রথম নির্দেশনাটির ওপর এটি যে-পরিমাণ গুরুত্ব দিয়েছে, কোনো জীবকে হত্যা বা জীবের ক্ষতি না করা। অহিংসা, তার শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটিকে তিনি বিশ্বজনীন এবং চূড়ান্ত একটি আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যারা মোক্ষলাভ করতে চাইছেন, তারা শুধুমাত্র চরম অহিংসার মাধ্যমে কার্মাকে পরিবর্তন করতে পারবেন, যা তাদেরকে পুনর্জন্মের চক্রের সাথে বেঁধে রেখেছে।
জৈন সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীরা অবশ্যই কোনোকিছুকে কষ্ট দিতে অথবা হত্যা করতে পারবেন না! খাদ্য হিসাবে কোনো প্রাণীকে হত্যা করা তাদের জন্যে। নিষিদ্ধ। তারা শিকার কিংবা মাছ ধরতে পারবেন না। এমনকি তারা মশাও মারতে পারবেন না, যখন কিনা সেটি তাদের মুখের উপর বসে রক্ত শুষে নেয়, কিংবা মৌমাছি, যদি সেটি তাদের ঘাড়ে হুল ফুটিয়ে দেয়। যদি তারা কোনো একটি মাকড়শা বা অবাঞ্ছিত কীট তাদের বাড়িতে খুঁজে পান, তারা তাদের হত্যা করতে পারবেন না। যদি তারা সেটি সেখানে না চান, তাহলে খুব সতর্কতার সাথে সেটি ধরতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে যেন এই প্রক্রিয়ায় সেগুলো আহত না হয়, এবং সম্মানের সাথে তাদের বাইরের পরিবেশে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। এবং যেহেতু মাটিতে তারা হাঁটেন, যেখানে বহু ক্ষুদ্র জীবন্ত প্রাণীদের বাস, তাদের খুব সতর্কভাবে হাঁটতে হবে, যেন তারা কোনো প্রাণীরই ক্ষতি না করেন। তাদের পায়ের চাপে যেন কোনো জীবন পিষ্ট না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে জৈন সন্ন্যাসীরা নরম পালকের ঝাড়ু ব্যবহার করেন, এবং তারা হাঁটার সময় আগে খুব সতর্কভাবে ঝাড়ু দিয়ে নেন, সেখানে পা রাখার আগে। কেউ কেউ এমনকি মুখোশ পরেন, কোনো প্রাণী যেন ভুল করে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করতে না পারে। তারা যেন কোনো জীবের ক্ষতি না করেন। সবধরনের জীবনের প্রতি তাদের এই বিশেষ শ্রদ্ধা, এমনি কন্দমূলের জন্যে প্রযোজ্য। মাটির নিচের সবজি টেনে উঠানো যেমন যাবে না, তেমনি সেভাবে সংগৃহীত খাদ্যও খাওয়া যাবে না, তাদেরও জীবন আছে, যে জীবন মানুষের জীবনের মতোই মূল্যবান।
বেশ, যদি তারা মাংস, মাছ অথবা সবজি না খান, তাহলে জৈনরা কী খেয়ে বেঁচে আছেন? তাদের কেউ কেউ আসলেই বেঁচে না-থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সাল্লেখানা বা সন্ত্রা বা উপোস করার মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া সর্বোচ্চ জৈন আদর্শ। এটি আত্মা থেকে সব আসক্তির নির্বাপণ এবং কার্মা থেকে চূড়ান্ত মুক্তি চিহ্নিত করে। কিন্তু আপনি কয়েক মুহূর্ত ভাবলেই বুঝতে পারবেন যে, এধরনের আত্মহত্যার একটি বিশ্বজনীন আচার হবার সম্ভাবনা নেই, এমনকি জৈন অনুসারীদের মধ্যেও। প্রতিটি ধর্মেই ধর্মীয় আচার অনুসরণ করার তীব্রতায় নানাধরনের স্তর আছে, অতিউৎসাহীদের তীব্র উগ্রতা থেকে শুরু করে কদাচিৎ আচার-অনুসরণকারী স্বল্পমাত্রার উৎসাহীরা। জৈনবাদ, যদিও ইতিহাসে খুবই তীব্র ধর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম, তবে এর অনুসারীদের মধ্যেও এই তীব্রতার নানামাত্রা আমরা দেখতে পাই। অধিকাংশই উপোস করে আত্মহত্যা করেন না। কিন্তু তারা যা করেন সেটি যথেষ্ট পরিমাণেই চরম পর্যায়ের। তারা শুধু ফল খান, সেই ফল, যা মাটিতে পড়ে। জৈনরা বৈপ্লবিকমাত্রায় ফলাহারী। বাতাসের কারণে মাটিতে পড়া ফল খাওয়ার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখেন অন্য কোনোধরনের জীবনের ক্ষতি না করে।
