০৬. কোথাও কোনও শব্দ নেই

ছয়

কোথাও কোনও শব্দ নেই। এমন নির্জন রাত্রে জ্যোৎস্নার দিকে তাকালেও ভয় ঢোকে মনে। জ্যোৎস্না বলেই গাছের ছায়া ফেলে। আর সেই ছায়ায় ওত পেতে থাকতে পারে মৃত্যু। কিন্তু সোম তো এখানে এসেছে প্রাণের ভয়েই।

সি-পিকে সে আজ প্রথম দেখছে না। কাউকে বাগে পেলে শেষ করে না দেওয়া পর্যন্ত লোকটা সুখ পায় না। টাকার লোভে সে যখন ফেঁসে গেল তখনই কেন সি-পি তাকে কোট মার্শাল করল না তা মাথায় ঢুকছে না। উল্টে সময় দিয়ে বলেছিল সেই খবর নিয়ে যাওয়া লোকটাকে খুঁজে বের করতে। চিতা নয়, তার ফেউকে খোঁজার দায়িত্ব তার ওপর। অত্যন্ত অপমানকর ব্যাপার। তবু ওই লোকটার সামনে থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েই সে বেরিয়ে পড়েছিল বলে রক্ষে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে হুকুম পাল্টে তাকে গ্রেপ্তার করার আদেশ জারি হল। এত জলদি মত বদলানো সি-পি-র স্বভাব নয়। চাপ এসেছে নির্ঘাত। তার মানে এখন সোমকে লড়তে হবে অনেকের সঙ্গে। আর ধরা পড়লে সারাজীবন কাটবে পাতালঘরে।।

বিপদের গন্ধ পেয়েই সোম বেরিয়ে পড়েছে রিভলভার আর গাড়িটাকে নিয়ে। তার একমাত্র বাঁচার পথ হল চিতাকে ধরে নিয়ে যাওয়া। সি-পি অথবা মিনিস্টার খুশি না হয়ে পারবে না। সোম জানে এটা হাতের মোয়া নয়, কিন্তু পথ ওই একটাই। কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করতেই এই বাংলোটার কথা মনে এসেছিল। দিন সাতেক আগে গোপনসূত্রে খবর পেয়ে তল্লাসি চালিয়েছিল সোম বিশেষ বাহিনী দিয়ে। কিছুই পাওয়া যায়নি, বাংলোর মালিক বিদেশে। কেয়ারটেকার বলেছে কেউ এখানে আশ্রয় নেয়নি। সোমের বিশ্বাস লোকটা সত্যি কথা বলেনি। কিন্তু চাপ দিতে পারেনি সে। মাঝে মধ্যে ম্যাডাম এই বাংলোয় বিশ্রাম নিতে আসেন। তখন বিশেষ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। কিছু না পাওয়া যাওয়ায় সি-পি খুব খুশি হয়েছিলেন। খোদ ম্যাডাম যেখানে বেড়াতে গিয়ে থাকেন সেখানে উগ্রপন্থীরা আশ্রয় নেবে এটা নাকি উদ্ভট কল্পনা। সোমের সন্দেহ থাকলেও চুপ করে যেতে হয়েছিল।

এখন তাঁর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। হাতে সময় নেই। ধরা পড়লে সি-পি তাকে ছিঁড়ে খাবে। সন্দেহ দূর করতে তাই এই বাংলো দিয়েই খোজ শুরু করা যাক। কী দুর্মতি না তার হয়েছিল, নইলে খবর নিয়ে আসা লোকটাকে তুলে নিয়ে চাঁদি হিলসে গেলে সে আজ বাদে কাল সি-পি হয়ে যেতে পারত।

চাঁদের গায়ে মেঘ জমছে। রিভলভারটা মুঠোয় নিয়ে সোম সিঁড়ি ভাঙল। সামনের দরজায় তালা বন্ধ। তার মানে এখন বাংলোয় কেউ নেই। কেয়ারটেকারটার তো থাকার কথা। বাংলো ছেড়ে চলে যাওয়াটা তো অস্বাভাবিক ব্যাপার। লোকটা বলেছিল দিনের বেলায় বিশেষ প্রয়োজন হলে সে বাইরে যায়। এই তালাটা লোক দেখানো নয় তো! সোমের মাথায় চিন্তা কিলবিল করছিল। কয়েক পা হাঁটতেই তার চোখে পড়ল ওদিকের একটা দরজা হাট করে খোলা। দীর্ঘকাল পুলিশে চাকরি করায় সোমের অনুমানশক্তি এখন প্রবল হয়ে উঠল। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না সে স্থির করতে পারছিল না। দরজার সামনে পৌঁছাতেই তার নাকে গন্ধটা পৌঁছাল। ভেতরে কেউ মরেছে। যে মেরেছে সে ওই দরজা খুলে রেখে পালিয়েছে। এরকম তীব্র গন্ধ নাকে নিয়ে কোনও জীবিত ব্যক্তি বাংলোয় বসে থাকতে পারে না। তার মনে হল যে মরেছে সে যে একটা মানুষ তা দেখা দরকার। এমন তো হতে পারে কুখ্যাত চিতাকেই কেউ খুন করে এখানে রেখে গিয়েছে।

বুনো ঝোপের আড়ালে গাড়ির ভেতর বসে ওরা দেখল লোকটা রিভলভার উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। স্বজনের প্রথমে মনে হয়েছিল এই লোকটা বাংলোর মালিক হতে পারে, পরে ওর চালচলন এবং রিভলভার দেখে ধারনাটা পাল্টেছে। খুনি নাকি খুনের জায়গায় একবার ফিরে আসে। এই লোকটাও তাই ফিরে এসেছে। রিভলভার উঁচিয়ে যেভাবে ঘরে ঢুকে গেল তাতে মোটেই শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক ভাবার কারণ নেই।

এই সময় পৃথা বলল, ‘খুনি ফিরে এসেছে।’

‘হুঁ। আস্তে কথা বলো।’

‘ও যদি আমাদের দেখতে পায় তাহলে শেষ করে দেবে। প্রথমে চিতা, বাইসন, ডেডবডি আবার খুনি। আমার নার্ভ আর সহ্য করতে পারছে না।’

‘বুঝতে পারছি। কিন্তু লোকটা যদি আজ রাত্রে না বের হয়, আলো ফুটলেই আমাদের দেখতে পাবে। কিছু একটা করা উচিত।’

‘কি করবে? ওর হাতে রিভলভার আছে।’

হঠাৎ স্বজনের মাথায় মতলবটা এল। লোকটা খুনি হোক বা না হোক মাটির নীচের ঘরে নিশ্চয়ই একবার যাবে। খুনি হলে নিজের চোখকে খুশি করতে আর না হলে গন্ধটা কোথেকে আসছে তা দেখার জন্যে তার মতন নীচে নামবে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলে যদি ওপরের দরজাটা বন্ধ করা যায় তাহলে— । কিন্তু লোকটা কখন নীচে নামছে তা এই এতদূর থেকে বোঝা যাবে কি করে? যদি নীচে না গিয়ে বাইরের ঘরে বসে থাকে! স্বজন নড়তে পারল না। এই মুহূর্তে গাড়িতে বসে থাকাটাই নিরাপদ।

ঘরে আলো জ্বলছে না, সোম সুইচ থেকে হাত সরিয়ে নিল। পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে সে চারপাশে বোলাল। এটা বেডরুম। এখানে একটু আগেও লোক ছিল নইলে বেডকভারটা ওভাবে পড়ে থাকতে পারে না। সে বিছানার ওপর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখতে পেল। চাপা গলায় সোম জিজ্ঞাসা করল, ‘বাংলোয় কেউ আছে? সাড়া না দিলে গুলি খেতে হতে পারে।’

নিজের কানেই শব্দগুলো অন্যরকম শোনাল। সোম মনে মনে নিশ্চিত, এই বাংলোটা খালি, তবে কেউ একটু আগে ছিল। একটু আগে যে কতটা আগে তা সে ঠাওর করতে পারছিল না। পাশের ঘরে ঢুকে সে আরও নিঃসন্দেহ হল। ফ্রিজ খুলে তখনও ঠান্ডা টের পেল। গন্ধটা কি তাহলে পচামানুষের নয়? কাউকে খুন করে পচিয়ে একসঙ্গে কোনও মানুষ থাকতে পারে? গন্ধের উৎস সন্ধান করতে করতে সোম নীচে যাওয়ার সিঁড়ির মুখটায় পৌঁছে গেল।

কাঠের সিড়ি। শব্দটা যতটা কম করলে নয় ততটাই করল সোম। এবং এক সময়ে কফিনের ভেতরে শুয়ে থাকা মৃতদেহটিকে আবিষ্কার করল সে। পুলিশ হিসেবে সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু কম ভীত হল। মৃত ব্যক্তিটির মুখে আলো ফেলামাত্র সে চমকে উঠল। এই লোকটিকে তার না চেনার কোনও কারণ নেই। সি-পি-র সঙ্গে বিশেষ রকমের জানাশোনা। কদিন এই কফিনে শুয়ে আছে কে জানে কিন্তু শরীরে বিকৃতি এসে গেছে। কফিনের ঢাকনা তুলে বিস্ময়ে দাঁড়িয়েছিল সোম হঠাৎ শব্দ কানে আসতেই আলোটাকে সরাল। গোটা কয়েক ধেড়ে ইঁদুর লাফিয়ে ঢুকে পড়েছে কফিনের মধ্যে। তাড়াতাড়ি ঢাকনাটা নামিয়ে দিয়ে সে ভেবে পাচ্ছিল না ইঁদুরগুলোকে ভেতর থেকে কিভাবে বের করে দেবে! বাবু বসস্তাললের শরীরের সঙ্গে ইঁদুরগুলোকে রেখে এসেছে জানলে সি-পি তাকে দ্বিতীয়বার কোর্ট মার্শালে ঝুলিয়ে দেবেন। তাও না হয় হল, কিন্তু লোকটার কতটা ক্ষতি করতে পারে। এখন কামড়লাওে লাগবে না, অসুখবিসুখ করবে না। হ্যাঁ, ইদুরগুলো বাবু বসন্তলালের শরীরের কিছুটা অংশ খেয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু তার আগেই সোম তো পুলিশে খবর দিয়ে দিতে পারে। মৃতদেহের আনাচ কানাচ থেকে ইঁদুর খুঁজে তাড়িয়ে দেওয়ার থেকে সেটা অনেক সহজ।

ওপরে উঠে এল সোম। বাইরের বারান্দায় পা রেখে সে চারপাশে তাকাল। জ্যোৎস্নার দিকে তাকাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। এখানে এসেছিল চিতা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনও খবর পাবে বলে, তার বদলে দেখতে পেল বাবু বসন্তলালের শরীর। বোঝাই যাচ্ছে ফোর্স যখন এখানে তল্লাসি করতে এসেছিল তখন মৃতদেহটা ছিল না। অর্থাৎ সাতদিন আগেও বাবু বসন্তলাল বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কোথায় ছিলেন? তিনি শহরে এলে হইচই পড়ে যায়। সি-পি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তোষামোদ করতে। মিনিস্টার পার্টি দেন আর ম্যাডাম! ম্যাডাম ওঁর জন্যে সব কিছু করতে পারেন। এই বাংলোয় মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্যে যে ম্যাডাম আসেন তা বাবু বসন্তলালের বাংলো বলেই। বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ যাঁর হাত ধরে দেশে ঢোকে সেই মানুষটা এখন কয়েকটা ইঁদুর নিয়ে মাটির তলার ঘরে একটা কফিনের মধ্যে শুয়ে শুয়ে পচছে।

হঠাৎ সোমের খেয়াল হল, এই বাংলোয় টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন? এখানে? শব্দটা খুবই আস্তে কিন্তু নির্জন বাংলোয় সেটা শোনার পক্ষে যথেষ্ট। ইস, এইটেই এতক্ষণ মাথায় ছিল না। সোম ছুটল। যেখানে ম্যাডাম বিশ্রাম নিতে আসেন সেখানে টেলিফোন না থেকে পারে? যাক, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।

অন্ধকার ঘরে শব্দ শুনে টেলিফোনের কাছে পৌঁছে গেল সোম। খপ করে রিসিভার তুলে চিৎকার করল, ‘হ্যালো! হ্যালো!’

ওপাশের মানুষটি যেন কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর কাটা কাটা স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে কথা বলছ?’

কে? নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে থমকে গেল সোম। খবরটা সি-পির কাছে পৌঁছে গেলে এখান থেকে আর বের হতে হবে না।

‘হ্যালো। কথা বলছ?’

গলার স্বর যতখানি সম্ভব অশিক্ষিত করে সোম জবাব দিল, ‘আমি এখানে থাকি।’

‘ওখানে তো কারও থাকার কথা নয়। নাম কি তোমার?’

‘আপনি কে বলছেন?’

প্রশ্নটা করা মাত্রই লাইনটা কেটে গেল। সোম পুলিশি অভ্যেসে চটপট অপারেটারকে চাইল, ‘হ্যালো, অপারেটার, বাবু বসন্তলালের বাংলো থেকে বলছি। একটু আগে এখানে কোত্থেকে ফোন করা হয়েছিল?’

অপারেটার সময় নিল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কে বলছেন?’

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘আমি অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার সোম বলছি।’

‘সরি স্যার, আমি বুঝতে পারিনি। টেলিফোনটা আপনার হেড কোয়াটাস থেকেই করা হয়েছিল। আপনি কথা বলবেন?’ অপারেটারের গলা খুবই বিনীত।

‘না, থ্যাঙ্কু।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল সোম। যাচ্চলে। লোকটা নিশ্চয়ই সন্দেহ করেছে। করে টেলিফোনে একটা উড়ো সুযোগ নিয়েছে তাকে ধরার। গলাটা যে পুলিশ কমিশনারের নয় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছে। সোম দিব্য চোখে দেখতে পেল সেই ছোটখাটো অফিসার ছুটতে ছুটতে পুলিশ কমিশনারকে খবর দিতে যাচ্ছে, স্যার, স্যার, এ সি সোমকে পেয়েছি ওই বাংলোয়। আর সেটা শুনে গোমড়ামুখো ভার্গিস বলছে, ‘লোকটা আর এ সি নয় মূর্খ। ওকে এখনই অ্যারেস্ট করো।’

অতএব এখনই এখানে ফোর্স এসে যাবে। ওরা এলে বাবু বসন্তলালের মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে যা করার তা করবে কিন্তু তার আগেই ওকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। সোম বাইরে বেরিয়ে এল। চাঁদ এখন প্রায় মেঘের আড়ালে। কোথায় যাওয়া যায়? পুলিশের গাড়ি নিয়ে বেশিদূরে গিয়েও কোনও লাভ নেই। ওই গাড়ির জন্যেই তাড়াতাড়ি ধরা পড়তে হবে। আবার গাড়ি ছাড়া এই রকম পাহাড়ি অঞ্চলে বেশিদূর পর্যন্ত যাওয়াও সম্ভব নয়। অন্তত নীচের রাস্তা পর্যন্ত তো যাওয়া যাক, ওরা আসার আগেই এই জায়গা ছাড়া উচিত। সে গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই আচমকা কাছাকাছি গাড়ির হর্ন বেজে উঠেই থেমে গেল। প্রচণ্ড চমকে গেল সোম। তাড়াতাড়ি রিভলভার হাতে সতর্ক ভঙ্গিতে দাঁড়াল। ওরা এর মধেই এসে গেল! ইম্পসিবে্‌ল। অবশ্য এমনও হতে পারে আগে ফোর্স পাঠিয়ে পরে ফোন করিয়েছে সি-পি। ধরা পড়লে নিস্তার নেই। গাড়ি আসার পথের দিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে পিছু হটতে লাগল সে। কোনমতে ওই ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়লে এখান থেকে সরে পড়া অসম্ভব হবে না।

পাশ ফিরতে গিয়ে কনুই-এর চাপ লাগায় হর্ন বেজে উঠেছিল। আঁতকে ফিরে তাকিয়েছিল পৃথা, স্বজনের মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করা হয়ে গেল। পৃথা চাপা গলায় বলল, ‘কি হবে এখন?’

মনে মনে হাজারবার সরি বললেও কিছুই বলা হবে না। কিন্তু ওরা অবাক হয়ে দেখল যাকে এতক্ষণ খুনি বলে মনে হচ্ছিল সেই লোকটা নির্ঘাত ভয় পেয়েছে। পায়ে পায়ে পিছিয়ে আসছে এদিকেই। আর একটু এলেই তাদের দেখতে পেয়ে যাবে লোকট, পিছন ফিরলেই। স্বজন বুঝতে পারল না হর্ন এদিকে বাজা সত্ত্বেও লোকটা উল্টোদিকে তাকাচ্ছে কেন? কিন্তু এভাবে গাড়ির মধ্যে বসে থেকে লোকটার মুখোমুখি হওয়ার কোনও মানে হয় না। সে পৃথাকে চাপা গলায় বলল, ‘চলো নামি। ধরা পড়তেই হবে।’

‘ধরা পড়ব বলছ কেন? আমরা কি কিছু করেছি?’ পৃথা প্রতিবাদ করল।

সঙ্গে সঙ্গে সোমকে অবাক হয়ে এদিকে তাকাতে দেখা গেল। মানুষের গলার স্বর স্পষ্ট তার কানে পৌঁছেছে। এবং সেটা তার পেছনের বুনো ঝোপ থেকে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ তাকে ঘিরে ফেলেছে ওরা।

সোম খুব নার্ভাস গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কে, কে ওখানে?’

স্বজন পৃথার দিকে তাকাল। লোকটার চেহারার মধ্যে রুক্ষত থাকলেও গলার স্বরে, হাবভাবে সেটা একদম নেই। সে গলা তুলল, ‘রিভলভারটা ফেলে দিন।’

সোম বুঝল তার সন্দেহ মিথ্যে নয়। এখন বীরত্ব দেখানো মানে বোকামি করা, সেটা তার চেয়ে বেশি কে জানে। সে রিভলভার মাটিতে ফেলে দিতেই স্বজন ঝোপের আড়াল থেকে হুকুম করল, ‘গুনে গুনে আট পা পিছিয়ে যান।’

অগত্যা সোম আদেশ পালন করল। তাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল।

পৃথা অবাক হয়ে দেখছিল। এবার বলল, ‘লোকটা খুনি নয়।’

দরজা খুলে বের হচ্ছিল স্বজন, ‘কেন?’

‘খুনিরা এমন সুবোধ হয় না।’

স্বজন কোনও কথা না বলে একদৌড়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়ে থাকা রিভলভারটা তুলে নিয়ে সোমের দিকে তাকাল।

জীবনে এত বিস্মিত সোম কখনই হয়নি। স্বজনকে ভাল করে বোঝার আগেই সে দেখল এক সুন্দরী তরুণী ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে। এরা কখনই পুলিশ নয়। কোনও বাহিনী তাকে ঘিরে ধরেনি, মাত্র দুটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে বোকা বানিয়েছে দেখে সে নিজের ওপর এমন রেগে গেল যে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ধ্যাত!’

রিভলভার হাতে স্বজন হকচকিয়ে গেল, ‘কি হল?’

‘তোমরা কারা?’ সোম প্রশ্ন করার সময়ে ভাবল লাফিয়ে পড়বে কিনা।

‘ভদ্রভাবে কথা বলুন। আমাদের তুমি বলার কোনও অধিকার আপনার নেই।’

‘সরি। আসলে পুলিশে চাকরি করে করে— !’ সোম থিতিয়ে গেল।

‘আপনি পুলিশ?’ স্বজন অবাক।

‘হ্যাঁ, আজ বিকেল পর্যন্ত ছিলাম। আপনারা এখানে কি করছেন।’

স্বজন পৃথার দিকে তাকাল। মেয়েরা মানুষ চেনে হয়তো, এই লোকটা খুনি নাও হতে পারে। সে বলল, ‘আমরা শহরে যাচ্ছিলাম। এখানে আমাদের গাড়ির তেল ফুরিয়ে যায়। একটা চিতা আমাদের আক্রমণ করে। ফলে বাধ্য হয়ে এই জায়গায় আটকে আছি।’

‘ব্যাপারটা যদি গল্প হয় তাহলে আপনাদের কপালে দুঃখ আছে।’ বেশ পুলিশি গলায় ঘোষণা করল সোম।

‘আমি একজন ডাক্তার।’

‘আচ্ছা। গাড়িটা কোথায়?

স্বজন বুনো ঝোপটাকে দেখাল। সোম বুঝতে পারছিল এদের থেকে ভয়ের কিছু নেই। তবু জিজ্ঞাসা করল, ‘বাংলোর ভেতরে গিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। ওখানে একটি মানুষ মরে পড়ে আছে।’

‘লোকটাকে চেনেন?’

‘কি করে চিনব? এই অঞ্চলে এর আগে আসিনি।’

‘কিন্তু ওই লোকটাকে খুনের অভিযোগে আপনাকে যদি ধরা হয়?’

‘টিকবে না। লোকটা মারা গিয়েছে তিনদিনের বেশি আগে। গত পরশুও আমি এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে অপারেশন করেছি।’

হঠাৎ সোমের খেয়াল হল। আর দেরি করা উচিত নয়। সি-পি যদি তাকে ধরার জন্যে ফোর্স পাঠিয়ে থাকে তাহলে—সে বলল, ‘রিভলভারটা দিন।’

স্বজন বলল, ‘আপনি কে তা না জেনে এটা দেব না।’

‘আমি পুলিশের অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার ছিলাম। ট্র্যাপে পড়ায় আজ থেকে আমার চাকরি নেই। যার জন্যে এই দুরবস্থা তাকে খুঁজতে এখানে এসেছিলাম। লোকটাকে খুঁজে বের করতে না পারলে আমাকে বিনা দোষে শাস্তি পেতে হবে। দিন রিভলভারটা, আমাকে এখান থেকে এখনই চলে যেতে হবে।’ হাত বাড়াল সোম। এই সময় পৃথা জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে খুঁজছেন আপনি?’

‘লোকে তাকেও চিতা বলে ডাকে। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা বদল করতে চায়। কিছুতেই তাকে ধরা যাচ্ছে না।’ সোম এগিয়ে এসে রিভলভারটা নিয়ে পৃথার দিকে তাকাল, ‘আপনারা স্বামীস্ত্রী?’

পৃথা বলল, ‘যদি নাও হই তাতে আপনার কি এসে যাচ্ছে।’

‘অ।’ নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে হঠাৎ থমকে গেল সোম। সোজা ফিরে গেল বুনো ঝোপের কাছে।’ এবার গাড়িটাকে দেখতে পেল। পুলিশের গাড়ি নিয়ে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু এটাকে তো ব্যবহার করা যেতে পারে। অবশ্য যে অবস্থায় গাছের গায়ে আটকে আছে—!

সে স্বজনকে ডাকল, ‘হাত লাগান, গড়িটাকে তুলি।’

ওরা গাড়িটাকে, হালকা গাড়ি বলেই, তুলতে পারল। নিজের গাড়ি থেকে একটা দড়ি নিয়ে এসে মারুতির সামনের অংশে বেঁধে বলল, ‘আপাতত এখান থেকে চলুন।’

স্বজন নিজের গাড়িতে বসল। পৃথা উঠতে যাচ্ছিল তার আগে কিন্তু সোম ডাকল, ‘ওখানে কষ্ট করে বসতে যাচ্ছেন কেন, এখানে চলে আসুন।’

পৃথা জবাব না দিয়ে মারুতিতেই বসল। সামনের গাড়ির টানে এবার মারুতি বাংলো ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বজন বলল, ‘লোকটা ডাকল, গেলেই পারতে।’

পৃথা বলল, ‘আশ্চর্য! লোকটাকে চিনি না, যা বলছে তা সত্যি কিনা কে জানে!’

গাড়িতে শব্দ হচ্ছে। দরজাগুলোর অবস্থা কাহিল। ওরা জঙ্গলের পথে উঠে এল। পেছনে গাড়ি বাঁধা থাকলে যে-গতিতে গাড়ি চালাতে হয় তার চেয়ে ঢের জোরে চলেছে সোম। লোকটা ভাঁওতাবাজ অথবা খুনি যাই হোক না কেন এই ভয়ঙ্কর বাংলো থেকে ওর কল্যাণে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে, এটাই সত্যি।

প্রাইভেট লেখা বোর্ড পার হয়ে নীচের পিচের রাস্তায় পড়ে সোমকে ডান দিকে বেঁকতে দেখল স্বজন। আশ্চর্য! ডানদিক কেন? ওদিকে তো সমতলে যাওয়ার পথ। তাদের উঠতে হবে বাঁদিক দিয়ে, ওপরে। সে হর্ন বাজাল লোকটাকে থামাবার জন্যে। কিন্তু সোম তা কানেই নিল না। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সামনের গাড়ি থেমে গেলে স্বজন ব্রেক চাপল। সোম নেমে এল গাড়ি থেকে। তার হাতে একটা সরু পাইপ। বলল, ‘আপনার গাড়ির চাবিটা দিন তো?’

‘কেন?’

‘পেট্রল ক্যাপটা খুলব। ওই গাড়ির পেট্রল এখানে চালান দেব।’ সোম হাসল, ‘পেট্রল পেটে পড়লেই তো ইনি চালু হবেন?’

‘হ্যাঁ তাই মনে হয়। কিন্তু পেট্রল ট্যাঙ্ক লিক্‌ হয়ে গিয়েছে আসার সময়।’

সোম মারুতিটাকে দেখল। নিজের গাড়ি থেকে কিছু যন্ত্রপাতি এবং সাবান বের করে মারুতির সিট সরিয়ে কাজে লেগে গেল। কিছুক্ষণ পরে সোম বলল, ‘মনে হয় ম্যানেজ করেছি, দেখা যাক।’

ওরা দেখল দুটো গাড়িকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে সোম খানিকটা মুখ দিয়ে টেনে এ গাড়ি থেকে ওই গাড়িতে পেট্রল যাওয়ার পথ তৈরি করে দিল।

স্বজন জিজ্ঞাসা করল, ‘কত তেল আছে আপনার গাড়িতে?’

‘সরকারি তেল, হিসেব করে তো কেউ খরচ করে না।’

‘দেখবেন আপনারটা না একদম খালি হয়ে যায়।’

‘খালি করার জন্যেই তো এই ব্যবস্থা’।

স্বজন প্রথমে কথাটার মানে বুঝতে পারেনি। তেল যখন আর এল না তখন সোম বলল, ‘দেখুন তো আপনার গাড়ি ঠিক আছে কিনা।’

স্বজন ইঞ্জিন চালু করে দেখল গাড়ি এত ঝড় সামলেও মোটামুটি ঠিকই আছে। এবার সোম তাকে ডাকল, ‘আমার নাম সোম। আপনার নামটা জানা হয়নি।’

‘আমি স্বজন আর ও পৃথা।’

‘বাঃ ভাল নাম। আপনারা আমার সঙ্গে হাত লাগিয়ে গাড়িটাকে ঠেলুন।’ সোম নিজের গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাল। ওরা গাড়িটাকে ঠেলতেই সেটা বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলল খাদের দিকে। সোম দাঁড়িয়ে পড়তেই স্বজন চিৎকার করল, ‘সর্বনাশ, আপনার গাড়ি তো খাদে পড়ে যাবে।’

সোম মাথা নাড়ল, ‘আমি তাই চাই।’

সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাকে নীচে চলে যেতে দেখল ওরা। অনেক নীচে গাছেদের মাথায় আছড়ে পড়তেই সোম ঘুরে দাঁড়াল, ‘আপনি আমার গাড়িতে ওঠেননি, আমাকে আপনাদের গাড়িতে উঠতে দিতেও কি আপনার আপত্তি আছে পৃথাদেবী?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *