০৬. কেনসিংটন গার্ডেনস

কেনসিংটন গার্ডেনস, হাইড পার্কের বাঁদিক দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে, তার নাম বেজওয়াটার বোড়। এজওয়ার রোড ও পার্ক লেনের মোড়ে মার্বেল আর্চকে স্পর্শ করতেই বেজওয়াটার। রোডের নাম হারিয়ে গেল, শুরু হলো অক্সফোর্ড স্ট্রিট।

সবুজের মেলার পাশের শান্ত বেজওয়াটার রোড নাম পাল্টাতেই চরিত্র হারিয়ে ফেলল। প্রাণ-চঞ্চল অক্সফোর্ড স্ট্রিট যেন মানুষের উন্মত্ত আকাক্ষার তীর্থক্ষেত্র। দুনিয়ার সবকিছু সম্পদ-সম্ভোগের প্রদর্শনী হচ্ছে এই অক্সফোর্ড স্ট্রিট পাড়া। অক্সফোর্ড স্ট্রিট, বেকার স্ট্রিট, নিউ বন্ড স্ট্রিট, রিজেন্ট স্ট্রিট, উইগমোর স্ট্রিট, টটেনহোম কোর্ট রোড, চারিং ক্রশ ও আশপাশে মানুষ গিজগিজ করছে। সীমাহীন লালসা নিয়ে বেড়াচ্ছে সবাই।

অক্সফোর্ড স্ট্রিট সোজা আরো এগিয়ে গেল। মানুষের ভিড় একটু পাতলা হলো। রাস্তার নামও পাল্টে গেল। এবার নিউ অক্সফোর্ড স্ট্রিট। এর পর আবার পরিচয় ও চরিত্র পাল্টে গেল

ওই একই রাস্তার। হলো হাই হোবন। আবার বদলে গেল। এবার শুধু হোবন।

রাস্তাটা ধনুকের মতো একটু ডান দিকে বেঁকে যেতেই আরো কতবার ওই একই রাস্তার পরিচয় ও চরিত্র পাল্টে গেল।

বেশ মজা লাগে তরুণের। কোনোদিন কাজকর্মের মাঝে সুযোগ পেলে অফিস থেকে বেরিয়ে স্ট্রান্ড রোড ধরে এগিয়ে যায় চারিং ক্রশ। তারপর যেদিকে খুশি চলে যায়। হারিয়ে যায় সর্বজনীন মহামেলায়। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে হাজির হয় টি সেন্টারে।

শুধু ক্লান্ত হয়ে নয়, মাঝে মাঝে ভুল করে, অন্যমনস্ক হয়েও তরুণ হাজির হয় টি সেন্টারে।

কাউন্টারের কাছে যাবার আগেই মিস বোস এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানান, আসুন, আসুন। এতদিন কোথায় ছিলেন?

তরুণ একটু হাসে, এক ঝলক দেখে নেয় মিস বোসের অশান্ত, অবাধ্য চুলগুলো আর ওই দুটো মিষ্টি চোখ। তারপর বলে, কোথায় আর যাব?

বন্দনা বোস বলে, আজও কি মানুষের শোভাযাত্রা দেখতে এদিকে এসেছেন?

যদি বলি আপনার কাছেই এসেছি।

রাশ-আওয়ার না হলেও তখনও বেশ কিছু কাস্টমার ছিলেন। তবুও বন্দনা হেসে উঠল। ভ্রূ দুটো টেনে উপরে উঠিয়ে বলল, ফর গডস সেক, এমন মিথ্যা বলবেন না।

যাকগে, ওসব বাজে কথা ছাড়ুন। চলুন আপনার বাড়ি যাই।

এক্ষুনি?