সবধরনের জীবনের পবিত্রতার ওপর গভীর বিশ্বাস ছাড়া, জৈনধর্ম খুব সামান্যই ধর্মীয় তত্ত্বের ভারে নিজেকে ভারাবনত করেছে। এর পদ্ধতির মধ্যে এটি চূড়ান্ত কোনো ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার জন্যে জায়গা রাখেনি। জাত বা বর্ণপ্রথার নিষ্ঠুরতাগুলো এটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু এর মোক্ষ বা মুক্তি লাভ করার পথটি মহাবিশ্বের একটি সুনির্দিষ্ট মানচিত্রের ওপর নির্ভরশীল। জৈনরা বিশ্বাস করতেন দুটি দানবীয় আকারের বিশাল গোলক দিয়ে এই মহাবিশ্ব তৈরি, যে গোলকদুটি একটি সংকীর্ণ কোমর দিয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে আছে। ছবিটি কল্পনা করতে চাইলে একটি বাতাসভর্তি বেলুনের মাঝখানে একটি গিঁট বাঁধার চেষ্টা করুন, যা এটিকে আপনার গিঁটটি দিয়ে সংযুক্ত দুটি ভাগে বিভক্ত করবে। জৈন ধর্মমতে এই মধ্যবর্তী গিঁটটি হচ্ছে আমাদের এই বিশ্ব, যেখানে পুনর্জন্মের চক্রে আত্মারা তাদের সময় অতিবাহিত করে। ঠিক যেমন বেশি পরিমাণ খাদ্য আমাদের শরীরকে স্থূল করে তোলে এবং যখন সেটি বহন করে চলতে আমাদের কষ্ট হয়, সেভাবে জৈন বিশ্বাসে মনে করা হয়, খারাপ আচরণ আমাদের আত্মাকে ভারী করে তোলে, পুনর্জন্মের চাকা থেকে মুক্তি পাবার বিষয়টিকে এটি আরো কঠিন করে তোলে। যে আত্মাগুলো এর আগে খারাপ জীবন কাটিয়েছে তারা ফিরে আসে নিম্নতর কোনো রূপে। হয়তো কোনো সাপ বা ব্যাঙ হিসাবে, এমনকি গাজর কিংবা পিয়াজ রূপেও হতে পারে। যে আত্মাগুলো আসলেই খুবই অশুভ জীবন কাটিয়েছে সেগুলো এতই ভারী হয়ে ওঠে যে, তাদের ওজন এদের নিচের দিকে টেনে নিয়ে যায় মহাবিশ্বের নিচের গোলকের মধ্যে সাতটি নরকের কোনো একটিতে, যেখানে প্রতিটি নরক নির্যাতনের মাত্রায় এর উপরের নরকের চেয়েও আরো বেশি ভয়ংকর।
আর এই একই আইন মেনে, যে আত্মারা নিজেদের পাপমুক্ত করতে পারে, সেটি আরো হালকা হয়ে যেতে থাকে যতই তারা সংগ্রাম করে। সত্যিকারের জৈনরা কৃচ্ছত; কঠোর তপশ্চর্যার আচার পালন করেন (অ্যাসেটিসিজম শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিকের ক্রীড়াজগৎ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে খুবই কঠোরভাবে পরিশ্রম করা, যেন তার ক্ষেত্রে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন)। জিনরা, যারা জৈনধর্মের সেরা চরিত্র, তারা তাদের আত্মার শুদ্ধির জন্যে এতটাই পরিশ্রম করেন যে, সেটি ক্রমশ হালকা হয়ে উপরের গোলকে স্বর্গে আরোহণ করে, ছাব্বিশটি স্বর্গ অতিক্রম করে তারা নির্বাণে পৌঁছে যান, যা তাদের সব সংগ্রামের চূড়ান্ত গন্তব্য। এখানে তারা স্থির পরমানন্দময় একটি অবস্থায় চিরবিরাজমান। অবশেষে মোক্ষলাভ।
জৈনধর্মের আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক দিক হচ্ছে, যেভাবে এটি তার। নির্ভারতার (আত্মার লঘুতা) সংগ্রামটির সম্প্রসারণ করেছিল ধারণার জগতেও। খারাপ কাজের মতোই, খারাপ ধারণাও আমাদের আত্মাকে আরো ভারী করে তুলতে পারে। ইতিহাস অবশ্যই সাক্ষী যে, ধর্মীয় ধারণাসহ নানাধরনের ধারণা নিয়ে অমিল মানুষের মধ্য সংঘর্ষের অন্যতম প্রধান একটি কারণ। কারণ জৈনদের জন্যে, অহিংসার মতবাদ সেই ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়, যেভাবে তারা মানুষের শরীরকে দেখেন, তেমনি তাদের ধারণাগুলোকেও দেখেন। এমনকি তাদের মানসিক জীবনেও জৈনরা কারো ক্ষতি করার কথা এবং অহিংস আচরণ করা থেকে বিরত থাকেন। তারা সেই ভিন্নপথগুলোকে শ্রদ্ধা করেন, যেভাবে বিভিন্ন মানুষ তাদের বাস্তবতাকে পর্যবেক্ষণ আর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, এবং একই সাথে সেই বিষয়টিকেও শনাক্ত করেন : আসলে কেউই সার্বিকভাবে পুরো ব্যাপারটি একা দেখতে পারেন না।
শ্রদ্ধার এই মতবাদটির তারা নাম দিয়েছেন ‘অনেকান্তবাদ’। এবং এটি ব্যাখ্যা করার জন্য তারা অন্ধ ছয় ব্যক্তির একটি কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন, যাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ অনুভব করে একটি হাতির বিবরণ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যে ব্যক্তি এর পা অনুভব করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন হাতি স্তম্ভের মতো দেখতে। যিনি এর লেজ স্পর্শ করেছিলেন তার কাছে এটি ছিল দড়ির মতো। যিনি এর শুড় অনুভব করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন এটি দেখতে একটি গাছের শাখার মতো। যে ব্যক্তি কান স্পর্শ করেছিলেন তার কাছে হাতি ছিল একটি হাতপাখার মতো, যিনি এর পেটে হাত বুলিয়েছিলেন এটি ছিল তারা কাছে একটি দেয়ালের মতো, যিনি এর শক্ত দাঁত ধরেছিলেন তিনি বলেছিলেন হাতি শক্ত একটি নলের মতো দেখতে। তাদের শিক্ষক সবাইকে বলেছিলেন, তারা সবাই সঠিক তাদের বিবরণে তবে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে, কিন্তু প্রত্যেকেই পুরো অংশটির শুধুমাত্র একটি অংশ বুঝতে পেরেছিলেন। এই গল্পের নীতিবাক্য হচ্ছে যে, বাস্তবতা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে মানুষের একটি সীমাবদ্ধতা আছে। যদিও তারা সম্পূর্ণ বিষয়টির প্রতি অন্ধ নাও হতে পারেন, কিন্তু শুধুমাত্র একটি একক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা সেটি দেখতে পারেন। আর এটি ঠিক আছে, যতক্ষণ-না তারা দাবি করছেন যে, একমাত্র তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই হচ্ছে সার্বিক চিত্র, এবং একইভাবে বিষয়টি দেখতে যখন তারা অন্যদের ওপর বল প্রয়োগ করেন।
জৈনরা মনে করেন, আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সেই মায়া বা অবাস্তবতার পরিণতি যেখানে আমরা আমাদের এই পাপপূর্ণ অস্তিত্বে আটকে আছি। শুধুমাত্র সর্বজ্ঞানপ্রাপ্তরাই নিখুঁত জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছেন। জৈনধর্মের অন্য বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যাই ভাবি না কেন, তবে আধ্যাত্মিক নম্রতার ব্যাপারে এর প্রণোদনা অন্যসব ধর্মের মধ্যে বিরল একটি বিষয়। ধর্মগুলো সাধারণত এমন কিছু দাবি করতে উৎসুক থাকে যে, শুধুমাত্র তাদের কাছে চূড়ান্ত সত্যটি আছে, সব ব্যাপারে তারাই সবকিছু জানেন। তারা সবাই সেই অন্ধ ভিখারিদের মতো, যারা একটি হাতির আকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে, এমন ধারণা তাদের কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
মহাবীর তার ধর্ম প্রচার করতে সারা ভারতজুড়েই ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, এবং তিনি বহু অনুসারীও আকৃষ্ট করেছিলেন। কমন এরা শুরু হবার ৪২৭ বছর আগে (খ্রিস্টপূর্ব) স্ব-নির্ধারিত উপোসের মাধ্যমে দেহত্যাগ করার সময়, যখন তার বয়স সত্তর, তার প্রায় চৌদ্দ হাজার সন্ন্যাসী আর ছত্রিশ হাজার সন্ন্যাসিনী অনুসারী ছিলেন। জৈনধর্মে সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীরাই মূল খেলোয়াড়। তারা নিজেদেরকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে তোলেন যেন বর্তমান জীবদ্দশাতেই নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যে তাদের আত্মা নির্ভার হয়ে ওঠে। তারাই মহাবীরের অহিংসা আর সব জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন-সংক্রান্ত উপদেশগুলো একত্র করে সংকলিত করেছিলেন, এটাই তাদের পবিত্র গ্রন্থ আগম।
অধিকাংশ ধর্মই যখন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, সেটি নানা উপদলে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। যেখানে প্রতিটি উপদলই মূল নবী বা শিক্ষকের প্রদর্শিত সত্যিকার সংস্করণটিকে অনুসরণ করছেন বলে দাবি করে থাকেন। জৈনধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি দুটি গোষ্ঠীতে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে পার্থক্য মৃদু এবং আসলেই বেশ সামান্য। একটি গোষ্ঠী, যারা নিজেদের বলেন ‘দিগম্বর’ (আকাশই যার পরনের কাপড়), তারা দাবি করতেন, সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীদের কোনো কাপড়ই পরা উচিত নয়। অন্যদিকে আরেকটি গোষ্ঠী, শ্বেতাম্বর, শুধুমাত্র সাদা কাপড় পরার অনুমতি দেয়।
এর সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী ছাড়াও ভারতে এখনো জৈনধর্মের কয়েক মিলিয়ন অনুসারী আছেন। যদিও এর সন্ন্যাসী আর সন্নাসিনীরা মূল খেলোয়াড়, এর সাধারণ সদস্যরা সমাজে তাদের অবস্থান যতটুকু অনুমতি দেয় ততটাই সাধারণ জীবন যাপন করেন। একটি জীবনের সংগ্রামের মাধ্যমে তারা ছাব্বিশতম স্বর্গে পৌঁছানোর আশা করেন না। কিন্তু তারা আশা করেন যে, বর্তমান জীবনের অহিংস নম্রতা পরের জন্মে তাদের জন্যে একটি সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীর জীবন নিশ্চিত করবে, এবং সেই জীবনের পর তারা অবশেষে নির্বাণে পৌঁছাতে পারবেন।
জৈনধর্মের প্রকৃতির জন্যই, এটি কখনোই একটি গণমানুষের ধর্মে পরিণত হয়নি। কিন্তু এটি প্রভাবশালী ছিল। এবং এটি একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও কঠোর আচার-অনুশীলন করার বিষয়টি এমনিতেই শুধুমাত্র সংখ্যালঘু কিছু মানুষের মনে দাগ কাটতে পারে ঠিকই, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতে এটি প্রভাব ফেলতে পারে, যা এর দৃষ্টিভঙ্গিকে মৃদুতর করে তোলে। সব জীবনের চূড়ান্ত পবিত্রতা-সংক্রান্ত জৈনদর্শনটি নানারূপে ভেজিটারিয়ান বা নিরামিষাশী খাদ্য আন্দোলনে এর অবদান রেখেছে এবং এর অহিংস মতবাদ রাজনীতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল। এটি মহাত্মা গান্ধীকে প্রভাবিত করেছিল, বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে যে আইনজীবী ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এটি প্রভাবিত করেছিল মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকেও, খ্রিস্টীয় যে যাজক যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক-অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধাংশে।
জৈনধর্ম এখনো আমাদের সামনে সেই সত্যটিকে উন্মোচন করা অব্যাহত রেখেছে, তৃষ্ণাই বেশিরভাগ মানব-দুঃখের মূল কারণ এবং শুধুমাত্র তৃষ্ণাগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যেই আছে আমাদের সুখ এবং সন্তুষ্টি। আমাদের মধ্যে খুব সামান্য কয়েকজনই হয়তো দিগম্বর হতে চাইবেন বা উপোস করে আত্মহত্যা করতে চাইবেন, কিন্তু যারা এই কাজ করেন, তাদের কথা স্মরণ করলে হয়তো আমরা খানিকটা সাধারণ জীবন কাটাতে অনুপ্রাণিত হতে পারি।
এই বইয়ের শুরুতে আমি উল্লেখ করেছিলাম, কঠোরভাবে সময়ের ধারাবাহিকতা মেনে চলার বিষয়টি খুব কঠিন হবে যখন বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাবের ইতিহাসের পথটি আমরা অনুসরণ করব। এর কারণ এই গল্পে সময়ের মতো স্থানও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস ঘটেছিল ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়। সুতরাং ইতিহাসের মধ্যেই আমাদের আঁকাবাঁকা পথেই অগ্রসর হতে হবে। এই কারণে পরের অধ্যায়ে আমরা আর্যদের ভারত-প্রবেশের কয়েকশত বছর পরের একটি সময়ে যাব, তবে পশ্চিমের একটি জায়গায়, ধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন সম্বন্ধে জানতে। এই রহস্যময় চরিত্রটির নাম ছিল আব্রাহাম।