তবে কি? মিসেস অরোরাকে বলুন আমাকে মাছ রান্না করে খাওয়াবেন বলে…।

বন্দনা আবার একটু হেসেই চলে গেলেন মিসেস আরোয়ার কাছে।

দু-এক মিনিটের মধ্যেই ঘুরে এসে বললেন, আপনার বহিনী আপনাকে ডাকছেন।

হাইকমিশনের সবাইকেই মিসেস আরোরা একটু খাতির করেন। তবে তরুণকে উনি ভালোবাসেন। হাইকমিশনের আর কেউ ওঁকে বহিনজী বলেন না, উনিও আর কাউকে ভাইসাব। বলেন না। লন্ডন শহরে এসব সম্পর্ক দুর্লভ হলেও মনটা তো ভারতীয়।

কদাচিৎ কখনও কখনও তরুণ এদিকে এলে বন্দনার সঙ্গে দেখা করবেই। সেবার চার্চ হলে নববর্ষ উৎসব আলাপ হবার পর থেকেই দুজনের মধ্যে একটা বেশ মৈত্রীর ভাব জমে উঠেছে। বন্দনায় ওই চুল আর ওই চোখ দুটো দেখে তরুণের যে অনেক কথা মনে পড়ে, অনেক স্মৃতি ফিরে আসে। কিন্তু সেকথা একটি বারের জন্যও প্রকাশ করে না। তবে বন্দনা জানে, বোঝে, তরুণ তাকে পছন্দ করে, হয়তো একটু ভালোবাসে। সে পছন্দ বা ভালোবাসায় অবশ্য মালিন্যের স্পর্শ নেই। টি এক্সপোর্ট ব্যুরোর চেয়ারম্যানের মতো নোংরা চরিত্রের লোক তরুণ নয়, সেকথা বন্দনা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে।

বৃদ্ধ চেয়ারম্যানের কথা মনে হলে ঘেন্নায় বন্দনার সারা মন ঘিনঘিন করে ওঠে।

…বিশ্বের বাজারে ইন্ডিয়ান টি-র চাহিদা কমে যাচ্ছে। এককালে যেসব দেশে শুধু দার্জিলিং বা আসামের চা বিক্রি হতো, সেসব দেশের বাজারে সিংহল ও সাউথ আফ্রিকায় চায়ের বেশ চাহিদা হচ্ছে। লন্ডন চা নিলামের বাজারে কবছর আগেও ইউরোপ আমেরিকার কাস্টমাররা দার্জিলিং টি কেনার জন্য হুড়োমুড়ি করত। লন্ডন, নিউইয়র্ক, বার্লিন, জেনেভা, ব্রাসেলস, টারান্টা উরস্টার, জনারিওর বড় বড় রেস্তোরাঁয় কবছর আগেও ইন্ডিয়ান চা সার্ভ করে নিজেদের কৌলিন্য প্রচার করত। বড় বড় নিওনসাইনের বিজ্ঞাপন দিত, ফর বেস্ট ইন্ডিয়ান টি, ভিজিট…। কবছরের মধ্যে সব নিওনসাইনের আলো নিভে গেল।

কর্মবীর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ও তাদের প্রতিভাবান কমার্শিয়াল অ্যাটাচির দল এসব ব্যাপারে নজর দেবার তাগিদবোধ করলেন না। কলকাতা থেকে বেস্ট ইন্ডিয়ান টি-র স্যাম্পল প্যাকেট পেয়েই ওঁরা মহাখুশি রইলেন।

দু-চারটে খবরের কাগজের রিপোর্ট ও পার্লামেন্টে কিছু কোশ্চেন হবার পর কুম্ভকর্ণ ভারত সরকারের যখন নিদ্রাভঙ্গ হয়ে উদ্যোগ ভবনে নতুন ফাইলের জন্ম হলো, ততদিনে ওসব দেশের কয়েক কোটি মানুষের অভ্যাস পাল্টে গেছে। সাউথ আফ্রিকা ও সিংহল গঁাট হয়ে বসেছে লন্ডন টি অকানে।

রোগটা যখন ক্যান্সারের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন সর্বরোগবিনাশিনী বটিকা আবিষ্কারের প্রয়াসে এক ডেপুটি মন্ত্রী তিন সপ্তাহে নটি দেশ ভ্রমণ করে দিল্লি ফিরে গেলেন। এই ভ্রমণে রোগের কোনো সুরাহা হলো না বটে, তবে ডেপুটি মন্ত্রীর গাল দুটি কাশ্মীরী আপেলের মতো লাল হলো।

প্রথম প্রিলিমিনারী রিপোর্ট ও প্রেস কনফারেন্স হতে দেরি হলো না। মাস তিনেকের মধ্যেই মিনিস্টর-ডেপুটি মিনিস্টার-সেক্রেটারির মিটিং হলো। পরের চার মাসে সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারিদের নিয়ে দু-তিনবার মিটিং করলেন। এর পর দুজন ডেপুটি সেক্রেটারি ও একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি টি এক্সপোর্টার্সদের সমস্যা ও মতামত জানার জন্য বারকয়েক কলকাতা-দার্জির্লিং গৌহাটি-শিলং ঘুরে এলেন পরের ছ-সাত মাসের মধ্যেই। জয়েন্ট-সেক্রেটারি দার্জিলিং গিয়ে একটু গ্যাংটক ঘুরে আসায় তার মনে হলো পাঞ্জাবের বেড কভারের ডিমান্ড ওখানে বেশ ভালোই। দিল্লি ফিরে একটা রিপোর্টও দিলেন, বেড কভার বিক্রি হলে সিকিমের কমন ম্যান ভীষণ খুশি হবে ও ইন্ডিয়া-সিকিমের কালচারাল-সোস্যাল ইকনমিক্যাল সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।

কেরালার কোট্টায়াম জেলার অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি এই রিপোর্ট পড়েই বললেন, ডিড আই নট টেল ইউ যে ওখানে কেরালার কয়ার ম্যাটের ভীষণ ডিমান্ড আছে?

তাই নাকি?

তবে কি! সেবার শিলিগুড়ি এয়ারপোর্টে সিকিম প্যালেসের একজন হাই-অফিসারের সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় উনিই জানালেন কয়ার ম্যাটকার্পেটের ভালো ডিমান্ড হতে পারে সিকিমে।

কোয়াইট ন্যাচারাল।

তাই তো বলেছিলাম, আপনি একবার কেরালা ঘুরে আসুন। তারপর একটা কমপ্রিহেনসিভ রিপোর্ট দিন।

চায়ের সমস্যা চাপা পড়ল। জয়েন্ট সেক্রেটারি ছুটলেন কেরালা।

যাই হোক, এমনি করে আবার মন্ত্রী পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে চা রপ্তানি শিল্পের প্রায় নাভিশ্বাস হয়ে ওঠার উপক্রম হলো। সার্জিক্যাল অপারেশন করে অনতিবিলম্বে রোগ সারাবার জন্য মিঃ বহুগুণার নেতৃত্বে সাতজনের এক কমিটি নিয়োগ করে বলা হলো সরকারি পয়সায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে এসে চটপট রিপোর্ট দিন।

এই কমিটির শিরোমণি হয়েই বহুগুণা সাহেব লন্ডন এসেছিলেন। টি সেন্টারের ম্যানেজারের ঘরে হলো অফিস। অস্থায়ী আবাসস্থান হলো কাছেরই মাউন্ট রয়্যাল হোটেলে।

দু-চার দিন টি সেন্টারে আসার পরই বহুগুণা সাহেব বললেন, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মিসেস অরোরা, মিস বোস আমার কাজে একটু হেল্প করুন।

কথাটা বলতে না বলতেই আবার বললেন, অবশ্য যদি আপনার এখানকার কাজের কোনো ক্ষতি না হয়।

মিসেস আবোরা একজন সামান্য ম্যানেজার। চেয়ারম্যান বহুগুণা সাহেবের অনুরোধ উপেক্ষা করার কথা উনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। উনি দিল্লিতে না থাকলেও ভূতপূর্ব সেন্ট্রাল মিনিস্টার বহুগুণা সাহেবের ইনফ্লুয়েন্সের কথা ভালোভাবেই জানেন। চায়ের রফতানির বাজার স্টাডি করতে এলেও এয়ার ইন্ডিয়ার ম্যানেজার থেকে হাইকমিশনার পর্যন্ত ওঁকে নিয়ে মহাব্যস্ত। সুতরাং মিসেস অবোরা কৃতার্থ হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই। যদি আমাকে দরকার হয়, বলতে দ্বিধা করবেন না।

তোমাকে বহুগুণা সাহেবের দরকার নেই। তোমার বসন্ত বিদায় নিয়েছে। চৈত্র দিনের ঝরা পাতার বাজারে তোমাকে নিয়ে কি হবে।

না, না, আপনাকে আর বিরক্ত করতে চাই না। মিস বোস হলেই সাফিসিয়েন্ট।

অ্যাজ ইউ প্লিজ স্যার। উই আর অ্যাট ইওর ডিসপোজ্যাল।

মেনী থ্যাঙ্কস মিসেস অরোরা।

কয়েক দিন পর কমিটির অন্য সদস্যরা কন্টিনেন্টে চলে গেলেন।

বহুগুণা সাহেব একাই থেকে গেলেন লন্ডনে।

আমি তো এখন একাই কাজ করব। আমি আর কেন একলা টি সেন্টারে যাই? তুমিই না হয় হোটেলে চলে এসো।

চেয়ারম্যানের আদেশ শিরোধার্য করে নিল বন্দনা।

একদিন বেশ কেটে গেল।

পরদিন।

এখন থেকে রোজ সকালেই আমি কেনসিংটনে হাই-কমিশনারের বাড়ি যাব। তুমি বিকেলের দিকেই এসো।

অ্যাজ ইউ প্লিজ স্যার।

বন্দনা দরজা নক করার আগে একবার ঘড়িটা দেখে নিল। হ্যাঁ, চারটেই বাজে।

কাম ইন।

আমন্ত্রণ শুনে ঘরে যেতেই হাসিমুখে বহুগুণা সাহেব অভ্যর্থনা করলেন, এস, এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।

বন্দনা পাশের সোফাটায় বসে একটু মুচকি হেসে বললে, সো কাইভ অফ ইউ স্যার।

দেখ বন্দনা, অত ফরম্যাল হবে না।

বহুগুণা সাহেব বন্দনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে তুলে নিয়ে বললেন, আমার কাছে এত ফরম্যাল হবার দরকার নেই। বী ইনফরম্যাল, কমফর্টেবল।

এই বলে বন্দনাকে নিয়ে বড় সোফাটায় পাশে বসালেন। বলো কফির সঙ্গে কি খাবে?

থ্যাঙ্ক ইউ ভেরী মাচ। আমি এখন কিছু খাব না!

আবার ফর্মালিটি? ডান হাত দিয়ে বন্দনাকে একটু জড়িয়ে ধরে বললেন, বিলেতে থেকে একেবারে বিলেতী হয়ে গেছ? বলল কি খাবে?

ওনলি কফি স্যার।

তাই কি হয়?

টেলিফোন তুলেই ডায়াল করলেন, রুম সার্ভিস! প্লিজ সেন্ড টু প্লেটস অফ চিকেন স্যান্ডউইচ, সাম পেস্ট্রি অ্যান্ড কফি ফর টু।

বন্দনা ঈশান কোণে একটা ছোট্ট কালো মেঘ দেখতে পেল। মনের মধ্যে অনিশ্চিতের আশঙ্কা দোলা দিল। অনুমান করতে কষ্ট হলো না বহুগুণা সাহেবের অন্তরের ক্ষীণ আশা।

আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই বন্দনার। তাই যেন একটু মুচকি হাসল। লন্ডনে আসার প্রথম কয়েক মাসে এমনি কত বিপদের ইঙ্গিত দেখা দিয়েছিল! শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে। তাই তো কেমন যেন একটু বিদ্রুপের হাসি উঁকি দিল তার ঐ দুটো ঠোঁটের কোণে।

জান বন্দনা, এতবার তোমাদের এই বিলেতে এসেছি কিন্তু সব সময়ই কাজকর্ম নিয়ে এমন বিশ্রী ব্যস্ত থেকেছি যে কিছুই দেখা হয়নি।

তাই নাকি স্যার?

তবে কি! ব্রিটিশ মিউজিয়াম বা উইন্ডসর ক্যাসেল-এর পাশ দিয়ে গেছি হাজার বার কিন্তু ভিতরে যাবার সময়-সুযোগ হয়নি।

বন্দনা মনে মনে ভাবে, হোটেলের এই ঘরে মাঝে মাঝে তোমার আলিঙ্গন ও আদর উপভোগ করার চাইতে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ান অনেক ভালো।

আমিও যে সব কিছু দেখেছি তা নয়; তবুও চলুন না, সব কিছু দেখিয়ে দেব।

দ্যাটস লাইক এ ওয়ান্ডারফুল গার্ল, বলেই বহুগুণা ডান হাত দিয়ে বন্দনাকে একটু কাছে টেনে আদর করলেন।

বন্দনা লোহার মতো শক্ত হয়ে থাকে, নিজের বুকের পর দুটি হাত রেখে ছোটখাটো আক্রমণ প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করে।

আঃ! তুমি বড় রিজিড, বড় কনজারভেটিভ। এতদিন বিলেতে থাকার পরও একটু ফ্রিলি মিশতে পার না? তাছাড়া আমার মতো ওল্ডম্যানের কাছে লজ্জা কি?

না না, লজ্জা কি!

সকাল সাড়ে এগারটায় বাকিংহাম প্যালেসের সামনে একদল বাচ্চা ও টুরিস্টদের সঙ্গে বহুগুণা সাহেবকে চেঞ্জিং অফ দি গার্ড দেখাল। তারপর ন্যাশনাল গ্যালারি, ব্রিটিশ মিউজিয়াম।

বুঝলে বন্দনা, এ তো মিউজিয়াম নয়, একটা দুনিয়া। ভালোভাবে দেখতে হবে। আর একদিন আসব। চলো আজকে একটু রিজেন্ট পার্ক বা কেনসিংটন গার্ডেনে যাই।

সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই বহুগুণার আরো গুণ প্রকাশ পেল।

শুনেছি তোমাদের এই লন্ডনে ওয়ার্ল্ড ফেমাস নাইট ক্লাব আছে। কে যেন বলেছিল ফোর হানড্রেড ক্লাব, রিভার ক্লাব ও আরো কি কি সব নাইট ক্লাব আছে। কত বারই তো এলাম অথচ কিছুই দেখলাম না। তুমি আমাকে একটু নাইট ক্লাব ঘুরিয়ে দাও তো।

লন্ডনের নাইট ক্লাবগুলি যে পৃথিবীবিখ্যাত, তা, বন্দনা শুনেছে। কখনও দূর থেকে, কখনও পাশ দিয়ে যাবার সময় নাইট ক্লাবগুলোর নিওন সাইন দেখেছে। সেরকম বন্ধু ও অপব্যয় করার মতো টাকাকড়ি থাকলে হয়তো একদিন ভিতরে ঢুকে দেখত। সে সুযোগ ওর আসেনি। তবে শুনেছে সবকিছু। ও জানে যৌবনপসারিণীরা নাচে, দর্শকদের নাচায়। রাত যত গম্ভীর হয় সবাই তত বেশি আদিম হয়। যৌবন-পসারিণীদের দেহ থেকে ধীরে ধীরে পোশাকের ভার যত কমে আসে দর্শকরা তত বেশি মদির হয়, উন্মত্ত হয়, আরো কত কি!

বহুগুণার মতো বৃদ্ধকে নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত ফোরহানড্রেড ক্লাবে যাবার কথা ভাবতেও বন্দনার বিশ্রী লাগল। একবার ভাবল, মিসেস অরোরাকে বলে। তারপর মনে হলো, বহুগুণা সাহেবের এইসব গুণের কথা জানাজানি হলে ওকে নিয়েও নিশ্চয়ই সরস আলোচনা শুরু হবে। নিশ্চয়ই অনেকে অনেক কিছু ভাববে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এদিক-ওদিক সেদিক চিন্তা করে বন্দনা বলল, ঠিক আছে, আমি আপনার একটা রিজার্ভেশন করে দেব।

ইউ নটি গার্ল! আমাকে একলা একলা নেকড়ে বাঘের মুখে ঠেলে দিতে চাও?

বন্দনার হাসি পেল।

নাইট ক্লাবে গেলেন বহুগুণা সাহেব। মিস বন্দনা বোসকে পাশে নিয়ে উপভোগ করলেন যৌবন-পসারিণীদের নাচ। লাস্ট ফাইন্যাল সিনে লাইট অফ হয়ে গেলে মুহূর্তের জন্য আতিশয্যের আধিক্যে বন্দনার হাতটা চেপে ধরলেন। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।

বারোটা বাজার আগেই নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ফেরার পথে বেশ একটু নিবিড় হয়ে বসলেন।

জান বন্দনা, তোমাকে বলতে একেবারেই ভুলে গেছি। কাল সকালেই চারজন ব্রিটিশ অনার্স আসছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। হাইকমিশনের অফিস থেকে যে ব্রিফ দিয়েছে, তার বেসিসে তোমাকে আজ রাত্রেই একটা ছোট্ট নোট ঠিক করে দিতে হবে।

আজ রাত্রেই? বন্দনা চমকে ওঠে। নাইট ক্লাব থেকে ফেরার পর বহুগুণা সাহেবের সঙ্গে হোটেলে ওই কাজ করতে হবে? আমি বরং স্যার কাল ভোরে এসেই…।

কথা শেষ হবার আগেই বহুগুণ বাধা দিলেন, নট অ্যাট অল! আজ রাত্রেই ওটাকে রেডি করতে হবে।

হোটেলের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বহুগুণা সাহেব নিজে বন্দনার কোট খুলে দিলেন। মুহূর্তের জন্য একবার যেন কী ভীষণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আগুনের হল্কার মতো নিঃশ্বাস পড়ছে তার। চিড়িয়াখানার নেকড়ে বাঘও তখন ওঁকে দেখলে হয়তো ভয় পেত।

বহুগুণা সাহেব আরো এগিয়ে এলেন। বন্দনা একটু পিছিয়ে যেতেই বহুগুণা সাহেব দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, প্লিজ ডোন্ট ডিসিভ মি টু-নাইট।

বন্দনার মুখ দিয়ে একটি শব্দ বেরুল না। বহুগুণা সাহেব হঠাৎ আলোটা নিভিয়ে দিয়ে দানবের বেগে জড়িয়ে ধরলেন বন্দনাকে!

সঙ্গে সঙ্গে কে যেন দরজায় ঠক্ঠক্ করে নক করল।

ঘরে আলো জ্বলে উঠল। বন্দনা প্রায় কাঁপতে কাঁপতে পাশে সরে দাঁড়াল। বহুগুণা সাহেব একটু থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কাম ইন।

দরজা খুলে অপ্রত্যাশিত ভাবে তরুণ সেনগুপ্ত একটা গোলাপি কভার নিয়ে ঘরে ঢুকল, এক্সকিউজ মি স্যার! দিল্লি থেকে একটা আর্জেন্ট মেসেজ আছে। আজ রাত্রেই রিপ্লাই দিতে হবে।

আজ রাত্রেই?

ইয়েস স্যার।

একটা ব্রিটিশ নিউজ পেপারের রিপোর্টের ভিত্তিতে বহুগুণা সাহেবের কমিটি নিয়ে পার্লামেন্টে সর্ট নোটিশে কোশ্চেন টেবিল করেছেন আট-দশজন অপোজিশন এম-পি।

স্যার আমাদের হাই-কমিশনের একজন স্টাফকে সঙ্গে এনেছি। আপনি কাইন্ডলি ওকে আপনার রিপ্লাইটা ডিকটেট করে নিচে একটা সই করে দেবেন। উই উইল সেন্ড এ কেবল টু ডেলি!

এবার তরুণ বন্দনার দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হয়ত স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, এক্সকিউজ মি মিস বোস, চলুন আমাদের অফিস কারে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।

বন্দনা সেদিন মনে মনে কোটি কোটি প্রণাম জানিয়েছিল ভগবানকে। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল তরুণকে।

সেই থেকে তরুণের প্রতি বন্দনার একটা অদ্ভুত বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। হয়তো ভালোবাসে। বন্দনা বুঝতে পারে তরুণ যেন কি খুঁজে বেড়াচ্ছে সারা দুনিয়ায়। ওর মতো এক সাধারণ মেয়ের দুটি চোখের ছোট্ট দুটি তারার মধ্য দিয়ে বিরাট এক দুনিয়া দেখছে। যেন ক্যামেরার ছোট্ট লেন্সের মধ্য দিয়ে সুন্দর অরণ্য-পর্বতের ছবি ভোলা। ক্যামেরাম্যান প্রকৃতির ওই অনন্য সৌন্দর্যকে বন্দী। করতে চায়, উপভোগ করতে চায় সর্বক্ষণ। তাই তো সে ক্যামেরার লেন্সকে যত্ন করে, ভালোবাসে। বন্দনা জানে সে শুধু ক্যামেরার লেন্সমাত্র, অপরূপ প্রকৃতি নয়।

তবু তার ভালো লাগে, তবু সে খুশি। তরুণ মাছ খেতে চাইলে সে এক পাউন্ড-দেড় পাউন্ড খরচা করে মাছ কেনে, মাংস কিনে কত যত্ন করে রান্না করে।

গ্যাসে মাছটা চাপিয়ে দিয়ে কোণার সোফাটায় বসে বন্দনা প্রশ্ন করে, একটা কথা বলবেন?

নিশ্চয়ই।

আপনি কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন?

কাকে আবার!

আপনি জানেন আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি বিশ্বাস করি আপনি মিথ্যা কথা বলেন না।

না, না, মিথ্যা বলব কেন? খুঁজি না কাউকে। তবে মনে পড়ে যায় অনেক দিন আগেকার কথা, ছেলেবেলার কথা, ছাত্রজীবনের কথা।

একটু নিবিড় হয়ে মিশলেই বেশ বোঝা যায় তরুণ যেন কারুর ভালোবাসার কাঙাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই পৃথিবীতে থেকেও সে যেন এক মহাশূন্যে বিচরণ করছে। পুরুষের চোখে। ধুলো দেওয়া যায়, কিন্তু মেয়েদের? অসম্ভব।

তরুণের জীবনের, মনের দুঃখের ইঙ্গিত পাবার জন্য বন্দনা যেন ওকে আরো ভালোবাসে।

তরুণও ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে বন্দনাকে। কি নিদারুণ পরিশ্রম করে মেয়েটা কটা বছরে সারা পরিবারকে রক্ষা করল।

দুটি বছরে দুজনে কত কাছে এলো।

বন্দনা, এবার তো আমার যাবার পালা।

তোমার ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেছে?

হ্যাঁ।

বন্দনা যেন বাকশক্তিটাও হারিয়ে ফেলল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

তরুণ একটু কাছে টেনে নেয় বন্দনাকে। মাথায় হাত দিয়ে বলে, আমার একটা কথা শুনবে বন্দনা?

নিশ্চয়ই।

তুমি একটা বিয়ে কর।তরুণের দৃষ্টিটা ঘুরে আসে লন্ডনের মেঘলা আকাশের কোল থেকে। আমার খুব ইচ্ছা করে তোমার বিয়েতে আমি খুব হৈ-চৈ করি, খুব মজা করি, খুব মাতব্বরি করি।

আর একটা বছর। ছোট ভাইটা যাদবপুর থেকে বেরিয়ে যাক। তারপর তুমি একটা ছেলে ঠিক করে দিও, নিশ্চয়ই বিয়ে করব।

বন্দনার এমন সুন্দর আত্মসমর্পণে মুগ্ধ হয় তরুণ। এমন অধিকার কজন আধুনিকা দিতে পারে অপরিচিত ডিপ্লোম্যাটকে?

নিশ্চয়ই আমি ছেলে খুঁজে দেব। তবে বিলেতি বাঁদরদের সঙ্গে কিন্তু আমি বিয়ে দেব না!

বন্দনা শুধু মাথা নিচু করে হাসে।

দুদিন পরে হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে তরুণ বিদায় নিল। বন্দনা ওই এয়ারপোর্টের ভিড়ের মধ্যেই প্রণাম করে বলল, আমাকে কিন্তু ভুলে যেও না।

পাগলী মেয়ে কোথাকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *